নূতন মানুষ

নূতন মানুষ

এমন আশ্চর্য ব্যাপার পূর্বে কখনও ঘটে নাই। নেপালচন্দ্রের পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়া কাঁদিল না, স্রেফ বলিল, ‘পেস্তা!’

নেপালের মনে বড় ধোঁকা লাগিল। এ কি রকম ছেলে? একে তো পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে একটি আঠারো বছরের তরুণীকে বিবাহ করিয়াছে, তাহার উপর পাকিস্তানে বাস—চারিদিকে পেস্তা-বাদামখোর মুস্কো জোয়ান ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; এরূপ অবস্থায় ছেলে যদি ভূমিষ্ঠ হইয়াই পেস্তার ফরমাস করে তবে কার না সন্দেহ হয়? কিন্তু নেপাল ভালমানুষ লোক, সে লজ্জায় সন্দেহের কথা কাহাকেও বলিতে পারিল না।

ষষ্ঠী পূজার দিন নেপালের স্ত্রী বলিলেন, ‘ছেলের মুখ অবিকল তোমার মতো হয়েছে।’

নেপাল অনেকক্ষণ ধরিয়া পুত্রমুখ নিরীক্ষণ করিল; কিন্তু নিজের মুখের সহিত কোনও সাদৃশ্যই খুঁজিয়া পাইল না; বরং অত্যন্ত পরিপক্ক ডেঁপো ছেলের মতো একটা মুখ। এত অল্প বয়সে মুখ এত পাকিল কি করিয়া নেপাল ভাবিয়া বিস্মিত হইল। শুধু একটা ভরসার কথা, গায়ের রঙ পেস্তাবাদামপুষ্ট কাবুলী ধাঁচের নয়, বরং খাঁটি বাঙালীর মতোই নবজলধরকান্তি।

একুশ দিনের দিন আঁতুড় ঘর হইতে বাহির হইয়া নেপালের পুত্র গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘ইডলি!’

কি সর্বনাশ! নেপাল চমকিয়া উঠিল। ‘ইডলি’ একপ্রকার মাদ্রাজী খাদ্য। তাহার মনে পড়িল পুত্রজন্মের নয় দশ মাস পূর্বে সে একবার অল্পদিনের জন্য সস্ত্রীক মাদ্রাজে গিয়াছিল। এত অল্প বয়সে এমন বাচাল ছেলে বাঙালীদের ঘরেও দেখা যায় না। তবে কি—তবে কি মাদ্রাজেই কোন গণ্ডগোল ঘটিয়াছে নাকি?

নেপালের মনে আর সুখ রহিল না। সে ভাবিতে লাগিল, ছেলেটা দেশ-বিদেশের খাবারের নাম করিতেছে, যদি বাঙালীর ছেলেই হয় তবে সন্দেশ রসগোল্লার নাম করে না কেন? পেস্তা এবং ইডলি কি সন্দেশ রসগোল্লার চেয়েও মুখরোচক? অন্তত পান্তুয়া কিংবা জিলিপি বলিতে পারিত! যে ছেলে অবলীলাক্রমে পেস্তা এবং ইডলি বলিতে পারে তাহার পান্তুয়া বা জিলিপি উচ্চারণ করা কি এতই শক্ত?

তারপর, এক মাস বয়সে নেপালের পুত্র একদিন ঘুম হইতে জাগিয়া হাই তুলিল এবং বলিল, ‘নাপ্পি!”

নাপ্পি! নেপাল শিহরিয়া উঠিল। এ যে ক্ৰমে ভারতের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে! যুদ্ধের সময় জাপানীরা বর্মা আক্রমণ করিলে একদল বর্মী পলাইয়া আসিয়া তাহার বাড়ির কাছে আশ্রয় লইয়াছিল বটে। হরি হরি!

নেপাল আর থাকিতে পারিল না। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হ্যাঁগা, এ ছেলে কোন দেশের মানুষ?’

স্ত্রী হাসিয়া উত্তর দিলেন, ‘ও নতুন যুগের মানুষ। ওর দেশ নেই, সব দেশই ওর দেশ। পৃথিবীর হাওয়া বদলে গেছে বুঝতে পারছ না?’

হয়তো বদলাইয়া গিয়াছে, নেপাল বুঝিতে পারে নাই। হয়তো ভবিষ্যতের ছেলেরা অ্যাটম বোমা হাতে লইয়া রৈ রৈ করিতে করিতে মাতৃগর্ভ হইতে বাহির হইবে, তাহাদের দেশকালপাত্র জ্ঞান থাকিবে না; বানর বংশে যেমন মানুষ জন্মিয়াছিল, মানুষ বংশে তেমনি অতিবানর জন্মিবে। Evolution না Atavism?

কিন্তু সে যাহা হোক সব ছেলেই যদি ঐ রকম হয়, তাহা হইলে অবশ্য এ ছেলেকে সন্দেহ করা চলে না—

নেপাল এইসব চিন্তা করিতেছে এমন সময় শুনিল ছেলে পরিষ্কার বলিতেছে—‘ল্যাংচা!’

নেপালের হৃৎযন্ত্র তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিল। যাক, তবু ছেলে বাঙলা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে।

২৭ ফাল্গুন ১৩৫৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *