নিজস্ব লড়াই
বৃহৎ প্রয়োজনে একটি সামান্য মেয়েকে ভুলতে পারছে এই সুখ এবং তিন-তিনটি বছর প্রেম কোরেও একটি মেয়ের জীবনে সে তার আদর্শের ছায়া পর্যন্ত ফেলতে পারলো না— এই দুঃখ নিরবে হজম কোরে মফিজকে গ্রামে চ’লে আসতে হলো।
মফিজ গ্রামে এসেছে দুই মাস। এইভাবে হুট কোরে গ্রামে চ’লে আসার কথা সে আগে ভাবেনি। একেবারেই যে অনিচ্ছায় এসেছে তাও না। পার্টির সিদ্ধান্ত গ্রাম পর্যায়ে সংগঠন সম্প্রসারিত করতে হবে। নগরের নষ্ট লোকজন দিয়ে বিপ্লব হবে না। মেহনতি মানুষের মাঝে কাজ করতে হবে। তারাই বিপ্লবের সাচ্চা বাহিনী। কাজেই পার্টির কর্মীদের যার যার নিজের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে। এরকম একটি ইচ্ছা মফিজও অনেকদিন থেকে ভেতরে ভেতরে লালন করছিলো। সমকালের রাজনীতি নিয়ে সে ভেবেছে অনেক। ছুটির দিনের দুপুর বা রাজনীতির কর্মহীন রাতে হলের দেয়ালে পা ঠেকিয়ে সে ভেবেছে। ছয়তলা হলের আলো বাতাসে ভরা ঘরে থেকে সাবসিডি দেয়া ডাইনিং-এর খাওয়া খেয়ে বিপ্লবের সৈনিক হওয়া কি সম্ভব? সকাল থেকে মধুর ক্যান্টিনে একের পর এক চা পান, বাতাসে নিকোটিনের ধোঁয়া বিতরন, আর সামন্ত না বিকাশমান পুঁজিবাদ এই নিয়ে তর্ক কোরেই তো সময় কাটছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন আর বন্ধের আগের দিন ছাত্র জমায়েত ও মিছিল করা। মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ দিবস। পত্রিকায় বিবৃতি দান, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আর নবীন বরনের মাধ্যমে সমাজ-বিপ্লব করা যাবে বোলে মফিজের মনে হয়নি। মনে মনে খুঁত খুঁত করেছে সে। কয়েকদিন বোলেও ফেলেছে মাঝারি নেতাদের কাউকে কাউকে। কেউ কেউ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। অনেকে বোঝেইনি।
পার্টির এই সিদ্ধান্তে মনে মনে খুশি হয়েছে মফিজ। নিজের দূরদৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে আস্থা বোধ করেছে। দুই একজন বন্ধুকে একটু ঘুরিয়ে, একটু উদাসিনভাবে এ-কথা সে বলেছেও। এ মুহূর্তে দলের নেতৃত্ব তার হাতে থাকলে কী কী বিরাট কাজ সম্পন্ন কোরে ফেলতো তাও সে মনে মনে ভেবে ফেলেছে। নাহ্ এই সুবিধাবাদী নেতৃত্ব দিয়ে কিছুই হবে না।
খুব শীগগীর না হলেও অদূর ভবিষ্যতে একদিন এ-জাতির দায়িত্ব তার কাঁধে আসছে একরম একটি আবছা স্বপ্নে সে হঠাৎ কোরে একটু গম্ভীর হয়ে যায়। চলাফেরা এবং কথাবার্তার মধ্যে যথাক্রমে ভারিক্কি ভাব ও পিঠ চাপড়ানো আন্তরিকতা নিয়ে আসে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দু-একজন তার এই হঠাৎ পরিবর্তনের ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে না পেরে ধ’রে নেয় সুলতানার সাথে হয়তো তার কোনো মান অভিমানের মহড়া চলছে।
কিন্তু তাকে নিয়ে গবেষনা করার জন্যে তার শুভাকাংখী বন্ধুদের সে যথেষ্ট সময় দিতে পারলো না। আপাতত জাতির দায়িত্বের পরিবর্তে পার্টির একটি কাজের দায়িত্ব নিয়েই তাকে গ্রামে চলে আসতে হয়েছে। এজন্যে সে ভালোই বোধ করছিলো। খারাপ লাগাটুকু ছিলো অন্য জায়গায়।
সুলতানার মোটেই পছন্দ নয় সে রাজনীতি করে। মফিজ তাকে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে, রাজনীতি বাদ দিয়ে পৃথিবীতে কিছুই হয় না। আমরা যা কিছুই করি না কেন সবই রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে। এই যে তোমার সাথে প্রেম করছি এ-ও তো রাজনীতির কারনে।
সুলতানা চটে গিয়ে গোপন শারীরিক সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত কোরে বলে— বলো ওটাতেও রাজনীতি আছে। মফিজ একটু থতমত খেয়ে যায়। চুপ কোরে থাকে। দূরে রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়ার শোভা দেখার ভান কোরে আরো জোরালো যুক্তি খুঁজতে চেষ্টা করে। বোঝে, আসলে সে নিজেও এ-ব্যাপারটি ভালো মতো হজম করতে পারেনি। তা-না হলে সে বোঝাতে পারে না কেন! কুদরত ভাই-এর সাথে বিষয়টি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলাপ করতে হবে একদিন। এই রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সে সুলতানার দিকে মুখ ফেরায়। একটু নরম এবং বুদ্ধিমান কণ্ঠে বলে— সুলতা, আমরা যদি রাজনীতি না করি তবে কারা এই জঘন্য সমাজটাকে পাল্টাবে?
সুলতানা বরং রুক্ষ স্বরেই বোলে ওঠে— আগে নিজে স্ট্যাবলিস্টড হও, তারপর ওসব করো। ভার্সিটি শেষ হতে আর মাত্র এক বছর বাকি। এখন থেকে শুরু না করলে হঠাৎ কোরে কিছুই করতে পারবে না। আর আব্বা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে প’ড়ে লেগেছে। অনেক বোলে ক’য়ে এক বছরের জন্যে রাজি করিয়েছি। একজন বেকার ছেলের সাথে কে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়, বলো? আগে নিজে স্ট্যাবলিস্টড হও, তখন দেখো সবাই তোমার কথা শুনছে। নিজেই তখন একটা রাজনীতির দল করতে পারবে।
সুলতানার অজ্ঞতার কথা ভেবে মফিজ মনে মনে ব্যথিত হয়। এই মেয়েটির সাথে তার সারা জীবন কাটাতে হবে, ভাবতেই কেন্নোর মতো কুঁকড়ে যায় সে। ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে পড়ে। ভাবে, এ মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কোনো মানেই হয় না। হোক সুন্দরী, হোক ওর বাবা বিত্তবান, বনেদি। ও আমাকে নষ্ট কোরে ফেলবে। বড়ো কিছুর জন্যে ত্যাগ চাই। সামান্য একটি মেয়েকে আমি ভুলতে পারবো না?
.
মফিজোদ্দি, কাজডা কলাম ভালো কত্তিছো না। গিরামের ছ্যামড়াগুলোরে যে আমার বিরুদ্ধে লাগাইছো, এ্যাহন আমি যদি ওগের কাছ থে আমার জমি জোমা ছাড়ায়ে নি, সব তো না খাইয়ে মরবে। খাতি দিবা তুমি? দ্যাহো বাপু, তোমার বাপ ছেলো আমাগে পোরজা। এই সেদিনেও তো আমার কাছ থে টাহা নিয়ে তোমার পড়ার খরচ চালাইছে। নয়া নয়া পয়সা হইছে, আন্দাজ পাচ্ছ না কিছু? লেহাপড়া কত্তিছো তাই করো। লোকে ভালো কবে। বুজিছো?
খুব ঠান্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে একটানা কথাগুলো বোলে যায় মোখলেস চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো, এবারের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছে। নামে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি তার। এলাকার চাষীদের তার জমির উপর নির্ভর না করলে চলে না। এ কথা বোঝে বোলেই সচরাচর কেউই তাকে বড় একটা ঘাটাতে যায় না। ন্যায় অন্যায় যাই বলুক সবাই মুখ বুজে সহ্য করে। শান্তি কমিটিতে থেকেও স্বাধীনতার পর বিশেষ কোনো ক্ষতিটতি হয়নি, মোটা অংকের নগদ সেলামি ছাড়া। তাছাড়া আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে দু’একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, তারাই সামাল দিয়েছে। তা জীবনে মানুষের সব দিন তো আর সমান যায় না।
মফিজ এতোক্ষন চুপ কোরে ছিলো। এবার মুখ খোলে— আমরা একটা অন্যায়কে তো আর মেনে নিতে পারি না। আপনার যা ইচ্ছা তাই করবেন, আর আমরা সব মুখ বুজে সহ্য করবো নাকি?
দ্যাহো বাপু, তোমাগে ওসব ভদ্রলোকি কতা আমি বুঝি না। তুমি ছেলে মানুষ, যা করো হিসেব কইরে কইরো।
মফিজ বলার যুৎসই তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে দর্পের সাথে উচ্চারন করে— দ্যাখা যাবে। যেতে যেতে মোখলেস চেয়ারম্যান একবার ফিরে তাকায়। কথাটা তার কানে গিয়েছে।
গ্রামের হাটখোলার চায়ের দোকানের সামনে তাদের বচসা হলো। সূর্য তখন পাটে নেমে গেছে। হাটবার না হলেও বেশ লোকজন আছে হাটে। মুহূর্তে যেন এই বচসার খবর ছড়িয়ে পড়লো প্রথমে হাটখোলায়, সন্ধা না ঘুরতেই সারা গ্রামে। অল্প বয়সীরা মফিজের সাহসে পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো, বয়স্করা এমন হঠকারী কাজের রীতিমত নিন্দা কোরে তারপর বাড়ির দিকে ছোট ছোট দল বেঁধে ফিরতে লাগলো। সন্ধায় রাতের খাবার খেয়ে না ঘুমানো পর্যন্ত তাদের এই আলাপে বিরতি থামলো না।
হাটখোলার অন্যান্যদের সামনে তখন বেশ দাপটের সাথে কথাটা উচ্চারন করলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে মফিজ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
মাত্র দু’মাসের মধ্যেই সে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পেরেছে এলাকার তরুনদের উপর। কিছু কিছু বয়স্ক লোকও তার কথাবার্তা শুনতে যায়। সন্ধার পর প্রায়ই সে চাষীদের সঙ্গে বসে। কারো দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে নয়তো কারো বাইরের ঘরে। মফিজ বোঝাতে চেষ্টা করে বিপ্লব জিনিশটা কী রকম। কে শোষক। কীভাবে শোষন করছে। কীভাবে তাকে উৎখাত করতে হবে। চাষীরা তাকে ঘিরে অনেক রাত পর্যন্ত বোসে থাকে। ওদের গা থেকে, কাপড় থেকে বিটকেলে গন্ধ বেরোয়। পচা কাদায় খাওয়া পায়ের ঘা খুঁটতে খুঁটতে ওরা কথা শোনে। কী বোঝে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে বিদঘুটে প্রশ্ন কোরে বসে কেউ— তুমি আল্লাহ মানো?
মফিজ সরাসরি না করে। বোঝা যায় ওরা খুশি হয়নি কেউ। একজন খানিক অভিযোগের সুরে বলে— তোমার বাপ জীবনে নামাজ কাজা করি নেই। বুড়ো হয়ে বিছেনে পোড়ে গেইছে, চোহি দ্যাহে না, তবু, দেহিছো নামাজ কাজা হবার কায়দা নেই। আর তারি ছোয়াল তুমি আল্লা মানো না!
যে কথাটি বল্লো তার নাম রুহুল। গ্রামের সবাই তাকে চোর বোলেই জানে। কিছুদিন আগে জেলও খেটেছে তিন মাস। তারই দুই বউ। ছোটটির বয়স পনেরোর বেশি হয়নি।
যে লোকটি প্রথমে প্রশ্ন করেছিলো সে উদাসিনভাবে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে— হাতের পাঁচটা আঙ্গুল কি সোমান অয়? আল্লার ছিষ্টি। সবাইরে সোমান কোরে বানাই নেই। কারো বড়ো লোক করিছে আর কারো করিছে গরীব তোমরা তা কীয়েরে সোমান বানাবা? বিপ্লব কোরে কি আর আল্লার বিধান পাল্টানো যায়!
মফিজ নানা রকম যুক্তি তর্ক দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে। ধনী দরিদ্রের ব্যাপারটি আল্লার তৈরি নয়। এটা মানুষের বানানো। সে চীন দেশের কথা বলে, রাশিয়ার কথা বলে। বোঝায় কীভাবে সেখানে বিপ্লব কোরে সমাজে সমতা এসেছে। চাষীদের কেউ কেউ ঘাড় চুলকোয়, কেউ হাই তোলে। বোঝা যায় চীন কিংবা রাশিয়া, সেখানের বিপ্লব— এসব তারা চিন্তায় আনতে পারে না। ওদের মুখগুলো বোকা বোকা দেখায়। অহেতুক চিন্তিত হবার ভান করে। কেউ কেউ কালকে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে টাকা না পেলে উপোস দিতে হবে এ কথাও ভাবে। বিপ্লব ভবিষ্যতে কখনো একটি স্মরনীয় ঘটনা হতে পারে এই রকম এক অস্পষ্ট স্বপ্নে চাষীরা উপস্থিত ক্ষুধা ও পুরোনো জালেই জড়িয়ে থাকে।
.
রাত বাড়ছে। অথচ ঘুম আসছে না মফিজের। গত দুমাসের নানা রকম ঘটনার কথা মনে আসছে। আজ বিকেলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার বচসার কথাও মনে পড়ে। টের পায় মুখোমুখি হবার দিন খুব বেশি দূরে নয়। চেয়ারম্যান যখন চটেছে কিছু না কিছু বিপদ ঘটবেই। একবার ভাবে, এতো তাড়াতাড়ি মুখোমুখি হওয়াটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখনো মজবুতভাবে দাঁড়াতে পারেনি তার সংগঠন। মুখের ওপর ওভাবে বলাটা উচিত হয়নি। কিন্তু ওখানে ওইভাবে কথাটা না বল্লে কি চলতো? যাদেরকে আমি সব সময় বোঝাচ্ছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, মুখোমুখি হতে হবে— চুপ কোরে থাকলে কিংবা নরম সুরে কথা বল্লে পরে কি ওরা আমায় খোঁচা দিতো না?
বারান্দায় বাবার কাশির আওয়াজ হয়। উত্তরের পোতায় এই নতুন টিনের ঘর ওঠার পর থেকে বাবা বারান্দায় শোয়। ঘন ঘন পেছাপ করার জন্যে বার বার উঠতে হয় বোলে এই ব্যবস্থা। বেশিদিন হয়তো বাঁচবে না। মাঝে মধ্যে যখন হাঁপানির চোট ওঠে, মনে হয় একেবারে শেষ। কিন্তু তবু বেঁচে যায়। প্রানপনে কামড়ে থাকে জীবনের মাটি। মৃত্যু এসে পেছন থেকে টানছে, ছাড়াতে পারছে না।
মা-র জন্যে খারাপ লাগে মফিজের। বেচারি সংসারের এই সুদিন দেখে যেতে পারলো না। সারা জীবন গতর খেটে গেছে। উপোস দিয়েছে দু’বেলা। একটা ছেলেকে তার লেখাপড়া শেখাতেই হবে। বড় ভাই এখলাসুদ্দিন ছোট বেলায়ই বখাটে হয়ে গেল। পড়ালেখার দায়িত্ব পড়লো তার উপর। কলেরায় মা যে বছর মরলো সে বছরই এখলাসুদ্দিন চিংড়ি মাছের ব্যবসা শুরু করেছে। তিন চার বছরেই একেবারে লাল অবস্থা। মা যেন মরে গিয়ে সংসারের সার হয়েছে। মা মরার পর থেকেই সংসারে উপচে পড়ছে সবকিছু। এটাই বোধহয় সংসারের নিয়ম। কেউ বেঁচে থেকে বাঁচায় আর কেউ মরে গিয়ে বাঁচায়। মফিজ এরকম একটা দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে আড়মোড়া ভাঙে। খাট থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশ দ্যাখে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার শোয়।
পাশের ঘরে এখলাসুদ্দিন এতোক্ষনে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন খুব খাটাখাটি করে। তার উপর নতুন বিয়ে করেছে। আগে অবশ্য মাঝ রাত্তির না হলে ঘরে ফিরতো না। মন্ডল বাড়ির এক মেয়ের সাথে তাকে জড়িয়ে নানা কথা রটেছিলো এলাকায়। এসব শুনে-টুনে মামারা জোর কোরে বিয়ে দিয়েছে। এখনো নাকি মন্ডল বাড়িতে এখলাসুদ্দিনের যাতায়াত আছে। অবশ্য একথা নিন্দুকেরা বলে। লোকটি ষোল বছরের একটি মেয়ের বুক জোড়া বিশ্বাসের উত্তাপ নিয়ে কী চমৎকার ঘুমুচ্ছে এখন— হয়তো ঘুমুচ্ছে না। হাসি পায় মফিজের। এ মুহূর্তে সুলতানার কথা মনে পড়ে আর সাথে সাথে বুকের ভেতর থেকে দলামোচা পাকিয়ে একটি বড় নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। ভেতরে খচ্ খচ্ কোরে কাঁটার মতো কিছু একটা বিঁধতে থাকে।
অন্যদিকে মন ফেরাতে চেষ্টা করে মফিজ। গত চার বছরে তার কতো পরিবর্তন হয়েছে। কলেজ পাশ কোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলো শেখ মফিজুদ্দিন। ছ’মাস না পেরোতেই সে হলো আহমেদ মফিজ। চেহারার তেল চিটচিটে ভাবটা কাটতে তেমন সময় লাগলো না। জড়িয়ে পড়লো রাজনীতির সাথে। তারপর এলো সুলতানা। তার সহপাঠী। আবার সুলতানা প্রসঙ্গে এসে যেতেই মফিজ ন’ড়ে চ’ড়ে শোয়। একবিন্দু ঘুম আসছে না চোখে। ভাবলো বাতিটা নিভিয়ে দিলে হয়তো ঘুম পাবে। উঠে বোসে হ্যারিকেনটার দিকে হাত বাড়াতেই জানালায় ফ্যাশ ফ্যাশ কন্ঠস্বর— মফিজ ভাই।
মফিজ চমকে তাকিয়ে দেখে ফারুক।
কি ব্যাপার এতো রাতে?
ফারুক একটু হেসে বলে— বন্দরে সিনেমা দেকতি গেইলাম। এ্যাহন ফিরতিছি। ঘরে আলো দেহে ভাবলাম একটা খবর দিয়ে যাই। এট্টু বাইরি আসেন।
চাপা স্বরেই কথাগুলো বলে ফারুক। মফিজ দরোজা খুলে বেরোয়। দুজনে রাস্তার পাশে পুকুর পাড়টার কাছে দাঁড়িয়ে আলাপ করে। ছ্যাদন হাজীর ছেলে আক্কাস। তাদের সাথেই কাজ করছিলো। গতকাল নাকি চেয়ারম্যানের কাছে তাদের সমস্ত পরিকল্পনার কথা বোলে দিয়েছে। খবরটা শুনে মফিজ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
আইজকে বিহেলে চেয়ারমেনের সাথে আপনার বোলে কথা কাটাকাটি হইছে? ফারুক জিগ্যেস করে।
কে বোল্লো?
সন্দের সুমায়ে আমি যহন বন্দরে যাই, তহন শুনলাম গোবিন্দর দোহানে বইসে কয়জন আলাফ কত্তিছে। চেয়ারমেন বোলে খুব কড়া কতা কইছে? আর আপনি ও বোলে কইছেন দেহে নেবো?
মফিজ কোনো উত্তর দেয় না। চুপ কোরে কিছু একটা ভাবে। ফারুক কেমন হতাশ কণ্ঠে বলে— আমাগে লোকজোন এ খবর শুনলি ভয় পায়ে যাবেনে।
যাও, রাত হয়েছে, বাড়ি যাও। সকালে বাড়ি থেকো। মফিজ ঘরে ঢুকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। খবরটা শোনার পর থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। আকাশ- পাতাল ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।
একটু বেলা কোরেই ঘুম ভাঙলো মফিজের। এখলাসুদ্দিনের বউ তখন রান্না ঘরে। বাবা বারান্দায় হেলান দিয়ে দোয়া দরুদ পড়ছে। পরকালের উপর গভীর আস্থাশীল লোকটির দিকে মফিজ তাকায়। শান্ত নির্লিপ্ত মুখখানা। ঠোঁট দুটো একটু একটু কোরে নড়ছে। শুকনো পাটের মতো ফিনফিনে শাদা দাঁড়ি ঝুলে রয়েছে বুক পর্যন্ত। শরীরের বাঁধুনী এখনও মজবুত। সে আরো তীক্ষ্ণ চোখে দ্যাখে। শান্ত নির্লিপ্ত মুখখানা পড়তে চেষ্টা করে। নাহ্, সারা জীবন অভাব অনটনে থেকেও লোকটির কোনো অভিযোগ নেই। পৃথিবীর উপর বরং সে যেন খুশি।
ঘর থেকে বারান্দায় পা রাখতেই চোখাচোখি হয় ময়নার সাথে। একগাল হেসে দুষ্টুমি মাখানো স্বরে ময়না বলে— কি, সায়েবের ঘোম ভাঙলো?
মাথার উপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাই তোলে মফিজ। একটু হাসার চেষ্টা কোরে বলে— ভাবী নাস্তা দাও, আমি মুখ ধুয়ে আসি।
পুকুর থেকে মুখ ধুয়ে, বারান্দায় রোদে পিঠ দিয়ে চটপট নাস্তা সারে মফিজ। তার তাড়াহুড়ো কোরে খাওয়া ময়না সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। হালকা এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে রাখে শুধু মুখে। তাড়াহুড়ো কোরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে মফিজ।
ফারুকদের বাড়িতে ঢোকার পথটি খুব চমৎকার। দুই পাশে মাথারও হাতখানেক উঁচু ধঞ্চে গাছ, মাঝখানে সরু পথ। গোলপাতায় ছাওয়া বড় ঘরখানা বেশ খোলামেলা আর উঁচু। মফিজ দরোজায় দাঁড়িয়ে ডাকে— ফারুক।
কাঁচা সবুজ রঙের শাড়ি পরা ঝলমলে রেবেকা বেরিয়ে আসে। রেবেকা ফারুকের বোন। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে। ওর ছোটো বোন রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক ওর হয়নি, হয়নি যে কেন, তা অবশ্য জানা যায় না। নানা জনের নানা রকম কথা। রঙটা ময়লা হলেও দেখতে অবশ্য খারাপ না। বয়সের তুলনায় বাড়ন্ত শরীর। খুব টানা টানা গভীর দুটো চোখ। কথাবার্তায় চোখা। ছেড়ে কথা কয় না কারো। এ জন্যেও তার নিন্দা কম নয় গ্রামে। বিয়ে হয়নি বোলে তার যে খুব মনোবেদনা, তেমন মনে হয় না কখনো। এই বরং ভালো আছে। হাড়ে হাওয়া লাগিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়ানোর এই সুযোগ বিয়ে হলে যে আর থাকতো না এটা সে বোঝে। আর বোঝে বোলেই বিয়ের খুব একটা উৎসাহ পায় না।
ফারুক কোথায়?
রেবেকা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে ঘরে আসতে আহ্বান জানায়। মফিজ মনে মনে খুশি হলেও বাইরে প্রকাশ করে না। একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে সে বারান্দায় উঠে আসে। রেবেকা জল চৌকিখানা এগিয়ে দেয়।
বইটা পড়া হয়েছে? প্রশ্ন করে মফিজ।
না।
উত্তর দিতে গিয়ে রেবেকার দুই ঠোঁটের মাঝখানে একবার একটু চোরা হাসি খেলা কোরে যায়। মফিজের চোখ এড়ায় না। চেহারায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য রক্ষা কোরে কথা বলে মফিজ। বোঝায়, একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার জন্যে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও এগিয়ে আসা উচিত। শুধু সমাজের বাইরেরটা পাল্টালেই সমস্যার সমাধান হবে না। একই সাথে ভেতর বাহির পাল্টানো দরকার। রেবেকা এসব কথা খুব আগ্রহের সাথে শোনে। এমন কথা সে আর কখনো কারো কাছেই শোনেনি। তার একাগ্র চোখের ভেতরে একধরনের স্বপ্নের ছবি ভেসে যায়। আবছা হলেও দেখতে পায় সে একটি সুন্দর জীবনে বাস করছে। রোকেয়ার মতো কথায় কথায় সে স্বামীর হাতে মার খায় না। বছর বছর বাচ্চা বিয়োতে হয় না। এ কথা মনে হতেই তার মা-র জন্যে কষ্টলাগে। বেচারি দশ বছরে সাতটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে একবারে চুপসে মরেই গেল। সন্তান জন্ম দেয়া আর রান্নাবান্না ছাড়া মেয়ে লোকটি আর কিছু করারই ফুরসৎ পায়নি। সাতজনের মধ্যে অবশিষ্ট এখন তিনজন। ঘরে নতুন মা এসেছে। তারও তিনটে এর মধ্যে। একটা পেটে।
কৈ, ফারুক কোথায় বোল্লে না?
চমকে মফিজের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পায় রেবেকা। দ্রুত ভেতরে চ’লে যেতে যেতে বলে— ডেকে দিতিছি।
রেবেকা চ’লে যেতেই মফিজ এই সপ্রতিভ মেয়েটির কথা ভাবে। একেবারে পাড়াগাঁয়ে এরকম একটি মেয়েকে পেয়ে মফিজ বেশ স্বস্তি বোধ করে। আস্তে আস্তে হয়তো ওকে দিয়ে পার্টির কাজও করানো যাবে। মফিজ লক্ষ্য করেছে বেশ কিছুদিন থেকে রেবেকা তার কথায় আঞ্চলিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে হাসি পেলেও সে কেন জানি মেয়েটির এই উদ্যোগটিকে সমর্থন করতে পছন্দ করে।
ফারুক এলে দুজনেই বেশ চাপা স্বরে আলাপে বসে। মফিজ দরোজার পাশে আর একজনের উপস্থিতি বুঝতে পারে। এবং সে যে রেবেকা তা টের পেয়ে মনে মনে খুশি হয়।
ফজোরালি কি কচ্ছিলো জানেন? কচ্ছিলো, মফিজির তালে তাল দিয়ে নাচাটা ঠিক হতিছে না। ও শহরে মানুষ, শহুরে লেহাপড়া করে। ওর সাথে আমাগো নাইচে লাবড়া কি? চেয়ারমেনের সাথে বোজাবুঝি কইরে আমরা বাঁচতি পারবো? ওগে দল কবে ক্ষেমতা পাবে তার কি কোনো ঠিক আছে?
কিছুটা হতাশ কন্ঠে একটানা কথাগুলো বোলে ফারুক থামে। মফিজ দীর্ঘশ্বাসের মতো নিশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে— তা, তোমরা কি বোল্লে?
আমরা বল্লাম যে— যা কও, যা কও, ও জমির ধান আমরা কাইটে উটোবো। ইসকুলির জমির ধান চেয়ারমেনের বাড়ি যাবে না। তোমরা মুরুব্বিরা থাকলি থাকবা, না থাকলি আমরা ছেমড়ারা এ কাজ করবো। তাতে যা আছে কপালে।
ফারুকের কথায় মফিজের যতোটা উৎফুল্ল দেখানো উচিত ছিলো তাকে ঠিক ততোটা উৎফুল্ল দেখায় না। বরং কিছুটা চিন্তিত মনে হয়। ফজোরালির উপর সে অনেকখানি নির্ভর করেছিলো। থানা পুলিশের ব্যাপারটা ও ভালো বোঝে। খাই খাতিরও আছে একটু আধটু। মফিজ ভেবেছিলো ছেলেপেলেদের নিয়ে সে এদিকে ধান কেটে তুলবে, থানা পুলিশ সামলাবে ফজোরালি।
আচ্ছা ফজোরালি হঠাৎ বিগড়ে গেল কেন?
মফিজ সরাসরি প্রশ্ন করে।
না যাইয়ে করবে কি? দুই দুডে মাছের ঘাট ওরে ছাইড়ে দিছে চেয়ারমেন।
মফিজের কাছে ব্যাপারটা এবার পরিষ্কার হয়। দুই ঘাট থেকে কম কোরে হলেও কয়েক হাজার টাকার মাছ তুলবে ফজোরালি। ঘাট ডাকের দায়িত্ব অনেকাংশে চেয়ারম্যানের উপর থাকে। সুযোগটা নিতে ফজোরালি ছাড়েনি। মফিজ এবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়।
ওমেদ মেম্বারের সাথে দেখা হয়েছিলো? ও কী বলে?
ফারুক ঘরে চৌকাঠের উপর বোসে কথা বলছিলো। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সে বেশ উদাসিন গলায় বলে— ওমেদ মেম্বার কয় যে দ্যাহো ইসকুলির খরচাপাতি তো সব চেয়ারমেন দিয়ে থাহে। ইসকুলির এই জমিটুকুও দ্যাহা শোনা করে সে। এ্যাহন তার সাথে গোলমাল বাধাতি যাইয়ে ইসকুলডারে বন্ধ কইরো না। তাতে আমাগে ক্ষেতি ছাড়া লাভ হবে কিছু?
—ঠিক আছে, রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তোমরা পোদ্দার বাড়ি থেকো।
মফিজ উঠে পড়ে। চ’লে আসার সময় দরোজায় রেবেকার বিষণ্ন মুখটি সে অনেকক্ষন ভুলতে পারে না।
বাড়ি ফিরে সুলতানার চিঠি পেলো। অনুতপ্ত হয়ে লিখেছে সে। অনুনয় কোরে লেখা চিঠিখানা মফিজ তিন চারবার প’ড়ে টেবিলের দেরাজে রেখে দিলো। সুলতানা বিষয়ক কোনো দুর্বলতা সে আর তার ভেতরে রাখতে রাজি নয়। ওই সব আবেগ প্রবনতাগুলো সে এখন ভুলে যেতে চেষ্টা করছে। সামনে তার কঠিন সময়।
কিন্তু সত্যি সে কি ভুলতে পেরেছে? মনে মনে একটু যেন চমকে ওঠে মফিজ সত্যিই যদি ভুলে গিয়ে থাকবে তাহলে ওর কথা মনে হতেই বুকের মধ্যে অমন খাঁ খাঁ কোরে ওঠে কেন? নাকি সে ভুলতে গিয়ে আরো বেশি কোরে ভালোবেসে ফেলছে ওকে? মফিজ কোনোটার ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে পারে না। যেমন সে নিশ্চিত হতে পারে না তার রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে। কখনো মনে হয় কী দরকার এসব ঝক্কি ঝামেলার। বেশ তো ছিলো সে। বাড়ি থেকে মাসে মাসে টাকা পেয়েছে। পড়াশোনা আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ চৈ কোরে বেশ তো কাটছিলো। এক বছর পর সুলতানাকে বিয়ে কোরে সুন্দর একটা সংসার পাততে পারে। একটা ভালো চাকরি বাকরি যদি জোগাড় করা যায় তাহলে তো ভালো, না হলে ব্যবসায় নেমে পড়বে। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি কোরে জীবনটা পার কোরে দেবে।
আবার কখনো এই গৃহপালিত জীবনকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। একটা পুরুষ মানুষ একজন মেয়ে মানুষের দেহ ভোগ কোরে, অফিস-বাসা আর বাসা- অফিস কোরে কীভাবে যে বেঁচে থাকে সে চিন্তাই করতে পারে না। জীবনে প্রকৃত কোনো ঝুঁকি নেই। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম নেই। শুধু আপোস আর আপোস। যে দেশে, যে সমাজে খেয়ে প’রে দিব্যি দিন কাটাচ্ছিস একটুকুন হলেও তার জন্য কিছু কর। মোষের মতো তিন বেলা খেয়ে, গন্ডা দুয়েক বাচ্চা-কাচ্চা বিয়োয়ে আর শেষ বয়সে জাবর কেটেই যদি মরবি, তাহলে এই বেঁচে থাকার মানেটা কি দাঁড়ালো?
—চেয়ারমেনের সাথে ঝামেলা বাঁধানোর দরকারটা কি তোর? অ্যা? পড়াশোনা কত্তিছিস তাই করবি। আমরা কারো সাতে আছি না পাছে আছি যে গায় পোড়ে গোলমাল বাঁধাবো? খাইয়ে পোরে শান্তিতি আছি, তাই থাকতি দে। খবরদার ওসবের মধ্যি আর যাইস না।
বোলেই চুডুস চুডুস শব্দ কোরে এখলাসুদ্দিন কাইন মাছের মাথাটা চুষতে থাকে। রান্না ঘরের বারান্দায় দুই ভাই খাচ্ছিলো। সামনে পিড়ি পেতে বোসে হাত পাখা ঘোরাচ্ছে ময়না। এখলাসুদ্দিনের কানেও পৌঁছেছে খবরটা। মফিজ মাথা নিচু কোরে খেতে খেতে বলে— বুঝলাম সব। কিন্তু ন্যায় অন্যায় বোলে তো একটা জিনিস আছে। এখলাসুদ্দিন খ্যাক খ্যাক কোরে খানিক কেশে নিয়ে বলে— বিপদে পড়লি তখন ন্যায় অন্যায় থাকবে নানে। ও রকম ম্যালা দেহিছি। কাজ সারা হলি সব স’রে পড়বে। গেরামের মানুষ চেনো নেই এ্যাহোনো।
মফিজ কথা বাড়ায় না। বোঝে, বোঝানোর চেষ্টা অহেতুক। সে খাওয়ায় মন দেয়। ময়না তার পাতে আর একখন্ড মাছ তুলে দিলে সে তাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শোবার ঘরের বারান্দা থেকে বুড়ো শ্বাস টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে— এ, চেয়ারমেনের সাথে কি হইছে? কার কি হইছে? কথার শেষ অংশটুকু কাশির শব্দের সঙ্গে এক হয়ে যায়। এখলাসুদ্দিন ক্যানকেনে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে— কিচ্ছু হোই নেই।
বুড়োর সব কথা না শুনলি ভাত হজম হয় না। পরের অংশটুকু গলা নামিয়ে বলে। বুড়ো ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ করতে করতে কাশতে শুরু করে। কাশতে কাশতে হাঁপানির টান ওঠে। হাত-পাখাখানা রেখে ময়না তার শ্বশুরের ওষুধ আনতে ঘরে ঢুকতে মফিজ হাতে পানি ঢালে।
.
অঘ্রান মাসের মাঝামাঝি সময়। গ্রামের বাতাসে এখন ধানের গন্ধ। নিশ্বাস নিলেই ধানের মম ঘ্রানে বুক ভ’রে যায়। বিলের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। পাকা ধানের এই সোনালি রঙ মফিজের খুব ভালো লাগে। এবার ফসলও হয়েছে খুব। গ্রামের প্রায় সবাই ব্যস্ত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে ধান কুড়োয়। শুধু প’ড়ে থাকা ধানই কুড়োয় না, সুযোগ বুঝে গাছ থেকেও চুরি করে। মালিকের নজরে পড়লে তাড়া খায়। ধরতে পালে কিল-থাপ্পড়।
মফিজের পরিকল্পনা মতো ধান কেটে ইসকুলের মাঠে তোলা হয়েছে। গ্রামের সবাই যা আশংকা করছিলো তার কিছুই ঘটেনি। টু শব্দটি করেনি চেয়ারম্যান। বরং আরো খোঁজ নিয়ে গেছে ধান ঠিক মতো উঠেছে কিনা। দু-একজনকে পাহারা দিতে বোলে গেছে।
এই সময়ে এলাকায় চুরি ডাকাতি বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। পরশু রাতে পোদ্দার বাড়ি ডাকাতি হয়ে গেল। রাম দা-র কোপ খেয়ে আহত হয়েছে দুজন। নগদ টাকা, গয়না-পাতি তো গেছেই, বাড়ির মেঝো বউ-এর উপর অত্যাচারও নাকি হয়েছে। মফিজ খোঁজ নিতে গিয়েছিলো। থানায় কেস করা হয়েছে। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান যথেষ্ট করেছে। ডাকাত না চিনতে পারলে কি হয়েছে, একটা ডায়রি করিয়ে রাখতে অসুবিধাটা কোথায়!
অসুবিধা যে কোথায় তা টের পাওয়া গেল ঘটনার তিনদিন পর। মাঝরাতে হন্তদন্ত হয়ে ফারুক এসে খবর দিলো চেয়ারম্যানের ঘাটে পুলিশের নৌকা। পোদ্দার বাড়ির ডাকাতি কেসের আসামি ধরতে এসেছে। মফিজ এক নম্বর আসামি। তার দলের কেউই প্রায় আসামি তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। নিখিল পোদ্দার নাকি স্বীকার করেছে যে, সে ডাকাত চিনতে পেরেছে। প্রানের ভয়ে আগে এ কথা বলতে পারেনি। আক্কাস, ওমেদ মেম্বর, ফজোরালি এরা সবাই সাক্ষী।
—তুমি এতো সব জানলে কী করে? মফিজ নিশ্চিত হতে চায়।
–কেন, রোকেয়ার বর চেয়ারম্যানের বাড়ি কাজ করে তা জানেন না? ওইতি আইসে খবর জানায়ে গেছে। রাত্তিরে গেরাম ঘেরবে। আমি বন্দরে চ’লে যাচ্ছি। গেরামে থাহা যাবে না। কেউরে বিশ্বেস নেই। আপনি এ্যাহন কী করবেন?
মফিজ কী যেন চিন্তা করে। গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলো একে একে ভেসে ওঠে চোখের সামনে। শেষ পর্যন্ত নিখিল পোদ্দার এই কাজ করলো!
—তহন বল্লাম না, বিপদ বাঁধাবা? এ্যাহন বুজতিছো?
মফিজ পেছনে ফিরে দেখে এখলাসুদ্দিন। বুঝতে পারে ঘরের ভিতর থেকে ওদের সব কথাই সে শুনেছে।
—যাও কাপোড় চোপোড় গুছায়ে এ্যাহনই ফারুর সাথে বন্দরে চ’লে যাও। কাইল সকালের লঞ্চে ঢাকা চ’লে যাবা। আর আমার খবর না পাঠানো পৈযন্ত বাড়ি আসবা না।
মফিজ কোনো কথা না বোলে ঘরে ঢোকে। এখলাসুদ্দিন নিজের মনেই গজ গজ করতে থাকে— এ্যাহন টাহার ছেরাদ্দ। কথা বোল্লি শোনবে না, বোঝবে না, গেইছে চেয়ারমেনের সাথে পাল্লা দিতি। একগাদা টাহা ঢালো এ্যাহন থানায়।
.
আকাশে অর্ধেক চাঁদ। ঘোলাটে জোস্নায় মফিজ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে নিন্দা আর পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাকে ফিরতে হবে, কয়েক ঘন্টা আগেও কি সে ভাবতে পেরেছে! দুজনইে মাথা নিচু কোরে হাঁটছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর পর কেউই কোনো কথা বলেনি। ফারুক কী ভাবছে মফিজ জানে না। হয়তো ভাবছে তাদের সবাইকে বিপদে ফেলে সে নিরাপদ জায়গায় চ’লে যাচ্ছে। হয়তো ভাবছে ফজোরালিই ঠিক বলেছিলো, মফিজ শহুরে মানুষ বিপদ দেখলেই শহরে স’রে পড়বে।
মফিজ একবার ভাবে, না সে ঢাকায় যাবে না। ফারুক, রশিদ, নিতাই, হিদাত ওরা যেখানে থাকবে সেও তো সেখানে থাকতে পারবে। এইটুকু ঝুঁকি নিতে সে কি পারবে না?
মফিজ চূড়ান্ত ঝুঁকি নিতে পারবে না। তার খুব ভেতরে কোথায় যেন একটি অন্য মানুষ কথা বলে। কী দরকার এই সব ঝামেলার! সামনে তোমার সুবর্ন সময়। সুলতানার মতো একটি চমৎকার মেয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে তোমার জীবন কানায় কানায় ভরিয়ে দেবে। অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান, ঘরে যুবতী স্ত্রী— একজন মানুষের এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?
তোমাদের খুব কষ্ট হবে ফারুক। কে জানে কতোদিন পালিয়ে বেড়াতে হয়!
মফিজের চোখ ভেজা! কন্ঠ ভাঙা ভাঙা বেসুরো। ফারুক কোনো কথা বলে না। তাকে খুব বিষণ্নও মনে হয় না। কী এক সতেজ চিন্তায় সে টান টান হয়ে থাকে। নির্বিকার চোখে সে লঞ্চটার চ’লে যাওয়া দ্যাখে। মফিজ হাত নাড়ে। একটু জোরেই বলে— আবার আসবো, দেখা হবে।
কিন্তু মফিজ জানে, সে আর আসবে না। মফিজরা কখনো আসে না। আসতে পারে না। তবে ফারুক, নিতাইরা ইতিমধ্যে বুঝতে পারে লড়াইটা তাদের। তাদেরই লড়তে হবে এবং মফিজদের বিরুদ্ধে।
১৮ ভাদ্র ১৩৮৬ মিঠেখালি মোংলা