পদ্মলোচনের শাঁখ
স্বামীজী একদিন শিষ্যকে বললেন : “যাতে ব্রহ্মবিকাশের সাহায্য করে তাই ভাল কাজ। সব কাজই প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে আত্মতত্ত্ববিকাশের সহায়কারী ভাবে করা যায়। তবে ঋষিপ্রচলিত পথে চললে ঐ আত্মজ্ঞান শিগগির ফুটে বেরোয়। আর যাকে শাস্ত্রকারগণ অন্যায় বলে নির্দেশ করেছেন, সেগুলি করলে আত্মার বন্ধন ঘটে, কখনো কখনো জন্ম-জন্মান্তরেও সেই মোহবন্ধন ঘোচে না।“
এযুগের মানুষের কাছে আবার আত্মতত্ত্ব কি? দেহতত্ত্বই সারকথা। প্রথমে লুটব তারপর ভোগ করব। আমি আর আমার ভোগ। এর বাইরে আর কিছু নেই। সমাজের চেহারাও ঠিক সেইরকম দাঁড়িয়েছে। সভ্যতা বাইরের মুখোশ মাত্র। ভেতরে পাশবিকতা। মানুষের অত্যাচারে মানুষই অতিষ্ঠ। অথচ ঋষিরা বলে গেছেন, সারা ভারতবর্ষ এক সাধনপীঠ। অসাধারণ লক্ষণসমূহ প্রস্ফুটিত হয়ে আছে দিকে দিকে। ভারত হলো বৈকুণ্ঠের প্রাঙ্গণ।
আমাদের অবহেলায়, আমাদের উদাসীনতায় আমরা সব হারাতে বসেছি। আত্মবিস্মৃতির শিকার হয়েছি। এখন মানুষের হাতে মানুষ শিকার হচ্ছে। বাঘ ভাল্লুকে আর কটা মানুষ মারে। মানুষ মরছে মানুষের হাতে। একালের মানুষ যেন ছাগল। ধর আর যে কোন ছুতোয় কাট। এখন এই আমাদের বীরত্ব।
অবাক হতে হয়, এই হলো বুদ্ধ, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের দেশের হাল। সভ্য মানুষের পাশবিকতা সম্পর্কে রুশোর বিশ্লেষণ ভারি সুন্দর! তিনি বলেছেন, বন্য মানুষের লড়াই ছিল খাদ্যের লড়াই। খাদ্যের অধিকার নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধ দীর্ঘকাল চলত না। কারণ সে লড়াইয়ে ব্যক্তিগত বা জাতিগত অহঙ্কারের প্রকাশ ছিল না, “as pride does not enter into the fight, it is ended with a few fisticuffs, the victor eats, the vanquished goes off to seek better luck elsewhere and all are pacisied.”
সভ্য মানুষ দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক বেশি অসভ্য। রুশো বলছেন : “ মোদ্দা প্রয়োজন যেই মিটল, অমনি শুরু হলো বাড়তি ধান্দা, তারপরেই এল বিলাসিতা, তারপর এল প্রাচুর্য”, তারপরই সেই দুষ্ট চক্র, “then Subject, then Slaves he does not have a moment of respite. Cut every throat until he is master of the whole universe.”
এই কারণেই মানুষের সভ্যসমাজে কি ধনী, কি দরিদ্র—সবাই অসুখী। রুশো লিখছেন, “Men are wicked.” মানুষ স্বভাবে দুর্বৃত্ত। আমাদের এই বিষণ্ণতা আর নিত্য অভিজ্ঞতায় অনবরতই তার প্রমাণ মিলবে। তবু বলব মানুষ কিন্তু প্রকৃতই সুন্দর। মানুষকে দুর্বৃত্ত করেছে কে? করেছে দ্রুত পরিবর্তন। সভ্যতা আর জ্ঞান যত বাড়ছে, মানুষ ততই দুষ্ট-প্রকৃতির হয়ে উঠছে।
ঠাকুর বলছেন : “জ্ঞান সদরমহল পর্যন্ত যেতে পারে। ভক্তি অন্দরমহলে যায়।”
ভক্তি কাকে বলে? এই মেড-ইজির যুগে ভক্তিকেও আমরা ইজি করে নিয়েছি। বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে টুক করে একটি নমস্কার। না সেলাম, না স্যালুট, না নমস্কার। শিক্ষিত, সভ্য মানুষ ঠাকুর-নমস্কার করছে, যদি কেউ দেখে ফেলেন। আবার কারুর কারুর ভক্তি মানে বিকট গলায়, মা মা চিৎকার। এদিকে গর্ভধারিণী মাতা ছেঁড়া ট্যানা পরে ঘুরছেন। কারুর কাছে ভক্তি মানে শ্মশানের বটতলায় কল্কে সেবন।
স্বামীজী সার কথা বলে দিয়েছেন, “মুখ্যা ভক্তি ও মুখ্য জ্ঞানে কোন প্রভেদ নেই। মুখ্যা ভক্তি মানে হচ্ছে—ভগবানকে প্রেমস্বরূপে উপলব্ধি করা। তুই যদি সর্বত্র সকলের ভেতরে ভগবানের প্রেমমূর্তি দেখতে পাস তো কার ওপর আর হিংসাদ্বেষ করবি?”
এই প্রেমই হলো ব্রহ্মবিকাশ। আমরা সবই শিখেছি। আকাশে উড়তে শিখেছি, চাঁদের মাটিতে পা ফেলেছি। এক বোমায় বিশাল একটা শহর ওড়াতে পারি। সমুদ্রের অতলে রোবট নামিয়ে হারাধন তুলে আনতে পারি। পারি না ভালবাসতে।
যে-পরিবারে আমাদের বসবাস, সেই পরিবার যদি প্রেমহীন হয় তাহলে আমরা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসকের প্রয়োজন অনুভব করি। প্রেমহীন সংসারের শিশু নিষ্ঠুর হয়, স্বার্থপর হয়। বয়স্করা আত্মহননের প্রবণতা অনুভব করেন। উন্মাদ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
সমাজ হলো বৃহৎ পরিবার। প্রেমহীন সমাজের মানুষ যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটিই হচ্ছে। অ্যাগ্রেসিভ। চরম স্বার্থপর। চরম নিষ্ঠুর। “Cut every throat until he is master of the whole universe.” আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় চেঙ্গিজ অথবা তৈমুর কিংবা আলেকজান্ডার নেই। আমরা একটু ছিঁচকে ধরনের। ঠাকুরের ভাষায় ম্যাদা মারা। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবারের কষ্টার্জিত অর্থের শ্রাদ্ধ করে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কা হচ্ছেন, তাঁদের লক্ষ্য বাঁধা মাস মাইনের একটা ভাল চাকরি। তারপর জীবনের সেই সহজ সরল ন্যাশানাল হাইওয়ে—বিবাহ, সুকন্যাসহ সযৌতুক। যৌতুকের ব্যাপারে কৌতুক চলবে না। একটু এদিক ওদিক হলেই সহজ সমাধান বধূ-নির্যাতন। শেষ অস্ত্র- কেরোসিন সিঞ্চন ও অগ্নিসংস্কার। বর্তমানের অতি পুণ্য কর্ম।
স্বামীজী বলছেন : “মেয়েদের পূজা করেই সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নাই সে দেশ, সে জাত কখনো বড় হতে পারেনি। কস্মিনকালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা। “
১৯০১ খ্রীস্টাব্দে বেলুড় মঠে বসে স্বামীজী এই উক্তি করেছিলেন। তার মানে আমাদের মানসিকতা তখনো যা ছিল, এখনো তাই আছে। একটুও বদলায়নি। মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে গোবিন্দদাস লিখেছিলেন :
“বাঙালী মানুষ যদি, প্রেত কারে কয়?
বৃথা ও ইংরেজী শিক্ষা,
বৃথা ও পাশ্চাত্য দীক্ষা,
হৃদয়ে নাহিক মোট জ্ঞানের উদয়।”
কি করে হবে! কেউ তো কোনদিন আমাদের বললেন না, ওহে মানুষ হও। যাঁরা বলেছিলেন, তাঁদের আমরা এক কথায় বাতিল করে বসে আছি। আর সেইটাই নাকি ইনটেলেকচুয়ালিজম। ঠাকুর বলছেন : “সংস্কার চাই, তা নাহলে, ঐ ভাগবত পাঠ হচ্ছে, ছোকরা মুখ বেঁকিয়ে উঠে গেল। বললে, কি বেড়োড় বেড়োড় করছে।”
উইলহেলম রাইখ মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর ধরনধারণ বড় ভাল বিশ্লেষণ করেছেন। যাঁরা আমাদের মুক্তি চান, মানবজাতির বিকাশ চান, তাঁদের আমরা শূলে চড়াই। যীশুকে ঝুলিয়ে দিলুম ক্রুশে।
“You have no sense organ for the truly great man. His way of being, his suffering, his longing, his raging, his fight for you are alien to you.”
আমরাই আমাদের পরম শত্রু। মহামানবরা আসেন ফিরে ফিরে চলে যান। আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরে। শিক্ষা, শিল্প, সভ্যতার শাঁখ ভোঁ-ভোঁ খুব বাজছে। ঠাকুরের কথায়, ও শাঁখ হলো পদ্মলোচনের শাঁখ। ঠাকুর এখন হেঁকে বলছেন :
“মন্দিরে তোর নাহিক মাধব!
পোদো, শাঁখ ফুঁকে তুই করলি গোল
তায় চামচিকি এগারজনা দিবানিশি দিচ্ছে হানা।”