পাথরের দেয়ালে পেরেক
আজ গেলে কাল কি হবে! এই চিন্তাই অহর্নিশ। ঘিনঘিনে চিন্তা—মশারির ভিতর মিনমিনে মশার মতো।
তাহলে তো তোমার হয়নি বাপু! রামকৃষ্ণের সন্তানদের তো এমন হওয়া উচিত নয়। বিশ্বাস, সমর্পণ দুটোতেই তোমার ঘাটতি আছে। তুমি মনে করছ, আমি তোমার কি করতে পারি! তোমার বিষয়জ্ঞান দিয়ে আমার কূলকিনারা পাবে না। তোমার ধারণা—আমি একটা ছবি, কিছু কথা, কিছু গল্প, কিছু গান। সেইটাই তোমার ভুল।
আমি একজন সাঁতার-শিক্ষক। সংসারসমুদ্রে কেমন করে সাঁতার কাটতে হয় সেই শিক্ষাটি আমি তোমাদের জন্য রেখে এসেছি। কোন্ ভেসলিন গায়ে মেখে জলে নামবে! কোন্ ডুবুরির পোশাক পরবে! কোন্ অক্সিজেনে শ্বাস নেবে! কখন ডুববে, কখন ভাসবে! মাঝে মাঝে ভুস করে ভেসে উঠে খানিক বাতাস নিয়ে আবার নাহয় ডুববে! সর্বক্ষণ চোখ কপালে তুলে বসে থাকার পরামর্শ আমি দিইনি। তোমরা গৃহে আছ, এটা, ওটা, সেটা নিয়ে থাকতে তো হবেই। কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে সামান্য কালি লাগবেই, বাবা! কামনা- বাসনাও থাকবে। সব ছাড়লাম বললেই সব ছাড়া হয় না। ওকথাটি বলো না, তাহলে তুমি যাও-বা একজন সহজ সরল মানুষ ছিলে, হয়ে যাবে ভণ্ড। ভণ্ডের কিছু হয় না, ভণ্ডামি ছাড়া। তার চেয়ে কিছু না করা যে অনেক ভাল। তিলক- সেবা করে মুহুর্মুহু বলবে-’হরি হরি’, আর মনের বাসনাটি হবে ‘হর হর’! এমন নাইবা হলে। এ ‘ক্যামোফ্লেজ’ তো ভয়ঙ্কর! লাউডগা সাপ। যেন সবুজ লতাটি, বাতাসে দোল খাচ্ছে ফুলের স্তবকে, আসলে সাপ। কেউ তো মাথার দিব্যি দিয়ে তোমাকে ‘ভগবান, ভগবান’ করতে বলেনি। তুমি তোমার অহঙ্কারের চেঙারিতে গুটিদার কোলা ব্যাঙটি হয়ে তোমার জ্ঞান গ্যাঙোর গ্যাঙোর করে উগরে যাও না! শ্রোতাও পাবে, বাহাদুরও বলবে কিছু লোকে। প্রবাদও তো আছে—”রতনে রতন চেনে!” ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু। লিখে রাখ স্ট্যাম্পপেপারে—এই তিন থাক মানুষের কোনদিনই জ্ঞান হবে না। তাদের অজ্ঞানটাই জ্ঞান। সেই তিনটে গ্রুপ কি? প্রথম- যাদের বাঁকা মন, সরল নয়। দ্বিতীয়—যারা শুচিবাই। তৃতীয়—যারা সংশয়াত্মা। এবার তুমি কোন্ স্তরে আছ দেখে নাও। যদি এই তিনের মধ্যে পড়ে থাক, তাহলে নিজের গাড়ি নিজেই ঠেল, আধ্যাত্মিক ইঞ্জিনের বাসনা করো না। আর করবেই বা কেন! মন তোমার ওদিকে যাবেই না। কিন্তু ঐ ইঞ্জিনটি বসাতে পারলে শুধু বিশ্বাসের পেট্রলেই গাড়ি গড়গড়িয়ে চলত। এই বিশ্বাসটা কে দেবে, সংস্কারে না থাকলে! যার বিদ্যার অহঙ্কার, যার পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার, যার ধনের অহঙ্কার তার জ্ঞান হয় না। এসব লোককে যদি বলা যায় যে, অমুক জায়গায় বেশ একটি সাধু আছে, দেখতে যাবে? তারা অমনি নানা ওজর করে বলে, যাব না। আর মনে মনে বলে, আমি এত বড় লোক, আমি যাব!
