দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

নিবারণ নন্দী

নিবারণ নন্দী

নিবারণ নন্দীর পল্লিতে খুব খাতির। তিনি করিতকর্মা। জীবনটাকে একেবারে হোল্ডঅলের মতো গুছিয়ে বেঁধে-ছেঁদে পা তুলে বসে আছেন। স্টেশান এলেই নেমে যাবেন। নিবারণ নন্দী খুব একটা শিক্ষিত বা পণ্ডিত নন। শিক্ষিত কি পণ্ডিত হলে সাংঘাতিক অহংকার হত। আর অহংকারী মানুষেরা তেমন করিতকর্মা হতে পারে না কখনই। কারণ জায়গা বিশেষে প্রয়োজনে তারা নতজানু হতে পারে না। তাঁদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘আমি জীবনে কারোর কাছে কখনও মাথা নোওয়াইনি, আর নোওয়াব না।’ অহংকারী মানুষদের আর একটি কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘কারোর কাছে হাত পাতব না।’ তাঁরা জানেন না, মাথা নীচু না করতে পারলে হাত না পাততে পারলে, জীবনকে গুছিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।

নিবারণ নন্দী কোনও রকমে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। বিবাহ করলেন এক বিদ্যালয় শিক্ষিকাকে। তিনি এম. এ. বি. টি.। নিবারণ নন্দী, জানতেন সুন্দরী মহিলার চেয়ে চাকুরে মহিলারা অনেক ভালো। বউ মানেই ব্যয়। বয়েসে শুধুই অব্যয়। উ: আ: শব্দে গাঁথা সজীব এক প্রাণী। বাতের উ:, মাথাধরার আ:। চাকুরে বউ মানে আয়-ব্যয়ের সমতা। নিবারণ নন্দী আরও ঘোরেল। তিনি বিবাহ করলেন শিক্ষিকাকে। ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েকে পড়াবার জন্যে শিক্ষক-শিক্ষিকা রাখবার প্রয়োজন হবে না। শিক্ষার পেছনে বাপকে আজকাল বহুত খরচ করতে হয়। শিক্ষক মশাইদের হাই রেট। সপ্তাহে তিন দিন দেড়শো কি দুশো টাকা। তাও সব সাবজেক্টের জন্যে নয়। ছাত্রপিছু আজকাল দুই কি তিনজন শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শিক্ষা আজকাল জুড়িগাড়ি। দু-ঘোড়ার গাড়ি চেপে ছাত্র চলেছে উচ্চ শিক্ষার পথে আর এদিকে বাপের হচ্ছে নেংটি পড়ার দশা। গাল তুবড়ে, চোখ বসে, টাক পড়ে অকালে বৃদ্ধ। এদিকে ছেলে কি শিখছেন—ড্রাগ অ্যাডিকশান, সিগারেট ভাং, স্নিফিং হ্যাশ। মাইকেলের ছিল অসীম প্রতিভা। মানিয়ে যেত। প্রতিভা ছাড়াই এখন সব বোতল বাবাজি।

নিবারণ নন্দী গঞ্জিকাবিলাসী হওয়ার জন্যে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে দেননি। পশ্চাদ্দেশে ডবল তালি মারা প্যান্ট পরে ছেলে আমেরিকান কায়দায় ইয়েপ ইয়াপ না করলেও চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা-দুই ছাপ প্রয়োজন। তারপর নিচু হয়ে, গুড়িসুড়ি মেরে, ফাঁকফোকর দিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকে পড়া।

তারপর! করিতকর্মার টেকনিক। পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই। কাজের লোক হওয়ার দরকার নেই। দরকার শুধু ঝোপ বুঝে কোপ মারার। নিবারণ ঢুকেছিলেন সামান্য কেরানি হয়ে। তিন বছরেই তিনজনকে টপকে অফিসার। যে তিনজনকে তিনি একলাফে ওয়েলার ঘোড়ার মতো টপকালেন, তাঁরা সকলেই ওই অহংকারের পিণ্ড। প্রাচীনপন্থী, বোকার দল। তাঁরা মনে-মনে বললেন, সিনসিয়ারলি কাজ করলে তার রিটার্ন অবশ্যই পাওয়া যায়। আজ না হোক, কাল। সে কাল আসার আগেই, দুজন রিটায়ার করে গেলেন। সাকুল্যে আড়াইশো টাকা পেনশান। বাড়ির ভাড়াই ছ-শো টাকা। বড় ছেলে সিনসিয়ারলি লেখাপড়া করে জ্ঞানী হয়েছে। চাকরি এখনও হয়নি; কারণ চাকরিতে জ্ঞানী অচল। তাঁরা রিটায়ার করেও দাঁড়ের টিয়ার মতো সেই একই কথা বলে চলেছেন—সিনসিয়ারিটি, অন্যটি অ্যান্ড হার্ড লেবার। আজ না হোক, কাল। খুব জোরে বলেন, যাতে নিজের ভেতরটা চমকে ওঠে। কারণ নিজের বিশ্বাসে অবিশ্বাস ঢুকে পড়ছে ক্রমশ। নিবারণ নন্দী ঢুকল কেরানি হয়ে। সামান্য একটা গ্র্যাজুয়েট। তিন বছরে তিন হাজারি। নিবারণকে প্রথম যেদিন দপ্তর অধিকর্তা ঘরে ডেকে সাংঘাতিক ঝাড়লেন, সেইদিন থেকেই নিবারণের হাতে এসে গেল গড়গড়িয়ে ঠেলে ওঠার হাতিরয়ার। নিবারণ প্রতিবাদ করল না। নিবারণ ইউনিয়ান দেখাল না। নিবারণের অহংকার ফোঁস করে উঠল না। নিবারণ জানে, ব্যাপারটা হল সহ্য করার। সহ্য করতে পারলেই, সোহাগ জুটবে। আজ না হোক, কাল। শাসন করে যে-ই, সোহাগ করে সে-ই। ক্ষমতাশালী বড়-বড় লোকরা বড় অসহায়। কর্মস্থলে তার ওপরওয়ালারা দিনে বারতিনেক ঝাড়ফুঁক করে দিচ্ছেন। বাড়িতে স্ত্রী পাত্তা তো দেনই না, উলটে গরু-ছাগলের মতো ব্যবহার করেন। ছেলেরা ওল্ডফুল ভুঁড়ো শেয়াল বলে। মেয়ে ড্যাডিই বলে। পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরার পরই কানে কানে বলে, একশোটা টাকা দেবে। মাকে কিন্তু বলবে না। প্রমিস।

এই ধরনের ঝাঁঝরা, জেরবার হয়ে যাওয়া একটা মানুষের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয়। সেই রাগ মুক্ত হওয়ার বেডপ্যান যে হতে পারবে তারই উন্নতি। ডাক নিবারণকে, ঝাড় নিবারণকে, তোল নিবারণকে। নিবারণ হল মুষ্টিযোদ্ধার বালির বস্তা।

নিবারণ জমি কিনেছেন। নিবারণ ভালো বাড়ি করেছেন। সবই হয়েছে তদ্বিরে। কাজ আদায়ের সময় নিবারণ তৃণাদপি সুনীচেন। প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তখন তার সাজ-পোশাক চাল-চলন সব বদলে যায়। লটারিতে জমি পাওয়া কম কথা! বাড়ির জন্যে লোন বের করা। নিবারণ উপকার পাওয়ার ভরসা পেলে বাজার করে দেবে। মিস্ত্রী ডাকিয়ে এনে বাথরুম মেরামত করিয়ে দেবে। নার্সিং হোমে গিয়ে বউদির সেবায় শরীর ফেলে দেবে। দাদাকে অবশ্য তার জন্যে ফেভার করতে হবে।

মায়েরা এবার ছেলেদের উপদেশ দেবেন, বৎস, বিবেকানন্দ নয়, রামকৃষ্ণ নয়, বুদ্ধ-শ্রীচৈতন্য নয়, এমনকী তোর বাপও নয়। আদর্শ হল নিবারণ নন্দী। নিবারণ নন্দী ভব। চাকরি, বাড়ি, ছেলের চাকরি, বিনা পয়সায় মেয়ের বিয়ে এই হল নিবারণ নন্দী। জীবনের লক্ষ্য। পান মুখে দিয়ে মহিলা খ্যাপলা হাসি মেরে বললে, ‘এরপর যদি একটা গাড়ি হয়, ম্যাগ্গো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *