1 of 2

নীল অপরাজিতা – মিহির মুখোপাধ্যায়

নীল অপরাজিতা – মিহির মুখোপাধ্যায়

বিন্দুবুড়ি ডাকল, “ময়না, ও ময়না!”

বোশেখের শুনশান দুপুর। বেশ গুমোট। টালির ঘরের দাওয়ায় বসেছিল বুড়ি। বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। কাছেই মাদুর পাতা। ভাত-ঘুমে শরীর টানছে। চোখের পাতা ভারী। কিন্তু নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমোবার উপায় নেই। গাছের আম পাহারা দিতে হচ্ছে। তিনটি আমগাছ বুড়ির। একটি গোলাপখাস, দুটি হিমসাগর। এবার ফলনও প্রচুর। ঝেঁপে আম হয়েছে। পাড়ার পাজি ছোঁড়াগুলি তক্কে তক্কে থাকে। একটু এদিক-ওদিক হলেই আর রক্ষে নেই। ইঁট-পাটকেল ছুঁড়ে ছুঁড়ে কচিকাঁচা কুশিগুলির দফারফা করে ছাড়বে। সেজন্য মা-পাখি যেমন বাচ্চা আগলে রাখে, তেমনি কষ্ট হলেও দুপুরে না-ঘুমিয়ে বাচ্চা আমগুলি পাহারা দেয় বিন্দুবুড়ি। ময়নাকে দিয়ে ভরসা নেই। মন উড়ু উড়ু। থাকে থাকে, পালায়। দু’দণ্ড ঘরে থাকতে চায় না।

অন্য বছরের মত এবারও আসরাফ আলি পাইকার গাছ তিনটি জমা নেবার জন্য ঘোরাঘুরি করছে। বড় ছেলে বাড়ি এসে ব্যবস্থা করবে।

বিন্দুবুড়ি হিসেব বোঝে না, গোনাগুনতি জানে না।

“দিদা, তোমার বয়স কত?” ময়না কখনো জিজ্ঞেস করলে ফোকলা মুখে হাসে বুড়ি। তারপর ভেবে ভেবে বলে, “যে বছর আশ্বিনের ঝড়ে বিশ্বাসদের তেঁতুল গাছটা পড়েছিল, সে মাসেই তোর মা আমার কোলে এল, এখন বুঝে দ্যাখ, আমার বয়স কত।” দিদার বয়সের হিসেব শুনে হাসতে হাসতে দমবন্ধ হবার অবস্থা।

এখন এই নিঝুম দুপুরে ময়না বাড়ি নেই। কোথায় টো-টো করতে বেরোল, কে জানে। দাওয়ায় বসে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে ঝিমুনি এসেছিল। ডাক-পিওন ছেলেটির ডাকাডাকিতে ঝিম-ঝিম ভাবটি ছুটে গেল।

“ও বুড়ি-মা, চিঠি আছে।” রাঙচিতার বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে ডাকছিল ছেলেটি। তাড়াতাড়ি নেমে এসে হাতে নিল। পোস্ট-কার্ডের চিঠি। ছেলেরা কেউ লিখেছে। দুই ছেলে বিন্দুবাসিনীর। বড় মহাদেব থাকে আগরপাড়া। ওখানকার এক কারখানায় কাজ করে। ছোট বাসুদেব বরাকর নামে অনেক দূরের একটা শহরের কাছে কোন এক কয়লাখনি-অফিসের চাপরাসী। ওদের উপরে একটা মেয়ে ছিল, ময়নার মা। পোস্ট-কার্ডখানা হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখল বুড়ি। পড়তে পারে না। তারপর রাস্তার দিকে মুখ করে উঁচু গলায় ডাকল, “ময়না, ও ময়না!”

ময়না তখন পেছনের ডোবার পাশ দিয়ে বাড়ি ঢুকছিল। আঁকশি নিতে এসেছে। দত্তদের পোড়ো বাগানে নোনাফল পাড়তে যাবে। দিদার ডাক শুনে চুপি চুপি পেছনে এসে দাঁড়াল। সামনে মাটির রাস্তার দুপাশে ঘন গাছপালার ছায়া।

ডাক-পিওন ছেলেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। বাঁক ঘুরে আড়াল হয়ে গেছে।

কিছুদূরে রাস্তার ওপাশে ভূষণ তাঁতির কারখানা-ঘরে তাঁতের শব্দ হচ্ছিল, খটখট-খটাখট। বিশ্বাসদের বাঁশবাগানের দিক থেকে থেমে থেমে একটা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছিল। চারপাশের নির্জনতার মধ্যে এইসব শব্দগুলি কেমন মিশে গেছে। রাস্তার পাশে একজোড়া শালিক চরছে।

বিন্দুবুড়ি সামনের দিকে তাকিয়ে আন্দাজেই আবার হাঁক দিল, “ময়না, ও ময়না!”

সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক পেছন থেকে চেঁচিয়ে জবাব এল, “এই যে আমি।”

চমকে ঘুরে দাঁড়াল বুড়ি, “দুর হ মুখপুড়ি, এরকম ভাব—”

খিলখিল করে হেসে উঠল ময়না, “ডাকছিলে কেন?”

“এই দ্যাখ তো, কার চিঠি এসেছে, তোর বড়মামা লিখেছে বোধ হয়।” দিদার কথাই ঠিক। পোস্ট-কার্ডখানি হাতে নিয়ে দেখল ময়না। আঁকাবাঁকা অক্ষরে বড়মামার নাম সই, ‘প্রণাম জানিবা, ইতি মহাদেব।’ কিন্তু ‘ইতি’ পর্যন্ত অন্য লোকের লেখা। ঠাসবুনুনি লেখায় পোস্ট-কার্ডখানির এমুড়ো-ওমুড়ো ভর্তি। প্রাইমারি স্কুলে কিছুদিন যাতায়াত করেছিল বটে, কিন্তু এই হাতের লেখা পড়ার বিদ্যে নেই ময়নার।

আ-কার, ই-কার, উ-কারের লম্বা লম্বা টানের মধ্যে জড়াজড়ি করে অক্ষরগুলি যেন কাঁটাতারের বেড়ার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। উল্টে-পাল্টে দেখে বললো ময়না, “আমি পড়তে পারছি না।” দিদার হাতে ফেরত দিল। পোস্ট-কার্ডখানি হাতে নিয়ে বুড়ি আবার দাওয়ায় এসে বসল। হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বললো, “তা হলে দ্যাখ, বিলু বোধ হয় বাড়ি আছে, ওকে ডেকে নিয়ে আয়।”

বিশ্বাসদের বাড়ির ছেলে বিশ্বনাথ তখন মস্ত ছাতার মত ছড়ানো শিরীষ গাছটার নিচে খাটিয়া পেতে ঘুমুচ্ছিল। ঘরের ভেতর গরম। এখানটায় বেশ ঠাণ্ডা।

সারাদিন শিরীষের ছায়া ছড়িয়ে থাকে। তেমন রোদ নামে না। কাছেই ওদের খিড়কির পুকুর। পুকুরের জল ছুঁয়ে এক-এক সময় ঠাণ্ডা হাওয়া গড়িয়ে আসে। ওপারে মস্ত বাঁশবাগান। ভেতরে কোথাও অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে একটা ঘুঘু ডাকছিল। এখানে বসে কান পাতলে তাঁতি-বাড়ির দিক থেকে খট-খট শব্দটাও অস্পষ্ট শোনা যায়।

কিন্তু এসব কিছুই শুনছিল না বিশ্বনাথ। অঘোরে ঘুমুচ্ছিল। দড়ির খাটিয়ার উপর শতরঞ্চি পাতা। শিয়রে বালিশের পাশে হাফহাতা বুশ-শার্ট, একটা পুরনো সিগারেটের কৌটোর মধ্যে বিড়ি আর দেশলাই, ছোট একটা হাতপাখা। উনিশ-কুড়ির বিশ্বনাথের পরনে পায়জামা, খালি গা, মুখে সরু গোঁফ, মোটা জুলপি, লম্বা চুল।

বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে পুকুরপাড় ঘুরে এল ময়না। খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমে আস্তে ডাকল, “বিলুদা, এই বিলুদা!”

কোন সাড়া নেই। শুধু ফুরুৎ-ফুরুৎ নাক ডাকছিল। হাসি পেল ময়নার।

শাড়ির আঁচলটা মুখে তুলে একা-একাই খানিকটা হেসে নিল।

তারপর সামান্য সামনে ঝুঁকে বিন্দুর নাকটি ধরে নাড়া দিয়ে ডাকল, “এই কুম্ভকর্ণ, ওঠো, বাপরে বাপ, এই দুপুরবেলা কি নাকের ডাক!”

“এই কে রে, মারবো এক—” বলতে বলতে ধড়মড় করে উঠে বসল বিশ্বনাথ। ময়নাকে দেখে বললো, “ও তুই! দিলি তো এমন জমাটি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে, আবার হাসি!”

“হাসবো না, কি নাকের ডাক, বাপরে বাপ!” মুখে আঁচল তুলে হাসি চাপল ময়না।

কয়েক পলক আঁচলটা দেখে বললো বিল্ব, “এই শাড়িটা তো সুন্দর, বেশ মানিয়েছে তোকে।”

“কেমন দেখাচ্ছে?” সলজ্জভাবে হাসল ময়না।

“বেশ ভাল দেখাচ্ছে, কেমন অন্যরকম লাগছে, কে দিল শাড়িটা?”

“কে আবার দেবে, বড়মামা দিয়েছে।” ময়না নিয়মিত শাড়ি ধরেছে সম্প্রতি।

কিছুদিন আগেও ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াত। এখনো বাড়িতে মধ্যে মধ্যে ফ্রক পরে। ফ্রক পরে ছুটোছুটি করার সুবিধে। কিন্তু দিদা বকাবকি করে।

বাড়ন্ত গড়নের ময়নাকে বয়সের তুলনায় বড়ই মনে হয়। শরীর-স্বাস্থ্য আর ফ্রকের শাসন মানছে না। চলাফেরার সময় চোখে লাগে। ময়নার বয়সের হিসেবটা বিন্দুবুড়ির কাছে পরিষ্কার। যে বছর চৈত্র মাসে বাংলাদেশের লড়াই শুরু হল, তার আগের শ্রাবণে ময়নার জন্ম। সে সময় বিশ্বাসবাড়ির বিশ্বনাথের মামারা সব যশোর থেকে পালিয়ে এসে এখানে প্রায় এক বছর ছিল। বিলুর বয়স তখন চার। পরের মাঘ মাসে ময়নার মা মারা গেল। দেহে রক্ত ছিল না, পেটে জল জমেছিল। ভুগেছিল অনেকদিন। এসব খবর দিদার মুখে কিছু কিছু শুনেছিল ময়না। কিন্তু কিছু মনে হয়নি। মায়ের ব্যাপারটাই ময়নার কাছে কেমন ফাঁকা, শূন্য, অর্থহীন। দূর আকাশে একচিলতে মেঘ ভেসে গেলে কিংবা সন্ধেবেলা একা-একা ফাঁকা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে কয়েক মুহূর্ত যেমন মনে হয়, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। দিদার কাছে একটা পুরনো তোরঙ্গ আছে। তার মধ্যে দু’ তিনখানা পুরনো শাড়ি, চারগাছা ব্রোঞ্জের চুড়ি, একছড়া সরু সোনার হার, একজোড়া কানপাশা, একটা রূপোর সিঁদুরকৌটো, একজোড়া রুপোর বালা, আর একখানি খামের মধ্যে ময়নার এই বয়সের একটি রোগামত মেয়ের ঝাপসা ছবি। উঠোন-ঘেরা রাঙচিতার বেড়ার পাশে খোলা চুলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, পরনে ডুরে শাড়ি। ব্যস, মায়ের সঙ্গে ময়নার এইটুকুই জানাশোনা। দিদা যে মা নয়, মায়ের মা, একথা বুঝতে পেরেছে জন্মের প্রায় দশ বছর পরে। এখন জিজ্ঞেস করল বিশ্বনাথ, “কি রে, ঘুমটা ভাঙালি কেন?”

“দিদা ডাকছে, তোমাকে।”

“কেন?” হাই তুলল বিশ্বনাথ।

“বড়মামার চিঠি এসেছে, পড়ে দিতে হবে।”

“তুই পড়তে পারলি না?”

“ওরকম জবরজং লেখা আমি পড়তে পারি না।”

ময়নার জবাব শুনে হাসল। হাতপাখা তুলে হাওয়া খেল কয়েকবার। তারপর শার্টটা গায়ে গলিয়ে বললো, “চল।”

ময়নার পেছন পেছন ওদের বাড়ি এল। দাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ে শোনাতে হল। জটিল জড়ানো লেখা বেশ কসরত করে পড়তে পারল। এবং চিঠির বয়ান শুনে বিন্দুবাসিনীর মুখ শুকিয়ে গেল।

খবর হল, মহাদেব এখন বাড়ি আসতে পারবে না, কারখানায় গোলমাল চলছে। আসরাফ আলি পাইকারের কাছ থেকে মা যেন কিছু টাকা আগাম নিয়ে রাখে। দরাদরি কিংবা লেনদেনের সময় যেন বিশ্বাসদার (বিল্বর জ্যাঠা কালী বিশ্বাস) সাহায্য নেয়। তারপর আসল খবর। ময়নার বাবা অনন্ত সরকার ময়নাকে নিতে আসবে। মেয়ে বড় হচ্ছে। বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে। এখন থেকেই খোঁজ-খবর করতে হবে। আজকাল ঘর-বর মিলিয়ে তেমন ছেলে যোগাড় করাও মুশকিল। এরকম একটি ছেলের খোঁজ পেয়েছে ময়নার বাবা। তারা এখন মেয়ে দেখতে চায়। এই ‘পরস্তাবটি’ মহাদেবেরও মনে ধরেছে। সত্যিই তো, অকালে মা-মরা ভাগনী বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে। এই পনেরো বছর মামার বাড়িতেই বড় হল। দিদিমা আর দুই মামা তাদের কর্তব্য করে দিয়েছে। এখন যার মেয়ে সে যদি বিয়ে দেবার জন্য নিয়ে যেতে চায়, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। মায়েরও অমত করা উচিত হবে না। মেয়ে-সন্তান বলে কথা, আজ হোক, কাল হোক, বিয়ে যখন দিতেই হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি।

চিঠিখানি শোনার পরে কয়েক পলক থম মেরে রইল বিন্দুবুড়ি।

তারপর ডাকল, “ময়না, ও ময়না, আবার গেলি কোথায়?”

একমুহূর্ত স্থির হয়ে থাকতে পারে না ময়না। দু’ মিনিট দাঁড়িয়ে চিঠিখানি শোনারও ধৈর্য নেই। বিলুদাকে ধরে এনে দিদার সামনে দাঁড় করিয়ে বাড়ির চারপাশে একবার টহল দিতে গেছে। রান্নাঘরের দাওয়ার ফুল পাড়ার জন্য বাঁশের কঞ্চির আঁকশিটা ছিল। সেটিকে সাবধানে বের করে রান্নাঘরের পেছনে লাউমাচার নিচে লুকিয়ে রাখল। দিদা যেন টের না পায়।

মাচার ছায়ায় ময়নার মেনি বেড়ালটা শুয়ে ছিল। ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে রান্নাঘরের পাশ ঘুরে ভেতরের উঠোনে এল। উঠোনের এপাশে রোদের দিকটায় ডালের বড়ি আর আচারের জন্য কচি আমের কুটরো শুকোচ্ছে, ওপাশে আম-কাঁঠালের ছায়া। তিনটে আমগাছ ছাড়াও একটা কাঁঠাল, দুটি পেয়ারা, একটি কুলগাছ আছে।

এ ছাড়া রান্নাঘরের পেছনে ডোবার চারপাশ ঘিরে পাঁচটি নারকেল, দুটি খেজুর আর কয়েকটি পেঁপেগাছ। কাঁঠালগাছে ছোট-বড় ছাব্বিশটি এঁচোড় ঝুলছে। একটি নিজেরা খেয়েছে। আরেকটি বিশ্বাস-বাড়ি দিয়েছে দিদা। বিলুদার জ্যাঠামশাই কালী বিশ্বাস “অঞ্চল-প্রধান”। তিনি এঁচোড়ের ডালনা খেতে ভালবাসেন। দিদাকে ডাকেন, “খুড়িমা”। বাকিগুলি আরো বড় হবে, পাকবে। কোন কোনটায় একশ’র কাছাকাছি কোয়া হয়। আর মধুর মত মিষ্টি। তারপর আষাঢ় মাসে অম্বুবাচীর আগের দিন একটি যাবে কালী বিশ্বাসের বিধবা মা অর্থাৎ বিল্বর ঠাকুমার জন্য, আরেকটি দিদা ঘরে রাখবে। বাকিগুলি বেচে দেবে। অম্বুবাচীর সময় ভাল দাম পাওয়া যায়।

বড়মামা বাড়ি না থাকলে এইসব বেচা-কেনার ব্যবস্থা করেন কালী বিশ্বাস।

বিশ্বাসমামার পেটে তেমন বিদ্যে নেই বটে, কিন্তু বিষয়-বুদ্ধিতে ঘুণ।

বাজারের পাশে বাসরাস্তার উপরে পাশাপাশি কয়লার আড়ত, আটা-কল, খড়কাটা মেশিনের দোকান। এ ছাড়া দুই ভাইয়ের (বিল্বর বাবা আর জ্যাঠা) নামে ষাট বিঘে চাষের জমি। পুকুর, বাঁশঝাড়, আমবাগান সমেত বসতবাড়িখানাই বা কত বড়, প্রায় চার বিঘের মত জমির উপর। ওদের ষাট বিঘের সঙ্গে দিদার পাঁচ বিঘেও চাষ হয়। সব তদারক করেন কালী বিশ্বাস। তার উপর অঞ্চল-প্রধানের কাজের অন্ত নাই। শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস বর্ষার পাম্প-শু আর ধুতির সঙ্গে রুপোর বোতাম লাগানো নীল হাফশার্ট গায়ে সাইকেলে চেপে বিশ্বাসমামা সারা এলাকা টহল দিয়ে বেড়ান। এঁচোড় কটা গুনতে গুনতে দিদার ডাক শুনতে পেল, “ময়না, ও ময়না কোথায় গেলি আবার?”

“যাই।” সাড়া দিয়ে পরমুহূর্তে সামনে এসে দাঁড়াল। ময়না হাঁটে না উড়ে চলে। “কি হল, ডাকছো কেন?”

“ওই শোন, তোর বড়মামা কি লিখেছে।” পোস্ট-কার্ডখানা তখনো বিল্বনাথের হাতে রয়েছে।

দিদার কথায় সেদিকে তাকাল ময়না, “কি লিখেছে?” বিল্ব কিছু বললো না।

জবাব দিল বিন্দুবুড়ি, “তোর বাবা তোকে নিতে আসবে।”

কয়েক মুহূর্ত কেমন হতভম্ব হয়ে গেল ময়না। একবার দিদার দিকে আরেকবার বিলুদার দিকে তাকাল, তারপর বললো, “বাবা! কার বাবা, কাকে নিতে আসবে?”

“তোর বাবা, আর কার বাবা, তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।”

“কোথায় নিয়ে যাবে?” ব্যাপারটা যেন বুঝতে পারছে না ময়না, কোন হদিস পাচ্ছে না।

“কোথায় আবার, তোর বাপ যেখানে থাকে, সেই দমদমের কাছে নাগেরবাজার না কি যেন নাম—” দিদার কথা শেষ না হতেই ফুঁসে উঠল ময়না, “কেন সেখানে যেতে হবে কেন?” ওর ভেতরের একগুঁয়ে ভাবটি এতক্ষণে বেরিয়ে এল।

এবার জবাব দিল বিশ্বনাথ, “তোর বিয়ের কথা হচ্ছে, ছেলেপক্ষ থেকে দেখতে আসবে।”

যেন চমকে উঠল ময়না। অবাক চোখে একবার দিদার দিকে আরেকবার বিলুদার মুখের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই একরাশ লজ্জা। ঘামে ভেজা ফর্সা মুখ গোলাপি। মুখের কাছে আঁচল মুঠো করে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো, “ধেৎ আমি বিয়ে করবো না, এখান থেকে যাবোই না।” বলতে বলতে একছুটে ঘরের ভেতর চলে গেল।

বিন্দুবুড়ি তখন বকবক শুরু করল (ময়নাকে লক্ষ্য করে), “এর মদ্দি তোর বড়মামারও সাঁট আছে, ভেবেছে বিয়ের যুগ্যি ভাগ্নীর দায় থেকে বাঁচা গেল, বাপের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলেই হল, তাহলে আর খরচাপাতি কিছু লাগবে না, কেন দুই মামা কি বিয়ে দিতে পারত না, না হয় আমার দু’বিঘে জমি বেচে দেব, কি বলিস বিলু?”

বিল্ব আর কি বলবে, এসব কথার মধ্যে কিছু বলার কোন মানে হয় না।

“ও ঠাকুমা, আমি যাচ্ছি, এটা রাখুন। পোস্ট-কার্ডখানা এগিয়ে দিল। কে কার কথা শোনে।

“আরে বোস না, এই দুপুরে তোর এমন কি রাজকাজ, আমার কথাটা শুনে যা, আমি ভাল বলছি না মন্দ বলছি, তুই-ই বিচার করে দ্যাখ—” সামান্য দম নিল বুডি, পোস্ট-কার্ডখানি হাতে নিয়ে আবার শুরু করল, “সেই নচ্ছার বাপটারই বা কি আক্কেল, জন্মে তো মেয়ের খোঁজ নিসনি, বছর না ঘুরতে ফের বিয়ে করেছিস, এপক্ষে শুনিচি দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে, ওই কানে শোনা পজ্জন্ত, চোখে দেখিনি কখনো, দেখতে চাইও না, কোন খোঁজ নেই, খবর নেই, দেখা-শোনা কিছু হল না, আমরা কিছু জানলুম না, শুনলুম না, হুট করে এসে বলে কিনা, ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ এরকম বেআক্কেলে কাণ্ড।”

“ও দিদা, তুমি চুপ করো দিকি—” ঘরের ভেতর থেকে ময়নার ধমক শোনা গেল।

“তুই থাম ছুড়ি, এর পেছনে তোর বড়মামীরও উসকানি আছে।” বুড়ি ভাঙা গলায় খরখর করে উঠল। তারপর বিল্বর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “তুই শুনে রাখ বিলু আমার কতা, তারপর বিচের করে বল, আমি ‘অনেজ্জ’ (অন্যায্য) কতাটা কি বলচি, সত্যি বলতে কি, আমার মহাদেবের মন অত ছোট নয়, ওই বউটার বুদ্ধিতেই ওর এমনধারা মতিগতি হয়েছে, না হলে এখান থেকে কি লোকে কারখানার ‘ডিবটি’ (ডিউটি) করে না, তুই-ই বল, কত লোক কলকেতা যাচ্ছে, গঙ্গা পেরিয়ে চুঁচড়ো যাচ্ছে, বিয়ের আগে তো মহাদেব এখান থেকেই যেত আসত, বিয়ের পর তিন মাস যেতে না যেতে সোহাগী বউ কানে যে কি মন্তর দেল কে জানে, বলে কিনা গাড়ির গণ্ডগোলে ‘ডিবটি’ কামাই হয়, কারখানার সস্তা ‘ক্যান্টি’তে (ক্যাণ্টিন) খেয়ে পেটের গোলমাল, আজ অম্বল, কাল পেট খারাপ, এইসব হ্যানো ত্যানো ননান ছুতো, শেষতক আগরপাড়া বাসা করে উঠে গেল, আর ছোটটা তো আগেই চাকরি নিয়ে রাজাগঞ্জ না রানীগঞ্জ লাইনে বরাকর না কোথায় চলে গেল, তারপর থেকে এই মেয়েটাকে বুকে কবে এই ভিটে আগলে পড়েছিলুম, মিথ্যে বলবো না, তোর বাপ-জ্যাঠা দেখাশোনা করে বলেই চলে যাচ্ছে, এখানে টিকে থাকতে পেরেছি, হরি আর কালী ওরা দুই ভাই আমার পেটের ছেলের চেয়েও বেশি, এখন এই মেয়েটা যদি চলে যায়, তাহলে আমি কি করে থাকবো—“বলতে বলতে বিন্দুবুড়ির গলা বন্ধ হয়ে গেল। চোখ মুছল।

বিশ্ব পড়েছে মুশকিলে। বুড়িকে এখন থামানো যাবে না, চলে যাবারও উপায় নেই। বাঁচিয়ে দিল ময়না। দরজার সামনে এসে বললো, “তুমি চলে যাও তো বিলুদা, এসব কথা তোমার শুনতে হবে না।”

আর কি দাঁড়ায় বিশ্বনাথ! পরক্ষণেই “চলি ঠাকুমা” বলে সোজা হাঁটা দিল। পেছন ফিরে আর তাকাল না। পেছনে বুড়ির বকবকানি থামেনি। এত তাড়াতাড়ি থামার কথাও নয়।

আগের জায়গায় ফিরে এল বিল্ব। খাটিয়ায় বসে কৌটো থেকে বিড়ি আর দেশলাই বার করল। বিড়িটি ধরিয়ে ভাবল, আর কিছু সময় গড়িয়ে নেবে কি না। এখনো দুপুর ফুরোয়নি। বেলা দুটো-আড়াইটে হবে। বিকেলে গিয়ে দোকানে বসতে হবে। হুকুম জারি করে জ্যাঠামশাই বারাসাত গেছেন। কোর্ট-কাছারিতে জমি-জমার কাজ। বাবা আদাহাটা হাইস্কুলে কেরানী। বেলা দশটায় সাইকেল চেপে চলে যান। ফিরতে ফিরতে বিকেল।

জ্যাঠতুতো বড়দা দোকানে বসে, চাষবাস দেখে। ছোড়দা গ্র্যাজুয়েট। কয়েক মাস হল বি-ডি-ও অফিসে কেরানীর চাকরি পেয়েছে। আর হরি বিশ্বাসের বড় ছেলে বিশ্বনাথ কোনরকমে বারো ক্লাসের বেড়া টপকে এখন ফুলটাইম বেকার। টায়টায় নম্বর যা জুটেছিল তাতে কলেজে ভর্তি হওয়া চলে না। সুতরাং আজ দু বছর কোন কাজ নেই বিল্বর।

আধ মাইল দূরে শেরপুর বাজারে বাসরাস্তার উপর ওদের পাশাপাশি তিনটি দোকান। সম্প্রতি জ্যাঠামশাইয়ের হুকুম হয়েছে, সামনের মাসে টাইপ স্কুলে ভর্তি হতে হবে। ‘টাইপ-শর্টহ্যাণ্ড’ শিখবে। আর রোজ বিকেল থেকে রাত ন’টা আটাকলের দোকানে বসে হিসেবপত্তর দেখতে হবে।

ভাল লাগে না। এসব কিছু ভাল লাগে না বিল্বর। কি করলে যে ভাল লাগবে তা-ও বুঝতে পারে না। শেষ টানের পরে ছুঁড়ে দিল বিড়িটা, তারপর হাতপাখা নেড়ে হাওয়া খেতে খেতে দেখতে পেল পুকুরপাড় ঘুরে ময়না আসছে।

শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়ানো, হাতে আঁকশি। কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, “ও বিলুদা, এখন কি করবে?”

“ভাবছি, আরো কিছু সময় গড়াবো, তারপর দোকানে যেতে হবে।”

“আর গড়াতে হবে না, এখন চলো আমার সঙ্গে।”

“কোথায় যাবো?” মুখে হাত চাপা দিয়ে ছোট্ট হাই তুলল বিল্ব।

“চলো, দত্তবাড়ির বাগান থেকে নোনাফল নিয়ে আসি।”

“ধুর্, নোনাফল কেউ খায় নাকি, আম হলেও কথা ছিল।”

“কি বলছো তুমি! এই এত বড় বড়!” দুই হাতে ধরার মত করে দেখাল ময়না, “সিঁদুরের মত রঙ, এত বড় নোনা তুমি এ গাঁয়ে আর কোথাও পাবে না, পাখিতে ঠুকরে শেষ করে দিচ্ছে।”

ব্যাপারটা জানা আছে বিল্বর তথাপি জিজ্ঞেস করল, “তুই জানলি কি করে, ও পাড়ার ওই পোড়াবাগানে ঢুকেছিলি না কি।”

“পরশু দিন পুষ্পর সঙ্গে নীল অপরাজিতা খুঁজতে গিয়েছিলুম, ওখানে অপরাজিতার ঝাড় হয়ে আছে।”

“ওখানে খুব সাপের ভয়, জানিস, গেল বছর পলান মণ্ডল ওখানে একটা গোখরো মেরেছিল, চন্দ্রবোড়াও আছে শুনেছি।”

বিল্বর কথা শুনে ঠোঁট উলটে, চোখে-মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে ময়না বললো, “ফুঃ!” সাপের ভয় ওর নেই। কিংবা ব্যাঙ-আরশোলা-কেঁচো- নেঙটি ইঁদুর, যেসব প্রাণী দেখলে মেয়েদের ভয় কিংবা গা-ঘিনঘিন করে সেসবে গ্রাহ্য নেই ময়নার।

বিম্বর ছোট বোন পুষ্পর সঙ্গেই টো-টো করে। পুষ্প থাকলে বিলুদার খোশামোদ করতে হত না। পুষ্প এখন স্কুলে। প্রাইমারিতে ময়নার সঙ্গে বরাবর এক ক্লাসে পড়েছে। ক্লাস ফোরে উঠেই ময়না স্কুল ছেড়ে দিল। আর যায় না। বড়মামা আগরপাড়া বাসা ভাড়া করে মামীকে নিয়ে চলে গেল। আর ময়নারও পড়াশোনায় ইতি। গেল পরশু ছিল রোববার।

ছুটির দিন দুপুরবেলা পুষ্পর সঙ্গে নীল অপরাজিতার খোঁজে দত্তবাড়ির পোড়ো বাগানে ঢুকে নোনাফলের গাছটা দেখে এসেছিল। এখন বিলুদার হাত টেনে বললো, “চলো, চলো, আর শুতে হবে না।”

অগত্যা ঊঠতে হল। পেছন পেছন যেতে যেতে বললো বিল্বনাথ, “তোর বাবা যদি এখান থেকে তোকে নিয়ে যায়, তা হলে এই রকম টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো বেরিয়ে যাবে, তখন মজা টের পাবি।”

“আমি যাবোই না, দেখে নিও তুমি।” ঘাড় নাড়লো ময়না, “দিদাই যেতে দেবে না।”

“মহাদেবকাকা চিঠি দিয়েছে, তোর বাবা নিতে আসবে, ঠাকুমা কি আর আটকে রাখতে পারবে?” বিলুদার কথায় ভাবনা হল ময়নার।

এই ‘বাবা’ মানুষটি কেমন কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না সে। ভাল-মন্দ কোনরকম ধারণাই নেই। এই পনেরো বছর ন’ মাসের জীবনে বলতে গেলে মা-বাবার সম্পর্কে মনের মধ্যে ছিটেফোঁটা কোন দাগই নেই। ধোয়ামোছা স্লেটের মত পরিষ্কার।

তবু মায়ের কিছু চিহ্ন চোখে পড়ে। কয়েকখানি পুরনো শাড়ি-ব্লাউজ, মায়ের হাতে সেলাই করা কাঁথা, সিঁদুরকৌটো, একখানি ফ্যাকাসে ফটো, পুরনো তোরঙ্গে যত্ন করে তুলে রেখে দিদা। ভাদ্র মাসের শেষে মেঘ কেটে ঝকঝকে রোদ ফুটলে অনাসব লেপ, তোশক, কাঁথা, বালিশের সঙ্গে এই তোরঙ্গটাও উঠোনে নামানো হয়। দিদার সঙ্গে ধরাধরি করে নামায় ময়না। ডালাটা খুললেই কালোজিরে, শুকনো নিমপাতা আর ন্যাপথলিনের গন্ধের সঙ্গে পুরনো একটা সোঁদা গন্ধ নাকে আসে। এই গন্ধটার সঙ্গে মায়ের কিছু জড়িয়ে আছে। ঠিক স্মৃতি নয়। মায়ের কোন স্মৃতি নেই। ‘মা’ বলে কেউ একজন ছিল, এইটুকুই শুধু মনে হয়। আর ‘বাবা’!

দিদার মুখে, দুই মামার মুখে টুকরো টুকরো যেটুকু শুনেছে, তাতে ‘বাবা’ মানুষটি সম্পর্কে তেমন কোন ভাল ধারণা হয়নি। দমদমের কাছে নাগেরবাজার নামে একটা জায়গায় নাকি থাকে বাবা। সেখানে নতুন-মা আছে, ছোট ছোট দু-তিনটি ভাইবোন আছে। কিন্তু সেখানে যাবার কিংবা তাদের দেখার কোন ইচ্ছে কোনদিন হয়নি। দমদমের কাছাকাছি আগরপাড়ায় বড়মামার বাসায় দু’তিনবার গেছে ময়না। এমনকি বরাকরের কাছে ছোটমামার কোলিয়ারির কোয়ার্টারেও গেল বছর পুজোর পরে কয়েকদিনের জন্য ঘুরে এসেছিল। কিন্তু নাগেরবাজার যাবার কথা কখনো মনে হয়নি। দিদা কিংবা মামারা কেউ কখনো বলেওনি। এখন যেতে যেতে একটু থেমে সামান্য পেছনে বিল্বর দিকে ফিরে বললো, “আমি যাবো না, বাবা নিতে এলেও যাবো না, দেখো তুমি, বড়মামা পাঠাতে চাইলেও যাবো না।” আগে আগে যাচ্ছিল ময়না। একপিঠ কোঁকড়া চুল। হলুদে-সবুজে ফুল-ফুল ছাপা শাড়ির আঁচলটা কোমরে জড়ানো। ডান হাতে আঁকশি।

ময়নার হাঁটার ভঙ্গিটি তো ভারি চমৎকার! যেন নতুন দেখল বিল্বনাথ। আগে কখনো এমনভাবে চোখে পড়েনি। আগে কোনদিন এমন নির্জন দুপুরে ময়নার পেছন পেছন হাঁটেনি। এরকমভাবে হাঁটার কোন সুযোগই হয়নি।

ছোটবেলা থেকে ছোটবোনের সঙ্গে ছুটোছুটি করতে দেখেছে। বাড়ির উঠোনের পাশে শিউলিতলায় পুষ্পর তৈরি খেলাঘরে ওদের পুতুল খেলতে দেখেছে।

ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে যাকে বড় হতে দেখেছে, সেই খুব চেনাশোনা মেয়েটিকে এই মুহূর্তে যেন নতুন করে দেখতে পেল বিশ্বনাথ।

সত্যিই ময়না বেশ বড় হয়ে গেছে। বড় আর সুন্দরী। বাড়ন্ত গড়নের মধ্যে কেমন একটা চটক এসেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল কয়েক পা এগিয়ে ময়নার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটে। কাঁধে হাত রেখে হাঁটে। কিংবা যদি ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে? ময়না কি রেগে যাবে, চেঁচামেচি করবে, ছুটে পালাবে। ভাবতে ভাবতে বিল্বর কান দুটি গরম হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে ছাদ পেটানোর শব্দ। তথাপি, যা হয় হোক ভেবে তাড়াতাড়ি দু’পা এগিয়ে যাবার সময় দেখল উলটো দিক থেকে ওপাড়ার অখিলদা সাইকেল চালিয়ে আসছেন। টিঙ-টিঙ ঘণ্টি বাজালেন। সরু মাটির রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল ময়না। পাশ কাটিয়ে যাবার জায়গা দিল। অগত্যা কয়েক হাত পেছনে বিশ্বনাথকেও দাঁড়াতে হল। ওর বেপরোয়া ইচ্ছেটাকে যেন দমিয়ে দিয়ে গেলেন অখিলদা। নিজেকে সামলে নিতে পারল। ময়নার পেছন পেছন আরো কিছুদূর যাবার পর ওদের পাড়া ছাড়িয়ে প্রায় আধ মাইল হেঁটে দত্তবাবুদের পোড়োবাড়ির পেছনে খিড়কির পুকুরপাড়ে বিশাল আমবাগানের কাছে এল।

দত্তবাবুরা এককালে এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। জমিদারি চলে যাবার পরে খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভায়েরা সব পেটের ধান্দায় নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

কলকাতার দিকে চলে গেছে সব। কলকাতা-দমদম-বরানগরে বাড়ি করেছে কেউ কেউ। চাকরি ব্যবসা। মোট কথা, এই পুরনো পোড়াবাড়িটায় এখন আর ওদের বংশের কেউ থাকে না। অথচ এককালে এই বাড়িটার কত জাঁকজমক ছিল, পুজো-পার্বণের কত জৌলুস ছিল। দিদার মুখে নানা গল্প শুনেছে ময়না। দোতলা, চকমিলানো, দুই-মহলা বাড়ি। পেছনের অন্দরমহলের দিকটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বট-অশ্বত্থের চারাগুলি বেশ বড় হয়ে উঠেছে। ইঁট-পাটকেল খসে গেছে, কড়ি-বরগা ঝুলে রয়েছে। পাল্লাহীন জানালার ভাঙা ফোকরগুলি কঙ্কালের চোখের মত খাঁ-খাঁ করছে। কেমন গা-ছমছম করে। শেয়াল, ভাম, সাপ, বাদুড়, ছুঁচোর আড্ডা।

সামনের দিকে বাইরের মহল এখনো একেবারে বসবাসের অযোগ্য হয়নি।

সেদিকে জনমানুষের আনাগোনা আছে। লক্ষ্মী-জনার্দনের মন্দির, চণ্ডীমণ্ডপ।

কাছারি দালানের ঘরগুলি যদিও তালা বন্ধ কিন্তু মন্দিরে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের পাশে ভোগের দালানের সঙ্গে কয়েকটি কুঠুরি নিয়ে সপরিবারে পুরোহিত বাঁকা ভটচাজ থাকেন। আর দেউড়ির পাশে দারোয়ানদের ঘরে একপাল পুষ্যি আর গরু-ছাগল নিয়ে কার্তিক পাইকের আস্তানা। মন্দিরের বরাদ্দ জমি থেকে ভোগের চাল অসে, আর কলকাতা থেকে বাবুরা পুজোর জন্য ভাগে ভাগে মাসোহারা পাঠান।

অন্দরমহলের পেছনে খিড়কির পুকুর ঘিরে আম-কাঠাল-জাম-জামরুলের পুরনো বাগান। চালতা, কুল, তেঁতুল, পেয়ারা, নোনাফলের গাছ। আর আগাছার জঙ্গল। ভাঁট, আকন্দ, আসশ্যাওড়ার ঝোপ। নানা জাতের মোটা মোটা লতা বড় বড় বুড়ো গাছগুলিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। বৈঁচি, শেয়াকুল আর গাঁদাললতার জঙ্গল। বুড়ো আমগাছের ডালে ধুঁদুল-লতায় শুকনো ফল ঝুলছে। সীমানার ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে ঢুকল দু’জনে।

ঝোপ-জঙ্গল এড়িয়ে ঘুরে ঘুরে সাবধানে পা ফেলে ফেলে পুকুরের কাছে এল। ওপারে বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ফাটলে আগাছা জন্মেছে। কোথাও জনমানুষ নেই। চতুর্দিকে নিবিড় নির্জন ছায়া। বোশেখ মাসের প্রখর রোদও সব জায়গায় সমানভাবে ঢুকতে পারেনি। পুকুরে চারদিকেই গাছ-গাছালি, ঝুঁকে পড়ে ছায়া ফেলেছে। শুধু মাঝখানে কচুরিপানার বড় বড় চকচকে পাতায় শেষ দুপুরের রোদ চমকাচ্ছে। ওপারে দত্তবাড়ির অন্দরমহলের ভাঙা দালান চোখে পড়ল।

সেদিকে তাকিয়ে বললো বিল্বনাথ, “ওখানে নাকি ভূতের ভয় আছে।”

“ধ্যুৎ, দিনের বেলা কিসের ভয়।” বললো বটে ময়না, কিন্তু তাকিয়ে রইল উপরে দোতলার দিকে। হাত তুলে কোণের দিকটা দেখিয়ে আবার বললো বিল্ব, “শুনেছি, ওই দিকের একটা ঘরে নাকি ও বাড়ির ছোটকর্তা তারক দত্তর বউ গলায় দড়ি দিয়েছিল।”

“চুপ করো, ওসব কথা মনে করিয়ে দিও না—” ধমক দিল ময়না। কিন্তু বিলুদা কিছু বলার আগেই মনে পড়েছিল। ওই দোতলার দিকে চোখ পড়তেই দিদার মুখে যা শুনেছিল সব মনে এল। প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তার দত্তের বউ ছিল যাকে বলে ‘ডাকসাইটে’ সুন্দরী। দিদার চেয়ে দু’চার বছরের বড় সেই রূপসী বউটি এক শীতের রাতে গলায় দড়ি দিয়েছিল। সঠিক কারণ কিছু বাইরে প্রকাশ পায়নি। কিন্তু দিদার কথা, “ছোটকত্তার স্বভাব-চরিত্তির ভাল ছেল না, বারমুখো ব্যাটাছেলে।” ‘বারমুখো’ কাকে বলে বোঝেনি ময়না, তবে খারাপ কিছু আন্দাজ করেছিল। সেই বউটিকে নাকি এখনো মধ্যে মধ্যে দেখা যায়। শীতের সন্ধেয় কিংবা শেষ রাতের আবছায়া কুয়াশার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে কেউ কেউ।

সেই বয়স, সেই রূপ। সারা গায়ে সোনার গয়না, লাল বেনারসী, কপালে সিঁদুর। মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল ময়না, “আচ্ছা, বিলুদা মানুষ মরে গেলে আর বয়স বাড়ে না, তাই না?” এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কখনো শোনেনি বিল্বনাথ। এরকম কথা কোনদিন ভেবেও দেখেনি। আমতা-আমতা করে জবাব দিল, “কি জানি, ঠিক বলতে পারবো না, তোর মনে নেই, দশ বছর আগে কলকাতার হাসপাতালে ছেলে হবার সময় মারা গেল বড়দি, তখন তার বয়স ছিল তেইশ-চব্বিশ, আমার চোখে এখনো বড়দির সেই চেহারাটাই ভাসে, এতদিন বেঁচে থাকলে কেমন দেখতে হত কে জানে!”

বিল্বনাথের বড়দি হল ওর জ্যাঠামশাই কালী বিশ্বাসের বড় মেয়ে শেফালি। ময়নার জন্মের আগেই তার বিয়ে হয়েছিল। ময়নার মায়ের সঙ্গে খুব ভাব ছিল।

ময়নাকে দেখতে এসে মায়ের জন্য নাকি খুব কেঁদেছিল বিল্বর সেই বড়দি। এক বছরের ময়নাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করেছিল। দিদার মুখে শুনেছে এসব।

সুতরাং সেই শেফালিদি আজ বেঁচে থাকলে কেমন দেখতে হত, সেটা ময়নার পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এ নিয়ে সে ভাবলও না। ময়নার মন এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। পুকুরের জলে ছলাৎ শব্দ হতে সেদিকে মুখ ফেরাল। এ পুকুরটায় মাছ আছে। পরক্ষণেই ডানদিকে হাত তুলে বললো, “ওই যে নোনাগাছটা, দ্যাখো।”

ডান পাশে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দু’জনে। পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের কাছাকাছি মস্ত নোনাফলের গাছ। অনেকদিন এ বাগানে ঢোকেনি বিল্ব। গাছটাকে আগে তেমনভাবে লক্ষও করেনি। এখন যা দেখল, রীতিমত অবাক হয়ে গেল। কাঁচাপাকা ফলে ফলে ভর্তি। এক-একটা বেশ বড়। দু-একটা টসটসে পাকা, পাখিতে ঠুকরে খেয়েছে।

আঁকশি দিয়ে চটপট চার-পাঁচটা আধপাকা পেড়ে ফেলল ময়না পাখিতে খাওয়া একটা পাকা, নোনা মাটিতে পড়ে ফেটে গেল। যারা খাচ্ছিল, সেই একজোড়া বুলবুলি ওদের ডাকাতি দেখে উড়ে পালাল। একটা কাঠবেড়ালী লেজ তুলে পাশের আমগাছের গা বেয়ে সড়সড় করে খানিকটা উঠে গেল। দুটো ডালের সন্ধিতে বসে ঘুরে তাকাল, তারপর চিড়িক-চিড়িক করে কয়েকবার ওদের ধমক দিল। ওর কাণ্ড দেখে হাসল ময়না।

হাসিমুখে বললো, “দেখো পাজীটা আমাদের বকছে।”

“আমরা ওর এলাকায় ঢুকে লুঠপাট আরম্ভ করেছি, বকবে না!” বলতে বলতে একটা মাটির ঢেলা ছুঁড়ে মারল বিল্ব। সুড়ুৎ করে আরো খানিকটা উপরে উঠে গেল। আবার চিড়িক-চিড়িক। আঁকশির নাগালের মধ্যে যে-কটা পেল, প্রায় সাত-আটটা, পেড়ে ফেলল ময়না।

সবে রঙ ধরেছে, কিন্তু শক্ত, সেগুলি চালের হাঁড়ির মধ্যে গুঁজে রাখতে হবে। দু-এক দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। কয়েকটা টসটসে পাকা। সেগুলি মাটিতে পড়েই ফেটে ছড়িয়ে গেল। এদিক-ওদিক থেকে সবগুলিকে কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে করতে বিল্ব বললো, “এই, অত জোরে টানছিস কেন, ভাল ভাল পাকাগুলি ফেটে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

“কি করব, জোরে না টানলে ছেঁড়া যাচ্ছে না।” ময়না নিরুপায়।

“এক কাজ কর।” একটা বুদ্ধি দিল বিল্বনাথ, “তুই আঁচল পেতে নিচে দাঁড়া, আমি টেনে ঠিক তোর আঁচলে ফেলব, তাহলে আর ফাটবে না।” মতলবটা মেনে নিল ময়না। কোমরে জড়ানো আঁচলের পাক খুলে দু’হাতে সামনে মেলে ধরলো।

এবার আঁকশি নিল বিল্বনাথ। ঠিকঠাক মত একটা পাকা নোনা ওর আঁচলে গড়তেই ময়না উল্লাসে অস্থির। “ওই যে, বিলুদা, ওই যে আরেকটা তোমার ডানদিকে—”

“আহা, চেঁচাসনি, কেতো পাইক লোকটা ভাল নয়, চেঁচানি শুনলে হয়তো তাড়া দেবে।”

“সাপের ভয়ে এদিকে কেউ আসে না।” হাসল ময়না, “তাছাড়া কেতো পাইকের বয়ে গেছে এই জঙ্গল পাহারা দিতে, না হলে এত বড় বড় পাকা নোনাগুলির এই অবস্থা হয়, পাখিতে ঠোকরাচ্ছে, কাঠবেড়ালি খাচ্ছে, কত মাটিতে পড়ে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেউ নিতে আসে না।”

“নোনা আবার একটা খাদ্য নাকি, নেহাত তোর জন্য আসতে হল, এবার চল, অনেক হয়েছে।”

“না, ওই যে আরেকটা, বেশ বড়।” ময়নার আশ মেটেনি, “ওই দ্যাখো, একটু উঁচুতে পাতার আড়ালে, দেখতে পাচ্ছো না?” দেখতে পেলেও নাগাল পেল না বিল্বনাথ।

আঁকশির শেষ প্রান্ত ধরে যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে, দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে সাধ্যমত উঁচু হবার চেষ্টা করেও নাগাল পেল না। সামান্য কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব রয়েই গেল।

“আমাকে দাও, তুমি পারবে না।”

ময়নার কথায় হাসি পেল বিল্বর, “তুই বুঝি আমার চেয়ে লম্বা!”

“দাও না আঁকশিটা, আমি একবার দেখি।” বলতে বলতে নোনা ক’টা নামিয়ে রেখে আঁচলটা আবার কোমরে জড়াল ময়না। আঁকশিটা তুলে সাধ্যমত উঁচু হবার চেষ্টা করল। দু-তিনবার লাফাল। কিন্তু সুবিধে হল না। আশপাশের ডালপাতায় খোঁচা লাগল শুধু। আসল জায়গায় পৌঁছুল না। ওর কাণ্ড দেখে হাসছিল বিল্ব।

চটে গেল ময়না, “অমন দাঁত বার করে হেসো না, তুমি গাছে উঠতে পারবে?”

“পাগল নাকি, আগের মত গাছে ওঠার অভ্যেস নেই, এখন আর পারবো না।”

“একবার দ্যাখোই না, ‘পারিব না একথাটি বলিও না আর—’ বলতে বলতে হেসে ফেলল ময়না।

“পায়জামা নোংরা হবে, সারা গায়ে গাছের ময়লা লাগবে, তাছাড়া দেখেছিস, লাল পিঁপড়ের ঢিপি, ওখানে পা পড়লে আর রক্ষে আছে!”

“তা হলে এখন কি করবো?”

“আর কিছু করতে হবে না, অনেক হয়েছে, এখন বাড়ি চল।”

“না বিলুদা, চলে গেলে হবে না, অমন ভাল নোনাটা পাখিতে ঠুকরে শেষ করে দেবে, কাঠবেড়ালিটাও কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে।”

“তাহলে কি করবি?”

বিল্ব কথার জবাবে একচিলতে হাসি ফুটল ময়নার মুখে, “এক কাজ করো, তুমি মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসো, আমি তোমার পিঠের উপর দাঁড়িয়ে—” বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে উঠল।

“তোর তো সাহস কম নয়।” প্রথমটা হতভম্ব বিল্বনাথ, “আমার পিঠে দাঁড়িয়ে—” পরক্ষণেই গরগর করে উঠল “থাক তুই এখানে, আমি চললুম—”

“আহা, শোনো, রাগ কোরো না।” ময়না ওর জামা ধরে টানল, তারপর রাস্তা আগলে দাঁড়াল, “তুমি এই জঙ্গলে আমাকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারবে?”

“খুব পারবো, এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।”

“আমাকে যদি লতায় (সাপে) কাটে?”

“কাটুক।”

“যদি ভূতে ধরে?”

“ধরুক, ধরাই উচিত।”

“ওমা আমার কি হবে!” নাকি সুরে কাচুমাচু মুখে কান্নার ভাব করল ময়না, “আমি এখন কাঁদব।”

“খুব হয়েছে, ন্যাকামি করিস না।” হেসে ফেলল বিল্ব, “যেতে হয়, চল।”

“আর একটু দাঁড়াও।” আবার সহজ গলা ময়নার, “আরেকবার দেখি।”

“আবার কি দেখবি, অনেকবার তো দেখলি, এভাবে হবে না।”

“এক কাজ করবে, আমাকে একটু তুলে ধরতে পারবে, তাহলে হয়ে যাবে।”

“তোকে তুলে ধরবো কি করে?” বিল্বর কথায় সন্দেহের ভাব। ময়না আবার ইয়ার্কি করছে কিনা, ঠিক বুঝতে পারল না।

“যেমন করে কোলে নেয়, তেমনি, আর কি, একটু উঁচু করে ধরবে।”

সহজভাবে বললো বটে ময়না, কিন্তু বিল্বর বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল। এক মুহূর্ত কানের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনল। আমতা আমতা করে বললো, “তুই কি কচি খুকি, তোকে কোলে নিলে লোকে কি বলবে?”

“ধ্যেৎ, এখানে আর কে দেখতে আসছে?” ময়নার মুখে সলজ্জ হাসি। চারপাশে তাকাল একবার। চারপাশে সবুজ ছায়ার নির্জনতা। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে শেষ দুপুরের রোদ বাঁকা হয়ে পড়েছে। পাকা নোনার গন্ধ, গাঁদাল লতার গন্ধ, শুকনো ঘাস-পাতার সঙ্গে উষ্ণ মাটির ভাপের গন্ধ, সব মিশে কেমন একটা ঝিমঝিম নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে।

আবার বললো ময়না, “তুমি একটু তুলে ধরলেই হয়ে যাবে।” কথা কয়টি যেন অনেক দূর থেকে বিল্বর কানে এল। কেমন নেশার মত মনে হচ্ছে। নেশার ঝোঁকেই যেন একটা আচ্ছন্নের মধ্যে ময়নার কথা রাখতে হল। সামান্য নিচু হয়ে দুই ঊরু বেষ্টন করে তুলে ধরল। উর্ধ্বমুখ বিল্বর থুতনি ডুবে আছে ময়নার নাভির নিচে। নরম-গরমের মধ্যে ডুবে গেছে। ময়নার শরীরে, শাড়িতে কেমন সোঁদা গন্ধ। পা কাঁপছে। বুকের মধ্যে হারু কামারের হাপর চলছে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম। বোধ হয় আধ মিনিটও হয়নি। বিল্বর মনে হচ্ছিল আধ ঘণ্টা। আঁকশিটা চটপট আধাপাকা ফলটার বোঁটায় লাগিয়ে টান দিল ময়না। নোনাটা ছিটকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে আঁকশিটাও ছেড়ে দিল। পরক্ষণেই বিশ্ব হাত আলগা দিতে মাটিতে পা রাখতে পারল। তখনো দুই হাতের মধ্যে রয়েছে। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছিল দু’জনেই। গায়ে গা লেপটে আছে। ময়নার মুখ বিল্বর মুখের কাছে। ময়নার চোখ বিল্বর চোখের সামনে। হঠাৎ কি যে হয়ে গেল! সামনে ঝুঁকে ময়নার ঘামে ভেজা লালচে ফর্সা দুই গালে আর পাতলা ঠোঁটে পরপর তিনটি চুমু দিয়ে ফেলল।

“এই, কি হচ্ছে!” ছটফট করে সরে গেল ময়না। আঁচল তুলে মুখ মুছতে মুছতে বললো, “দিলে তো থুথু লাগিয়ে, ইস্, কি বিচ্ছিরি বিড়ির গন্ধ তোমার মুখে।”

অপ্রস্তুতের মত হাসল বিল্বনাথ। হাসির মুখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। বুকের মধ্যে ধুকপুক। তবে আর কিছু বললো না ময়না। সহজভাবেই নোনাটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখল। না, ফাটেনি। রঙ ধরলেও তেমন নরম হয়নি।

সব ক’টা আঁচলে গুছিয়ে নিল। ছোটবড় দশ-বারোটা নোনার ভারে আঁচল ছিঁড়ে যাবার অবস্থা। “ও বিলুদা, তুমি ক’টা নাও তো!”

দুই হাতে গোটা চারেক নিতে পারল বিল্বনাথ। তারপর অনুগতের মতো ময়নার পেছন পেছন চললো। ভাগ্য ভাল, ময়না রাগ করেনি, চেঁচায়নি।

ভাঙা পাঁচিল পার হয়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসার পরে অনেকটা ধাতস্থ হল।

নরম গলায় ডাকল, “ময়না, এই ময়না!”

“কি বলছো?” সামনে চোখ রেখেই জবাব দিল ময়না।

“তুই কি রাগ করেছিস?”

“কেন, রাগ করবো কেন?”

“কি যে হঠাৎ হয়ে গেল, মানে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, ভাবলুম—”

এবার যেতে যেতে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল ময়না, মুচকি হেসে বললো, “তুমি একটা অসভ্য!”

সন্ধে হয়-হয়। বিন্দুবুড়ি তখন ঘরে ধূপ-ধুনো দেখাচ্ছিল। তুলসীতলায় প্রদীপ দেবে ময়না, শাঁখে ফুঁ দেবে। কোথায় গেল মেয়েটা? ময়না তখন চুপিচুপি বাড়ি ঢুকল।

নোনাফল কয়টা পুষ্পর কাছে রেখে এসেছে। দিদা দেখলে জেরা করত, কোথায় পেলি? কার বাগান থেকে চুরি করেছিস? হ্যানো-ত্যানো হাজার কৈফিয়ত। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হত। “কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সন্ধে দিতে হবে না?” দিদার ধমকের জবাবে নিরীহ মুখে বললো, “ওই তো পুষ্পদের বাড়ি, পুষ্পর সঙ্গে লুডো খেলছিলুম কিনা, তাই দেরি হয়ে গেল, জানো দিদা, আমি তিনবাজি জিতেছি আর পুষ্প কোন রকমে একবাজি।”

চটপট হাতমুখ ধুয়ে শাড়ি পালটে তুলসীতলায় প্রদীপ দিল ময়না। তারপর দিদার পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ দম নিয়ে শাঁখে ফুঁ দিল। টানা তিনটি ফুঁ।

দিন পনেরো পার করে বোশেখ মাসের শেষ রোববার, অক্ষয় তৃতীয়ার আগের দিন বেলা দশটা নাগাদ অনন্ত সরকার এসে উপস্থিত। দশ বছর বাদে জামাইকে দেখে প্রথমটা কেমন থম মেরে গেল বিন্দুবুড়ি। তারপর মেয়ের কথা বলে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে ফোঁপাতে লাগল। পনেরো বছরের ময়নাকে দেখে অনন্ত সরকারও তেমনি অবাক, কিছুটা অপ্রস্তুত। মহাদেবের মুখে শুনেছিল বটে, মেয়ে বড় হয়েছে।

কিন্তু এরকম বাড়ন্ত গড়নের ফুটফুটে সুন্দরী আশা করেনি। মায়ের রঙ পেয়েছে ময়না। রোদে ঘোরাঘুরির জন্য তেমন জেল্লা নেই বটে, তবে এই মেয়ে যদি শহরে থাকতে পারত, সেজেগুজে থাকত, তাহলে এই রঙের চমকেই চোখ ধাঁধিয়ে যেত। যারা দেখতে আসবে, তারা যে এক কথায় পছন্দ করে নেবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

রাঙচিতার বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে শুকনো হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল অনন্ত সরকার, “এই যে ময়না, আমাকে চিনতে পারছো?” চিনতে পারার কথা নয়। তথাপি আন্দাজে বুঝল ময়না, এই লোকটি তার বাবা। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে দিল, এই তোর বাবা, তোকে নিয়ে যেতে এসেছে, এখান থেকে অনেক দূরে, অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। উৎকণ্ঠা, বিস্ময় এবং কিছুটা আতঙ্ক ময়নার চোখে-মুখে। একটু আগে স্নান করে এসেছে। একপিঠ ভেজা-ভেজা কোঁকড়া চুল। ধোয়া শাড়ি, ব্লাউজ। কুলোয় করে সরষে ধুয়ে এনেছে। সামনের উঠোনে শুকুতে দেবে। ভেতরের উঠোনে এখনো তেমন রোদ নামেনি। আসছে কাল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন দিদা সরষে কুটবে, কাসুন্দি বানাবে। আম-কাসুন্দি খেতে যা দারুণ! ভাবলেই জিভে জল আসে (কিন্তু এই মুহূর্তে গলা শুকিয়ে গেল) এই সরষে কোটার ব্যাপারে দিদার অনেক আচার-বিচার। নিজেও স্নান সেরে ধোয়া থান আর শেমিজ পরে নিয়েছে।

নাতনীর পেছনে দাওয়া থেকে সরে নেমে আসছিল। জামাইকে দেখে প্রথমটা থতমত খেল, তারপর মেয়ের নাম করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নার সুর তুলল।

অনন্ত সরকারের পরনে ধুতির সঙ্গে টেরিলিনের পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা, হাতে রসগোল্লার হাঁড়ি। বাঁশের আগল সরিয়ে এপাশে এল।

বিন্দুবাসিনী তখন সিঁড়িতে পা রেখে দাওয়ার কিনারায় বসে পড়েছে। চোখে আঁচল তুলে ফোঁপাচ্ছে। শাশুড়ির সামনে মিষ্টির হাঁড়ি নামিয়ে রেখে কাপড়ের ব্যাগ থেকে শাড়ির প্যাকেট আর সন্দেশের বাক্স বার করল অনন্ত।

শাশুড়ির জন্য থানধুতি আর ময়নার জন্য কচি কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়ি এনেছে। তারপর শাশুড়ির পা ছুঁয়ে প্রণাম করে পায়ের কাছে প্রণামী বাবদ একখানি দশ টাকার নোট আর একটি কাঁচা টাকা রাখল। “এসো, বাবা এসো।” আঁচলে চোখ মুছে ভাঙা-ভাঙা গলায় বললো বিন্দুবুড়ি, “তুমি আবার এসব আনতে গেলে কেন, আমার কি আর শখ-আল্লেদ বলে কিছু আচে?” তারপর মুখ ফিরিয়ে, “হ্যারে ময়না, হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বাপকে পেন্নাম কর।”

তাড়াতাড়ি সরষের কুলো উঠোনের রোদে নামিয়ে রেখে বাবা নামের এই অচেনা লোকটার পায়ে হাত দিয়ে দায়সারা গোছের একটা ‘পেন্নাম’ ঠুকল ময়না। মেয়ের মাথায় আলতোভাবে হাত রেখে কোনরকমে ‘থাক থাক হয়েছে’ বললো বটে অনন্ত, কিন্তু মনে মনে কুঁকড়ে গেল। যে মেয়ের জন্য বলতে গেলে কিছুই করেনি, এই পনেরো বছরে তেমনভাবে কোন খোঁজখবরও নেয়নি, সেই মেয়ের কাছ থেকে বাপ হিসেবে প্রণাম নেবার অধিকার কি আছে, না থাকা উচিত!” এই জিনিসগুলি তুলে রাখ।” আবার বললো বিন্দুবুড়ি, “মাদুর পেতে বসতে দে, মুখ ধোয়ার জল এনে দে, পাখা দিয়ে হাওয়া কর, আমি দেখি একটু চায়ের যোগাড়—”

“না, না, আপনি ব্যস্ত হবেন না।” জামাইয়ের আপত্তিতে কান দিলে চলে না। হাজার হোক জামাই বলে কথা। শহুরে জামাই। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চায়ের অভ্যেস। এদিকে বিন্দুবুড়ির ঘরে চায়ের পাট নেই। ছেলেরা কখনো বাড়ি এলে কয়েকটা দিনের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করে নেয়। বিশ্বাসদের বাড়িতে অবশ্য দুবেলা চা হয়। হরি, কালী ওরা দুই ভাই-ই খুব চা খায়, বউয়েরা খায়। তাছাড়া বাইরের তেমন কেউ এলে দেয় ওরা। চায়ের খোঁজে সেদিকে গেল বিন্দুবাসিনী।

ময়না ততক্ষণে দাওয়ায় মাদুর পেতে বাবাকে বসতে দিয়েছে। হাতপাখা নেড়ে হাওয়া দিচ্ছে। একটু একটু করে নতুন চেনা বাবার সঙ্গে আলাপ শুরু হল।

থেমে থেমে আস্তে আস্তে কথা বলছে ময়না। এরকমভাবে ভেবেচিন্তে মেপে মেপে কথা বলার অভ্যেস নেই। এমনিতেই দিদা বলে ‘বকবকানির গুরুমা’। তার উপর নতুন শাড়িখানা পেয়ে খুব খুশি। সেই খুশি কলকলানি এখন চেপে রাখতে হচ্ছে, পুষ্পর কাছে গিয়ে উগরে দেবে। যা ভেবেছিল, এই ‘বাবা’ মানুষটিকে তেমন কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না। ভয় কেটে গেছে, সঙ্কোচের ভাবটিও যায়-যায়।

কলকাতা দেখার লোভ আছে, আর নাগেরবাজার জায়গাটা তো বলতে গেলে কলকাতার মধ্যেই। সেখানে সিনেমা আছে, টি-ভি আছে (আগরপাড়ায় বড়মামার বাড়িওয়ালার ঘরে দেখেছিল)। কিন্তু দিদার কাছে কি আর ফিরে আসতে পারবে? দো-টানার মধ্যে পড়ছে। “আসবে বইকি, যখন খুশি চলে আসবে।” বাবার কথাটা শুনলো বটে ময়না, কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারল না। ভয় কেটে গেলেও ভাবনা গেল না। আগরপাড়া তো বেশি দূর নয়। এখান থেকে বাসে নৈহাটি এক ঘণ্টা। তারপর রেলগাড়িতে চল্লিশ মিনিট। বড়মামাই সেখান থেকে সব মাসে আসতে পারে না। আর সে-ই বরাকর থেকে ছোটমামা আসে বছরে একবার। পুজোর সময়।

দুই মামারই যখন এই অবস্থা, ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারে না, তখন নাগেরবাজার থেকে কি আর ইচ্ছেমত চলে আসা যাবে? এখন অনেক রকম ভাল ভাল কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর একবার ওখানে নিয়ে যেতে পারলে, আর হয়তো আসতে দেবে না। বরাবরের মতো আটকে রাখবে। এই আটকে রাখার কথা ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ময়নার। কোন বকম বাঁধা-ধরার মধ্যে থাকা ধাতে পোষায় না। আগরপাড়া কয়েকবার গেছে! সেখানেও এই ব্যাপার। বড়মামি শুধু বলে, “কোথাও বেরোবি না, এসব জায়গা ভাল নয়, আমাকে না বলে কোথাও যাবি না।”

জায়গার আবার ভাল-মন্দ কি? বড়মামীর যত অদ্ভুত কথা! শুনলে হাসি পায়। চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-বদমাশ কি সবসময় ওত পেতে আছে? বড়মামী খালি আজেবাজে কথা ভাবে আর ভয় পায়। রাত্তিরবেলা দরজায় ভেতর থেকে তালা দেয়, এমনকি রাস্তার দিকের জানালা দুটিও বন্ধ করে রাখে। মামীর পাল্লায় পড়ে বড়মামাও আজকাল কেমন ভীতু স্বভাবের হয়ে গেছে। ময়নার অত ভয়-ডর নেই। নতুন জায়গা দেখার, নতুন মানুষজন চেনার, নতুন জায়গায় বেড়াবার একটা আলাদা মজা আছে। নতুন মাকে দেখার জন্য, নতুন ভাইবোনদের চেনার জন্য, দমদমের কাছে নাগেরবাজার জায়গাটা ঘুরেফিরে দেখে আসার জন্য একটা গোপন ইচ্ছে মনে মনে নাড়া দিচ্ছিল।

আর দমদম নামটাই বা কেমন মজার! এরকম নাম ভূ-ভারতে আর কোথাও আছে বলে শোনেনি ময়না। দমদম! দমদম! আলুর দম কিংবা দমাদ্দম পিটুনির কথা মনে পড়ে আর হাসি পায়। এই সময় একটা সিগারেট ধরাল অনন্ত। লম্বাটে দামী প্যাকেট। যদিও কারখানার হেড-মিস্ত্রি, কাজের সময় হরদম বিড়ি টানে। আজ শ্বশুরবাড়ি আসার আগে এই কিং-সাইজের প্যাকেট কিনেছে।

হাল্কা নীল ধোঁয়ার গন্ধটাও কি চমৎকার! মুগ্ধ ময়না।

আহা, বেচারা বিলুদা, খালি বিচ্ছিরি বিড়ি টেনে মরে। এরকম একটা সিগারেট হাতে পেলে নিশ্চয়ই চমকে যাবে। খুশিতে টগবগিয়ে উঠবে। শাশুড়িকে আসতে দেখে দামী সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়েই ছুঁড়ে দিল অনন্ত। জামাইয়ের সামনে কাঁসার বাটিতে চিঁড়েভাজা, কাঁসার রেকাবিতে দুটি ছানার সন্দেশ আর দুটি নারকোলের নাড়ু নামিয়ে রাখল বিন্দুবুড়ি। তাড়াতাড়ি ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে জল গড়িয়ে আনল ময়না।

“এত সবের কি দরকার ছিল, আপনি আবার—” কিন্তু-কিন্তু মুখ করে একটি সন্দেশ তুলে বললো অনন্ত, “তুমি একটা নাও।”

“না, না, আপনি খান।” লজ্জার সঙ্গে মাথা নাড়ল ময়না।

“নে না, বাবা দিচ্ছে হাতে করে।” দিদার কথায় নিতে হল। সন্দেশটা হাতে নিয়ে ভেতর গেল ময়না। সামনে বসে খেতে কেমন লজ্জা করছিল।

মিষ্টির পর চিঁড়েভাজা শুরু হতে না-হতে চায়ের কেটলি আর দুটি কাপ নিয়ে এল পুষ্প। সঙ্গে ওর জেঠামশাই। জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করার জন্য কালী বিশ্বাসকে ডেকে এসেছিল বিন্দুবুড়ি। ভাগ্যিস ওকে এই সময় বাড়ি পাওয়া গেল। বিশ্বাসমশাইকে দেখে তাড়তাড়ি দাঁড়িয়ে নমস্কার দিল অনন্ত সরকার।

“বোসো বাবাজী, বোসো, বহুকাল পরে দেখা, তারপর কেমন আছ?”

মুখোমুখি বসলেন কালী বিশ্বাস। পুষ্প দু’কাপ চা ঢেলে দিল।

দু’জনে আলাপ শুরু হল। কালী বিশ্বাস পাকা লোক। তার উপরে বিন্দুবুড়ির অগাধ আস্থা। ময়নাকে যেতে দেবার আগে ভালভাবে খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ময়নার মা মাধবীর গয়নাসমেত তোরঙ্গটি এখন চাইলেও দেবে না।

নাতনীর বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছে বিন্দুবুড়ি। সেসব এখন হাতছাড়া করবে না। আগে বিয়ের কথা পাকা হোক, দিনক্ষণ ঠিক হোক। তারপর মহাদেব নিজে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসবে। তার আগে জামাইয়ের ভাবগতিক বোঝা দরকার। কোন কথা নেই, বার্তা নেই। দশ বছর বাদে হুট করে এসে মেয়েটাকে ‘নিয়ে যাব’, বললেই হল! কোথায় বিয়ের কথা হচ্ছে, কি ‘বেত্তান্ত’, আসল মতলবটা কি, ভালভাবে হদিস নিতে হবে। তবে কালী বিশ্বাসের কাছে জারিজুরি খাটবে না। পেটের কথা টেনে বার করতে জানে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গেল বিন্দুবুড়ি। জামাইয়ের জন্য দু’চার পদ ভালমন্দ কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। ময়না সাহায্য করবে। দরকার হলে পুষ্পও হাত লাগাবে। বিন্দুবাসিনীর হেঁশেলে আমিষের বালাই নেই। ছেলের বউয়েরা বাড়ি এলে রান্নাঘরের দাওয়ায় আলাদা উনুনে আমিষ রান্না করে। আজ কালী বিশ্বাসের বউ রুইমাছ রান্না করে পাঠিয়ে দেবে বলেছে। দই-মিষ্টির জন্য বিন্দুকে বাজারের দিকে পাঠানো হয়েছে।

প্রায় ঘণ্টা দুই ধরে জামাইয়ের সঙ্গে নানা বিষয় আলাপ করলেন কালী বিশ্বাস। তারপর পুষ্পকে ডেকে স্নানের জন্য অনন্তকে তাদের পুকুরে নিয়ে যেতে বললেন। তেল-সাবান-গামছা আর মহাদেবের একটা পুরনো ধোয়া ধুতি পুষ্প নিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সেই ফাঁকে রান্নাঘরের সামনে এসে চুপি চুপি বললেন কালী বিশ্বাস, “খুড়িমা, কথাবার্তা শুনে তো খারাপ কিছু মনে হল না, মেয়ে যখন বড় হচ্ছে, একদিন তো বিয়ে দিতেই হবে, সম্বন্ধটি যা শুনলাম, খারাপ নয়, হাজার হোক বাপ বলে কথা, নিতে যখন এসেছে, তখন ভাল মনে দিয়ে দিন, কয়েকটা দিন বাদে মহাদেবকে পাঠাবো, দেখেশুনে আসবে, ভালভাবে খোঁজখবর নিয়ে তো বিয়ে দেওয়া যায় না, এদানীং চাদ্দিকে যা সব হচ্ছে, রোজ খবরের কাগজে একটা দুটো বউ খুনের কেচ্ছা বেরোয়, এরকম অবস্থায় ভালভাবে দেখাশোনা না করে আমরা তো মেয়ের বিয়েতে মত দিতে পারি না, জামাইকেও সে কথা বলে দিয়েছি।”

“তা তুমি যদি বলো বাবা, তা হলে ভরসা করে পাঠাই।”

“দিন পাঠিয়ে, কিছু ভাববেন না, আমরা তো পাঁচজন আছি।”

রান্নাঘরের এক কোণে বসে চাল বাছতে বাছতে কথাগুলি শুনল ময়না। স্বস্তি পেল না।

যাবে কি যাবে না, সাব্যস্ত করতে পারল না। দু’চার দিনের জন্য ঘুরে আসা যেতে পারে। কিন্তু বরাবরের মত দিদাকে ছেড়ে, এই বাড়ি, এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকা অসম্ভব।

দুপুরে (বেলা প্রায় দেড়টা) ঝকঝকে কাঁসার থালায় জামাইকে খেতে দিল বিন্দুবুড়ি। কলমা চালের ভাত, বেগুন ও করলা ভাজা। তিনটি কাঁসার বাটিতে মুগডাল, আলুপটল, রুইমাছ (কালিয়ার কাছাকাছি একটি পদ)। পাথরের বাটিতে কচি আমের চাটনি আর স্টিলের রেকাবিতে দই-সন্দেশ। খাওয়াটা বেশ জম্পেশ হয়ে গেল।

বহু বছর এমন চমৎকার স্বাদের টাটকা পাকা রুইমাছ কপালে জোটেনি (বেশ বড় বড় দু’টি টুকরো নয়, ‘খণ্ড’ বলা চলে)। গেল মাঘ মাসে এক বিয়েবাড়িতে (বরযাত্রী বলেই মাছ-মাংস দুই-ই জুটেছিল, না হলে হয় মাংস, নয় মাছ) তিন-চার টুকরো রুইমাছ পেয়েছিল। কড়ে আঙুল সাইজের টুকরো, এরকম স্বাদের ধারে-কাছে নেই। আজকাল ভোজের বাড়িতে রুই-কাতলের সঙ্গে ‘সিলভার কাপ’ মেশানো হচ্ছে। সেই বিলিতি মাছের টুকরো পাতে পড়েছিল কিনা কে জানে! বাইরের দাওয়ায় মাদুর পেতে দিয়েছিল ময়না, সঙ্গে বালিশ। সেখানে বসে সিগারেট ধরাল অনন্ত সরকার। ময়না পান এনে দিল। তারপর হাতপাখা নেড়ে হাওয়া দিতে বসল।

“আমাকে হাওয়া দিতে হবে না, অনেক বেলা হল, তুমি এবার খেয়ে নাও মা, আর দেরি কোরো না, বিকেলে যেতে হবে।” নতুন চেনা বাবার মুখে ‘মা’ ডাকটি ভাল লাগল ময়নার। কিন্তু ‘বিকেলে যেতে হবে’ কথাটি শুনে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। যেতে হবে, যেতে হবে, এখান থেকে চলে যেতে হবে।

দিদার পাশে বসে শুধু ভাত নাড়াচাড়া করছিল ময়না।

“কি রে, খাচ্ছিস না যে?”

দিদার কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কি আজ বিকেলেই চলে যেতে হবে?”

“সে রকম কথাই তো—” বিন্দুবুড়ির গলায় ভাতের দলা আটকে গেল। এক ঢোক জল খেতে হল।

“আমি যাব না দিদা, তুমি বারণ করে দাও।”

“তা কি করে হয়, কালীনাথ বলে গেল, তুই তো নিজের কানে শুনলি, তোর বাবা নিতে এসেছে, আমি আর কি করে—” বলতে বলতে চোখে জল এল বিন্দুবুড়ির।

বাঁ-হাতে আঁচল তুলে চোখ মুছল। মুখ নিচু করে নিজেকে সামলে নিল ময়না। অদ্ভুত একটা অভিমান হল। কোথায় দিদা জোর করে আটকে রাখবে তা নয়, বিশ্বাসমামার কথায় গলে গেল। আসলে তাকে কেউ চায় না।

বড়মামা নয়, মামী নয়, এমনকি দিদাও না। মেয়ে পার করতে পারলেই বেঁচে যায় সবাই। ঠিক আছে, চলেই যাবে সে। তারপর যা হয় হবে।

কোনরকমে খাওয়া শেষ করে বাইরের দাওয়ায় এসে দেখল, বাবা ঘুমিয়ে পড়ে আছে। ওপাশে কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে। শিয়রের কাছে সেই দামী সিগারেটের প্যাকেট। এদিক-ওদিক তাকাল ময়না। কাছেপিঠে কেউ নেই। দিদা বান্নাঘরে।

আলতো পায়ে এগিয়ে এসে প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বার করে নিল। আরো চার-পাঁচটা রয়েছে। প্যাকেট বন্ধ করে আগের জায়গায় রাখল। তারপর সাবধানে সরে এল। বিলুদাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে, জানা আছে।

শিরীষ গাছের নিচে খাটিয়া পেতে শুয়ে ছিল বিল্বনাথ। ঘুম আসছে না। বেশ গরম। পরশু বিকেলে আচমকা ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল। অথচ গরম কমেনি।

ময়নাকে আসতে দেখে উঠে বসল। লম্বা কিং-সাইজ সিগারেট হাতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “কোথায় পেলি?”

“বাবার প্যাকেট থেকে নিয়েছি।”

“চুরি করেছিস বল।”

“তোমার জন্য করতে হল।” বলতে বলতে ঝপ করে পাশে বসল ময়না।

সিগারেট ধরিয়ে লম্বা দুটি টান দিল বিল্বনাথ। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোর বাবা কি তোকে নিয়ে যেতে এসেছে?”

“সেরকম কথাই তো হয়েছে।”

“কবে নিয়ে যাবে?”

“আজই বিকেলে যেতে হবে।”

“সে কি! আজই?”

কয়েক সেকেণ্ড থম মেরে রইল বিল্ব। আবার জিজ্ঞেস করল, “তোর যাবার ইচ্ছে আছে?”

“আমার ইচ্ছেয় কি হবে, ভেবেছিলুম দিদা যেতে দেবে না, এখন দেখছি, তোমার জেঠামশাইয়ের কথা শুনে দিদাও রাজী হয়েছে।” বলতে বলতে মুখ নিচু করল ময়না।

“এ কি রে, কাঁদছিস নাকি?” ময়নার চিবুকে আঙুল ছুঁইয়ে মুখখানি তুলে ধরল বিহু।

“কাঁদবো কেন, অত সহজে কাঁদি না আমি।” মুখ সরিয়ে নিল ময়না। আবার বললো, “এখানে আমাকে কেউ চায় না, বড়মামা না, মামী না, এমন কি দিদাও না, আমি সকলের বোঝা।” গলা ভারী হয়ে এল।

বিল্বর এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে ময়নার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো, “কেন রে, আমি তো তোকে চাই, আমরা কাছাকাছি থাকবো।”

“ফাজলামি কোরো না।” বিল্বর হাতখানি সরিয়ে দিয়ে সামান্য সরে বসল ময়না। ম্লান হাসিমুখে বললো, “তুমি কে? তোমার কথায় কি হবে?”

ঘন ঘন সিগারেট টেনে গম্ভীর মুখে কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল বিশ্বনাথ। তারপর বললো, “একটা কথা বলছি, কাউকে বলিস না, আমি তোদের সঙ্গে যাব, চুপি চুপি যাব, কেউ টের পাবে না।”

“সে কি! কেন?” ময়না অবাক।

“নাগেরবাজারে তোর বাবা কোথায় থাকে দেখে আসবো।”

“তাতে লাভ কি?”

“তোর খবর নিতে পারবো, দরকার হলে দেখা করতে পারবো, তোর দিদাকে খবর দিতে পারবো।”

“কিন্তু লুকিয়ে যাবে কি করে, বাবা যদি দেখে ফেলে!”

“দেখলেও চিনতে পারবে না, আমি তো আজ সামনে যাইনি, ছোটবেলায় আমাকে হয়তো দু’একবার দেখে থাকতে পারে, আমার মনে নেই, তোর বাবারও মনে থাকার কথা নয়।”

কথাটা ঠিক। খানিকটা ভেবে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল ময়না, “যদি রাত হয়ে যায়, অতদূর থেকে তুমি একা-একা ফিরে আসতে পারবে?”

“কি যে বলিস?” হাসল বিল্বনাথ। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “ওসব জায়গায় আমার অনেক ঘোরা আছে, তুই তো জানিস দমদমের কাছে প্যাটেল কলোনিতে আমার মেজমাসীমার বাড়ি, নাগেরবাজার থেকে তেমন দূর নয়, ওখানে যাব বলেই বাড়ি থেকে বেরোব।”

বিলুদা চুপি চুপি সবাইকে লুকিয়ে সঙ্গে যাবে। বেশ মজা হবে। পুরো ব্যাপারটা নতুন ধরনের এক লুকোচুরি খেলা মনে হল। ভেতরের গুমোট ভাবটা কমে গেল। অনেকটা হালকা মনে উঠে দাঁড়াল ময়না, “যাই পুষ্পর সঙ্গে দেখা করে আসি।”

“ওকে কিছু বলিস না কিন্তু।” সাবধান করল বিশ্বনাথ, “তোর পেটে তো আবার কথা থাকে না।” সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিল।

আগে আগে যাচ্ছিল অনন্ত সরকার, পেছনে ময়না। বাবার দেওয়া কচি-কলাপাতা রঙের নতুন শাড়ি। হালকা গোলাপি ব্লাউজ। আঁটো খোঁপা। আলতা পরা পায়ে স্যাণ্ডেল। গেল পুজোর সময় কেনা এই স্যাণ্ডেল জোড়ার সঙ্গে ময়নার পায়ের খুব একটা সম্পর্ক নেই। সারাদিন পাড়ার মধ্যে এখানে-ওখানে, এবাড়ি-ওবাড়ি, বনে-বাগানে, পুকুরঘাটে খালি পায়েই ঘুরে বেড়াত, ছুটোছুটি করত। বরং এখনই স্যাণ্ডেল পায়ে দিয়ে তেমন তড়বড়িয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছে না। শান্ত মেয়ের মতন বাপের পেছন পেছন ধীর পায়ে যাচ্ছে। হাতে প্লাস্টিকের একটা বালতি-ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে ওর শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, গামছা, সস্তার স্নো-পাউডার, চিরুনি। একটি ছোট টিনের বাক্সে সেলাইয়ের টুকিটাকি।

রাঙচিতার বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন চোখ মুছছিল বিন্দুবুড়ি।

ময়না একবার পেছন ফিরে দেখল দিদা দাঁড়িয়ে আছে, আর অনেক পেছনে বিলুদা আসছে। নীল প্যাণ্ট, চকরাবকরা বুশ শার্ট আর হাওয়াই চপ্পল। বিন্দুবুড়িও বিল্বকে যেতে দেখল, কিছু মনে করল না। রোজই তো এসময় বাজারের দিকে ওদের দোকানে যায়। তবে সাইকেলে যায় আজ হেঁটে যাচ্ছে।

হয়তো কাছাকাছি কোন বন্ধুর বাড়ি যাবে। আর বিল্ব দেখল, বেশ সহজভাবেই যাচ্ছে ময়না। ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নাকাটি কিংবা হা-হুতাশ করা ওর ধাতে নেই। ওদিকে আকাশে মেঘ জমছে, বাতাস থমকে আছে। দু’দিন আগে, সন্ধের মুখে আচমকা ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল, আজও সেরকম হতে পারে।

মেঘ-ছেঁড়া একঝলক বিকেলের রোদ এসে পড়েছে গাছপালার গায়ে, ময়নার রাস্তায়, নতুন শাড়িতে। দারুণ দেখাচ্ছে।

প্রায় মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। শেরপুর বাজারের গায়ে বাস-স্টপ। তিয়াত্তর নম্বর বাস-রুট। এদিকে হাবড়া বাজার, ওদিকে নৈহাটি স্টেশন। দেড় ঘণ্টার দৌড়। এখান থেকে নৈহাটি এক ঘণ্টার কাছাকাছি।

খগেন সাধুখাঁর চায়ের দোকানের সামনে দু’খানি বেঞ্চি পাতা থাকে। তার একটিতে চুপচাপ বসে আছে ময়না। পাশে বালতি-ব্যাগ। উলটো দিকে শ্যামের পানের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে দড়ির আগুনে সিগারেট ধরাচ্ছে অনন্ত সরকার। সামান্য তফাতে মহালক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ভেতর থেকে লক্ষ রাখছে বিশ্বনাথ, সত্যি বলতে কি, বেশ কিছুটা অবাক। ময়নাকে এরকম ঠাণ্ডা চুপচাপ কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। চোখের সামনে ময়না আছে, অথচ ছটফটানি নেই, বকবকানি বন্ধ। ভাবা যায় না।

দুপুরবেলা কিছুক্ষণ এই বাজার এলাকাটা ঝিমিয়ে থাকে। এখন বিকেলের শুরুতে দোকানপাট খুলছে, লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। সন্ধেবেলা জমজমাট হবে।

খানিকটা সময় পার করে বাস এল (মোটামুটি পঁচিশ মিনিট অন্তর সার্ভিস)। তেমন কিছু উপচেপড়া না হলেও, বেশ ভিড়। বাবার সঙ্গে উঠল ময়না। বসার জায়গা নেই। তবে বাঁ-দিকে মেয়েদের জায়গায় সামান্য চাপাচাপি করে বসতে পারল। উলটো দিকে মুখ করে মাথার উপর লোহার রড ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনন্ত।

বাসের ঘন্টি বাজতেই একছুটে এসে সামনের দরজা দিয়ে উঠে পড়ল বিল্বনাথ। ময়নার পেছনে জানালা, সেজন্য ওঠার সময় দেখতে পায়নি কয়েক মিনিট বাদে বাঁ-দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেল, সামনের দরজার কাছে জটলার মধ্যে সামান্য ঝুঁকে বিলুদা ওকে লক্ষ করছে। চোখাচোখি হতে হাসল। ময়নাও হাসিমুখে চোখ ফিরিয়ে নিল। এদিকে বাবা টিকিট কাটছিল। এইসময় একটি লোক উঠে আসতে বসার জায়গা পেয়ে গেল। বুড়োমত মানুষটি ঠেলেঠুলে দরজার দিকে এগিয়ে এল। রাজাপুর। বোধ হয় আধ মিনিটও থামল না। আবার ছুটল। রাস্তা ভাল নয়। ঝাঁকুনি দিতে দিতে ঢিক ঢিক করে তিয়াত্তর নম্বর চলেছে। এরপর ঈশ্বরীগাছার বাজার। ডান পাশের বউটি উঠে যেতেই সরে এসে দরজা ঘেঁষে বসতে পেল ময়না। বাজারে নামল কয়েকজন, উঠল অনেক। এখন বেশ ভিড়। সামনে মানুষের আড়াল। ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পেল ময়না। উলটো দিকে লম্বা বসার জায়গায় সামনের প্রান্তে কাটা-সিটের ঠিক পেছনে বসতে পেরেছে বাবা। আর আশ্চর্য! বসে বসে ঝিমুচ্ছে। দুপুরে জমাট ঘুমের রেশ এখনো যায়নি। ওদিকে আকাশ কালো হয়ে এসেছে। বাজার এলাকা ছাড়াবার পরেই দু’পাশে খোলা মাঠ। যতদূর দেখা যায়, মাঠের আকাশে মেঘ থই-থই করছে। দূরের গ্রাম, গাছপালা অন্ধকার। রাস্তার পাশে ধুলোর ঘূর্ণি। কালবোশেখী ছুটে আসছে। এখুনি হয়তো ঝড় শুরু হবে। এরকম বাসে যেতে যেতে কখনো ঝড় দেখেনি ময়না। উৎসুক চোখে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মনে মনে উত্তেজিত, উৎফুল্ল। পুষ্প এখন কি করছে? এই ঝড়ে কি আম কুড়োতে যাবে? নাকি ময়না নেই বলে ওর মা একা-একা যেতে দেবে না। হঠাৎ মনে পড়ল, উঠোনে রোদে দেওয়া সরষে আর ডালের বড়িগুলি তোলা হয়নি। চলে আসার সময় খেয়াল ছিল না। দিদা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তুলে রেখেছে।

সামনে দরিয়াপুর, তারপর আওয়ালসিদ্ধি। তারপর আদাহাটা। বিলুদার বাবা এখানকার স্কুলে চাকরি করে। কয়েকবার আগরপাড়া আসা-যাওয়ার পথে এই নামগুলি মোটামুটি চেনা। লোকজনের ওঠা-নামা। ঘণ্টির টিঙটিঙ। বাবা ঝিমুচ্ছে। মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। বিলুদা এখনো বসার জায়গা পায়নি।

বাস ছুটেছে সোজা পশ্চিমে। ওদিকে নৈহাটি। তারপর গঙ্গা। গঙ্গার ওপার থেকে মেঘ উঠে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। দূরে গাছপালার মাথায় বিদ্যুতের চকমকি। একটানা বাসের গোঙানির সঙ্গে মেঘের গুরুগুরু। কানের পাশে হুহু হাওয়া। দেখতে দেখতে সাহেব কলোনি। সামনে চওড়া নতুন রাস্তা। দক্ষিণ-উত্তর বরাবর এই রাস্তাটা বারাকপুর থেকে কল্যাণী গেছে। সেখান থেকে নাকি গঙ্গা পার হয়ে কোথায় বোম্বে রোডের সঙ্গে মিশবে, শুনেছে ময়না। বাসটা থামতে না থামতেই উঠে দাঁড়াল। পায়ের কাছে রাখা বালতি-ব্যাগটা তুলে নিয়ে টুক করে নেমে এল, বাবা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। নৈহাটি গিয়ে ঘুমের মজা টের পাবে।

ওদিকে হতভম্ব বিল্বনাথ। একি কাণ্ড! ময়না হঠাৎ এরকম অচেনা জায়গায় নেমে গেল কেন? টিঙটিঙ শব্দের সঙ্গে গাড়িটা চলতে শুরু করতেই খেয়াল হল।

তাড়াতাড়ি দু-তিনজনকে ঠেলেঠুলে হুড়মুড় করে নেমে পড়ল। (পেছনে কয়েকটি কটু মন্তব্য।) বাস ততক্ষণে নতুন রাস্তা পার হয়ে গেছে। মোড়ে দাঁড়িয়ে হাসছে ময়না।

ঝোড়ো হাওয়ায় ওর আঁচল উড়ছে। কাছাকাছি এসে বললো বিল্বনাথ, “কি কাণ্ড করলি, বল তো!”

“বাবাকে কেমন ফাঁকি দিলুম, নৈহাটি নেমে খুঁজে মরবে।” হি-হি করে হাসল ময়না।

“এরকম করার মানে কি?”

বিশ্বের জিজ্ঞাসার জবাবে বললো, “মানে আবার কি, আমার তো যাবার ইচ্ছেই ছিল না, ঝড় আসছে দেখে আম কুড়োবার কথা মনে হল, বাবাকে ঘুমোতে দেখে সোজা নেমে এলুম।” ময়নার হাসি আর থামে না।

বিল্বর মুখেও সেই হাসির ছোঁয়া লাগল। আবার জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করবি?”

“কি আর করবো, সোজা উলটোদিকের বাসে চেপে বাড়ি চলে যাব।” বলতে বলতে বৃষ্টি ছুটে এল। কালো রাস্তার উপর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। একছুটে রাস্তার পাশে একটা জারুল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে। কিছুদূরে রাস্তার ওপাশে একটা চালাঘরে চায়ের দোকান। উলটোদিকের বাস বোধ হয় ওখানেই থামে। দুই বড় রাস্তার কাটাকুটির কাছাকাছি কোন দোকানপাট এখনও গড়ে ওঠেনি। কাছেপিঠে কোনও বাড়িঘরও নেই।

চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত ফাঁকা। চওড়া নতুন রাস্তায় উপর দিয়ে অনেকটা দূর থেকে বৃষ্টির ছুটে আসা চমৎকার দেখা যাচ্ছে। তুমুল বৃষ্টি। উথাল-পাতাল হাওয়া। জারুল গাছের নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে দু’জনেই। গাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরতে শুরু করেছে। একটু পরেই অঝোরে ঝরবে। এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না। ছুটে গিয়ে ওই চায়ের দোকানে ঢুকবে কিনা ভাবছিল বিল্ব। ময়নার ভ্রূক্ষেপ নেই। বিলুদার সঙ্গে এরকম একটা নতুন জায়গায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে অদ্ভুত মজা। খুব খুশির গলায় বললো, “যেখানে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে কি এরকম বৃষ্টি দেখা যায়, আম কুড়োনো যায়, সেখানে পুষ্পকে পাচ্ছি কোথায়, দিদাকে পাচ্ছি কোথায়, আর—”

ফিক করে হেসে বললো, “সেখানে তোমাকেই বা পাবো কোথায়?”

আকাশে আকাশে সন্ধ্যার ম্লান আলো। ঝড়বৃষ্টি উড়ে গেছে। বোশেখের বৃষ্টি, হুড়মুড় করে এসেছিল, হুস করে চলে গেল। উঠোনময় আমপাতা, খড়কুটো। কতগুলি কচি আমও পড়েছে এদিক-ওদিক। অন্ধকারে ঠাহর হচ্ছে না। ময়না বাড়ি নেই। কে আর ছুটোছুটি করে আম কুড়োবে?

তুলসীতলায় প্রদীপ দিল বিন্দুবুড়ি। শাঁখটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। আগের মত দম নেই। বাজাতে পারবে না। ওবাড়ি থেকে পুষ্পকে ডেকে আনবে কিনা ভাবছিল। এমন সময় ঠিক ঝড়ের মতই হইহই করে এল ময়না। “ও দিদা, আমি এসে গেছি।”

“ওমা! তুই?”

“ঝড় বৃষ্টির জন্য ফিরে এলাম।”

“তোর বাবা কোথায়?”

“চলে গেছে, দাঁড়াও আমি শাঁখ বাজাব, শাড়ি বদলে আসছি।”

তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে, হাতমুখ ধুয়ে তুলসীমঞ্চের কাছে রোজের মত নিজের জায়গাটিতে এসে দাঁড়াল ময়না। দীর্ঘ দম নিয়ে শাঁখে ফুঁ দিল। টানা তিনবার ফুঁ।

১৩৯৩ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *