1 of 2

নিরুপম তীর্থ – জগদীশ গুপ্ত

নিরুপম তীর্থ – জগদীশ গুপ্ত

পায়ের চটির একটা হুটোপাটি শব্দ করিতে করিতে ত্রিলোকপতি গুরুদাসের বৈঠকখানার দরজায় পৌঁছিয়াই থমকিয়া গেল।

প্রত্যহ সন্ধ্যার পর যে উদ্দেশ্যে সে আসে, আজও সে সেই উদ্দেশ্যেই আসিয়াছে; কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হইবার আশা বৈঠকখানার দুয়ারেই অন্তর্হিত হইয়া গেল।

গুরুদাস আর সে এই সময়ে এখানে বসিয়া দাবা খেলে। গুরুদাস যথারীতি বৈঠকখানায় উপস্থিত আছে বটে, কিন্তু দেখা গেল, একটি অপরিচিত ভদ্রলোকও সেখানে বসিয়া আছেন, শুদ্ধমাত্র ভদ্রলোক যে তিনি নন, তিনি যে একজন অবস্থাপন্ন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক, তাহা তাঁহার অঙ্গ-অবয়ব চোখে পড়িতেই এক নিমেষেই স্পষ্ট বুঝা গেল। বসিয়া তিনি আছেন, কিন্তু যেমন-তেমন করিয়া বসিয়া নাই, এমন ভঙ্গিতে বসিয়া আছেন, যাহা সহজ অথচ গম্ভীর এবং শিষ্ট; পরিচ্ছদে একটা শুভ্র সমারোহ আছে। পরিচ্ছদ মূল্যবান নয়, কিন্তু শোভন। নিজেকে কি পোশাকে মানায়, বিকৃত রুচির দরুন অনেকেই তাহা বুঝিতে পারে না, কিন্তু ইনি বেশ পারিয়াছেন বলিয়া ত্রিলোকপতির মনে হইল।

ভদ্রলোকের আগমনের কারণ, অর্থাৎ অতিথিসমাগমের ব্যাপারটা যে সাধারণ নয়, তাহাও ত্রিলোকপতি বুঝিল। গুরুদাসের সেই সর্বোৎকৃষ্ট লণ্ঠনটি বৈঠকখানায় আনা হইয়াছে, যাহা আনাইতে ত্রিলোকপতি ও অন্যান্য বন্ধু রাগে চিৎকার করিয়াও পারে নাই—লণ্ঠন চুরি যাওয়ার ভয় দূর করা যায় নাই। ফরাশের সেই ধূলিপূর্ণ, পুরাতন, বিবর্ণ শতরঞ্জির উপর পরিষ্কার চাদর বিছানো হইয়াছে, গড়গড়াটা মাজা হইয়াছে; সটকাটাও নূতন; কলিকাটি সুবৃহৎ। গন্ধে বুঝা গেল যে-তামাক আজ পুড়িতেছে, তাহা নিত্যসেব্য ছ’ আনা সেরের তামাক নহে—ইঁহারই তুষ্টির জন্য এবং সম্মানার্থে আনাইয়াছে। তাহার উপর ত্রিলোকপতি লক্ষ করিল যে, গুরুদাস নিজে খালি গায়ে নাই, জামা পরিয়া নিজেরই বৈঠকখানায় আসিয়াছে। কেবল তাহাই নহে, সে বিশেষ উৎসাহিত, কৃতার্থ এবং বিনীতভাবাপন্ন হইয়া মাত্র বসিয়া নাই, যেন অনুগ্রহ পাইবার আশায় দরবারে হাজির আছে।

ঐ সব দেখিতে এবং হৃদয়ঙ্গম করিতে ত্রিলোকপতির বেশিক্ষণ লাগিল না।

গুরুদাস যখন অত্যন্ত সম্রান্তভাবে বলিল: “এসো ত্রিলোক বসো।”—তার পূর্বেই সে গুরুদাসের নিজের এবং তার বৈঠকখানার এই রূপান্তর—ভালোর দিকে পরিবর্তনটা—দেখিয়া লইয়াছে।

ফরাশে স্থান সঙ্কীর্ণ বলিয়া এবং ভদ্রলোকটিকে যথেষ্ট ব্যবধানে রাখিতে হইবে বলিয়া ত্রিলোকপতি অদূরবর্তী চেয়ারখানায় বসিল, বসিয়া সে গুরুদাসের তেঁতুলে মাজা গড়গড়ার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রইল, যেন গড়গড়ারও একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা অবশ্যই প্রাপ্য।

গুরুদাস খুব আভিজাত্যের সহিত বলিল: “ইনি রঘুনাথগঞ্জ থেকে এসেছেন, শিউলিকে দেখতে।”

রঘুনাথগঞ্জের নাম ত্রিলোকপতি শুনিয়াছে, কিন্তু শিউলি ব্যক্তিটা কে, তাহা ত্রিলোকপতি ঘুণাক্ষরেও জানে না; কিন্তু বিশিষ্ট ভদ্রলোকের সম্মুখে অজ্ঞতা প্রকাশ করা চলিবে না—বিজ্ঞভাবে বলিল: “ও।”

কিন্তু ঘটনাটা এই যে, শিউলি আর কেহই নয়, গুরুদাসেরই সহোদরা।

ত্রিলোকপতি এদেশে কর্মোপলক্ষে মাত্র কয়েক মাস পূর্বে আসিয়াছে; এখানকার কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব জন্মিলেও কাহার জ্ঞাতি-আত্মীয় কুটুম্ব-স্বজন-ভাই-ভগিনী প্রভৃতি কোথায় কে বাস করে, সে খবর সে এখনও পায় নাই।

তবে রঘুনাথগঞ্জ হইতে ইনি শিউলিকে দেখিতে আসিয়াছেন শুনিয়া হাত তুলিয়া সে ভদ্রলোকটিকে নমস্কার করিল—তিনিও প্রতিনমস্কার করিলেন কিন্তু কথা হইল না।

ত্রিলোকপতি একটু লাজুক স্বভাবের লোক। এদিকে চিন্তাশীল আর ভক্তিপরায়ণ এবং ওদিকে দাবার চালে প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন হইলেও অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে অবান্তর কথা তুলিয়া আলাপ জমাইতে সে ভাল পারে না।

রঘুনাথগঞ্জে ইলিশমাছ সস্তা কিনা, কবিরাজি ঔষধালয় প্রচুর কিনা, গঙ্গা তার কোন দিকে, এখানকার মতো সেখানেও পথে ধূলা যথেষ্ট কিনা, ডাক দু’বেলা—কি একবেলা বিলি হয়, পাকা বাড়ির সংখ্যা বেশি—কি কাঁচা বাড়ির সংখ্যা বেশি, বালাপোষের কারখানা রঘুনাথগঞ্জে আছে কিনা, গুটিপোকার আবাদ ওদিকে কোথায় কোথায় হয়, এ স্থান হইতে যাতায়াতের রেলভাড়া কত,—ইত্যাদি বিষয় সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করা যাইত, কিন্তু বিশিষ্ট ভদ্রলোকটি বাজে কাজে এখানে আসেন নাই, গুরুদাসের বাড়ির—বোধ হয় গুরুদাসের পরমাত্মীয়াই—শিউলিকে দেখিতে আসিয়াছেন এবং দায়িত্বপূর্ণ আর গুরুতর চিন্তার একটা ব্যাপার উভয়পক্ষেরই ঘটিতে যাইতেছে! দ্বিতীয়তঃ ভদ্রলোকটির চোখের দিকে তাকাইয়া মনে হয়, ইহার প্রভুত্বশক্তি অত্যন্ত প্রবল, সুতরাং বিবেচনাপূর্বক ক্ষুদ্ৰ বৃহৎ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে হইবে, ইহাই মনে করিয়া ত্রিলোকপতি একটা নমস্কারেই কর্তব্য শেষ করিয়া চুপ করিয়া রহিল…

একটা দেনাপাওনা, পছন্দ-অপছন্দের দ্বন্দ্বও ভিতরে ভিতরে পীড়িত না করুক, ভিতরে আছে—চুপ করিয়া বসিয়া ত্রিলোকপতি তাহাই অনুভব করিতে লাগিল।

আগেই অনেক কথা নিশ্চয়ই হইয়াছে—

গুরুদাস এখনও খুব উদাত্ত কণ্ঠে বলিল: “আগেও আপনাকে বলছি, আবারও বলছি, আমি দরিদ্র, কিন্তু উচ্চাভিলাষী। আপনার ছেলের সঙ্গে আমার সহোদর বিবাহ দিতে চাই, এতেই আমার উচ্চাভিলাষ যে কত, তা বুঝবেন।”

গুরুদাসের উচ্চাভিলাষের কথাটা বলিবার ভঙ্গির দরুন, কতকটা দম্ভের মতো শুনাইল এবং ত্রিলোকপতি বুঝিয়া লইল যে, গুরুদাস ইঁহার কাছেও নির্বিবাদে খাটো হইতে চায় না।

ভদ্রলোকটি মৃদু একটা হাস্য করিলেন—

ত্রিলোকপতির মনে হইল, ইনি চট করিয়াই হাসেন না; হাসির ভাণ্ডার হইতে হাসি যেন চুয়াইয়া বাহির হয়, এমনি ধীরে ধীরে হাসেন।…বলিলেন, “বেশ, ছেলেটাকে এখনো তো দেখেন নি।”

শুনিয়া গুরুদাস খুব মুরুব্বিয়ানার সঙ্গে একটু হাসিল; বলিল: “সে আমার দেখাই। পিসিমা যা লিখেছেন, তার একটি বর্ণও যে মিথ্যা নয়, তা আমি জানি। আর একটি কথা—ছেলে যে আপনার!”— বলিয়া গুরুদাস আনন্দে গদগদ হইয়া খানিকটা গা দুলাইল…

ত্রিলোকপতির মনে হইল, মানুষকে স্তবে তুষ্ট করার কৌশল গুরুদাস বেশ জানে; এবং ঐ কথার দ্বারাই তাহা সে পরম সুষ্ঠুভাবে করিয়াছে; যেটুকু বাকি ছিল, গুরুদাস যেন তাহা শেষ করিয়া আনিয়াছে, অর্থাৎ এ-বিবাহ হইবেই। কিছু বাদ-ছাদ দিতে চাহিলেও রঘুনাথগঞ্জের ইনি আশ্কারা না দিয়া পারিবেন না।

“তামাক খান।”—বলিয়া সেই ভদ্রলোকটি অচঞ্চলভাবে গড়গড়ার নল নামাইয়া রাখিতেই গুরুদাস হঠাৎ যত লজ্জিত, তত বিহ্বল হইয়া গেল; গড়গড়ার উপর হইতে সন্তর্পণে কলিকাটি তুলিয়া লইয়া এবং তাড়াতাড়ি নিজের হুকোটি ঘরের কোণ হইতে সংগ্রহ করিয়া ঘরের বাহিরে অর্থাৎ বারান্দায় গেল…

সহোদরার শ্বশুর যিনি হইবেন, তিনি এখন হইতেই গুরুজন বই কি!

বারকতক হুঁকা টানিয়া গুরুদাস ডাকিল: “ত্রিলোক, শোনো।”

ত্রিলোক শুনিতে গেল।

কিন্তু অবনতমস্তকে লোহার চেয়ারে বসিয়া তাহার মনে হইতেছিল, বিবাহ-ব্যাপারে, সুকোমল, শুভদ আর সুখদ বিবাহ-ব্যাপারে, দেনাপাওনার কথাগুলি বড় কর্কশ—অসুন্দর লাগে; নানাপ্রকারের দেনাপাওনার উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া খুঁটিয়া খুঁটিয়া তাহা আদায় করা, আর তার পৌনঃপুনিক প্রতিবাদ— মানুষের ভালো লাগার কথা নয়। সানন্দে নয়, ও স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হইয়া, টানাটানিতে অবসন্ন বোধ করিতে করিতে, দুঃসাধ্য বিবাহ-ব্যাপার চুকাইতেই হইবে—ইহাতে মনটা বড় ধিক ধিক করে। যাহার নাম বিবাহ, অর্থাৎ দীর্ঘজীবী একটা মিলন, তাহারই সূত্রপাতে এই বাজার-দর-কষাকষি কেমন যেন কটু লাগে; মনে হয়, বিবাহের সম্ভ্রমহানি ঘটিতেছে, তার মাধুর্যের চমৎকারিত্ব নষ্ট হইতেছে।

গুরুদাস চুপি চুপি বলিল: “পঁচিশ ভরি সোনা চায়; দু’ভরি কমিয়ে তেইশ ভরিতে রাজি করেছি— অনেক কেঁদে কেটে। হাজার এক নগদ, তার উপর খাট-বিছানা, ঘড়ি, বাসন ইত্যাদি। প্রায় আড়াই হাজার কেবল দিতে হবে।”

শুনিয়া ত্রিলোকপতি যেন আর্তনাদ করিয়া উঠিল: “বাবা!”…তারপর বলিল: “তোমার সহোদরা আছে—তা তো জানতাম না। তা আবার বিয়ের উপযুক্ত! বয়স হল কতো ওর?”

“পনেরো চলছে নির্বিবাদে। তুমি ভেবেছ বুঝি যে, তাড়াতাড়ি গৌরীদান করছি! তা নয়। তবে ছেলেটি ভালো, এম এ পড়ে; দেখতে শুনতে চমৎকার—লম্বা-চওড়া, সুপুরুষ—পয়সাওলা। এটাকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইনে।”—বলিয়া গুরুদাস হুঁকা লইয়া উঠিল।

ত্রিলোক বলিল: “আমি যাই।”

“আচ্ছা এসো! কাল এসো কিন্তু। আজ আর খেলাটা হল না। ফলাফল কাল শুনো।”

ত্রিলোকপতি রাস্তার জ্যোৎস্নায় নামিয়া তার মেসের দিকে চলিতে লাগিল; কিন্তু তৎপূর্বেই একটা কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে; ফুলের কোরকের অভ্যন্তরে যেমন পরাগ থাকে, তেমনি একটি সূক্ষ্ম সুকোমল বস্তুকে চারিদিক হইতে বেষ্টন করিয়া তার হৃদয় যেন মুদিত হইয়া গেছে…

পথে চলিতে চলিতে ত্রিলোকপতির সেই কোরকসদৃশ, পেলব অন্তরের অভ্যন্তর হইতে বিভিন্ন রসস্রোত নির্গত হইতে লাগিল, অর্থাৎ সে ভাবিতে লাগিল সর্বস্ব নগদ দিয়া কে নিঃস্ব হইতে যাইতেছে—সে কথা নয়, গুরুদাসের সহোদরা শিউলির বিবাহের কথা…

শুধু শিউলির বিবাহের কথাই নয়, পুরুষ ও নারীর বৈবাহিক সম্বন্ধের কথাও। পুরুষ আসিয়া মেয়েটিকে বিবাহ করিয়া লইয়া যাইবে। নির্বোধ ব্যক্তির হঠাৎ মনে হইতে পারে, মেয়েটির বিবাহের বয়স হইয়াছে, অতএব মন্ত্রশক্তির দ্বারা জীবনে জীবনে একটা অকাট্য গ্রন্থি দিবার অভিনয় করিয়া পুরুষটি মেয়েটিকে লইয়া যাইবে সন্তানার্থে, নিতান্তই একটা স্থূল ব্যাপার, যাহার নাম হইবে স্বামী-সেবা এবং গৃহস্থালী। অনেকেরই ধারণা, এই নিয়মেই অর্থাৎ ধাপ্পাবাজির উপরেই জগৎ চলিতেছে। ত্রিলোকপতি চাঁদের দিকে চাহিয়া একটু হাসিল।

কি আশ্চর্য, আজও কাহারও কাহারও এই কুসংস্কার আছে যে, বিবাহ আর কিছুই নয়, উভয় পক্ষেরই অর্থাৎ নারী ও পুরুষের জীবনযাপন-বিষয়ক একটি সুবিধাজনক চুক্তিমাত্র—অন্য অর্থ টানিয়া আনিয়া যদি কেহ ভাবোন্মত্ত হন, তবে তিনি তা’ হইতে পারেন, কিন্তু ব্যাপার ঐ। পুরুষের আধিপত্য স্বীকার করিয়া লইয়া স্ত্রী থাকিবেন পোষা এবং উপযুক্ত ব্যবহার আর অন্নবস্ত্র না পাইলে স্ত্রী করিবেন গোঁসা। আবার কি চাই?

গোঁসা করিবার অনুমতি স্ত্রীকে দেওয়া আছে।

ত্রিলোকপতি আবার একটু হাসিল।

ঐ ধৃষ্ট লোকগুলির প্রজ্ঞার ঐখানেই শেষ—তার বেশি অগ্রসর হইতে তারা শেখে নাই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দেখা যায়, অনেকেই আছে ভালো, পরস্পরে মিলও আছে—স্বামীর প্রতি স্ত্রী এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামী অনুকম্পাসম্পন্ন।

তারপর ত্রিলোকপতির মনে হইল, বিবাহের এটা নিতান্তই ঘরোয়া, অপরিণত আর রূঢ় দিক—স্থূল উদ্দেশ্যকে সার্থক করা মাত্র; কিন্তু বিবাহের গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে তাহার দিকে দৃষ্টি অধিকাংশেরই নাই, তবু তা আছে।—স্ত্রীকে সহধর্মিণী বলা হয়—মিথ্যা বলা হয় না; স্বামী পতি ইহাও মিথ্যা নয়; বিবাহকে দৈহিক সুখের আর স্বপ্ন সুখের দ্বারোদ্ঘাটনের মতো ব্যবহার করার মনোবৃত্তিই বেশির ভাগ লোকের, ইহাও সত্য। কিন্তু ইহা একেবারেই ভুল— মানুষ ভারী ভুল করে, শোচনীয়ভাবে ঐখানটায় ভুল করিয়া সে বসিয়া আছে। বিবাহ ঐহিকও নয়, দৈহিকও নয়,—বিবাহ পারত্রিক এবং আত্মিক। ইহা যে মানিতে না চায়, সে উৎসন্নে গিয়াছে।

বিবাহের পরই নবদম্পতির চেহারার জৌলুস খুলিয়া যায় ইহা সবাই জানে। লোকে বলে বিয়ের জলের গুণ। কিন্তু তা নয়। সত্তার গভীরতম আনন্দানুভূতির সঙ্গে তাহারা যে জগতে চক্ষুরুন্মীলন করে, সেখানে আত্মাই কর্তা—দেহ নয়; প্রকৃতি সুপ্তির শেষে সবগুলি দল উন্মোচিত করিয়া পূর্ণতম আনন্দে বিকশিত হইয়া উঠে—ঐ শ্রী তাহারই। উভয়ের গভীর অন্তরগত মিলন যেমন কামনাকে অভূতপূর্ব, অনির্বচনীয় করিয়া তোলে, তেমনি দেহকে করে সুন্দর, মনকে করে পবিত্র, আত্মাকে করে অন্তর্মুখী। কাজেই দু’জনারই চেহারা হয় এমন নবীন, যেন এক রাজ্য ছাড়িয়া অন্য রাজ্যে তাহারা নূতন করিয়া জন্ম নেয়। কেবল একটা লৌকিক স্থূল অনুষ্ঠানের পুনরাবর্তন ঘটে, অন্তরগত কোনো নবতর পরিবর্তন ঘটে না বলিয়াই দ্বিতীয় বার বিবাহের সম্মান নাই—শাস্ত্রেই তার মর্যাদা খুবই কম।

সংসারের যাবতীয় বিবাহিত ব্যক্তিকে এবং অন্যান্য অবুঝ লোকগুলিকে পরিত্যাগ করিয়া ত্রিলোকপতি অতঃপর গুরুদাসের সহোদরার কথা, তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিতে লাগিল…

এ বিবাহ নিশ্চয় হইবে এবং ইহাদের বনিবনাও নিশ্চয়ই হইবে; সবারই হাতে কুমারীর হৃদয়-অমরাবতীর দ্বার খুলিবার চাবি নাই, তবু মেয়েটি সুখী হইবে; সবারই নিশ্বাসে মুকুল চোখ মেলে না, তবু মেয়েটি সুখী নিশ্চয়ই হইবে।

বন্ধু গুরুদাসের সহোদরা বলিয়া ত্রিলোকপতি যে শিউলির সুখাশঙ্কা করিতেছে—এমন নয়, সুখ তাহার পক্ষে স্বাভাবিক এবং অনিবার্য বলিয়াই ত্রিলোকপতির মনে হইতেছে।

শুনা যায়, পুরুষ নারীর প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন, নারীকে সে অবজ্ঞা করে; বর্বর যুগে পুরুষ নারীকে ভয় করিত—তার মৃদুতা, কোমলতা আর দুর্বলতাকে সে ভয়ের চক্ষে দেখিত; সেই ভয় এখন অবজ্ঞায় রূপান্তরিত হইয়াছে। পৃথিবীর অন্যায় উক্তি আর গর্হিত আচরণের দ্বারাই মৌলিক ও উন্নত হইয়া উঠিতেছে!…আশ্চর্য!…

আশ্চর্য হইয়াই ত্রিলোকপতি মেসের বাসায় পৌঁছিয়া গেল—জিজ্ঞাসা করিল: “ঠাকুর, ভাত হয়েছে?”

“একটু দেরি আছে, বাবু।”

“তা থাক, একটু জিরুই।”—বলিয়া ত্রিলোকপতি উঠানে ঠাকুরেরই খাটিয়ার উপরে বসিল…

তখন তার মনে হইল, মেয়েটি বাড়ীর ভিতরেই মানুষ হইয়াছে; আজ পর্যন্ত বাড়ীর বাহিরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে নাই—জ্ঞান অল্প হওয়া সম্ভব; কিন্তু ঠিক ঐ কারণেই অন্যদিকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেছে বোধ হয়। আজকাল বিবাহের পবিত্র বন্ধনের মর্যাদা মেয়েদের তরফ হইতেই সর্বত্র সুষ্ঠুভাবে রক্ষিত হইতেছে না—অনেকেই বন্ধন শিথিল করিয়া আনিতেছে; কেহ কেহ বন্ধন কাটিবার জন্য ছুরিও শাণাইতেছে দেখা যায়। কোনো মেয়ে হয়তো শিক্ষায়তনের উচ্চ চূড়া হইতে অবতরণ করিয়া পাঁচ-সাত বৎসর কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করিয়াছেন, নিজের রুচি-অনুযায়ী অবসর যাপন করিয়াছেন, নিজের অভীষ্ট সাধনের উপায় নিজেই করিয়াছেন, জীবনের সুখোপকরণ নিজের জন্য নিজেই সংগ্রহ করিয়াছেন, ইত্যাদি।

তাঁহাকে ধরুন, বিবাহবন্ধন স্বীকার করিতে হইল…

তারপর হঠাৎ একদিন ধরা পড়িল যে, তিনি ভুল করিয়াছেন; যাহা আশা কিংবা অনুমান করিয়াছিলেন, ইহা তাহা নহে; কর্মময় জীবনের বহির্মুখী অভিসারই ছিল ভাল—এখন যেন সবই উল্টা-পাল্টা, অস্বস্তিকর লাগিতেছে—মনের স্বাধীন স্ফুর্তি ব্যাহত হইতেছে…

অথচ স্বামীকে তিনি ভালোবাসেন এবং ইহাও জানেন যে, চক্ষুলজ্জা বলিয়া ভয়ঙ্কর একটা জিনিস আছে—লোকে মনে করিতে পারে, তাঁহাকেই লক্ষ্য করিয়া এ কথা উঠিতে পারে যে, পারিবারিক শৃঙ্খলা ও শান্তি যে নষ্ট করে, তার শিক্ষা নিস্ফল, বুদ্ধি অল্প, মন দুর্বল, নৈতিক জ্ঞান নাই…

কাজেই বিক্ষোভ একটা চলিতেই থাকে, কিন্তু ভিতরে বাহিরে তার প্রকাশ থাকে না। স্বামীকে ভালোবাসেন বলিয়াই নিজের মনের প্রকৃত অবস্থা জানাইয়া তাঁহাকে আঘাত দিতে চান না মহিলাটি— অপ্রত্যাশিত দিকে তৎপরতা দেখাইয়া বিরোধের সৃষ্টি করিতে চান না—নিঃশব্দে তিনি একটি অশান্তি ও অসন্তোষের যন্ত্রণা বহন করিতে থাকেন…

এরূপ পরিস্থিতি অত্যন্ত অবাঞ্ছনীয়।

কিন্তু ইহাদের তেমন কিছু ঘটিবে না। মাকড়সা যেমন দেহাভ্যন্তরের তন্তু বাহির করিয়া জাল প্রস্তুত করে, তেমনি ইহারা শিউলি আর তার এই ‘সুপুরুষ’ স্বামী—নিজেদের অন্তরের সূক্ষ্ম, সমুজ্জ্বল পরিবেশে শ্ৰী-অলঙ্কার-সমন্বিত করিয়া সসাগরা পৃথিবীব্যাপী একটি কাল্পনিক আবাস নির্মাণ করিবে, যাহাকে কখনো মনে হইবে কুটীর, কখনো মনে হইবে প্রাসাদ, কখনো উপবন, কখনো উদ্যান, কখনো স্বর্গ, কখনো জ্যোৎস্নাময়, কখনো সূর্যদীপ্ত এবং সর্বদাই চমকপ্রদ আর সুখদ।

ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিল: “ভাত দেব, বাবু?”

ত্রিলোকপতি বলিল: “দাও।”

আহারান্তে ত্রিলোকপতি একটি সিগারেট ধরাইল; বারান্দায় মাদুর বিছাইয়া আর বালিশ লইয়া সে শুইল…

চাঁদের আলো সমগ্র বারান্দায় পড়িয়াছে—ত্রয়োদশীর চাঁদ, অত্যন্ত উজ্জ্বল।

শুইয়া শুইয়া ত্রিলোকপতির মনে হইতে লাগিল, রঘুনাথগঞ্জের ঐ বিশিষ্ট ভদ্রলোকটির পুত্রের সহিত শিউলির বিবাহ হইবেই; গুরুদাসের যেরূপ আগ্রহ দেখা গেল—তাহাতে মনে হয় ক্ষতিকে ক্ষতি মনে না করিয়া এ-বিবাহ সে দিবেই; আরো সস্তার কোথাও পাত্র পাওয়া যায় কি না, তাহা সে অনুসন্ধান করিবে না।

কিন্তু ত্রিলোকপতি শিউলিকে দেখে নাই—সে আছে বলিয়াই ত্রিলোকপতি জানিত না। বরটি তো একেবারেই অজ্ঞাত—তার নামই জানা নাই। কিন্তু তাহাতে ত্রিলোকপতির বিঘ্ন কিছুই ঘটিল না; সে অবলীলাক্রমে এখানকার শিউলির এবং রঘুনাথগঞ্জবাসী সেই যুবকটির অনুপম মৃর্তি কল্পনা করিল— পাশাপাশি স্থাপিত করিয়া নয়, পৃথক ভাবে। তার মনে হইল, গুরুদাসের সহোদরা দেখিতে ভালই— ভাল না হইয়া সে পারে না; তার চক্ষুদুটি গম্ভীর, প্রশান্ত ও স্নিগ্ধ। বর্ণ খুব গৌর নয়, কিন্তু অত্যন্ত উজ্জ্বল—এত উজ্জ্বল যে, মনে হয়, তার ত্বকের যেন চৈতন্য আছে, স্বতন্ত্র এমন একটা চেতনা, যা অপর চেতনাকে অভিভূত করে; তার কাছে যাইয়া যে দাঁড়ায়, তার মুখে চোখে চেতনাময় সেই ঔজ্জ্বল্যের সুপ্রসন্ন আভা পড়ে।…একটুখানি লম্বাটে গড়ন—পরিপূর্ণতার আর পরিমাণ-পারিপাট্যে তার দেহের অনিন্দ্য আনন্দসুষমা যেন উৎসের মতো ঝরিতেছে; গতিতে একটা মৃদু লীলা আছে…

কিন্তু সর্বাপেক্ষা সুন্দর সে তখন, যখন সে স্নানান্তে ভিজা চুল পিঠের উপর ছাড়িয়া দেয়। তখনই সে অপূর্ব-কুমারী আর স্বভাব-কুমারী—সুকুমার আর ধৌত কুমারীদেহে জলকণা আর রৌদ্রের আভা ঝলমল করিতে থাকে—চোখের পাতায় জল থাকে বলিয়া চোখ বড় করুণ দেখায়। কিন্তু কথায় তাহাকে পাওয়া ভার—ভারী কৌতুকপ্রিয়।

সর্বোপরি এমন একটা শিষ্টতা আর শালীনতা তার প্রত্যেকটি আচরণে আছে, যার জন্য তার বাড়ীর লোকের গর্বিত হওয়া উচিত।

ত্রিলোক একটু হাসিল।

“ভাত খেয়েছ?”

ত্রিলোক বলিল:“খেয়েছি।”

“আমরাও খাইগে। ঠাকুর ভাত দাও…আজ কে হারলে?”

“বাজি চটে গেছে।”

“তা, বুঝি চাল ভাবছ শুয়ে শুয়ে?”

‘হুঁ।’

বাবুরা হাত মুখ ধুইতে গেলেন…

ত্রিলোকপতি তখন ভাবিতে লাগিল, ইহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে—-অনায়াসে অবাধে ভালবাসিবে; সে ভালবাসার তুলনা নাই; সেই মুহূর্ত হইতে তাহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে—সহজাত এবং সদাজাগ্রত একটা ঐশী আকর্ষণ দুর্নিবার হইয়া তাহাদের হৃদয় দুইটিকে সংযুক্ত করিয়া দিবে। মানুষের এই ভালবাসাই সংসারকে অলৌকিক করিয়া রাখিয়াছে বলিয়া ত্রিলোকপতির মনে হইল। মানুষের জীবনে আর আছে কি! এই প্রেমই তার জীবন—জীবন বলিতে যাহা কিছু বুঝায় তাহারই সমষ্টি এই প্রেম। লোকে বলে, প্রণয়ী-প্রণয়িনীদের একজন ভালবাসে, আর একজন ভালবাসিতে দেয়। হয়তো এই সত্যই সাধারণ, কিন্তু তখনই পৃথিবীর পুনরাবর্তন অভিনব উৎসবময় আর রসাভিষিক্ত হইয়া চোখে পড়ে, যখন দুজনেই দু’জনকে ভালবাসিতে দেয়।

এইখানে ত্রিলোকপতি খচ করিয়া একটা যন্ত্রণা অনুভব করিল; যদি তা না হয়। কিন্তু না,—তাহা হইবে না,হইতে পারে না। ইহাদের ভালবাসার ইতিহাস কেবল এইটুকু যে, তাহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে।

ত্রিলোকপতি অত্যন্ত দৃঢ়তার সহিত অনুভব করিল যে, ইহাদের প্রেমে কলুষ থাকিবে না, কারণ, কলুষ অপ্রসন্ন,—আর জ্বালাময় ধ্বংস তার ভাগ্যে ঘটে—দ্বিতীয়ত কলুষের তীব্র একটা উদ্দীপনা আছে—সেই উদ্দীপনা বেদনা বহন করে আর, অবসাদ আনয়ন করে। সে দুর্ভাগ্য ইহাদের ঘটিবে না; ইহারা ভালবাসিবে আর মনে করিবে, আত্মার মণিকোঠায় বসিয়া দেবতা স্বয়ং তাহা গ্রহণ করিতেছেন। ইহারা এ-কথাটাও ভুলিবে না যে প্রেম অর্জন করা মানেই প্রেমের অনশ্বরত্ব উপলব্ধি করা।

তারপর ইহাদের কি বিরহ ঘটিবে না। নিশ্চয়ই ঘটিবে—সংসারীর পক্ষে তা অনিবার্য, বিরহ না ঘটিলে চলে না। বিরহের গভীর আর্ততা তাহাদের চোখে ফুটিবে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোকপতি স্পষ্টই অনুভব করিল, এই আর্ততার সঙ্গে সঙ্গে তাহার যে-সুখ অনুভব করিবে, তার সীমাপরিসীমা নাই— তখন একটা অনাহত মধ্যাহ্নের উদয় হইবে; তাহার আলোকে তাহারা দেখিবে, অন্তরের দিগন্ত পর্যন্ত অত্যন্ত উজ্জ্বল,—সেই উজ্জ্বলতাকে মহিমায় মণ্ডিত আর সৌন্দর্যে পুলকিত করিয়া বিরাজ করিতেছে একটিমাত্র মূর্তি। সেই মূর্তি শিউলির বেলায় হইবে সেই ছেলেটির, এবং সেই ছেলেটির বেলায় হইবে শিউলির। ইহাদের প্রেমে দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশ নাই। আত্মবিলোপের ভিতর দিয়া সার্থক সে প্রেম।

কিন্তু মানুষের প্রেমের ট্র্যাজেডি বিবহে নয়, অবসাদে আর ক্ষুদ্রতার পরিচয়ে, আর উদাসীনতায়…

ত্রিলোকপতি মনে মনে একটু বক্র হাসি হাসিল—নিজেরই উদ্দেশে…

খারাপ হালকা আয়নার ভিতর ছায়া যেমন বিকৃত, অদ্ভুত দেখায় এ-ও তেমনি অর্থাৎ তাহার নিজের মন অতিশয় ক্রুর বলিয়া প্রেমের এই অসম্ভব বিকৃতির কথা সে ভাবিতে পারিয়াছে।

সে যাহা হউক, যে স্থানে তাহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে, সে স্থান হইবে তীর্থতুল্য; সে-স্থানটি কি এবং কেমন তাহা ত্রিলোকপতি আগেই ভাবিয়া রাখিয়াছে—সে স্থানটি তাহাদের হৃদয়ের রাসমন্দির— এই স্থানের অনন্ত রূপান্তর কেবল তাহাদিগকে কেন্দ্র করিয়া আসিবে যাইবে এবং আবর্তিত হইবে। ঐ স্থানটা মানুষের চোখে পড়িবে না, কিন্তু মনে জাগিবে—নির্নিমেষ অপলক হইয়া জাগিবে; মানুষের শ্রদ্ধার প্রণিপাতের স্পর্শে তাহাদের প্রেমের ঐতিহ্যের সৃষ্টি হইয়া সে স্থান হইবে অক্ষয়, আর চিরস্মরণীয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ ইহাই।

এই তীর্থ-আবিষ্কারের পর ত্রিলোকপতি অতিশয় মুগ্ধ হইয়া শয়ন করিতে গেল।…সকালবেলা ঘুম ভাঙিয়া দেখিল, চিরআকাঙ্ক্ষিত আরাধ্য বস্তুকে লাভ করিয়া মনটা যেন গ্লানিহীন পরম তৃপ্তির মধ্যে ডুবিয়া আছে।

বিকালে গুরুদাস বলিল: “বুড়ো ভারী ঠ্যাঁটা হে! কিছুতেই বাগ মানতে চায় না—কিছুতেই কমালে না ! কি করি, তাতেই রাজি হয়েছি। ৭ই বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে।”

ত্রিলোকপতি বলিল, “বাঁচলাম।”

ত্রিলোকপতির ভয় হইয়াছিল, পাছে এই সম্বন্ধ ভাঙিয়া যায়। কিন্তু গুরুদাসের মনে হইল, ত্রিলোকপতি ঠাট্টা করিল। তাহার কি দায় যে, শিউলির বিবাহের দিন স্থির হইয়া যাওয়ায় সে বাঁচিয়া গেল। সে কেমন করিয়া জানিবে যে, এই বিবাহ হইবেই মনে করিয়া ত্রিলোকপতি কত মাথা ঘামাইয়াছে, আর, হওয়াটা দেখিবার জন্য সে কত উদগ্রীব হইয়াছে।

৭ই তারিখ শীঘ্রই আসিয়া পড়িল।

ত্রিলোকপতি বাজার করিল, শামিয়ানা খাটাইল, শামিয়ানার বাঁশ ভাঙিয়া আছাড় খাইল, এবং আরও কত কি কাণ্ড করিল তাহার হিসাব নাই। বরাত্রিগণ আসিবার পূর্বে যে গোলমাল, আর খাটুনি, আর ব্যতিব্যস্ততা ছিল, তাহারা আসিবার পর তাহা চতুর্গুণ বাড়িয়া গেল—সবাই পরিশ্রম করিতেছে। কিন্তু দেখা গেল, ত্রিলোকপতি করিতেছে সকলের চতুগর্গুণ। মশলা-পেষা, শিল-নোড়া ধোয়া হইতে জনৈক বরযাত্রীর জন্য সেতার-সংগ্ৰহ সেই করিল। বরযাত্রীদের জল, পান, তামাক, চা দিল; বরকে বাতাস করিল। বরের বাবা সেই বিশিষ্ট ভদ্রলোকটিকে করজোড়ে নমস্কার করিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল: “ভাল ছিলেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার খবর ভাল?”

কিন্তু জবাব দেওয়ার সময় ত্রিলোকপতি পাইল না। কে একজন চায়ে আরো খানিক চিনি চাহিলেন—ত্রিলোকপতি চিনি আনিতে দৌড়াইল।

ত্রিলোকপতি উঠান ঝাঁট দিল, পাতা করিল, জল দিল ইত্যাদি। সে না করিল কি। সে মানুষকে খাওয়াইল, সমাদর করিল, যত্ন করিল, উৎসাহিত করিল, আপ্যায়িত করিল—একটি ভৃত্য গুরুদাসের ধমক খাইয়া রাগ করিয়াছিল, ত্রিলোকপতি হাতে ধরিয়া তার রাগ ভাঙ্গাইল…

প্রীতি-উপহার-বিতরণও সে-ই করিল—

এবং সম্প্রদানের পর বরকন্যা বাসরঘরে গেলে ত্রিলোকপতি খালি একটা রসগোল্লা মুখে দিয়া মাত্র এক গ্লাস দধি পান করিল।

কৃতজ্ঞ গুরুদাস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিল: “আর কিছু খাবে না?”

“না। ক্ষিদে নাই।”

“অত খাটাখাটনি আর ঘাঁটাঘাঁটির পর খেতে রুচি নেই, কেমন?”

“তাই?”

“বর কেমন দেখলে?”

“চমৎকার, চমৎকার, চমৎকার।”—বলিয়া ত্রিলোকপতি তার তীর্থের দিকে চাহিল—তার মনে হইল, কিছুই ভুল করি নাই।

গুরুদাস বলল: “শিউলির সঙ্গে মানিয়েছে বেশ।”

“আমি তা জানতাম।”

“হিতৈষী তুমি, খুশী ত’ হবেই।”

ত্রিলোকপতি বলিল: “আসি এখন…”

“এসো। ভারী খেটেছ। আচ্ছা, এর পুরস্কার তুমি পাবে।”—বলিয়া গুরুদাস পুলকিত কণ্ঠে হাসিতে লাগিল।

ত্রিলোকপতি তার মেসের বাসার দিকে চলিতে লাগিল, কিন্তু এত ক্লান্তির পরও যেন পথ দিয়া নয়, আকাশ দিয়া—চরিতার্থ হইয়া। তার মনে হইতে লাগিল, আমিই পথ করিয়া দিলাম।

১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *