নিশীথে

নিশীথে

রায় বাহাদুর দ্বিজনাথ চৌধুরীর কন্যার বিবাহ আগামী কল্য।

দ্বিজনাথ জেলার পুলিস সুপারিন্টেডেন্ট, দস্তুরমত সাহেব, ঘোরতর নীতিপরায়ণ এবং কর্তব্যপালনে সম্পূর্ণ দয়ামায়া শূন্য। অত্যন্ত রাশভারি লোক; তাঁহার সম্মুখে গুরুতর বিষয় ছাড়া অন্য কথা উত্থাপন করিতে গেলে মনে হয় ধৃষ্টতা করিতেছি। আইন বা নীতি যে-ব্যক্তি একবার রেখামাত্র ক্ষুন্ন করিয়াছে, দ্বিজনাথবাবুর গৃহে তাহার প্রবেশ নিষেধ—তা সে যত বড়ই পরমাত্মীয় হোক না কেন।

তাঁহার স্ত্রী প্রথম শ্রেণীর ট্রামের পশ্চাতে দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রামের মতো সর্বদা স্বামীর অনুগামিনী ছিলেন; স্বনির্বাচিত পথে চিন্তা করিবার শক্তি তাঁহার ফুরাইয়া গিয়াছিল। মাঝে মাঝে অতি গোপনে তাঁহার শীর্ণ গণ্ড বাহিয়া অশ্রুর ধারা নামিতে দেখা যাইত কিন্তু তাহা কেবল অন্তর্যামী দেখিতে পাইতেন।

মেয়ের বয়স আঠারো-ঊনিশ। সাহেবিয়ানার দৌলতে সে সমশ্রেণীর স্ত্রীপুরুষ সকলের সহিত মিশিতে পাইত; এমন কি স্বামী নির্বাচন ব্যাপারেও তাহার অভিরুচিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করা হয় নাই। কিন্তু দড়ি লম্বা হইলেও খোঁটা এতই শক্ত ছিল যে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাহিরে পা বাড়াইবার শক্তি তাহার ছিল না।

মেয়ের নাম রূপলেখা। সুন্দর মেয়ে, চোখের দৃষ্টি ভারি নরম, সর্বদাই চোখদুটিতে হাসির টুকরা ঝিক্‌মিক্‌ করিতেছে। আবার কদাচিৎ বেদনার মেঘে ছায়াচ্ছন্ন হইয়া আসিতেও পারে। অন্তরের গভীরতা মুখের সহজ স্মিত প্রসন্নতায় সহসা ধরা পড়ে না। রূপলেখাকে তাহার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবী সকলেই লেখা বলিয়া ডাকিত। কেবল দুই জন বলিত—রূপু। একজন তাহার মা; আর অন্য জন—

কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম প্রকাশ্যে উল্লেখযোগ্য নয়, দ্বিজনাথবাবু জানিতে পারিলে অনর্থ ঘটিবার সম্ভাবনা।

রূপলেখার বিবাহের আগের সন্ধ্যায় দ্বিজনাথবাবুর ড্রয়িংরুমে একটি মাঝারি গোছের মজলিশ বসিয়াছিল। বাহিরের লোক বড় কেহ ছিল না; দু’চার জন আত্মীয়, রূপলেখার কয়েকটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী এবং ভাবী বর|

দ্বিজনাথবাবুর কোথায় একটা সরেজমিন তজবিজে গিয়াছেন, এখনও ফেরেন নাই; বোধ করি কর্তব্য কর্মের শেষ বিন্দুটুকু অবশিষ্ট রাখিয়া ফিরিবেন না। গৃহিণী ঘরের এক কোণে একটি বৃহৎ চেয়ারে প্রায় নিমজ্জিত হইয়া বসিয়া আছেন এবং মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক চাহিয়া সময়োচিত প্রফুল্লতার সহিত হাসিবার চেষ্টা করিতেছেন। আশেপাশে বৃহদায়তন ঘরের এখানে-ওখানে অতিথিরা বসিয়া মৃদুস্বরে গল্পগুজব করিতেছেন। মাঝে মাঝে তক্‌মাধারী ভৃত্যেরা আসিয়া চা প্রভৃতি পরিবেশন করিয়া যাইতেছে। ঘরে আলোর বাহুল্য নাই, অথচ অন্ধকারও নয়; বেশ একটি মোলায়েম আবহাওয়া ঘরটিকে পরিবৃত করিয়া রাখিয়াছে।

ভাবী বরের নাম প্রমথ। সে লাজুক ও ভালমানুষ গোছের যুবক; ওকালতিতে সুবিধা করিতে না পারিয়া সুপারিশের জোরে মুন্সেব পদে উন্নীত হইয়াছে। ওকালতি করিবার জন্য যে-সব সদ্‌গুণ আবশ্যক, হাকিমীতে তাহার প্রয়োজন নাই, তাই সকলেই আশা করিতেছেন—

কিন্তু প্রমথর আদ্যোপান্ত পরিচয়ের প্রয়োজন নাই; সে ভালমানুষ ও সুশ্রী, রূপলেখা তাহাকে পছন্দ করিয়াছে এবং দ্বিজনাথবাবুরও আপত্তি হয় নাই—আমাদের পক্ষে ইহাই যথেষ্ট।

ড্রয়িংরুমের যে-দরজাটা একটা বারান্দা পার হইয়া পাশের বাগানে গিয়া পড়িয়াছে তাহারই এক পাশে একটা কৌচে বসিয়া প্রমথ একাকী চা পান করিতেছিল ও চকিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাইতেছিল। এই চকিত চাহনির কারণ, রূপলেখা এতক্ষণ এই ঘরেই ছিল কিন্তু সহসা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে। দ্বিজনাথবাবুর একটি বর্ষীয়সী আত্মীয় হঠাৎ আসিয়া প্রমথর সহিত গল্প জুড়িয়া দিয়াছিলেন; প্রমথ তাঁহাকে লইয়াই ব্যস্ত ছিল। তারপর তিনি হঠাৎ উঠিয়া গিয়া আর একজনের সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিলেন। প্রমথ তখন ঘরের চারপাশে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল রূপলেখা ঘরে নাই—অলক্ষিতে কখন ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।

অভাবনীয় ব্যাপার কিছু নয়। কিন্তু তবু প্রমথ উৎকণ্ঠিতভাবেই ইতি-উতি চাহিতেছিল। প্রেমিকের চক্ষু নাকি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয়; আজ এখানে পদার্পণ করিয়াই প্রমথ অনুভব করিয়াছিল কোথায় যেন একটু খিঁচ্‌ আছে। তাহাকে দেখিয়া রূপলেখার চোখে আলো ঝিক্‌মিক্‌ করিয়া উঠিয়াছিল বটে কিন্তু সেই আলোর পশ্চাতে অজ্ঞাত উদ্বেগের বাষ্প মেঘের আকারে পুঞ্জিত হইয়া উঠিতেছে তাহাও যেন সে কোনও অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বারা বুঝিতে পারিয়াছিল। তারপর রূপলেখা হাসিয়াছে কথা কহিয়াছে, একবার চা দিবার ছলে ক্ষণেকের জন্য তাহার পাশে বসিয়াছে—কিন্তু তবু প্রমথর মনের কাঁটা দূর হয় নাই। তারপর দ্বিজনাথবাবুর বর্ষীয়সী আত্মীয়ার নিকট মুক্তি পাইয়া যখন সে দেখিল রূপলেখা ঘরে নাই, তখন সে বাহিরে ধীরভাবে চা পান করিতে থাকিলেও মনে মনে বেশ উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল।

চায়ের বাটি শেষ করিয়া প্রমথ কি করিবে স্থির করিতে না পারিয়া অনিশ্চিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে এমন সময় দরজা দিয়া রূপলেখা প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। প্রমথ দেখিল ঘরের মৃদু আলোকেও তাহার মুখখানা ফ্যাকাসে বোধ হইতেছে, নিশ্বাস যেন একটু দ্রুত চলিতেছে; চোখে চাপা উত্তেজনা।

প্রমথ কাছে গিয়া দাঁড়াইতেই রূপলেখা চমকিয়া তাহার পানে তাকাইল, তারপর আত্মসম্বরণ করিয়া একটু ফিকা রকমের হাসিল।

প্রমথ বলিল, ‘তোমাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে—। বাগানে গিছলে বুঝি?’

‘হাঁ—ঘরে গরম হচ্ছিল—তাই—একটু বাগানে গিয়েছিলুম—’ রূপলেখার নিশ্বাসের দ্রুততা তখনও শান্ত হয় নাই।

প্রমথ গলা খাটো করিয়া সাগ্রহে বলিল, ‘চল না—তাহলে বাগানেই খানিক বসা যাক—’

‘বাগানে? না না—এখন থাক, এখন আর আমার গরম বোধ হচ্ছে না—’

গরম বোধ হইবার কথা নয়, কারণ সময়টা মাঘ মাস। এবং বাগানের অন্ধকারে বৃদ্ধ আর্দালি চৈত সিং চুপি চুপি কাগজের যে টুকরাটা তাহার হাতে গুঁজিয়া দিয়া প্রস্থান করিয়াছিল, তাহাতে উত্তাপের সংস্পর্শ কতখানি ছিল অন্তর্যামীই জানেন; কিন্তু বুকের অত্যন্ত নিকটে লুক্কায়িত থাকিয়া কাগজের টুকরাটা রূপলেখার বুকে দুরু দুরু কম্পনই জাগাইয়া দিয়াছিল।

বুকের উপর একবার হাত রাখিয়া সে ভীতভাবে হাত সরাইয়া লইল।

‘আমি—আমি এখুনি আসছি—’

প্রমথ দাঁড়াইয়া রহিল; রূপলেখা সহজতার একটা বাঁধা হাসি মুখে লইয়া সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া ঘরের অন্য একটা দরজা দিয়া অন্দরের দিকে প্রস্থান করিল।

কিন্তু সহজতার অভিনয় করিলেও কৌতুহলীর দৃষ্টি এড়ানো সহজ নয়। ঘরের মধ্যেই কেহ কেহ রূপলেখার মানসিক অ-সহজতার আভাস পাইয়াছিল, এবং নিম্ন কণ্ঠে কিছু জল্পনাও চলিতেছিল।

ঘরের নির্জন কোণে এক মিথুন বসিয়া বিশ্রম্ভালাপ করিতেছিলেন। মহিলাটি দৃষ্টি দ্বারা রূপলেখার অনুসরণ করিয়া শেষে বলিলেন, ‘আজ লেখার কী যেন হয়েছে—ছটফট করে বেড়াচ্ছে।’

পুরুষটির অধর কোণে একটু হাসি খেলিয়া গেল, তিনি মহিলাটির প্রতি একটি অর্ধ-নিমীলিত কটাক্ষ করিয়া বলিলেন, ‘ও কিছু নয়। বিয়ের আগের রাত্রে মেয়েদের অমন হয়ে থাকে!’

মহিলাটি একটু মাথা নাড়িলেন।

‘না, ও সে জিনিস নয়। কিছু একটা হয়েছে।’

রূপলেখা তখন ঘরের বাহির হইয়া গিয়াছে। পুরুষটি ঘরের চারিদিকে চাহিতে চাহিতে বলিলেন, ‘আজ আত্মীয় বন্ধু সকলেই এসেছেন দেখছি—শুধু—’

‘শুধু একজন নেই।’

‘চুপ—দ্বিজনাথবাবু!’

গৃহস্বামী বাহির হইতে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তীক্ষ্ণ চক্ষে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া মাথার হেলমেট খুলিয়া ফেলিলেন। ঘর নিস্তব্ধ হইয়া রহিল; কেহ কেহ উঠিয়া দাঁড়াইল। দ্বিজনাথবাবু তুষারকঠিন কণ্ঠে বলিলেন, ‘আমার দেরি হয়ে গেল। কাজ ছিল। আসছি এখুনি—’ বলিয়া টুপি মস্তকে স্থাপন করিয়া ভিতরের দরজার দিকে অগ্রসর হইলেন।

দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়া তিনি একবার ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘রূপলেখা কোথায়?’ তারপর উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়াই প্রস্থান করিলেন।

দ্বিজনাথবাবুর স্ত্রী উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, আবার ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন। ঘরের মধ্যে বহু দীর্ঘনিশ্বাস পতনের সমবেত শব্দ হইল, যেন সকলে এতক্ষণ শ্বাসরোধ করিয়া বসিয়াছিল।

যে কন্যার বিবাহ আগামী কল্য, মধ্যরাত্রে তাহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করা রুচিবিগর্হিত কিনা এ বিষয়ে মতভেদ থাকিতে পারে; কিন্তু ঐ কন্যার মনের মধ্যে প্রবেশ করা একেবারেই ভদ্রতা বিরুদ্ধ। কথায় বলে স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং। তাহাদের মন লইয়া নাড়াচাড়া করা নিরাপদ নয়; কেঁচো খুঁড়িতে গিয়া সাপ বাহির হইয়া পড়িতে পারে। তাই আমরা ফটোগ্রাফের ক্যামেরার মতো রূপলেখার বহিরাচরণ লিপিবদ্ধ করিয়াই নিরস্ত হইব, তাহার মনের ধার ঘেঁষিয়াও যাইব না।

গভীর রাত্রি। ঘর নিস্তব্ধ। শিঙার-মেজের উপর একটি মোমবাতি জ্বলিতেছে। বাহিরের দিকের জানালা ঈষৎ খোলা, কন্‌কনে বাতাস নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া বাতির শিখাটাকে মাঝে মাঝে কাঁপাইয়া দিতেছিল।

সন্ধ্যাবেলার পোশাকী সাজ ছাড়িয়া রূপলেখা মামুলি শাড়ি শেমিজের উপর একটা র‍্যাপার জড়াইয়া নিজের বিছানায় পা ঝুলাইয়া বসিয়াছিল। রাত্রি বারোটা অনেকক্ষণ বাজিয়া গিয়াছে; পাশের ঘরে দ্বিজনাথবাবু ও তাঁহার স্ত্রীর কথাবার্তার শব্দ আধঘণ্টা পূর্বে থামিয়া গিয়াছে, বোধ হয় তাঁহারা ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। রূপলেখার চোখে কিন্তু ঘুম নাই; ঈষৎ-খোলা জানালাটার দিকে অপলক চক্ষে চাহিয়া সে বসিয়া আছে।

ঠং করিয়া কোথায় একটা ঘড়ি বাজিল।

রূপলেখা উঠিয়া দাঁড়াইল। মেঝেয় কার্পেট পাতা; তবু সে অতি সন্তর্পণে পা টিপিয়া টিপিয়া দরজার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। ভেজানো দরজার ওপারে বাবা মা ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন; রূপলেখা কান পাতিয়া শুনিল, ও ঘরে শব্দ মাত্র নাই। দ্বিজনাথবাবুর প্রচণ্ড দাপটে বাড়িতে কাহারও নাক ডাকিত না।

ফিরিয়া আসিয়া রূপলেখা শিঙার-মেজের সম্মুখে দাঁড়াইল। মোমবাতির পীতাভ শিখার দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বুকের ভিতর হইতে সেই কাগজের টুকরা বাহির করিল। সেটা খুলিয়া মোমবাতির আলোয় পড়িতে পড়িতে তাহার ঠোঁট দুটি কাঁপিতে লাগিল। চিঠিতে লেখা ছিল;

“এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ কি মনে হল ট্রেন থেকে নেমে পড়লুম। হঠাৎ চৈত সিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল; বুড়োর কাছে শুনলুম কাল তোমার বিয়ে!! রাত্রে শোবার ঘরের জানলা খুলে রেখো। আমি আসব। তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

চিঠিখানা পেন্সিলের আকারে পাকাইয়া রূপলেখা মোমবাতির শিখার কাছে লইয়া গেল; কিন্তু আগুনে সমর্পণ করিতে পারিল না—কি ভাবিয়া সেটাকে খুলিয়া ভাঁজ করিয়া আবার বুকের মধ্যে রাখিয়া দিল। বুকের ভিতর হইতে একটি শিহরিত নিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল।

‘রূপু!’

অতি মৃদু ডাক কানে যাইতে রূপলেখা চমকিয়া জানালার দিকে বিস্ফারিত চক্ষু ফিরাইল; তারপর ছুটিয়া গিয়া জানালার কবাট খুলিয়া ধরিল।

অবলীলাক্রমে জানালা উল্লঙঘন করিয়া যে যুবকটি ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিল তাহার বয়স বোধ করি বাইশ কি তেইশ! মাথায় রুক্ষ ঝাঁকড়া চুল, গায়ে একটা টুইলের আধ-ময়লা কামিজ; মুখে বেপরোয়া দুঃসাহসিক ধৃষ্টতার ভাব, চোখ দুটা জ্বল্‌জ্বলে এবং অত্যন্ত সতর্ক। ঘরে অবতীর্ণ হইয়াই সে জানালা বন্ধ করিয়া দিল, তারপর রূপলেখার দুই হাত নিজের দুই মুঠিতে ধরিয়া বুকের কাছে তুলিয়া লইল। ব্যগ্র আনন্দে কথা কহিতে গিয়া হঠাৎ থামিয়া শ্যেন দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাইল।

তাহার দৃষ্টি সমস্ত ঘর ঘুরিয়া যখন রূপলেখার মুখের উপর ফিরিয়া আসিল তখন রূপলেখার দুই চক্ষু ছাপাইয়া অশ্রুর ধারা নামিয়াছে; ঝাপসা অশ্রুর ভিতর দিয়া সে যুবকের মুখের পানে ক্ষুধিত চক্ষে চাহিয়া আছে।

নিঃশব্দ হাসিতে যুবকের মুখ ভরিয়া গেল। সে রূপলেখার হাত ছাড়িয়া দিয়া দু’হাতে তাহার কাঁধ ধরিয়া টানিয়া আনিল, তারপর তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘ও ঘরের খবর কি?’

রূপলেখা যুবকের বুকের কামিজের উপর গাল ঘষিয়া গালের অশ্রু মুছিয়া ফেলিল; ভগ্নস্বরে চাপা গলায় বলিল, ‘মা বাবা ঘুমিয়েছেন।’

যুবক তখন চিবুক ধরিয়া রূপলেখার মুখখানি তুলিয়া ধরিল, কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া শেষে যেন নিজমনেই বলিল, ‘রূপুরাণীর কাল বিয়ে। আশ্চর্য! আমিও ঠিক এই সময়েই এসে পড়লুম।

রুদ্ধস্বরে রূপু বলিল, ‘আমি জানতুম—আজ সকালে ঘুম ভেঙে অবধি কেবল তোমার কথা—’ তাহার গলা বুজিয়া গেল।

যুবক রূপলেখার হাত ধরিয়া খাটের দিকে লইয়া চলিল।

‘এস—বসি।’

দু’জনে পাশাপাশি পা ঝুলাইয়া বসিল। বিছানাটি নরম ও শুভ্র; পায়ের কাছে লেপ পাট করা রহিয়াছে। যুবক আড়চোখে সেই দিকে একটা লুব্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া সবলে লোভ সম্বরণ করিয়া ফিরিয়া বসিল। বলিল, ‘বেশীক্ষণ থাকতে পারব না—ক্ষণিকের অতিথি। সন্দেহ হয়, চৈত সিং ছাড়া আরও দু’একজন আমাকে চিনে ফেলেছে। আজ রাত্রেই পালাতে হবে।’

ত্রাসে রূপলেখার চক্ষু ডাগর হইয়া উঠিল, যুবকের হাত চাপিয়া ধরিয়া সে বলিল, ‘তবে? কি হবে? যদি ধরা পড়—?’

রূপলেখার ভয় দেখিয়া যুবক নিঃশব্দে হাসিতে লাগিল, শেষে বলিল, ‘যদি ধরে ফ্যালে, ঝুলিয়ে দিতে বেশী দেরি করবে না। পুলিস সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছে!’

যুবকের ঠোঁটের উপর হাত রাখিয়া রূপলেখা আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘চুপ্‌ কর, চুপ্‌ কর—বোলো না—’

‘আচ্ছা, ও কথা থাক।’

যুবক একটু চুপ করিল, ঘাড় বাঁকাইয়া একবার দরজার পানে তাকাইল, পাশের ঘরে নিদ্রিত থাকিয়াও দ্বিজনাথবাবু ইহাদের উপর অদৃশ্য প্রভাব বিস্তার করিতেছেন, তাঁহার অদূর-স্থিতি ইহারা মুহুর্তের জন্যও ভুলিতে পারিতেছে না।

যুবক রূপলেখার আর একটু কাছে ঘেঁষিয়া বসিল, বলিল, ‘ভাবী বরের নাম শুনলুম প্রমথ। পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি। লোকটি কেমন?’

রূপু ঘাড় বাঁকাইয়া মাথা হেঁট করিয়া রহিল। যুবকের ঠোঁটে একটু হাসি খেলিয়া গেল; সে আবার প্রশ্ন করিল, ‘দেখতে কেমন? শুনিই না। আমার চেয়ে দেখতে ভাল নিশ্চয়ই?’

রূপু পলকের জন্য যুবকের মুখের পানে চোখ তুলিয়া আবার চোখ নত করিয়া ফেলিল। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ক্ষীণালোক ঘরে দু’জনে পাশাপাশি শয্যার উপর বসিয়া আছে। যুবক রূপলেখার আপাদমস্তক চোখ বুলাইয়া মৃদু হাস্যে বলিল, ‘গায়ে একটু মাংস লেগেছে দেখছি।— বিয়ের জল?’

পরিহাসে কান না দিয়া রূপলেখা মর্মপীড়িত চোখ তুলিয়া বলিল, ‘কিন্তু তুমি যে—তুমি যে বড্ড রোগা হয়ে গেছ।—কেন? কেন?’

যুবক একটু হাসিল। রূপলেখা বলিতে লাগিল, ‘এই শীতে—মাগো—ঠাণ্ডা মাথা—’ বলিতে বলিতে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল।

যুবক কামিজ তুলিয়া দেখাইল ভিতরে একটা সস্তা জাপানী সোয়েটার আছে।

মাথা নাড়িয়া রূপলেখা বলিল, ‘তা হোক, ওতে কি শীত ভাঙে!’

যুবক রূপলেখার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল, ‘রূপু, বুকের রক্ত যার গরম তার জামা দরকার হয় না। কিন্তু এবার যেতে হবে। বিয়েটা দেখবার বড় সাধ হচ্ছিল, তা আর হল না।’

খামখেয়ালী হাসিয়া যুবক উঠিবার উপক্রম করিল।

রূপলেখা তাহার হাঁটুর উপর হাত রাখিয়া তাহাকে উঠিতে দিল না, মিনতির স্বরে বলিল, ‘আমার একটা কথা শুনবে?’

‘কি?’

আঙুল হইতে আঙটি খুলিতে খুলিতে রূপলেখা বলিল, ‘এটা নাও। যদি কখনো দরকার হয়—বিক্রি করলে—’

যুবকের মুখ কঠিন হইয়া উঠিল, সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘রূপু, এ বাড়ির একটা কুটো আমি ছোঁব না।’

কাঁদিতে কাঁদিতে, আঙটিটা তাহার হাতে গুঁজিয়া দিতে দিতে রূপলেখা বলিল, ‘এ বাড়ির নয়; এ আমার। উনি আমাকে দিয়েছেন—’

যুবক সচকিতে আঙটিটার দিকে চক্ষু ফিরাইয়া যেন পরম বিস্ময়ে সেটার পানে তাকাইয়া রহিল। তারপর রূপলেখার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল। নিঃশব্দ হাসি, কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয়, দুর্নিবার অট্টাহাসির দমকে সে এখনি ফাটিয়া পড়িবে।

দীর্ঘকাল পরে হাসি থামিলে যুবক সংযতভাবে বলিল, ‘আচ্ছা, নিলুম।’ বলিয়া কড়ে আঙুলে আঙটি পরিধান করিল।

ঠং করিয়া কোথায় একটা ঘড়ি বাজিল। একটা—না দেড়টা?

যুবক নিতান্ত সহজভাবে বলিল, ‘চললুম। আবার কবে কোথায় দেখা হবে জানি না। হয়তো—’ কথা শেষ না করিয়া যুবক থামিয়া গেল, তারপর একটু হাসিয়া জানালার দিকে অগ্রসর হইল।

জানালার সম্মুখে পৌঁছিয়া কবাট খুলিয়াছে, এমন সময় পিছন হইতে রূপলেখার সংহত কণ্ঠস্বর আসিল।

‘যাচ্ছ?’

যুবক আবার ফিরিয়া আসিয়া রূপলেখার সম্মুখে দাঁড়াইল, ক্ষণকালের জন্য একটা ব্যথার ভাব তাহার মুখের উপর দিয়া খেলিয়া গেল।

‘হ্যাঁ—চললুম। আড়াইটার সময় একটা ট্রেন আছে, সেইটে ধরব।’

তারপর গভীর স্নেহে তাহাকে জড়াইয়া লইয়া কপালে একটি চুম্বন করিল, অস্ফুটস্বরে বলিল, ‘সুখী হও—চিরায়ুষ্মতী হও।’

জানালা ডিঙাইয়া যুবক নিঃশব্দে বাহিরের অন্ধকারে মিশাইয়া গেল। মোমবাতিটা পুড়িয়া পুড়িয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল; খোলা জানালা পথে শীতল বাতাস প্রবেশ করিয়া তাহার শিখাটাকে কাঁপাইয়া দিতে লাগিল।

রূপলেখা বিছানার উপর শুইয়া পড়িল। রোদনের অদম্য উচ্ছ্বাস শাসন মানিতে চায় না কিন্তু জোরে কাঁদিয়া মনের ব্যাকুলতাকে মুক্ত করিয়া দিবার উপায় নাই; পাশের ঘরে দ্বিজনাথবাবু ঘুমাইতেছেন। রূপলেখা সজোরে বালিশ কামড়াইয়া ধরিয়া ভাঙা ভাঙা স্বরে বার বার বলিতে লাগিল, ‘দাদা! দাদা—!’

২ ফাল্গুন ১৩৪৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *