নবীনকালীর আশ্রয়ে কমলার প্রাণটা যেন অল্পজল এঁদো-পুকুরের মাছের মতো ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিল। এখান হইতে বাহির হইতে পারিলে সে বাঁচে, কিন্তু বাহিরে গিয়া দাঁড়াইবে কোথায়? সেদিনকার রাত্রে গৃহহীন বাহিরের পৃথিবীকে সে জানিয়াছে; সেখানে অন্ধভাবে আত্মসমর্পণ করিতে আর তাহার সাহস হয় না।
নবীনকালী যে কমলাকে ভালোবাসিতেন না তাহা নহে, কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে রস ছিল না। দুই-এক দিন অসুখ-বিসুখের সময় তিনি কমলাকে যত্নও করিয়াছিলেন, কিন্তু সে যত্ন কৃতজ্ঞতার সহিত গ্রহণ করা বড়ো কঠিন। বরঞ্চ সে কাজকর্মের মধ্যে থাকিত ভালো, কিন্তু যে-সময়টা নবীনকালীর সখীত্বে তাহাকে যাপন করিতে হইত সেইটেই তার পক্ষে সব চেয়ে দুঃসময়।
একদিন সকালবেলা নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া কহিলেন, “ওগো, ও বামুন-ঠাকরুন, আজ কর্তার শরীর বড়ো ভালো নাই, আজ ভাত হইবে না, আজ রুটি। কিন্তু তাই বলিয়া একরাশ ঘি লইয়ো না। জানি তো তোমার রান্নার শ্রী, উহাতে এত ঘি কেমন করিয়া খরচ হইবে তাহা তো বুঝিতে পারি না। এর চেয়ে সেই যে উড়ে বামুনটা ছিল ভালো, সে ঘি লইত বটে, কিন্তু রান্নায় ঘিয়ের স্বাদ একটু-আধটু পাওয়া যাইত।”
কমলা এ-সমস্ত কথার কোনো জবাবই করিত না; যেন শুনিতে পায় নাই, এমনি-ভাবে নিঃশব্দে সে কাজ করিয়া যাইত।
আজ অপমানের গোপনভারে আক্রান্তহৃদয় হইয়া কমলা চুপ করিয়া তরকারি কুটিতেছিল, সমস্ত পৃথিবী বিরস এবং জীবনটা দুঃসহ বোধ হইতেছিল, এমন সময় গৃহিণীর ঘর হইতে একটা কথা তাহার কানে আসিয়া কমলাকে একেবারে চকিত করিয়া তুলিল। নবীনকালী তাঁহার চাকরকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, “ওরে তুলসী, যা তো, শহর হইতে নলিনাক্ষ ডাক্তারকে শীঘ্র ডাকিয়া আন্। বল্, কর্তার শরীর বড়ো খারাপ।”
নলিনাক্ষ ডাক্তার! কমলার চোখের উপরে সমস্ত আকাশের আলো আহত বীণার স্বর্ণতন্ত্রীর মতো কাঁপিতে লাগিল। সে তরকারি-কোটা ফেলিয়া দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তুলসী নীচে নামিয়া আসিতেই কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইতেছিস তুলসী?” সে কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিতে যাইতেছি।”
কমলা কহিল, “সে আবার কোন্ ডাক্তার?”
তুলসী কহিল, “তিনি এখানকার একটি বড়ো ডাক্তার বটে।”
কমলা। তিনি থাকেন কোথায়?
তুলসী কহিল, “শহরেই থাকেন, এখান হইতে আধ ক্রোশটাক হইবে।”
আহারের সামগ্রী অল্পস্বল্প যাহা-কিছু বাঁচাইতে পারিত, কমলা তাহাই বাড়ির চাকর-বাকরদের ভাগ করিয়া দিত। এজন্য সে ভর্ৎসনা অনেক সহিয়াছে, কিন্তু এ অভ্যাস ছাড়িতে পারে নাই। বিশেষত গৃহিণীর কড়া আইন অনুসারে এ বাড়ির লোকজনদের খাবার কষ্ট অত্যন্ত বেশি। তা ছাড়া কর্তা-গৃহিণীর খাইতে বেলা হইত; ভৃত্যেরা তাহার পরে খাইতে পাইত। তাহারা যখন আসিয়া কমলাকে জানাইত “বামুন-ঠাকরুন, বড়ো ক্ষুধা পাইয়াছে’ তখন সে তাহাদিগকে কিছু-কিছু খাইতে না দিয়া কোনমতেই থাকিতে পারিত না। এমনি করিয়া বাড়ির চাকর-বাকর দুই দিনেই কমলার একান্ত বশ মানিয়াছে।
উপর হইতে রব আসিল, “রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়াইয়া কিসের পরামর্শ চলিতেছে রে তুলসী? আমার বুঝি চোখ নাই মনে করিস? শহরে যাইবার পথে এক বার বুঝি রান্নাঘর না মাড়াইয়া গেলে চলে না? এমনি করিয়াই জিনিসপত্রগুলো সরাইতে হয় বটে! বলি বামুন-ঠাকরুন, রাস্তায় পড়িয়া ছিলে, দয়া করিয়া তোমাকে আশ্রয় দিলাম, এমনি করিয়াই তাহার শোধ তুলিতে হয় বুঝি!”
সকলেই তাঁহার জিনিসপত্র চুরি করিতেছে, এই সন্দেহ নবীনকালীকে কিছুতেই ত্যাগ করে না। যখন প্রমাণের লেশমাত্রও না থাকে তখনো তিনি আন্দাজে ভর্ৎসনা করিয়া লন। তিনি স্থির করিয়াছেন যে, অন্ধকারে ঢেলা মারিলেও অধিকাংশ ঢেলা ঠিক জায়গায় গিয়া পড়ে আর তিনি যে সর্বদা সতর্ক আছেন ও তাঁহাকে ফাঁকি দিবার জো নাই, ভৃত্যেরা ইহা বুঝিতে পারে।
আজ নবীনকালীর তীব্রবাক্য কমলার মনেও বাজিল না। সে আজ কেবল কলের মতো কাজ করিতেছে, তাহার মনটা যে কোন্খানে উধাও হইয়া গেছে তাহার ঠিকানা নাই।
নীচে রান্নাঘরে দরজার কাছে কমলা দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। এমন সময় তুলসী ফিরিয়া আসিল, কিন্তু সে একা আসিল। কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “তুলসী, কই ডাক্তারবাবু আসিলেন না?”
তুলসী কহিল, “না, তিনি আসিলেন না।”
কমলা। কেন?
তুলসী। তাঁহার মার অসুখ করিয়াছে।
কমলা। মার অসুখ? ঘরে আর কি কেহ নাই?
তুলসী। না, তিনি তো বিবাহ করেন নাই।
কমলা। বিবাহ করেন নাই, তুই কেমন করিয়া জানিলি?
তুলসী। চাকরদের মুখে তো শুনি, তাঁহার স্ত্রী নাই।
কমলা। হয়তো তাঁহার স্ত্রী মারা গেছে।
তুলসী। তা হইতে পারে। কিন্তু তাঁহার চাকর ব্রজ বলে, তিনি যখন রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন, তখনো তাঁহার স্ত্রী ছিল না।
উপর হইতে ডাক পড়িল, “তুলসী!” কমলা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং তুলসী উপরে চলিয়া গেল।
নলিনাক্ষ–রঙপুরে ডাক্তারি করিতেন–কমলার মনে আর তো কোনো সন্দেহ নাই। তুলসী নামিয়া আসিলে পুনর্বার কমলা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দেখ্ তুলসী, ডাক্তারবাবুর নামে আমার একটি আত্মীয় আছেন–বল্ দেখি, উনি ব্রাহ্মণ তো বটেন?”
তুলসী। হাঁ, ব্রাহ্মণ, চাটুজ্জে।
গৃহিণীর দৃষ্টিপাতের ভয়ে তুলসী বামুন-ঠাকরুনের সঙ্গে অধিকক্ষণ কথাবার্তা কহিতে সাহস করিল না, সে চলিয়া গেল।
কমলা নবীনকালীর নিকট গিয়া কহিল, “কাজকর্ম সমস্ত সারিয়া আজ আমি একবার দশাশ্বমেধঘাটে স্নান করিয়া আসিব।”
নবীনকালী। তোমার সকল অনাসৃষ্টি। কর্তার আজ অসুখ, আজ কখন কী দরকার হয়, তাহা বলা যায় না–আজ তুমি গেলে চলিবে কেন?
কমলা কহিল, “আমার একটি আপনার লোক কাশীতে আছেন খবর পাইয়াছি, তাঁহাকে একবার দেখিতে যাইব।”
নবীনকালী। এ-সব ভালো কথা নয়। আমার যথেষ্ট বয়স হইয়াছে, আমি এ-সব বুঝি। খবর তোমাকে কে আনিয়া দিল? তুলসী বুঝি? ও ছোঁড়াটাকে আর রাখা নয়। শোনো বলি বামুন-ঠাকরুন, আমার কাছে যতদিন আছ ঘাটে একলা স্নান করিতে যাওয়া, আত্মীয়ের সন্ধানে শহরে বাহির হওয়া, ও-সমস্ত চলিবে না তাহা বলিয়া রাখিতেছি।
দারোয়ানের উপর হুকুম হইয়া গেল, তুলসীকে এই দণ্ডে দূর করিয়া দেওয়া হয়, সে যেন এ বাড়িমুখো হইতে না পারে।
গৃহিণীর শাসনে অন্যান্য চাকরেরা কমলার সংস্রব যথাসম্ভব পরিত্যাগ করিল।
নলিনাক্ষ সম্বন্ধে যতদিন কমলা নিশ্চিত ছিল না ততদিন তাহার ধৈর্য ছিল; এখন তাহার পক্ষে ধৈর্যরক্ষা করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। এই নগরেই তাহার স্বামী রহিয়াছেন অথচ সে এক মুহূর্তও যে অন্যের ঘরে আশ্রয় লইয়া থাকিবে, ইহা তাহার পক্ষে অসহ্য হইল। কাজকর্মে তাহার পদে পদে ত্রুটি হইতে লাগিল।
নবীনকালী কহিলেন, “বলি বামুন-ঠাকরুন, তোমার গতিক তো ভালো দেখি না। তোমাকে কি ভূতে পাইয়াছে? তুমি নিজে তো খাওয়াদাওয়া বন্ধ করিয়াছ, আমাদিগকেও কি উপোস করাইয়া মারিবে? আজকাল তোমার রান্না যে আর মুখে দেবার জো নাই।”
কমলা কহিল, “আমি এখানে আর কাজ করিতে পারিতেছি না, আমার কোনোমতে মন টিকিতেছে না। আমাকে বিদায় দিন।”
নবীনকালী ঝংকার দিয়া বলিলেন, “বটেই তো! কলিকালে কাহারো ভালো করিতে নাই। তোমাকে দয়া করিয়া আশ্রয় দিবার জন্যে আমার এতকালের অমন ভালো বামুনটাকে ছাড়াইয়া দিলাম, একবার খবর লইলাম না তুমি সত্যি বামুনের মেয়ে কি না। আজ উনি বলেন কিনা, আমাকে বিদায় দিন। যদি পালাইবার চেষ্টা কর তো পুলিসে খবর দিব না! আমার ছেলে হাকিম–তার হুকুমে কত লোক ফাঁসি গেছে, আমার কাছে তোমার চালাকি খাটিবে না। শুনেইছ তো–গদা কর্তার মুখের উপরে জবাব দিতে গিয়াছিল, সে বেটা এমনি জব্দ হইয়াছে, আজও সে জেল খাটিতেছে। আমাদের তুমি যেমন তেমন পাও নাই।”
কথাটা মিথ্যা নহে– গদা চাকরকে ঘড়িচুরির অপবাদ দিয়া জেলে পাঠানো হইয়াছে বটে।
কমলা কোনো উপায় খুঁজিয়া পাইল না। তাহার চিরজীবনের সার্থকতা যখন হাত বাড়াইলেই পাওয়া যায়, তখন সেই হাতে বাঁধন পড়ার মতো এমন নিষ্ঠুর আর কী হইতে পারে। কমলা আপনার কাজের মধ্যে, ঘরের মধ্যে কিছুতেই আর তো বদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে না। তাহার রাত্রের কাজ শেষ হইয়া গেলে পর সে শীতে একখানা র৻াপার মুড়ি দিয়া বাগানে বাহির হইয়া পড়িত। প্রাচীরের ধারে দাঁড়াইয়া, যে পথ শহরের দিকে চলিয়া গেছে সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকিত। তাহার যে তরুণ হৃদয়খানি সেবার জন্য ব্যাকুল, ভক্তিনিবেদনের জন্য ব্যগ্র, সেই হৃদয়কে কমলা এই রজনীর নির্জন পথ বাহিয়া নগরের মধ্যে কোন্ এক অপরিচিত গৃহের উদ্দেশে প্রেরণ করিত–তাহার পর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া তাহার শয়নকক্ষের মধ্যে ফিরিয়া আসিত।
কিন্তু এইটুকু সুখ, এইটুকু স্বাধীনতাও কমলার বেশি দিন রহিল না। রাত্রির সমস্ত কাজ শেষ হইয়া গেলেও একদিন কী কারণে নবীনকালী কমলাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বেহারা আসিয়া খবর দিল, “বামুন-ঠাকরুনকে দেখিতে পাইলাম না।”
নবীনকালী ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “সে কী রে, তবে পালাইল নাকি?”
নবীনকালী নিজে সেই রাত্রে আলো ধরিয়া ঘরে ঘরে খোঁজ করিতে আসিলেন, কোথাও কমলাকে দেখিতে পাইলনে না। মুকুন্দবাবু অর্ধনিমীলিতনেত্রে গুড়গুড়ি টানিতেছিলেন; তাঁহাকে গিয়া কহিলেন, “ওগো, শুনছ? বামুন-ঠাকরুন বোধ করি পালাইল।”
ইহাতেও মুকুন্দবাবুর শান্তিভঙ্গ করিল না; তিনি কেবল আলস্যজড়িত কণ্ঠে কহিলেন, “তখনই তো বারণ করিয়াছিলাম; জানাশোনা লোক নয়। কিছু সরাইয়াছে নাকি?”
গৃহিণী কহিলেন, “সেদিন তাহাকে যে শীতের কাপড়খানা পরিতে দিয়াছিলাম, সেটা তো ঘরে নাই, এ ছাড়া আর কী গিয়াছে, এখনো দেখি নাই।”
কর্তা অবিচলিত গম্ভীরস্বরে কহিলেন, “পুলিসে খবর দেওয়া যাক।”
এখজন চাকর লণ্ঠন লইয়া পথে বাহির হইল। ইতিমধ্যে কমলা তাহার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, নবীনকালী সে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র তন্ন-তন্ন করিয়া দেখিতেছেন। কোনো জিনিস চুরি গেছে কি না তাহাই তিনি সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এমন সময় কমলাকে হঠাৎ দেখিয়া নবীনকালী বলিয়া উঠিলেন, “বলি, কী কাণ্ডটাই করিলে? কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?”
কমলা কহিল, “কাজ শেষ করিয়া আমি একটুখানি বাগানে বেড়াইতেছিলাম।”
নবীনকালী মুখে যাহা আসিল তাহাই বলিয়া গেলেন। বাড়ির সমস্ত চাকরবাকর দরজার কাছে আসিয়া জড়ো হইল।
কমলা কোনোদিন নবীনকালীর কোনো ভর্ৎসনায় তাঁহার সম্মুখে অশ্রুবর্ষণ করে নাই। আজও সে কাঠের মূর্তির মতো স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
নবীনকালীর বাক্যবর্ষণ একটুখানি ক্ষান্ত হইবামাত্র কমলা কহিল, “আমার প্রতি আপনারা অসন্তুষ্ট হইয়াছেন, আমাকে বিদায় করিয়া দিন।”
নবীনকালী। বিদায় তো করিবই। তোমার মতো অকৃতজ্ঞকে চিরদিন ভাত-কাপড় দিয়া পুষিব, এমন কথা মনেও করিয়ো না। কিন্তু কেমন লোকের হাতে পড়িয়াছ সেটা আগে ভালো করিয়া জানাইয়া তবে বিদায় দিব।
ইহার পর হইতে কমলা বাহিরে যাইতে আর সাহস করিত না। সে ঘরের মধ্যে দ্বার রুদ্ধ করিয়া মনে মনে এই কথা বলিল, যে লোক এত দুঃখ সহ্য করিতেছে ভগবান নিশ্চয় তাহার একটা গতি করিয়া দিবেন।
মুকুন্দবাবু তাঁহার দুইটি চাকর সঙ্গে লইয়া গাড়ি করিয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন। বাড়িতে প্রবেশের দরজায় ভিতর হইতে হুড়কা বন্ধ। সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে।
দ্বারের কাছে রব উঠিল, “মুকুন্দবাবু ঘরে আছেন কি?”
নবীনকালী চকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ঐ গো, নলিনাক্ষ ডাক্তার আসিয়াছেন। বুধিয়া, বুধিয়া!”
বুধিয়া-নামধারিণীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন নবীনকালী কহিলেন, “বামুন-ঠাকরুন, যাও তো, শীঘ্র দরজা খুলিয়া দাও গে। ডাক্তারবাবুকে বলো, কর্তা হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছেন, এখনি আসিবেন; একটু অপেক্ষা করিতে হইবে।
কমলা লণ্ঠন লইয়া নীচে নামিয়া গেল–তাহার পা কাঁপিতেছে, তাহার বুকের ভিতর গুর্ গুর্ করিতেছে, তাহার করতল ঠাণ্ডা হিম হইয়া গেল। তাহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে এই বিষম ব্যাকুলতায় সে চোখে ভালো করিয়া দেখিতে না পায়।
কমলা ভিতর হইতে হুড়কা খুলিয়া দিয়া ঘোমটা টানিয়া কপাটের অন্তরালে দাঁড়াইল।
নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কর্তা ঘরে আছেন কি?”
কমলা কোনোমতে কহিল, “না, আপনি আসুন।”
নলিনাক্ষ বসিবার ঘরে আসিয়া বসিল। ইতিমধ্যে বুধিয়া আসিয়া কহিল, “কর্তাবাবু বেড়াইতে গেছেন এখনি আসিবেন, আপনি একটু বসুন।”
কমলার নিশ্বাস প্রবল হইয়া তাহার বুকের মধ্যে কষ্ট হইতেছিল। যেখান হইতে নলিনাক্ষকে স্পষ্ট দেখা যাইবে, অন্ধকার বারান্দার এমন একটা জায়গা সে আশ্রয় করিল, কিন্তু দাঁড়াইতে পারিল না। বিক্ষুব্ধ বক্ষকে শান্ত করিবার জন্য তাহাকে সেইখানে বসিয়া পড়িতে হইল। তাহার হৃৎপিণ্ডের চাঞ্চল্যের সঙ্গে শীতের হাওয়া যোগ দিয়া তাহাকে থরথর করিয়া কাঁপাইয়া তুলিল।
নলিনাক্ষ কেরোসিন-আলোর পাশে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া কী ভাবিতেছিল। অন্ধকারের ভিতর হইতে বেপথুমতী কমলা নলিনাক্ষের মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। চাহিতে চাহিতে তাহার দুই চক্ষে বার বার জল আসিতে লাগিল। তাড়াতাড়ি জল মুছিয়া সে তাহার একাগ্রদৃষ্টির দ্বারা নলিনাক্ষকে যেন আপনার অন্তঃকরণের গভীরতম অভ্যন্তরদেশে আকর্ষণ করিয়া লইল। ঐ-যে উন্নতললাট স্তব্ধ মুখখানির উপরে দীপালোক মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছে, ঐ মুখ যতই কমলার অন্তরের মধ্যে মুদ্রিত ও পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল ততই তাহার সমস্ত শরীর যেন ক্রমে অবশ হইয়া চারি দিকের আকাশের সহিত মিলাইয়া যাইতে লাগিল; বিশ্বজগতের মধ্যে আর-কিছুই রহিল না, কেবল ঐ আলোকিত মুখখানি রহিল–যাহার সম্মুখে রহিল সেও ঐ মুখের সহিত সম্পূর্ণভাবে মিশিয়া গেল।
এইরূপে কিছুক্ষণ কমলা সচেতন কি অচেতন ছিল, তাহা বলা যায় না; এমন সময় হঠাৎ সে চকিত হইয়া দেখিল, নলিনাক্ষ চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং মুকুন্দবাবুর সঙ্গে কথা কহিতেছে।
এখনি পাছে উঁহারা বারান্দায় বাহির হইয়া আসেন এবং কমলা ধরা পড়ে এই ভয়ে কমলা বারান্দা ছাড়িয়া নীচে তাহার রান্নাঘরে গিয়া বসিল। রান্নাঘরটি প্রাঙ্গণের এক ধারে, এবং এই প্রাঙ্গণটি বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া যাইবার পথ।
কমলা সর্বাঙ্গমনে পুলকিত হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, “আমার মতো হতভাগিনীর এমন স্বামী! দেবতার মতো এমন সৌম্য-নির্মল প্রসন্ন-সন্দুর মূর্তি! ওগো ঠাকুর, আমার সকল দুঃখ সার্থক হইয়াছে।’
বলিয়া বার বার করিয়া ভগবানকে প্রণাম করিল।
সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিবার পদশব্দ শোনা গেল। কমলা তাড়াতাড়ি অন্ধকারে দ্বারের পাশে দাঁড়াইল। বুধিয়া আলো ধরিয়া আগে আগে চলিল, তাহার অনুসরণ করিয়া নলিনাক্ষ বাহির হইয়া গেল।
কমলা মনে মনে কহিল, “তোমার শ্রীচরণের সেবিকা হইয়া এইখানে পরের দ্বারে দাসত্বে আবদ্ধ হইয়া আছি, সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলে, তবু জানিতেও পারিলে না।’
মুকুন্দবাবু অন্তঃপুরে আহার করিতে গেলে কমলা আস্তে আস্তে সেই বসিবার ঘরে গেল। যে চৌকিতে নলিনাক্ষ বসিয়াছিল তাহার সম্মুখে ভূমিতে ললাট ঠেকাইয়া সেখানকার ধূলি চুম্বন করিল। সেবা করিবার অবকাশ না পাইয়া অবরুদ্ধ ভক্তিতে কমলার হৃদয় কাতর হইয়া উঠিয়াছিল।
পরদিন কমলা সংবাদ পাইল, বায়ুপরিবর্তনের জন্য ডাক্তারবাবু কর্তাকে সুদূর পশ্চিমে কাশীর চেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থানে যাইতে উপদেশ করিয়াছেন। তাই আজ হইতে যাত্রার আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে।
কমলা নবীনকালীকে গিয়া কহিল, “আমি তো কাশী ছাড়িয়া যাইতে পারিব না।”
নবীনকালী। আমরা পারিব, আর তুমি পারিবে না! বড়ো ভক্তি দেখিতেছি।
কমলা। আপনি যাহাই বলুন, আমি এইখানেই থাকিব।
নবীনকালী। আচ্ছা, তা কেমন থাক দেখা যাইবে।
কমলা কহিল, “আমাকে দয়া করুন, আমাকে এখান হইতে লইয়া যাইবেন না।”
নবীনকালী। তুমি তো বড়ো ভয়ানক লোক দেখিতেছি। ঠিক যাবার সময় বাহানা ধরিলে। আমরা এখন তাড়াতাড়ি লোক কোথায় খুঁজিয়া পাই! আমাদের কাজ চলিবে কী করিয়া?
কমলার অনুনয়-বিনয় সমস্ত ব্যর্থ হইল; কমলা তাহার ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া ভগবানকে ডাকিয়া কাঁদিতে লাগিল।