পঞ্চাননের হাতি (উপন্যাস) – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
পঞ্চানন মুখোঁপাধ্যায়ের তিন কুলে আর কেউ ছিল না–শুধু আট বছরের একটি ফুটফুটে নাতনি ছাড়া। সে-নাতনিও তাঁর কাছে থাকে না, থাকে তাঁর ঠাকুর্দা ত্রিলোচন চক্রবর্তীর বাড়িতে। অর্থাৎ পঞ্চানন হচ্ছেন নাতনির দাদু।
পঞ্চাননের বাপ-মা তো সেই কবে মারা গেছেন–সে তো তিন যুগ আগে। ভাই-বোন বলতেও কেউ ছিল না। স্ত্রী মারা গেলেন বছর দশেকের একটি মেয়েকে রেখে। পঞ্চানন সেই মেয়েটিকে বড় করলেন, অনেক খুঁজেপেতে তিনখানা গাঁয়ের পরে ত্রিলোচন চক্রবর্তীর একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। ছেলেটির নাম নিতাই, খুব ভালো ছেলে বিএ পাশ করে কী সব ব্যবসা-ট্যাবসা করত। মেয়েটাকে সুখী দেখে পঞ্চাননের আনন্দের সীমা রইল না।
কিন্তু বরাত আর কাকে বলে!
নাতনি রুনকুমার ভালো নাম স্বাতী–তার যখন তিন বছর বয়েস, তখন দুদিনের সামান্য একটু অসুখেই তার মা চোখ বুজল চিরকালের মতো। শোকে-দুঃখে একেবারে পাথর হয়ে গেলেন পঞ্চানন। পঁয়তাল্লিশ বছরেই তিনি যেন ষাট বছরের বুড়ো হয়ে গেলেন।
তারপর আরও পাঁচটা বছর পার হল।
মেয়ের মৃত্যুর পর আর বেয়াইবাড়ি যাননি পঞ্চানন–একবারের জন্যেও না। মা-মরা নাতনিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন কী করে? ত্রিলোচন চিঠি লিখেছেন, বেয়াই, একটিবার অন্তত আসুন। জামাই নিতাই দু-তিনবার এসে ঘুরেও গেছে। পঞ্চানন যাননি–যেতেই পারেননি।
এর মধ্যে অবশ্য ত্রিলোচন চক্রবর্তী অবস্থা পাল্টে ফেলেছেন। ব্যবসার বুদ্ধি তাঁর ছিলই, নিতাইয়ের মাথাটা খুব সাফ, এই সাত-আট বছরের ভেতরে বাপ-ছেলেতে মিলে অনেক টাকা রোজগার করেছেন। ছিলেন সাধারণ গেরস্ত, হয়েছেন পেল্লায় বড়লোক। মস্ত তিনতলা বাড়ি করেছেন, অনেক জমি-জমা পুকুরবাগান এই সব হয়েছে–এমনকি একখানা মোটর গাড়ি পর্যন্ত কেনা হয়েছে। সেই গাড়িতে চড়ে তার ভোঁপ-ভোঁপ আওয়াজে গাঁয়ের গোরু-মোষকে চমকে দিয়ে নিতাই মধ্যে-মধ্যে ব্যবসার খাতিরে শহরে যায়।
পঞ্চাননের মনে আর একটা বাধা এইখানেই। তিনি গরিব মানুষ, পুরুতগিরি করে খান, সামান্য জমি থেকে যা ধান-টান আসে, তাতে একলা মানুষের কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়। রামের মা বলে গাঁয়ের একটি অনাথা দূর সম্পর্কের বিধবা আত্মীয়া আছে, সে-ই এসে তাঁকে দুবেলা দুটো বেঁধে দেয়।
তাঁর নাতনি বড়লোকের আদরের দুলালী। ঠাকুদার চোখের মণি বাপ তার জন্যে পাগল, ঝি-চাকরে তাকে সব সময় আগলে রাখে। তায় দুবছর হল নিতাই কলকাতার কোন সাহেবি স্কুলে নিয়ে গিয়ে পড়াচ্ছে। নিতান্তই পেঁয়ো পুরুত ঠাকুর পঞ্চানন মুখুজ্যেকে সে কি আর চিনতে পারবে? এক-আধবার ভেবেছেন দু চারদিনের জন্যে রুনকুকে কাছে এনে রাখবেন, কিন্তু তাঁর এই মাটির দাওয়া আর এই টিনের ঘর–এখানে এসে কি সে থাকতে পারবে? যে রাজভোগ খায়, মোটা চালের ভাত আর শাক-তরকারি কি তার মুখে রুচবে?
এই সব ভেবেই পঞ্চানন এতদিন চুপ করে ছিলেন, এমন সময় একদিন একখানা ছোট্ট চিঠি এল তাঁর নামে। ছেলেমানুষী কাঁচা অক্ষরে লেখা–
দাদু, আমি গরমের ছুটিতে কলকাতা থেকে এখানে এসেছি। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তুমি কেন আমার কাছে আসছ না? প্রণাম নিয়ো। রুনকু।
চিঠিটা পড়ে পঞ্চাননের চোখে জল এল। তিন বছর বয়সের যে ফুটফুটে নাতনিটিকে দেখে এসেছিলেন শেষবার, তাকে যেন নতুন করে আবার দেখতে পেলেন। এক মাথা কোঁকড়া চুল, দুষ্টুমিভরা বড় বড় চোখ আর সেই চোখের কাজল গালে-মুখে একাকার। পঞ্চানন এতদিন পরেও যেন তার আধো-আধো গলার ডাক শুনতে পেলেন, দাদু–দাদু!
যে-মেয়েটি তাকে দুবেলা বেঁধে-বেড়ে দেয়, সে বললেন, তা যাও না দাদা, নাতনিকে দেখেই এসো না এবারে। নিজের হাতে চিঠি লিখে তোমায় ডেকে পাঠিয়েছে।
চোখের জল মুখে পঞ্চানন বললেন, কিন্তু নাতনিকে দেখলে যে আমার মেয়েটার কথা মনে পড়বে।
সেজন্যে দুঃখ করে আর কী হবে, দাদা! যে যায় সে তো আর ফিরে আসে না। তাই বলে নাতনিকে তুমি ভুলে থাকবে?
তার ওপরে তারা এখন মস্ত বড়লোক
তারা বড়লোক তো কী হয়েছে। নাতনি তো তোমার।
অনেক ভেবেচিন্তে পঞ্চানন ঠিক করলেন, যাবেন এবারে নাতনিকে দেখতে। যদি আসতে চায়, নিয়েও আসবেন দু-চার দিনের জন্যে। হোক বড়লোকের মেয়ে–গরিব দাদুর ঘরে শাক-পাতা যা জোটে তাই খাবে পেট ভরে।
রওনা হবার দিন পঞ্চানন দেখলেন, রামের মা এক কাণ্ড করে বসে আছে। মুখবাঁধা দুটো মস্ত মস্ত হাঁড়ি তাঁর সঙ্গে যাবার জন্যে তৈরি।
আরে, এ কিসের হাঁড়ি? কী আছে এতে? কুটুমবাড়ি যাবে দাদা, খালি হাতে যাওয়াটা কী ভালো দেখায়? নারকোলের নাড়, চিড়ের মোয়া, মুড়কি–
ওরা বড়লোক, এ-সব খাবে?
বড়লোকে কি সোনা খায়?–রামের মা রাগ করে বললে, খুব খাবে, তরিবত করে খাবে। তুমি নিয়েই যাও না।
কিন্তু চার ক্রোশ রাস্তা, পায়ে হেঁটে যাব, সঙ্গে ছাতা থাকবে, ব্যাগ থাকবে। তায় এত বড় দুটো বাঘা হাঁড়ি, নেব কী করে?
তুমি নেবে কেন? এসব কি কেউ হাতে করে নিয়ে নিজে নিয়ে যায়? সঙ্গে তোমার পাইক যাবে।
পাইক!–পঞ্চানন আকাশ থেকে পড়লেন : আমি কি মহাজন, না জমিদারের নায়েব? পাইকবরকন্দাজ আমি পাব কোথায়?
এই তো আমি হাজির আছি দা-ঠাকুর!
যেন ভূতের গলা শুনছেন, এমনিভাবে চমকে ফিরে তাকলেন পঞ্চানন। দেখলেন, প্রায় হাত ছয়েক লম্বা রোগা কিটকিটে এক তালঢ্যাঙা মূর্তি, গায়ের রঙ ভুসো কালির মতো কালো। সেই মূর্তির মাথায় একহাত উঁচু এক পাগড়ি, হাতে বাঁশের লাঠি। রাত্তিরবেলা। মাঠে-ঘাটে চেহারাখানা দেখলে অতি বড় সাহসীও বাবা গো বলে টেনে দৌড় লাগাবে।
আরে–কে এটা!
আমি দামু এজ্ঞে–জ্যান্ত তালগাছ কান পর্যন্ত দাঁত ছড়িয়ে দিয়ে হাসল : আমায় চিনতে পারলেন না? আপনার দামু–সুদাম দাস।
চিনব কী করে–যা জগদ্দল পাগড়ি চাপিয়েছিস মাথায়! তার ওপরে ওই ঠ্যাঙা।
হিঁ-হিঁ–দামু আরও খুশি হল : এজ্ঞে পাইক হয়ে যাচ্ছি যে আপনার। একটু সাজগোজ করে যাব না?
সে তো বুঝতেই পারছি–পঞ্চানন ব্যাজার হয়ে গেলেন : তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব? তুই যে এক নম্বরের ভণ্ডুলরামকী করতে কী করে বসবি তার ঠিক নেই।
এজ্ঞে না, এখন আমি চালাক হয়ে গেছি–দামু বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল : সঙ্গে নিয়েই দেখেন না আমাকে। কোনও গোলমাল যদি হয়, আমার কান ছিঁড়ে নেবেন।
কান ছিঁড়তে বলছে, সেটা ভালো কথাই। কিন্তু বেঁটে-খাটো ধরনের মানুষ পঞ্চানন সেকান হাতে পাবে কী করে, সেটাই বুঝতে পারলেন না।
সঙ্গে নিয়ে যাও দাদা রামের মা বললে, বোকা-সোকা আছে বটে, কিন্তু দামু ছেলে ভালো। এতটা পথ হেঁটে যাচ্ছ, সঙ্গে ভরসার মতো রইল। তারপর হাঁড়ি-টাঁড়িগুলোও নিয়ে যেতে পারবে। ওকে নিয়ে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না, দেখে নিয়ো।
তবু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন পঞ্চানন। সন্দেহ নেই, দামু মানুষ ভালো। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, একটু বেশি রকমেরই ভালো। তারও মা-বাপ নেই, আছে কেবল এক মাসি। সে-মাসি লোকের বাড়ির কাজকর্ম করে, ধান-টান ভেনে দিয়ে কোনওমতে দিন চালায়। দামু সেই মাসির আদরেই আছেনইলে এতদিনে তার যে কী হাল হত জোর করে সেকথা বলা শক্ত।
ছেলেটা দারুণ হাবা। একবার কে যেন বলেছিল, দেখে এলাম, আমড়া গাছতলায় তোর ডান কানটা পড়ে আছে–তাই শুনে, নিজের কান পরখ না করেই, আধ মাইল দূরের আমড়াতলায় কান কুড়োতে ছুটেছিল দামু। আর-একবার, তার নিজের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে, কে যেন তার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলেছিল–তুই তো আর বাড়ি থেকে যেতে পারবি না, তুই হারিয়ে গেছিস–আর তাই শুনে পাক্কা দেড় ঘন্টা দামু সেখানে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান করে কেঁদেছিল : ওগো–আমি কেমন করে বাড়ি যাব গো–আমি যে হারিয়ে গেছি–মাসি গো
তা এসব হল ছেলেবেলার ব্যাপার। এখন অবশ্য দামুর কুড়িবাইশ বছর বয়েস হয়েছে, অতটা ক্যাবলামিও আর নেই, কিন্তু তাই বলে বুদ্ধিটা যে খুব পেকে উঠেছে তা-ও বলতে পারা যায় না। এখনও দামু যদি হাটে-বাজারে জিনিস কিনতে যায়-ধরো, সে দশ পয়সার কুমডোফালি আর আট পয়সার ঝিঙে কিনে দোকানিকে একটা আধুলি, মানে পঞ্চাশ পয়সা দিয়েছে তা হলে দোকানি হয়তো এইভাবে তাকে হিসেব বুঝিয়ে দেবে : দশ পয়সা আর আট পয়সায় হল চব্বিশ পয়সা–তুমি দিয়েছ–পঞ্চাশ-চব্বিশ আর বারোতে হল পঞ্চাশ–ঠিক তো? (দামু সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লা, হিসেব ঠিক আছে) তা হলে এই নাও বারো পয়সা ফেরত–আর দামু নাচতে নাচতে ওই বারো পয়সাই ফেরত নিয়ে আসবে।
এ-হেন একটি সঙ্গীকে নিয়ে–পঞ্চানন ইতস্তত করতে লাগলেন।
দেরি করছ কেন দা-ঠাকুর, চলো–দামুর উৎসাহী গলা শোনা গেল। পঞ্চানন চেয়ে দেখলেন, সেই জাঁদরেল পাগড়ির ওপরে দুটো বিরাট হাঁড়িকে চাপিয়ে নিয়েছে দামু-এক মাইল দূর থেকেই বোধহয় দেখা যাচ্ছে সেগুলো। বগলে নিয়েছে লাঠি, আর হাতে নিয়েছে ব্যাগটা।
চলো দা-ঠাকুর–রোদ উঠে গেলে কষ্ট হবে রাস্তায়।
হাঁ রে, হাঁড়ি-টাঁড়ি ফেলে দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করবি না তো শেষ তক?
দা-ঠাকুর, কক্ষনো ফেলব না–মা কালীর দিব্যি!
দুর্গা শ্রীহরি–একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পঞ্চানন : চল তা হলে, যাওয়াই যাক।
.
দুই
চার ক্রোশ রাস্তা–মানে আগেকার হিসেবে আট মাইল। তোমরা যারা কলকাতার মতো বড় শহর-টহরে থাকো, তোমাদের তো এক কিলোমিটার হাঁটতেই হাঁফ ধরে; রিক্সা, কিংবা ট্যাক্সি আর নিদেন পক্ষে বাস না হলে চোখে প্রায় সর্ষের ফুল ফুটে ওঠে। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের মানুষের পক্ষে ওরকম দশ বারো মাইল রাস্তা কিছু নয় বড় বড় পা ফেলে দেখতে-দেখতে পার হয়ে যায়।
তবু, পঞ্চাননের তো বয়েস হয়েছে–একটু ধীরে ধীরেই যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু দামুর আর তর সয় না। একে তো ঠাকুরমশাইয়ের পাইক সেজেছে, তার ওপর মাথায় ওই পেল্লায় পাগড়ি আর হাতে ওই জাঁদরেল লাঠি–হাঁড়ি-ফাঁড়ি সুদ্ধ সে প্রায় পঞ্জাব মেলের মতো চলতে। লাগল। আর পঞ্চানন মধ্যে মধ্যে কাতর হয়ে ডাকতে লাগলেন, একটু ধীরেসুস্থে যা বাপু, সব ফেলে-টেলে দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি করবি নাকি?
কেলেঙ্কারি প্রায় হতেই যাচ্ছিল আর কি!
এখন দেশসুদ্ধ লোক সবাই ই তো দামুকে চেনে। ওই তালঢ্যাঙা চেহারা, নিপাট বোকামি, কান-হারানোর গল্প–সব মিলে দাম দস্তুরমতো বিখ্যাত লোক। তার ওপর তার আজকের সাজগোজ প্রকাণ্ড পাগড়ির ওপর জগদ্দল হাঁড়ি–এই সমস্ত দেখেশুনে ছেলেপুলের দল চমকে গেল। দামুর সামনে এসে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে গেল তারা।
ও দামু, তোর মাথায় কী?
প্রথমটায় দামুর খুব অহঙ্কার হল।
দেখতেই পাচ্ছিস পাগড়ি।
পাগড়ির ওপরে ও কী?
হাঁড়ি–হাঁড়ি। দামু দাঁত বের করে বললে, কোথাকার নিরেট গাধা রে সব, হাঁড়ি চিনিসনে?
হাঁড়িতে কী আছে রে দামু?
হাঁড়িতে আবার কী থাকে? চিড়ের মোয়া, নারকোলের নাড়, ছানার মুড়কি–এই সব আছে।
ছেলের দল তাই শুনে আরও ঘন হয়ে এল।
দূটো দে না ভাই দামু, আমরা খাই।
ব্যস, আর যায় কোথায়! তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে উঠল দামু।
আস্পর্ধা তো কম নয়। ঠাকুরমশাই তত্ত্ব নিয়ে যাচ্ছেন কুটুমবাড়ি–আর তাই খেতে দেব তোদের! পথ ছেড়ে দে বলছি শিগগির–
ও দামু, দুটো নাড়-মুড়কি দে দামু–ছেলের দল মজা পেয়ে একসঙ্গে কোরাস ধরল।
নোলা কেটে দেব তোদের।–দামু চিৎকার ছাড়ল : পথ ছাড় শিগগির–যেতে দে—
দুটো মোয়া দিয়ে যা দামু–দামু রে দামু–
পথ তো ছাড়লই না, পেছন থেকে এসে আবার দামুকে কুট করে চিমটিও কেটে দিল একটা।
এরপরে কারও মেজাজ আর ঠিক থাকে–মানে থাকতে পারে কখনও। দামু বোঁ করে একপাক ঘুরে গেল। হাঁক ছাড়ল-হা-রে-রে-রে–তারপর ছেলের দলকে তাড়া করতে গেল।
এর পরে যা ঘটতে যাচ্ছিল সে তো বুঝতেই পারছ। হাঁড়ি আছড়ে পড়ত মাথা থেকে, তারপর ছেলের দলের পোয়া বারো। কিন্তু সেই সময় এসে পড়লেন পঞ্চানন।
এসে পড়লেন ছুটতে ছুটতেই। দূর থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করেছিলেন।
এই দামু–কী হচ্ছে–এই—এই–
দ্যাখেন না ঠাকুর মশাই, এই বাঁদরগুলো বলছে–ও দামু আমাদের নাড়মুড়ি খেতে দে।
পঞ্চাননকে দেখে ছেলের দল ছিটকে গিয়েছিল। দুর থেকে তারা চাঁচাতে লাগল : দামু রে দামু–
কে আবার বাঙাল ভাষায় কবিতা মিলিয়ে বললে, মোয়া দে খামু—
দামু তাদের তেড়ে যায় আর কি! খাওয়াচ্ছি মোয়া-দাঁড়া–দাঁড়া–
পেছন থেকে খপাৎ করে পঞ্চানন চেপে ধরলেন তাকে। বললেন, সর্বনাশ করেছে রে, সব যাবে! ওরে দোহাই তোর, ওদের আর তাড়া করতে হবে না, ভালোয় ভালোয় তোকে নিয়ে পৌঁছতে পারলে এখন বাঁচি।
একবার ছেড়ে দেন কতা–দামু তবুও তড়পাতে লাগল : হাতে এই রামলাঠি রয়েছে, কটা বাঁদরকে পিটিয়ে ঢিট করে আসি।
আর ঢিট করতে হবে না বাপু, এতেই যথেষ্ট। নে–চল চল–
গোঁ গোঁ করে দামু এগিয়ে চলল। আর পেছন থেকে শোনা যেতে লাগল : দামু রে দামু–
শুনছেন?
পঞ্চানন বললেন, শুনছি। তাতে আর কী হয়েছে, গায়ে তো ফোস্কা পড়ছে না। পা চালা–পা চালা। কিন্তু এবারে বাপু আমি আর সঙ্গ ছাড়ছিনি। লম্বা ঠ্যাং দুটোকে একটু সামলাও, নইলে দুজনেই বেঘোরে মারা পড়ব।
পথে আর অঘটন কিছু ঘটল না। একবার কেবল একটা পুকুরঘাটে হাঁড়ি নামিয়ে যখন জল খেতে গিয়েছিল দামু, তখন কটা মাছি এসে হাঁড়ির ওপর উড়ে বসছিল আর দামু উপেন্দ্রকিশোরের সেই সাতমার পালোয়ান কানাইয়ের মতো লাঠি হাঁকড়ে সবসুদ্ধ সাবাড়ের জো করেছিল। কিন্তু পঞ্চানন তক্কেতকে ছিলেন, ধাঁ করে সে-যাত্ৰা লাঠিটা কেড়ে নিলেন।
তারপর দুজনে বেয়াইবাড়ি গিয়ে পৌঁছুলেন।
ত্রিলোচন চক্রবর্তীর মস্ত বাড়ি, অনেক টাকা, গরিব পঞ্চাননের তো দেউড়ির সামনে গিয়ে পা আর উঠতেই চায় না। কিন্তু ত্রিলোচন বসেছিলেন বাইরের বৈঠকখানায়, ধান-চালের হিসেব করছিলেন, তিনি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন।
আরে বেয়াইমশাই যে! কী ভাগ্যি–কী ভাগ্যি! অ্যাদ্দিনে পায়ের ধুলো পড়ল!
এজ্ঞে তা ধুলো বই কি! চার ক্রোশ রাস্তার ধুলো।–এক কাঠা দাঁত বের করে দামু। বুদ্ধিমানের মতো জবাব দিলে।
পঞ্চানন বিরক্ত হয়ে বললেন, থাম তুই, মেলা বকিসনি।
ত্রিলোচনও ততক্ষণে দামুকে দেখেছেন, তার পাগড়ি, হাঁড়ি, লাঠিন্ধু সেই বিরাট কাণ্ডকারখানা দেখে হাঁ হয়ে গেছেন। রাতের অন্ধকারে এটিকে দেখলে তিনি বাবা গো বলে ছুটে পালাতেন।
ঘাবড়ে ত্রিলোচন বললেন, বেয়াই, এটি—
আমাদের গাঁয়ের ছেলে। জিনিসপত্র বয়ে সঙ্গে এসেছে। নাম দামু! ওরে দামু, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাঁড়ি-টাঁড়িগুলো নামা
এজ্ঞে নামাই– বলেই দামু হাঁড়ি দুটো ধপাৎ করে ত্রিলোচনের একেবারে পায়ের ওপর নামিয়ে ফেলল। উঃ– বলে ত্রিলোচন লাফিয়ে উঠলেন।
পঞ্চানন বললেন, কী রে, হাঁড়ি দুটো একেবারে পায়ের ওপর ফেলে দিলি? একটা আক্কেল-বিবেচনা বলেও কিছু নেই? তোর মতো গো-মুখকে সঙ্গে আনাই–
পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বাধা দিলেন ত্রিলোচন : ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার লাগেনি। যাও হে দামু, বসে বিশ্রাম-টিশ্রাম করো। ওরে–কে আছিস, হাঁড়ি দুটো ভেতরে নিয়ে যা।
এঃ হে, আপনাকে পেন্নাম করতেই ভুলে গেনু বলে দামু এবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে ত্রিলোচনের পায়ে। যেখানে হাঁড়ি নামিয়েছিল, সেই ব্যথার জায়গাতেই ঠাস করে ঠুকে দিলে মাথাটা।
ত্রিলোচন একবার বললেন, ইঃ–তারপর বললেন, বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো। এবার ভেতরে যাও।
বড়লোক বেয়াইবাড়ির আদর-যত্নে পঞ্চানন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। মরা মেয়েটার কথা মনে হয়ে চোখে জল আসছিল, কিন্তু ফুটফুটে নাতনিটিকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ তিনি ভুলে গেলেন। আরও অনেক মিষ্টি হয়েছে রুনকু–অনেক সুন্দর হয়েছে। টক টক করে। কথা বলে, কলকাতার গল্প, তার স্কুলের গল্প, মেমসায়েব দিদিমণির গল্প। তারপর আবার কতগুলো ইংরেজী ছড়াও শুনিয়ে দিলে দাদুকে। পঞ্চানন মুগ্ধ হয়ে গেলেন। আর বারবার মনে-মনে বলতে লাগলেন, বেঁচে থাক দিদি, সুখে থাক।
কিন্তু ত্রিলোচনের এই আদরের নাতনিকে তিনি কী করে নিয়ে যান তাঁর ভাঙা কুঁড়েঘরে? রামের মা ভরসা দিয়েছে বটে, কিন্তু পঞ্চানন মনে জোর পাচ্ছিলেন না। যাই হোক, আজকের দিনটা তো যাক। ভেবেচিন্তে কাল যা হয় করা যাবে।
তার আগেই দামু একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসল। দামুকে দেখে রুনকুর ভালো লাগবে এ তো জানা কথা। আর কুটুমবাড়ি এসে, বেশ করে অনেকগুলো লুচি-মণ্ডা খেয়ে দামুরও মেজাজ খোলতাই হয়ে গিয়েছিল, এ-সব ভালো জিনিস তো আর যখন-তখন তার বরাতে জোটে না। সে রুনকুকে নিয়ে গল্প জমিয়ে বসল।
জানো দিদি, এবারে আমরা তোমায় নিয়ে যাব।
রুনকু খুশি হয়ে বললে, ই, দাদুর বাড়িতে আমি বেড়াতে যাব এবার।
সেখানে রামের মা আছে। সে কত রান্না করে দেবে। আর আমি গাছ থেকে পাখি ধরে দেব তোমাকে।
পাখি ধরে দেওয়ার কথায় রুনকুর আর উৎসাহের সীমা রইল না। সে বললে, সব পাখি ধরে দেবে?
সব। দোয়েল, কোকিল, শ্যামা, শালিক—যা চাও।
রুনকু নেচে উঠল : কী মজা হবে, সব পাখি আমি খাঁচায় করে পুষব! কখন নিয়ে যাবে আমায়?
কাল। দাঁড়াও, আজ একটু ভালোমন্দ খেয়ে নিই, তোমার দাদু বড় বড় রুই মাছ ধরিয়েছে পুকুর থেকে, সেগুলো ভালো করে সাবাড় করি, তারপর।
রুনকুর মন রুই মাছের দিকে ছিল না। সে আবার বললে, কীসে করে নিয়ে যাবে আমাকে?
কেন, তোমাদের মটোর গাড়িতে? ভোঁপ-ভোঁপ করে চলে যাব।
দূর, মোটরে তো সব সময় চড়ি। মোটর ভালো লাগে না।
তা হলে গোরুর গাড়িতে চেপে?
না–গোরুর গাড়িতে নয়।
তবে তো মুস্কিল!–দামু মাথা চুলকোতে লাগল : তা হলে কীসে যাবে? পাল্কিতে? ঘোড়ায়? হাতিতে?
হাতি-ঘোড়া-পালকি এসব বলবার জন্যেই বলেছিল, কিন্তু হাতি শব্দটা টুক করে কানে লাগল রুনকুর।
দাদুর হাতি আছে বুঝি?
দামু পেছনোর পাত্র নয়। বলেই যখন ফেলেছে, তখন আর হার মানা চলে না। বললে, আলবাত আছে। কী নেই তোমার দাদুর? হাতি, ঘোড়া, গোরু, সব।
রুনকু আবার নেচে উঠল : তা হলে আমি হাতি চেপেই দাদুর বাড়ি যাব। ঠিক—ঠিক–ঠিক–
দামু টেরও পেল না, কী সর্বনেশে কাণ্ডটি বাধিয়ে বসল সে।
.
তিন
দুদিন বেয়াই–বাড়িতে আদর-যত্নে তো খুব চমৎকার কেটে গেল পঞ্চাননের। ব্রিলোচন তাঁকে তো আর ছাড়তেই চান না। আর দামু যেরকম উৎসাহের সঙ্গে মাছের মুড়ো, মাংসের কালিয়া আর দই রসগোল্লা খেয়ে চলেছিল, তাতে মনে হল, এখানে সারা জীবন থেকে যেতে হলেও তার এতটুকুও আপত্তি নেই! অমন এলাহি খাওয়া-দাওয়া তার কপালে তো কোনওদিন জোটেনি!
কিন্তু গোলমাল বাধল তত তিন দিনের দিন। যেদিন পঞ্চানন রুনকুকে নিয়ে যাবেন, সেইদিন।
ত্রিলোচন বলেছিলেন, নিয়ে যাবেন বই কি, আপনাদেরই তো মেয়ে।রুনকুও একেবারে তৈরি। তার ছোট্ট সুটকেস তার খেলনা, তার ছবির বইসব ঠাকুরমা যত্ন করে গুছিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে বুড়ি ঝি সদু যাবে, সেও তার পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে নিয়েছে। ত্রিলোচনের দেউড়িতে মোটর গাড়িখানা এসে দাঁড়িয়েছে, পঞ্চানন দুগা-দুগা এই সব বলে-টলে চটিজোড়া পায়ে গলাতে যাচ্ছেন, দামুর মাথায় সেই দেড়-হাত উঁচু পাগড়িটা প্রায় বাঁধা হয়ে গেছে, এমন সময়
এমন সময় সেই বিপর্যয় কাণ্ড!
হঠাৎ রুনকুর এক আকাশ-ফাটানো চিৎকার : আমার হাতি কোথায়?
হাতি! ব্যাপারটা কেউ বুঝে উঠতে পারলেন না। ত্রিলোেচন হেসে বললে, ওহো, দিদির বোধহয় খেলনাটা নিতে ভুল হয়ে গেছে। ওরে কে আছিস, সেই তুলোর তৈরি গলায় ঘুঙুর বাঁধা লাল হাতিটা।
না–লাল তুলোর হাতি না।–রুনকু আবার চিৎকার করে জানাল : আমি জে বড় হয়ে গেছি, ও-হাতি নিয়ে তো আমি আর খেলি না। আমার আসল জ্যান্ত হাতি কোথায়? সেই হাতিতে চেপেই তো আমি দাদুর বাড়ি যাব।
সে কি! হাতি কোথায় পাওয়া যাবে?
বা রে, দামুদাদা যে বললে আমাকে হাতিতে করে দাদুর বাড়িতে নিয়ে যাবে! কই দামুদাদা, হাতি কই আমার?
দামু প্রমাদ গনল। ভাবগতিক দেখে তার নিরেট মগজটাও একটু করে সাফ হতে আরম্ভ করেছিল। দামু বুঝতে পারল, কাজটা খুব কাঁচা হয়ে গেছে। বড়লোকের আদুরে নাতনিকে হাতিমাকা গল্প বলা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি।
দন্তবিকাশ করে, খানিকটা হেঁ-হেঁ আওয়াজ তুলে, মাথা-টাথা চুলকে দামু বললে, ঐ হে-হে। রুনকু দিদি, ও আমি একটুখানি ঠাট্টা করেছিলাম। এবার না হয় মোটর গাড়ি চেপেই দাদুর বাড়ি চলল, তারপর দেখেশুনে একটা দাঁতওলা পেল্লায় হাতি–
আর বলতে হল না। রুনকু একেবারে সোজা বসে পড়ল ধুলোর ওপর। তারপর হাত-পা ছুঁড়ে শুরু হল দাপাদাপি–মোটর গাড়ি ছাই, মোটর গাড়ি বিচ্ছিরি আমাকে হাতি এনে দাও, এক্ষুনি এনে দাও
তার পরের ব্যাপার আর না বলাই ভালো। মা-মরা নাতনিকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়েছিলেন ত্রিলোচন, কিছুতেই তার জেদ ভাঙানো গেল না। ত্রিলোচন অনেক বোঝালেন, পঞ্চাননের বেয়ান এসে বিস্তর ভালো-ভালো কথা শোনালেন, সদু ঝি অনেক মিষ্টি কথায় তাকে ভোলাতে চাইল, কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। শেষকালে ধুলোতে শুয়ে পড়ল রুনকু।
হাতি কোথায় গেল–দাদুর হাতি? হাতি না হলে আমি যাব না।
তেতে-বিরক্ত হয়ে শেষে রুনকুর বাবা যখন মেয়েকে মারবার জন্যে একটা চড় তুলেছে, তখন পঞ্চানন এসে তাকে কোলে তুলে নিলেন। বললেন, থাক বেয়াই, এ-ভাবে জোর করে নিয়ে গিয়ে তো কোনও লাভ নেই। তার চাইতে এখন থাকুক-একটু ঠাণ্ডা হোক, তারপর না হয়–
বিলোচন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, সেইটেই ভালো কথা। আপনি আরও দুটো দিন থাকুন বেয়াই, আমি এর ভেতরে মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে দেব।
চোখে জল আসছিল, পঞ্চানন সামলে নিলেন। ম্লান হেসে বললেন, না বেয়াই, আমার আর থাকবার জো নেই–বাড়িতে রামের মা একা রয়েছে। যখন সুবিধে হয়, আপনি পাঠিয়ে দেবেন। আমি বরং আজ আসি, আপনারা ততক্ষণ রুকুকে শান্ত করুন।
শান্ত যে সে সহজে হবে, এমন মনে হচ্ছিল না। সদু ঝি তাকে দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেও সমানে শোনা যাচ্ছিল তার কান্না আর ফোঁপানিঃ হাতি কোথায়, হাতি? দামুদাদা যে বলেছিল আমাকে হাতি–
মাথার দেড়-হাত উঁচু পাগড়িটা খুলে ফেলে, কোলের ওপর সেই মস্ত লাঠিখানা রেখে দামু কেলে হাঁড়ির মতো মুখ করে একটা কাঁটালতলায় বসেছিল। কী ভাবছিল, সেই জানে। এইবার তার দিকে একটা বজ্ৰদৃষ্টি ফেললেন পঞ্চানন।
কি রে, যাবি আমার সঙ্গে? না–হাতি জোগাড় করবি এখানে বসে বসে?
শুকনো গায় দামু বললে, এজ্ঞে চলুন। পায়ে হেঁটে যেতে যতই সময় লাগুক, মোটরে আর কতটুকু রাস্তা? ধুলো উড়িয়ে, ভঁক ভঁক করে হর্ন বাজিয়ে, দুপাশের গোর তাড়িয়ে গাড়ি চলতে লাগল। পেছনের সিটে বসে পঞ্চাননের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। দামু মাথা নিচু করে বসেছিল ড্রাইভারের পাশে, জীবনে প্রথম মোটর গাড়িতে চাপতে পেরেও তারও মনে যে এতটুকু সুখ ছিল না, পঞ্চানন তা বুঝতে পারছিলেন।
হতভাগা–গো-মুখ্য কোথাকার!
কিন্তু রাগ করে আর কী হবে, ইচ্ছে করে তো আর বিপদ বাধায়নি। স্রেফ বুদ্ধির দোষেই এই কেলেঙ্কারিটা বাধিয়ে বসেছে। পঞ্চানন ভাবতে লাগলেন, সবই তাঁর কপালের দোষ।
হলে নিজের মেয়েটা এত সুখী হয়েও এমন অসময়ে মরেই বা যাবে কেন, আর নাতনিটাই বা দামুর মতো গর্দভের কথায় বিশ্বাস করে এমন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসবে কেন! তাঁর বরাতটাই খারাপ, নাতনিকে দু-দিনের জন্যে কাছে নিয়ে যাওয়াও তাঁর অদৃষ্টে লেখা নেই, তিনি আর কাকে দোষ দেবেন। রামের মার কথা ভেবে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল–সে বেচারি অনেক আশা করে রুনকুর জন্যে নারকোলের নাড়, রসবড়া, গঙ্গাজলী চিড়ের মোয়া-এই সব তৈরি করে বসে রয়েছে।
দামু চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে, বিষম ব্যাজার গলায় বললে, দাদাঠাকুর, আমি একটা আস্ত পাঁঠা।
পঞ্চাননের তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মুখে তিনি সেকথা বলতে পারলেন না, বরং দামুকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টাই করলেন একটু।–তুই আর কী করবি, একটু বেশি গল্প করেছিলি বই তো নয়। সেইটে যে ও বিশ্বাস করে বসে থাকবে, তা তুই কেমন করে জানবি?
না দাদাঠাকুর, আমি একটা গাড়ল।
মনে দুঃখ করিসনি দাম, ভুল-টুল মানুষের হয়ই।
আমাকে যে সবাই বলে অকর্মার ধাড়ি আর পয়লা নম্বরের ভণ্ডলরাম-সে একদম খাঁটি কথা।
পঞ্চাননের মন আদৌ ভালো ছিল না, তার ওপরে দামুর এইসব খেদোক্তি শুনে এখন তাঁর বিরক্তি ধরে গেল। বললেন, হয়েছে, হয়েছে, বাপু, থাম। যা করেছিস, করেছিস, এখন আর ভ্যানভ্যান করে আমাকে জ্বালাসনি।
দামু আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গাড়িটা যখন গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছে, তখন হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল : ও ডেরাইভার সায়েব, গাড়িখানা একটু থামাও দিকিনি।
পঞ্চানন বললেন, আবার কী হল, গাড়ি থামাতে হবে কেন?
একটু কাজ আছে দাদাঠাকুর।–কই গাড়ি থামালে না?
মোটর থামল। আর থামতে না থামতেই লাঠি আর পাগড়ি নিয়ে গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে পড়ল দামু।
পেন্নাম দাদাঠাকুর, আমি চললুম।
পঞ্চানন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। গ্রাম তো এখনও দু মাইল দূরে। এখানে নেমে তুই কোথায় যাচ্ছিস?
গ্রামে যাব না দাদাঠাকুর। তোমার যে-ক্ষেতি করেছি, তার প্রতিবিধেন না করে গাঁয়ে আর মুখ দেখাব না। রুনকু দিদির জন্যে হাতি খুঁজতে যাচ্ছি।
রাগে আর বিরক্তিতে পঞ্চাননের আর মেজাজ ঠিক রইল না।
হতভাগা–উল্লুক! হাতি কি পাকা আমড়া যে গাছতলায় গেলেই কুড়িয়ে পাওয়া যায়? শিগগির ওঠ বলছি গাড়িতে, এখন আমার মস্করা করবার সময় নয়।
মস্করা নয় দাদাঠাকুর, সত্যি বলচি। প্রিতিজ্ঞে করচি, হাতিতে চাপিয়ে দিদিকে আপনার কাছে নিয়ে আসব, নয় আর কোনওদিন গাঁয়েই ফিরব না। এই আমি চললুম।
তারপরেই আর দেখতে হল না। সেই এক-একখানি হাত-চারেক লম্বা ঠ্যাং ঝড়ের বেগে ফেলে ফেলে লাঠি আর পাগড়িসন্ধু তালগাছের মতো দামু পাশের মাঠে নেমে পড়ল, আর পঞ্চানন ভালো করে কিছু বোঝবার আগেই বাবলা বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
প্রায় পনেরো মিনিট ধরে গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকি করলেন পঞ্চানন। কিন্তু দামুর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। সে ততক্ষণে মাইল দেড়েক পথ পাড়ি দিয়েছে।
ড্রাইভার বললে, আমি খুঁজতে যাব বাবু?
তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে পঞ্চানন বললেন, খুঁজে কী হবে? পেটে আগুন লাগালে আপনিই ফিরে আসবে এখন। হতচ্ছাড়া উজবুক কোথাকার! তুমি গাড়ি চালাও।
.
চার
রাগে, দুঃখে, বিরক্তিতে একাকার হয়ে পঞ্চানন তো বাড়ি ফিরে গেলেন। আর ওদিকে দামু চলল পঞ্চাননের হাতির খোঁজে। হাতিতে চাপিয়ে রুনকু দিদিকে যদি দাদুর বাড়ি নে যেতে না পারি, তা হলি গাঁয়ে আর মুখই দেখাব না মনে-মনে এই কঠিন প্রতিজ্ঞা করে। লম্বা লম্বা ঠ্যাঙে দামু মাঠের পর মাঠ পেরুতে লাগল।
ঘন্টা চারেক এই ভাবে মাঠ-ঘাট বনবাদাড় গ্রাম-গঞ্জ পাড়ি দিয়ে তারপর দামুর হাঁপ ধরল। বেশ বড় গোছর একটা গ্রামের কাছে এসে ছায়া-ছায়া একটা নিম গাছের তলায় বসে পড়ল সে।
ইস-কাণ্ডখানা দ্যাখো একবার!–দামু ভাবতে লাগল : কারবারটা একবার দ্যাখো। এই-যে এতটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে এলুম–তা প্রায় ক্রোশ চারেক হবে–এর মধ্যে একটা হাতিও কি চোখে পড়ল? গোরু চরছে তো চরছেই, ছাগলে ঘাস খাচ্ছে তো খেয়েই যাচ্ছে, দুটো-চারটে ভেড়াও ভ্যা-ভ্যা করছে এদিক-ওদিক, এক-আধটা ঘোড়াও তো ছোলা-মটরের বুড়ো শাকগুলো চিবিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু একটা হাতিরও কি চরতে নেই কোথাও? কেন হাতি কি ঘাস খায় না, ছোলা-মটরের শাক চিবোয় না?
ভাবতে ভাবতে দামু বিরক্ত হয়ে গেল। কেমনধারা লোক সব দেশের? এত গোর-ঘোড়া-ছাগল পুষছে–অথচ দু-দশটা হাতি পুষতে পারে না কেউ? কত সুবিধে! পিঠে চাপা যায়–সে তো আছেই। তা ছাড়া–এই ধরো না, হাতিকে লাঙ্গলে জুড়ে চাষ করলেওঃ, সে আর দেখতি হবে না। ওই পেল্লায় জানোয়ার–এক ঘন্টার ভেতরে দশ বিঘে জমি চষে একেবারে ধুলো করে দেবে। আর গোরু পোয্য কী জন্য? দুধ খাবার জন্যি তো? হাতি পুষে তাকে দুইয়ে নাও না কমসে কম একমন দুধ দেবে একবারে, গাঁ সুষ্ঠু লোককে দুবেলা বাটিবাটি পায়েস খাইয়ে দিতে পারবে।
সেসব টু-টু, পুষছে কতগুলো শিংওলা গোরু আর দাড়িওলা কটা পুঁচকে ছাগল। দেশসুদ্ধ লোকের বোকামি দেখে দামুর গা জ্বালা করতে লাগল।
অবিশ্যি, সব চেয়ে বেশি জ্বালা করছিল পেটের ভেতরে। রওনা হওয়ার আগে ত্রিলোচন চক্রবর্তীর বাড়িতে খান তিরিশেক লুচি আর সের খানেক মিঠাই খেয়েছিল সে, কিন্তু এই চার ক্রোশ রাস্তা পাড়ি দিয়ে সেসব কখন বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। হাতির খোঁজ পরে হবে,
সে তো আছেই, তার আগেই পেটটা একটু ঠাণ্ডা করে নেওয়া যাক।
একটু দূরেই, একটা টিনের ছাউনির তলায় বসে মাথায় টাক পড়া ভালোমানুষ চেহারার একজন লোক মস্ত লোহার কড়াইয়ে জিলিপি ভেজে-ভেজে রসে ফেলছিল। সেই জিলিপির গন্ধ দামুর প্রাণমন কেড়ে নিলে। আপাতত হাতির ভাবনা ছেড়ে দিয়ে সে ময়রার কাছে গিয়ে হাজির হল।..
জিলিপি দাও তো দাদু দু গোণ্ডা।
দু গোণ্ডা? আট খানা?–লোকটা বললে, আট আনা লাগবে কিন্তু। পঞ্চাশ পয়সা।
অ্যাঁ, পঞ্চাশ পয়সা! ইকি ডাকাতের গাঁ নাকি হে? আমাদের দেশে তো পঁচিশ পয়সাতেই দু গোণ্ডা জিলিপি পাওয়া যায়।
সেসব ভাঙা আর বাসী জিলিপি। নিবারণ ময়রার দোকানে ওসব পাবে না। তবে তুমি বিদেশী লোক, অতিথ এয়ে বলতে গেলে, তোমাকে চল্লিশ পয়সায় দিতে পারি।
দাও তবে, তাই দাও।
তা হলে বোসো ওখানে–নিবারণ ময়রা একটা নড়বড়ে বেঞ্চি দেখিয়ে দিলে।
বেঞ্চিতে বসে দামু গম্ভীর হয়ে জিলিপি খেতে লাগল। জিলিপিগুলো সত্যিই ভালো, লোকটা জাঁক করতে পারে বটে। আরও দু-চারখানা খেলেও হত। কিন্তু না, বেশি পয়সা খরচ করা চলবে না।
লোকে তাকে বোকারাম বলে বটে, কিন্তু এখন দামু চালাক হয়ে গেছে। রুকু দিদির জন্যে হাতি খুঁজতে বেরিয়েছে সে। এমনিতে সে-হাতি পাওয়া যাবে কি না কে জানে, হয়তো কিনতে হবে শেষ পর্যন্ত। হাতির দাম কত হবে কে বলতে পারে। দোকানদারেরা সুযোগ পেলেই তাকে ঠকায়, তাই মাসি অনেক কান্নাকাটি করে তাকে গুনতে শিখিয়েছে। দাম জানে, এখন তার ট্যাকে কম করেও তেরো টাকা বারো গণ্ডা পয়সা আছে। পঞ্চানন তাকে দুটো টাকা দিয়েছিলেন, পাঁচ টাকা দিয়েছেন ব্রিলোচন, আরও পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন ত্রিলোচনের গিন্নি–মানে রুনকুর ঠাকুরমা। আসবার সময় মাসি আরও এক টাকা বারো গণ্ডা পয়সা দিয়েছিল, তা হলে দাঁড়াল তেরো টাকা বারো গণ্ডা। সোজা হিসেব।
এরই মধ্যে তাকে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে–আর এমনিতে যদি কারুর কাছে গতি না পাওয়া যায়, তা হলে একটা কিনেই নিতে হবে তাকে। একটা হাতির দাম কত হবে? মনে-মনে আঁচ করতে লাগল দামু। অত বড় জানোয়ার, অমন পেরকাণ্ড শুড়, গাছের গুঁড়ির মতো মোটা-মোটা পা-দাম একটু বেশিই হবে নিশ্চয়। হয়তো আট-দশটা টাকাই লেগে যাবে হাতি কিনতে। হুঁ, বুঝেই খরচ করতে হবে একটু। জিলিপি খেতে যতই ভালো লাগুক, লোভ সামলেই চলতে হবে আপাতত।
দামু মনে-মনে হিসেব করছিল আর জিলিপি খাচ্ছিল, এদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছিল নিবারণ ময়রা। দেখবার মতো চেহারাই বটে। এমনটি সচরাচর নজরে পড়ে না।
শেষে আর থাকতে না পেরে নিবারণ বললে, পাগড়িখানা তো জব্বর চাপিয়েছ হে?
দামু খুশি হয়ে বললে, হুঁ-হুঁ, কুটুমবাড়ি গিয়েছিলুম কি না।
তা বেশ করেছিলে। কুটুমবাড়ি যাওয়ার মতো সাজই বটে। এখন বুঝি বাড়ি ফিরছ?
বাড়ি? এখন? উঁহু!–দামু সগর্বে মাথা নাড়ল : একটা হাতি যোগাড় করতে বেরিয়েছি।
হাতি?–নিবারণ একটু চমকাল। তারপর বললে, ওঃ, বুঝিছি, খেলনার হাতি? তা উদিকে কুমোর পাড়ায় যাও–সেখানে তারা ওসব বানায়-টানায়।
খেলনার হাতি তোমায় কে বললে?–দামু নাক কোঁচকাল : সত্যিকারের হাতি। ঘরের চালের সমান উঁচু। শুড় নাড়ে, চলে বেড়ায়।
নিবারণ টাক চুলকোল। আবার কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দামুর দিকে।
তা হাতি দিয়ে কী করবে?
অত খোঁজে তোমার দরকারটা কী? হাতি একটা আমার অবিশ্যিই চাই, সেইজন্যিই বেরিয়েচি। কোথায় পাব বলতে পারো?
গরিবের ঘোড়া-রোগ হয় বলে জানতুম, কারুর কারুর যে হাতি-রোগও হয় এটা এই পেপ্রথম শোনা গেল।–নিবারণ আবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগল দামুর। এত মন দিয়ে দেখতে লাগল যে জিলিপি ভাজার কথা স্রেফ ভুলেই গেল সে।
কী বললে হে তুমি?
কী আর বলব তোমায়।–নিবারণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : মাথায় ছিট থাকলে তাকে কী আর বলা যাবে। তা যাও খোঁজ গে হাতি।
ছিট-টিট বোলো না ময়রার পো–দামুর রাগ হতে লাগল : তুমি কি হেঁজি-পেঁজি পেলে আমায়? জানো, দরকার হলে হাতি আমি কিনতে পারি?
কিনতি পায়রা? লাটসায়েবের নাতি নাকি তুমি? কত টাকা নিয়ে বেরিয়েচ।
হুঁ হুঁ, অনেক। তোমাকে জিলিপির দাম দিয়েও আমার তেরো টাকাইয়ে তেরো টাকা, খুচরো পয়সার হিসেব করতে গিয়ে দামুর একটু গুলিয়ে গেল : মরুক গে, তেরো টাকা কয়েক গণ্ডা পয়সা থেকে যাবে আমার কাছে। কত হবে বলে একটা হাতির দাম? বেশি হলেও ওই ধরো দশটা টাকাই লাগুক–অ্যাঁ?
আরও একবার চমকাল নিবারণ ময়রা। এবার এত বেশি করে চমকাল যে জিলিপি ভাজার কড়াইটা উল্টে যেতে যেতে একটুর জন্যে সামলে গেল।
তারপর নিবারণ সোজা দুহাতে নিজের টাক থাবড়ে বলতে লাগল : হায়—হায়—হায়–হায় রে।
বলি, অমন করে মাথা চাপড়াচ্ছ কেন? আমি হাতি কিনব শুনে তোমার যে সব্বোনাশ হয়ে গেল মনে হচ্ছে।
সে কথায় কানই দিলে না নিবারণ। টাক থাবড়ে বলে যেতে লাগল : ওগো, এমন পাগলাকেও কেউ রাস্তায় ছেড়ে দেয়? দশ টাকায় হাতি কিনতে চায়, একে যে পাগলা গারদে আটকে রাখা উচিত ছিল গো! হায়—হায়—হায়–
বর্ষার জল-ভরা ধানখেতে ঢোঁড়া সাপের তাড়া খেয়ে ধেনো চিংড়িগুলো যেমন ছটাং ছটাং করে লাফিয়ে ওঠে, তেমনি করে একটা লাফ মারল দামু।
বটে, মস্করা হচ্ছে আমার সঙ্গে? আমায় বলছ পাগল?–দামু চেঁচিয়ে উঠল : ভাগ্যিস তোমার জিলিপি খেয়েছি, নইলে হাতের এই লাঠি দিয়ে তোমায় পিটিয়ে আমি চৌকো করে দিতুম! ইঃ, উনি আবার জিলিপি ভাজেন। তোমার জিলিপি পচা, তোমার জিলিপি ছাই, তোমার জিলিপি ছাগলেও খায় না। এই আমি চললুম। হাতি নিয়ে তোমার সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে যদি চলে না যাই, তবে আমার নাম দামু মণ্ডলই নয়।
কড়ায় জিলিপি পুড়ে গেল, নিবারণ হাঁ করে চেয়ে রইল দামুর দিকে। পয়সা আগেই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, মাথায় সেই জগঝম্প পাগড়ি আর মস্ত লাঠি নিয়ে হন্ হন্ করে এগিয়ে গেল দামু।
ফুঃ, ময়রাজিলিপি ভাজতেই জানে কেবল, হাতির ও কী জানে। চলতে-চলতে ভাবতে লাগল দামু : এ-সব বোকা-সোকা লোকের সঙ্গে কথা কয়ে লাভ নেই, বুঝদার কাউকে জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে। গাঁ সুদ্ধ সবাই নিশ্চয় ময়রাটার মতো হাবাগোবা নয়।
বুঝদার তোক পাওয়া গেল একটু পরেই। দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্ছিল সে।
তার নাম জগাই ঘোষ। পেল্লায় মোটা চেহারা, প্রকাণ্ড ভূঁড়ি, লম্বা-লম্বা কান। গাঁয়ের ছেলে-পুলে দূর থেকে তাকে দেখে হাতি-হাতি বলে চাঁচায়, আর তা শুনলেই জগাই ঘোষ–
তা শুনলেই জগাই ঘোষ কী করে, সেটা দামুই টের পেল একটু পরে।
জগাইয়ের জাঁদরেল চেহারা দেখেই দামু দাঁড়িয়ে গেল। বেশ বিনয় করে বললে, ও মশাই!
লাল টুকটুকে দুটো খুদে চোখ দিয়ে দামুকে একবার দেখল জগাই। তারপর বললে, কী, দই চাই? দই আজ ফুরিয়ে গেছে, আর হবে না। কাল সকালে এসো।
এজ্ঞে দই চাইনে। একটা হাতি—
ঠক করে হুঁকোটা নামিয়ে জগাই ঘোষ ঘোঁৎ করে উঠল : কী বললে?
এজ্ঞে হাতি। একটা হাতি যদি—
ব্যস, ওই পর্যন্তই, আর বলতে হল না। তখুনি দাঁড়িয়ে পড়ল জগাই ঘোষ।
পাজি–নচ্ছার—বেল্লিক—ছুঁচো– বলে আকাশ ফাটিয়ে ডাক ছাড়ল একটা। তারপরেই কুড়িয়ে নিল একখানা রাম-লাঠি–দামুর লাঠির চাইতেও হাতখানেক সেটা লম্বা।
আজ খুনই করে ফেলব তোকে–বলে জগাই সেই বিরাট শরীর নিয়ে–হা-রে-রে-রে বলে তাড়া করল দামুকে!
বাবা রে গিচি–গিচি–বলে দামু ছুটল। ছুটল বিশ মাইল স্পিডে। পেছনে খ্যাপা হাতির মতো তেড়ে চলল জগাই ঘোষ।
.
পাঁচ
ছুট তো ছুট–একেবারে বাপ-রে মা-রে করে।
হাতে অবিশ্যি পেল্লায় লাঠিখানা দামুর ছিলই, কিন্তু জগাইয়ের সেই হাতির মতো জগঝম্প চেহারা, সেই পাকা করমচার মতো টুকটুকে লাল চোখ, সেই পিলে কাঁপানো চিৎকার আর অ্যাই মোটা ঠ্যাঙাটা দেখেই দামু বুঝতে পেরেছিল যে জগাই একবার তাকে ধরতে পারলে আর আস্ত রাখবে না। প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে দামু ভাবতে লাগল : এই দ্যাখো একবার। কাণ্ডখানা! হাতির খবর জানতে চাইলে তেড়ে মারতে আসে। এ কী রকম গাঁ–আর এখানকার মনিষ্যিগুলিই বা কী ধরনের! বাবা গো–এ যে দেখছি মেরেই ফেলবে একেবারে।
কিন্তু জগাই দামুকে ধরতে পারল না। একে তো তালগাছের মতো লম্বা লম্বা ঠ্যাং, তার ওপরে প্রাণের দায়। দামু ছুটতে লাগল দিল্লি মেলের মতো। আরও একটা কাণ্ড ঘটল তার সঙ্গে। হঠাৎ দূর থেকে পাঁচ-সাতটা ছেলে: চেঁচিয়ে উঠল। এই রে হাতি খেপেছে।
ঘাঁক করে থেমে গেল জগাই ঘোষ, যেন ব্রেক কষল। ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল : কে বললে রে?
দূর থেকে সাড়া এল :হাতি খেপেছে রে, হাতি খেপেছে।
তোদের সব কটাকে চটকে আমি ছানা বানাব বলেই জগাই ঘোষ এবার ছুটল ছেলেদের দিকে। অর্থাৎ দিল্লি মেলের পেছনে ছুটলাগানো বোম্বাই মেল লাইন বদল করল। আর দামু গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল একটি ভালোমানুষের ঘাড়ে, সে বেগুন-মুলো-কাঁচকলা–এই সবের পসার নিয়ে বসেছিল তার ঘরের সামনে। বোধহয় হাটে বেরুতে যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ মুলো-বেগুন কাঁচকলার ভেতরে গড়াগড়ি খেল দুজনে। তারপর সামলেসুমলে উঠে বসল দামু। হাতজোড় করে বললে, কিছু মনে কোরো না দাদা–যে রামতাড়া লাগিয়ে ছিল, দিশে হারিয়ে তোমার ঘাড়ে এসে পড়িচি।
চাষী গেরস্তটি নিপাট ভালোমানুষ। সে ধুলো ঝেড়ে উঠে তরকারি গোছাচ্ছিল। বললে, কিছু মনে করিনি ভাই, নিজের চোখেই তো দেখলুম। ওই ছোঁড়াগুলোই তোমায় বাঁচিয়ে দিলে। ওদের আর ধরতে পারবে না–টুক টুক করে আমগাছে জামগাছে উঠে পড়বে। তা বেত্তান্তটা কী? জগাই ঘোষকে অমন খেপিয়ে দিলে কী বলে?
খেপাইনি তো। হাতির কথা জিজ্ঞেস করেছিলুম।
আল্লা–আল্লা।–চাষীটির মুখ ভার হল :তোমারই বা আক্কেল কী, দাদা? একেবারে ছেলেমানুষ তো নও। তুমিও হাতি-হাতি বলে জগাইকে খেপাতে গেলে?
আরে দুত্তোর! আমি ভি-গেরাম থেকে এইচি, কী করে জানব যে হাতির নাম শুনলিই। লোকটার অমন মাথামুণ্ডু বিগড়ে যায়? কেবল বলিচি, দাদা-একটা হাতি কোথায় পাব–অমনি ব্যস!
তুমি জানতে না?
মা কালীর দিব্যি, কিচ্ছু জানতুম না।
অ।–চাষীটি বললে, ওই তো মুস্কিল। যাক গে, বেঁচে গেলে এ-যাত্রায়। কিন্তু কারবারখানা কী বলল দিকিনি? সত্যিই তোমার একটা হাতি দরকার নাকি?
সত্যিই দরকার।
কিন্তু তুমি হাতি নিয়ে কী করবে?–লোকটি ভালো করে দামুর দিকে চেয়ে দেখল : তুমি তো দেখছি আমার মতন গরিব মানুষ। হাতি পুষবে কী করে?
অনেক খরচ বুঝি?
বেজায়। শুনিচি, হাতি পুষতে রাজা বাদশাও দেউলে হয়ে যায়।
তবে পুষব না। কাজ মিটে গেলে বনেবাদাড়ে ছেড়ে দেব। চরে খাবে।
সে আবার কী?–একটা বেগুন হাতে নিয়ে চাষীটি বোকার মতো চেয়ে রইল :তোমার কথার মাথামুণ্ডু তো বুঝতে পারছি না।
সব বুঝিয়ে বলছি। আগে এক ঘটি জল খাওয়াও দাদা–ওই জগাইয়ের তাড়ায় আমার বুকের ভেতরটা হাঁক্কোল-পাঁক্কোল করছে।
লোকটি ভেতরে উঠে গেল। শুধু এক ঘটি জলই নয়, একটা ছোট ধামায় করে খানিক মুড়ি-মুড়কিও নিয়ে এল। আর তখন সব দুঃখ ভুলে গিয়ে, মুড়ি-মুড়কিতেই মন দিলে দামু। জগাই ঘোষের চিৎকার শুনেই নিবারণ ময়রার জিলিপিগুলো হাওয়া হয়ে গিয়েছিল পেটের ভেতর।
দেখতে দেখতে ধামা সাফ। তারপর এক ঘটি জল। এতক্ষণ পরে দামুর পেট, শরীর, মাথা সব একসঙ্গে জুড়িয়ে গেল। নাঃ, যা ভেবেছিল তা নয়। এ-গাঁয়ে ভালো লোকও আছে! একটা ঢেকুর তুলে, মুখ-টুখ মুছে বললে, তা হলে বেত্তান্তটা হল গিয়ে তোমার–
ব্যথার ব্যথী পেয়ে দামু খুলে বললে ব্যাপারটা। পঞ্চাননের কথা, রুনকুর কথা–সব।
চাষীর নাম কলিম শেখ। শুনে সে মাথা চুলকোতে লাগল।
তবে তো মুস্কিল।
খুব মুস্কিল।
দশ-বারো টাকায় হাতি কিনতে চাইছ- কলিম শেখ মাথা নাড়তে লাগল :সে তো হবে না।
পঁচিশ-তিরিশ লেগে যাবে নাকি?–দামু ভয় পেয়ে গেল।
না হে, শুনচি দুত্তিন হাজার টাকা লাগে।
দুত্তিন হাজার! সে কত?
কে জানে। চোখে দেখেচি নাকি কোনওদিন? মানে, তোমার আমার মতো বিশ-পঞ্চাশ জনকে বেচলেও হবে না। উঁহু, হাতি তুমি কিনতে পারবে না।
তবে কী হবে?–দামুর কান্না এসে গেল গলায় : হাতি কী একটা আমি পাব না? তা হলে যে আমি আর ঠাকুরমশাইয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আমাকে সন্নিসি হয়ে চলে যেতে হবে।
দাঁড়াও–দাঁড়াও, সন্নিসি হবে কেন? তুমি তোক ভালো, আল্লা আছেন–একটা ব্যবস্থা করে দেবেনই। কলিম শেখ একটু ভেবে নিল : শুনিচি, চৌধুরীপাড়ার জমিদারবাবুর একটা হাতি আছে। যাও না–তাঁকে বলে কয়ে কদিনের জন্যে চেয়ে নাও না হাতিটা।
দেবে?
কেন দেবে না? তুমি একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেই দিতে পারে।
চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী–দামু ভাবল। যা মনে হচ্ছে, হাতি বোধহয় কেনা যাবে না। তার চেয়ে জমিদারের কাছে গিয়েই ধরে পড়া যাক। বড়লোক, শরীফ মেজাজকে জানে দিয়েও দিতে পারে।
চৌধুরীপাড়া? সে কত দূর?
তা কোশ পাঁচেক হবে এখান থেকে। এই তো সোজা রাস্তা-জোর পায়ে যদি হেঁটে যাও, তা হলে সন্ধের পর পৌঁছে যাবে সেখানে। তার চেয়ে আমি বলি কী, সে তো অচেনা জায়গা–রাত-বিরেতে গিয়ে কিছু ঠাহর করতে পারবে না–আমার এখানেই রাতটা থেকে যাও।
কিন্তুক দেরি হয়ে যাবে যে।
কিচ্ছু দেরি হবে না। আর জমিদার–তাদের হল গে নবাবী মেজাজ, রাত্তিরে কি আর তারা তোমার আমার মতো গরিব মানুষের সঙ্গে দেখা করবে, না কথা কইবে? থেকে যাও এখানেই। আমাদের রান্না তো আর খাবে না, আমি নতুন হাঁড়ি দেব, চাল-ডাল-আনাজ দেব, দুটি ফুটিয়ে নিয়ো।
দামু ভেবে-চিন্তে বললে, তবে তাই হোক দাদা, আজ আমি তোমারই অতিথ হলাম।
.
রাতটা খুব সুখে কেটে গেল দামুর। শুধু ডাল-চাল-আনাজ নয়, কোত্থেকে চারটি মাছও এনে দিলে কলিম শেখ। রান্না-টান্ন দামুর আসে না–কলিম শেখের বুড়ো মা দূরে বসে সব দেখিয়ে-টেখিয়ে দিলে। মোটের ওপর খাওয়াটা তার ভালোই হল।
সকালে উঠেই দামু তৈরি। আর তর সইছে না।
কলিম বললে, আল্লা ঠিক তোমায় একটা হাতি জুটিয়ে দেবেন। কিন্তু যাওয়ার সময় এখান দিয়ে একটু দেখিয়ে নিয়ে যেয়ো ভাই। আমার অনেক কলাগাছ আছে, তোমার হতিকে পেট পুরে খাইয়ে দেব।
নিচ্চয়–নিচ্চয়। সকলের আগে তো তোমার দোরগোড়াতেই হাতি নিয়ে আসব। অনেক উবগার করেছ দাদা–কোনওদিন তোমায় ভুলতে পারব না।
দামু বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
একটু এগিয়েছে, হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল একদল ছেলের চিৎকার : খেপেছে রে, হাতি খেপেছে–
আবার জগাই ঘোষ!
দামু আর দাঁড়ায়? কোনওদিকে না তাকিয়েই সোজা দৌড়।
দৌড়ল মাইল তিনেক। না–গাঁ-টা পেছনে পড়ে গেছে অনেকক্ষণ, জগাইয়ের চিহ্নও নেই কোথাও। দামু জিরোবার জন্যে একটা গাছতলায় বসে পড়ল।
একদল লোক আসছিল উল্টো দিক থেকে। দামু তাদের জিজ্ঞেস করলে, চৌধুরীপাড়া এদিকেই তো?
তাদের একজন বললে, , আর কোশ তিনেক হবে। আমরাও চৌধুরীপাড়া থেকেই আসছি।
বটে-বটে।–দামু উঠে দাঁড়াল : তবে তো ভালোই হল। বলতি পারো, ওখানে গেলে জমিদারবাবুর সঙ্গে হবে কি না?
জমিদারবাবু? তিনি তো এখন গাঁয়ে নেই, ছমাস হল কলকাতায় গেছেন। সেখানেই তিনি থাকেন, কালে-ভদ্রে গাঁয়ে আসেন। কেন, তাঁকে তোমার কী দরকার?
তাঁকে দরকার নেই, দরকার তাঁর হাতিটা।
হাতি?–লোকগুলো আশ্চর্য হল। তারপর একজন বললে, বুঝেছি, মাহুতের চাকরি চাও। কিন্তু সে-হাতি তো মরে গেছে সাত বচ্ছর হল। আর এখন তো জমিদারিই নেই হাতি পুষবে কে?
–অ্যাঁ!–ধপাস করে দামু বসে পড়ল গাছতলায়। কী হল, শুনে যে তোমার মাথায় বাজ পড়েছে মনে হচ্ছে।
কিন্তু একটা হাতি যে আমার চাই-ই দাদা।
নেতান্তই চাই!–আর একজন ঠাট্টা করে বললে, তাহলে জঙ্গলে চলে যাও–একটা হাতি ধরেই আনো গে।
শুনে, সব লোকগুলো খ্যাঃ খ্যাঃ করে একচোট হাসল, তারপর এগিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল দামু। বসে রইল মুখোনাকে একটা কেলে হাঁড়ির মতো বিকট আর গম্ভীর করে।
ঠিক বলেচে। হাতিই ধরব জঙ্গল থেকে। সেদিনও পালানো ছাগল ধরে এনিচি, দড়ি ছেঁড়া বাছুর ধরিচি–আর একটা হাতি ধরতি পারব না? নিশ্চয় ধরব। কেবল জঙ্গল চাই একটা। দামু উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে পড়ল জঙ্গল খুঁজতে।
.
ছয়
জঙ্গল একটা খুঁজতে হবে। কিন্তু কোথায় সেরকম জঙ্গল, যাতে হাতি পাওয়া যায়?
চলতে চলতে দামু দাঁড়িয়ে পড়ল। তার খিদে পেয়েছে। হাতির ভাবনা ভাবতে ভাবতে হাতির মতোই খিদে পেয়ে যায় কেবল। কী মুস্কিল!
একটা কুয়ো দেখা যাচ্ছিল একটু দূরে, গাঁয়ের মেয়েরা তাতে জল তুলছিল। দামু সেই কুয়োর কাছে গিয়ে মস্ত একটা পাকুড় গাছের তলায় বসে পড়ল। খাওয়ার ভাবনা ছিল না, আসবার সময় কলিম শেখের বুড়ি মা পুঁটলি বেঁধে সের দুই মুড়ি-মুড়কিকদমা বাতাসা বেঁধে দিয়েছিল তার সঙ্গে। তারই খানিকটা খেতে-খেতে দামু ভাবতে লাগল-একটা বেশ বড়গোছর জঙ্গল দরকার।
অবশ্য তার নিজের গাঁয়ে, আশেপাশে, ঝোঁপঝাড়, বনবাদাড় বিস্তর আছে। টোপা কুল, বৈঁচি, তফল, পানিয়াল কিংবা ট্যাঁপারির খোঁজে সে সব ঝোপেঝাড়ে আদাড়ে-পাদাড়ে সে হানা দিয়েছে অনেকবার। শেয়াল-খরগোশ-খটাশ এ সব অনেক দেখেছে, ভাম বেড়ালও চোখে পড়েছে দু চারটে, কিন্তু হাতি কখনও দেখেনি। হাতির জন্যে অনেক বড় জঙ্গল দরকার বোধহয়। অমন পেল্লায় জানোয়ার-ছোটখাটো জঙ্গলে কি তার পোয়?
কিন্তু সেই বড় জঙ্গলটার খবর পাওয়া যাবে কী করে?
থাবা থাবা মুড়ি-মুড়কি খেয়ে, গোটা ছয়েক কদমা চিবিয়ে, দামুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। যে-মেয়েরা জল তুলছিল, তাদের দিকে এগিয়ে গেল সে।
এটটু জল দাও দিনি বাছারা। গলায় কদমা আটকে তো মলাম।
প্রায় এক বালতি জল খেয়ে দামুর প্রাণটা একটু ঠাণ্ডা হল।
বাঁচালে বাছারা। ভগবান ভালো করবেন তোমাদের।
ভার-ভাত্তিক গিন্নি-বান্নি চেহারার একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল : বিদেশী লোক বুঝি?
হাঁ দিদি, বিদেশী লোক।
যাবে কোথায়?
যাব?–একটু ভেবে-চিন্তে দামু বললে, যাব একটা হা–মরুক গে, যাব জঙ্গলে।
জঙ্গলে! অ্যাঁ, সেকি গো?–মেয়েরা অবাক হয়ে গেল। অবশ্য দামুকে দেখলে আচমকা জঙ্গলের জীব বলেই সন্দেহ হয়, কিন্তু সত্যি সত্যিই সে যে জঙ্গলে যেতে চাইবে এটা তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলে না।
হাঁ দিদি, একটা জঙ্গলই আমার দরকার। বড় জঙ্গল।
বড় জঙ্গল! কী করবে সেখানে গিয়ে?–একজন দামুর মস্ত লাঠিখানার দিকে চেয়ে দেখল : বাঘ–ভালুক মারবে নাকি? ওই লাঠি দিয়ে?
না–না, বাঘ-ভালুক মারব না। দামু ভীষণ চমকে গেল : বাঘ-ভালুক আমি আদৌ পছন্দ করি না।–বলতে বলতে দামুর মনে পড়ে গেল, তাদের গাঁয়ের কে যেন জঙ্গলে যেত কাঠের ব্যবসা করতে। সে বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলে বসল : আমি কাঠের ব্যবসা করি।
তাই বুঝি?
সেই জন্যেই তো জঙ্গল খুঁজে বেড়াচ্ছি দিদি। বলতে পারো, কোন্ দিকে গেলে জঙ্গল পাব?
তা জঙ্গলের অভাব কী? দেশটাই তো জঙ্গলে ভর্তি। এই তো পুবদিকে ক্রোশ দুই হাঁটলেই রাজার গড়ের মস্ত জঙ্গল রয়েছে। মাঝে মাঝে সেখান থেকে চিতে বাঘ-টাঘ বেরোয় শুনেছি।
না–না, চিতে বাঘ নয়।–দামু আবার ভীষণভাবে চমকে উঠল : আমার দরকার একটা হা বলতে বলতেই দামু জিভ কাটল। এই রে, হাতির কথাটা বলে ফেলেছিনু আর কি। জগাই ঘোষের তাড়া খেয়ে আর পথ-চলতি লোকগুলোর ঠাট্টা মস্করা শুনে, সে বুঝে গিয়েছিল–হাতির ব্যাপার যাকে-তাকে বলে ফেলাটা উচিত নয়। তাতে লাভ তো হয়ই না, বরং ঝঞ্জাট বেড়ে যায়। সাধে কি পিসি বলে, ভালো পিত্তিজ্ঞে পাঁচ কান করতে নেই?
সেই গিন্নি বান্নি মেয়েটি অবাক হয়ে বললে, হা কিগো? হা কাকে বলে?
কাউকে বলো না দিদি, কাউকে না।–দামু খুব বুদ্ধিমানের মতো সামলে নিলে : এই মুখ দিয়ে একটা হাই উঠেছিল কিনা, তোমার গে সেইটেকেই–সে যাক গে, আমি রাজার গড়ের জঙ্গলের দিকেই চললুম।
বলতে বলতে, হাতের সেই রামলাঠিতে ভর দিয়ে দামু লাফিয়ে নেমে পড়ল মাঠের ভেতর। তারপর আরও গোটা কয়েক লাফ দিয়ে একেবারে উধাও!
মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইল সেদিকে। তারপর একজন বললে, লোকটা যেন কেমনধারা। পাগল-টাগল নাকি?
আর একজন বললে, মানুষ নয় বোধহয়। বেহ্মদত্যি-টত্যি হতে পারে। চেহারাখানা দেখলে না? তার ওপর আবার লাফাতে লাফাতে চলল জঙ্গলের দিকে। হুঁ, বেহ্মদত্যিই নিঘাত।
অ্যাঁ। রাম—রাম–রাম–
আর দামু তো চলল জঙ্গলের দিকে। মাঠ-ঘাট খানা-খন্দ গাঁ-গঞ্জ পেরিয়ে চলেছে তো চলেছেই। হাতি ধরবে–হাতি ধরবে। যে-জঙ্গলে চিতাবাঘ থাকে সেখানে হাতি থাকবে না, তাও কি হয়?
কিন্তু বাঘ!
দামু একবার থেমে দাঁড়াল। এই বাঘের ব্যাপারটাই তার পছন্দ হচ্ছে না। যদি হাতি ধরতে গিয়ে বাঘে খায়? সব্বোনাশ!
ঝঞ্জাটটা দ্যাখো দিকিনি একবার। একটা ভালো কাজও কি নিশ্চিন্দি হয়ে করবার জো আছে? জঙ্গল থাকবে, সেখানে পালে-পালে হাতি চরে বেড়াবে আর দামু তাদের একটা শুড় ধরে সুড়সুড় করে টেনে নিয়ে আসবে। এর ভেতরে আবার খামকা বাঘ এসে হাজির হয় কেন? বাঘ সোঁদরবনে যাক না–সেখানে হালুম-হালুম করে যাকে ইচ্ছে ধরে খাক।
মরুক গে, আর ভাবব না। পিঠের পুঁটলি থেকে আরও কিছু মুড়ি কদমা খেয়ে, একটা পুরনো দিঘি থেকে খানিকটা জল খেয়ে নিয়ে-দামুর মনে হঠাৎ একটা তেজ এসে গেল। ইস, বাঘে খেলেই হল আর কি। হাতে লাঠি আছে না? দাদাঠাকুরের নাতনির জন্যে হাতি খুঁজতে চলেছি, কত বড় পুণ্যির কাজ-বাঘের সাধ্যি কী, আমার কাছে এগোয়? হাতের এই পেল্লায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে একেবারে পরোটা বানিয়ে ছাড়ব।
যেই মনে হল কথাটা, অমনি দামু একটা হুঙ্কার ছাড়ল। কাছেই দুটো দাড়িওয়ালা ছাগল চরছিল, তারা আচমকা ভয় পেয়ে ব্যাব্যা করে বাড়ির দিকে ছুটল।
দামু চলল। মাথার ওপর দিয়ে দুপুর গড়িয়ে গেল, বিকেল হল। তবু রাজার গড়ের জঙ্গলের তো দেখা নেই। মিথ্যে কথা বললে নাকি মেয়েরা?
একজন চাষী আসছিল নিড়েন হাতে। দামু তাকেই ডাকল।
ও দাদা।
কী গো?
রাজার গড়ের জঙ্গল কোনদিকে?
রাজার গড়? সে তো ওদিকে।–দামু যে-দিক থেকে এসেছে সেই দিকটাই দেখিয়ে দিল লোকটা।
ওই রাস্তা দিয়েই তো এলমদেখতে পেলাম না তো?
কটা উঁচু উঁচু ঢিবি দ্যাখোনি? একটা পুরনো দিঘি?
দেখব না কেন? সেই দিঘিতে নেমে তো জল খেলুম।
সেইটেই তো রাজার গড়।
কিন্তু জঙ্গল তো দেখতে পেলুম না।
আরে জঙ্গল তো ছিল বিশ বছর আগে। কবে কেটে সাফ করে দিয়েছে লোকে। পাঁচ-সাত বছর আগেও দু-চারটে গাছটাছ ছিল, এখন তাও নেই।
অ্যাঁ।–দামু বসে পড়ল ধুলোর ওপর।
কী হল তোমার?
কিছু হয়নি দাদা, তুমি যাও।
এবার দামুর কান্না পেতে লাগল। বরাত একেই বলে। জমিদারের হাতি মরে গেছে সাত বচ্ছর আগে, বিশ বছর হল রাজার গড়ের জঙ্গল সাফ। তা হলে? তা হলে হাতি কোথায় পাওয়া যাবে? কেমন করে সে ফিরে যাবে দা-ঠাকুরের কাছে, রুনকু দিদির কাছে? আর কি কোনও দিন কারও কাছে মুখ দেখাতে পারবে সে?
চোখ দিয়ে দামুর জল পড়তে লাগল।
অনেকক্ষণ একভাবে সে বসে রইল। সূর্য ডুবে গেল মাঠের ওপারে, চারদিকে কালো রাত নেমে এল। তখন দামুর মনে হল মাঠের ভেতরে এরকম একা একা বসে থাকার কোনও মানে হয় না। কাছাকাছি কোনও গাঁয়ে গিয়ে রাতের আস্তানাটা যোগাড় করা যাক, তারপরে কাল সকালে যা হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
দামু গ্রাম খুঁজতে বেরুল। কিন্তু অন্ধকারে মাঠের ভেতরে পথ হারাতে তার সময় লাগল না। না পায় খুঁজে গ্রাম, না চোখে পড়ে একটা আলো। ঘুরতে ঘুরতে হাঁটু টনটন করতে লাগল, কাঁটায় পা ছড়ে গেল, কিন্তু গ্রাম আর মেলে না! কোথা থেকে যে কোথায় যাচ্ছে, কিছুই টের পাচ্ছে না সে।
ইকি ল্যাঠায় পড়া গেল রে বাপু। সারা রাতই ঘুরে মরতে হবে নাকি এমনি করে?
ল্যাঠা মিটতে দেরি হল না। শেষ পর্যন্ত দামু যেখানে গিয়ে পৌঁছল সেখানে চারদিকে শুধু গাছপালার সার আর অথই অন্ধকার।
অ্যাঁ–এই তো জঙ্গল! এই তো পেয়ে গেছি!
কিন্তু জঙ্গল পেয়েও দামুর মনে তখন আর সুখ ছিল না। বুক ভয়ে ধুকপুক করছে। তখন। বাপরে, কী অন্ধকার আধ হাত দূরেও যদি নজর চলে! ঝাঁ ঝাঁ করে ঝিঁঝি ডাকছে চারদিকে–সে-আওয়াজে কানের পর্দা ছিঁড়ে যাওয়ার জো! ধু ধুধুম করে কোথায় একটা হুতোম প্যাঁচাও ডাকল।
হাতি মাথায় থাক, এখন বাঘে না খেলেই রক্ষে।
লাঠিটা অবিশ্যি সঙ্গেই আছে, বাঘকে জুতমতো পেলে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করেও দেওয়া যায়। কিন্তু তার আগেই তো বাঘ তাকে ধরে ফেলবে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, পিছন থেকে বাঘ যদি গুটিগুটি এসে
ওরে বাপরে!
দামু আর ভাবতে পারল না। হাতি-টাতি পরে হবে, এখন তো একটা গাছে টাছে উঠে পড়া যাক। তারপর সকাল হলে খুঁজে দেখা যাবে, এই বনের ভেতর দু-একটা হাতির দেখা মেলে কি না!
অতএব আর কথা নয়, সামনে যে-গাছটা পেল, তাতেই তড়বড়িয়ে উঠে পড়ল দামু।
কী গাছ কে জানে। যেমন বড়, তেমনি ঝুপসি। গাছটার আধাআধি উঠে পড়ে, গোটা দুই মোটা ডালে ঠেসান দিয়ে বসে পড়ল দামু। জায়গাটা মন্দ জোটেনি। এখানে শুধু বসে থাকা নয়, ইচ্ছে হলে একটু ঝিমিয়েও নেওয়া যেতে পারে।
দু-চারটে কাঠপিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছিল, তাতে এক-আধটু জ্বালা করছিল। একঝাঁক বিচ্ছিরি মশাও গুনগুন করছিল কানের কাছে। তবু পরম নিশ্চিন্তি হয়ে বসে রইল দামু। অনেকটা উঠে বসেছে সে–এখানে অন্তত বাঘ তাকে লাফিয়ে ধরতে পারবে না।
আশেপাশে এদিকে-ওদিকে জোনাকির সার জ্বলছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন দামুর দুচোখ ভরে ঘুম এল। হাতের লাঠিটা যে কোন ফাঁকে নীচে পড়ে গেল সে টেরও পেল না। তারপর একসময় চটকা তার ভাঙল। শুকনো পাতায় খসখস করে আওয়াজ উঠছে যেন। গাছের নীচে কালো মতন কী একটা চরে বেড়াচ্ছে না? অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে গিয়েছিল। ভালো দেখতে না পেলেও দামু বুঝতে পারল, সেটা চার পায়ে গুঁড়ি মেরে হাঁটছে। না–বাঘ নয়। বরং–
অ্যাঁ, তবে কি বাচ্চা হাতি? মানে হাতির বাচ্চা?
মনে হতে যা দেরি। তবে তো পেয়ে গেছি! জয় গুরু!
গাছের তলায় হাতির বাচ্চাটা তখনও গুঁড়ি মেরে হাঁটছিল। দামু নামতে লাগল আস্তে আস্তে। ধরবই এবার। একবার ঝপাং করে পিঠে চড়াও হই, তারপর দেখব তুমি কেমন হাতির বাচ্চা! দেখব সুড়সুড় করে তোমায় পঞ্চানন মুখুজ্যের দুয়ারে নিয়ে হাজির করতে পারি কি না!
জয় গুরু!
হাত তিনেক ওপর থেকেই দামু ধপাস করে লাফিয়ে পড়ল হাতির বাচ্চার পিঠের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই সে আওয়াজ করল, ক্যাঁক–আর মাটির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
জঙ্গল কাঁপিয়ে, দামু বিজয়োল্লাসে হাঁক ছাড়ল : ধরিচি—ধরিচি—
.
সাত
সেই মিশমিশে অন্ধকারের ভেতরে একটা বিটকেল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল তখন।
ধরিচিধরিচি বলে দামু যত গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচায়–ততই চেপটে যাওয়া জানোয়ারটা কী রকম যেন কঁক কঁক করে আওয়াজ করতে থাকে। দাম বললে, করো–করো কঁক কঁক–! এর পরে যখন কলাটা মুলোটা খাইয়ে দিদিমণিকে তোমার পিঠে চাপিয়ে দেব, তখন ভাববে–হাঁ, হাতি-জন্মটা অ্যাদ্দিনে সাথক হল আমার।
কিন্তু একটু পরেই কেমন খটকা লেগে গেল দামুর। অ্যাঁ–ই কী রকমটা হল? হাতিটার মাথায় যেন ছাঁটা-ছাঁটা কদম চুল রয়েছে। হাতির বাচ্চার মাথায় চুল থাকে নাকি? কই–এমন তো কখনও শোনা যায়নি। তা ছাড়া গায়ে যেন তেল মাখা রয়েছে মনে হচ্ছে! আর হাতির গুঁড়-দামু মুখে হাত বুলিয়ে দেখল শুড় তো নেই, দিব্যি একটা থ্যাবড়া মতন নাক রয়েছে সেখানে।
.
অ্যাঁ–এ যে মনিষ্যি বলে মনে হচ্ছে গো!
দামু হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠবে কি না ঠাহর করবার আগেই টর্চ লাইটের খানিক আলো এসে পড়ল তার গায়ে। তারপরই মোটা গলার আওয়াজ : বলি হচ্ছে কী? হচ্ছেটা কী এই অন্ধকারের ভেতর?
কোত্থেকে আবার লণ্ঠন হাতে জন দুই লোক দৌড়েও এল। দামু দেখল, টর্চ আর লাঠি হাতে গাঁয়ের চৌকিদার, তার পিছনে পিছনে দুজন গাঁয়ের মানুষ।
আর সে যার ওপর গাঁট হয়ে বসে রয়েছে সে এক কালো মুশকো জোয়ান। তার পরনে। লেংটি মন কী রয়েছে, এক হাতে একটা সিঁদকাঠি। জোয়ানটা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে–গলা দিয়ে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বেরুচ্ছে তার।
চৌকিদার আর লোক দুটো খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল এই অপরূপ দৃশ্যের দিকে। তারপর তাদের একজনের মুখ থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বেরুল : এ যে পটাই চোর গো!
কিন্তু পটাইয়ের পিঠের ওপর বসে কে? ঐ যে আদত বেহ্মদত্যি!
তা বেহ্মদত্যি ছাড়া কী আর? চেহারাখানা একবার দেখছ না? তার ওপরে আবার মাথায় আড়াই হাত এক পাগড়ি।
দামু এতক্ষণে একটু একটু করে ধাতস্থ হচ্ছিল। দুত্তোর, জঙ্গল না ঘোড়ার ডিম, কোত্থেকে কাঁদের এক আমবাগানে ঢুকে বসে আছি! আর হাতির বাচ্চাই বা কোথায় কোন এক লেংটিপরা পটাই চোরকেই ঘপাৎ করে ধরে ফেলিচি! রামো-রামো।
লোকগুলো দূরে দাঁড়িয়ে কথা কইছিল, এতক্ষণে ভরসা পেয়ে চৌকিদার একটু একটু করে এগিয়ে গেল। বেশ মিহি গলায় দামুকে ডাকল : ওহে বেহ্মদত্যি।
শুনে দামু চটে গেল।
আমি বেহ্মদত্যি নই–দামু।
তা দামুই হও আর বেহ্মদত্যিই হও–এবার পটাইয়ের পিঠ ছেড়ে ওঠো দিকিনি। অজ্ঞান হয়ে গেছে-গোঁ গোঁ করছে, দেখতে পাচ্ছ না?
দামু এতক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পটাইয়ের পিঠেই গদিয়ান হয়ে বসেছিল, এবার তোক করে লাফিয়ে উঠল।
চৌকিদার গুটিগুটি পায়ে আরও একটু এগোল দামুর দিকে।
তুমি কে বট হে?
দামু বিরক্ত হয়ে বললে, কানে কম শোনো নাকি? বললুম না–আমি দামু? বিদেশ থেকে এইচি?
বিদেশ থেকে? তা এই আমবাগানে ঢুকেছিলে কেন?
কে জানে আমবাগান না কী!–হাতির ব্যাপারে দামু চালাক হয়ে গিয়েছিল, আসল কথাটা স্রেফ চেপে গেল। গজগজ করে বললে, আঁধার হয়ে গেল, গাঁ-টা কিছু খুঁজে পাইনে, এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিলুম। ভেবেছিলুম, সকাল হলে যা হয় হবে।
বিদেশী তো এখানে কেন?
একটা চা-চাকরি খুঁজতে।
তোমার যা চেহারা–দেখলেই তো প্রাণ ঠাণ্ডা হয়ে যায়।–একজন টিপ্পনি কেটে বললে, চাকরি তোমায় দেবে কে হে? রাত্তিরবেলা তোমাকে দেখলে তো মানুষের দাঁতকপাটি লেগে যাবে।
আর তুমিই বা কোন কাত্তিকটি হে?–দামু চটে গেল : এই তো বেঁটে একটা খটাশের মতন চেহারা–তার ওপর কপালে আবার একটা আব গজিয়েছে। ঠিক কোলাব্যাঙের মতো দেখতে।
চৌকিদার থানার লোক–সে গম্ভীর হয়ে ঝগড়াটা থামিয়ে দিলে। বললে, যেতে দাও, যেতে দাও, এ-সব তুচ্ছু কথা নিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না। তা দামু, তুমি পটাইকে ধরলে কী করে বলো তো হে? ভারি ঘোড়েল চোর, আজ তিন মাস ধরে আমরা ধরবার চেষ্টা করছি অথচ ওর টিকিও ছুঁতে পাইনে। ইদিকে আশপাশের পাঁচ-সাতখানা গাঁ চুরি করে একেবারে ফাঁক করে দিলে। কী করে এটাকে ধরলে দাদা?
ইচ্ছে করে তো ধরিনি।
সেই কপালে আবওলা কোলাব্যাঙের মতো লোকটা আবার টিপ্পনি কাটল : তা যা বলেছ, ইচ্ছে করে তোমার ধরবার দরকার হয় না। সামনে এসে একবার দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়ালেই–ব্যস!
চৌকিদার মোটা গলায় বললে, আঃ, চুপ করো না গুপী হাজরা। এখন আইনের কথা হচ্ছে, এর মধ্যে টিকটিক কোরো না। তুমিই বলো দিকিনি দাদা হয়েছিলটা কী?
কী আর হবে?–দামু একবার কটমট করে তাকাল গুপী হাজরার দিকে : ভাবলুম বনবাদাড়, রাত্তিরে আবার মা-মনসা ছুবলে না দেন। তাই গাছের ডালে উঠে একটু ঘুমুতে চেষ্টা করছিলুম। তারপরেই যেন একটা হাতি
হাতি! হাতি কী হে!–চৌকিদার চমকে গেল।
না–না, ভুল বলিচি।–দামু সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটল : মানে হাতি নয়–ঘুমের ঘোরে হাত ফসকে পড়ে গিয়েছি গাছ থেকে। একেবারে লোকটার ঘাড়ের ওপর।
পটাই কী করছিল গাছতলায়?
কী করছিল সে আমি কেমন করে জানব? ওকেই শুধোও না।
কিন্তু তুমি যে ধরিচিধরিচি বলে চ্যাঁচাচ্ছিলে? সেই চিৎকার শুনেই তো আমরা এদিকে দৌড়ে এলুম।
দামু মাথাটা একবার চুলকোতে চাইল, কিন্তু পাগড়ির জন্যে চুলকানো গেল না। বললে, তাই তো–কেন যে চ্যাঁচালুম–সে তো জানিনে। বোধহয় বেভুল লেগে গিয়েছিল।
চৌকিদার মাথা নেড়ে বললে, লাগে, ওরকম বেভুল লাগে। ঘুমুতে-ঘুমুতে ও-ভাবে। আচমকা কারুর ঘাড়ের ওপর পড়লে অমন চিৎকার লোকের বেরোয়।
পটাই চোর এতক্ষণে আস্তে আস্তে উঠে বসল। চোখ দুটো ছাগলের চোখের মতো গোল-গোল করে তাকাতে লাগল চারদিকে! ব্যাপারস্যাপার যেন এখনও সে বুঝতে পারছে না।
চৌকিদার ঠাট্টা করে বললে, ওঠো হে মক্কেল, আর কেন? বিস্তর হাড় জ্বালিয়েছ আমাদের, উঠে পড়ো এবারে। লক্ষ্মী ছেলের মতো থানায় চলো এবার, তারপর মাস ছয়েক বেশ করে জেলখানায় ঘানি ঘুরিয়ে আসবে।
পটাই ঘোঁ-ঘোঁ করে বললে, ভূ—ভূ–ভূত—
গুপী হাজরা খ্যাখ্যা করে হাসল : ভূত নয়–ভূত নয়, বেহ্মদত্যি! পরশু চক্কোত্তি মশাইয়ের বাড়িতে সিঁধ কেটেছিলে না? তিনিই বেহ্মদত্যি চালান করে দিয়েছেন।
দামু বললে, দ্যাখো কোলাব্যাঙ–
চৌকিদার বললে, আহা থামো থামো, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে নেই। চলো হে পটাই, দারোগাবাবু তোমার মুখোনা দেখবার জন্যে ভারি ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন। আর দামুদাদা, তোমাকেও যে একবারটি থানায় আসতে হচ্ছে আমাদের সঙ্গে।
থানার নাম শুনে বিষম ঘাবড়ে গেল দাম।
আমি? আমি কেন থানায় যাব? চোর নাকি আমি?
আহা-হা, চোর তুমি কেন, চোর তোপটাই। তুমি তাকে ধরেচ না? পটাইকে ধরলে একশো টাকা বকশিশ পাওয়া যাবে, দারোগাবাবু নোটিশ দিয়েছেন যে! আজ তো তোমারই ফুর্তি হে! চলো–চলো–ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে চলল।
পটাই হাজতে গেল, চৌকিদারের সঙ্গে সেই দুজন ছাড়া আরও কিছু কিছু লোক পটাইকে গাল দিতে দিতে থানায় গিয়েছিল, তারাও বাড়ি চলে গেল। দারোগা একটা চেয়ারে বসে হুঁকো খাচ্ছিলেন। এবার দামুর দিকে তাকিয়ে বললে, তুমি কোথায় যাবে?
আমি আবার যাব কোন চুলোয়?–দামু, চটাস করে একটা মশা মারবার চেষ্টা করে। বললে, যদি দয়া করে থাকতে দেন, তা হলে থানার বারান্দায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি।
তারপর?
কাল সকালে আবার পথে বেরিয়ে পড়ব।
কিন্তু তোমার চোর ধরবার বকশিশ? ও তো সরকারি টাকা–পেতে একটু দেরি হবে।
তা বটে!–দামু ভাবনায় পড়ল : টাকাটা পেলে খুব উগার হত। একটা দামী জিনিস কিনতে বেরিয়েছি–মানে একটা হাতি–
দারোগার হুঁকোর ফুড়ক-ফুড়ক টান বন্ধ হয়ে গেল।
কী কিনতে বেরিয়েছ বললে?
দামু একটু চুপ করে রইল। তারপর দারোগাবাবুর ভারভাত্তিক চেহারা দেখে তার মনে হল, হাঁ, বিশ্বেস করে সব কথা এঁকে বলা যায়। ইনি শোনবার মতো লোক।
একটু কেশে নিয়ে দামু বললে, তা হলে ইয়ে মানে দারোগাবাবু, আপনাকে সবটা গোড়া থেকেই বলি।
দারোগা গম্ভীর হয়ে সব শুনলেন। কোনও কথা বললেন না, দু-একবার বোধহয় হাসি পেয়েছিল, খুক খুক করে কেশে সেটা সামলে নিলেন। তারপরে সব শুনে-টুনে আবার ফুড়ক-ফুড়ক করে হুঁকো টানলেন কিছুক্ষণ।
দামু কাতর হয়ে বললে, দারোগাবাবু, আমি হাতি পাব একটা?
দারোগাবাবু বললেন, নিশ্চয়।
আপনি যোগাড় করে দিতে পারবেন?
দারোগা বললেন, আলবাত। আমরা থানার দারোগা–ইচ্ছে করলে সব পারি। যদি মনে করি, তোমাকে এক ঘটি টাটকা বাঘের দুধও খাইয়ে দিতে পারি–তা জানো?
দামু একেবারে গলে গেল।
এজ্ঞে জানি বই কি! সবাই তো সেই কথাই বলে।
দারোগা বললেন, তবে হাতি তো–দু-চারদিনের কাজ নয়, যোগাড় করতে একটু সময় লাগবে। সেদিন তুমি বরং আমার বাসাতেই থেকে যাও। আপত্তি আছে?
আপত্তি! বলেন কী! আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব।
দারোগা খুশি হয়ে বললেন, তা হলে চলো আমার বাসায়। রাত্তিরে বোধ হয় কিছু খাওয়া হয়নি তোমার?
খাওয়ার কথায় দামুর মনে পড়ে গেল, সেই চিড়ের পুঁটলি সাবাড় হয়ে গেছে কখন, এখন পেটে আগুন জ্বলছে। বললে, এজ্ঞে না। খুব খিদে পেয়েছে।
পাবেই। পটাই চোরকে ধরা কি চাট্টিখানি কথা হে? ওর মুখ দেখেই তো অন্নপ্রাশনের চাল পর্যন্ত হজম হয়ে যায়। এসো–এসো আমার সঙ্গে। দেখি, বাড়িতে ভাত-তরকারি কিছু আছে কি না।
পরমানন্দে দামু দারোগার সঙ্গে রওনা হল।
আর দারোগাবাবু ভাবছিলেন–যাক, বাঁচা গেল। একটা হাবা-গোবা চাকর খুঁজছিলুম অনেক দিন ধরে–অ্যাদ্দিনে পাওয়া গেল সেটাকে। একেই বলে বরাত।
.
আট
চোর ধরা পড়ল, বকশিশও জুটল, কিন্তু দারোগার বাড়ি থেকে দামুর আর ছুটি মেলে না। সন্ধেবেলা–যেদিন থানায় বিশেষ কাজ-টাজ থাকে না–সেদিন দামুকে পাক্কা দুটি ঘণ্টা ধরে দারোগার হাত-পা ডলাই-মলাই করতে হয়। আমেজে দারোগার চোখ বুজে আসে, আর দামু তখন তাঁর কানের কাছে সমানে ভ্যানর-ভ্যানর করতে থাকে : আমার হাতি কী হল? অ দারোগাবাবু, আমার হাতি?
মেজাজী ঘুমটা চটে যায়–দারোগা ভারি বিরক্ত হন বোকা লোকটার ওপর। ধমক দিয়ে বলেন : হচ্ছে–হচ্ছে, এত ব্যস্ত কেন?
কই আর হচ্ছে। এক মাস পেরিয়ে গেল যে।
হাতি কি আর চাড়ডিখানি জানোয়ার?–হাই তুলে দারোগা বলেন, পাঁঠা না গোরু যে গলায় দড়ি বেঁধে দিলুম ব্যাব্যা, হাম্বা-হাম্বা করে ডাকতে থাকল আর তুই হিড়হিড়িয়ে টেনে নিয়ে গেলি? অত বড় পেল্লায় একখানা কাণ্ড, তাকে ধরতে বিস্তর হ্যাঁপা। এখন চুপ করে থাক, সময় হলেই এনে দেব, আর তুই তখন তার পিঠে চেপে ড্যাং ড্যাং করতে করতে চলে যাবি।
বলতে বলতে দারোগা ঘুমিয়ে পড়েন আর কুড়ং কুড়ং করে তাঁর নাক ডাকতে থাকে।
আসলে, দামুকে পেয়ে দারোগাবাবুর আর তাঁর গিন্নির সুখের সীমা নেই, মাইনে-টাইনে কিছু তো দিতে হচ্ছে না–দামু মাইনে চায়ও না–বিনি পয়সায় এমন খাটবার লোক, এমন। একটি নিরেট বোকারাম আর কোথায় পাওয়া যাবে? শুধু হাত-পা-ই টেপে নাকি? কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে দিচ্ছে, বাগান কোপাচ্ছে, আস্ত-আস্ত গাছ হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে কেটে চ্যালা কাঠ বানাচ্ছে, কাঁড়ি কাঁড়ি বাসন মেজে দিচ্ছে। তার ওপরে গোরু চরানো তো আছেই।
দারোগা আর তাঁর গিন্নি দুধ-ক্ষীর এইসব খেতে খুব ভালবাসেন–কেই বা না বাসে, বলো? আর পেট পুরে দুধ-ক্ষীর-দই খাওয়ার জন্যে দারোগা গোটা সাতেক গোরু পুষেছেন। রোজ সকালবেলা নটা নাগাদ বাড়ির কাজকর্ম সেরে দামু বেরোয় গোরু চরাতে। রাতের খানিকটা বাসী রুটি-তরকারি গিন্নি-মা পুঁটলি করে বেঁধে দেন–সারাদিন তাই গিলে বিকেল পর্যন্ত দামু নদীর ধারে গোরু চরায়, তারপর বিকেল হলে গোরুর পাল তাড়িয়ে ফিরে আসে।
গোরু চরাতে দামুর যে খুব খারাপ লাগে তা নয়। বাড়িতে থাকলেই তো গিন্নি মার হাজারো ফাইফরমাস, তার চাইতে এ এক রকম ভালো। নিজের আনন্দে চেঁচিয়ে গান। গাওয়া যায়-এমনিতে কেউ তার গান শুনতে চায় না, হয়তো কেবল প্রাণ খুলে যাত্রাগানের একটা সুর ধরেছে : ও ভাই লক্ষ্মণ রে, কোথায় গেল জনকনন্দিনী–অমনি চারদিকে সবাই হইচই করে ওঠে: থাম-থাম কান ফেটে গেল) গোরুরাও তার গানে কোনও আপত্তি করে না। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, একটা লাল-শাদা আর একটা কালো গোরুকে নিয়ে। দারোগার গোক হলে কী হয়–সে-দুটো আইন কানুন কিছু মানে না। একবার ছাড়া পেল তো আর কথা নেই সঙ্গে সঙ্গে দে-দৌড়। লম্বা লম্বা ঠ্যাং নিয়েও দামু তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না, একেবারে ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে গোরু দুটো।
শুধু ছুটলেও বা কথা ছিল। এর কলাই খেতে নেমে সব মুড়িয়ে দিয়ে আসে, তার লাউয়ের মাচা টেনে নামায়, ওর বাগান ভেঙে ঢুকে কচি কচি পালং শাকগুলো একেবারে সাফ করে দেয়। গোৰু তো নয়–যেন দু-দুটো ডাকাত পুষেছেন দারোগা। তাঁর গোরু বলে লোকে আর তাদের ধরে খোঁয়াড়ে দিতে সাহস পায় না; কিন্তু দামুকে গালাগাল করে একেবারে ধুন্ধুড়ি উড়িয়ে দেয়!
কেমন বেয়াক্কেলে গো-মুখ রাখাল তুমি হে! গোরু সামলাতে পারো না।
গো-মুখ্য বলেই তো গোরু চরাই। হি-হি!–দামু হাসতে চেষ্টা করে।
আবার দাঁত বের করে হাসা হচ্ছে? বলি, আমার পালং শাকগুলো সব যে খেয়ে নিলে–তার দাম কে দেবে হে? তুমি?
আমি দেব কেন? দারোগাবাবুর গোরু, তাঁর কাছেই যাও না।
দারোগার কাছে আর কে পালংলা কলাইয়ের দাম চাইতে যাচ্ছে? জলে বাস করে কুমিরকে ঘাঁটানো–আরে ব্বাস! নিরুপায় লোকগুলো বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়–আর দূর থেকে দামুকে গাল পাড়ে।
কেলেভূত–ঊন-পাঁজুরে–বেয়াক্কেলে।
কিন্তু সবাই তো আর নিরীহ ভালোমানুষ নয়। শেষ পর্যন্ত একদিন একজন লোক এসে ক্যাঁক করে দামুর টুটি টিপে ধরল।
কী তার চেহারা! সেই হাতি-মাকা জগাই ঘোষকেও বলে তফাত থাকো! বুনো মোষের মতো জোয়ান, মুখে দেড় হাত দাড়ি, চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। দামুর ঘাড় চেপে ধরে বললে, দে শিগগির, আমার সাত সের ঝিঙের দাম দে।
সেই বজ্র টিপুনিতে দামুর দম আটকে আসবার জো।
ছাড়ো-ছাড়ো, আমি কোথায় পয়সা পাব মিঞা সাহেব।
পয়সা নেই তো আমার ঝিঙেগুলো গোরুকে দিয়ে খাওয়ালি কী বলে?
আমি তো খাওয়াইনি–নিজেই খেয়েছে। তোমার ইচ্ছে হয় দারোগাবাবুকে—
নিকুচি করেছে দাবোগাবাবুর! তুই রাখাল–সব দোষ তোর! বলে লোকটা দামুকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, চোখ কপালে চড়ে গেল দামুর।
আমি–আমি–দাবোগাবাবুকে বলে দেব।
দে বলে।–দাড়িওয়ালা লোকটা বিচ্ছিরি করে মুখ ভ্যাংচাল : তারপর আবার আসবি তো গোরু চরাতে? তখন তোর মুণ্ডটি ভেঙে নদীর বালিতে পুঁতে দেব–এই তোকে বলে গেলুম।
তারপর ঠাঁই-ঠাঁই করে কটা রাম চড়। সেই চড় খেয়ে দামু মাথা ঘুরে পড়ে গেল, যখন উঠল তখন দাড়িওয়ালা লোকটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে।
মনের দুঃখে দামু বসে বসে খানিকটা হাঁউমাউ করে কাঁদল। তার পিসিমার কথা মনে পড়ে গেল কতদিন দেশে যায়নি সেকথা ভেবে তার আরও কান্না পেতে লাগল। কী কুক্ষণেই যে রুনকুকে হাতি চড়াবার কথাটা বলেছিল সে।
একটু সামলে-সুমলে দেখে সামনেই সেই লাল-সাদা গোরুটা। সাত সের ঝিঙে খেয়ে এসে পরমানন্দে জাবর কাটছে এখন।
তোর জন্যেই এত কাণ্ড! দাঁড়া–মেরে পোম্বা উড়িয়ে দেব।
হাতে লাঠি ছিল না–দামু ঠেসে একটা চাঁটি বসিয়ে দিল গোরুকে। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ হল ফোঁসস! এক তঁতোয় গোরু দামুকে চিত করে দিয়ে ল্যাজ তুলে হন হন করে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।
সেদিন বাড়ি ফিরে দামুর আর ধৈর্য থাকল না। একে চড়ের জ্বালা, তার ওপরে গোরর অঁতো–মানুষের শরীরে আর কত সয়! দামু সোজা গোঁ-গোঁ করতে করতে দারোগাবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হল।
শিগগির হাতি দিন আমার। আমি চলে যাব।
দারোগা মুখ থেকে হুঁকো নামিয়ে বললেন, চলে যাবি মানে?
মানে, চলে যাব। আর আমি গোরু চরাতে পারব না।
পারবি না-বটে!–দারোগা মিটমিটে চোখে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ : যাবার চেষ্টা করেই দ্যাখ না। তোকে আমি তখুনি ধরে চোর বলে হাজতে পুরে দেব।
চোর বলে–অ্যাাঁ?–দামু শুনে আকাশ থেকে পড়ল : কেন, আমি কী চুরি করিচি তোমার?
আমার চুরি করবি কেন? গাঁসুন্ধু লোকের ঘরে সিঁধ দিয়েছিস।
আমি।
হুঁকোয় একটা জর টান দিয়ে দারোগা বললেন, আলবাত। সিঁদেল চোর না হলে আর অমন বিটকেল চেহারা হয় কারও? তুই পটাই চোরের দলের লোক–আমি বুঝেছি।
আমি পটাই চোরের দলের?–দামু কটা খাবি খেল শুনে : বা রে, আমি তাকে ধরিয়ে দিলুম, আর শেষে আমাকেই–
হাঁ-হাঁ, তোকেই–তোকেই হাঁড়ির মতো মুখ করে দারোগা বললেন, আমি বিশ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছি, চোর চিনি নে? কত ঘঘাড়েল চোরকে জেলে পাঠিয়ে ঘানি ঘোরালুম আর তুই তো তুই।–দারোগা হুঁকোয় আর একটা টান দিয়ে বললেন, আমি সব জানি। চুরির বখরা নিয়ে পটাইয়ের সঙ্গে তোর ঝগড়া হয়েছিল, তাই তুই তার ঘাড়ে চড়াও হয়ে ধরিয়ে দিয়েছিস, আর দিব্যি ভালোমানুষ সেজে সরকারের কাছ থেকে বকশিশ। নিয়েছিস। আমি ইচ্ছে করে তোকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ফের যদি হাতি-হাতি করে চ্যাঁচাবি কিংবা এখান থেকে সটকাতে চাইবি–তা হলে তোকে তখুনি আমি হাজতে চালান করে দেব। তারপরে পাক্কা ছটি মাস জেল।
অ্যাঁ।–
দামু হাঁ করে চেয়েই রইল, আর কথা ফুটল না তার মুখ দিয়ে।
দারোগা বললেন, আর যদি জেল খাটতে না চাস, তা হলে যেমন আছিস, তেমনি থাক–বাসন-টাসন মাজ, কাঠ চ্যালা কর, গোরু চরা। তোফা আরামে থাকবি। এই তোকে সাফ কথা বলে দিলুম। এখন যা–খানিক সর্ষের তেল এনে ভালো করে আমার হাঁটুতে মালিশ করে দে। বেশ টনটন করছে–বাতই হল কি না কে জানে।
এই বলে দারোগা পরম আরামে হুঁকো টানতে লাগলেন। আর তাঁর সেই মোক্ষম কথাগুলো শুনে গোটা তিনেক খাবি খেয়ে, দামু হুঁকোর মতো মুখ করে গিন্নি-মার কাছে সর্ষের তেল আনতে চলে গেল।
মুচকি হেসে দারোগা মনে মনে বললেন, পুলিশের খপ্পরে পড়েছ বোকারাম–এত সহজেই কি আর ছাড়ান পাবে? হুঁ–হুঁ—
.
নয়
হাঁড়ির মতো মুখ করে দামু দারোগার পায়ে তেল মালিশ করতে লাগল, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন দারোগা, গুড়গুড় করে নাক ডাকতে থাকল তাঁর। তখন দামু উঠে পড়ল সেখান থেকে, তারপর দারোগার বাসা থেকে বেরিয়ে সুড়সুড় করে এসে থানার বারান্দায় বসে পড়ল।
ইস, প্যাঁচখানা দ্যাখো একবার। কী কুক্ষণেই যে সে হাতির বাচ্চা ভেবে পটাই চোরের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছিল, তারপর থেকেই এই যাচ্ছেতাই কাণ্ড! পটাই এখন কোনও জেলে আছে নিশ্চয়, অনেক ভালোই আছে তার চাইতে। সেও তো কয়েদী, দারোগাবাবুর হাত থেকে ছাড়া পাবার কোনও রাস্তাই তো দেখা যাচ্ছে না। জেলে গেলে নাকি ঘানি ঘোরাতে হয়, পটাইও নিশ্চয় ঘোরাচ্ছে, কিন্তু দামুর মনে হল তার চাইতে অনেক সুখেই আছে সে। তাকে তো আর দুটো হাড়বজ্জাত গোরু চরাতে হয় না, সেই গোরুর গুতো খেতে হয় না, কোত্থেকে একটা দাড়িওলা বিটকেলে লোক এসে তাকে ঠাঁই-ঠাঁই করে চাঁটিয়ে দেয় না! আর কাঠ চ্যালা করা–ওঃ! একদিন তো কুড়ল ফসকে তার একখানা পা-ই চ্যালা হয়ে যাচ্ছিল।
অথচ, দারোগাবাবুকে কী নিপাট ভালোমানুষটিই মনে হয়েছিল তখন! এমন মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বললেন যে দামু ভেবেছিল–গণ্ডা গণ্ডা হাতি তাঁর গোয়ালঘরে বাঁধা আছে, যখন ইচ্ছে দামুকে একটা বের করে দেবেন। দ্যাখো এখন! হাতি তো দূরে থাক, চলে যেতে চাইলে হাজতে পুরে দেবেন বলে শাসাচ্ছেন,আর বলছেন সে-ও পটাই চোরের দলের লোক।
এখন কী করবে সে? পালাবে?
কিন্তু পালিয়ে কি রেহাই মিলবে দারোগার হাত থেকে? ঠিক চৌকিদার পাঠিয়ে ধরে আনবেন, তারপর বরাতে যে কী আছে ভগবানই জানেন। তা অমন ধড়িবাজ দারোগার খপ্পরের চাইতে জেলে ঘানি ঘোরানোও ভালো। কিন্তু—কিন্তুক–হাতির কী হবে? যেমন করে তোক রুনকুকে যে হাতি চাপাতেই হবে তার। রুনকু–দা-ঠাকুর–সক্কলে যে তারই জন্যে পিত্যেশ করে বসে আছে!
দামুর ইচ্ছে হল, খানিকক্ষণ ডাক ছেড়ে গাঁ-গাঁ করে কাঁদে, পিসিমার নাম ধরেই কাঁদে। এই দারুণ বিপদে পিসিমা কাছে থাকলে যা-হোক একটা উপায় বাতলে দিতে পারত। খুব বুদ্ধি আছে পিসিমার। কিন্তু, এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোথায় পাওয়া যাবে পিসিমাকে?…
আরে ফাগুয়াকো রাত হো,
শ্যাম হোরি খেলে হো,
আরে লালে লাল হো,
আরে চ্যারারা-রা-রা-রা—
বিকট গানের আওয়াজে বেজায় রকমের চমক খেল দাম, থানার বারান্দা থেকে নীচে ঘাসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে অনেক কষ্টে সামলে গেল। খাকি শার্ট পরে, দেহাতী চামড়ার জুতো মচমচিয়ে থানার কনস্টেবল ছত্তেরি সিং আসছে। তারই মোটা গোঁফের ফাঁক দিয়ে বেরুচ্ছে এই ভয়ঙ্কর গান : আরে ফাগুয়াকো রাত হে, চ্যা-রা-রা-রা–! ফাগুয়া–মানে দোলের বেশ দেরি আছে, কিন্তু ছত্তেরি সিং এখন থেকেই মশগুল। আজ সারা সকাল বসে বসে সে তার ঢোলে নতুন করে ছাউনি দিয়েছে।
থানার বারান্দায় যে কেরোসিনের আলোটা ঝুলছিল, তাইতে দামুর প্যাঁচা-মাকা মুখোনা দেখতে পেল ছত্তেরি সিং। গান থামিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে এল দামুর দিকে।
–এ দামু ভেইয়া, ক্যা ভইল বা?
–কী আর হবে সেপাইজী? মন-মেজাজ ভারি খারাপ।
–কেননা? মেজাজ খরাব হইলো কেনো?–ছত্তেরি সিং মুচকি হাসল : হাঁথি নেহি মিলা?
দামুর হাতির গল্পটা সকলেরই জানা। ছত্তেরি সিংও জানে।
–কোথায় হাতি?–আরও ব্যাজার হয়ে দামু বললে, খালি বলেন, হবে–হবে। আজ অ্যাদ্দিন হয়ে গেল, হাতির ল্যাজ অবধি দেখতে পেলুম না। আজ রাগ করে বলেছিলুম, চলে যাব–তাতে শাসিয়ে বলেছেন, তা হলে আমায় চোর বলে হাজতে ভরে দেবেন। ইকি ল্যাঠায় পড়লুম বল দিকিনি সেপাইজী!
ছত্তেরি সিং এবার আর হাসল না। দামুর পাশে এসে বসে যে গম্ভীরভাবে হাতের তেলোয় খইনি ডলতে লাগল। তারপর গম্ভীর হয়ে বললে, আভি হম তো সব কুছ সমঝলাম (সব কিছু বুঝে ফেলেছি)।
দামু আকুল হয়ে বললে, কী সমঝালে সেপাইজী?
–বোলো, বড়বাবুকে (মানে দারোগাকে) হামার কথা তুমি বোলবে না?
–না, বলব না।
–হামি জানে, বড়বাবু তুমাকে ছোড়বে না।
–ছাড়বে না? কেন?
–আরে মাহিনা দিতে হোবে না, কুছু না–নোকর (চাকর) বড়বাবু ছোড়বে? অ্যায়সা আদ–মি নেহি! বড়বাবু তুমাকে কভি ছোড়বে না।
বা-রে!–দামু ফাঁস করে উঠল : বিনা মাইনেয় ওঁর চাকরি করবার জন্যে বুঝি আমি দেশ-গাঁ ছেড়ে এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে এসে পড়ে আছি। আমার হাতির তা হলে কী হবে?
–হাঁথি? আঁথি!–এক খাবলা খইনি মুখে পরে ছত্তেরি সিং বললে, আমি একটা সচ বাত (সত্যি কথা) বোলবে দামু দাদা–তুমি গোঁসা করবে না। তুমি বহুৎ বুন্ধু (বোকা) আছে। আরে দারোগাবাবু হাঁথি কাঁহাসে পাবে? মাজিস্টর (ম্যাজিস্ট্রেট) সাহেব ভি হাঁথি মিলাতে পারে না–উ তো রাজা-মহারাজা কা জাবর (জানোয়ার) আছে।
–তা হলে কী হবে সেপাইজী?–দামু এতক্ষণে কেঁদে ফেলল : সারা জন্ম আমায় এমনি করে দারোগাবাবুর গোরু চরাতে আর কাঠ ফাড়তে হবে নাকি?
ছত্তেরি সিং বললে, আমি বোলে কি, তুমি হিয়াসে ভাগো!
–ভাগব?
–জরুর। আভি ভাগো। আজ রাতমে ভাগো।
–যদি ধরে আনে?
–কেইসে ধরবে? আরে দাদা তুমার ডর কী আছে? তুমি তো চোরি-উরি কুছ করেনি। তুমি বুন্ধু আছে–তাই বড়বাবু ঝুটমুট উসব বাত বোলে। তুমাকে কোই ধরবে না। ভাগ যাও।
–কিন্তু হাতি কোথায় পাব?–আকুল হয়ে জানতে চাইল দামু।
–হাঁ, ওহি বাত। আবার কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভাবল ছত্তেরি সিং। তারপর বললে–হাঁ, এক কাম করো। তুমি আসাম মে চলা যাও।
–আসাম!–অবাক হয়ে দামু হাঁ করল : সে আবার কোথায়?
–কুছ দূর তো হবে।–ভেবে-চিন্তে ছত্তেরি সিং বলতে লাগল : রেল গাড়ি মে চড়ে যেতে হয়। উহা পর হাঁথি মিল সকতা (ওখানে হাতি পাওয়াও যেতে পারে)।
–ওখানে হাতি থাকে বুঝি?
–হাঁ, বহুৎ। জঙ্গল মে থাকে। উহাসে তো হাঁথি ধরে হামার দেশে শোনপুরের মেলা মে বেচতে লিয়ে আসে। তুমি আসাম মে যাও।
দামু একটু চুপ করে রইল। নানা অবস্থায় পড়ে এতদিন সে বুঝেছে, হাতি যোগাড় করা সোজা নয়, অনেক টাকা লাগে। বকশিশের একশো টাকা আর ট্যাঁকের কটা টাকা দিয়ে আর যাই করা যাক–হাতি কেনা যায় না।
মাথা চুলকে দামু বললে, কিন্তু আমি কি হাতি কিনতে পারব?
–আরে–তুমি কিনবে কেমন কোরে? রাজা-মহারাজা সব কোই পারে না, জিলার মাজিস্টর সাহেব ভি পারে না। যে লোগ াঁথি ধরে–উসসে পাস যাও। কাম-উম করে দাও–সাথ-সাথ রহো (কাজ-টাজ করে দাও, সঙ্গে সঙ্গে থাকো)খুশ করো, উসকে বাদ একঠো হাঁথি বখশিশ মাঙ্গ (চেয়ে) লেও।
–দেবে?
–দে সকতা (দিতেও পারে)। খুশি হোলে কেনো দিবে না?
আর বলতে হল না। দামু লাফিয়ে উঠল এবার।
–সেপাইজী, আমি আসামেই যাব।
–হাঁ যাও।-ছত্তেরি সিং ভরসা দিয়ে বললে, কুছ ডর নেহি দাদা, তুমি বহুৎ ভালা আদমি আছে–তুমার ভালা হোবে। এখানে বড়বাবু তোমাকে বুদ্ধ বানিয়েছে, তাই আমার বহুৎ দুখখো হইলো–এহি শলা (পরামর্শ) তুমাকে দিলাম। চলা যাও ভাইয়া-আজহি চলা যাও।
দামুর চোখ জলে ভরে গেল!
–সেপাইজী, খুব উগার করলে আমার। এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, হাতি যদি পাই তোমাকে পেট ভরে আমি মোণ্ডা খাওয়াব।
–আচ্ছা-আচ্ছা, আগে হাঁথি মিলে, তবে তো!–ছত্তেরি সিং হাসল।
সেই রাতেই রওনা হল দামু। দারোগা আর তাঁর গিন্নি তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। ছত্তেরি সিং তাকে স্টেশনের রাস্তা বলে দিয়েছিল। মাইল পনেরো রাস্তা বাসে চেপে যেতে হয়। কিন্তু পাড়াগাঁয়ে আর অত রাতে বাস কোথায়? তা ছাড়া ছত্তেরি সিং-এর কথায় দামুর ভরসা নেইবাসে যদি কেউ তাকে চিনে ফেলে আর দাবোগাকে গিয়ে খবর দেয়? সর্বনাশ! উঁহু, বাস পেলেই চেপে বসবে, দামু এমন কাঁচা ছেলে নয়।
লম্বা লম্বা ঠ্যাংয়ের কাছে পনের মাইল কিছুই নয়-দামুর হাঁটবার অভ্যেস আছে, দেখতে-দেখতে সে পথ পেরিয়ে গেল। চতুর্দশীর জ্যোৎস্না ছিল আকাশে, কোনও অসুবিধে হল না। কেবল দু-চার বার তাকে দেখে গাঁয়ের কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করে উঠেছিল কয়েকটা শেয়াল খ্যাঁচম্যাচ করে এদিক-ওদিক ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল, একজন চৌকিদার কে যায় গো বলে হাঁক দিয়ে দামুর সামনে এসেই–ওই বিকট মূর্তি, মস্ত পাগড়ি আর লম্বা লাঠি দেখে, ভূত ভেবে–বাবা গো বলে দৌড় দিয়েছিল। আসাম যাওয়ার উৎসাহে দামু এ সব কিছুই গায়ে মাখেনি; থানার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে মাইল পাঁচেক এসেই সে একটা করুণ গান ধরেছিল–ও রাম, কেন তুই যাবি বনবাস–আর এই গান গাইতে গাইতেই ঠিক ভোরবেলায় এসে সে রেলের ইস্টিশনে পৌঁছে গেল।
আসাম যেতেই হবে। কিন্তু তার আগে–।
তার আগেই দামুর চোখে পড়ল স্টেশনের লাল ইটের দেওয়ালে ছবিওলা একটা মস্ত পোস্টার। হাতি-ঘোড়া বাঘ-ক্লাউন–তারের ওপরে সাইকেল চালাচ্ছে মেয়েরা, ফ্লাইং ট্রাপিজ থেকে একজন শূন্যে উড়ে যাচ্ছে। আর, আর লেখা আছে–দি গ্রেট হিমালয়ান সাকাস। চমকপ্রদ হাতি আর বাঘের খেলা। রহিমপুরের মেলায় দেখানো হইতেছে। এমন সুযোগ–
দামু সামান্য যেটুকু লেখাপড়া জানত, তাতে ওটুকু সে এক রকম পড়ে ফেলল। নেচে উঠল তারপরেই।
সে কোথায় যাবে ঠিক হয়ে গেছে। আসাম নয় রহিমপুরে।
.
দশ
এই সকালবেলাতেই একজন লোক ইস্টিশনের বাইরে বসে, একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে, শিশিরে ভিজে ভিজে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে, কুড়মুড় কুড়মুড় করে মুড়ি খাচ্ছিল আর একটা পাকা লঙ্কায় একটু একটু করে কামড় দিয়ে হুস-হুঁস করে শিস টানছিল। দামু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার খাওয়া দেখল, তারপর ডাকল, ও মশাই।
লোকটি বললে, উঁ–হু–উস। আমায় কিছু বলছ?
এজ্ঞে আপনাকেই তো!
হুস–কুড়মুড় কুড়। তা কী বলবে বলে ফ্যালো।
এজ্ঞে সার্কেসটা কোন দিকে হচ্ছে?
সার্কেস? হু উ-উস!–একবার লাল লঙ্কার শেষটুকু অবধি দাঁতে কেটে নিয়ে, তার বোঁটাটা নাকের কাছে ধরে, লোকটা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দামুর দিকে। লঙ্কার ঝালে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, বাঁ-হাতে সেটা মুছে ফেলে বললে, সার্কেস হচ্ছে ওই ওদিকে রথতলার মাঠে। কিন্তু তুমি কে হে?–দামুর সেই তালট্যাঙা চেহারা, মাথায় সেই জাঁদরেল পাগড়ি আর হাতের সেই জবরদস্ত লাঠির ওপর খানিকটা চোখ বুলিয়ে নিয়ে শেষে বললে, বুঝিচি।
কী বুঝেছ হে?
তুমি নিযস সার্কেসের খেলুড়ে। চেহারাতেই মালুম হচ্ছে।
দামু আপত্তি করে বললে, না, আমি কখনও সার্কেসের খেলুড়ে নই।
বললেই হল দাদা? কুড়কুড়কুড়। সার্কেসের লোক না হলে এমন উদভুট্টে চেহারা হয়। কারুর? তোমায় রাতের বেলা রাস্তায় দেখলে আমারই যে ভিরমি লেগে যেত হে!
দামু রাগ করে বললে, মেলা বোকো না। আমার চৌদ্দ পুরুষ সার্কেসের খেলুড়ে নয়।
তাই নাকি? হু-উ-স! তবে তুমি কোথায় খেলা দেখাও দাদা? কুড়-মুড়-কুড়। রাত-বিরেতে আমগাছে জামগাছে নাকি? রাম—রাম–রাম! ভূত আমার পুত, শাঁকচুন্নি আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে–
ধ্যাত্তোর–কী একটা বেহেড লোকের পাল্লায় পড়লুম।–দামু গজগজ করতে লাগল : তুমি বকর বকর করো বসে আর মুড়ি গিলে ময়রা–আমি যাচ্ছি।
পিছন থেকে খ্যাঁকর-খ্যাঁকর করে হাসতে থাকল নোকটা। দামু হনহন করে চলল। রথতলার মাঠের দিকে।
চিনিয়ে দিতে হল না সাকাসের তাঁবু, তার মাথার ওপর দিয়ে দড়িতে লাল-নীল পতাকার সার অনেক দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। তার সামনে পৌঁছে দামু খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল। ওরেব্বাকত ছবি টাঙিয়েছে এখানে-ওখানে! সাইকেলে চেপে বাঁদর চলে যাচ্ছে–দড়ির দোলনা থেকে কারা যেন পরীর মতো আকাশে উড়ে চলেছে, হাতিরা লাল বল নিয়ে খেলা করছে, একজন আবার রাজপুত্তুরের মতো পোশাক পরে-হাতে চাবুক নিয়ে তিন-তিনটে সিঙ্গীকে শাসাচ্ছে।
কিন্তু দামু সব ছবি দেখছিল না–তার নজর শুধু হাতির দিকে। আহা–অমন একখানা হাতি যদি তিন দিনের জন্যও তাকে দেয়। শুধু যে রুনকু দিদিকে পিঠে চাপিয়ে দাদুর বাড়িতে নিয়ে যাবে তা নয়–দিদির সঙ্গে রাঙা বল নিয়ে এক-আধটু খেলাও করবে হয়তো। কী চমৎকার যে হবে তা হলে! ভাবতে গিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে উঠতে ইচ্ছে হল দামুর।
সামনের বড় গেটটা পেরিয়ে দামু একেবারে তাঁবুর কাছে চলে এল। বাইরে একটা খাঁচার। ভেতরে চার-পাঁচটা বাঁদর লাফালাফি করছিল, কয়েকটা বাচ্চা গাঁয়ের ছেলে হাঁ করে বাঁদর দেখছিল আর বাঁদরগুলো ভেংচি কাটছিল তাদের। দামুও কিছুক্ষণ সেসব দেখল। তিনটে ঘোড়া চি-হি-হি করছিল এক জায়গায় আর শাদা পোশাক-পরা দুজন লোক বালতি করে জল দিচ্ছিল, একজন মালকোঁচা মারা গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান থাবড়ে থাবড়ে গা পরিষ্কার করছিল তাদের।
দামু এদিক-ওদিক তাকাল। কিন্তু যে-হাতির জন্য সে এখানে এসেছে, তাদের কাউকে সে দেখতে পেল না। সাকাসের হাতিদুটোকে ছেলেপুলেরা বিরক্ত করে বলে ম্যানেজার তাঁবুর ওপাশে–ভেতর দিকে বেঁধে রেখেছিল তাদের।
যারা ঘোড়া ধোয়াচ্ছিল, এবার তাদের নজর পড়ল দামুর দিকে। বেড়ে মূর্তিটি তো! এমন জীব তত সহজে চোখে পড়ে না!
একজন জিজ্ঞেস করলে, ওই ওহে–তোমার নাম কী?
সাহস পেয়ে দামু বললে, আমি? আমার নাম দামু দাস।
সার্কাসে চাকরি করবে?
শুনে যে দামুর মনটা একবার ছটফট করে উঠল না, তা নয়। সার্কাসের চাকরি? আহা–তার মতো সুখের আর কী আছে! রোজ বিনি পয়সায় হাতি-ঘোড়া বাঘ-ভাল্লুকের। খেলা দেখা যাবে, হয়তো বা হাতিতে চড়াও যাবে কখনও কখনও। লোকে কত খাতির করবে-বলবে, সাবাস-সাকাসের খেলুড়ে। হয়তো অনেক মাইনেও দেবে কে জানে, এক কুড়ি টাকাই কি না!
কিন্তু তা হয় না। আগে রুনকু দিদির জন্যে হাতি যোগাড় করে তবে অন্য কথা। দামু গম্ভীর হয়ে বললে, না–আমি এখন চাকরি করব না।
কেন হে–আপত্তি কী?–একটা লোকের নাকের নীচে মাছির মতো একটু গোঁফ ছিল, সে মিটমিট করে হেসে বললে, আমাদের খাঁচায় শিম্পাঞ্জি নেই–অনেক দাম, তুমি থাকলে তোমাকে দিয়েই কাজ চলে যেত।
শিম্পাঞ্জি?–দামু অবাক হয়ে গেল সে কাকে বলে?
নিজেই তো তুমি শিম্পাঞ্জি হে–চেনো না? বেশ খাঁচায় থাকবে–কলাটা-মুলোটা খেতে দেব–নেচে নেচে খেলা দেখাবে–হি-হি-হি!
সব লোকগুলো একসঙ্গে হাসিতে গড়িয়ে পড়ল।
দামু বোকা হলেও বুঝতে পারল এরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে, আর শিম্পাঞ্জি নিশ্চয় কোনও জানোয়ারের নাম। বানর-টানরই হবে হয়তো বা।
দামু গজগজ করে বললে, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা কইব না। সার্কেসের মালিকের সঙ্গে দেখা করব।
মালিক? তার সঙ্গে তোমার কী কাজ?
দরকারি কথা কইব।
দরকারি কথা?–লোকগুলো একটু অবাক হয়ে হাসি বন্ধ করল : কী কথা?
তাঁর ঠেয়ে বলব।
লোকগুলো একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর একজন এগিয়ে এসে বললে, আমাকে বলতে পারো, আমিই মালিক।
দামুর ঠিক বিশ্বাস হল না! কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বললে, একটা জিনিস আমি চাইতে এসেছি। এই তিন দিনের জন্যে।
কী সেটা?
একটা হাতি।
কী বললে?-লোকগুলো একসঙ্গে হাঁ করল : কী বললে তুমি?
দামু আবার গম্ভীর হয়ে জবাব দিলে : হাতি–একটা হাতি। রুনকু দিদির ওখানে নিয়ে যাব–দিদি সেটাতে চেপে দাদুর বাড়িতে–
দামুর কথাটা শেষ হতেও পেল না! লোকগুলো চারদিক ফাটিয়ে হেসে উঠল হা-হা করে। একজন বললে, পাগল, আর একজন বললে, দে ওর মাথাটা ঠাণ্ডা করে।
ঝপাৎ–ছলাৎ! একেবারে পুরো এক বালতি ঘোড়া-ধোয়ানোর ময়লা জল এসে পড়ল দামুর মুখে। সেই জলের ঘায়ে উল্টে পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দামু দেখল, আর-এক বালতি তুলে ধরেছে আর একজন।
গিছি গিছি–বাবা গো–বলে টেনে দৌড় দিলে দামু। যে বাচ্চাগুলো এতক্ষণ বাঁদরের ভেংচি দেখছিল, পাগলা-পাগলা বলে তারাই তাড়া করল দামুকে।
ছুটতে ছুটতে দামু চলে এল প্রায় গাঁয়ের বাইরে। তারপর সামনে একটা জংলা বাগানের ভেতরে মস্ত একটা পোড়ো বাড়ি দেখতে পেয়ে ঢুকে গেল তার ভেতরে।
না ঢুকে উপায় ছিল না। প্রায় শ তিনেক ছেলে তার পিছু নিয়েছিল আর সমানে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাচ্ছিল : পাগলা–হাতি-পাগলা। দামু এতক্ষণে বুঝতে পারছিল, হাতির নাম শুনলেই সেই জগাই ঘোষ অমন করে খেপে যায় কেন।
একটা ভাঙাচুরো অন্ধকার ঘরের ভেতরে, ইটের ওপর মাথা রেখে সারাদিন মনের কষ্টে চুপ করে পড়ে থাকল দামু। আজকে তার কিছুই খাওয়া হয়নিদারুণ দুঃখে সেই খিদের কথাটাও একেবারে ভুলে গেল সে। পাওয়া গেল না-হাতি পাওয়া গেল না। দাদাঠাকুরের অপমান হল, রুনকু দিদি দাদুর বাড়িতে যেতে পারল না, দামুর কথার খেলাপ হয়ে গেল। না–সে আর দেশে ফিরবে না। এইবার একদম বিবাগী হয়ে–যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই চলে যাবে।
ছত্তেরি সিং বলেছিল, আসামের জঙ্গলে হাতি ধরে, সেখানে গেলে চেয়ে-চিন্তে একটা হাতির বাচ্চা আনা যায়। কিন্তু তারাও কি দেবে। হয়তো এমনি পাগল বলেই তাড়িয়ে দেবে তাকে। দামুর গাঁয়ের কথা মনে পড়ল, পিসিমার কথা মনে পড়ল, ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগল দামু।
দিনটা এইভাবে কেটে গেল, বেলা পড়ল, সন্ধ্যার অন্ধকার নামল পোড় বাড়িতে ঝিঁঝি ডাকতে লাগল, দামুর ভয় ধরে গেল।–ভাবল, এই বেলা উঠে পড়ি এখান থেকে–আঁধারে আঁধারে পালিয়ে যাই স্টেশনের দিকে। এমন সময়–
এমন সময় হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজ। কারা যেন চুপিচুপি কথা কইছে!
ভূত। পিলে চমকে উঠল। তারপরেই দামুর চোখে পড়ল, ঘরটার ফাটা দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আলো আসছে। পাশের ঘরে কারা যেন কথা বলছে।
দামু চোখ এগিয়ে নিলে ফাটলের দিকে।
আর পরিষ্কার শুনতে পেল : হাঁ, ওই সার্কাসের তাঁবুতে। আজ রাত্তিরেই আগুন দিতে হবে– ব্যাটাচ্ছেলেরা কালু নস্করকে চেনে না।
আরও খাড়া হল দামুর কান, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার।
শুনতে শুনতে দামুর যে কেবল কান খাড়া হল তা নয়, সারা বুক ধড়ফড় করতে লাগল, হাত-পা হিমহয়ে আসবার জো হল। বলে কী লোকগুলো! সার্কেসের তাঁবুতে আগুন লাগিয়ে দেবে! ই কী সব্বোনেশে কথা গো!
কালু নস্কর বলে লোকটার কালো কালো বেঁটে চেহারা, হাত ভর্তি বড়বড় রোঁয়া, নাকের নিচে ছাঁটামতন গোঁফ আর মুখে ইয়া ইয়া দাঁত। রেগে সে দাঁত কটমট করছিল আর গোল-গোল চোখ দুটো তার বনবন করে পাক খাচ্ছিল। দেওয়ালের ফাটল দিয়ে লণ্ঠনের
আলোয় দামু তার যেটুকু দেখল–আত্মারামকে আঁতকে দেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট।
কালু নস্কর বললে, বুঝিচিস তো হেবো?
হেবো বললে, বিলক্ষণ–বুঝিনি আবার! এক-টিন কেরোসিন ঢেলে দেব তাঁবুর গায়ে। তারপরে একটা দেশলাইয়ের কাঠির ওয়ান্তা। ব্যস–খেল খতম।
খতম বলে খতম। আর কারদানি করে সাকাস দেখাতে হচ্ছে না বাছাদের! আমি কালু নস্কর-সাতখানা গাঁয়ের ঝানু কাপ্তান–আমাকে পাশ দেবে না? বলে, বিনি-পয়সায় সাকাস দেখা যায় না রাস্তায় মাদারীর খেল দ্যাখো গে। ঠিক আছে–এবার তোদেরই আমি মাদারীর খেল দেখাচ্ছি কালু এমন করে দাঁত বের করল যে দামুর মনে হল, এখুনি সে কাউকে খ্যাঁক করে কামড়ে দেবে।
হেবো বললে, মাঝরাতে তো?
মাঝরাতে বই কি। সামনেই ওদের লোক জেগে থাকে, পিছনে বড় কেউ থাকে না–সে আমি নজর করে দেখেছি। আর থাকলেও বুঝলি তো আমরা তিনজন আছি, জাপটে ধরে কপ করে হাত-মুখ বেঁধে ফেলব।
সঙ্গে যে আর-একটা জোয়ান লোক ছিল, সে বললে, গাঁট্টা মেরে একেবারে চুপ করিয়ে ফেলব।
কালু বললে, ঠিক আছে, এই কথাই তা হলে রইল। চল–উঠে পড়ি এবার। ওদিকে আবার সব ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা করতে হবে।
হেবো লণ্ঠন নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কালু আর জোয়ান লোর্কটাও উঠল। তারপর তিনজনে যে সুট করে কোন দিকে চলে গেল, দামু তা আর ঠাহর করতে পারল না।
পোড়ো জংলা বাড়িটাকে ঘিরে তখন অথই অন্ধকার নেমেছে। দামু মশার কামড় খেতে-খেতে, প্যাঁচার ডাক শুনতে-শুনতে ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। স্বপ্ন দেখলম নাকি? সার্কেসের তাঁবুতে–মাঝরাত্তিরে–এক-টিন কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেবে? পটাই চোর কোথায় লাগে এদের কাছে? এরা তো ডাকাতের ওপরেও এক কাঠি।
সব্বোনাশ–সব্বোনাশ! এখুনি তো সার্কেওলাদের খবরটা দিতে হয়।
দামু হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল খানিকটা। ঘরের বাইরে মুখ বের করে দেখল–চারদিকে শুধু অন্ধকার, এখানে-ওখানে ইটের পাঁজা, গাছপালাগুলো কালো কালো ভূতের মতো দুলছে। না–জন-মনিষ্যিরও সাড়া নেই কোথাও। কালু নস্করের দলবল সেই অন্ধকারের ভেতরে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে।
দামু উঠে পড়ল। তারপরেই টেনে দৌড়।
আর কোথাও নয়–একেবারে সোজা সাকাসের তাঁবুর দিকে।
তখন সাকাস আরম্ভ হয়ে গেছে। একেবারে জমজমাট। শুধু এই গঞ্জই নয়, চারদিকের সব গাঁ ঝেটিয়ে লোক এসেছে সাকাস দেখতে। ভেতরে চলছে ছুটন্ত ঘোড়ার খেলা। সাকাসের মালিক নিজেই রিং-মাস্টার, ঘোড়া আর বাঘ-সিঙ্গীর খেলা সে-ই দেখায়। বেশ জবরদস্ত পোশাক পরে, গলায় মেডেলের মালা দুলিয়ে–চাবুক সাঁই সাঁই করে ঘোড়ার দৌড় করাচ্ছে। ওদিকে আবার দুজন ক্লাউন নেমেছে এসে–একজন একটা ঘোড়ার পেট ধরে ঝুলছে আর একজন ঘোড়ায় চাপতে গিয়ে ধপাস ধপাস করে আছাড় খাচ্ছে। হেসে কুটিপাটি হচ্ছে লোক, ক্ল্যাপও দিচ্ছে ঘন ঘন।
এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে দামু এসে গেটে হাজির।
আমি সার্কেসের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করব–এক্ষুনি।
কেন–কী দরকার?
ভীষণ ব্যাপার আছে একটা। সব্বেনাশ হয়ে যাবে।
দামুর বিটকেল চেহারা আর তার ভাবভঙ্গি দেখে গেটকিপার চটে গেল।
এঃ, ভারি একটা লাটসায়েব এসেছেন সব্বোনাশ হয়ে যাবে! যাওয়াও–মেলা। ঝামেলা কোরো না। ম্যানেজার এখন খেলা দেখাচ্ছেন কিছু বলতে হয়, সকালে এসে বোলো।
না–এখুনি বলতে হবে। পথ ছেড়ে দাও শিগগির-বলে দামু গেটকিপারকে ধাক্কা মারল একটা।
আরে–আচ্ছা লোক দেখছি তো।–গেটকিপার দামুর ঘাড়টা চেপে ধরল : পাগল নাকি?
ভারি গোলমাল শুরু হল একটা।
কোন দিক থেকে সেই দুটো লোক এগিয়ে এল–সেই যারা সকালে ঘোড়া ধোয়াচ্ছিল। দামুকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল তারা।
আরে এই তো সেই পাগলা। সকালে হাতি চাইতে এসেছিল।
পাগলা-পাগলা বোলো না বলে দিচ্ছি।–দামু চেঁচিয়ে উঠল : উদিকে রাত্তিরে লোকে তাঁবুতে আগুন দিতে চাইছে, আর এরা–
হাতি ছেড়ে এবারে আগুন।–লোকগুলো হা-হা করে হেসে উঠল : মাথায় একটা-একটা খেলে ভালো। যা পাগলা–শিগগির ভাগ এখান থেকে
তোরা পাগল–তোরা ভাগ। আমি ম্যানেজারবাবুকে বলবই। নইলে রাত্তিরে যদি আগুন ধরিয়ে দেয়
হা-হা-হা-হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ল লোকগুলো।
সরো–আমায় যেতে দাও বলছি বলে দামু এবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল গেটকিপারের ওপর। আর তক্ষুনি তিন-চারটে লোক সাপটে ধরল তাকে।
এই পাগলটা তো দেখছি এখানে আর সাকাস করতে দেবে না। আবার যাঁড়ের মতো চাঁচাচ্ছে দ্যাখ না। হাত-পা মুখ বেঁধে ফ্যাল শক্ত করে।
তাই হল। দামুকে তারা আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল বস্তার মতো। গোঁ-গোঁ করতে লাগল দামু। সার্কাসের জিমন্যাস্টিক করা জোয়ান লোক সব–তাদের সঙ্গে সে পারবে কী করে?
একজন বললে, চল–এটাকে ম্যানেজার সাহেবের তাঁবুতে ফেলে রেখে আসি। যা করবার তিনিই করবেন এখন।
কী আর করবেন–আচ্ছা করে ঠ্যাঙাবেন।
কিংবা থানায়-টানায় পাঠিয়ে দেবেন–যা খুশি।
বলে তারা চ্যাং-দোলা করে দামুকে তুলে নিয়ে গেল।
তাঁবুর বাইরে গোলমাল একটু হচ্ছিল বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তখন জমাট খেলা, ক্ল্যাপ আর হাসির আওয়াজ–ম্যানেজার কিছুই টের পাননি। ঘণ্টা দেড়েক বাদে, খেলা শেষ হলে, ভেতরে এসে তিনি অবাক হয়ে গেলেন–এটা কী রে? কোনও আজব জানোয়ার নাকি?
লোকেরা বললে, স্যার–ওটা পাগল।
মানে?
সকালে কদিনের জন্যে হাতি ধার চাইতে এসেছিল।
সে কী?
আর বলেন কেন স্যার, আমরা তখন তাড়িয়ে দিলুম। আবার সন্ধেবেলায় এসে ভারি হাঙ্গামা আর মারামারি বাধিয়ে দিলেবলে, আপনার সঙ্গে দেখা করবে কারা রাত্তিরে নাকি তাঁবুতে আগুন দেবে–হা-হা-হা!
ম্যানেজার দামুকে একটা খোঁচা দিলেন, দামু সাড়া দিলে না।
মুখটা খুলে দাও।
খোলা হল–তবুও দামুর সাড়া নেই।
কাল সারা রাত জেগে পথ-চলা, আজ গোটা দিন না-খাওয়া, ভয়ে-দুঃখে-ক্লান্তিতে দামু মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে কিছুতেই আর জাগানো গেল না।
ম্যানেজার বললেন, রাত্তিরটা থাক পড়ে। সকালে তাড়িয়ে দিস।
কিন্তু তাঁবুতে আগুন! কেমন যেন বেয়াড়া কথাটা। বলুক পাগলে, তবু মনের ভেতরটা খচখচ করতে লাগল। একটু সাবধানে থাকলে ক্ষতি কী। তাতে তো পয়সা লাগে না।
বন্দুক নিয়ে জেগেই রইলেন ম্যানেজার। পাঁচ-সাতজন লোককে রেখে দিলেন পাহারায়।
.
দামু একবার চোখ মেলল মাঝরাতে।
বাইরে দারুণ হট্টগোল তখন। দুমদাম করে গোটা দুই বন্দুকের আওয়াজ। কেরোসিনের টিনসুষ্ঠু ধরা পড়েছে কালু নস্কর আর তার সঙ্গী জোয়ান লোকটা। হেবোকে ধরা যায়নি,
অন্ধকারে ছুটে পালিয়েছে সে।
কিন্তু খিদেয়, ক্লান্তিতে দামু তখন কিছু বুঝতে পারল না, ভাবতেও পারল না। একবারের জন্যে চারদিকে তাকাল, কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কিছু মনে করতেও পারল না। তারপরে আবার ঠিক মরণঘুমে দুই চোখ তার জড়িয়ে এল।
.
দামু চেঁচিয়ে বললে, আরে থামোথামো-ই কী করছ!
কিন্তু কে শোনে কার কথা! পুরো দশ মিনিট তাকে কাঁধে করে নাচলেন ম্যানেজার। নিজের নাচ শেষ হলে দামুকে তুলে দিলেন আর-একজন পালোয়ানের হাতে–যে মাথায়। একটা হেলমেট পরে তারের খাঁচার ভেতরে বনবনিয়ে মোেটরসাইকেল চালায়। সে দামুকে পিঠে করে গোটা তাঁবুর ভেতরে সাঁই সাঁই করে তিন পাক ঘুরে এল। তারপর সে আবার দামুকে তুলে দিলে ভীমের মতো জোয়ানটার হাতে–যে বুকের ওপর হাতি চাপায়। সে-লোকটা আবার দামুকে ধাঁই করে ছুঁড়ে দিলে! দামু-বাবা গো–গিচি গিচি করতে করতে টাঙানো একটা জালের ঝোলার মধ্যে পড়ল। একটুও লাগল না–চিত হয়ে তার ওপর শুয়ে দোল খেতে লাগল।
সার্কাসের ক্লাউনরা ডিগবাজি খেতে লাগল। আর সবাই মিলে হাততালি দিয়ে গান গাইতে লাগল : লা-লা-লা–ট্রা-লা-লা–
ঝোলার মধ্যে আঁকুপাঁকু করতে করতে দামু বললে, তোমরা ই কী করচ–অ্যাঁ?
ঝোলা থেকে নামিয়ে এনে ম্যানেজার দামুর হাত ঝাঁকাতে লাগলেন : তুমি আমার সাকাস বাঁচিয়েছ, লাখ টাকা বাঁচিয়েছ। তুমি সময়মতো খবর না দিলে আগুন লেগে সর্বনাশ হয়ে যেত একেবারে। বলো মিস্টার–কী করতে পারি তোমার জন্যে।
খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল দামু। তখনও তার মাথা ঘুরছে।
ম্যানেজার বললে, তুমি খবর না দিলে ওরা ঠিক আগুন দিয়ে পালিয়ে যেত। পারেনি শুধু তোমার জন্যে আমরা ওদের ক্যাঁক করে ধরে ফেলেছি। আমার লোকজন না বুঝে। তোমার ওপর খুব দুর্ব্যবহার করেছে, আমি সেজন্য ভারি লজ্জিত। বলো মিস্টার কী পুরস্কার তুমি চাও?
এতক্ষণে দামুর মাথায় একটু-একটু করে আক্কেল গজাতে লাগল। তা হলে এসব হচ্ছে তারই অভ্যর্থনা–তারই জন্যে আনন্দ করছে সবাই! দামু বললে, সে সব কথা পরে হবে, আগে কিছু খাওয়াও দিনি। কাল থেকে পেটে কিচ্ছুটি পড়েনি, খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে।
ও–এই কথা?
ম্যানেজার তক্ষুনি গলা ফাটিয়ে হাঁক ছাড়ল : এই–কৌন হ্যায়! রসগোল্লা লাও-চমচম লাও–গজা লাও-মোতিচুর লাও–সিঙাড়া লাওকচুরি লাও–দহি লাও–দুহিবড়া লাও
দামু যা খেল, সে দেখবার মতো। রসগোল্লা-চমচম-গজা-সিঙাড়া-দইবড়া কিচ্ছুটি ফেলা গেল না। তার খাওয়া দেখে সাকাস সুদ্ধ লোক থ! সবাই বললে, শাবাশ খাইয়ে বলতে হয় তো একেই।
খাওয়া-দাওয়া মিটে গেলে ম্যানেজার বললে, মিস্টার–তুমি সাকাসে চাকরি করবে? শুনে দামু চটে গেল। কালকের কথা মনে পড়ে গেল তার।
তোমার সাকাসের খাঁচায় বুঝি আমায় বাঁদর সাজিয়ে বসিয়ে রাখবে?
ম্যানেজার জিভ কেটে বললে, আরে রাম রাম, কে বলেছে সেকথা! তুমি বাঁদর সাজবে কেন? মধ্যে মধ্যে মাথায় পাগড়ি বেঁধে লাঠি হাতে এসে লাফালাফি করবে, আর
দামু গোঁজ হয়ে বললে, না–আমি সাকাসে চাকরি করব না।
করবে না?–ম্যানেজার দুঃখিত হয়ে বললে, অল রাইট। তবে আর কী করা যাবে। কিন্তু বলোক পুরস্কার কত টাকা তোমার চাই?
দামু বললে, একটা টাকাও চাই নে। শুধু সাতদিনের জন্যে একটা হাতি ধার চাই আমার।
.
শুধু হাতি ধার দেননি ম্যানেজার, হাতি চালাবার লোক দিয়েছেন, আর সেই সঙ্গে দিয়েছেন হাতির খাই-খরচ। হাতির রোজকার খাওয়া তো চারটিখানি ব্যাপার নয়–সে এক এলাহি কাণ্ড! অন্তত গোটা দশেক কলাগাছ আর সের তিরিশেক চাল তার চাই। গরীব মানুষ দামু সে-সব জোটাবে কোত্থেকে।
হাতি চড়ে বীরদর্পে দামু রওনা হয়ে গেল। পিছন থেকে হাততালি দিয়ে ম্যানেজার আর তার দলবল গান গাইতে লাগল। ট্রা-লা-লা-লা-লা–
দামু চলল–মাঠ-ঘাট পেরিয়ে–গ্রাম ছাড়িয়ে। যেতে-যেতে এক জায়গায় দেখল সাইকেল থামিয়ে তার হাতির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই দারোগাবাবু। দামু তাঁকে দেখে গান গেয়ে উঠল :
এখন করবে আমার কী
আমি হাতি পেয়েছি।
দারোগা কিছুই করতে পারলেন না। কেবল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন।
হাতি চলল কলাগাছ খেতে-খেতে–আরও অনেক গ্রাম-নদ-নদী-মাঠ-জঙ্গল পেরিয়ে। তারপরে এক জায়গায় একদল ছেলেমেয়ে চেঁচিয়ে উঠল–হাতি-হাতি? দামুর হাতি দেখেই তারা চ্যাঁচালো কি না কে জানে কিন্তু ঘোঁৎ করে আওয়াজ তুলে একটা বেজায় মোটা লোক তক্ষুনি তাদের পিছনে তাড়া করল।
জগাই ঘোষ!
হাতির ওপরে বসে দামু দুলে দুলে বলতে লাগল :
বনের হাতির পিঠে চড়ে–
মানুষ-হাতি দৌড়ে মরে!
জগাই শুনতে পেল না। সে হা-রে-রে-রে করে বাচ্চাদের পিছনে পিছনে ছুটতেই লাগল।
ঠিক সেই সময় কলিম শেখ এক ঝাঁকা ঢ্যাঁড়স নিয়ে বাজারে বেরুচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখল সামনে একটা বিরাট হাতি।
কিন্তু হাতিটাকে ভালো করে দেখবার আগেই তার কানে এল : কলিম দাদা–ও কলিম দাদা!
কলিম হাঁ হয়ে দেখল, হাতির উপরে দামু বসে।
অ্যাঁ, তুমি।
আমিই তো। সেই দামু। কত খাইয়েছিলে, কত আমায় যত্ন করেছিলে–মনে আছে?
হাতি পেয়েছ তা হলে?
দেখতেই পাচ্ছ।
ভীষণ খুশি হয়ে কলিম শেখ বললে, যে লোক ভালো হয়, আল্লাহ তার ভালো করেন। তা হাতি থামাও দাদা-দুটো কলা-মুলো খাইয়ে দিই।
নিশ্চয়–নিশ্চয়। তোমার এখানেই তো হাতিকে বরণ করতে হবে আগে। তুমি ভরসা না দিলে তো আমি ডুবে যেতুম কলিম দাদা। তুমি কলা-মুলো খাওয়াবে–আর নিবারণ ময়রাকে ডাকো–সে পাঁচ টাকার জিলিপি দিয়ে যাক–ভারি চ্যাটাং চ্যাটাং তার কথা। ও মাহুত দাদা-হাতি থামাও।
.
পঞ্চানন মুখুজ্যের বেয়াই ত্রিলোচন চক্রবর্তী তাঁর কাছারি বাড়িতে বসে চমকে উঠলেন। মস্ত একটা হাতি দেউড়ি পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল।
আশ্চর্য হয়ে বেরিয়ে এলেন ত্রিলোচন।
কার হাতি? কোত্থেকে এল?
পা ভেঙে হাতি বসে পড়ল তাঁর সামনে। আর হাতির ল্যাজ বেয়ে সড়াক করে নেমে এল দামু। ত্রিলোচনের পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললে, রুনকু দিদিকে হাতি করে দাদুর বাড়ি নে যাব দা-ঠাকুর।
ত্রিলোচন একটা খাবি খেয়ে বললেন, অ্যাঁ।
দিদি কোথায়–তাকে ডাকুন।
ত্রিলোচন আবার বললেন, অ্যাঁ।
কিন্তু দিদিকে আর ডাকতে হল না। দোতলা থেকেই সে হাতি দেখেছিল, হাতির পিঠে দামুকেও দেখেছিল। চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে, লাফাতে লাফাতে সে ছুটে বেরিয়ে এল।
আমার হাতি এসেছে–আমার হাতি এসেছে। দামুদা হাতি এনেছে–এবার আমি হাতি চেপে দাদুর বাড়ি যাব।
তারপর?
তারপর আর কী? হাতি চেপে রুনকু দাদুর বাড়ি গেল কত আনন্দ, কত খাওয়াদাওয়া হল, রামের মা রুনকুর জন্যে কত পিঠে, কত নাড়, কত মোয়া যে তৈরি করল! বেশিটাই অবিশ্যি গেল দামুর পেটে।
আর পঞ্চানন–দামুকে বুকে জড়িয়ে ধরে–কত চোখের জল ফেলে–কত যে আশীর্বাদ করলেন–সে আর কী বলব।
ওদিকে থানার সেপাই ছত্তেরি সিং! হঠাৎ একদিন দশ টাকার একটা মানি অর্ডার এসেছিল তার নামে। তাতে লেখা : হাতি পেয়েছি, মিঠাই খেয়ো। ছত্তেরি সিং ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না–কিন্তু মিঠাই খেল পেট ভরেই।
দামু এখন আর গাঁয়ে থাকে না–সে থাকে কলকাতায়। সে আর তার পিসি রুনকু দিদির কলকাতার বাড়িতেই রয়েছে। দামুদাদাকে ছাড়া রুনকুর এক মিনিটও চলে না–দামু তাকে এখনও হাতি পাওয়ার গল্প বলে–শুনে-শুনেও রুনকুর কাছে তা পুরনো হয় না।
দামু এখন কলকাতার লোক–অনেক চালাকচতুর হয়ে গেছে। এখন আর তার পাগড়ি নেই, সে লাঠিও না। তবু তাকে দেখলেই তোমরা চিনতে পারবে। রোজ বেলা দশটার সময়–গড়িয়াহাটার মোড়ে একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে সে ইস্কুলে নিয়ে যায়। দু-চারদিন ওই সময়–মোড়টার কাছে দাঁড়ালেই তোমরা ওদের দেখতে পাবে। তখন ওকে জিজ্ঞেস কোরো :তোমার নাম কি দামু? ও গম্ভীর হয়ে বলবে : আমার নাম সুদামচন্দ্র মণ্ডল।
তোমার পাগড়ি কোথায় গেল?
পাগড়ি আমি আর পরিনে।–দামু আরও গম্ভীর হয়ে বলবে : গাঁয়ের লোকে পরে।
তোমার লাঠিগাছটা কোথায়?
দিদিমণিদের বাড়িতে বন্দুক আছে। লাঠি আর লাগে না।
দামু, তুমি আমাদের হাতি চড়াতে পারো?
দামু আরও গম্ভীর হয়ে বলবে : সে অনেক বেত্তান্ত। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আমার কথা কইবার সময় নেই, দিদিমণির ইস্কুলের দেরি হয়ে যাবে।
তোমরা এই হাতির গল্পটা যদি দামুর মুখ থেকেই শুনতে চাও, তা হলে ওর রুনকু দিদিমণির সঙ্গেই ভাব করে নিয়ো।