নিষ্পত্তি

নিষ্পত্তি

শহর হইতে মাইল তিনেক দূরে গঙ্গার তীরে একটি পাথরের টিলা আছে। মাটির দিক হইতে টিলাটি ধীরে ধীরে উঁচু হইয়াছে, কিন্তু গঙ্গার মুখোমুখি পৌঁছিয়া একেবারে হঠাৎ খাড়া নীচে নামিয়া গিয়াছে; মনে হয় গঙ্গাদেবী তাঁহার ক্ষুরধার স্রোতের দ্বারা টিলাটির অর্ধেকটা কাটিয়া লইয়া গিয়াছেন। দূর প্রসারিত সমতলভূমির প্রান্তে নদীর কিনারে এই টিলা অনেক দূর হইতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে; কিন্তু স্থানটি নির্জন, লোকজন বড় কেহ এদিকে আসে না। শোনা যায়, পুরাকালে কোন্ এক মুদ্‌গল মুনি এখানে বসিয়া তপস্যা করিতেন।

শরৎকালের এক স্বচ্ছ অপরাহ্ণে পরমেশবাবু গঙ্গার ধার দিয়া টিলার পানে চলিয়াছিলেন। সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু পশ্চিম দিগ্বধূর বর্ণ-প্রসাধন এখনও আরম্ভ হয় নাই। গঙ্গার পালিশ করা সুচিক্কণ বুকে জলের গতি আছে, কিন্তু চঞ্চলতা নাই। পরমেশবাবুও চলিয়াছিলেন তৃপ্তি মন্থর চরণে; তাঁহার গতির একটা লক্ষ্য ছিল বটে, কিন্তু ত্বরা ছিল না।

পরমেশ কিছুদিন হইতে মনে একটা অচঞ্চল শান্তি অনুভব করিতেছিলেন। তাঁহার বয়স এখন পঞ্চাশোর্ধে; সম্প্রতি মোটা পেন্সন লইয়া চাকরি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহার গোলগাল শরীরটি এখনও বেশ নিরেট ও নিরাময় আছে। তিনি নিঃসন্তান; কয়েক বৎসর পূর্বে পত্নীও গত হইয়াছেন। এইরূপ সর্বাঙ্গীণ অনুকূল অবস্থার মধ্যে পড়িয়া তাঁহার মনটি স্বভাবতই প্রসন্ন শান্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।

চারিদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে তিনি চলিয়াছিলেন, মনে মনে বলিতেছিলেন, ‘আহা, মধু মধু—মধু বাতা ঋতায়তে—’

টিলার কাছাকাছি পৌঁছিয়া পরমেশের মনে পড়িল কেন তিনি বহুবর্ষ পরে এদিকে আসিয়াছেন। ছেলেবেলার স্কুলে-কলেজে পড়ার সময় তিনি প্রায়ই এই টিলায় আসিয়া বসিতেন; কারণ তখন হইতেই তাঁহার মন ভাবপ্রবণ। কিন্তু গত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে আর এদিকে আসা হয় নাই। পরমেশ সস্নেহ দৃষ্টিতে টিলা নিরীক্ষণ করিলেন; টিলা ঠিক তেমনই আছে। ত্রিশ বৎসরে কিছুমাত্র বদলায় নাই। ক্ষণেকের জন্য তাঁহার মনে হইল, ত্রিশ বৎসর বুঝি কাটে নাই, পৃথিবী যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু পরক্ষণে তাঁহার স্মরণ হইল, আজ সকালে তিনি একটি চিঠি পাইয়াছেন এবং তাহারই ফলে আজ এখানে আসিয়াছেন। তাঁহার মনের উপর একটি ছায়া পড়িল।

সকালবেলা তিনি যে চিঠি পাইয়াছেন তাহাতে এই কথাগুলি লেখা ছিল—

ভাই পরমেশ, আমাকে নিশ্চয় ভোলোনি। ইস্কুলে কলেজে একসঙ্গে পড়েছি; সর্বদা আমরা একসঙ্গে থাকতাম, প্রায় সন্ধ্যেবেলা সেই মুদ্‌গল মুনির পাহাড়ে গিয়ে বসতাম। লোকে বলত মাণিকজোড়। আমি সেই খোদন।

ছেলেবেলায় তুমিই ছিলে আমার প্রাণের বন্ধু—friend, philosopher and guide. তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, সে আজ কতদিনের কথা! তিরিশ বছরের কম নয়। সেই থেকে আর আমাদের দেখা হয়নি। কিন্তু তোমার কথা প্রত্যহ মনে পড়ে। অনেকবার মনে হয়েছে তোমাকে চিঠি লিখি, কিন্তু সংসারের নানা ঝঞ্ঝাটে লেখা হয়নি। তবে তুমি পেন্সন নিয়ে বাড়িতে আছ সে খবর পেয়েছি। আমারও তো পেন্সন নেবার সময় হল, কিন্তু—

ভাই, আমি বড় বিপদে পড়েছি। কী বিপদ তা চিঠিতে লেখা যাবে না। তোমার সঙ্গে দেখা করা দরকার কিন্তু তোমার বাড়িতে যাবার সাহস নেই। আগামী শুক্রবার সন্ধ্যার সময় তুমি যদি মুদ্‌গল মুনির টিলাতে যাও তাহলে আমার সঙ্গে দেখা হবে, তখন সব কথা বলব। ভাই, আমাকে উদ্ধার করতেই হবে; তুমি ছাড়া আর কেউ তা পারবে না। একলা এসো কেউ যেন জানতে না পারে। —তোমারই খোদন।

পুনঃ—পঞ্চাশটি টাকা সঙ্গে এনো; আমি তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। যদি নিতান্তই না পারো অন্তত পঁচিশ টাকা এনো।

এতক্ষণে পরমেশ টিলার পাদমূলে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন; একটি নিশ্বাস ফেলিয়া তিনি উপরে উঠিতে লাগিলেন। উঠিবার পথ চারিদিকে বড় বড় পাথরে আকীর্ণ সংসার পথের মতই দুর্গম। পরমেশের মনে পড়িল ছেলেবেলার খোদনের মুখ; সংসার-চিন্তাহীন কচি কিশোর মুখ। এখন তাহার চেহারা কেমন হইয়াছে কে জানে! পরমেশ একটু লজ্জিত হইয়া ভাবিলেন, গত ত্রিশ বছরের মধ্যে খোদনের স্মৃতি বোধ করি পাঁচ বারও তাঁহার মনে উদয় হয় নাই। অথচ একদিন সত্যই তাঁহারা অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন। কে জানে খোদনের কী বিপদ হইয়াছে।

টিলার ডগায় উঠিয়া তিনি কিন্তু খোদনের কথা ভুলিয়া গেলেন; চারিদিকের অপরূপ সৌন্দর্যে তাঁহার মন ভরিয়া গেল। আকাশে কাশপুষ্প উড়িতেছে, সম্মুখে সুদূর বিস্তার গঙ্গা। টিলাটি যেন একটি প্রকাণ্ড সিংহাসন, গঙ্গার দিকে মুখ করিয়া বসানো হইয়াছে। পঞ্চাশ হাত নীচে তাহার প্রস্তরময় চরণ জলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। টিলার পাদমূলে গঙ্গার জল চঞ্চল, মজ্জিত পাথরে উপহত হইয়া কল কল শব্দে বহিয়া যাইতেছে।

পরমেশ হৃষ্টমনে উপবেশন করিলেন। কুলুঙ্গির মতো বসিবার স্থান, পাথরের মেঝের উপর সবুজ মখমলের মতো শ্যাওলার নরম আস্তরণ বিছানো রহিয়াছে। এখানে বসিলে পাশে বা পিছনে কিছু দেখা যায় না—কেবল পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত নদী ও বালুচর চোখের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়া থাকে। এখানে জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান বড় কম, শরীরের ভারকেন্দ্র একটু বিচলিত হইলে পঞ্চাশ হাত নীচে পড়িয়া দেহত্যাগ অবশ্যম্ভাবী তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গালাভ। মুদ্‌গল মুনি বাছিয়া বাছিয়া তপস্যা করিবার স্থানটি ভালই আবিষ্কার করিয়াছিলেন।

জলকণাস্নিগ্ধ বায়ু পরমেশের ললাট স্পর্শ করিল। সূর্য প্রতীচীর দিকে আর একটু ঢলিয়াছে; নদীর বুকে রৌদ্রের প্রতিফলন কাঁসার বর্ণ ধারণ করিয়াছে। ওপারে চরের উপরে কাশবনে কয়েকটি গরু চরিতেছে। পরমেশ মনে মনে বলিলেন,—‘আহা—মাধ্বীর্গাবো—’

এই রমণীয় নিসর্গ শোভা হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া পরমেশ সহসা চমকিয়া উঠিলেন; দেখিলেন পাশের দিকে হাত পাঁচ ছয় দূরে পাথরের চ্যাঙড়ের ওপারে একটি উট গলা বাড়াইয়া তাঁহার পানে চাহিয়া আছে। তিনি কেবল উটের মুখ হইতে গলা পর্যন্ত দেখিতে পাইলেন। উটের বোধ হয় কিছুদিন পূর্বে বসন্ত হইয়াছিল, কারণ তাহার মুখময় কালো কালো দাগ। তা ছাড়া, উট অন্তত দুই হপ্তা দাড়ি কামায় নাই, থলথলে অথচ শীর্ণ গালে রাশি রাশি কাঁচা-পাকা লোম গজাইয়াছে। রম্য পরিবেশের মাঝখানে এই বেখাপ্পা মূর্তি দেখিয়া পরমেশ স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন।

উট তখন লম্বা লম্বা হলুদবর্ণ দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘চিনতে পারলে না—আমি খোদন। তোমাকে কিন্তু দেখেই চিনেছি।’

খোদন আসিয়া পরমেশের পাশে বসিল। বোতামহীন কামিজ ও ছেঁড়া ধুতির নোংরা মলিনতা অবর্ণনীয়; শরীরটা বোধ করি ততোধিক নোংরা। একটা দূষিত গন্ধ আসিয়া পরমেশের নাকে লাগিল। এই খোদন! দেখিলেও প্রত্যয় হয় না। কিন্তু পরমেশ লক্ষ্য করিলেন, এই ব্যক্তির নাকের ডগায় পরম পরিচিত একটি জটুল রহিয়াছে। সুতরাং চেহারার যত বদলই হোক, খোদনই বটে। কিন্তু খোদন এমন হইয়া গেল কি করিয়া!

পরমেশ গলাটা একবার ঝাড়িয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘কি হয়েছে তোমার?’

প্রশ্নটা একটু নীরস শুনাইল। এতদিন পরে বাল্যবন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ, কিন্তু চেষ্টা করিয়াও তিনি কণ্ঠস্বরে সহৃদয়তা আনিতে পারিলেন না।

খোদন ধূর্ততাভরা চক্ষুতে অনেকখানি করুণ রস সঞ্চারিত করিয়া হাত কচ্‌লাইতে লাগিল। তাহার শুধু চেহারার পরিবর্তন হয় নাই, মনের পরিবর্তন হইয়াছে। সে দমকা একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘আরে ভাই, কথায় বলে দশচক্রে ভগবান ভূত। নইলে, ভাল চাকরি করছিলুম, ওপরওয়ালার সুনজরে ছিলুম, স্ত্রীপুত্র নিয়ে ঘর-সংসার করছিলুম—আমার আজ এ দশা হবে কেন?’ এই পর্যন্ত বলিয়া হঠাৎ ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, ‘টাকাটা এনেছ তো ভাই?’

পরমেশ নিঃশব্দে পকেট হইতে পঞ্চাশ টাকার নোট বাহির করিয়া দিলেন। লুব্ধ ব্যগ্রতায় নোটগুলি ছোঁ মারিয়া লইয়া খোদন সেগুলি ক্ষিপ্রহস্তে গণিয়া দেখিল, তারপর অতি যত্নে কোমরে গুঁজিয়া রাখিতে রাখিতে বলিল, ‘বাঁচালে। কিছুদিন এতেই চলবে।’ তাহার ধূর্ত চক্ষু একবার পরমেশ্বরকে তীক্ষ্ণভাবে নিরীক্ষণ করিয়া লইল; যে লোক এককথায় পঞ্চাশ টাকা বাহির করিয়া দিতে পারে, তোয়াজ করিলে তাহার নিকট হইতে আরও অনেক টাকা দোহন করা যাইতে পারে, এই কথাটাই তাহার ধূর্ত দৃষ্টির আড়াল হইতে উঁকি মারিল। সে কণ্ঠস্বরে অনেকখানি চাটুতার রস নিঙড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘মহাপ্রাণ লোক ভাই তুমি। অনেক পুণ্যে তোমার মতো বন্ধু পাওয়া যায়। ঠিক ছেলেবেলায় যেমনটি ছিলে এখনও তেমনি আছ। আর চেহারাও কি তোমার অতটুকু বদলায় নি! মনে হয় না যে বয়স হয়েছে।’

প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌছিয়া এমন কথা শুনিলে মনে আনন্দ হইবার কথা। কিন্তু পরমেশ আনন্দ অনুভব করিলেন না; বরং তাঁহার মনটা কেমন ভারী হইয়া উঠিল। পশ্চিম দিকপ্রান্তে তখন দিনান্তের হোলিখেলা আরম্ভ হইয়াছে। শরতের দিনগুলি এমনি বর্ণগরিমায় আরম্ভ হয়, আবার এমনি প্রসন্ন লীলাবিলাসে সমাপ্ত হয়; তারপর ধীরে ধীরে চাঁদ উঠিয়া আসে। দিন ও রাত্রি, সীমা ও অসীম ওতপ্রোত একাকার হইয়া যায়—মহাকালের স্তিমিত নয়ন স্বপ্নাতুর হইয়া ওঠে—

পরমেশ ঈষৎ উদাসকণ্ঠে বলিলেন, ‘তোমার এমন অবস্থা হল কি করে? কী করেছিলে?’

খোদন একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ভাই, তোমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই—আমি পুলিসের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

পরমেশের মনটা আরও ভারী হইয়া উঠিল। জীবনের অসংখ্য জটিলতা যেন আবার তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিতেছে। পুলিস! পুলিস নামক এক জাতীয় জীব যে পৃথিবীতে বাস করে একথা কিছুদিন যাবৎ তিনি ভুলিয়া ছিলেন।

‘কেন? কি হয়েছিল?’

খোদন এবার সবিস্ময়ে নিজের জীবন কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিল। এই ধরনের আত্মকথা মাঝে মাঝে পুস্তকাকারে প্রকাশ হয়; বক্তা অনুতাপচ্ছলে নিজের দুষ্কৃতির লোভনীয় ইতিহাস বর্ণনা করিয়া আনন্দ পায়। কণ্ডূয়ন প্রবৃত্তিই ওই শ্রেণীর চরিত কথার মূল উৎস।

খোদন ভাল চাকরি পাইয়াছিল, বিবাহাদি করিয়া সংসারও পাতিয়াছিল; কিন্তু জীবনের সদ্‌ব্যবহার সে করে নাই। হয়তো সংসর্গদোষেই সে বিগ্‌ড়াইয়া গিয়াছিল। ক্রমে যোষিৎ আনন্দই তাহার বাঁচিয়া থাকার প্রধান লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

পরমেশের মতো সচ্চরিত্র বন্ধুর সৎসঙ্গের অভাবেই যে তাহার এমন অবনতি ঘটিয়াছিল তাহাতে খোদনের সন্দেহ নাই। কিন্তু সকলই গ্রহের ফের, অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাইবে কে? নহিলে আজ তাহার কিসের অভাব। সে তিন শত টাকা পর্যন্ত মাহিনা পাইয়াছে, তা ছাড়া উপরিও যথেষ্ট ছিল। তবু শেষ বয়সে তাহার সর্বনাশ হইয়া গেল। দুর্দৈব আর কাহাকে বলে?

স্ত্রীজাতি অতি ভয়ঙ্কর জাতি। সারা জীবন ধরিয়া নাড়াচাড়া করিয়াও সে স্ত্রীজাতির নারকীয় চাতুরী চিনিতে পারিল না। শেষ বয়সে এক সর্বনাশী কুহকিনীর খপ্পরে পড়িল। খোদনের কোনই দোষ ছিল না, স্ত্রীলোকই তাহাকে প্রলুব্ধ করিয়া মোহের নাগপাশে বাঁধিয়া ফেলিল—

তারপর দোহন আরম্ভ হইল। টাকা চাই, সিল্কের শাড়ি চাই, জড়োয়া গহনা চাই। কী করিবে বেচারা খোদন? শেষ পর্যন্ত দায়ে পড়িয়া সে গভর্নমেন্টের টাকা চুরি করিল। চুরি অবশ্য সে করে নাই, ধার বলিয়া লইয়াছিল; কিন্তু গভর্নমেন্ট তাহা বুঝিল না, তাহার নামে ওয়ারেন্ট জারি করিল। নিরুপায় দেখিয়া খোদন ফেরার হইয়াছে।

বরবর্ণিনী দিগ্বধূর জলক্রীড়া দেখিতে দেখিতে কতকটা অন্য মনেই পরমেশ বসিয়া ছিলেন; কথাগুলা কানে যাইতেছিল। শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হইতেছিল, সূর্যে গ্রহণ লাগিয়াছে, বাতাস দুর্গন্ধ অশুচি ধুমে আবিল হইয়া উঠিয়াছে; তাঁহার অন্তর্লোকে প্রসন্নতার যে শুভ্রজ্যোতি কিছুদিন ধরিয়া নিষ্কম্প শিখায় জ্বলিতেছিল তাহা নিভিয়া গিয়াছে।

চরিতামৃত শেষ করিয়া খোদন বলিল, ‘কপালে লিখিতং ঝ্যাঁটা কোন্ শালা কিং করিষ্যতি। নইলে কত লোক কত কি করে তাদের কিছু হয় না, চোর-দায়ে ধরা পড়লুম আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়—দুত্তোর, সন্ন্যেসী হয়ে যাই; কিন্তু ভাই, সংসার ছাড়তে মন সরে না। হাজার হোক, আমি সংসারী মানুষ,; বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে কি ভাল লাগে? তার ওপর শরীরের একটি পাজি রোগ ঢুকেছে—’

পরমেশ খোদনের কৃষ্ণবিন্দু চিহ্নিত মুখের পানে চাহিলেন—‘কি রোগ?’

খোদন কহিল, ‘বললুম না ধরা পড়েছে রাধা। সবাই ফুর্তি করে, রোগ হবার বেলা আমি। চিকিচ্ছে করবারও সময় পেলুম না, পালাতে হল। এখন তুমিই ভরসা তুমিই মরণ-বাঁচন। ছেলেবেলায় তোমার পরামর্শ শুনেই চলতুম, এখন তুমিই একটা বুদ্ধি দাও ভাই, যাতে এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাই। এ কষ্ট আর সহ্য হয় না।’

পরমেশের মনের ভিতরটা অন্ধকার হইয়া গেল—গাঢ় অন্ধকার—কিছু দেখা যায় না। তারপর ধীরে ধীরে রাহুগ্রস্ত সূর্য গ্রহণমুক্ত হইয়া বাহির হইয়া আসিল। সেই নবোন্মেষিত উগ্র আলোকে পরমেশ খোদনের মুক্তি-পথ দেখিতে পাইলেন। একমাত্র মুক্তি-পথ।

তিনি খোদনের দিকে ফিরিয়া সাগ্রহে বলিলেন, ‘উদ্ধার পেতে চাও? একটা রাস্তা আছে—’

‘কী—কী রাস্তা?’

‘এই যে—’ বলিয়া পরমেশ দুই হাতে সজোরে খোদনকে ঠেলিয়া দিলেন। খোদন কিছু বুঝিতে পারিবার আগেই শূন্যে একটা ডিগ্‌বাজি খাইয়া নীচে পড়িতে লাগিল।

পঞ্চাশ হাত নীচে গঙ্গার শিলা কণ্টকিত জলে ছপাৎ করিয়া শব্দ হইল।

পরমেশ টিলা হইতে নামিয়া আসিলেন।

সূর্য অস্ত গিয়াছে। সন্ধ্যা কিরণের সুবর্ণ মদিরা ভাগীরথীর স্ফটিক পাত্রে টলমল করিতেছে। মুদিত আলোর কমল কলিকাটি কোন্‌ কনকচ্ছটা বিচ্ছুরিত নব-প্রভাতের অভিমুখে ভাসিয়া চলিয়াছে কে জানে।

খোদন বলিয়া কি কেহ ছিল? অথবা পরমেশের অবচেতনার নক্রসঙ্কুল সমুদ্র হইতে তাহার বিকলাঙ্গ বীভৎস স্মৃতি বাহির হইয়া আসিয়াছিল? ভয়ের মুখোস—? কষ্টের বিকৃত ভান—?

গঙ্গার তীরে দাঁড়াইয়া পরমেশ চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। কোথাও জনমানব নাই। তিনি তখন জামা-কাপড় খুলিয়া রাখিয়া গঙ্গার জলে অবতরণ করিলেন। শরীর শীতল হইল। আহা, মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ—

স্নান শেষ করিয়া পরমেশ আবার বস্ত্রাদি পরিধান করিলেন। দূরে গঙ্গার ওপারে চরের উপর পাখি ডাকিল—টিট্টি-টিট্টিহি—

পরম পরিতৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিয়া পরমেশ অস্ফুট কণ্ঠে বলিলেন, ‘আহা, মধু মধু—’

৩০ আষাঢ় ১৩৫৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *