দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

নিবারণ নন্দী

পাসবই

তিনতলা, কি চার তলার ওপর দক্ষিণ খোলা একটা কুড়ি বাই ষোলো ঘর। স্ট্র-কলারের পালিশ করা মোজাইক মেঝে। দক্ষিণের জানালা ঘেঁষে বিশাল একটা খাট। সেই খাটে ধবধবে সাদা একটা চাদর টানটান করে পাতা। বিভিন্ন মাপের ধবধবে সাদা বালিশ এপাশে-ওপাশে ছড়ানো। ছড়ানো রয়েছে বিলিতি ও দিশি নানা ম্যাগাজিন। ভেতরে মালমশলা যাই থাক, ম্যাগাজিনগুলো যেন ঝকঝকে হয়। তা না হলে ওই বিছানায় মানাবে না। সাদা মার্বলটপ কর্নার টেবিলে, ফিনফিনে কাচের গেলাসে কমকম এক গেলাস কমলালেবু রঙের পানীয়। তাতে বরফ তখনও ভাসতে-ভাসতে গলছে।

ঘরের শেষ মাথায় ছোট্ট একটা লকার। ও মাথায় অ্যালুমিনিয়াম রঙের একটা কমপ্যকট স্টিরিয়ো সিসটেম। সি-শাড়ি পরা মহিলার মতো এক জোড়া স্পিকার দেওয়ালের দু-কোণে ‘গান’ ছোঁড়ার জন্যে ঝুলছে। আমি লকারের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। একটা খোপ খুলে, ছোট্ট এতটুকু পাসবই বের করব। ছোট হলেও, মস্ত বড় একটা টনিক। শহরের সেরা ব্যাঙ্কের নাম লেখা। পাসবইটা খুলে দেখব—ফিকসড ডিপোজিট, ছ-লাখ। বইটা যথাস্থানে রেখে, হালকা পায়ে এগিয়ে যাব কর্ণার টেবিলের দিকে। ঠান্ডা এক চুমুক অরেঞ্জ স্কোয়াস খেয়ে শরীরটাকে ফেলে দেব বিছানায়।

একবার এ-বালিশে মাথা। একবার ও-বালিশে মাথা। সাদা চাদরের ওপর ঝকঝকে একটা সোনার কলম। সাদা ধবধবে একটা প্যাড। কোনও পাতাতেই কিছু লেখা নেই। আমি একবার একটা বিলিতি ম্যাগাজিন হাতে তুলে নেব। দু-চার পাতা ক্যাজুয়েলি উলটে পাশে ফেলে দেব। তুলে নেব একটা দিশি। দু-চার পাতা ওলটাব। ‘ধ্যাততেরিকা’ বলে ফেলে দেব। সাহিত্য-টাহিত্য আজকাল কিস্যু হচ্ছে না। কোনও টান নাই। কোনও স্টোরি নেই। কী সব লিখছে আজকাল। প্যান-প্যানে। একটা সিনেমা পত্রিকা তুলে নেব। কিছুটা টান আছে। উত্তেজনা আছে। কে কাকে বিয়ে করছে। কার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কে বেরিয়ে এল। কার ঝোলায় কে ঢুকে বসে আছে। কার সঙ্গে কার ছাড়াছাড়ি হতে গিয়ে লাস্ট মোমেন্টে আবার জড়াজড়ি হয়ে গেল। কোনও অভিনেত্রী বলছেন, প্রয়োজনে সব জামাকাপড় খুলে ফেলতে রাজি আছি, অপ্রয়োজনে ওসব মামার বাড়ি চলবে না। কে বলছেন, রুপোলি পরদায় চামড়া ছাড়া আর কোনও আভরণ রাখার কোনও মানে হয় না। কোনও চিত্রতারকা বিলেত গিয়ে শরীরের চামড়া টানটান করে এসেছেন। তিনি এখন সত্তর থেকে নেমে এসেছেন সতেরোয়। এক অভিনেত্রী আর এক অভিনেত্রীকে মহিলা কুকুর বলেছেন। সাত কোটি টাকার ছবি ফ্লপ করায় চিত্রজগতে আতঙ্ক। ফর্মূলা পুরোনো হয়ে গেছে। নতুন ফর্মূলার সন্ধানে। সুন্দরী সুরমার যোগাসন সিরিজ।

দেখতে-দেখতে আমার চোখে ঘুম নেমে আসবে। মধুর দিবানিদ্রা। ছ-লাখ টাকার ঘুম।

পাঁচটা নাগাদ একজন এসে অতি মোলায়েম গলায় বলবে,’গাড়ি এনেছি। বেড়াতে চলুন। হজমি বেড়ান। এবার উঠুন। কলকাতার গঙ্গায় সানসেট দেখবেন, না ব্যারাকপুরের গঙ্গায়?’

‘আজ আর সানসেট নয়। বাইপাস ধরে একটা রাউন্ড মেরে আসি।’

যেতে -যেতে আমি ফুটপাতের বাসিন্দাদের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠব—কি সাব হিউমান একজিসটেনস। ফুটপাতে গোল-গোল কি শুকোতে দিয়েছে ওগুলো। রুটি! ওই রুটি খাবে! আরে না না, ইনফেকসান হয়ে যাবে। ছি ছি, স্বাধীনতার পর চল্লিশ-একচল্লিশ বছর হয়ে গেল, দেশটার এখনও কিছুই করতে পারলে না এরা! সব চোর। চোর। এই চিন্তার পর, আমার ক্ষুব্ধ মনকে একটু রিলিফ দেওয়ার জন্যে, রুপোর কৌটা খুলে দু-চার দানা সুগন্ধী তবকি মশলা আমার মুখে ফেলব। ঝুপড়ির সামনে প্রায় বিবস্ত্রা মা তার উলঙ্গ শিশুটিকে পিটিয়ে ছাতু করছে। আমি মনে-মনে বলব, এই অবস্থায় কোন সাহসে তোমরা নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনো! কেন ভিখিরি আর সমাজ-বিরোধীর সংখ্যা বাড়াচ্ছ! একটু সংযম অভ্যাস করো। মা হবে সেই দিন, যেদিন সন্তানকে, হ্যাপি ভ্যালি কি ডুন স্কুলে পাঠাবার সঙ্গতি হবে। এখন নিজেরা ভুগছ, আবার নতুন করে নতুন প্রাণ এনে কেন তাদের বিপদে ফেলা! এই সব ভেবে আমি আবার দু-চার দানা তবকি মশলা মুখে ফেলব।

ফেরার পথে সিমলার সন্দেশের দোকান থেকে, ডজনতিনেক নরমপাক কিনে নিলুম। এইমাত্র হল তো! দেখবেন মশাই, এ জিনিস আবার ঘণ্টাতিনেকের বেশি থাকে না। বাঁচতে গেলে একটা কিছু খেতে হবে তো! আমার আবার এমন পেট, লাউড কিছু সহ্য হয় না। এই একটু সন্দেশ, একটু চিকেন, দু-চামচ সরু চালের ভাত, এইভাবে কোনও রকমে জীবন ধারণ করা। আমার আদর্শ হল, প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং।

আমাকে আবার দিনকয়েকের জন্যে ফরেন যেতে হবে। ফর এ চেকআপ। জার্মানিতে চোখ দেখাব। আমেরিকায় হার্ট, ভিয়েনায় কিডনি, সুইজারল্যান্ডে লাংস। এদেশের ডাক্তারি ব্যবস্থার ওপর আমার আর ফেথ নেই। আমার সাদা বিছানার ওপর আড় হয়ে শুয়ে, আমি একটু মিহি সেতার শুনছি। মাঝে-মাঝে বাইরের দিকে তাকাচ্ছি। উঁচু বাড়ি থেকে কলকাতার স্কাইলাইন এখনও বেশ সুন্দর দেখায়। কলকাতার মাথার দিকটা মন্দ নয়। পায়ের দিকটার বারোটা বেজে গেছে। কে একজন কানে-কানে বলে গেল, ‘সাড়ে ছয়।’ সময় নয়। বর্ষার নদীতে জল বাড়ার মতো, আমার পাস বইতে এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে, পঞ্চাশ হাজার বেড়ে গেল। উ:, আর পারা যায় না। এ যেন ফাইলেরিয়া। গোদের মতো বেড়েই চলেছে। হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেল।

নারী কণ্ঠ—’ওঠো ওঠো। তক্তাপোশটাকে সরাই। তোমার বালিশে টপাটপ জল পড়ছে। ছাদের এই দিকটা যা হয় একটু ছিল, আজ দেখছি তাও গেল। কাল সকালেই একটা টারফেল্ট এনে লাগাও।’

‘পাসবইতে আর কত?’

‘একশো ছ-টাকা।’

‘বলো কি? সেঞ্চুরি করে আরও ছ-রান।’ ঘরের বিভিন্ন প্রান্তে নানা মাপের বাটি, বালতি। ছাদ থেকে জল পড়ে জলতরঙ্গ। তবলা নিয়ে বাজাতে বসে গেলুম। বড় ওস্তাদের সঙ্গে আজ সারা রাত —সওয়াল জবাব। রাগ, কিরমানি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *