পথের শেষ কোথায়!
‘মানুষ হয়ে আর জন্মাবে?’
‘চিন্তা করছি।’
‘এমন মানব জনম আর পাবে না।’
‘তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। আর জন্মাতে হবে না।’
‘এই ব্যাপারটাই তো ঠিক মতো কেউ বলছে না। ধরো। ‘নেক্সট টাইম’ যদি কুকুর হয়ে জন্মাই।’
‘বিলিতি কুকুর হতে আমার আপত্তি নেই। প্রচণ্ড আদর-যত্ন। ছোট লোমওয়ালা হলে গাউন-পরা সুন্দরী মেমসায়েবদের কোলে থাকব। রোজ বুরুশ দিয়ে লোম পরিপাটি করে দেবে। বিলিতি পাউডার মাখাবে। বিলিতি বিস্কুট খাওয়াবে। মাংসের কিমা। বিলিতি পাঁউরুটি। চকচক করে দুধ খাব। খেঁউ খেঁউ করে ডাকব সরু গলায়। সারাদিন শুধু খেলা। মাঝেমাঝে একটু একটু ঘুমিয়ে নেব দামি সোফার ওপর। আর রাত্তির বেলা মেমসায়েবের কোলের কাছে। মেমসায়েবের স্বামী বেশিদিন টেকে না। বিয়ে ফেঁসে ফর্দাফাঁই। সেই কারণে মেমরা স্বামী আর কুকুর দুটোই রাখে। স্বামী কেটে পড়লেও কুকুরটা থাকে। কুকুরটার সঙ্গে যত প্রাণের কথা। আয় রে ‘জনি’, তোর চেয়ে আপনার পৃথিবীতে আর কে আছে রে বগলা! আবার সায়েবটারও একটা কুকুর থাকে। দামড়া অ্যালসেশিয়ান, অথবা গোল্ডেন রিট্রিভার, কি বক্সার! সায়েব বলবে, আয় রে কমলা, তুই তো মেয়েদের মতো চপলা নোস। এই নে চিকেন প্যাটিস খা।’
‘সায়েবরা এত বউ পালটায় কেন বল তো!’
‘মেমগুলো যে মাছের জাত। পিছলে যায়। ভালো বক না হলে ধরা যায় না। আবার ধরা গেলেও ধরে রাখা সহজ নয়। সায়েবরা বিয়ে করতে করতে এগোতে এগোতে একদিন মরে যায়। তখন মাথার কাছে বসে থাকে বিশ্বস্ত কুকুর কালুয়া।’
‘আমি তা হলে নেক্সট টাইম সায়েব হয়ে জন্মাব।’
‘কেন?’
‘বিয়ে করার প্রচণ্ড স্কোপ। তিন চার বছর অন্তর-অন্তর নতুন-নতুন বউ।’
‘আমি কুকুরই হব।’
‘দিশি মানুষ দিশি কুকুরই হবে। পুনর্জন্মের এলাকা ভাগ করা আছে। সমুদ্র টপকে বিলেত যাওয়া হবে না। এদেশের কাঁঠাল ওদেশে যাবে? হবে না। আর একটা জিনিস শুনে রাখ, একবার মানুষ হয়ে গেলে আর কুকুর হওয়া যাবে না। মানুষই হতে হবে; যেমন আমের পুনর্জন্ম আম। আম আমড়া হতে পারে না।’
‘আমি তা হলে আর জন্মাব না। পিঠে কুড়ি কেজি ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে পারব না। প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা দিতে পারব না। মাধ্যমিক পাস করা সম্ভব হলেও উচ্চমাধ্যমিকে ধেড়াবই। ফেল করলেই মেট্রো রেল। আত্মহত্যা আর হত্যা ছাড়া এ যুগে আর কী আছে! এজ অফ সুইসাইড, মার্ডার অ্যান্ড টর্চার। স্কুলে, কলেজে টর্চারের বিলাইতি নাম ‘র্যাগিং’। ঘরে ঘরে টর্চারের সংস্কৃত নাম নিপীড়ন। লকআপে টর্চারের নাম, ‘থার্ড ডিগ্রি’। আবার ‘মেন্টাল টর্চার’ আছে। মানসিক পীড়ন। আবার শাস্ত্রীয় নিপীড়ন আছে। বড়জাত, ছোটজাত, জল অচল জাত। তারপর বড়লোকরা পৃথিবীটাকে ভাগ করে নিয়েছে। বড়লোকরা বাঘ। মধ্যবিত্তরা শেয়াল। স্লোগানই তাদের গান এবং গান (Gun)। দুলে দুলে, নেচে নেচে, সুরে, সুরে, টেনে টেনে, ছন্দে ছন্দে, ‘চলছে না, চলবে না। দিতে হবে, দিতে হবে। ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ কেড়ে খাও, খেয়ে কাড়ো। খেয়োখেয়ি করে মরো। অহঙ্কারে লুচির মতো ফুলে ওঠো। জীবনের চাপে তক্তা। বহুরকমের বক্তা।
‘কিন্তু ভায়া, পৃথিবীটা যে কবিতা। জলে নামে চাঁদ। রুপোর তবক গাছের পাতায়। ভোরের জালে রুপোর মাছ। শিশুর মুখে ঊষার আলো। বৃদ্ধের মুখের ভাঁজে দিবাশেষের কাব্য। গনগনে রোদের আঁচে পথিক বৃদ্ধা। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিজেকেই নিজে জিগ্যেস করছে—পথের শেষ কোথায়! কবির উত্তর ‘ শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে!’