“নরেন শিক্ষে দিবে”
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃত অর্থে ছিলেন এক মহাবিপ্লবী। তিনি ছিলেন ভূমিকম্পের মতো। পৃথিবী কাঁপে দু-ধরনের শক্তিতে, এক হলো——স্লো আর্থ ট্রেমার’, যা ভিতর থেকে পাহাড়-পর্বত ঠেলে তোলে। সমুদ্রের তল উঁচু করে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করায়। দুই—ভয়ঙ্কর কম্পন, পৃথিবী ভেঙেচুরে শেষ করে দেয়। ঠাকুর প্রথমে আমাদের মনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। ছোট মনের মালা দিয়েই গাঁথা হয় সমাজ-মন। ব্যক্তি-মানুষকে না পালটালে সমাজের পরিবর্তন অসম্ভব। ঠাকুর ছিলেন বিজ্ঞানী। ‘ভব-রোগ-বৈদ্য’। আগে নিরীক্ষণ, পরে পথের সন্ধান। কোন্ হাতিয়ারে তৈরি হবে মানুষের সুখের বাসস্থান!
।। নিরীক্ষণ।।
তিনি দেখলেন সমাজের ওপরতলা, নিচের তলা। ওপরতলায় রয়েছেন বিষয়ভোগী ধনী। বিষয় ছাড়া তাঁরা কিছু বোঝেন না। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সৌখিন ধার্মিক। যথেষ্ট ভোগ হয়েছে। আট-নটি ছেলেপুলে। আচ্ছা, এইবার দেখা যাক ধর্মের ‘এক্সকারশানে’ বেরিয়ে বাড়তি কিছু পাওয়া যায় কিনা! রয়েছেন প্রচারক। যে-প্রচার সকল মানুষের অন্তর স্পর্শ করে না। ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের মতো মেন্টাল এক্সারসাইজ। ঈশ্বরের রূপ ও গুণ বর্ণনা। আর কেবল পাপ-পুণ্যের কথা। ওপরতলার কিছু শিক্ষিত মানুষের ‘অ্যাসেম্বল’। নিচের দিকের ধর্মে গুরুবাদ। বিপথগামিতা। বীভৎস কদাচার। ধর্মের আড়ালে যাবতীয় ভোগ। মানুষের দেবতাকে মুক্ত না করে পশু-মুক্তি। ঠাকুর ইন্টেলেকচুয়ালদের দেখলেন। মথুরবাবুকে সঙ্গী করে সমাজের মাথাওয়ালাদের কাছে একে একে গেলেন। দেখলেন জ্ঞান আছে, বিজ্ঞান নেই। হৃদয় আছে, অন্তর নেই। পশ্চিমের ভোগবাদের ছোঁয়ায় বিভ্রান্ত। অহং-সর্বস্ব। সকলেই ভেবে বসে আছেন, আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। ঠাকুর গোলাম বাঙালীদের কাছে গেলেন। তাদের অন্তঃপুরে ফুঁড়ে ফেঁড়ে ঢুকে গেলেন। দেখলেন সবাই দুখচেটে সংসারী। শিশ্নোদরপরায়ণ। দাসত্ব মনের ওপর চেপে বসে আছে। কাম-কাঞ্চনে আসক্ত। তমোগুণী। স্ত্রৈণ। ঠাকুর সাধুদেরও দেখলেন। বেশিরভাগই পুঁটলি সামলানো সাধু। লুচি-হালুয়া দেখে লাফায়, মেয়েদের দিকে আড়ে আড়ে চায়। সন্ন্যাস যেন জীবিকা। এরপর ঠাকুর বিশাল প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন, যেখানে পড়ে আছে দেশের নব্বুই ভাগ। চুলে তেল নেই, পেটে অন্ন নেই, মাথায় ছাদ নেই। কলকাতার পথে চলেছেন ঘোড়ার গাড়িতে। সহিসকে বলছেন, চালাও, চালাও। জোরসে চালাও, আমি দেখব, সব দেখব শহর দেখব, শতাব্দী দেখব, দেহজীবী দেখব, শিমারা বখাটে ছোঁড়া দেখব, গোরা সাহেব দেখব। দেখলেন। সকলেরই দৃষ্টি নিচের দিকে। পোকার মতো সব কিলবিল করছে জীবনের অন্ধকারে। পণ্ডিতসমাজ শকুনির উপমা। উঠেছে অনেক ওপরে, দৃষ্টি ভাগাড়ে। শতাব্দীর আঁচল ধরে টান মারলেন। উন্মোচিত হলো তার শরীর। এইবার তিনি দুর্দমনীয়, ভয়ঙ্কর। কারোকে রেহাই দিতে রাজি নন। রাসমণিকে কষিয়ে দিলেন এক চড়। ভগবানের নাম করতে করতে বিষয়চিন্তা কেন? ঈশ্বর মন দেখেন। মন আর মুখ এক কর। গঙ্গার ঘাটে জয় মুখুজ্জেকেও হাঁকিয়ে দিলেন দুই থাপ্পড়। শম্ভু মল্লিককে করলেন তিরস্কার। সমাজসেবা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল স্থাপন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। মূল উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ। ঈশ্বরলাভ হলে মানুষ নিরাসক্ত হয়। অহং ঘুচে যায়। আনন্দলাভ করে। মথুরবাবুর সঙ্গে তীর্থে গিয়ে অনবরত বিষয়ের আলোচনা শুনে বললেন, খুব হয়েছে, আমাকে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়ে দাও। কেশবচন্দ্র সেনকে ‘পালপিট প্রিচার’ থেকে টেনে আনলেন ভক্তির জগতে। তিনি দু-হাতে মানুষকে দিতে চান—রুক্ষ মাথায় তেল, নিরন্নকে অন্ন, বারবনিতাকে চৈতন্য। ভগবানের কাছে চাইলেন একজন রসদদার। পেলেন মথুরবাবুকে। পেলেন শম্ভুচরণ মল্লিককে। চাইলেন একটি ‘সন্তান’। পেলেন রাখালচন্দ্রকে। চাইলেন ‘খাপখোলা একটি তরোয়াল’। পেলেন নরেন্দ্রনাথকে।
।। বিস্ফোরণ।।
নরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সমাধি। চেয়েছিলেন নিজের মুক্তি। তা কি করে হয়! ঠাকুর ধমক দিলেন—স্বার্থপর! তুই হবি বটবৃক্ষ। আমার শক্তির ঝুরি তুই ধারণ করবি। নিচেরটাকে তুলে আনবি ওপরে। জগৎটাকে কাঁপিয়ে দিবি। নব ভারত জাগবে তোর মধ্য দিয়ে। বিশ্বকে শোনাবি, যত মত তত পথ। সোস্যালিজমের ‘ফোররানার’ হবি তুই। বলবি, জীবই শিব।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমস্ত শক্তির আধার করে রেখে গেলেন বিবেকানন্দকে। ভূমি প্রস্তুত। যত গৃহী মধ্যবিত্ত পথের সন্ধান পেয়েছেন। সমাজ-মন আলোড়িত। শতাব্দী শেষ হয়ে গেল। বিগ্রহ অন্তর্হিত। ভাব-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। নব-ভাবের ধূপের ধোঁয়ার পরিবেশ আচ্ছন্ন। শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদরা ছটফট করছেন। ‘নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।’ তাঁরা একবার বলছেন, চল, ফিরে যাই গৃহে। লীলা তো শেষ। আবার বলছেন, না, কখনো নয়। ছেড়ে দিয়ে ধরা কেন? চলো যাই সন্ন্যাস নিয়ে তীর্থে তীর্থে।
অসম্ভব, তা কি করে সম্ভব? ভগবান শক্তির তন্তু দিয়ে গেঁথে দিয়ে গেছেন পার্ষদমালিকা। ছেঁড়ে কার সাধ্য! স্বামীজীকে বলেছিলেন : “আমার তো সিদ্ধাই করার উপায় নেই, আমি তোর ভিতর দিয়ে সিদ্ধাই করব।” একখানা কাগজে ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন : “নরেন শিক্ষে দিবে।” নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন :
“আমি ওসব পারব না।” ঠাকুর বলেছিলেন : “তোর হাড় করবে।”
ঠাকুর কতটা শক্তি নরেন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন, তা অনুভব করতে পেরেছিলেন কালীপ্রসাদ। নরেন্দ্রনাথ কাশীপুরের বাগানে গাছতলায় ধুনি জ্বেলে বসে আছেন, কালীপ্রসাদকে বললেন : “আমার হাত ধর দেখি।” ধরামাত্রই কালীপ্রসাদ বললেন, কি একটা ‘শক’ তোমার গা ধরাতে আমার গায়ে লাগল। ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, তুমি আমার জন্যে দেহধারণ করে এসেছ। মাকে বলেছিলাম, মা, আমি কি যেতে পারি! গেলে কার সঙ্গে কথা কব? মা, কাম-কাঞ্চনত্যাগী শুদ্ধ ভক্ত না পেলে কেমন করে পৃথিবীতে থাকব! তুই রাত্রে এসে আমায় তুললি, আর আমায় বললি, ‘আমি এসেছি।’ কাশীপুরে ঠাকুর বলেছিলেন, চাবি আমার কাছে রইল। ও আপনাকে জানতে পারলে দেহত্যাগ করবে।
রাখাল বরানগর মঠে বলছেন : “চল নর্মদায় বেরিয়ে পড়ি।”
নরেন্দ্রনাথ বলছেন : “বেরিয়ে কি হবে? জ্ঞান কি হয়? তাই জ্ঞান জ্ঞান করছিস?”
আরেকজন ভক্ত শুনে বলছেন : “তাহলে সংসার ত্যাগ করলে কেন? “ নরেন্দ্রনাথ বলছেন : “রামকে পেলাম না বলে শ্যামের সঙ্গে থাকব—আর ছেলেমেয়ের বাপ হব—এমন কি কথা!”
শ্বেত অঙ্গে টকটকে গেরুয়া। কপাটের মতো বিশাল তাঁর বক্ষ। পদ্মপলাশ লোচন। ঠাকুর বলতেন : “রাঙাচক্ষু বড় রুই।” দাঁড়িয়ে আছেন দৃপ্তভঙ্গিতে। মুখে যাঁর একটিই কথা—”ওয়াহ গুরু-কি ফতে!” তিনিই চিনেছিলেন গুরুকে—শঙ্করের বিচারশক্তি ও চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তি এইবার একাধারে মূর্তিমন্ত হলো, আবার শ্রীকৃষ্ণের সর্বধর্মসমন্বয় বার্তা শোনা গেল, আবার দীন দরিদ্র পাপী-তাপীর জন্য বুদ্ধদেবের ন্যায় একজন ক্রন্দন করছেন, শোনা গেল; অবতারপুরুষগণ যেন অসম্পূর্ণ ছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়ে তাঁদের পূর্ণ করেছেন। “Once more the wheel is turning up, once more vibrations have been set in motion from India, which are destined at no distant day to reach the farthest limits of the earth.
।। পরিশেষ।।
বিদেশী অনেক গাছ লাগাবার চেষ্টা হলো। স্বদেশভূমিতে তা পারল না শিকড় চালাতে। শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জোড়া কলমের ভাবতরু আজ বিশালবৃক্ষ। কোন্ ছায়াতে বসে আছ তাপিত পথিক? জান না! তাহলে শোন স্বামীজীর মুখ দিয়ে কি আগুন ঝরছে—
“Now my brothers, if you do not see the hand, the finger of Providence, it is because You are blind, born-blind indeed.”