তোমার দুশ্চিন্তা কিসের! মাকে যদি ধরতে পারতে তাহলে বুক ঠুকে বলতে পারতে—রাজার ছেলের মাসোহারার ভয় নেই। কাম-কাঞ্চনকেই যদি জীবনের সার কর, তাহলে তোমার দহন কে ঠেকাবে বাপু! তিনটে গুণের কথা শুনেছ নিশ্চয়—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ। সত্ত্বগুণী হয়ে দেখ না কি হয়! সংসারীদের সত্ত্বগুণ কিরকম জান? বাড়িটি এখানে ভাঙা ওখানে ভাঙা—মেরামত করে না। ঠাকুরদালানে পায়রাগুলো নোংরা করছে, উঠোনে শেওলা পড়ছে। হুঁশ নেই! আসবাবগুলো পুরনো, ফিটফাট করার চেষ্টা নেই। কাপড় একখানা হলেই হলো। ছেলেদের পোশাকের জন্য ভাবে না, মান-সম্ভ্রমের জন্য ব্যস্ত হয় না। ঈশ্বরচিন্তা, দান-ধ্যান সব গোপনে-লোকে টের পায় না। মশারির ভিতর ধ্যান করে, লোকে ভাবে—বাবুর রাতে ঘুম হয়নি, তাই বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন। লোকটি খুব শান্ত, শিষ্ট, দয়ালু, অমায়িক; কারো কোন অনিষ্ট করে না। সত্ত্বগুণে অন্তর্মুখ হয়, আর গোপন। কিন্তু খুব লোক। ঈশ্বর-কথায় এত উল্লাস! রোজগার পেটচলা পর্যন্ত, কখনো লোকের তোষামোদ করে ধন নেয় না। সত্ত্বগুণ সিঁড়ির শেষ ধাপ, তারপরেই ছাদ। সত্ত্বগুণ এলেই ঈশ্বরলাভের আর দেরি হয় না—আরেকটু গেলেই তাঁকে পাবে।
সত্ত্বগুণে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়; রজঃ, তমোগুণে ঈশ্বর থেকে তফাত করে। সত্ত্বগুণকে সাদা রঙের সহিত উপমা দিয়েছে, রজোগুণকে লাল রঙের সঙ্গে আর তমোগুণকে কালো রঙের সঙ্গে।
এসব তাঁর কথা। আমাদের সমস্যা হলো, তাঁর সব কথাতেই যে ঈশ্বরের প্রসঙ্গ এসে পড়ছে। কী হবে! কে ঈশ্বর! আমরা তো ‘সেকুলার’। সেটাই বা কি, তাও তো জানি না। ঐ একটা কথাতেই সরকার সোজা হয়, সরকার চিৎপাত হয়। ঈশ্বর যিনিই হন আধুনিক জীবনের পক্ষে খুব ক্ষতিকর। ওসব ঝামেলায় নাই বা গেলাম ঠাকুর! ধ্যান-ধারণা, জপতপ, একজায়গায় স্থির হয়ে পাঁচটা মিনিটও যে বসা যায় না! বরং বেশ কিছু টাকা, একটা জবরদস্ত ফ্ল্যাট, মোটা মাইনের চাকরি, একটা চার চাকা। তোফা। সোফায় হেলেপড়ে টিভি দর্শন। সামান্য পরিচিতি, কিঞ্চিৎ দাপট। জীবনের এই মডেলটাই তো ফার্স্টক্লাস! নাঃ, তাই বা বলি কি করে! কোটিপতির দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক তো অনেক বেশি। এই বুঝি সব গেল! অনেক উঁচু থেকে পড়লে হাড়গোড় একেবারেই চুরমার
আবার তাঁর কথাতে ফিরে যাই।
চিলের ঠোঁটে মাছের কথা তো আগেই বলেছি। ঝাঁক ঝাঁক কাক ছিঁড়ে খেতে চায়। বুদ্ধিমান চিল মাছটা ফেলে দিলে। নির্ঝঞ্ঝাটে মন্দিরের চূড়ায় গিয়ে শান্তিতে বসল। চিল-গুরুর কাছে শিক্ষাটা নাও না! ভোগ বললেই যে দুর্ভোগ শব্দটা আসবে।
একটু উদ্যোগী হতে না পারলে, বৈষয়িক অবস্থা ফেরাতে না পারলে লোকে যে অপদার্থ, ম্যাদামারা বলবে। সবার আগে পরিবার-পরিজনই যে ছ্যা ছ্যা করবে।
তোমার রোগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে-ঘরে বিকারের রোগী, সেই ঘরে জলের জালা আর আচার তেঁতুল! যদি বিকারের রোগী আরাম করতে চাও, ঘর থেকে ঠাঁইনাড়া করতে হবে। সংসারী জীব বিকারের রোগী, বিষয় জলের জালা, বিষয়ভোগতৃষ্ণা—জলতৃষ্ণা। আচার তেঁতুল মনে করলেই মুখে জল সরে, কাছে আনতে হয় না—এরূপ জিনিসও ঘরে রয়েছে—বিষয়সঙ্গ। তাই নির্জনে চিকিৎসা দরকার।
একটা পাতকুয়ার ব্যাঙ কখনো পৃথিবী দেখেনি; তাই বিশ্বাস করবে না যে, একটা পৃথিবী আছে। বিষয়ীরা ভগবানের আনন্দের সন্ধান পায়নি। তাই ‘সংসার, সংসার’ করছে। ঈশ্বরের আনন্দ পেলে সংসার কাকবিষ্ঠা হয়ে যায়।
ঠাকুর! তাহলে কোথায় এসে দাঁড়ালাম?
তুমি কোথায় দাঁড়ালে তা তুমিই জান, তবে তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি কোথায় দাঁড়ালাম শোন—হাজার লেকচার দাও, বিষয়ীদের কিছু করতে পারবে না। পাথরের দেয়ালে কি পেরেক মারা যায়? পেরেকের মাথা ভেঙে যাবে তো দেয়ালের কিছু হবে না। তরোয়ালের চোপ মারলে কুমিরের কি হবে? সাধুর কমণ্ডলু চারধাম ঘুরে আসে, কিন্তু যেমন তেতো তেমনি তেতো থেকে যায়।
আমার অভিমানে বড় লাগল ঠাকুর!
তাহলে বলি শোন—বিষয় কি? ওতে আছে কি? টাকাকড়ি, মান, শরীরের সুখ—ওতে আছে কি?
“রামকো যো চিনা নাই, দিল চিনা হ্যায় সো কেয়া রে।
শান্ত ওহি হ্যায় যো রাম-রস চাখে।”
ঈশ্বরই বস্তু, আর সব অবস্তু। ঈশ্বরই সত্য আর সব দুদিনের জন্য।