হেমনলিনী রমেশের নিকট হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িল। প্রথম আবেগটা শান্ত হইবামাত্র একটা লজ্জা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল। ‘কেন আমি রমেশবাবুর সঙ্গে সহজভাবে দেখা করিতে পারিলাম না ? যাহা আশা করি না, তাহাই হঠাৎ কেন আমার মধ্য হইতে এমন অশোভন ভাবে দেখা দেয় ? বিশ্বাস নাই, কিছুই বিশ্বাস নাই। এমন করিয়া টল্মল্ করিতে আর পারি না।’
এই বলিয়া সে জোর করিয়া উঠিয়া পড়িয়া দরজা খুলিয়া দিল, বাহির হইয়া আসিল; মনে মনে কহিল, ‘আমি পলায়ন করিব না, আমি জয় করিব।’ পুনর্বার রমেশবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চলিল। হঠাৎ কী মনে পড়িল। আবার সে ঘরের মধ্যে গেল। তোরঙ্গ খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে ক্ষেমংকরীর প্রদত্ত বালাজোড়া বাহির করিয়া পরিল, এবং অস্ত্র পরিয়া যুদ্ধে যাইবার মতো সে আপনাকে দৃঢ় করিয়া মাথা তুলিয়া বাগানের দিকে চলিল।
অন্নদাবাবু আসিয়া কহিলেন, “হেম, তুমি কোথায় চলিয়াছ ?”
হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু নাই ? দাদা নাই ?”
অন্নদা। না, তাঁহারা চলিয়া গেছেন।
আশু আত্মপরীক্ষাসম্ভাবনা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া হেমনলিনী আরাম বোধ করিল।
অন্নদাবাবু কহিলেন, “এখন তবে— ”
হেমনলিনী কহিল, “হাঁ বাবা, আমি চলিলাম; আমার স্নান করিয়া আসিতে দেরি হইবে না, তুমি গাড়ি ডাকিতে বলিয়া দাও।
এইরূপে হেমনলিনী নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য হঠাৎ তাহার স্বভাববিরুদ্ধ অত্যন্ত উৎসাহ প্রকাশ করিল। এই উৎসাহের আতিশয্যে অন্নদাবাবু ভুলিলেন না, তাঁহার মন আরো উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল।
হেমনলিনী তাড়াতাড়ি স্নান সারিয়া সজ্জিত হইয়া আসিয়া কহিল, ‘বাবা, গাড়ি আসিয়াছে কি ?”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “না, এখনো আসে নাই।”
ততক্ষণ হেমনলিনী বাগানের রাস্তায় পদচারণা করিয়া বেড়াইতে লাগিল।
অন্নদাবাবু বারান্দায় বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন।
অন্নদাবাবু যখন নলিনাক্ষের বাড়ি গিয়া পৌঁছিলেন বেলা তখন সাড়ে দশটার অধিক হইবে না। তখনো নলিনাক্ষ কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসে নাই। কাজেই অন্নদাবাবুর অভ্যর্থনাভার ক্ষেমংকরীকেই লইতে হইল।
ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুর শরীর ও সংসারের নানা কথা লইয়া প্রশ্ন ও আলোচনা উত্থাপিত করিলেন; মাঝে মাঝে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাঁহার কটাক্ষ ধাবিত হইল। সে মুখে কোনো উৎসাহের লক্ষণ নাই কেন ? আসন্ন শুভঘটনার সম্ভাবনা সূর্যোদয়ের পূর্বে অরুণরশ্মিচ্ছটার মতো তাহার মুখে দীপ্তিবিকাশ করে নাই তো ! বরঞ্চ হেমনলিনীর অন্যমনস্ক দৃষ্টির মধ্য হইতে একটা ভাবনার অন্ধকার যেন দেখা যাইতেছিল।
অল্পেই ক্ষেমংকরীকে আঘাত করে। হেমনলিনীর এইরূপ ম্লানভাব লক্ষ্য করিয়া তাঁহার মন দমিয়া গেল। ‘নলিনের সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ যে-কোনো মেয়ের পক্ষেই সৌভাগ্যের বিষয়, কিন্তু এই শিক্ষামদমত্তা মেয়েটি আমার নলিনকে কি তাঁহার যোগ্য বলিয়াই মনে করিতেছেন না ? এত চিন্তা, এত দ্বিধাই বা কিসের জন্য ? আমারই দোষ। বুড়া হইয়া গেলাম, তবু ধৈর্য ধরিতে পারিলাম না। যেমন ইচ্ছা হইল, অমনি আর সবুর সহিল না। বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে নলিনের বিবাহ স্থির করিলাম, অথচ তাহাকে ভালো করিয়া চিনিবার চেষ্টাও করিলাম না। হায় হায়, চিনিয়া দেখিবার মতো সময় যে হাতে নাই, এখন সংসারের সব কাজ তাড়াতাড়ি সারিয়া যাইবার জন্য তলব আসিয়াছে।’
অন্নদাবাবুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে ক্ষেমংকরীর মনের ভিতরে ভিতরে এই সমস্ত চিন্তা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কথাবার্তা কহা তাঁহার পক্ষে কষ্টকর হইয়া উঠিল। তিনি অন্নদাবাবুকে কহিলেন, “দেখুন, বিবাহের সম্বন্ধে বেশি তাড়াতাড়ি করিয়া কাজ নাই। এঁদের দুজনেরই বয়স হইয়াছে, এখন এঁরা নিজেরাই বিচার করিয়া কাজ করিবেন, আমাদের তাগিদ দেওয়াটা ভালো হইতেছে না। হেমের মনের ভাব আমি অবশ্য বুঝি না— কিন্তু আমি নলিনের কথা বলিতে পারি, সে এখনো মন স্থির করিতে পারে নাই।”
এ কথাটা ক্ষেমংকরী হেমনলিনীকে বিশেষ করিয়া শুনাইবার জন্যই বলিলেন। হেমনলিনী অপ্রসন্নমনে চিন্তা করিতেছে, আর তাঁর ছেলেই যে বিবাহের প্রস্তাবে একেবারে নাচিয়া উঠিয়াছে, এ ধারণা তিনি অপর পক্ষের মনে জন্মিতে দিতে পারেন না।
হেমনলিনী আজ এখানে আসিবার সময় খুব একটা চেষ্টাকৃত উৎসাহ অবলম্বন করিয়া আসিয়াছিল; সেই জন্য তাহার বিপরীত ফল হইল। ক্ষণিক উত্তেজনা একটা গভীর অবসাদের মধ্যে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। যখন ক্ষেমংকরীর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল তখন হঠাৎ তাহার মনকে একটা আশঙ্কা আক্রমণ করিয়া ধরিল— যে নূতন জীবনযাত্রার পথে সে পদক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে তাহা তাহার সম্মুখে অতিদূর-বিসর্পিত দুর্গম শৈলপথের মতো প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল।
সমস্ত শিষ্টালাপের মধ্যে নিজের প্রতি অবিশ্বাস হেমনলিনীর মনকে আজ ভিতরে ভিতরে ব্যথিত করিতে লাগিল।
এই অবস্থায় যখন ক্ষেমংকরী বিবাহের প্রস্তাবটাকে কতকটা প্রত্যাখ্যান করিয়া লইলেন, তখন হেমনলিনীর মনে দুই বিপরীত ভাবের উদয় হইল। বিবাহবন্ধনের মধ্যে শীঘ্র ধরা দিয়া নিজের সংশয়দোলায়িত দুর্বল অবস্থা হইতে শীঘ্র নিষ্কৃতি পাইবার ইচ্ছা তাহার থাকাতে প্রস্তাবটাকে সে অনতিবিলম্বে পাকা করিয়া ফেলিতে চায়, অথচ প্রস্তাবটা চাপা পড়িবার উপক্রম হইতেছে দেখিয়া উপস্থিতমত সে একটা আরামও পাইল।
ক্ষেমংকরী কথাটা বলিয়াই হেমনলিনীর মুখের ভাব কটাক্ষপাতের দ্বারা লক্ষ্য করিয়া লইলেন। তাঁহার মনে হইল, যেন এতক্ষণ পরে হেমনলিনীর মুখের উপরে একটা শান্তির স্নিগ্ধতা অবতীর্ণ হইল। তাহাতে তাঁহার মনটা তৎক্ষণাৎ হেমনলিনীর প্রতি বিমুখ হইয়া উঠিল। তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘আমার নলিনকে আমি এত সস্তায় বিলাইয়া দিতে বসিয়াছিলাম !’ নলিনাক্ষ আজ যে আসিতে দেরি করিতেছে ইহাতে তিনি খুশি হইলেন। হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “দেখেছ নলিনাক্ষের আক্কেল ? তোমরা আজ এখানে আসিবে সে জানে, তবু তাহার দেখা নাই। আজ নাহয় কাজ কিছু কমই করিত। এই তো আমার একটু ব্যামো হলেই সে কাজকর্ম বন্ধ করিয়া বাড়িতেই থাকে, তাহাতে এতই কী লোকসান হয় ?”
এই বলিয়া আহারের আয়োজন কতদূর অগ্রসর হইয়াছে দেখিবার উপলক্ষে কিছুক্ষণের ছুটি লইয়া ক্ষেমংকরী উঠিয়া আসিলেন। তাঁহার ইচ্ছা, হেমনলিনীকে তিনি কমলার উপর ভিড়াইয়া দিয়া নিরীহ বৃদ্ধটিকে লইয়াই কথাবার্তা কহিবেন।
তিনি দেখিলেন, প্রস্তুত অন্ন মৃদু আগুনের আঁচে বসাইয়া রাখিয়া কমলা রান্নাঘরের এক কোণে চুপটি করিয়া এমন গভীরভাবে কী-একটা ভাবিতেছিল যে, ক্ষেমংকরীর হঠাৎ আবির্ভাবে সে একেবারে চমকিয়া উঠিল। পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া স্মিতমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, “ওমা, আমি বলি, তুমি বুঝি রান্নার কাজে ভারি ব্যস্ত হইয়া আছ।”
কমলা কহিল, “রান্না সমস্ত সারা হইয়া গেছে মা।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, এখানে চুপ করিয়া বসিয়া আছ কেন মা ? অন্নদাবাবু বুড়োমানুষ, তাঁর সামনে বাহির হইতে লজ্জা কী ? হেম আসিয়াছে, তাহাকে তোমার ঘরে ডাকিয়া লইয়া একটু গল্পসল্প করো’সে। আমি বুড়োমানুষ, আমার কাছে বসাইয়া রাখিয়া তাহাকে দুঃখ দিব কেন ?”
হেমনলিনীর নিকট হইতে প্রত্যাহত হইয়া কমলার প্রতি ক্ষেমংকরীর স্নেহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল।
কমলা সংকুচিত হইয়া কহিল, “মা, আমি তাঁর সঙ্গে কী গল্প করিব ! তিনি কত লেখাপড়া জানেন, আমি কিছুই জানি না।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “সে কী কথা ! তুমি কাহারো চেয়ে কম নও মা ! লেখাপড়া শিখিয়া যিনি আপনাকে যত বড়োই মনে করুন, তোমার চেয়ে বেশি আদর পাইবার যোগ্য কয়জন আছে ? বই পড়িলে সকলেই বিদ্বান হইতে পারে, কিন্তু তোমার মতো অমন লক্ষ্মীটি হওয়া কি সকলের সাধ্য ? এসো মা, এসো। কিন্তু তোমার এ বেশে চলিবে না। তোমার উপযুক্ত সাজে তোমাকে আজ সাজাইব।”
সকল দিকেই ক্ষেমংকরী আজ হেমনলিনীর গর্ব খাটো করিতে উদ্যত হইয়াছেন। রূপেও তিনি তাহাকে এই অল্পশিক্ষিতা মেয়েটির কাছে ম্লান করিতে চান। কমলা আপত্তি করিবার অবকাশ পাইল না। তাহাকে ক্ষেমংকরী নিপুণহস্তে মনের মতো করিয়া সাজাইয়া দিলেন, ফিরোজা রঙের রেশমি শাড়ি পরাইলেন, নূতন ফ্যাশানের খোঁপা রচনা করিলেন, বার বার কমলার মুখ এ দিকে ফিরাইয়া ও দিকে ফিরাইয়া দেখিলেন এবং মুগ্ধচিত্তে তাহার কপোল চুম্বন করিয়া কহিলেন, “আহা, এ রূপ রাজার ঘরে মানাইত।”
কমলা মাঝে মাঝে কহিল, “মা, উঁহারা একলা বসিয়া আছেন, দেরি হইয়া যাইতেছে।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “তা, হোক দেরি। আজ আমি তোমাকে না সাজাইয়া যাইব না।”
সাজ সারা হইলে তিনি কমলাকে সঙ্গে করিয়া চলিলেন, “এসো এসো মা, লজ্জা করিয়ো না। তোমাকে দেখিয়া কালেজে-পড়া বিদুষী রূপসীরা লজ্জা পাইবেন, তুমি সকলের কাছে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পার।”
এই বলিয়া যে ঘরে অন্নদাবাবুরা বসিয়াছিলেন সেই ঘরে ক্ষেমংকরী জোর করিয়া কমলাকে টানিয়া লইয়া গেলেন। গিয়া দেখিলেন, নলিনাক্ষ তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। কমলা তাড়াতাড়ি ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল, কিন্তু ক্ষেমংকরী তাহাকে ধরিয়া রাখিলেন; কহিলেন, “লজ্জা কী মা, লজ্জা কিসের ! সব আপনার লোক।”
কমলার রূপে এবং সজ্জায় ক্ষেমংকরী নিজের মনে একটা গর্ব অনুভব করিতে ছিলেন; তাহাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হউক, এই তাঁহার ইচ্ছা। পুত্রাভিমানিনী জননী তাঁহার নলিনাক্ষের প্রতি হেমনলিনীর অবজ্ঞা কল্পনা করিয়া আজ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন, আজ নলিনাক্ষের কাছেও হেমনলিনীকে খর্ব করিতে পারিলে তিনি খুশি হন।
কমলাকে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হইল। হেমনলিনী প্রথম দিন যখন তাহার পরিচয় লাভ করিয়াছিল তখন কমলার সাজসজ্জা কিছুই ছিল না; সে মলিনভাবে সংকুচিত হইয়া এক ধারে বসিয়া ছিল, তাও বেশিক্ষণ ছিল না। তাহাকে সেদিন ভালো করিয়া দেখাই হয় নাই। আজ মুহূর্তকাল সে বিস্মিত হইয়া রহিল, তাহার পরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া লজ্জিতা কমলার হাত ধরিয়া তাহাকে আপনার পাশে বসাইল।
ক্ষেমংকরী বুঝিলেন, তিনি জয়লাভ করিয়াছেন; উপস্থিত-সভায় সকলকেই মনে মনে স্বীকার করিতে হইয়াছে, এমন রূপ দৈবপ্রসাদেই দেখিতে পাওয়া যায়। তখন তিনি কমলাকে কহিলেন, “যাও তো মা, তুমি হেমকে তোমার ঘরে লইয়া গল্পসল্প করো গে যাও। আমি ততক্ষণ খাবারের জায়গা করি গে।”
কমলার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল। সে ভাবিতে লাগিল, “হেমনলিনীর আমাকে কেমন লাগিবে কে জানে।’
এই হেমনলিনী এক দিন এই ঘরের বধূ হইয়া আসিবে, কর্ত্রী হইয়া উঠিবে— ইহার সুদৃষ্টিকে কমলা উপেক্ষা করিতে পারে না। এ বাড়ির গৃহিণীপদ তাহারই ছিল, কিন্তু সে কথা সে মনেও আনিতে চায় না— ঈর্ষাকে সে কোনোমতেই অন্তরে স্থান দিবে না। তাহার কোনো দাবি নাই। তাই হেমনলিনীর সঙ্গে যাইবার সময় তাহার পা কাঁপিয়া যাইতে লাগিল।
হেমনলিনী আস্তে আস্তে কমলাকে কহিল, “তোমার সব কথা আমি মা’র কাছে শুনিয়াছি। শুনিয়া বড়ো কষ্ট হইল। তুমি আমাকে তোমার বোনের মতো দেখিয়ো ভাই। তোমার কি বোন কেহ আছে ?”
কমলা হেমনলিনীর সস্নেহ সকরুণ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া কহিল, “আমার আপন বোন কেহ নাই, আমার একটি খুড়তুতো বোন আছে।”
হেমনলিনী কহিল, ‘ভাই, আমার বোন কেহ নাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার মা মারা গেছেন। কতবার কত সুখদুঃখের সময় ভাবিয়াছি, মা তো নাই, তবু যদি আমার একটি বোন থাকিত ! ছেলেবেলা হইতে সব কথা কেবল মনের মধ্যেই চাপিয়া রাখিতে হইয়াছে, শেষকালে এমন অভ্যাস হইয়া গেছে যে, আজ মন খুলিয়া কোনো কথা বলিতেই পারি না। লোকে মনে করে, আমার ভারি দেমাক— কিন্তু তুমি ভাই, এমন কথা কখনো মনে করিয়ো না। আমার মন যে বোবা হইয়া গেছে।”
কমলার মন হইতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল; সে কহিল, “দিদি, আমাকে কি তোমার ভালো লাগিবে ? আমাকে তো তুমি জান, আমি ভারি মূর্খ।”
হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “আমাকে যখন তুমি ভালো করিয়া জানিবে, দেখিবে আমিও ঘোর মূর্খ। আমি কেবল গোটাকতক বই পড়িয়া মুখস্থ করিয়াছি, আর কিছুই জানি না। তাই আমি তোমাকে বলি, যদি আমার এ বাড়িতে আসা হয় তুমি আমাকে কখনো ছাড়িয়ো না ভাই ! কোনোদিন সংসারের ভার আমার একলার হাতে পড়িয়াছে মনে করিলে আমার ভয় হয়।”
কমলা শিশুর মতো সরলচিত্তে কহিল, “ভার তুমি সমস্ত আমার উপর দিয়ো। আমি ছেলেবেলা হইতে কাজ করিয়া আসিয়াছি, আমি কোনো ভার লইতে ভয় করি না। আমরা দুই বোনে মিলিয়া সংসার চালাইব, তুমি তাঁহাকে সুখে রাখিবে, আমি তোমাদের সেবা করিব।”
হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা ভাই, তোমার স্বামীকে তো তুমি ভালো করিয়া দেখ নাই, তাঁহাকে তোমার মনে পড়ে ?”
কমলা কথার স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “স্বামীকে যে মনে করিতে হয় তাহা আমি জানিতাম না দিদি ! খুড়ার বাড়িতে যখন আসিলাম তখন আমার খুড়তুতো বোন শৈলদিদির সঙ্গে আমার ভালো করিয়া পরিচয় হইল। তিনি তাঁহার স্বামীকে যেরকম করিয়া সেবা করেন তাহা চক্ষে দেখিয়া আমার প্রথম চৈতন্য জন্মিল। আমি যে-স্বামীকে কখনো দেখি নাই বলিলেই হয় আমার সমস্ত মনের ভক্তি তাঁহার উদ্দেশে যে কেমন করিয়া গেল, তাহা আমি বলিতে পারি না। ভগবান আমার সেই পূজার ফল দিয়াছেন, এখন আমার স্বামী আমার মনের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন, তিনি আমাকে গ্রহণ না’ই করিলেন— কিন্তু আমি তাঁহাকে এখন পাইয়াছি।”
কমলার এই ভক্তিসিঞ্চিত কথা কয়টি শুনিয়া হেমনলিনীর অন্তঃকরণ আর্দ্র হইয়া গেল। সে খানিক ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তোমার কথা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। অমনি করিয়া পাওয়াই পাওয়া। আর সমস্ত পাওয়া লোভের পাওয়া, তাহা নষ্ট হইয়া যায়।”
কমলা এ কথা সম্পূর্ণ বুঝিল কি না বলা যায় না— সে হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া রহিল, খানিক বাদে কহিল, “তুমি যাহা বলিতেছ দিদি, তা সত্যই হইবে। আমি মনে কোনো দুঃখ আসিতে দিই না, আমি ভালোই আছি ভাই ! আমি যেটুকু পাইয়াছি তাই আমার লাভ।”
হেমনলিনী কমলার হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া কহিল, “যখন ত্যাগ এবং লাভ একেবারে সমান হইয়া যায় তখনই তাহা যথার্থ লাভ, এই কথা আমার গুরু বলেন। সত্য বলিতেছি বোন, তোমার মতো অমনি সমস্ত নিবেদন করিয়া দিয়া যে সার্থকতা তাহাই যদি আমার ঘটে, তবে আমি ধন্য হইব।”
কমলা কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন দিদি, তুমি তো সবই পাইবে, তোমার তো কোনো অভাবই থাকিবে না।”
হেননলিনী কহিল, “যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ। আমার মুখে এ-সব কথা তোমার আশ্চর্য লাগিবে, আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগে, কিন্তু এ-সব কথা ঈশ্বর আমাকে ভাবাইতেছেন। জান না, বোন, আজ আমার মনে কী ভার চাপিয়া ছিল— তোমাকে পাইয়া আমার হৃদয় হালকা হইল, আমি বল পাইলাম, তাই আমি এত বকিতেছি। আমি কখনো কথা কহিতে পারি না, তুমি কেমন করিয়া আমার সব কথা টানিয়া লইতেছ ভাই ?”