প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 6

পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে

পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে

ঠাকুর আপনি কী নারীবিদ্বেষী ছিলেন! একালের নারীমুক্তির যুগের আধুনিকারা যদি এই কথা মনে করে আপনার প্রতি অভিমানী হয় তাহলে কী করা যাবে? আপনি একদিন বললেন, ‘মেয়ে মানুষের কাছে খুব সাবধান হতে হয়। গোপাল ভাব! এসব কথা শুনো না। মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে। অনেক মেয়েমানুষ জোয়ান ছোকরা দেখতে ভাল দেখে নতুন মায়া ফাঁদে। তাই গোপাল ভাব।” এই যে আপনি বললেন—’মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে।’ এই উক্তিটি শুনে মহিলারা হয়তো দু:খ পাবেন। সংসারী জীবকে আপনি মেনে নিলেও, আদর্শ সংসার ও সংসারীর একটি ধারা আপনি বারে বারে নির্দেশ করে গেছেন। সংসার যে আদতে এক ধোঁকার টাটি সে কথা আপনি স্মরণে রাখতে বলেছেন। সেদিন একটি সুন্দর গল্পও বলেছিলেন, ”গুরু শিষ্যকে এ কথা বোঝাচ্ছিলেন। ঈশ্বর তোমার আপনার আর কেউ আপনার নয়। শিষ্য বললে, আজ্ঞা, মা, পরিবার এরা তো খুব যত্ন করেন; না দেখলে অন্ধকার দেখেন, কত ভালোবাসেন। গুরু বললেন, ও তোমার মনের ভুল। আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি, কেউ তোমার নয়। এই ঔষধ বড়ি কয়টি তোমার কাছে রেখে দাও। তুমি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে শুয়ে থেকো। লোকে মনে করবে যে তোমার দেহত্যাগ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তোমার সব বাহ্যজ্ঞান থাকবে, তুমি দেখতে শুনতে সব পাবে—আমি সেই সময় গিয়ে পড়ব। শিষ্যটি তাই করল। বাড়িতে গিয়ে বড়ি ক’টি খেলে। খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল। মা, পরিবার, বাড়ির সকলে কান্নাকাটি আরম্ভ করলে। এমন সময় গুরু কবিরাজের বেশে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সমস্ত শুনে বললেন, আচ্ছা—আবার বেঁচে উঠবে। তবে একটি কথা আছে। এই ঔষধটি আগে একজন আপনার লোকের খেতে হবে, তারপর ওকে দেওয়া যাবে। যে আপনার লোক ওই বড়িটি খাবে, তার কিন্তু মৃত্যু হবে। তা এখানে ওর মা কি পরিবার এঁরা তো সব আছেন, একজন না একজন কেউ খাবেন সন্দেহ নাই। তা হলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে।

শিষ্য সমস্ত শুনছে। কবিরাজ আগে মাকে ডাকলেন। মা কাতর হয়ে ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন। কবিরাজ বললেন—মা আর কাঁদতে হবে না। তুমি এই ঔষধটি খাও, তাহলেই ছেলেটি বেঁচে উঠবে। তবে তোমার এতে মৃত্যু হবে। মা ঔষধ হাতে ভাবতে লাগলেন। অনেক ভেবেচিন্তে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, বাবা আমার আর ক’টি ছেলেমেয়ে আছে, আমি গেলে কী হবে, এও ভাবছি। কে তাদের দেখবে, খাওয়াবে, তাদের জন্যে ভাবছি। পরিবারকে ডেকে তখন ঔষধ দেওয়া হল—পরিবারও খুব কাঁদছিলেন, ঔষধ হাতে করে তিনিও ভাবতে লাগলেন। শুনলেন যে, ঔষধ খেলে মরতে হবে। তখন কেঁদে বলতে লাগলেন, ওগো, ওঁর যা হওয়ার, তা তো হয়েছে গো। আমার অপগন্ডগুলির এখন কী হবে বলো? কে ওদের বাঁচাবে! আমি কেমন করে ও ঔষধ খাই? শিষ্যের তখন ঔষধের নেশা চলে গেছে। সে বুঝলে যে কেউ কারু নয়। ধড়মড় করে উঠে গুরুর সঙ্গে চলে গেল। গুরু বললেন, তোমার আপনার কেবল একজন—ঈশ্বর।

পরে আর একদিন এই গল্পটাই আপনি একটু অন্যভাবে বলে, আর কাহিনি সংযোজন করেছিলেন, সেটি আরও মারাত্মক। যেমন, ”আর একজন শিষ্য গুরুকে বলেছিল, আমার স্ত্রী বড় যত্ন করে, ওর জন্যে গুরুদেবের কাছে যেতে পারছি না। শিষ্যটি হঠযোগ করত। গুরু তাকেও একটি ফন্দি শিখিয়ে দিলেন। একদিন তার বাড়িতে খুব কান্নাকাটি পড়েছে। পাড়ার লোকেরা এসে দেখে হঠযোগী ঘরে আসনে বসে আছে এঁকেবেঁকে আড়ষ্ট হয়ে। সব্বাই বুঝতে পারলে তার প্রাণবাবু বেরিয়ে গেছে। স্ত্রী আছড়ে কাঁদছে, ওগো আমাদের কী হল গো—ওগো তুমি আমাদের কী করে গেলে গো—ওগো দিদি গো, এমন হবে তা জানতাম না গো। এদিকে আত্মীয় বন্ধুরা খাট এনেছে, ওকে ঘর থেকে বার করছে।

এখন একটি গোল হল। এঁকেবেঁকে আড়ষ্ট হয়ে থাকাতে সে দ্বার দিয়ে বেরুচ্ছে না। তখন একজন প্রতিবেশী দৌড়ে গিয়ে একটি কাটারি লয়ে দ্বারের চৌকাঠ কাটতে লাগল। স্ত্রী অস্থির হয়ে কাঁদছিল। সে দুমদুম শব্দ শুনে দৌড়ে এল। এসে কাঁদতে-কাঁদতে জিগ্যেস করল, ওগো কী হয়েছে গো। তারা বললেন ইনি বেরুচ্ছেন না, তাই চৌকাঠ কাটছি। তখন স্ত্রী বললেন, ওগো অমন কর্ম করো না গো। আমি এখন রাঁড় বেওয়া হলুম। আমার আর দেখবার লোক কেউ নাই, ক’টি নাবালক ছেলেকে মানুষ করতে হবে। এ দোয়ার গেলে আর তো হবে না। ওগো ওর যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে—হাত, পা ওঁর কেটে দাও। তখন হঠযোগী দাঁড়িয়ে পড়ল। তার তখন ঔষধের ঝোঁক চলে গেছে। দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তবে রে শালি আমার হাত-পা কাটবে।’ এই বলে বাড়ি ত্যাগ করে গুরুর সঙ্গে চলে গেল।

এর পর আপনি যোগ করলেন উপসংহার—”অনেকে ঢং করে শোক করে। কাঁদতে হবে জেনে আগে নৎ খোলে আর আর গহনা সব খোলে, খুলে বাক্সর ভিতর চাবি দিয়ে রেখে দেয়। তারপর আছড়ে এসে পড়ে আর কাঁদে, ”ওগো দিদিগো, আমার কী হল গো!”

ঠাকুর, মায়ার সংসারে, স্বার্থের সংসারে নারীর চিত্র! এমন দর্শন, এমন নিপুণ পর্যবেক্ষণ আপনার মতো অন্তর্যামীর পক্ষেই সম্ভব। আর সাহস। বেপরোয়া সাহস। কোনও রাখঢাক নেই। রামপ্রসাদ বলেছিলেন গানে—একটু নরম করে—’যার জন্য মরো ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে। সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে!!’

গিরিশকে আপনি একদিন বললেন—”দ্যাখো না, মেয়েমানুষের কী মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের। পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে বসে আছে তখন বলি, আহা! এরা গেছে—হারু কোথা গেল, ওরে হারু এমন সুন্দর ছেলে তাকে পেতনিতে পেয়েছে। ওরে হারু কোথা গেল, আর হারু কোথা গেল। সব্বাই গিয়ে দেখে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে রূপ নাই, সে তেজ নাই, সে আনন্দ নাই। বটগাছের পেতনি-তে হারুকে পেয়েছে।”

”স্ত্রী যদি বলে, ‘যাও তো একবার’—অমনি উঠে দাঁড়ায়। ব-সো তো’—অমনি বসে পড়ে।”

একালের ভাষায়, আমরা যাকে বলি জরুকা গোলাম। আপনার সেই বারোশো ন্যাড়া আর তেরশো নেড়ির গল্প। নিত্যানন্দ গোস্বামীর ছেলে বীরভদ্রের তেরোশো ন্যাড়া শিষ্য ছিল। তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘এরা সিদ্ধ হল। লোককে যা বলবে তাই ফলবে, যে দিক দিয়ে যাবে সেই দিকেই ভয়। কেন না লোকে না জেনে যদি অপরাধ করে তাদের অনিষ্ট হবে।’ বীরভদ্র তাঁদের জন্যে মেয়েছেলের ফাঁদ পাতলেন। একশো বেরিয়ে গেল কেটে। বারোশোর জুটল সেবাদাসী। ‘মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকাতে আর সে বল রইল না, কেন না সে সঙ্গে স্বাধীনতা লোপ হয়ে যায়।’

যাই বলুন ঠাকুর, সংসারীকে আপনি সত্যিই কি তেমন বিশ্বাস করতেন! সংসারীকে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন মাত্র। সংসার থেকে দূরে থেকে সংসার দেখেছেন আর বলেছেন—’কেবল ঝগড়া, কোঁদল, হিংসা, তারপর রোগ, শোক, দারিদ্র! দেখে বললাম—মা, এই বেলা মোড় ফিরিয়ে দাও।’ সকলেরই ঈশ্বরের দিকে মন—বিদ্যার সংসার, এরূপ প্রায় দেখা যায় না। তাই বলি, ‘মা যদি কখনও শরীর ধারণ হয়, যেন সংসারী কোরো না।

তাই তো বলি ঠাকুর, মায়েরা যাই ভাবুন, মলাট উলটে স্বরূপ তো আপনি দেখিয়ে দিলেন। আমরা এই শয়েশয়ে ন্যাড়া এখন কী করি। পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে। তবে এটাও ঠিক নির্বোধ উটের তো কাঁটাগাছই পথ্য। আপনি তো চেতনের সারথি। অচেতনের জন্যে ‘তোমরা একটু ওইখানে গিয়ে বসো। অথবা বলি, যাও বেশ বিল্ডিং দ্যাখো গে।’

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *