1 of 2

নৃশংস – রবীন দেব

নৃশংস – রবীন দেব

ড্রইংরুমে বসে গোয়েন্দা অফিসার মুকুল চৌধুরী অপেক্ষা করছিল সুরেন দাশের জন্য। বারবার হাতঘড়ি দেখছিল। আশ্চর্য! আজকেও সুরেন দাশ এল না কেন?

সুরেন দাশের ওপর সে সম্পূর্ণ নির্ভর করে আছে। তার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে কোনও সংবাদ আনতে পারবে। তার মতো গুণ্ডা যদি এ-সংবাদ না আনতে পারে, তাহলে আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মেয়েটি অ-শনাক্তই থেকে যাবে। যারা খুন করেছে, তারা বেশ সুস্থ মাথায় প্রতিটি প্রমাণ নিখুঁতভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। কী নৃশংসভাবে খুন করেছে মেয়েটাকে!

মুকুল এবার চমকে উঠল।

মানুষ এত হিংস্র শয়তান হতে পারে!

ক্ষুরধার ব্লেডের সাহায্যে কেটেছে। মাথা, হাত, পা—কিছুই নেই, শুধু ধড়টা আছে। গলা থেকে কোমর পর্যন্ত একটুকরো মাংসখণ্ড।

ধড়টা একটা মেয়ের। পূর্ণ যুবতী, যৌবনের প্রতিটি রেখা নিখুঁত। একসময় হয়তো সুন্দরী ছিল, রংও ছিল ফরসা, এখন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ। ফুলে গেছে। একটু পচা গন্ধও যেন বাতাসে ভাসছে।

মুকুলের নাকে যেন হঠাৎ পচা দুর্গন্ধ ভেসে এসে ঝাপটা মারল। আর পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল মুহূর্তের জন্য। সে ডাক্তার অপরেশ মুখার্জিকে জিগ্যেস করেছিল, হোয়াইট উইল বি দ্য এজ, ডক্টর মুখার্জি?

—মে বি টুয়েন্টি ফাইভ।

ধড়টা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, অন্তত দু-তিনদিন আগে খুন করা হয়েছে। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে রং। কাটা জায়গায় একফোঁটাও রক্ত নেই, মাংস কাগজের মতো সাদা।

আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন পরিষ্কার করতে নেমে সুইপার দেহটা পেয়েছিল।

মৃতদেহের যেটুকু পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয়, মেয়েটির যথেষ্ট দেহ-সৌন্দর্য ছিল। বয়েস মাত্র পঁচিশ বছর। কী নিটোল দেহ!…কে এমন নৃশংসভাবে খুন করতে পারে!…শনাক্ত করাও তো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শনাক্ত না হলে খুনিকে ধরা সহজ হবে না। খুনি খুন করে মেয়েটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে চারিদিকে ছড়িয়ে ফেলেছে। মাত্র এই ধড়টা ছাড়া আর কোনও অংশ পাওয়া যায়নি। হয়তো আর পাওয়া যাবে না।

পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট বলেছে, তীক্ষ্ন ব্লেডের সাহায্যে মাথা, হাত-পা কাটা হয়েছে। খুনি শরীরের বিভিন্ন অংশ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ। অর্থাৎ, তার বায়োলজি সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান নেই। মেয়েটির পেটে অ্যালকোহল এবং অজীর্ণ মাংস পাওয়া গেছে। মৃত্যুর সময় রাত্রি একটা থেকে দেড়টার মধ্যে।

যেদিন বডি পাওয়া গেছে তার দু-দিন আগে খুন হয়েছে।

পাবলিক প্রেস এবং সংবাদপত্রে সমস্ত বিবরণ প্রকাশ করেও কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন? মেয়েটির কি কোনও আত্মীয় নেই? যদি থাকে, তাহলে কেন তারা নিখোঁজ মেয়ের জন্য থানায় জানাচ্ছে না?

খুনির বায়োলজির কোনও জ্ঞান নেই। ব্লেড চালিয়েছে অপটু হাতে। তবে কি খুনি নতুন কোনও পাপী?

মেয়েটিকে শনাক্ত করতে অনেক চেষ্টা করেছে মুকুল, কিন্তু পারেনি। শেষটায় সুরেন দাশের সাহায্য নিতে হয়েছে তাকে। ইতিপূর্বে আরও কয়েকবার বিভিন্ন সংবাদের জন্য সুরেনকে নিয়োগ করা হয়েছিল, প্রতিবারই সে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।

সুরেন বলেছে, কিছু ভাববেন না, স্যার, দু-দিনেই আমি আসামিকে হাজির করছি।

আজ তিনদিন ধরে প্রতিদিনই মুকুল ভাবছে, আজ হয়তো সুরেন আসবে। কিন্তু আসেনি। আজও বসে আছে প্রতীক্ষায়।

—স্যার, খুব চিন্তা করছেন তো?—হাসতে-হাসতে সুরেন এল ড্রইংরুমে।

মুকুল হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল। সে দেখল, নেভি ব্লু রঙের টাইট প্যান্টের সঙ্গে ক্রিম কালার শার্টে সত্যিই চমৎকার মানিয়েছে সুরেনকে। লাল টকটকে গায়ের রং। বলিষ্ঠ, সুদেহী সুরেনের চেহারায় বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে। অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে। সহসা কেউ বিশ্বাস করবে না যে, সে গুণ্ডা। অথচ গুণ্ডামি আর চোরাই আফিমের কারবারের জন্য সে দুবার জেল খেটেছে। বর্তমানে আর বেআইনি কিছু করছে না। একটা রেস্টুরেন্ট দিয়েছে মহাত্মা গান্ধী রোডে। মুকুল গিয়েছিল কয়েকবার। বেশ চালু দোকান। দোকানটার নামটাও বড় চমৎকার : ‘সোনালি ড্রিঙ্ক’।

—বোসো সুরেন।—মুকুল হেসে বলল।

সুরেন সোফাতে বসে বলল, পেয়েছি, স্যার।

—পেয়েছ?—সাগ্রহে বলে মুকুল।

—হ্যাঁ, স্যার। মেয়েটার নাম মিস সোফিয়া বার্নার্ড। সে প্রাইভেট বিজনেস করত।

—প্রাইভেট বিজনেস! মানে?

—মানে স্যার, আপনার কাছে বলতে—।—একটু লজ্জা পেল সুরেন : এই সন্ধ্যার পর কোনও বারে বা রেস্টুরেন্টে নতুন বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে রাত কাটাত।

বুঝতে মুকুলের কোনও অসুবিধে হল না। গম্ভীর হয়ে বলল, কে বা কারা খুন করেছে জানতে পারলে?

—না স্যার, ওইখানেই ফেল মারলাম। তবে চেষ্টা করছি। হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই জানতে পারব। তবে স্যার, ওই ‘মিডনাইট কাফে’তে একটু নজর রাখবেন। আমি জেনেছি, সোফিয়া ওখানেই নাকি শিকার খুঁজতে প্রতিসন্ধ্যায় যেত।

সুরেনের কাছ থেকে সোফিয়া বার্নার্ড-এর ঠিকানা নিয়ে মুকুল বলল, অনেক ধন্যবাদ, সুরেন। আশা করি, তুমি আরও খবর এনে দিতে পারবে।

সুন্দর হাসিতে সুরেনের মুখ ভরে উঠল। বলল, আই হ্যাভ এনগেজড মাই অল স্ট্রেংথ ফর ইউ, স্যার।

সুরেন চলে যাওয়ার পর মুকুল অনেকক্ষণ একা-একা বসে রইল।…মিডনাইট কাফে। ওখানে বেআইনি কাজ-কারবার চলে বলে সে অনেক খবর পেয়েছে। কিন্তু কোনও প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি।…সোফিয়া বার্নার্ড ওখানে যেত শিকারের সন্ধানে। ভালো জায়গা। পকেট ভারী না থাকলে মিডনাইট কাফেতে যাওয়া যায় না। তরল নেশা আর নারীর নরক। সোফিয়ার পেটে ছিল অজীর্ণ মাংস আর মদ।

শহরের সন্ধ্যা।

নিয়নের হাতছানি মেশানো আলোর মায়াজাল।

মুকুল ক্রিক রো-তে এসে তার মোটরবাইক থামাল। তারপর নম্বর মিলিয়ে এক ত্রিতল বাড়ির গেটে এসে দরজার কলিংবেলের বোতামে চাপ দিল।

দরজা খুলে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বললেন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, মিস্টার?

মুকুল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রমহিলার দিকে সহজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আই ওয়ান্ট টু মিট মিস সোফিয়া। উইল ইউ প্লিজ শো মি হার ফ্ল্যাট?

—সোফিয়া! শি ইজ নট হিয়ার। শি ওয়েন্ট টু বোম্বে অন ফ্রাইডে বাই মর্নিং ফ্লাইট।

—বোম্বে! থ্যাংক্স, ম্যাডাম।—মুকুল ধন্যবাদ দিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিল। মনে-মনে হিসেব করল : শুক্রবার সোফিয়া বোম্বাই গেছে, আর যে-মেয়েটার ধড় পাওয়া গেছে, সে-ও খুন হয়েছে সেদিনই রাত্রি একটা থেকে দেড়টার মধ্যে।…সোফিয়া বার্নার্ডই হয়তো খুন হয়েছে। সুরেনের ইনফরমেশান মিথ্যে নাও হতে পারে।

দূর থেকেই মুকুলের দৃষ্টি আটকে গেল ঝলমলে নিয়ন লাইটে ঝলসানো ‘মিডনাইট কাফে’তে।

মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ভেতরে এল।

একটা টেবিলও খালি নেই। পরদা ফেলা কেবিনগুলোর মধ্যেও বেশ একটা মৃদু গুঞ্জন। সার্ভাররা ট্রে হাতে সার্ভ করে যাচ্ছে পেগ, গ্লাস।

মুকুল এগিয়ে গেল কাউন্টারে। একটা চেয়ারের হাতলে বসে এক সুবেশিনী। তার যৌবনপুষ্ট দেহ যেন আকাশি রঙের নাইলন শাড়ি ভেদ করে ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বড় উগ্র তার দেহ-সৌন্দর্য। পাতলা লাল ঠোঁটে স্ট্র চেপে কোল্ড ড্রিঙ্কস পান করছে।

মুকুল এসে দাঁড়াল।

নারী তন্দ্রাচ্ছন্ন চাউনি মেলে ধরল। যেন পদ্মকোরক পাপড়ি মেলেছে। মিষ্টি সুরে বলল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট, মিস্টার?

মেয়েটির ইংরেজি শুনে মুকুল বুঝল এ-ভাষাটা তার এখনও বিশেষ ভঙ্গিমায় রপ্ত হয়নি। সে বলল, মিস্টার কাপুর কোথায়?

—মিস্টার কাপুর তিন নাম্বার কেবিনে গেছেন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে।

মুকুল আর কিছু না বলে ফিরে চাইল। প্রকাণ্ড হলে অন্তত একশোটা টেবিল। প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ কী নির্লজ্জের মতো ড্রিঙ্ক করছে। তার মনে হল, হয়তো সে এ-দেশে নেই। সমুদ্রপারের কোনও বিদেশি শহরের এক বারে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা টেবিল হতে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছোকরা বেসামাল অবস্থায় তার বান্ধবীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে বেরিয়ে গেল।

মুকুল এসে বসল সেখানে।

—এনি ড্রিঙ্ক স্যার?—সার্ভার এসে দাঁড়াল।

—হুইস্কি। বড়া পেগ।—মুকুল সিগারেট ধরাল।

সার্ভার ট্রে হতে পেগ, গ্লাস নামিয়ে রেখে চলে গেল।

মুকুল স্থির দৃষ্টি মেলে দেখল, তরল নেশা টলটল করছে সুদৃশ্য কাচের গ্লাসে।

হঠাৎ সে দেখল মিস্টার কাপুর তিন নম্বর কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন কাউন্টারের দিকে। মুকুল দ্রুত এসে দাঁড়াল তাঁর কাছে। বলল, মিস্টার কাপুর, আই হ্যাভ সাম আর্জেন্ট টক উইথ ইউ।

—আর ইউ মিঃ চৌধুরী? —অবাক বিস্ময়ে বলেন মিস্টার কাপুর, বলুন, কী ব্যাপার।

—চলুন, আপনার চেম্বারে যাওয়া যাক।

মিস্টার কাপুরের কপালের চামড়া কুঁচকে গেল। তিনি বিস্মিত দৃষ্টি মেলে মুকুলের দিকে তাকিয়ে একটা দরজার ভারী নীল পরদা সরিয়ে সরু প্যাসেজ দিয়ে তাকে নিয়ে নিজের চেম্বারে বসলেন।

—আপনি মিস সোফিয়া বার্নার্ড বলে কাউকে চেনেন?

—সোফিয়া বার্নার্ড! সোফিয়া!—বিড়বিড় করে বারকয়েক নামটা উচ্চারণ করলেন মিস্টার কাপুর। পরে পরিষ্কার কণ্ঠে বললেন, আই অ্যাম সরি, মিস্টার চৌধুরী। এ-নামের কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই।

—আপনার এখানে যেসব মেয়ে আসে, তাদের সবাইকে চেনেন?

—সবাইকে চিনি বললে ভুল হবে। তবে যারা নিয়মিত আসে, তাদের চিনি বইকি।—মৃদু হাসলেন মিস্টার কাপুর। বললেন, কেন বলুন তো?

—না, তেমন কিছু নয়। শুধু তার হোয়্যার অ্যাবাউটস জানতে চাই।—মুকুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

মিডনাইট কাফের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবছিল।…মিস্টার কাপুর সোফিয়াকে চেনেন না? আশ্চর্য তো! অথচ সে নাকি নিয়মিত এখানে শিকারের সন্ধানে আসত। তবে কি কাপুর মিথ্যে বললেন?….এই বার সম্বন্ধে অনেক খবর তার জানা আছে। তবে কি এখানেই কোনও অঘটন ঘটেছে?

হঠাৎ সে দেখল, একজন সার্ভারের কাঁধে ভর করে এক ভদ্রলোক আসছেন।

চকিতে তার মনে পড়ল, তিন নম্বর কেবিনের পরদা উঠিয়ে যখন মিস্টার কাপুর বেরিয়ে আসেন, তখন এ-মুখটাকে সেখানে সে দেখেছিল। মুকুল দ্রুত এগিয়ে এল তাদের কাছে।

এক ট্যাক্সি ড্রাইভার যেন ভাড়ার জন্য ওত পেতে বসেছিল। সে এগিয়ে এল। সার্ভার আর ধরে রাখতে পারছে না বেহুঁশ লোকটাকে। মুকুল এসে লোকটাকে আর-এক হাত ধরে ঠিক করে দাঁড় করাতেই তার পকেট থেকে একটা পার্স পড়ে গেল।

মুকুল পার্সটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল, এক যুবতীর ফটোগ্রাফ আটকানো। ভ্রূ কুঁচকে গেল তার। সার্ভারের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, একে চেনো?

—জি সাব। মিস সোফিয়া।—মৃদু হেসে বলল সার্ভার।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে তৈরি করে নিল মুকুল। সে ড্রাইভারের সঙ্গে লোকটাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসল।

মিস্টার কাপুর বলেছেন, তিনি সোফিয়াকে চেনেন না। কিন্তু সেই মাতাল মিস্টার গোপাল গণেশন বলেছে, কাপুর তার সঙ্গে সোফিয়ার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সোফিয়া, ভেরি চার্মিং লেডি। হাউ নাইস শি ইজ! হাউ সুইট! অথচ আজ পাঁচদিন সে তার কোনও খবর পাচ্ছে না।

মুকুল বলেছিল, কেন, কোথায় গেছে?

—জানি না। বৃহস্পতিবার রাত্রে সোফিয়াকে নিয়ে এক জুয়েলারি দোকানে গিয়ে হীরের ব্রেসলেট কিনে দিয়েছিলাম। কথা ছিল, শুক্রবার সন্ধ্যায় দেখা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনও খবর নেই। প্রতিদিন বারে গেছি। রাত এগারোটা পর্যন্ত চুপ করে বসে ড্রিঙ্ক করেছি। শূন্য গ্লাসের মতো শূন্য হৃদয়ে ফিরে এসেছি। কাপুরকে জিগ্যেস করেছি। অথচ সোফিয়া যেন হাওয়ায় মিশে গেল!—মিস্টার গণেশনের নেশা-জড়ানো চোখের কোণে অশ্রু চকচক করে উঠেছিল।

—তার বাড়িতে খোঁজ নিলেন না কেন?

—ঠিকানা জানিনে। বারেই আলাপ। সেখানেই দেখা পেতাম। তাই ঠিকানার কোনও প্রয়োজন হয়নি। —মিস্টার গণেশন ক্লান্ত কণ্ঠে বলেছিল।

মুকুল নিজে ক্রিক রো-তে গিয়ে সোফিয়ার ফ্ল্যাট সার্চ করে এসেছে। কিছুই পায়নি। চলে যাওয়ার সমস্ত চিহ্ন শুধু ছড়ানো ছিল তার ঘরে। প্রয়োজনীয় কোনও জিনিস ফেলে যায়নি। হয়তো সে সত্যিই চলে গেছে এ-নগর ছেড়ে অন্য নগরের হাটে।

এয়ারওয়েজ অফিসগুলোতে খবর নিয়ে জেনেছে, সোফিয়া বার্নার্ড নামে কোনও মেয়ে বোম্বে যায়নি। ভেবেছিল, হয়তো অন্য নামের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু না। সোফিয়া বার্নার্ডের ফটোগ্রাফ দেখে এয়ারহোস্টেস বলেছে, এ-মেয়েকে সে দেখেনি।

মুকুলের মনের মধ্যে কতগুলো সন্দেহ মাথা তুলে জেগে উঠল।

কাপুর। কাপুরই এ-রহস্যের নায়ক। হয়তো সে ছিল সোফিয়ার এজেন্ট। কোনও কারণে মনোমালিন্য হওয়াতে তাকে সরিয়ে দিয়েছে। নতুন পাপী এমন নিখুঁত কাজ করতে পারে না। ঠান্ডা মাথায় ব্লেড চালিয়ে দেহের অংশগুলো কেটেছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে খুন করে শনাক্ত করতে না দেওয়ার জন্য দেহের অংশগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ফেলেছে।

গণেশন হয়তো মিথ্যে বলেনি, ওরকম মাতাল এমনভাবে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না।

—স্যার।

চমকে উঠল মুকুল। সত্যি সে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল। নইলে সে জানতে পারত সুরেন কখন এসেছে। মৃদু হেসে কৌতূহলী চাউনি মেলে বলল, আর কিছু জানতে পারলে?

—একটু আভাস পেয়েছি, স্যার। মিস্টার গোপাল গণেশন আর ম্যানেজার মিস্টার কাপুর, এরা দুজনেই এ-রহস্যের নায়ক।—শান্ত কণ্ঠে বলে সুরেন।

—আমার কিন্তু গণেশনকে সন্দেহ হয় না।

—বলেন কী!—দু-চোখ কপালে তুলে বলে সুরেন।

—মাতাল গণেশনকে আমি জেরা করেছি। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু বুঝতে পারিনি।

—আমি জানি, স্যার। সেসময় আমিও বারে ছিলাম। ওদের ওয়াচ করছিলাম। গণেশন কী অদ্ভুতভাবে মাতালের অভিনয় করে আপনাকে বোকা বানাল!—সুরেন রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল।

—অভিনয়?—মুকুলের ভ্রূ কুঁচকে যায়।

—হ্যাঁ, স্যার। আমি ওদের পাশের কেবিনে ছিলাম। কাঠের পার্টিশনের ফাঁকে চোখ রেখে দেখেছি। গণেশন গায়ে মদ ঢেলে মাতালের মতো টলতে-টলতে এক সার্ভারের কাঁধ ধরে বেরিয়ে আসে। আপনি যখন তাকে জেরা করেন, তখন সে মোটেই মাতাল ছিল না।

—সোফিয়াকে ওরা খুন করবে কেন?

—এখনও তা ঠিক বুঝতে পারিনি। আশা করছি, দু-একদিনের মধ্যে প্রমাণসমেত ওদের আপনার কাছে ধরে দিতে পারব। তবে মনে হচ্ছে, ওদের কোনও গোপন কথা সোফিয়া জানত, তাই হয়তো সে তাদের ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল।

সুরেন চলে যাওয়ার পর মুকুলের মনে হল, হয়তো সে ঠিক খবরই দিয়ে গেল। গণেশনকে এখন কেমন যেন ঠিক মাতালের মতো মনে হচ্ছে না। নেশায় যে ঠিক দাঁড়াতে পারছিল না, সে যেন অনেকটা সুস্থ মানুষের মতো প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। সোফিয়া যে-চরিত্রের মেয়ে তার পক্ষে অন্যের গোপন কথা জানতে পারা অসম্ভব নয়। তবে কি তারা ব্ল্যাকমেলড হওয়ার ভয়েই এমন নৃশংসভাবে খুন করে প্রমাণ নষ্ট করেছে?

অফিসে এসে নিজের চেম্বারে বসে আবার গভীরভাবে প্রতিটি ঘটনা চিন্তা করতে শুরু করল। বারকয়েক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পড়ল। একবার ভাবলে, মিডনাইট কাফে রেইড করবে। কিন্তু কোনও প্রমাণ তো হাতে নেই! অসহায় হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল।

—স্যার!—সাব-ইন্সপেক্টর বিদ্যুৎ সেন এসে দাঁড়াল।

—কিছু জানতে পারলে?—মুকুলের ক্লান্ত কণ্ঠ।

—মিস্টার গোপাল গণেশন সম্পর্কে মাদ্রাজ পুলিশের কাছ থেকে ওয়্যারলেসে খবর এসেছে।

—তাই নাকি!—মুকুল সোজা হয়ে বসল।

—হ্যাঁ, স্যার। মিস্টার গণেশন একজন চোরাকারবারি বলে মাদ্রাজ পুলিশ সন্দেহ করে। তা ছাড়া একটা মার্ডার কেসের সঙ্গেও সে নাকি আংশিকভাবে জড়িত। তবে তার জোরালো অ্যালিবাই থাকার জন্যে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না।

—মিস্টার কাপুরের সম্পর্কে ইনফরমারদের কী রিপোর্ট?

—মিস্টার কাপুর চোলাই মদের বেআইনি ব্যবসা করছেন। সে-চোলাই মদ চন্দননগর থেকে চালান হয়ে আসে। তবে এখনও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।—বিদ্যুৎ বলল।

মুকুল হতাশ হয়ে পড়ে। আশ্চর্য! এই দুজন ক্রিমিন্যাল সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে কাজ-কারবার চালিয়ে যাচ্ছে নিখুঁতভাবে। তার যেন মনে হল, মিস্টার কাপুর আর গণেশন তার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে উন্মাদের মতো হেসে ব্যঙ্গ করছে।

অসহ্য! ভেতরে-ভেতরে ছটফট করতে থাকে মুকুল। না, যে-করেই হোক এদের সে আর পৃথিবীর মুক্ত প্রাঙ্গণে চলাফেরা করে পাপ কাজ করতে দেবে না।

গভীর রাত্রি।

অন্ধকার আকাশের বুকে শুধু নিয়ন লাইটের বিজ্ঞাপন জ্বলছে।

ক্লান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে গভীর ক্লান্তিতে।

মুকুল ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলেছে।

স্ট্র্যান্ড রোডের ফুটপাথ থেকে নেমে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল মহাত্মা গান্ধী রোডের এক গলির মধ্যে। সরু বাই লেন দিয়ে চলতে থাকল। সামনেই বাঁদিকে সুরেন দাশের রেস্টুরেন্ট সোনালি ড্রিঙ্ক-এর খিড়কি দরজা। সুরেন এখানেই থাকে। তাকে চুপিচুপি ডেকে নিয়ে এখনই যাবে মিডনাইট কাফেতে হামলা করতে। সুরেন সঙ্গে থাকলে অনেক সহজ হবে কাজ। কারণ, মিডনাইট কাফের অলিগলি সবই তার নখদর্পণে।

দরজার সামনে দাঁড়াল মুকুল।

ভেতরে আলো জ্বলছে। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর ক্ষীণ রেখা এসে পড়ল মুকুলের মুখ হতে কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে।

সে ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়াল।

সুন্দর একটা ঘর। ও-পাশের দেওয়াল ঘেঁষে দুটো রেফ্রিজারেটর। একটা ওয়টলের সাদা চেয়ারে বসে আছে সুরেন। তার সামনের টেবিলে মুক্তো-রঙের ফ্লাওয়ার ভাসে তাজা ব্ল্যাক প্রিন্স। ও-পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার মুখ দেখতে পেল না মুকুল। শুধু তার দুধ-সাদা অর্গান্ডির গাউনের ফ্রিল শ্বেত-প্রজাপতির পাখার মতো ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে। নরম সোনালি হাতের কনকচাঁপা আঙুলে সদ্য-জ্বলা সিগারেট।

—কী করবে ঠিক করেছ?—জলতরঙ্গের মিষ্টি আওয়াজ মেয়েটির কণ্ঠে।

—এগুলো ঠিকমতো পাচার করতে পারলে আর চিন্তা করি না।—সুরেন ওয়াইন গ্লাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল।

—মিস্টার চৌধুরী সন্দেহ করেনি তো?—মেয়েটির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

—না। শুধু আজকের রাতটা কেটে গেলেই আমি নিশ্চিন্ত। তাহলে আর কে…।—সুরেনের যেন দম আটকে যায়। একটু কেশে ওঠে। বার দুই ঢেকুর তোলে সে। তারপর রুমাল দিয়ে মুখ মোছে।

মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা রেফ্রিজারেটরের সামনে গিয়ে পাল্লা খুলে দাঁড়ায়।

—আর মাত্র একঘণ্টা। তারপর ওগুলো সরিয়ে ফেলব।—সুরেনের মুখে জাগে অদ্ভুত হাসি, চোখে ফোটে শ্বাপদের হিংস্রতা।

মেয়েটি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুকুল তার মুখ দেখতে পেল না। সে কৌতূহলী চাউনি মেলে তাকিয়ে রইল।

মেয়েটার রুক্ষ চুল এসে থেমে গেছে অনাবৃত মসৃণ গোলাপি পিঠে। সাদা অর্গান্ডির স্বচ্ছ বুনটের ভিতরে সুন্দর নিটোল দেহ।

—এ-কাজ না করলে পারতে।

—কী যে বলো! নইলে শয়তানি সব পুলিশে বলে দিত। বর্মায় লিমাং ছিল আমার একমাত্র ভরসা। ও-ই ওখান থেকে ওপিয়াম আর গোল্ড পাঠাত। কিন্তু কী করব? সুযোগ বুঝে আমাকে ধমক দিল, ভয় দেখাল; পাঁচ লাখ টাকা না দিলে সব পুলিশে জানিয়ে দেবে। তাই তো কায়দা করে লিমাংকে এখানে এনে শেষ করে দিলাম। তা না করলে যে আমাকেই মরতে হত।

সুরেন গম্ভীর হয়ে ওঠে।

মেয়েটি এবার আসে সুরেনের কাছে।

চমকে ওঠে মুকুল।

সোফিয়া! সেই দীঘল চোখে কেমন যেন আতঙ্ক। সোনা-রং মুখে তার ঘাম, পাতলা লাল ঠোঁট দুটো চকচক করছে। একটু কাঁপছে।

সে চাইল খোলা রেফ্রিজারেটরের ভেতরে। মধ্যের তাকে রয়েছে দুটো পা আর দুটো হাতের ছিন্ন অংশ। একটা কী যেন জড়ানো আছে রক্তাক্ত কাপড়ে। হয়তো লিমাং নামের মেয়েটার মাথা…!

শিউরে উঠল মুকুল। সে যেন অনেকটা ছুটেই এল বড় রাস্তাতে।…থানা…থানা অনেক দূরে।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৬৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *