1 of 2

পরাশর বর্মা ও ধাঁধানো ছবি – প্রেমেন্দ্র মিত্র

পরাশর বর্মা ও ধাঁধানো ছবি – প্রেমেন্দ্র মিত্র

শুক্রবার কাগজের কাজ-কর্ম দুপুরেই একরকম শেষ হয়ে যায়। এরপর যা দায় তা ছাপাখানার আর দপ্তরির। শেষ ফর্মাটায়, মানে কাগজের প্রথম ফর্মায়, প্রিন্ট অর্ডার দিয়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম আড়াইটে এখনও বাজেনি।

মনে হল, অনেকদিন ছবি-টবি দেখা হয়নি। গেলে হয়। ছবি দেখার সেরকম বাতিক আমার নেই। কিন্তু কলকাতায় দু-মাস ধরে নাকি এমন এক ছবি চলছে যা না দেখলে আর মান থাকে না।

চেনা-অচেনা যার সঙ্গে দেখা হোক, খানিক আলাপের পর এ-ছবির কথা উঠবেই।

দেখেছেন ছবিটা! —কেউ গদগদ উচ্ছ্বাসে।

কী যে রুচি হয়েছে আজকাল মানুষের! পয়সা দিয়ে ওই আজগুবি ছবি কেউ দ্যাখে! —যিনি ঘৃণায় নাক সেঁটকান, তিনিও অবশ্য পয়সা দিয়ে ছবিটা না দেখে পারেননি!

অর্থাৎ, ভালো লাগুক বা না লাগুক, এ-ছবি না দেখলে সভ্য-সমাজে নাম কাটা যাওয়ার ভয়।

টেবিলের ড্রয়ারে চাবি দিয়ে তাই ওঠবার উপক্রম করছি, এমন সময় ফোন বেজে উঠল।

ধরব না ভেবে দরজার দিকে দু-পা বাড়িয়েও চলে যেতে শেষপর্যন্ত বাধল। ফিরে এসে ফোন ধরতেই পরাশরের গলা।

—হ্যালো, কৃত্তিবাস! আছ তাহলে? এখুনি যাচ্ছি। একটা বিশেষ দরকার।

আমায় কথা বলবার কোনও সুযোগ না দিয়েই পরাশর ওধারে ফোনটা নামাল।

সত্যি কথা বলতে গেলে পরাশরের সঙ্গলাভের সম্ভাবনায় খুশির চেয়ে সন্ত্রস্তই হয়ে উঠলাম আপাতত। বিশেষ দরকার মানে তিন দিস্তে কবিতা নিশ্চয়। সিনেমায় যাওয়ার তো দফারফা, তার ওপর পরাশরী কবিতার ধাক্কা সামলাতে ক’টা অ্যাসপিরিন লাগবে কে জানে!

বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না। মিনিটদশেক বাদেই পরাশর এসে হাজির। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার হাতে কবিতার খাতা নয়, একটা খবরের কাগজ।

আজকাল সে খবরের কাগজেই কবিতা ছাপাচ্ছে নাকি? না, তাও নয়, লাল পেনসিলে দাগ দেওয়া কাগজের একটা বিজ্ঞাপন আমায় দেখিয়ে সে একটা জরুরি ব্যাপার আলোচনা করতে চায়।

কবিতার বদলে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন শুনে তখন আমার মেজাজ খোশ হয়ে সাহস বেড়েছে। খবরের কাগজটা মুড়ে পকেটে রেখে বললাম, তোমার সব কথা শুনতে আমি প্রস্তুত, কিন্তু তার আগে তোমায় সিনেমায় একটা ছবি দেখতে যেতে হবে আমার সঙ্গে।

ছবি! কী ছবি? —পরাশর সত্যি হতভম্ব।

তোমার পছন্দসই ছবি। —তাকে ভরসা দিলাম।

আমার পছন্দসই? কোনও কবি-টবির জীবনী? সেরকম কোনও ছবি কোথাও দেখাচ্ছে নাকি?

আরে না, কবির জীবনী হবে কেন? গোয়েন্দাগিরির রহস্য-রোমাঞ্চের ছবি।

পরাশর নাক সিঁটকে বললে, না, না, ওসব ছবি আবার মানুষে দ্যাখে!

হ্যাঁ, দ্যাখে। কলকাতার অর্ধেক মানুষ দেখেছে। তোমাকেও আজ আমার সঙ্গে যেতে হবে। তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়া অবধি অনেক জুলুম তোমার সয়েছি। আমার এ-অনুরোধ তোমায় রাখতেই হবে।

পরাশর আর আপত্তি করলে না। কিন্তু কুইনিন গেলার মতো যেরকম মুখ করে সিনেমা হলে গিয়ে বসল, তাতে মনে-মনে হাসিই পাচ্ছিল।

কয়েকটা ছোটখাটো সংবাদ-চিত্র ইত্যাদির পর একটু বিরতি। তারপর আসল ছবি আরম্ভ। ছবি তিন রিল কী বড়জোর চার রিল চলবার পরই হঠাৎ পাশে চেয়ে দেখি সিটে যতখানি সম্ভব হেলান দিয়ে পরাশর পরমানন্দে ঘুমোচ্ছে।

সত্যি, একটু রাগই হল। হতে পারে পরাশর মস্ত গোয়েন্দা, তা বলে এরকম একটা পয়লা নম্বরের ছবিতেও তার মন বসে না! আমি তো তখন সত্যি মশগুল হয়ে ছবির গোলকধাঁধায় নাজেহাল হচ্ছি। অত বড় গোয়েন্দাই যখন, তখন এ-ছবির আসল শয়তান কে, ধরবার চেষ্টা করুক না!

কনুইয়ের একটা খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তাকে সেই কথাই চাপা গলায় বললাম।

হুঁ! —বলে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে পরাশর ছবিটায় মনোযোগ দেওয়ারই চেষ্টা করলে বোধহয়। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! খানিক বাদেই আবার যথা পূর্বং।

এবার ঠেলা দিতে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে বললে, ছবি শেষ হয়ে গেছে নাকি?

ছবি এরই মধ্যে শেষ হবে কী হে! সবে তো অর্ধেক!

এখনও অর্ধেক!—হতাশভাবে সে আবার সিটে এলিয়ে পড়ে একটা কাগজে কী লিখে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললে, এটা রাখো। আর শেষ হলে আমায় জাগিয়ো।

তাই জাগাব!—বিরক্তভাবে বলে তার দেওয়া কাগজটা তাচ্ছিল্যভরে পকেটে রেখে দিলাম।

ছবিটা সত্যি তখন দারুণ জমে উঠেছে। তিনজনের ওপরই সমান সন্দেহ। মেয়েটি, তার বর্তমান প্রেমিক, আর তার মৃত স্বামীর কাগজপত্রসমেত ব্রিফকেস সমুদ্রতীরে যে কুড়িয়ে পেয়েছিল সেই লোকটি। মেয়েটির নাম মার্থা। বড় সম্ভ্রান্ত ধনীর ঘরের মেয়ে। নিজের সমাজ ছেড়ে ভালোবেসে এক বাউণ্ডুলে অভিনেতাকে বিয়ে করেছিল। চেষ্টা করেও স্বামীর স্বভাব শোধরাতে পারেনি, বিয়েও সুখের হয়নি। স্বামীর জুয়া আর বদখেয়ালের টাকা জোগাতে-জোগাতে হয়রান হয়ে একদিন খেপে যায়। আর এক কপর্দকও স্বামীকে দেবে না বলে জানিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ করবার প্রতিজ্ঞা করে। স্বামীর তখন মত্তাবস্থা। সে মার্থাকে মারধর করবার চেষ্টা করে। মার্থাকে ছেলেবেলা থেকে ভালোবাসলেও যে বিয়ে করতে পারেনি, সেই ইউজিন ছেলেটি সেখানে কী কারণে হঠাৎ এসে পড়েছিল। সে মার্থাকে স্বামীর হাত থেকে বাঁচায়। মার্থার স্বামীকে উত্তমমধ্যম কিছু দিয়ে বাড়ি থেকে বারও করে দেয়।

কিন্তু তারপর থেকেই মার্থার স্বামী একেবারে নিরুদ্দেশ। প্রায় মাসখানেক বাদে দূরের এক সমুদ্রতীরে তার একটি ব্যাগ একজন কুড়িয়ে পায়। ব্যাগটি পুলিশের হাতে যথারীতি দেওয়া হয় ও পুলিশ সেই ব্যাগে মার্থার স্বামীর হাতে লেখা সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যার সঙ্কল্পের চিঠি পায়।

ব্যাপারটা সেইখানেই চুকে যেত, কিন্তু কিছুদিন বাদেই মার্থার স্বামীর আত্মহত্যা সরকারিভাবে স্বীকার করবার খুঁটিনাটি সারতে গিয়ে পুলিশ ধরতে পারে যে, মার্থার স্বামীর আত্মহত্যার চিঠিটি জাল। মার্থার স্বামীর হাতের লেখা সুকৌশলে কেউ নকল করবার চেষ্টা করেছে। আত্মহত্যা না করে থাকলে মার্থার স্বামীর কী হয়েছে তাহলে? সন্ধান করতে জানা যায়, ইউজিনকে কিছুকাল আগেও ওই সমুদ্রতীরের একটি হোটেলে দেখা গেছল। মার্থাও কয়েকদিন বাদে সেই হোটেলে এসে উঠে দিন-দুই থেকে আবার চলে যায়। মার্থা ও ইউজিন অবশ্য পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে জানায় যে, হ্যারল্ডই বোঝাপড়া করতে ফোনে তাদের ডেকেছিল। হ্যারল্ডকে তারা অবশ্য পায়নি।

ব্যাপারটা আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে সমুদ্রতীরে যে-লোকটি মার্থার স্বামীর ফোলিও ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিল, তার ব্যবহারে। সে গোপনে একদিন মার্থার কাছে এসে একটি চিঠি দেখায়। চিঠিটি মার্থার স্বামী হ্যারল্ডেরই লেখা। লোকটি স্বীকার করে যে, হ্যারল্ডের ব্রিফকেসটি পুলিশের হাতে দেওয়ার সময় সে কিছু কাগজপত্র সরিয়ে রেখেছিল। চিঠিটা পড়ে বোঝা যায়, হ্যারল্ড সেটা মার্থার কাছেই লিখেছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত ডাকে আর কেন পাঠায়নি কে জানে। হয়তো সময় পায়নি। চিঠি ছোট, তাতে হ্যারল্ড সকাতরে মার্থা ও ইউজিনকে তাকে রেহাই দিতে অনুরোধ করেছে। লিখেছে, প্রতি মুহূর্তে এই ভয়ে-ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে বাঁচা আর তার সহ্য হচ্ছে না। মার্থা বিবাহবিচ্ছেদ করে ইউজিনকেই বিয়ে করুক, সে বাধা দেবে না। সে শুধু নিরাপদ শান্তি চায়। তার জন্য সে আমেরিকা ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতেও প্রস্তুত।

মার্থাকে চিঠি পড়ে স্তম্ভিত মনে হয়। সে প্রথমে রেগে বলে, এ-চিঠিও জাল। লোকটি সায় দিয়ে বলে, তা হওয়া সম্ভব। কিন্তু পুলিশের হাতেই দেওয়া উচিত হলেও সে মার্থাকে একবার এটা দেখাতে এসেছিল। মার্থা এবার সোজাসুজিই চিঠিটা লোকটির কাছে কিনে নিতে চায়। লোকটি প্রথমে রাজি হয় না, কিন্তু শেষে প্রচুর টাকার বিনিময়ে চিঠিটি মার্থাকে দেয়। মার্থা গোপনে চিঠিটি একজন বড় হস্তাক্ষর-বিশারদকে দিয়ে পরীক্ষা করায়। তাতে জানা যায় চিঠিটি জাল নয়।

পুলিশ এদিকে হ্যারল্ডের ব্যাগের জিনিসপত্র নতুন করে পরীক্ষা করতে গিয়ে ‘সোনেরিল’ নামে একটি ওষুধের শিশির ভেতর কয়েকটি বিষাক্ত বড়ি পেয়েছে। ওষুধটা সেই জাতের যাতে স্নায়ু শান্ত রাখে। কিন্তু গোপনে অনেকে সেটা নেশা হিসেবে ব্যবহার করে। হ্যারল্ডও করত। কিন্তু শিশির ভেতর এই নকল করা চেহারার বিষাক্ত বড়ি গেল কী করে! পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে তারপর যে, ইউজিন শহরের এক মস্ত বড় ডিসপেন্সারির মালিক। মার্থার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে ইউজিনের দোকান থেকেই এক রাত্রে হ্যারল্ড ওষুধ কেনে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিষাক্ত ও বদ নেশার জিনিস বলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে নাম-ঠিকানা লিখে এ-ওষুধ নিতে হয়। ডিসপেন্সারির খাতায় হ্যারল্ডের ওষুধ কেনা তাই ধরা পড়েছে। সেইসঙ্গে এ-কথাও জানা গেছে যে, নিজে হাতে ওষুধ না বেচলেও ইউজিন সে-রাত্রে ওই সময়ে দোকানের দৈনিক বিক্রির শেষ হিসেব নেওয়ার জন্যে ভেতরে ছিল।

হ্যারল্ডের ফোলিও ব্যাগ যে পেয়েছিল, তাকেও সন্দেহক্রমে পুলিশ এবার গ্রেপ্তার করেছে। মার্থার কাছে হ্যারল্ডের আগের চিঠি বেচবার পরই সে আবার একদিন হ্যারল্ডের লেখা একটি রোজনামচার বই নিয়ে আসে। তার ভেতরে হ্যারল্ডের হাতের লেখায় যা পাওয়া যায় তা সাঙ্ঘাতিক। সেখানে স্পষ্টই লেখা আছে যে, দিনের পর দিন সে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে কাটাচ্ছে। মার্থা ও ইউজিন তার পেছনে খুনে-গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে, সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পুলিশকে জানাতেও তার সাহস হচ্ছে না। তার মতো হতভাগা জুয়াড়ি মাতালের কথা কে বিশ্বাস করবে! মার্থা প্রচুর টাকা দিয়ে সে-ডায়েরি কিনে নেওয়ার পরই লোকটি গ্রেপ্তার হয়েছে। পুলিশ জানতে পেরেছে যে, হ্যারল্ডকে শেষ দেখা যায় সমুদ্রতীরের বন্দর থেকে একটি ছোট মোটর-লঞ্চ ভাড়া করে এক রাত্রে সমুদ্রে বেড়াতে যেতে। তার সঙ্গে ওই লোকটিও ছিল বলে একজন অন্তত এজাহার দিয়েছে। পুলিশ আরও খুঁজে বার করেছে যে, ওই লোকটি এককালে ইউজিনের অধীনেই কাজ করত। ইউজিন অবশ্য এই বলে সাফাই গেয়েছে যে, লোকটির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। বহুকাল আগে চুরির অভিযোগে তাকে সে বরখাস্ত করেছিল মাত্র।

হ্যারল্ডকে তাহলে সত্যি পৃথিবী থেকে সরিয়েছে কে? ইউজিন একা, না মার্থার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে? সে-ষড়যন্ত্রে ওই লোকটিও কি ছিল, না ইউজিন বা সেই লোকটি একাই এ-কাজ করেছে?

ছবি শেষ হওয়ার পর অভিভূতভাবে পরাশরের দিকে তাকিয়েছি। আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে সে-ও তখন সোজা হয়ে বসেছে। বললাম, কী যে তুমি হারালে তা জানো না! এ-গল্পের শেষ তুমিও কল্পনা করতে পারতে না!

তাই নাকি!—পরাশরের সত্যি একটু আপশোস হয়েছে বলেই মনে হল।

অফিসেই ফিরে গিয়ে আমার কাছে পরাশরের আসার আসল কারণটা শুনতে হল। এমন কিছু জরুরি ব্যাপার আমার অবশ্য মনে হল না।

মজার কথা শুধু এই যে, এই ব্যাপারটাও একটা ফোলিও ব্যাগ সংক্রান্ত। খবরের কাগজে একটি ফোলিও ব্যাগ হারানোর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে বক্স নম্বর দিয়ে। কেউ সে-ব্যাগ পেয়ে থাকলে যেন উক্ত বক্স নম্বরে চিঠি লেখেন। আসল মালিক তখন প্রমাণ দিয়ে ফোলিও ব্যাগ নিয়ে যাবেন এবং সেইসঙ্গে হাজার টাকা পুরস্কারও দেবেন।

পরাশরের অনুরোধ, আমিই যেন ব্যাগটি পেয়েছি বলে বক্স নম্বরে একটা চিঠি দিই।

তার মানে?—হতভম্ব হয়ে বললাম, যে-ব্যাগ চোখেও দেখিনি তাই পেয়েছি বলে চিঠি দেব!

আহা, দিয়েই দ্যাখো না।—পরাশর অম্লান বদনে জানালে।—কে ব্যাগটা চাইতে আসে দেখাই যাক না! তোমার বাড়ি—না, না—এই অফিসের ঠিকানাতেই দেখা করতে বলবে।

একটু চটে উঠেই বললাম, এ তোমার আচ্ছা পাগলামির জুলুম দেখছি! কোথায় কী ব্যাগ কিছুর ঠিক নেই, এক হাজার টাকা পুরস্কারের লোভে একটা মিথ্যে চিঠি লিখব! পুরস্কারটা যখন অমন, তখন ব্যাগটা নিশ্চয় দামি। ব্যাগ না পেলে তো আর পুরস্কার কেউ দেবে না!

হঠাৎ কথাটা মনে হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি, তুমি কি ব্যাগটা পেয়েছ নাকি?

আমায় একেবারে নির্বাক করে দিয়ে পরাশর নেহাত হালকাভাবেই বলল, না, পাইনি এখনও, কিন্তু পেতে পারি।

পরাশরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অসম্ভব। যত তর্কই করি, শেষপর্যন্ত তার আজগুবি অনুরোধ রাখতেই হল।

চিঠি দেওয়ার দুদিন বাদে দুপুরবেলা একটা ফোন পেলাম। ব্যাগ হারানোর বিজ্ঞাপন যিনি দিয়েছেন, কখন দেখা করতে এলে আমার সুবিধে হয় তিনি জানতে চাইছেন। পরাশর যেরকম পরামর্শ দিয়েছিল, সেই অনুসারে অফিস বন্ধ হওয়ার পর রাত আটটায় তাঁকে দেখা করতে বললাম। পরাশরকেও আগের ব্যবস্থামতো জানিয়ে দিলাম।

কী অস্বস্তিতে আটটা পর্যন্ত তারপর কাটল, তা বোঝানো অসম্ভব। পরাশর সাড়ে সাতটা নাগাদ এল। আমার মেজাজ তখন প্রায় সপ্তমে উঠেছে। তিক্ত স্বরে বললাম, ভদ্রলোক তো ব্যাগ নিতে এসেছেন, এখন কী বলব কী!

সে তোমায় ভাবতে হবে না, যা বলবার আমি বলব।—পরাশরের কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই যেন ছেলেখেলা।

ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় আটটায় বেয়ারা রামদীন এসে খবর দিলে একজন দেখা করতে এসেছেন। অফিসের সকলকে ছুটি দিয়ে এই রামদীনকেই শুধু রেখে দিয়েছিলাম ফাইফরমাসের জন্যে। রামদীনের সসম্ভ্রমে ঘোষণা করবার ধরন থেকে যা অনুমান করেছিলাম, আগন্তুক ভদ্রলোকের চেহারা তার সঙ্গে মিলল। শুধু লম্বা-চওড়া দশাসই নয়, দস্তুরমতো সম্ভ্রান্ত ও সম্পন্ন চেহারা। সাজ-পোশাকে আড়ম্বর নেই, কিন্তু একবার চাইলেই বোঝা যায়, পদাতিকদের একজন তিনি নন। দামি গাড়িটা চোখে না দেখলেও যেন অনুমান করা যায়।

ভদ্রলোক নিজেই আগে পরিচয় দিলেন। আমার অনুরোধে সামনের চেয়ারে বসে আমাদের দুজনকে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, আমার নাম উমাপতি রায়। আপনাদের চিঠি পেয়ে আমাকেই আসতে হয়েছে।

পরাশর কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, যা আপনারা বলতে চাইছেন আমি জানি। বিজ্ঞাপনের উত্তরে যাঁর কাছে আপনি চিঠি দিয়েছিলেন, আমি সেই গুণধর হাজরা নই। কিন্তু আপনাদের চিঠি পেয়ে আমিই আপনাদের ফোন করেছিলাম এবং আমাকেই গুণধর হাজরার জায়গায় আসতে হয়েছে।

কেন বলুন তো!—সসম্ভ্রমে আমি প্রশ্ন করলাম। চেহারা দেখার পর নাম শুনে উমাপতিবাবুর পরিচয় আমি বুঝে ফেলেছি। বাঙালি ব্যবসায়ী মহলে বিচক্ষণ শিল্পপতি হিসাবে তাঁর নাম ইদানীং যথেষ্ট।

এক মুহূর্ত যেন ইতস্তত করে উমাপতিবাবু বললেন, আসতে হয়েছে, কারণ ওই বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর থেকে গুণধরবাবুকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

তার মানে? আপনি তাহলে আমাদের চিঠি পেলেন কী করে? গুণধরবাবুর হয়েই বা এলেন কেন?—পরাশর বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করলে।

সব কথাই বলছি শুনুন।—বলে উমাপতি যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই : উমাপতিবাবু নানা শিল্প ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। তাঁর সমস্ত কাজের একরকম ডান হাত ও বিশ্বাসী সহায় এই গুণধর হাজরা। হাজরা তাঁর স্কুলের সহপাঠী ছিল, তারপর তাঁর ব্যবসায়ের একজন কর্মচারী হিসেবে ঢুকে নিজের ক্ষমতায় এত উঁচু দায়িত্বের পদে উঠেছে। অধিকাংশ জায়গায় সে-ই উমাপতিবাবুর প্রতিনিধি হয়ে যায়। দিন-দশেক আগে এমনই একটি অত্যন্ত জরুরি কাজে বেরিয়ে কাজ না সেরেই হাজরা শুকনো ছাইয়ের মতো মুখ নিয়ে ফিরে আসে। যে-ফোলিও ব্যাগে অত্যন্ত মূল্যবান দলিল ও কাগজপত্র নিয়ে হাজরা এই কাজে বেরিয়েছিল, তা সে কোথায় হারিয়ে ফেলেছে কিছুই মনে করতে পারছে না। এই মনে-করতে-না-পারা উমাপতিবাবুর সব চেয়ে আশ্চর্য লেগেছে। হাজরার কিছুদিন যাবৎ শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছিল। কিছুদিন লম্বা ছুটি নিয়ে কোথাও বিশ্রাম করবার কথাও উমাপতিবাবু বলেছিলেন, কিন্তু এরকম স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার মতো কোনও লক্ষণ তখন তার মধ্যে ছিল না। কোনও উপায় না দেখে উমাপতিবাবু তাকে শেষ চেষ্টা হিসেবে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে বলেছিলেন। হাজরা তা-ই দিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার পরদিন থেকেই সে নিরুদ্দেশ। বিজ্ঞাপনের উত্তরে কোনও হদিশ মিলবে, এ-আশা উমাপতিবাবুর ছিল না। আমাদের চিঠি পেয়ে তিনি তাই হাতে স্বর্গ পেয়েছেন। ব্যাগটি কীরকম ও তাতে কী-কী ছিল, সমস্ত তিনি লিখে এনেছেন, সেই সঙ্গে পুরস্কারের টাকাও। এখন আমরা ফোলিও ব্যাগটি ফেরত দিয়ে যদি তাঁকে বাধিত করি।

উমাপতিবাবু একটি হাতে লেখা কাগজ আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে টাকার জন্যেই পকেট থেকে ‘ওয়ালেট’ বার করলেন।

পরাশরই কাগজটা হাতে নিয়ে উমাপতিবাবুকে বাধা দিয়ে বললে, টাকা এখন থাক, মিস্টার রায়। কিছু যদি মনে না করেন দু-একটা কথা তাহলে জিজ্ঞাসা করি।

একটু বিস্মিত হয়েই উমাপতিবাবু বললেন, করুন।

গুণধরবাবুর হঠাৎ এরকম নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ কী আপনার মনে হয়? টাকাকড়ি সংক্রান্ত কোনও গোলযোগ বা…।

উমাপতিবাবু পরাশরকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না। একটু অপ্রসন্নভাবেই বললেন, শুনুন, গুণধর সম্বন্ধে কিছু জানলে এরকম কথা উচ্চারণও করতেন না। যুধিষ্ঠিরের ‘ইতি গজ’টুকুও তার মধ্যে ছিল না। সারাজীবনে অনেকবার তাকে পরীক্ষা করে দেখেছি, তবে…।

উমাপতিবাবু হঠাৎ থেমে যেতে পরাশর বেশ একটু জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তবে কী?

না, ওই যা বলেছি, ইদানীং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না।

বেশ বোঝা গেল উমাপতিবাবু কী একটা কথা চেপে গেলেন।

পরাশর কিন্তু এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করলে না। তার বদলে জিজ্ঞাসা করলে, গুণধরবাবু নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সন্ধান নেওয়ার কী ব্যবস্থা করেছেন? পুলিশে খবর নিশ্চয় দিয়েছেন?

পুলিশে!—উমাপতিবাবু একটু চুপ করে থেকে ধীরে-ধীরে বললেন, না, পুলিশে এখনও খবর দিইনি। শিল্প-ব্যবসার একেবারে ওপরতলায় বাজার কীরকম কানপাতলা আপনারা জানেন না। এতটুকু কানাঘুষোয় রাতারাতি সেখানে রাজ্য উলটে যায়। রায় সিন্ডিকেটের গুণধর হাজরা অমূল্য সব কাগজপত্র সমেত হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে ঘুণাক্ষরে জানলে এখুনি সেখানে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যাবে। তাই গোপনে যা খোঁজ নেওয়ার নিচ্ছি আর একান্তভাবে আশা করছি গুণধর এখনও ফিরে আসবে।

শেষ কথাগুলোর সময় উমাপতিবাবুর গলাটা একটু যেন ধরা শোনাল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি আবার বললেন, এসব কথা আপনাদের বলার দরকার ছিল না, উচিতও নয়। তবে ফোলিও ব্যাগটা ফেরত দিয়ে আসল সর্বনাশ থেকে আপনারা বাঁচাচ্ছেন বলেই বোধহয় এত কথা কৃতজ্ঞতায় বলে ফেললাম। আচ্ছা, অনুগ্রহ করে ব্যাগটা যদি এবার দেন।

ব্যাগটা আজ আপনাকে দিতে পারছি না, মিস্টার রায়।

কেন?—উমাপতিবাবুর গলা ও মুখের চেহারা এক মুহূর্তে বদলে গেল। যাঁর আঙুল নাড়ায় হাজার-হাজার লোকের ভাগ্যের চাকা ঘোরে, সেই জবরদস্ত মানুষের অসহিষ্ণুতার সুরই পাওয়া গেল তাঁর কণ্ঠে : যে-প্রমাণ আমি দিচ্ছি, তা কি যথেষ্ট নয়? না, সুবিধে পেয়ে আরও বেশি টাকা নিংড়ে নিতে চান? বেশ, বেশি টাকাই পাবেন। হাজারের জায়গায় দু-হাজার, নয় পাঁচ হাজার। দেখি আমার ব্যাগ।

আমি তখন প্রমাদ গুনছি, কিন্তু পরাশর নির্বিকার। একটু হেসে সে বললে, অত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, মিস্টার রায়? বেশি টাকা আমরা চাই না। ফোলিও ব্যাগও আপনাকেই দেব। কিন্তু আজ নয়, কাল।

কাল, কখন?—উমাপতিবাবুর স্বর অত্যন্ত কঠিন।

এই ধরুন, বেলা দুটোয় আপনার অফিসেই নিয়ে যাব।

বেশ, তাই যাবেন। যেন ভুল না হয়।

উমাপতিবাবু নমস্কার পর্যন্ত না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি সভয়ে পরাশরের দিকে ফিরে বললাম, কী ফ্যাসাদ এখন বাধালে বলো তো? আজ তো ধাপ্পা দিয়ে ঠেকালে, কিন্তু কাল দুটোর মধ্যে ও-ব্যাগ কি ভেলকিতে তৈরি হবে?

হবে, হবে! তুমি ভেবো না, কাল বেলা দেড়টায় তৈরি থেকো, আমি এসে নিয়ে যাব তোমায়!—বলে পরাশরও বেরিয়ে গেল।

পরের দিন ঠিক বেলা দেড়টায় সে হাজির। আর হাতে তার সত্যি দামি চামড়ার একটা ফোলিও ব্যাগ।

প্রথমে অবাক হলেও পরে ব্যাপারটা আন্দাজ করে বললাম, ও-ব্যাগ তা হলে তুমি আগেই পেয়েছিলে!

না।—বলে পরাশর হাসল।

তা হলে এখন পেলে কোথায়, কী করে?

পেলাম ট্রাম-কোম্পানির অফিসে প্রমাণ দিয়ে!—আমার হতভম্ব চেহারা দেখে পরাশর ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে বিশদভাবে টাকাকড়ি যখন নেই, তখন ব্যাগটা নেহাত চোর-ছ্যাঁচড়ের হাতে না পড়লে মারা যাবে না আমি বুঝেছিলাম। স্টেট ট্রান্সপোর্ট, বাস সিন্ডিকেট, ট্রাম কোম্পানির অফিস আর থানা, সব জায়গাতেই ও-বিজ্ঞাপন পড়বার পর আমি খোঁজ নিই। তার মধ্যে ট্রাম কোম্পানির অফিসেই ওরকম একটা ব্যাগের সন্ধান মেলে, কিন্তু তখনও প্রমাণ হাতে নেই। কাল মিস্টার রায়ের কাছে প্রমাণের যে-কাগজ পেয়েছি, তারই জোরে আজ ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম!

ওই ব্যাগ হারাবার একটা সামান্য বিজ্ঞাপন পড়ে এত কাণ্ড তুমি করেছ?

বাঃ, হাজার টাকা পুরস্কার নিতে হবে না!—বলে আমায় একরকম টানতে-টানতে পরাশর অফিস থেকে বাইরে নিয়ে গেল।

উমাপতিবাবুর নিজস্ব অফিস কামরায় যখন পৌঁছলাম, তখনও দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট।

তাঁর খাস কামরায় ঢোকবার সময় উমাপতিবাবুর মুখে যে-ভ্রকুটিটুকু ছিল, পরাশরের হাতের ব্যাগটা দেখে তা কোথায় উবে গিয়ে প্রায় আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখা গেল। অভ্যর্থনার ঘটা তখন দেখে কে!

আসুন, আসুন, বসুন! কী আনব বলুন, চা, কফি? কোল্ড ড্রিঙ্কস?

কিছু না। আগে ব্যাগটা পরীক্ষা করে দেখুন, সব ঠিক আছে কি না!—পরাশর ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল।

এ-অনুরোধ আর দুবার করতে হল না। ব্যাগটা খুলে কাগজপত্রগুলো তাড়াতাড়িতেও বেশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে উমাপতিবাবু হেসে বললেন, না, সব ঠিক আছে। এখন কত টাকার চেক লিখব, বলুন।

তার আগে ব্যাগটা আর-একটু ভালো করে দেখলে হত না! সবই ঠিক আছে বলছেন!

একটু অবাক হয়ে আর-একবার কাগজগুলো গুনে উমাপতিবাবু বললেন, হ্যাঁ, আছে তো দেখছি।

পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বার করে পরাশর বললে, এই ওষুধটাও ব্যাগে ছিল।

তাই নাকি!—প্যাকেটটা হাতে নিয়ে উমাপতিবাবু বললেন, এ তো দেখছি অ্যাভোমিন।

হ্যাঁ, প্লেন বা জাহাজে চড়লে যাদের মাথা ঘোরে বা গা গুলোয়, তাদের দরকার হয়। জাহাজে তো নিশ্চয় নয়, গুণধরবাবু প্লেনে সম্প্রতি কোথাও গেছলেন?

প্লেনে? হ্যাঁ, আসামে আমাদের এক চা-বাগানে কিছুদিন আগেই গেছল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন সেখানে ছিলাম।

এই ফোলিও ব্যাগ হারানোর আগেই?

উমাপতিবাবু মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, সেখান থেকে ফেরার পরই এই ব্যাপার ঘটে। আমি তার দুদিন বাদে ফিরে জানতে পারি।

কাল যে-কথাটা চেপে গেছলেন সেটা এখন তা হলে বলুন, মিস্টার রায়। —পরাশরের প্রায় যেন আদেশের সুর।

একটু থতমত খেয়েও উমাপতিবাবু বিস্ময়ের ভান করলেন। —কী কথা আমি চেপে গিয়েছি?

‘তবে’ বলে শুরু করে বলতে গিয়েও গুণধরবাবু সম্বন্ধে যে-কথাটা বলেননি।

পরাশরের স্থির দৃষ্টির সামনে বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করেই উমাপতিবাবু আবার গরম হয়ে উঠলেন : যদি না বলে থাকি, তাতেই বা কী হয়েছে! ব্যাগ ফেরত দিয়েছেন, পুরস্কার নিয়ে যান। আমায় জেরা করবার কী অধিকার আপনার আছে?

জেরা করবার অধিকার নেই, আছে সাহায্য করবার ইচ্ছে।

ধন্যবাদ! আপনার সাহায্যে আমার দরকার নেই।—উমাপতিবাবু একটা মোটা খাম পরাশরের দিকে একরকম ছুড়েই দিলেন যেন। বুঝলাম তাতেই পুরস্কারের টাকা।

সেটাকে অগ্রাহ্য করে পরাশর গম্ভীরভাবে বললে, সাহায্য না চান, সত্যি কথাটা শুনে রাখুন। তাড়াতাড়িতে পরীক্ষা করে আপনি বুঝতে পারেননি, ও-ব্যাগের বেশিরভাগ কাগজপত্র ও সিকিউরিটি জাল।

ঘরে সত্যিই যেন বজ্রপাত হল। নির্বোধের মতো খানিক চেয়ে থেকে উমাপতিবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, জাল!—তারপর একটানে কাগজপত্রগুলো ব্যাগ থেকে বার করে তিনি সেগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়লেন। কিছুক্ষণ বাদে তাঁর মুখের চেহারা দেখেই বোঝা গেল পরাশর মিথ্যে বলেনি।

উমাপতিবাবু বিহ্বলভাবে বললেন, এর মানে?

মানে অনেক গভীর।—পরাশর শান্ত ও দৃঢ় স্বরে জানালে, শুধু এই সামান্য ক’টাই নয়, আমার বিশ্বাস রায় সিন্ডিকেটের এরকম বহু দামি শেয়ার ও সিকিউরিটির কাগজপত্র গত এক বছর ধরে সিন্দুক থেকে সরে গিয়ে তার জায়গায় জাল কাগজ রাখা হয়েছে। সত্যি কথাটা তাহলে শুনুন : এইরকম একটা গোলমেলে ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হয়ে একটি ব্যাঙ্ক গোপনে এ-ব্যাপারের তদন্ত করবার জন্যে আজ দু-মাস হল আমার ওপর ভার দিয়েছে।

আপনাকে!

হ্যাঁ,—পরাশর সবিনয়ে বললে, আমি মাঝে-মাঝে এসব কাজ করি। নাম পরাশর বর্মা।

পরাশর বর্মা নামটা উমাপতিবাবুর খুব পরিচিত বলে মনে হল না। তিনি শুধু হতাশভাবে বললেন, এখন উপায়, মিস্টার বর্মা।

উপায় গুণধর হাজরাকে খুঁজে বের করা। সুতরাং তাঁর সম্বন্ধে কিছু গোপন করবেন না। বলুন, সেদিন কী কথা চেপে গিয়েছিলেন।

সে এমন কিছু নয়, মিস্টার বর্মা। এ-ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও যোগ আছে বলেও মনে করি না। আমি আবার বলছি, গুণধর যুধিষ্ঠিরের মতো সৎ ও সাধু।

সাধুদেরও পতন হয়, মিস্টার রায়। এখন বলুন যা লুকিয়েছেন।

না, লুকোইনি ঠিক, তবে গুণধরের একটা ব্যাপার ইদানীং একটু খারাপ লাগছিল। তার কোথাও কেউ নেই। বিয়ে-থা করেনি। সারাজীবন একা কাটিয়েছে। সম্প্রতি কোনও একটি মেয়ের পাল্লায় বুড়ো বয়সে সে পড়েছে মনে হচ্ছে।

কে সে মেয়ে?

জানি না। একদিন রাস্তায় তার সঙ্গে দেখেছিলাম। গুণধরের তুলনায় বয়েস অনেক কম। সুন্দরীও বলা চলে। সকলেরই শত্রু থাকে। গুণধরেরও ছিল। কেউ-কেউ আমাকে ইঙ্গিত করতে চেষ্টা করেছে—আমি কান দিইনি, গুণধরকেও কখনও কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি।

একটু চুপ করে থেকে পরাশর জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, গুণধরবাবুর কি হার্টের অসুখ ছিল?

হার্টের অসুখ!—উমাপতিবাবু অবাক হয়ে বললেন, আমি তো অন্তত জানি না। কিন্তু এ-প্রশ্ন করছেন কেন?

তা এখন না-ই জানলেন। হার্টের অসুখ তাহলে ছিল না বলছেন?

না,—উমাপতিবাবু একটু ভেবে বললেন, তাই বা কী করে বলি। কিছুদিন তার শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল আগে বলেছি। কিন্তু সেটা সাধারণ লিভারের দোষ-টোষই ভেবেছিলাম। দাঁড়ান, দাঁড়ান, একদিন এই ঘরে হঠাৎ বুকটা চেপে সে বসে পড়েছিল মনে আছে। জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল, ও কিছু নয়। গুণধর এমনিতেই খুব কম কথা বলে।

ধন্যবাদ।—পরাশর উঠে দাঁড়িয়ে বললে, মনে হচ্ছে দু-চার দিনের ভেতরই গুণধরবাবুকে আপনার সামনে হাজির করতে পারব। জাল-কাগজপত্রের রহস্য তখন বোঝা যাবে।

গুণধরকে সত্যি দু-চার দিনেই পাবেন আশা করেন?—উমাপতিবাবু ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলেন।

তাই তো করি। রোগাটে, লম্বা, ময়লা রং, মাথার সামনে টাক পড়তে শুরু করেছে। পোশাকে-আশাকে একটু ঢিলেঢালা—এই তাঁর বর্ণনা তো?

সায় দিয়ে উমাপতিবাবু বললেন, পুরস্কারটা নিয়ে যান তাহলে।

না, এখন থাক। ওর চেয়ে বড় পুরস্কারই আপনার কাছে নেওয়ার আশা করি। বলে পরাশর আমায় নিয়ে বেরিয়ে এল।

তারপর পরাশর বর্মার সব জারিজুরি ভাঙবার দাখিল। দু-চার দিনের জায়গায় সাতদিন কেটে গেল, গুণধরের টিকির খোঁজ মিলল না।

এ-ক’দিন আমার হয়রানিরও অন্ত নেই। অফিস থেকে যেটুকু ছাড়া পাই, তার খামখেয়ালে শহরের সর্বত্র ওষুধের দোকানে ঘুরতে হয়। কী যে এক অদ্ভুত ওষুধের পরাশর দোকানে-দোকানে নাম করে! ছোটখাটো দোকান তো জানেই না, খুব কম বড় দোকানেই সেটা পাওয়া যায়। শেষপর্যন্ত চৌরঙ্গী ও অন্যান্য অঞ্চলের যে-ক’টি দোকানে ওষুধটা পাওয়া গেল, তারাও প্রেসক্রিপশান ছাড়া সে-ওষুধ দিতে নারাজ। কিন্তু পরাশরও নাছোড়বান্দা। যেখানে যেমন ম্যানেজার বা মালিকের সঙ্গে তারপর তার দেখা করা চাই। কী যে তর্কাতর্কি সে তাদের সঙ্গে করে জানি না, কারণ আমি বেশিরভাগ সময় বিরক্ত হয়ে বাইরেই তখন থাকি। কিন্তু ওষুধটা পেতে তাকে কোথাও দেখলাম না।

শেষে একদিন জ্বালাতন হয়ে তাকে বললাম, অত যদি ওষুধটার দরকার, কোনও ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসক্রিপশান করিয়ে নিলেই তো পারো।

প্রেসক্রিপশান করাব!—পরাশর যেন আকাশ থেকে পড়ল।

হ্যাঁ, তোমার এই পাগলামির ধারেকাছে আমি পারতপক্ষে থাকি না, কিন্তু সেদিন কোন দোকানে যেন কোনও মেয়ে-টেয়ে প্রেসক্রিপশান এনে এ-ওষুধ নিয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করছিলে না? ওই কথাটা কানে গেছল, তাই বলছি।

ঠিকই বলেছ।—বলে পরাশর আমার পরামর্শটাকে বেমালুম চাপা দিলে।

তার পরদিনই সন্ধ্যায় আমার অফিসে এসে পরাশর আমায় এই মারে তো সেই মারে! সে কী তার মেজাজ!

তোমার জন্যেই আমার এই হাল!

হতভম্ব হয়ে বললাম, আমি আবার কী করেছি?

কী করেছ? ওরকম একটা রদ্দি ছবি দেখতে জোর করে নিয়ে গেছল কে! ওই ছবির ছাপ মনের ওপর ছিল বলেই আমার সব গুলিয়ে গেছল। ওসব বাজে ছবি কখনও দেখতে আছে?

কিন্তু তুমি ছবি দেখলে কখন! অর্ধেকটা পর্যন্ত না দেখেই তো ঘুমিয়েছ, শেষ কী হল তাও জানো না।

জানি না! তোমার পকেটে যে-কাগজটা দিয়েছিলাম সেটা পড়েছ?

তাই তো! কী ভাগ্যি কাগজটা তখনও পকেটে ছিল। বার করে পড়ে সত্যি আমি থ। অভিভূতের মতো জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি আগেই বুঝতে পেরেছিলে!

তার প্রমাণ তো তোমার হাতেই রয়েছে, কিন্তু এখন ওসব বাজে কথার সময় নেই। বলে সে ফোন ধরে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের একজন মাথাকে যা জানাল, তাতে আমি একেবারে স্তম্ভিত।

লালবাজারের ফোন সেরে সে স্বয়ং উমাপতিবাবুকেই ফোনে ডাকল—হ্যালো, হ্যাঁ, মিস্টার রায়কে দিন।…তিনি ব্যস্ত! তা হোক, বলুন পরাশর বর্মা ডাকছেন, তাহলেই হবে।

তাই হল। পরাশর বর্মার নামে উমাপতিবাবু নিজেরই ফোন ধরলেন এবার।

হ্যালো!—হ্যাঁ, আমি বর্মা, আপনার কাছে এখুনি যাচ্ছি। এখুনি বেরুচ্ছিলেন? তবু আধঘণ্টা একটু অপেক্ষা করুন। সব রহস্যের মীমাংসা হয়ে গেছে। গিয়ে সব বলছি। আপনার এখন একেবারে সময় নেই? কিন্তু এ-কাজটা যে সবচেয়ে জরুরি, মিস্টার রায়। গুণধরবাবুকে? না, তাঁকে পাইনি, তবে পাব নিশ্চয়। তাঁর মৃতদেহটা অবশ্য। আবোলতাবোল বকছি? না, সেখানে পুলিশ খোঁজ শুরু করেছে, খবর এল বলে। আপনার চা-বাগানের নিজস্ব নির্জন বাংলো থেকে বেরিয়ে যে-পাহাড়ি রাস্তাটা গৌহাটির দিকে গেছে, তারই পাশের কোনও খাদে অবশ্যই পাওয়া যাবে। না, না, ফোন ছাড়বেন না, অনেক কথা এখন বাকি। রায় সিন্ডিকেটের টাল-বেটাল অবস্থা সামলাতে নিজেই যেসব কাগজ জাল করেছেন, ফাটকা বাজারে বেনামীতে যত শেয়ার কেনা-বেচার জুয়া খেলেছেন, শেষপর্যন্ত একমাত্র বিশ্বাসী বন্ধু ও সহায় গুণধর হাজরাই যেন সব নষ্টের মূল বুঝিয়ে তার নিরুদ্দেশ হওয়াটা যেভাবে সাজিয়েছেন, সব কথাই বলতে হবে যে! সব কিছু মিথ্যার মধ্যে একটা সত্যি কথা আপনি শুধু বলেছিলেন, মিস্টার রায়। বলেছিলেন যে, গুণধর হাজরা যুধিষ্ঠিরের মতো সাচ্চা মানুষ। বাল্যবন্ধু হলেও সেই সাচ্চা মানুষ আপনার সব কীর্তি শেষপর্যন্ত বুঝে ফেলে বেঁকে দাঁড়িয়েছিল বলেই আপনি তাকে মিথ্যে অজুহাতে চা-বাগানে ডাকিয়ে যেভাবে হোক দুনিয়া থেকে সরানোর ব্যবস্থা করেন। পাগলের প্রলাপ আর শুনতে চান না? এখুনি বেরুচ্ছেন, কিন্তু তা তো পারবেন না। লালবাজারে খবর গেছে, তারা এতক্ষণে আপনার অফিস নিশ্চয়ই ঘেরাও করে ফেলেছে—কী হল?

ফোনের ভেতরই ঝন-ঝনাৎ করে একটা কী পড়ে যাওয়ার আওয়াজ আমিও পেলাম।

‘হ্যালো, হ্যালো!’ করে কয়েকবার ডেকে পরাশরও ফোনটা নামিয়ে রেখে হতাশভাবে বললে, না—মিস্টার রায় এখন সব গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বাইরে।

তার মানে?

মানে! পুলিশ গিয়ে ওঁর মৃতদেহটাই পাবে। ওঁরই হার্টের অসুখ। ফোলিও ব্যাগে অ্যাভোমিন-এর সঙ্গে একটা পেন্টানাইটাইট-এর শিশিও আমি পাই। রোগ যাদের গুরুতর, হার্টের হঠাৎ ব্যথা উঠলে তারা খায়। এ-ক’দিন সব ওষুধের দোকানে ওই ওষুধটারই আমি খোঁজ করেছি, কে-কে সম্প্রতি এ-ওষুধ কিনেছে জানবার আশায়। আমার ধারণা ছিল ওষুধটা যখন ব্যাগে থেকে গেছে, তখন গুণধর হাজরা নিজে বা তার বুড়ো বয়েসের প্রেম সেই মেয়েটির সাহায্যে এ-ওষুধ কোথাও কেনার চেষ্টা করবেই। কিন্তু গুণধরবাবুর হার্টের অসুখই ছিল না। তার প্রেমের গল্পটাও মিস্টার রায়ের বানানো। তোমার সঙ্গে ওই বাজে ছবি দেখতে না গেলে গোড়াতেই মিস্টার রায়ের কারসাজি আমি ধরে ফেলতাম।

একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বললাম, কিন্তু ও-ছবি দেখে তোমার মাথা গুলোল কেন? ওখানে তো শেষপর্যন্ত জানা গেল যে, হ্যারল্ড সত্যি মরেনি। মার্থার কাছে টাকা আদায়ের জন্যে আর তাকে ও ইউজিনকে জব্দ করার জন্যে সে-ই নিজের মৃত্যুটা ওইভাবে সাজিয়ে সেই লোকটির সাহায্যে সকলকে ধোঁকা দিচ্ছিল!

হ্যাঁ, ওই ছবিটা মাথায় থাকার দরুনই আমি একরকম চোখ বন্ধ করে ধরে নিয়েছিলাম যে, গুণধর হাজরাই রায় সিন্ডিকেটকে ফাঁক করে ফোলিও ব্যাগটা ফন্দি করে ট্রামে ফেলে দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। ব্যাগটা ইচ্ছে করেই ট্রামে ফেলে যাওয়া হয়েছিল সত্যি, কিন্তু ফেলে গেছল গুণধর নয়, মিস্টার রায়। আসামের চা-বাগান থেকে গুণধরের ওই ব্যাগটি নিয়েই তিনি কলকাতায় আসেন ও একদিন ট্রামে ফেলে গিয়ে গুণধরের নামে ওই বিজ্ঞাপন দেন। ব্যাগে যে মনের ভুলে অ্যাভোমিন আর পেন্টানাইট্রাইট-এর শিশি দুটো থেকে গেছে, তাঁর খেয়ালই হয়নি।

কিন্তু ছবিতে হ্যারল্ডই যে আসল শয়তান, ওইটুকু দেখে বুঝেছিলে কী করে?

বুঝেছিলাম হ্যারল্ডের বা যে গল্প লিখেছে তার অতিবুদ্ধির বহর দেখে। আত্মহত্যার বদলে খুন প্রমাণ করবার জন্যে ফোলিও ব্যাগে জাল চিঠিই যথেষ্ট। তার ওপর আবার বিষের বড়ির ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি। বিষে যদি কেউ মরে তো তাহলে সমুদ্রের তীরে তার ব্যাগটা শুধু পড়ে থাকবে কেন! আর ব্যাগটা যে-লোকটি পায়, আর যাকে এক রাত্রে মোটর বোটে হ্যারল্ডের সঙ্গে যেতে দেখা যায়, সে নিজের গরজে বা কারুর টাকা খেয়ে যদি হ্যারল্ডকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে ব্যাগটা সে সাধ করে পুলিশের হাতে নিশ্চয় দেবে না! নাঃ, ওসব বাজে ছবি আর কখনও দেখবে না, তার চেয়ে বুদ্ধিতে শান দেওয়ার জন্যে আধুনিক কবিতা পড়া অনেক ভালো।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৫৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *