নিগ্রহ
সংসার সংসার করে শংকরটা একেবারে জেরবার হয়ে গেল। রুগ্ন বউ। বাইরে থেকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই। মনে হবে অসাধারণ স্বাস্থ্য। শংকরের চেয়ে শতগুণ ভালো। ভেতরটা না কি একেবারে ফোঁপরা। ফুলশয্যার মাঝরাতেই সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। শংকর প্রায় খুনের দায়েই পড়ে আর কি। দরজা বন্ধ করে সোহাগের বশে বউকে একটি যুঁই ফুলের মালা পরিয়েছিল। তিন মিনিটের মধ্যে বউ অমনি হাপরের মতো শ্বাস টানতে শুরু করল। মনে হচ্ছে, ঘরের সমস্ত বাতাস যেন শুষে নেবে। এমন সাঁসাঁ শব্দ, বাইরে যারা কান পেতে ছিল, তারা সব চিৎকার জুড়ে দিল, ঘরে কী চলছে? কী মেশিন চালালেন, শংকরদা?
শংকরে তখন আর শংকর নেই। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সবাই অমনি ঘরে ঢুকে, কেউ জানলা খুলছে, কেউ মশারি তুলছে, কেউ পাখার রেগুলেটার ঘোরাচ্ছে। হইহই ব্যাপার।
শংকরের বউ অতি কষ্টে বললে, ‘অ্যালার্জি। যুঁই আর গাঁদা ফুলে আমার অ্যালার্জি আছে, ভাই। তিন ফোঁটা চুনের জল আধ কাপ জলে।’
ফুলশয্যা হয়ে গেল রোগশয্যা।
সেই থেকে শংকরকে আর দেখতেই হল না, স্ত্রীর অঙ্গও স্পর্শ করতে হল না। বউ চলে গেল ডাক্তারবাবুদের হাতে। সব স্পেশ্যালিস্ট। হার্ট, লাংস, কিডনি, ই এন টি, আই, ফিমেল ডিজিজ, অস্টিওপ্যাথ, মাঝে-মাঝে হোমিওপ্যাথ, নেচারোপ্যাথ। একজন বেরোচ্ছে তো আর একজন ঢুকছেন। বড়-বড় হোটেলে যেমন প্রতিদিনের মেনু থাকে, লেখা থাকে টুডেজ স্পেশ্যাল। খানা টেবিলে বসে জিগ্যেস করেন, আজকের স্পেশ্যাল আইটেম? সেইরকম শংকর রোজ সকালে উঠে বউকে জিগ্যেস করে, ‘আজকের খবর?’ খাবারের বদলে খবর। তারপর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। স্ত্রী অমনি বলেন, ‘বেশ ছিলম, বুঝলে। যেই তুমি ডাকলে, শুনছ সাড়ে ছ’টা বাজল। আমি অমনি ধড়মড় করে উঠে বসলুম। শরীরটা একটা ঝাঁকুনি খেল তো, আর সঙ্গে-সঙ্গে আধকপালে হয়ে গেল। উ:, মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।’
‘কী হবে এখন?’
‘আর কী হবে। হয়ে গেল। আমার আবার মাথা ধরলে গা গুলোতে থাকে। সারাদিন কিছু আর খেতে পারব না। ওদিকে আলসার। পেট খালি থাকলেই ব্যথা শুরু হয়ে যায়। পেটে গ্যাস হবে। গ্যাস হলেই ঠেল মারবে ওপরে। সঙ্গে-সঙ্গে চাপ মারবে হার্টে। হার্টে চাপ মারলেই প্রেসার চড়ে যাবে। প্রেসার চড়লেই হাত, পা অবশ হয়ে যাবে। তোমাকে আমি কতবার বলেছি, আমাকে আচমকা অমন করে ডাকবে না।’
‘আমি তাহলে ডাক্তারবাবুকে একবার কল দি। পরে যদি বাড়াবাড়ি হয়।’
মানুষ সকালে ব্রেকফাস্ট করে, চা-বিস্কুট, অথবা টোস্ট-চা। শংকরের বউয়ের ব্রেকফাস্ট হল জল, ক্যাপসুল। বিছানা থেকে উঠে আবার বিছানাতেই ফিরে আসা। আজ দশটা বছর ধরে শঙ্কর এই করে যাচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় ওষুধের নাম তার কণ্ঠস্থ। যেকোনও অসুখ সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। ডাক্তারবাবুরাই এখন তার পরামর্শ নেন।
মাদুর্গা, কার্তিক আর গণেশকে বললেন, ‘যে সবার আগে বিশ্ব পরিক্রমা করে ফিরে আসতে পারবে, তার গলায় আমার এই মণিমালা ঝুলিয়ে দেব।’
কার্তিক অমনি ময়ূর চেপে বেরিয়ে গেল। গণেশ কিন্তু বসেই রইল। মা বললেন, ‘কী রে। তুই গেলি না?’ গণেশ বললে, ‘ও তো একপলকের ব্যাপার।’ গণেশ গদি ছেড়ে উঠে মাকে প্রদক্ষিণ করে গলাটা বাড়িয়ে দিল। এক বছর পরে কার্তিককুমার ফিরে এসে অবাক।
তা শংকর তার বউকে প্রদক্ষিণ করে ফার্মাকোপিয়া বনে গেছে।
প্রথম প্রথম আমরা শংকরের বউকে জিগ্যেস করতুম, ‘কী কেমন আছ?’ ভদ্রতা করে যে প্রশ্ন সকলেই সকলকে করে। এখন আর ভুলেও করি না। তাতেও কি নিষ্কৃতি আছে? পা ঘষে-ঘষে, পা ঘষে-ঘষে, এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন, ‘কেমন আছেন, ঠাকুরপো?’
তখন পালটা প্রশ্ন করতেই হয়, ‘তোমার খবর কী? যেন দোদমার পলতেয় আগুন ছোঁয়ালুম। শব্দের ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। সঙ্গে-সঙ্গে টেলিপ্রিন্টার চালু হয়ে গেল। ‘আর বলবেন না। বেশ ছিলুম। হঠাৎ রাস্তায় একটা লরির টায়ার ফাটল। আচমকা শব্দ তো। বুকের কাছটা ধক করে উঠল। সেই যে লাফাল, আর থামছে না। শরীরটা যেন ঝিম মেরে আসছে। বুকের এই বাঁদিকটায় হাত দিয়ে দেখুন। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।’
হাত দেব কী? ওই জায়গায় হার্ট ছাড়াও মেয়েদের আরও একটা জিনিস থাকে।
শংকরের অবস্থা দেখলে দু:খ হয়। অথচ ছেলেটা বউকে ভীষণ ভালোবাসে। সেবা করে বিগ্রহের মতো। আমরা বলি নিগ্রহ। সেবার একটা নেশা আছে। কারণ সেবা, গঞ্জিকা সেবা, জীবিকার সেবা, সমাজ সেবা। রবিবার দেখার মতো অবস্থা। পাজামা হাঁটুর ওপর। হাতে ঝাড়ু, পাশে বালতি, কাঁধে গামছা, দুটো গ্যাস ওভেনের একটায় ভাত, আর একটায় সিঙি মাছের ঝোল। সারা বাড়ি ছত্রাকার। বউয়ের নাকি সুর। ‘শুনচ আমার বোধহয় দ্বিতীয় ক্যাপসুলটা খাওয়ার সময় হল।’
সেদিন দুপুরে শংকরকে ডাকতেই বেরিয়ে এল। পরনে একটা সায়া। একি। বললুম, ‘তুমি বোধহয় লিঙ্গ ভুল করে ওটা পরেছ।’
শংকর বললে, ‘তাই তো আমি ভাবছি, পাজামার তো দুটো পা হয়। আর একটা পা গেল কোথায়? তখন থেকে খুঁজেই যাচ্ছি। দেখেছ কী কান্ড। আর ভাই, আমার মাথার ঠিক নেই।