নোনাজল
সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ। ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা। চোখ বন্ধ করে দিলেও হাতড়ে হাতড়ে ঠিক বের করতে পারব, কোথায় জলের কল, কোথায় চাখিলির দোকান, মুর্গীর খাঁচাগুলো রাখা হয় কোন জায়গায়। অথচ আমি জাহাজের খালাসী নই-অবরের-সবরের যাত্রী মাত্র।
ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলায়নি। শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল। এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোদা-সোদা যে গন্ধটা আর সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতর থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে। এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়। পুরনো দিনের রূপরসগন্ধস্পর্শ সবই রয়েছে, শুধু লক্ষ্য করলুম ভিড় আগের চেয়ে কম।
দ্বিপ্রহরে পরিপাটি আহারাদি করে ডেকচেয়ারে শুয়ে দূর-দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। কবিত্ব আমরা আসে না, তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার চোখে ধরা পড়ে না, যতক্ষণ না রবি ঠাকুর সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাই আমি চাঁদের আলোর চেয়ে পছন্দ করি গ্রামোফোনের বাক্স। পোর্টেবলটা আনিব আনব করছি, এমন সময় চোখে পড়ল একখানা মন্দিতা ‘দেশ’—মালিক না আসা পর্যন্ত তিনি যদি পরিহস্তে কিঞ্চিৎ আভ্ৰষ্টা’ও হয়ে যান, তা তার স্বামী বিশেষ বিরক্ত হবেন না নিশ্চয়ই।
‘রূপদশী’ ছদ্মনাম নিয়ে এক নতুন লেখক খালাসীদের সম্বন্ধে একটি দরদ-ভরা লেখা ছেড়েছে। ছোকরার পেটে এলেম আছে, নইলে অতখানি কথা গুছিয়ে লিখল কী করে, আর এত সব কেচ্ছা-কাহিনীই বা যোগাড় করল কোথা থেকে? আমি তো একখানা ছুটির আর্জি লিখতে গেলেই হিমসিম খেয়ে যাই। কিন্তু লোকটা যা সব লিখেছে, এর কি সবই সত্যি? এতবড় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে খালাসীরা লড়াই দেয় না কেন? হুঁ:! এ আবার একটা কথা হল! সিলেট নোয়াখালির আনাড়ীরা দেবে ঘুঘু, ইংরেজের সঙ্গে লড়াই-আমিও যেমন!
জাহাজের মেজো সারেঙের আজ বোধ হয় ছুটি। সিল্কের লুঙ্গি, চিকনের কুর্তা আর মুগার কাজ-করা কিস্তি টুপি পরে ডেকের ওপর টহল দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছেও। ডিসপ্যাচের পুঁটি ও মানওয়ারির তিমি দুইই মাছএকেই জিজ্ঞাসা করা যাক না কেন, ‘রূপদৰ্শ’ দর্শন করেছে কতটুকু আর কল্পনায় বুনেছে কতখানি!
একটুখানি গলা খাকারি দিয়ে শুধালুম, ‘ও সারেঙ সাহেব, জাহাজ লেট যাচ্ছে না। তো?’
লোকটা উত্তর দিয়ে সবিনয়ে বলল, ‘আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। সাহেব। আমি আপনাকে দু-একবারের বেশি দেখি নি, কিন্তু আপনার আব্বা সাহেব, বড় ভাই সাহেবেরা এ-গরিবকে মেহেরবানি করেন।’
খুশি হয়ে বললুম, ‘তোমার বাড়ি কোথা? বাস-না, তার ফুরসত নেই?’ ধাপ করে ডেকের উপর বসে পড়ল।
আমি বললুম, ‘সে কী? একটা টুল নিয়ে এসো। এসব আর আজকাল—’ কথাটি শেষ করলুম না, সারেঙও টুল আনল না। তারপর আলাপ পরিচয় হল। দ্যাশের লোক— সুখ-দুঃখের কথা অবশ্যই বাদ পড়ল না। শেষটায় মোক পেয়ে ‘রূপদশী-দর্শন’। তাকে আগাগোড়া পড়ে শোনালুম। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার জাতভাই চাষারা যেরকম পুঁথিপড়া শোনে সে রকম আগাগোড়া শুনল, তারপর খুব লম্বা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
আল্লাতালার উদ্দেশে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললে, ইনসাফের (ন্যায়ধর্মের) কথা তুললেন, হুজুর, এ-দুনিয়ায় ইনসাফ কোথায়? আর বে-ইনসাফি তো তারাই করেছে। বেশি, যাদের খুদা ধনদৌলত দিয়েছেন বিস্তর। খুদাতালাই কার জন্যে কী ইনসাফ রাখেন, তাই বা বুঝিয়ে বলবে কে? আপনি সমীরুদীকে চিনতেন, বহু বছর আমেরিকায় কাটিয়েছিল, অনেক টাকা কমিয়েছিল?’
আমেরিকার কথায় মনে পড়ল। ‘চোঁতলি পরগণায় বাড়ি, না, যেন ওই দিকেই কোনখানে।’
সারেঙ বললে, ‘আমারই গা ধলাইছড়ার লোক। বিদেশে সে যা টাকা কমিয়েছে। ওরকম কামিয়েছে অল্প লোকই! আমরা খিদিরপুরে সাইন (Sign) করে জাহাজের কামে ঢুকেছিলাম-একই দিন একই সঙ্গে।’
আম শুধালুম, ‘কী হল তার? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
সারেঙ বললে, ‘শুনুন।’
‘যে লেখাটি হুজুর পড়ে শোনালেন, তার সব কথাই অতিশয় হক। কিন্তু জাহাজের কাজে, বিশেষ করে গোড়ার দিকে যে কী জান মারা খাটুনি তার খবর কেউ কখনও দিতে পারবে না যে সে জাহান্নামের ভিতর দিয়ে কখনও যায় নি। বয়লারের পাশে দাঁড়িয়ে যে লোকটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কয়লা ঢালে, তার সর্বাঙ্গ দিয়ে কী রকম ঘাম ঝরে দেখেছেন-এই জাহাজেই যার দুদিক খোলা, পদ্মার জোর বাতাসের বেশ খানিকটা যেখানে স্বচ্ছন্দে বেশ আনাগোনা করতে পারে। এ তো বেহেশৎ। আর দরিয়ার জাহাজের গর্ভের নীচে যেখানে এঞ্জিন-ঘর, তার সব দিক বন্ধ, তাতে কখনও হাওয়া-বাতাস ঢোকে না। সেই দশ বারো চোদ্দ হাজার টনী ডাঙর ডোঙর জাহাজের বয়লারের আকারটা কত বড় হয় এবং সেই কারণে গরমিটার বহর কতখানি, সে কি বাইরের থেকে কখনও অনুমান করা যায়? খাল বিল নদীর খোলা হাওয়ার বাচ্চা আমরা-হঠাৎ একদিন দেখি, সেই জাহান্নামের মাঝখানে কালো-কালো বিরাট-বিরাট শয়তানের মত কলকব্জা, লোহালক্কড়ের মুখোমুখি।
‘পয়লা পয়লা কামে নেমে সবাই ভিরমি যায়। তাদের তখন উপরে টেনে জলের কলের নীচে শুইয়ে দেওয়া হয়, হাঁশ ফিরলে পর মুঠো মুঠো নুন গেলান হয়, গায়ের ঘাম দিয়ে সব নুন বেরিয়ে যায় বলে মানুষ তখন আর বাঁচতে পারে না।
‘কিংবা দেখবেন কয়লা ঢেলে যাচ্ছে বয়লারে ঠিক ঠিক, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, বেলচা ফেলে ছুটে চলেছে সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে, খোকা ডেক থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। অসহ্য গরমে মাথা বিগড়ে গিয়েছে, জাহাজী বুলিতে একেই বলে ‘এখম’’—’
আমি শুধালুম ‘একেই কি ইংরাজিতে বলে এমাক (amuck)? কিন্তু তখন তো মানুষ খুন করে!’
সারেঙ বললে, ‘জী হাঁ। তখন বাধা দিতে গেলে হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়ে খুন করতে আসে।’ তারপর একটু থেমে সারেঙ বললে, ‘আমাদের সকলেরই দু-একবার হয়েছে, আর সবাই জীবড়ে ধরে চুবিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা করেছে—শুধু সমীরুদী ককখনো একবারের তরেও কাতর হয় নি। তাকে আপনি দেখেছেন, সায়েব? বাং মাছের মত ছিল তার শরীর, অথচ হাত দিয়ে টিপলে মনে হত কচ্ছপের খোল। জাহাজের চীনা বাবুর্চির ওজন ছিল তিন মণের কাছাকাছি—তাকে সে এক থাবড়া মেরে বসিয়ে দিতে পারত। লাঠি খেলে খেলে তার হাতে জন্মেছিল বাঘের থাবার তাগিদ। কিন্তু সে যে ভিরমি যায় নি, ‘এমখ’ হয় নি, তার কারণ তার শরীরের জোর নয়-দিলের হিম্মৎ-সে মন বেঁধেছিল, যে করেই হোক পয়সা সে কামাবেই, ভিরমি গেলে চলবে না, বিমারি পাকড়ানো সখৎ মানা।’
সারেঙ বললে, ‘কী বেহদ তকলীফে জানিপানি হয়ে যে কুলুম শহরে পৌঁছলাম-’
আমি শুধুলাম, ‘সে আবার কোথায়?’
বললে, ‘বাংলায় যারে লঙ্কা কয়।’
আমি বললুম, ‘ও, কলম্বো!’
‘জী। আমাদের উচ্চারণ তো আপনাদের মত ঠিক হয় না। আমরা বলি কুলুম শহর। সেখানে ডাঙায় বেড়াবার জন্য আমাদের নামতে দিল বটে, কিন্তু যারা পয়লা বার জাহাজে বেরিয়েছে, তাদের উপর কড়া নজর রাখা হয়, পাছে জাহাজের অসহ্য কষ্ট এড়াবার জন্যে পালিয়ে যায়। সমীরুদী বন্দরে নামলেই না। বললে, নামলেই তো বাজে খরচা। আর সেকথা ঠিকও বটে, হুজুর, খালাসীরা কাঁচা পয়সা বন্দরে যা ওড়ায়! যে জীবনে কখনও পাঁচ টাকার নোট দেখে নি, আধুলির বেশি কামায় নি, তার হাতে পনের টাকা। সে তখন ক্যাগের বাচচা কেনে।
‘আমরা পেট ভরে যা খুশি তাই খেলাম। বিশেষ করে শাক-সবজি। জাহাজে খালাসীদের কপালে ও জিনিস কম। নেই বললেও হয়-দেশে যার ছড়াছড়ি।
‘তারপর কুলুম থেকে আদন বন্দর।’
আমার আর ইংরিজি ‘এইডন’ বলার দরকার হল না।
‘তারপর লাল-দরিয়া পেরিয়ে সুসোর খাড়ি—দু দিকে ধু-ধু মরুভূমি, বালু আর বালু, মাঝখানে ছোট্ট খাল।’
বুঝলুম, সুসোর খাড়ি’ মানে সুয়েজ কানাল।
‘তারপর পুসঁই। সেখানে খালের শেষ। বাড়িয়া বন্দর। আমরা শাকসবজি খেতে নামলাম সেখানে। ঝানুরা গেল খারাপ জায়গায়।’
পোর্ট সাঈদের গণিকালয় যে বিশ্ববিখ্যাত, দেখলুম, সারেঙের পো সে খপরটি রাখে। পুর্সই থেকে মার্সই, মার্সই থেকে হামবুর–জার্মানির মুলুকে।’
ততক্ষণে সিলেটি উচ্চারণে বিদেশী শব্দ কী ধ্বনি নেয়, তার খানিকটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, তাই বুঝলুম, মারসেইলজ, হামবুর্গের কথা হচ্ছে। আর এটাও লক্ষ্য করলুম যে, সারেঙ বন্দরগুলোর নাম সোজা ফরাসি-জার্মান থেকে শুনে শিখেছে, তারা যে-রকম উচ্চারণ করে, ইংরিজির বিকৃত উচ্চারণের মারফতে নয়।
সারেঙ বলল, হামবুরে সব মাল নেমে গেল। সেখান থেকে আবার মাল গাদাই করে আমরা দরিয়া পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছলুম নুউক বন্দরে–মিরকিন মুলুকে।
নিয়া ঝুনা কোন খালাসীকে নুউক বন্দরে নামতে দেয় না। বড় কড়াকড়ি সেখানে। আর হবেই বা না কেন? মিরকিন মুলুক সোনার দেশ। আমাদের মত চাষাভুষাও সেখানে মাসে পাঁচ-সাত শো টাকা কামাতে পারে। আমাদের চেয়েও কালা, একদম মিশকালা আদমীও সেখানে তার চেয়েও বেশি কামায়। খালাসীদের নামতে দিলে সব কটা ভোগে গিয়ে তামাম মুলুকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণভরে টাকা কামাবে। তাতে নাকি মিরকিন মজুরদের জবর লোকসান হয়। তাই আমরা হয়ে রইলাম জাহাজে বন্দী।’
‘নুউক পৌঁছবার তিন দিন আগে থেকে সমীরুদ্দীর করল শক্ত পেটের অসুখ। আমরা আর পাঁচজন ব্যামোর ভান করে হামেশাই কাজে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সমীরুদী এক ঘণ্টার তরেও কোন প্রকারের গাফিলি করে নি বলে ডাক্তার তাকে শুয়ে থাকবার হুকুম দিলে।’
‘নুউক পৌঁছবার দিন সন্ধ্যেবেলা সমীরুদী আমাকে ডেকে পাঠিয়ে কসমকিরে খাইয়ে কানে কানে বললে, সে জাহাজ থেকে পালাবে। তারপর কী কৌশলে সে পারে পৌঁছাবে, তার ব্যবস্থা সে আমায় ভাল করে বুঝিয়ে বললে।
‘বিশ্বাস করবেন না। সায়েব, কী রকম নিখুঁত ব্যবস্থা সে কত ভেবে তৈরি করেছিল। কলকাতার চোরা-বাজার থেকে সে কিনে এনেছিল একটা খাসা নীল রঙের সুট, শার্ট, টাইকলার, জুতা, মোজা।
‘আমাকে সাহায্য করতে হল। শুধু একটা পেতলের ডেগচি যোগাড় করে দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সমীরুদী সাঁতারের জঙিয়া পড়ে নামল জাহাজের উলটো ধার দিয়ে, খোলা সমুদ্রের দিকে। ডেগচির ভিতরে তার সুট, জুতো, মোজা আর একখানা তোয়ালে। বুক দিয়ে সেই ডেগচি ঠেলেঠেলে বেশ খানিকটা চক্কর দিয়ে সে প্রায় আধা-মাইল দূরে গিয়ে উঠবে ভাঙায়। পাড়ে উঠে, তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, জঙিয়া ডেগচি। জলে ডুবিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে যাবে শহরের ভিতর। সেখানে আমাদেরই এক সিলেটি ভাইকে সে খবর দিয়ে রেখেছিল হামবুর থেকে। পুলিশের খোঁজাখুঁজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে কয়েকদিন তারপর দাড়িগোঁফ কামিয়ে চলে যাবে নুউক থেকে বহুদূরে, যেখানে সিলেটিরা কাঁচা পয়সা কামায়। পালিয়ে ডাঙায় উঠতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার যে কোন ভয় ছিল না তা নয়, কিন্তু একবার সুটটি পরে রাস্তায় নামতে পারলে পুলিশ দেখলেও ভাববে, সে নুউকবাসিন্দা, সমুদ্রপারে এসেছিল হাওয়া খেতে।
‘পেলেনটা ঠিক উতরে গেল, সায়েব। সমীরুদ্দীর জন্য খোজ-খোঁজ রব উঠল। পরের দিন দুপুরবেলা। ততক্ষণে চিড়িয়া যে শুধু উড় গিয়া তা নয়। সে বনের ভিতর বিলকুল উধাও। একদম না-পাত্তা। বরঞ্চ বনের ভিতর পাখিকে পেলেও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু নুউক শহরের ভিতর সমীরুদীকে খুঁজে পাবে কোন পুলিশের গোসাঁই?’
গল্প বলায় ক্ষান্ত দিয়ে সারেঙ গেল জোহরের নমাজ পড়তে। ফিরে এসে ভূমিকা না। দিয়েই সারেঙ বললে, ‘তারপর হুজুর আমি পুরো সাত বচ্ছর জাহাজে কটাই। দু-পাঁচবার খিদিরপুরে নেমেছি বটে, কিন্তু দেশে যাবার আর ফুরসৎ হয়ে ওঠে নি। আর কী-ই বা হত গিয়ে, বাপ-মা মরে গিয়েছে, বউ-বিবিও তখন ছিল না। যতদিন বেঁচে ছিল, বাপকে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতাম-বুড়া শেষের কি বছর সুখেই কাটিয়েছে-খুদাতালার শুকুর-বুড়ি নাকি আমার জন্য কাঁদত। তা হুজুর দরিয়ার অথৈ নোনা পানি যাকে কাতর করতে পারে না, বুড়ির দু ফোঁটা নোনা জল তার আর কী করতে পারে বলুন!’
বলল বটে হক কথা, তবু সারেঙের চোখেও এক ফোঁটা নোনা জল দেখা দিল।
সারেঙ বললে, যাক সে কথা। এ সাত বছর মাঝে মাঝে এর মুখ থেকে ওর মুখ থেকে খবর কিংবা গুজব, যাই বলুন, শুনেছি, সমীরুদী বহুত পয়সা কমিয়েছে, দেশেও নাকি টাকা পাঠায়, তবে সে আস্তানা গেড়ে বসেছে মিরকিন মুলুকে, দেশে ফেরার কোন মতলব নেই। তাই নিয়ে আমি আপসোস করি নি, কারণ খুদাতালা যে কার জন্য কোন মুলুকে দানাপানি রাখেন, তার হদিস বাতিলাবে কে?
‘তারপর কল-ঘরের তেলে-পিছল মেঝেতে আছাড় খেয়ে ভেঙে গেল আমার পায়ের হাডি। বড় জাহাজের কম ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসে ঢুকলাম ডিসপ্যাঁচারের কামে। এজাহাজে আসার দুদিন পরে, একদিন খুব ভোরবেলা ফজরের নমাজের ওজু করতে যাচ্ছি, এমন সময় তাজ্জব মেনে দেখি, ডেকে বসে রয়েছে সমীরুদ্দী! বুকে জীবড়ে ধরে তাকে বললাম, ভাই সমীরুদ্দী! এক লহমায় আমার মনে পড়ে গেল, সমীরুদীকে এককালে আমি আপনার ভাইয়ের মতন কতই না প্যার করেছি।
‘কিন্তু তাকে হঠাৎ দেখতে পাওয়ার চেয়েও বেশি তাজ্জব লাগিল আমার, সে আমার প্যারে কোন সাড়া দিল না বলে। গাঙের দিকে মুখ করে পাথরের পুতুলের মত বসে রইল সে। শুধালাম, ‘তোর দেশে ফেরার খবর তো আমি পাই নি। আবার এ জাহাজে করে চলেছিস তুই কোথায়? কলকাতা? কেন? এদেশে মন টিকল না?’
‘কোন কথা কয় না। ফকির-দরবেশের মত বসে রইল ঠিায়, তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে, যেন আমাকে দেখতেই পায় নি।
‘বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তখনকার মত তাকে আর কথা কওয়াবার চেষ্টা না করে, ঠেলোঁঠুলে কোন গতিকে তাকে নিয়ে গেলাম। আমার কেবিনে। নাশতার পেলেট সামনে ধরলাম, আণ্ডা ভাজা ও পরটা দিয়ে সাজিয়ে-ওই খেতে সে বড় ভালবাসতকিছু মুখে দিতে চায় না। তবু জোর করে গেলালাম, বাচ্চাহারা মাকে মানুষ যে রকম মুখে খাবার ঠেসে দেয়, কিন্তু হুজুর, পরের জন্য অনেক কিছু করা যায়, জানতক কুরবানি দিয়ে তাকে বাঁচানো যায়, কিন্তু পরের জন্য খাবার গিলি কী করে?
‘সেদিন দুপুরবেলা তাকে কিছুতেই গোয়ালন্দে নামতে দিলাম না। আমার, হুজুর, মনে পড়ে গেল বহু বৎসরের পুরনো কথা-নুউক বন্দরেও আমাদের নামতে দেয় নি, তখন সমীরুদী সেখানেই গায়েব হয়েছিল।
‘রাত্রের অন্ধকারে সমীরুদীর মুখ ফুটিল।
‘হঠাৎ নিজের থেকেই বলতে আরম্ভ করল, কী ঘটেছে।’
সারেঙ দম নেবার জন্য না অন্য কোন কারণে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল বুঝতে পারলুম না। আমিও কোন খোঁচা দিলুম না। বললে, ‘তা সে দুঃখের কাহিনী—ঠিক ঠিক বলি কী করে সাহেব? এখনও মনে আছে, কেবিনের ঘোরাঘুটি অন্ধকারে সে আমাকে সবকিছু বলেছিল। এক-একটা কথা যেন সে অন্ধকার ফুটো করে আমার কানে এসে বিন্ধেছিল, আর অতি অল্প কথায়ই সে সব কিছু সেরে দিয়েছিল।
‘সাত বছরে সে প্রায় বিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল দেশে তার ছোট ভাইকে। বিশ হাজার টাকা কতখানি হয়, তা আমি জানি নে, একসঙ্গে কখনও চোখে দেখি নি-’
আমি বললুম, ‘আমিও জানি নে, আমিও দেখি নি।’
‘তবেই বুঝুন হুজুর, সেটাকা কামাতে হলে কটা জানি কুরবানি দিতে হয়।
‘প্ৰথম পাঁচশো টাকা পাঠিয়ে ভাইকে লিখলে, মহাজনের টাকা শোধ দিয়ে বাড়ি ছাড়াতে। তার পরের হাজার দেড়েক বাড়ির পাশের পতিত জমি কেনার জন্য। তারপর আরও অনেক টাকা দিঘি খোদাবার জন্য, তারপর আরও বহুত টাকা শহুরী ঢঙে পাকা চুনকাম করা দেয়াল-ওলা টাইলের চারখানা বড় ঘরের জন্য, আরও টাকা ধানের জমি, বলদ, গাই, গোয়ালঘর, মরাই, বাড়ির পিছনে মেয়েদের পুকুর, এসব করার জন্য এবং সর্বশেষে হাজার পাঁচেক টাকা। টঙি ঘরের উল্টোদিকে দিঘির এপারে পাকা মসজিদ বানাবার জন্য।
‘সাত বছর ধরে সমীরুদী মিরকিন মুলুকে, অসুরের মত খেটে দু শিফটু আড়াই শিফ্টে গতর খাটিয়ে জান পানি করে পয়সা কামিয়েছে, তার প্রত্যেকটি কড়ি হালালের রোজাকার, আর আপন খাই-খরচার জন্য সে যা পয়সা খরচ করেছে, তা দিয়ে মিরকিন মুলুকের ভিখারিরও দিন গুজরান হয় না।
‘সব পয়সা সে ঢেলে দিয়েছে বাড়ি বানাবার জন্য, জমি কেনার জন্য। মিরকিন মুলুকের মানুষ যে-রকম চাষবাসের খামার করে, আর ভদ্রলোকের মত ফ্যাশানের বাড়িতে থাকে, সে দেশে ফিরে সেই রকম করবে বলে।
‘ওদিকে ভাই প্ৰতি চিঠিতে লিখেছে, এটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে-করে করে যেদিন সে খবর পেল মসজিদ তৈরি শেষ হয়েছে, সেদিন রওয়ানা দিল দেশের দিকে। নুউক বন্দরে জাহাজে কাজ পায় আনাড়ী কালা আদিমও বিনা তাকলিফে। তার ওপর সমীরুদী হরেক রকম কারখানার কাজ করে করে কলকব্জা এমনি ভাল শিখে গিয়েছিল যে, তারই সার্টিফিকেতের জোরে, জাহাজে আরামের চাকরি করে ফিরল খিদিরপুর। সন্ধ্যের সময় জাহাজ থেকে নেমে সোজা চলে গেল শেয়ালদা। সেখানে প্লাটফর্মে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে চাটগাঁ মেল ধরে শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছল রাত তিনটোয়। সেখান থেকে হেঁটে রওয়ানা দিল ধলাইছড়ার দিকে—আট মাইল রাস্তা, ভোর হতে না-হতেই বাড়ি পৌঁছে যাবে।
‘রাস্তা থেকে পোয়াটাক মাইল ধানক্ষেত, তারপর ধলাইছড়া গ্রাম। আলোর উপর দিয়ে গ্রামে পৌঁছতে হয়।
‘বিহানের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে সমীরুদী পৌঁছল ধানক্ষেতের মাঝখানে।
‘মসজিদের একটা উঁচু মিনার থাকার কথা ছিল—কারণ মসজিদের নকশাটা সমীরুদীকে করে দিয়েছিলেন এক মিশরী ইঞ্জিনিয়ার, আর হুজুরও মিশর মুলুকে বহুকাল কাটিয়েছেন, তাদের মসজিদে মিনারের বাহার হুজুর দেখেছেন, আমাদের চেয়ে ঢের বেশি।
‘কত দূর-দরাজ থেকে সে-মিনার দেখা যায়, সে আপনি জানেন, আমিও জানি সমীরুদ্দীও জানে।’
মিনার না দেখতে পেয়ে সমরুদী আশ্চর্য হয়ে গেল, তারপর ক্ৰমে ক্রমে এগিয়ে দেখে—কোথায় দিঘি, কোথায় টাইলের টঙি ঘর!’
আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালাম, ‘সে কী কথা!’
সারেঙ যেন আমার প্রশ্ন শুনতে পায় নি। আচ্ছন্নের মত বলে যেতে লাগল, ‘কিছু না, কিছু না, সেই পুরনো ভাঙা খড়ের ঘর, আরও পুরনো হয়ে গিয়েছে। যেদিন সে বাড়ি ছেড়েছিল, সেদিন ঘরটা ছিল চারটা বাঁশের ঠেকনায় খাড়া, আজ দেখে ছটা ঠেকনা। তবে কি ছোট ভাই বাড়ি-ঘরদের গায়ের অন্য দিকে বানিয়েছে? কই, তা হলে তো নিশ্চয়ই সেকথা কোন-না-কোন চিঠিতে লিখত। এমন সময় দেখে গায়ের বাসিত মোল্লা। মোল্লাজী আমাদের সবাইকে বড় প্যার করে। সমীরুদীকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘প্রথমটায় তিনিও কিছু বলতে চান নি। পরে সমীরুদ্দীর চাপে পড়ে সেই ধানক্ষেতের মধ্যিখানে তাকে খবরটা দিলেন। তার ভাই সব টাকা ফুঁকে দিয়েছে। গোড়ার দিকে শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, মৌলবীবাজারে, শেষের দিকে কলকাতায়—ঘোড়া, মেয়েমানুষ আরও কত কী?’
আমি থাকতে না পেরে বললুম, ‘বল কী সারেঙ! এ-রকম ঘা মানুষ কি সইতে পারে? কিন্তু বল দিকিনী, গায়ের কেউ তাকে চিঠি লিখে খবরটা দিলে না কেন?’
সারেঙ বললে, ‘তারাই বা জানবে কি করে, সমীরুদী কেন টাকা পাঠাচ্ছে। সমীরুদীর ভাই ওদের বলেছে, বড় ভাই বিদেশে লাখ টাকা কামায়, আমাকে ফুর্তি-ফার্তির জন্য তারই কিছুটা পাঠায়। সমীরুদ্দীর চিঠিও সে কাউকে দিয়ে পড়ায় নি—সমীরুদ্দি নিজে আমারই মত লিখতে পড়তে জানে না, কিন্তু হারামজাদা ভাইটাকে পাঠশালায় পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। তবু মোন্নাজী আর গায়ের পাঁচজন তার টাকা ওড়াবার বহর দেখে তাকে বাড়িঘরদের বাঁধতে, জমি-খামার কিনতে উপদেশ দিয়েছিলে। সে নাকি উত্তরে বলেছিল, বড় ভাই বিয়ে শান্দি করে মিরকিন মুলুকে গোরস্থালী পেতেছে, এ দেশে আর ফিরবে না, আর যদি ফেরেই বা, সঙ্গে নিয়ে আসবে লাখ টাকা। তিন দিনের ভিতর দশখানা বাড়ি হাঁকিয়ে দেবে।’
আমি বললুম, ‘উঃ! কী পাষণ্ড! তারপর?’
সারেঙ বললে, সমীরুদী আর গায়ের ভিতর ঢেকে নি। সেই ধানক্ষেত থেকে উঠে ফিরে গেল। আবার শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে। সমীরুদী আমাকে বলে নি কিন্তু মোল্লাজী নিশ্চয়ই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু সে ফেরে নি। শুধু বলেছিল, যেখান থেকে এয়েছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।
নিয়ে এলেন স্টেশনে—টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে সে গায়েই ছিল। সমীরুদ্দীর দু পা জড়িয়ে ধরে সে মাপ চেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে। আরও পাঁচজন বললেন, বাড়ি চল, ফের মিরকিন যাবি তো যাবি, কিন্তু এতদিন পরে দেশে এসেছিস, দুদিন জিরিয়ে যা।’
আমি বললুম, ‘রাস্কেলটা কোন মুখ নিয়ে ভাইয়ের কাছে এল সারেঙ?’
সারেঙ বললে, ‘আমিও তাই পুছি। কিন্তু জানেন সায়েব, সমীরুদী কী করলে? ভাইকে লাথি মারলে না, কিছু না, শুধু বললে সে বাড়ি ফিরে যাবে না।
‘তার পরদিন ভোরবেলা এই জাহাজে তার সঙ্গে দেখা। আপনাকে তো বলেছি, শাবন্দরের বারুণীর পুতুলের মত চুপ করে বসে।’
দম নিয়ে সারেঙ বললে, ‘অতি অল্প কথায় সমীরুদী আমাকে সব কিছু বলেছিল। কিন্তু হুজুর, শেষটায় সে যা আপন মনে বিড়বিড় করে বলেছিল, তার মানে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। তবে কথাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে বলেছিল, ‘ভিখিরি স্বপ্নে দেখে সে বড়লোক হয়ে গিয়েছে, তারপর ঘুম ভাঙতেই সে দেখে সে আবার দুনিয়ায়। আমি দেশে টাকা পাঠিয়ে বাড়ি ঘরদোর বানিয়ে হয়েছিলাম বড়লোক, সেই দুনিয়া যখন ভেঙে গেল তখন আমি গোলাম কোথায়?’
বাস্তব ঘটনা না হয়ে যদি শুধু গল্প হত, তবে এইখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু আমি যখন যা শুনেছি তাই লিখছি তখন স্যারেঙের বাদবাকি কাহিনী না বললে অন্যায় হবে।
সারেঙ বললে, ‘চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমার সর্বক্ষণ মনে হয় যেন কাল সাঁঝে সমীরুদ্দী আমার কেবিনের অন্ধকার তার ছাতির খুন ঝরিয়েছিল।
‘কিন্তু ওই যে ইনসাফ বললেন না হুজুর তার পাত্তা দেবে কে?’
সমীরুদী মিরকিন মুলুকে ফিরে গিয়ে দশ বছরে আবার তিরিশ হাজার টাকা কামায়। এবারে আর ভাইকে টাকা পাঠায় নি। সেই ধন নিয়ে যখন দেশে ফিরছিল তখন জাহাজে মারা যায়। ত্রিসংসারে তার আর কেউ ছিল না বলে টাকাটা পৌঁছল সেই ভাইয়েরই কাছে। আবার সে টাকাটা ওড়াল।’
ইনসাফ কোথায়?
এটা সইয়েদ মুজতবা আলীর বাস্তব জীবনের ঘটনা অবল্বনে লেখা বিখ্যাত ছোটো গল্প।