নীল আগুন
যেরকম পথে ঘাটে হিপিদের দেখা যায়, লম্বা-লম্বা চুলওয়ালা ছেলে ও মেয়ে অনেক সময় খালি পা, নোংরা পোশাক—সেইরকমই একজোড়া যুবক-যুবতীকে আমি দেখেছিলাম। কিছুই অবাক হইনি।
ওরা পার্কস্ট্রিটে চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। দুজনেরই পোশাক একরকম, প্যান্ট ও সার্ট, সোনালি রঙের চুল, হালকা নীল চোখের মণি, দুধে আলতা রং, অন্য হিপিদের মতো এরা তেমন নোংরা নয়, যদিও পোশাক ছেঁড়াখোঁড়া।
ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে পরস্পরের মধ্যে নীচু গলায় কথা বলছিল। আমি দু-এক পলক ওদের দিকে তাকিয়েছিলাম, ওরা এতই রূপবান যে, না তাকিয়ে পারা যায় না। দুজনেরই মুখ অপরূপ সারল্য মাখানো।
আমি ভাবলাম, ওরা তো বেশ ভালোই আছে। চাকরি-বাকরি কিংবা ঘর সংসার নিয়ে থাকাই এই পৃথিবীর নিয়ম। এ নিয়ম বড় পুরোনো হয়ে গেছে, ওরা যদি সে নিয়ম না মানে, তাহলে বুঝতে হবে ওরা অন্যরকম সুখ চাইছে।
অধিকাংশ হিপিই একরকম চেহারার হয়, এবং সাহেব-মেমদের মুখ একবার মাত্র দেখে মনে রাখাও যায় না। সুতরাং ওদেরও মনে রাখার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু আমি ঘাম মুছবার জন্য যেই পকেট থেকে রুমাল বার করতে গেছি অমনি ঝনঝন করে কয়েকটা খুচরো পয়সা রাস্তায় পড়ে গেল। কয়েকটা গড়িয়ে গেল ওদের পায়ের কাছে।
আমি নীচু হয়ে পয়সা তুলতে গেলাম। ছেলেমেয়ে দুটিও পয়সা কুড়িয়ে আমার হাতে দিল। আমি হেসে বললাম থ্যাঙ্ক য়ু।
ওরা দুজনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর কি বলল আমি বুঝতে পারলাম না। বোধহয় ওদের ভাষা ইংরেজি নয়, জার্মান, ফরাসি ডাচ ছেলেমেয়েরাও তো হিপি হয়।
আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। হাঁটতে লাগলাম ধর্মতলার দিকে। ওরা সেখানেই রইল দাঁড়িয়ে। মেয়েটির হাসি আমার এতই সুন্দর লেগেছিল যে, আমি দু-একবার ওদের দিকে ফিরে ফিরে না তাকিয়ে পারিনি। বেশিবার তাকানো আবার অভদ্রতা। তবে, ছেলেটার চোখ যেন বেশি জ্বলজ্বল করছিল।
এটা একটা সামান্য ঘটনা মনে রাখবার মতন কিছু নয়। আমিও মনে রাখিনি।
এর কয়েকদিন পর আমি বেনারস গিয়েছিলাম। বেনারস তো একেবারে হিপিদের রাজত্ব। রাস্তায়, বিশেষত গঙ্গার ধারে শতশত হিপিদের যখন-তখন দেখা যায়। এদের মধ্যে যদি সেই দুজন হিপিকে হঠাৎ একদিন দেখি, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমি কিন্তু ওদের দুজনকে অত ভিড়ের মধ্যেও চিনতে পেরেছিলাম। সেই মেয়েটির হাসি দেখেই চিনলাম। হাসিটা আমার চোখে লেগেছিল, মেয়েটির শরীরটা এত সুন্দর এবং মুখখানা এত লাবণ্যময়, যে সিনেমায় নামলে দারুণ নাম করতে পারত, তার বদলে একটা পাতলা জামা ও প্যান্ট পরে গঙ্গার ধারে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে।
এর দুদিন পরে বেনারসে একটা ছোটখাটো দাঙ্গা লেগেছিল। একদল লোক লাঠিসোটা এমন কি খোলা তলোয়ার হাতে রাস্তায় নেমে পড়ল। তারা সব হিপিদের তাড়াবে। কয়েকজন হিপিকে মারধোরও করল খুব। তবে ঠিক সময়ে পুলিশ এসে পড়ায় বেশিদূর গড়াল না। অনেক গ্রেপ্তার হল। লোকগুলো নাকি অধিকাংশ গুন্ডাশ্রেণির।
হিপিদের ওপর ওদের অত রাগের কারণটা পরে জানতে পারলাম। বেনারসে আমি উঠেছিলাম আমার বন্ধু প্রশান্তর বাড়িতে। আমার বন্ধুর স্ত্রী গীতি যাকে বলে সরকারি গেজেট। রোজ সকালবেলা বাজার করতে গিয়ে গীতি যাবতীয় খবর সংগ্রহ করে আনে।
গীতি আমাদের একটি লোমহর্ষক কাহিনি শোনাল।
বেনারসের আশেপাশে এখনও অনেক ছোটখাটো রাজা ও জমিদার রয়ে গেছে, তারা প্রায় মধ্যযুগীয় কায়দায় জীবন কাটায়। তারা নিজস্ব গুন্ডা পোষে, অনেক সময় লোকজনকে খুন করে মৃতদেহ গায়েব করে দেয়, নানা জায়গা থেকে স্ত্রীলোক ধরে আনে।
হিপিদের মধ্যে অনেক সুন্দর-সুন্দর মেয়ে আছে বলে অনেক সময় এইসব রাজা ও জমিদাররা গুন্ডা দিয়ে হিপি মেয়েও লুঠ করে। আগেকার দিনে কোনও মেমসাহেবকে ভোগ করার কথা তারা ভাবতেও পারত না। এখন অনেক সুযোগ, বেনারসে এত হিপি মেয়ে গিসগিস করছে। তার মধ্যে দু-একজন হারিয়ে গেল কি না গেল কে খোঁজ রাখে।
সেই রকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল গতকাল। একজোড়া হিপি ছেলেমেয়ে রাত্তিরবেলা একটা সরু গলি দিয়ে যাচ্ছিল, এই সময় তিনজন গুন্ডা তাদের অনুসরণ করে। গুন্ডাদের সঙ্গে লাঠি ও ছুরি ছিল।
গলিটা ছিল কানাগলি। এক জায়গায় শেষ হয়ে গেছে। সামনে দেওয়াল, হিপি ছেলে ও মেয়েটা বুঝতে পেরেছিল, তাদের পিছনে গুন্ডা লেগেছে। কিন্তু রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের আর পালাবার উপায় নেই, তাই পিছনে ফিরল।
সঙ্গে-সঙ্গে গুন্ডা তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির ওপর। মেয়েটি কিন্তু একটুও ভয় পায়নি। সে চিল্কার করে কি যেন বলল ছেলেটিকে।
ছেলেটি একজন গুন্ডাকে টেনে তুলল। তারপর সে গুন্ডাটির দুটি হাত ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। ছিঁড়ে ফেলে মানে শরীর থেকে একেবারে ছিঁড়ে আলাদা করে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর সে গুন্ডাটার চোখ দুটো খুবলে নেয়।…
গল্পের মাঝখানে বাধা দিয়ে আমি বললাম, গীতি বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছেনা? গীতি তার সুন্দর মুখে দারুণ বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, আপনি বিশ্বাস করছেন না? সবাই একথা শুনেছে। সাহেব ছেলেটার চোখ দিয়ে নাকি আগুন বেরুচ্ছিল।
—তারা কী করে জানল? ওখানে কি আর কেউ উপস্থিত ছিল? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি যেন পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলে।
এসব কথা ঠিক জানা যায়, বুঝলেন। পরে সেই ডেড বডিটা অনেকে দেখেছে, তার মুখটা আগুনে পোড়া, অথচ সেখানে কোনও আগুন ছিল না।
বাকি গুন্ডা দুজন কী করল?
তারা সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল।
মানুষের হাত টেনে ছিঁড়ে ফেলা একটা অমানুষিক কাজ, হিপিরা সাধারণত নিরীহ হয়। ওদের কাছে অস্ত্র থাকে না, তা ছাড়া গাঁজা-ভাঙ খেয়ে-খেয়ে শরীরেও জোর থাকে না বিশেষ। তবে জুডো আর ক্যারাটে নামে কয়েক রকম যুযুৎসু আছে, যাতে একজন ছোটখাটো মানুষও বিশাল চেহারার লোককে টিট করে দিতে পারে। কিন্তু হাত ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব। আমরা এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম, এমনসময় প্রশান্তর বন্ধু তুষার এল।
তুষার সব শুনে বলল, গল্পটার অনেকখানি অংশ সত্যি। গতকাল রাত্রে কাশীর একটা সরু গলিতে একজন কুখ্যাত গুন্ডার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তার একটা হাত কাটা অবস্থায় পড়ে ছিল পাশে। চোখ দুটোও গেলে দেওয়া হয়েছে।
তুষারের মামা এখানকার পুলিশের একজন হোমড়া-চোমড়া অফিসার। তিনি দিয়েছেন এ খবর। ব্যাপারটার মধ্যে বেশ রহস্য আছে।
মারা গেছেন একজন কুখ্যাত গুন্ডা—সে একটা মেয়েকে চুরি করতে গিয়েছিল। সুতরাং সে যোগ্য শাস্তিই পেয়েছে বলা যায়। কিন্তু দেখা গেল, বেনারসে অধিকাংশ লোক হঠাৎ ক্ষেপে গেল হিপিদের ওপরে। দাবি উঠল সব হিপিকে তাড়িয়ে দেওয়ার। থাইল্যান্ড কিংবা শ্রীলঙ্কায় যে রকম করা হয়েছে। গুন্ডারা বেনারসে চিরকালই ছিল এবং থাকবে। তাদের ঘাঁটাবার কোনও মানে হয় না।
শিক্ষিত লোকেরা বলতে লাগল, হিপিদের মধ্যে সি.আই.এ.-র দালাল এবং নানারকম স্পাই মিশে থাকে। ওদের এরকম যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। কথাটার মধ্যে হয়তো কিছু সত্যি থাকতেও পারে। তবে হিপিদের মধ্যে যে অন্য অনেক কিছু মিশে থাকে, তার প্রমাণ আমি পেলাম কয়েকদিন পরে।
বেনারসে ওই ঘটনা শুনে আমার মনে হচ্ছিল আমি যে হিপি যুগলকে চিনি এই ব্যাপারটা বোধহয় তাদের নিয়েই। অবশ্য এর কোনও ভিত্তি নেই। হাজার-হাজার হিপি রয়েছে। তবে হিপিদের। মধ্যে অনেক সুন্দর মেয়ে থাকলেও ওই মেয়েটির মতো সুন্দর আমি কারুকে দেখিনি।
শুনলাম অনেক হিপি বেনারস ছেড়ে চলে গেছে। নিশ্চয়ই ওদের স্বর্গস্থান নেপালে আরও ভিড় বাড়বে।
প্রশান্তর ফিয়াট গাড়িটা গ্যারেজ থেকে মেরামত হয়ে আসার পরই ও বলল, চলো কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
বেনারসে আমি বেশ কয়েকবার এসেছি। অনেক কিছুই দেখা। শুধু চুনারে আমার যাওয়া হয়নি। তাই ঠিক হল চুনারে যাওয়া হবে।
কথা ছিল, সকালে গিয়ে সন্ধের আগে ফিরে আসা। কিন্তু চুনারে দুর্গের ওপরের গেস্ট হাউসটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি ভারতের বহু জায়গায় গেস্ট হাউসে থেকেছি, কিন্তু এমন সুন্দর জায়গা দেখিনিই প্রায় বলতে গেলে।
পাহাড় কেটে বসানো হয়েছে দুর্গ, সেই দুর্গে একসময় যেটা ছিল দরবার এখন সেটাই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। বিশাল বিশাল সুসজ্জিত ঘর। সামনে সুন্দর সাজানো চাতাল, অনেক নীচে গঙ্গা। গঙ্গা এখানে একটা বাঁক নিয়েছে, সন্ধের আধো অন্ধকারে মনে হল ঠিক যেন। বাঁকা চাঁদ।
আমি গীতি আর প্রশান্তকে বললাম, এসো আজ রাতটা এখানেই থেকে যাই। গীতি বলল, দারুণ জায়গা। আমারও থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সঙ্গে জিনিসপত্র যে কিছু আনিনি!
প্রশান্তর থাকার খুব ইচ্ছে, কিন্তু কাল সকালেই ওর অফিসের ব্যাপারে একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
তখন ঠিক হল, আমি একাই ওখানে থেকে যাব। প্রশান্ত আর গীতি আজ ফিরে যাবে, ফিরে আসবে কাল বিকেলে। তারপর তিন-চারদিন থাকা হবে।
গেস্ট হাউসের ঘর দুটোই ফাঁকা ছিল। সুতরাং রিজার্ভেশন পেতে কোনও অসুবিধা হল না।
যাওয়ার সময় গীতি আবার বলল, সুনীলদা, আপনার একা-একা এখানে ভয় করবে না তো!
আমি বললাম, যাঃ ভয় আবার কী!
প্রশান্ত হাসতে-হাসতে বলল, এখানে রাজা-মহারাজাদের আমলে যুদ্ধ চলছে, কত খুন জখম হয়েছে, তাদের ভূতটুত থাকতে পারে।
আমি বললাম, ভূতরাও মিলিটারিদের ভয় পায়।
দুৰ্গটার এক অংশ এখন মিলিটারিদের দখলে। একদিকে একটা মন্দির আছে আর এই গেস্ট হাউস শুধু জনসাধারণের জন্য।
আমি এক জামাকাপড়ে রয়ে গেলাম সেখানে। প্রশান্ত আর গীতি চলে যাওয়ার পর আমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনের চত্বরটায় বসে গঙ্গা দেখতে লাগলাম। সন্ধের পর এখানে আর বাইরের লোকদের আসতে দেওয়া হয় না। জায়গাটা এখন খুবই নির্জন। অনেকদিন এমন নির্জনতা উপভোগ করার সুযোগ পাইনি।
সাব!
আমি চমকে উঠলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, ডাকবাংলোর চৌকিদার। সে জিগ্যেস করল রাত্তিরে আমার জন্য খাবার বানাতে হবে কি না। তাইতো! নির্জনতা নিয়ে কবিত্ব করতে গিয়ে
আমি খাবার কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। কথাটা ভাবতেই আমার খিদে পেয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, খাবার কী পাওয়া যাবে?
সবচেয়ে সুখাদ্য এবং সহজে রান্না করা যায়, অর্থাৎ ভাত আর মুরগির মাংস তারও ব্যবস্থা। আছে। আমি সেটারই অর্ডার দিলাম, এবং বললাম, খুব জলদি বানাতে।
আপশোশ হতে লাগল কেন একটা হুইস্কি বা ব্র্যান্ডির বোতল সঙ্গে আনিনি, তাহলে এই নির্জনতা আরও ভালোভাবে উপভোগ করা যেত।
চৌকিদারকে কথাটা জিগ্যেস করতে লজ্জা করছিল। তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে জিগ্যেস করেই ফেললাম। সে বলল, এনে দিতে পারে, তবে অনেকটা সময় লাগবে। পাহাড়ের নীচে বাজারে যেতে হবে কি না।
আমি তাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দিয়ে বললাম, যাও তাই নিয়ে এসো।
চৌকিদার চলে যাওয়ার পর জায়গাটা আরও বেশি নির্জন মনে হতে লাগল। একটা জিনিস লক্ষ্য করে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চারপাশে এত সৌন্দর্য, মাথার ওপরে বিশাল আকাশ, নীচেও বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, গঙ্গার রূপও এখানে অসামান্য, চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে—তবু একা। থাকার জন্য আমি এসব তেমনভাবে উপভোগ করতে পারছি না। আমার একটু ভয়-ভয় করছে। সঠিক ভূতের নয়, বরং চোর-ডাকাতের ভয়ই বেশি। চৌকিদারকে না পাঠালেই হত। আমাকে এখানে একা পেয়ে কেউ যদি খুন করে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে যায়? আমার কাছে মাত্র। শদেড়েক টাকা রয়েছে যদিও কিন্তু এদেশে পাঁচ-দশটাকার জন্যেও অনেক সময় খুন হয়। হঠাৎ মনে হল, ঠান্ডা হাওয়ার জন্য আমার একটু শীত-শীত করছে। আসলে এটা একটা অজুহাত। বাইরে একা বসে থাকতে আমার গা ছমছম করছিল। ঘরের মধ্যে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশি নরম গদি। খুব আরামের। একটুক্ষণ বাদেই আমি বাইরে কার যেন গলার আওয়াজ শুনলাম। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি চত্বরের একেবারে শেষপ্রান্তে গঙ্গার দিকে দুজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে মনে হয়।
সিগারেট ধরিয়ে আমি বাইরে এলাম। অল্প চাঁদের আলোয় দেখলাম, একজন সাহেব ও মেম। রাত্রে সাধারণত কাউকে আসতে দেওয়া হয় না। তবে সাহেব ও মেমদের জন্য সব সময়ই অনেক বেশি সুযোগ সুবিধে থাকে। কিংবা হয়তো ওদের আগে থেকে ঘর রিজার্ভ করা ছিল।
একটু এগিয়ে এসে আমি দারুণ চমকে উঠলাম। সেই দুজন হিপি যুবক-যুবতী। এদের একবার আমি দেখেছি কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটে, একবার কাশীতে, আবার এখন চুনারে! আমি যেখানে। যাচ্ছি, এরা কি সেখানেই যাচ্ছে?
নিজের মনকে বোঝালাম হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয় যোগাযোগ। হঠাৎ এরকম মিলে যেতেই পারে। বেনারস থেকে হিপিরা বিতাড়িত হচ্ছে বলেই বোধহয় ওরা দুজন চুনারে এসেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ওরা যখন আমার প্রতিবেশী, তখন ওদের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে।
এগিয়ে গিয়ে বললাম, হ্যালো।
ওরা একটু চমকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়েছিল। মেয়েটির দিকেই আমার প্রথম চোখ পড়েছিল। মেয়েটির মুখে সেইরকম হাসি নেই। বরং একটা রাগের ভাব। আমাকে কিছু না বলে দুর্বোধ্য কী একটা ভাষায় কিছু বলল ছেলেটিকে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম ওরা ইংরেজি জানে না।
আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম। ভারতবর্ষে যখন ঘুরছে তখন কিছু একটা দুর্বোধ্য ভাষা তো জানবে। বোধহয় হিন্দি জানে। তাই আমি বললাম, আপ লোক…
ছেলেটি আমায় কিছু বলতে দিল না। দুর্বোধ্য একটা শব্দ করে আমার দিকে তাকাল। আমার। শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ছেলেটির দু-চোখ দিয়ে নীল রঙের আলো বেরুচ্ছে। দুটো নীল আগুনের রেখা এসে ভেদ করল আমার মুখ। সেরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি।
ছেলেটি এগিয়ে এসে আমার একটা হাত ধরল। কী অসম্ভব গরম তার হাত। একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর হলেও মানুষের দেহে অতখানি উত্তাপ থাকে না।
স্বীকার করতে একটু লজ্জা নেই, আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারলাম না। সমস্ত শরীর দিয়ে বুঝতে পারলাম এরা সাধারণ মানুষ নয়।
আমার মনে পড়ে গেল কাশীর সেই গুন্ডাটার হাত ছিঁড়ে যাওয়ার এবং চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমি এক হাতে চোখ ঢেকে চিৎকার করে বললাম, আমায় ছেড়ে দিন! দয়া করে ছেড়ে দিন! আমার কোনও খারাপ মতলব নেই! আমি সেখানে অজ্ঞান হয়ে অনেকক্ষণ পড়েছিলাম। চৌকিদারটা ফিরে এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে মাথায় জলের ছিটে দেয়, চোখ মেলেও প্রথমে আমার মনে হয়েছিল আমি মরেই গেছি। তারপর দেখলাম নিজের দুটো হাত ও দুটো চোখ অক্ষত আছে কি না। সবই ঠিক আছে। সেই ছেলেটি ও মেয়েটি সেখানে নেই। তাদের কেউ দেখেনি। চৌকিদার জোর দিয়ে বলল রাত্তিরে এখানে কারুর আসার হুকুম নেই। আমি আজও ভূতে বিশ্বাস করি না। আমার দৃঢ় ধারণা ওরা ভূতটুত নয়—অন্য কিছু। আমাদের জানা জগতের বাইরের কোনও অস্তিত্ব। বন্ধুরা অবশ্য সব শুনে বলে, পুরো ব্যাপারটাই আমার চোখের ভুল। নির্জন জায়গায় সম্পূর্ণ একা থাকলে ওইরকম নাকি হয়। কিন্তু এখনও আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই। দুটো নীল আগুনের শিখা! ভাবলেই আমার বুক কেঁপে ওঠে।