নসিবের খেলা
মধ্যপ্রদেশের এক শহর। কিছুকাল আগে সেখানে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা সত্য, কিন্তু আশ্চর্য। খবরটা কাগজে বেরিয়ে সেই সময়ে বিশেষ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ঘটনাটা ইংরেজ কবি বায়রনের কথাই প্রমাণিত করে—‘এ হচ্ছে আশ্চর্য, কিন্তু সত্য; কারণ সত্য হচ্ছে সর্বদাই আশ্চর্য—কল্পকাহিনির চেয়ে বেশি আশ্চর্য।’
মি. হিনেসেন (আই সি এস) সেখানে নূতন অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনারের পদে নিযুক্ত হয়ে এসেছেন।
আদালতের কাজ সেরে তিনি বাসার দিকে ফিরছেন পদব্রজে। পথে যেতে যেতে হঠাৎ একটা মস্ত দেশি কুকুর তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।
কেউ কাছে নেই, তবু একবার এপাশে আর একবার ওপাশে মুখ ফিরিয়ে কুকুরটা বার বার তেড়ে দংশন করছিল যেন শূন্যতাকেই। প্রায় ত্রিশ গজ দূর থেকেই তার দাঁতের ঠকঠকানি শোনা যাচ্ছিল এবং তার দুই চোয়াল দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছিল সফেন লালা।
চারিদিকে ভীত চিৎকার উঠিল, ‘পাগলা কুকুর! পাগলা কুকুর!’
পথ থেকে দুদ্দাড় করে লোকজনরা ছুটে পালাতে লাগল।
কিন্তু সামনেই একটা বৃহৎ পিপুল গাছের তলায় উপবিষ্ট ছিলেন জনৈক গৈরিকধারী সাধু। ক্ষ্যাপা কুকুরটাকে দেখে তিনি একটুও নড়লেন না, কোলের উপর দুই হাত রেখে আসনপিঁড়ি হয়ে সমানে বসে রইলেন পাথরের মূর্তির মতো।
হিনেসেন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই নির্বোধ! বাঁচতে চাও তো তাড়াতাড়ি সরে পড়ো!’
সাধু কিন্তু অটল, যেন বাইরের জগতের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
কুকুরটা একেবারে তাঁর সামনে এসে পড়ল।
নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে সাধুকে রক্ষা করবার জন্যে সাহেব পকেট থেকে রিভলভার বার করে ঘোড়া টিপে দিলেন।
আর্ত চিৎকার করে কুকুরটা মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ল।
সাধু তবু কথা কইলেন না, এমনকী মাথা তুলে চেয়ে দেখলেনও না।
সাহেব তো মহা খাপ্পা! এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা দেখে সাধুকে তাঁর প্রহার করতে ইচ্ছা হল। কিন্তু সে ইচ্ছাটা দমন করে সাহেব তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রৌঢ় সাধু, কিন্তু পেশিবদ্ধ সবল দেহ, মাথায় জট-পাকানো লম্বা চুল, গায়ে ছাই-মাখা। যেমন আকচার দেখা যায়।
সাহেবকে দেখে সাধুর কোনোরকম ভাবান্তর হল না। কেবল তিনি সহজভাবেই বললেন, ‘তুমি তো নতুন কমিশনার সাহেব?’
‘হ্যাঁ, গেল হপ্তায় আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি। কিন্তু বাপু, তুমি আজ খুব বেঁচে গিয়েছ।’
‘এ হচ্ছে নসিবের খেলা।’
‘রাবিশ! নসিব, কিসমৎ ওসব আমি মানি না। ঘটনাগুলো ঘটে গেল দৈবগতিকেই। দৈবক্রমেই আজ আমার পকেটে ছিল রিভলভার। আর ঘোড়ার অসুখ হয়েছে বলে আজ আমি পায়ে হেঁটেও আসছি দৈবক্রমেই। এর মধ্যে কিছুমাত্র নসিবের খেলা নেই।’
সাধু কিছুক্ষণ কথা বললেন না, যেন তিনি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘কিবা রাত, কিবা দিন, রিভলভারটা সর্বদাই সঙ্গে রাখতে ভুলবে না।’
হিনেসেন বললেন, ‘অকারণে আমি সঙ্গে রিভলভার রাখি না।’
সাধু বললেন, ‘অকারণে নয়, কারণ থাকতেও পারে।’
সাহেব জানতে চাইলেন, ‘এ কথার অর্থ কী?’
সন্ন্যাসী যেন অন্যমনস্কের মতো বললেন, ‘বিপদের ছায়া তোমার চারপাশেই ঘনিয়ে উঠছে। নসিবের খেলা!’ তারপরেই তিনি গড় গড় করে কতকগুলো দুর্বোধ্য সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগলেন।
হিনেসেন আর কোনো বাক্যব্যয় না-করে মাইল খানেক হেঁটে একটা মাঠ পেরিয়ে নিজের বাংলোয় গিয়ে উঠলেন। রিভলভারটা টেবিলের একটা ড্রয়ারের ভিতরে রেখে দিয়ে নিজের মনেই বললেন, ‘ধাপ্পাবাজ সাধু! আমাকে যোগবলের মহিমা দেখাতে চায়! এসব বুজরুকিতে আমি ভোলবার পাত্র নই।’
* * *
হপ্তা খানেক পরে।
বেজায় গরম। ঘরের ভিতরে প্রাণ হাঁপায়। হিনেহেন বাংলোর বারান্দায় ক্যাম্প-খাট পেতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ভোরের দিকে আচম্বিতে এক বিষম গণ্ডগোলে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল, ধড়মড় করে উঠে বসে দেখলেন, একটা কপনি-পরা প্রকাণ্ড প্রায় নগ্ন মূর্তি তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
সাহেব বিছানা থেকে নামতে-না-নামতেই সেই ষণ্ডামার্কার মতো মূর্তিটা তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং দুই হাতে সজোরে তাঁর গলা টিপে ধরল।
তাকে বাধা দিতে গিয়েই হিনেসেন বুঝতে পারলেন তার কাছে তিনি শিশুর মতোই অসহায়। দেখতে দেখতে তার বলিষ্ঠ হাতের চাপে তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
সাহেব আর কিছু না করতে পেরে তাকে প্রাণপণে কামড়ে ধরলেন—কিন্তু বৃথা! তাঁর দংশন আমলেই আনল না, উলটে হাতের চাপ আরও বেড়ে উঠল, হিনেসেনের জ্ঞান ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে আসতে লাগল।
এমন সময়ে সোঁ করে কী-একটা আওয়াজ শোনা গেল, তারপরেই একটা প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের গলার উপর থেকে হাতের চাপ আলগা হয়ে গেল এবং শত্রুর মূর্তিটা ধপাস করে তাঁর দেহের উপর আছড়ে পড়ল।
ততক্ষণে চারিদিক থেকে চাকর-বাকররা ছুটে এসে আক্রমণকারীকে ধরে ফেলেছে, কিন্তু তার শরীরে এমন বিষম শক্তি যে কয়েকজন মিলেও তাকে বাগে আনতে বিশেষ বেগ পেতে হল—যদিও শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতেই হল। সকলে মিলে দড়ি দিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেললে।
হিনেসেন ভীষণ হাঁপাতে লাগলেন, ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলেন না।
তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি, চারিদিক ছায়াময়। লণ্ঠন জ্বালতেই হিনেসেন সচমকে দেখলে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই সাধু, তাঁর হাতে একগাছা মোটা লাঠি।
এতক্ষণে হিনেসেনের হুঁশ হল, তিনি বুঝতে পারলেন কে তাঁর রক্ষাকর্তা!
সাধু বললেন, ‘আজ তোমার ফাঁড়া আছে জেনেই আমি এখানে এসেছি। ও লোকটা উন্মাদগ্রস্ত। একেবারের বদ্ধপাগল।’
হিনেসেনের মন কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে উঠল। সাদরে করমর্দন করবার জন্যে তিনি তাড়াতাড়ি নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
সন্ন্যাসী কিন্তু ভাবহীন মৌন মুখে নিশ্চল, নিস্পন্দ।
হিনেসেন বললেন, ‘সাধু, তুমি কী বকশিশ চাও?’
সাধু বললেন, ‘বকশিশের কথা তুলো না সাহেব! আজ আমি খালি কৃতজ্ঞতায় ঋণ শোধ করে গেলুম,’ বলতে বলতে লাঠি ঠকঠক করতে করতে তিনি বাংলোর বারান্দা থেকে নেমে গেলেন।
লোকজনরা বলে উঠল, ‘সন্ন্যাসী ঠাকুর চোখে দেখতে পান না।’
আশ্চর্য হয়ে হিনেসেন বললেন, ‘চোখে দেখতে পান না?’
‘না। উনি অন্ধ।’
হিনেসেন হতভম্ব। তিনি ভাবতে লাগলেন, তাহলে কি যোগবল, অন্তর্দৃষ্টি, অলৌকিক শক্তি, এসব ব্যাপার মিথ্যা নয়?
তারপরেও আবার সাধুর কাছে গিয়েও তিনি তাঁর প্রশ্নের জবাব পাননি।
—