নবারুণবাবু সুখে থাকুন
আজ কিছুদিন হল নবারুণবাবু কিছুটা মোটা হয়ে পড়েছেন। নবারুণবাবুর বয়েস এই আগামী পয়লা অগ্রহায়ণে পঁয়তাল্লিশ পূর্ণ হবে। এক স্ত্রী, এক কন্যা। খুব ঝামেলা ঝঞ্জাট নেই তার জীবনে। চিরকাল মাঝারি চাকরি করেছেন, মাঝারি ধরনের উচ্চাশা তার। খুব টানাটানিও নেই তার, আবার খুব সচ্ছলতাও নেই।
ভালভাবেই চলে যাচ্ছিল নবারুণবাবুর দিন। কিন্তু এইসব মাঝারি মানুষদের মধ্যে জীবনে একটা ধাক্কা আসে, মোটা হওয়ার ধাক্কা। মেদবৃদ্ধির প্রাবল্যে শরীরের মধ্যদেশ ফুলে ওঠে। বিনা কারণে শুয়ে-বসে সারাজীবন ধরে যেরকম চলা-ফেরা খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তার কোনও পরিবর্তন না হলেও শরীরে অগাধ প্রাচুর্য কোথা থেকে চলে আসে কেউ জানে না।
নবারুণবাবুরও ঠিক তাই হয়েছে। তবে তিনি সুরসিক লোক, তিনি এই বয়েসে এই মোটা হওয়ার নাম দিয়েছেন: মাঝারি মানুষের মাঝারি বয়েসের মাঝারি অসুখ। নবারুণবাবু নিজে এই অসুখ বাধাননি। তিনি যে খুব অলস বা খুব বেশি খাওয়া-দাওয়া করেন তাও নয়। আসলে এই মোটা হওয়ার অসুখটা নবারুণবাবুদের বংশানুক্রমিক। তার পূর্বপুরুষেরা অনেকেই তাদের বিস্তৃতির জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। তবে সেকালে মোটা হওয়া ব্যাপারটা নিয়ে লোকরা এত মাথা ঘামাত না, বরং সেটা ছিল সামাজিক মর্যাদার একটি বিশেষ প্রতীক। মা-ঠাকুমারা প্রাণপণ চেষ্টা করতেন ঘি, মাখন, দই, মিষ্টি খাইয়ে তাদের স্নেহভাজনদের মোটা, আরও মোটা, আরও আরও মোটা করতে। তখনও শুরু হয়নি রক্তপরীক্ষা। হার্টের অসুখ এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু একালে মোটা হওয়া বিপজ্জনক। পথে-ঘাটে, অফিসে বাজারে, চেনা-আধোচেনা যাঁর সঙ্গেই দেখা হোক, তিনি একটু ভুরু কুঁচকিয়ে নবারুণবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, আরে নবারুণবাবু যে, একদম চিনতেই পারিনি। সাংঘাতিক মোটা হয়ে গেছেন দেখছি! তারপর একটু থেমে কিছুটা অভিভাবকত্বের ভঙ্গিতে পরামর্শদান, এত মোটা হওয়া ভাল নয়। সাবধানে থাকবেন। মনে আছে। তো নগেনবাবুর ঘটনাটা। আর কিছুই নয়, উভয়েরই পরিচিত নগেনবাবু নামে এক ভদ্রলোককে বছরখানেক আগে রাস্তায় কুকুরে কামড়েছিল। শুভানুধ্যায়ীর বক্তব্যের সারমর্ম হল, নগেনবাবু অতটা মোটা না হলে দৌড়ে পালাতে পারতেন, পাগলা কুকুরের কামড় খেতে হত না, পেটে বড় বড় আঠারোটা ইঞ্জেকশন নিতে হত না।
মোট কথা এই যে নবারুণবাবু নিজে মোটা হয়ে যাওয়ার জন্যে চিন্তিত। ফলে তাঁকে স্থূলতা কমানোর জন্য বাধ্য হয়ে চেষ্টাশীল হতে হল।
ছাত্রজীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাজারে দেখা হলে তার পরামর্শে, বিশেষ করে ওষুধ-ফষুধ খেতে হবে না, তা ছাড়া ঘরের মধ্যেই স্কিপিং করা যাবে, এই সুবিধার কথা ভেবে নবারুণবাবু সেদিনের বাজারে কিছু পয়সা বাঁচিয়ে সেই পয়সা দিয়ে একটা ভাল স্কিপিং রোপ কিনে ফেললেন। বাড়িতে এসে কাউকে কিছু বললেন না।
কিন্তু স্কিপিং করার এত ঝামেলা একথা আগে কে জানত! নগেনবাবু থাকেন একটা পুরনো তেতলা বাড়ির দোতলায়। তার ভারী শরীর নিয়ে তিনি পরদিন সকালে শোয়ার ঘরে লাফাতে গেছেন। প্রথম লাফের শব্দে তার স্ত্রী চোখ খুলে আধো ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ দেখলেন, মালকোঁচা দিয়ে লুঙ্গি পরা নবারুণবাবু হাতে কী একটা লম্বা দড়ির মতো নিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন শূন্যে হাত তুলে। আগের দিন সন্ধ্যায় বাজার থেকে মাছ না আনায় নবারুণবাবুর সঙ্গে মালতীর, অর্থাৎ তার স্ত্রীর, খুবই কথা কাটাকাটি হয়েছিল। এখন স্বামীকে শূন্যে হাত তুলে ঘরের মধ্যে আধো অন্ধকারে দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে মালতী বুঝতে পারলেন নবারুণ মনের দুঃখে ও প্রচণ্ড অভিমানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুকের রক্ত হিম করা একটি সুতীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে উঠলেন।
এরপরে ঘটনার গতি অতি দ্রুত। আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে এল। রাস্তায় দুজন খবরের কাগজের হকার কাগজ বিলি করছিল বাড়িতে বাড়িতে, তারা ছুটে এল, তাদের সঙ্গে মাদার ডেয়ারির দুধের ছেলে এবং সঙ্গে একজন ভিখিরি, যে শেষ রাত থেকে করুণকণ্ঠে জানলায় রুটি ভিক্ষা করে, তারাও এল।
তা ছাড়া তিনতলা থেকে বাড়িওলা স্বয়ং নেমে এলেন। বাড়িওলার সঙ্গে আজ চার বছর মামলা চলছে নবারুণবাবুদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
সবাইকে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়ে বিদায় করা হল। কিন্তু বাড়িওলা চালাক লোক, তিনি স্কিপিং রোপ ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে সব টের পেলেন, একবার ট্যারা চোখে পেটমোটা নবারুণবাবুর দিকে এবং আরেকবার রঙ্কুটির দিকে তাকিয়ে সোজা থানায় ডায়েরি করতে গেলেন, স্যার আমার মোটা ভাড়াটে লাফিয়ে লাফিয়ে আমার পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলছে। বাড়ি ভেঙে পড়লে বহুলোক একসঙ্গে মারা পড়বে। মার্ডার কেস স্যার।
নবারুণবাবুর বাড়িওলা এর আগে আরও আটবার নবারুণবাবুর নামে থানায় ডায়েরি করেছেন, সুতরাং তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তার চেয়ে আমরা নবারুণবাবুর রোগ হওয়ার গল্প বলি।
স্কিপিং রোপের পয়সাটা জলে গেল। এই বয়সে রাস্তায় বা পার্কে স্কিপিং করা সম্ভব নয় অথচ বাড়িতে লাফালে বিপদ আছে, থানায় ডায়েরি করে রেখেছেন বাড়িওলা।
এদিকে আরও মোটা হয়ে চলেছেন নবারুণবাবু। কিছু একটা করা দরকার। রোগা হওয়ার বিষয়ে তিনটে ইংরেজি পেপার-ব্যাক বই তিনি পড়ে ফেলেছেন, অবশেষে মনস্থির করেছেন খাওয়া কমিয়ে শরীরের মেদ এবং ভুড়ি কমাবেন। অনেক পড়াশোনা করে নবারুণবাবু বুঝলেন শশাই একমাত্র খাদ্য, যাতে মোটা করার মতো কিছু নেই। সুতরাং শুধু শশা খেতে শুরু করলেন তিনি। দৈনিক দু কেজি করে শশা কিনতে লাগলেন।
সকালে দুধ চিনি ছাড়া এক পেয়ালা চা আর একটা শশা। দশটার সময় অফিস যাওয়ার মুখে একটা শশা সেদ্ধ, দুটো শশার সুপ। দুপুরে টিফিনের সময় আরেকটা শশা, এবার সামান্য একটু নুন দিয়ে। এর পরেও বিকেলে যদি খিদে লাগে তবে আরেকটা শশা। তারপরে রাতে শশার ডিনার। আবার শশা সেদ্ধ, শশার সরষে বাটা চচ্চড়ি, শশার ডানলা, অল্প একটু তেঁতুল দিয়ে শশার টক এবং সেই সঙ্গে লেবু লঙ্কা দিয়ে শশার স্যালাড।
দিন দশেক এই রকম সশঙ্কভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর নবারুণবাবু আর মানুষ রইলেন না। দু পায়ে হাঁটতে তার অসুবিধা হতে লাগল, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে পারলে ভাল হয়। যখন তার এই রকম অবস্থা, মালতী বাধ্য হয়ে ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার এসে সব দেখে শুনে বললেন, সর্বনাশ! এ বয়েসে এসব চলবে না। ভাল করে দুধ-মাছ-ডিম না খেলে কাজ করার শক্তি আসবে কী করে?
সুতরাং মালতী নবারুণবাবুর জন্যে কাজ করার শক্তি সরবরাহ করতে লাগলেন। অপর্যাপ্ত স্নেহপদার্থের সৌজন্যে এবং মালতীর রান্নার মাধুর্যে নবারুণের শরীর আরও উথলিয়ে উঠল। শশা খেয়ে যেটুকু অবনতি হয়েছিল, তার চারগুণ পুষিয়ে গেল।
এরপরে যা হবার তাই হল। রাস্তায় নবারুণকে দেখে পরিচিত ভদ্রজন চমকে চমকে উঠতে লাগলেন। দশ বছর আগের সেই পাতলা দোহারা মানুষটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মেদের সমুদ্রে। পুরনো রসিকতা আছে যে ওজনের যন্ত্রে একজন অতি স্থূলাঙ্গ পঁড়িয়েছে, কার্ড বের হল, এক সঙ্গে দুজন নয়, দয়া করে একজন একজন করে উঠুন। নবারুণবাবুর অবস্থা ঠিক তা না হলেও, পরপর কয়েকবার তার ওজনের কার্ডে, ওজনের সঙ্গে কার্ডে যে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে তাতে লেখা বেরোল, আপনার উন্নতি অনেকেরই চক্ষুশূলের কারণ হয়েছে।
এই ওজনের যন্ত্র বিষয়টিও খুবই রহস্যময়। মধ্যে শশা খাওয়ার সময় নবারুণবাবু প্রায় প্রতিদিনই এমনকী কোনও কোনও দিন প্রায় একাধিকবার ওজন দেখতে শুরু করেন। প্রায় নেশা হয়ে যায়। স্টেশনে, ডাক্তারখানায়, সিনেমা হলে যেখানেই ওজনের যন্ত্র দেখতে পান সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত চলে যায় একটা খুচরো দশপয়সা আছে কিনা? এই অভ্যাস এখন প্রায় স্থায়ী হয়ে গেছে। এর ফলে নবারুণবাবুর অভিজ্ঞতা হয়েছে বিস্তর। কোনও দুটো ওজনের যন্ত্রই কোনও সময় এক কথা বলে না। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বসুশ্রী সিনেমায় ওজন উঠল সাতাশি কেজি, পনেরো মিনিটের মধ্যে লেক মার্কেটের সামনের এক দোকানের মেশিনে সেটা কমে গিয়ে উঠল বিরাশি কেজি। তা ছাড়া সব মেশিনের গায়ে লেখা আছে, চাকা না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কোনও কোনও মেশিনে সেই চাকা আর থামে না। ঘুরছে তো ঘুরছেই। অতি দ্রুত বেগে তারপর ক্রমশ আস্তে, আস্তে আস্তে। নবারুণবাবু একবার একটা মেশিনের উপর একটানা আধঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলেন তবুও চাকা। ঘুরছে তো ঘুরছেই। শেষে আর ওজন নেওয়ার ধৈর্য রইল না, আর ওই চাকা ঘোরাকালীন ওজন নেওয়ার কোনও মানেই হয় না।
সে যাই হোক নবারুণবাবু ইতিমধ্যে আরও মোটা, আরও গোলগাল হয়ে গেছেন। তার নিজের মাথাতেই এবার দুশ্চিন্তা ধরেছে, কী করে সত্যি সত্যি হালকা হওয়া যায়। সত্যিই বেশ কষ্ট হচ্ছে। আজকাল। একটু হাঁটাহাঁটি করলেই হাঁফিয়ে পড়ছেন, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গেলে জিব বেরিয়ে যায়। কোথাও গেলে তারা একটু সচেতন ভাবে শক্ত চেয়ারটা এগিয়ে দেয়। রিকশাওলারা নবারুণবাবুর সঙ্গে দ্বিতীয় সওয়ারি রিকশায় তুলতে চায় না।
সুতরাং নবারুণবাবুকে আবার রোগা হওয়ার চেষ্টায় অবতীর্ণ হতে হল। কেউ কেউ বললেন, সকালবেলা ঘণ্টাখানেক জোরে জোরে লেকে হাঁটাহাঁটি করো, দেখবে শরীর থেকে মেদ ঝরে যাবে। নবারুণবাবুর বহুকষ্টে শেষ রাতে উঠে সেটা শুরুও করেছিলেন। কিন্তু একজন বন্ধুর কথায় একদিন তার ভুল ভেঙে গেল। সে বোঝাল, হাঁটছ হাঁটো। কিন্তু তাতে রোগা হওয়ার আশা কোরো না। বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদাহরণ দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে সে দেখাল লেকে গিয়ে দেখবে গত তিরিশ বছর এঁরা বাই বাই করে হাঁটছেন। অথচ এঁরাই কলকাতার সেরা মোটা লোক। তিরিশ বছর হেঁটেও এক ছটাক ওজন তো কমেইনি, সময় মতো যথাসম্ভব বেড়ে গেছে।
সুতরাং হেঁটে লাভ নেই। সকালে একঘণ্টা হাঁটা এবং তারপরে একঘণ্টা বিশ্রাম, শুধু শুধু দিনারম্ভেই দুটি অমূল্য ঘণ্টা নষ্ট। তার চেয়ে ওষুধ খাওয়া ভাল। অফিসে এক সহকর্মী একটা টোটকার কথা বললেন। লুই ফিশারের বইতে নাকি লেখা আছে, গান্ধীজি খেতেন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক চামচে লেবুর রস আর এক চামচে মধু। এই দুটি নির্দোষ পানীয় একত্রিত হলে। তার যে কী বিচিত্র, অবর্ণনীয় স্বাদ হয়, কী করে যে মহাত্মাজি দিনের পর দিন এই অভক্ষ্য গ্রহণ করতেন, ঈশ্বর জানেন। কিন্তু নবারুণবাবু সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ। এক চামচে লেবুর রস এক চামচে মধু একসঙ্গে খেয়ে প্রথমদিন নবারুণবাবুর হাত পা ঝিমঝিম করতে লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল। তারপর মিনিট দশেকের মধ্যে বমি হতে লাগল। আর খালি পেটে বমি করা যে কী ভীষণ কষ্ট তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। কলেজে পড়ার সময় নবারুণবাবু একবার বন্ধুদের সঙ্গে গঙ্গার ধারে বসে লুকিয়ে ব্র্যান্ডি খেয়েছিলেন, তাতেও সেই বয়েসে এতটা মাথা ঘোরেনি, এরকম বমি হয়নি।
অতএব অন্য পন্থা নিতে হল। তবে তাতে একটু খরচের ধাক্কা আছে। ঘনশ্যামবাবু বলে এক ভদ্রলোক বউবাজারে থাকেন। তিনি শক্তহাতে ম্যাসাজ করে ভুড়ি ও শরীরের জমানো মেদ ধোঁয়া। করে দেন। ঘনশ্যামবাবু মুচড়িয়ে টিপে দেওয়ার সময় ভুড়ি থেকে নীলচে আভা প্রায় ধোঁয়ার মতো, শীতের দিনে মুখ থেকে যেমন বেরোয়, প্রায় সেই রকম বেরোচ্ছে।
ঘনশ্যামবাবুর খাঁই একটু বেশি। সপ্তাহে একদিন আধ ঘণ্টার জন্যে মাসমাইনে দিতে হবে পঞ্চাশ টাকা। সেটা হল যদি তার বাড়িতে গিয়ে ম্যাসাজ করানো হয়। আর নিজের বাড়িতে ঘনশ্যামবাবুকে নিয়ে আসতে গেলে মাসে দেড়শো টাকা লাগবে।
দেড়শো টাকা অনেক টাকা। সুতরাং নবারুণবাবু ঘনশ্যামবাবুর বাসায় যাওয়াই মনস্থ করলেন। বউবাজারের গলির মধ্যে একটা একতলা বাড়ির উঠোনে টিনের চালার মধ্যে রাধেশ্যাম মেদনিধন ব্যায়ামাগার। রাধেশ্যাম হল ঘনশ্যামবাবুর বাবার নাম, তিনিই এই মেদনিধন প্রক্রিয়াটির আবিষ্কর্তা। রাধেশ্যামবাবু এখন স্বর্গত হয়েছেন, তবে জীবিত অবস্থায় এ অঞ্চলের অসংখ্য চিনে, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং বউবাজারের স্বর্ণকারদের ভুড়ি তার হাতের গুণে সমতল হয়েছিল।
ঘনশ্যামবাবুর হাতযশ নাকি আরও বেশি। ঘনশ্যামবাবুর নাম ও পেশা শুনলেই বেঁটেখাটো, কালো মোটা, গোলগাল যেরকম চেহারার কথা মনে ভেসে ওঠে তিনি সত্যিই সেইরকম দেখতে। তবে তিনি ন্যাটা, বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে তাঁর অসম্ভব জোর। কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিখিলবঙ্গ বাৎসরিক ব্যায়াম প্রদর্শনীতে তার বাঁধা প্রোগ্রাম ছিল-বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে একটা নতুন ক্রিকেট বল নিয়ে সেটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলা।
মেদনিধন ব্যায়ামগারে পৌঁছানোর পরে ভর্তি ফি পঞ্চাশ টাকা আর মাসমাইনে পঞ্চাশ টাকা মোট একশো টাকা দিয়ে শয্যাশায়ী হলেন নবারুণবাবু। শয্যা মানে কাঠের তক্তপোশের উপর কিঞ্চিৎ পুরনো ও ছেঁড়া পাটি। জামা-টামা খুলতে হল না, জামা আর গেঞ্জি পেটের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন ঘনশ্যামবাবু, তারপর ভুঁড়ির অর্ধবৃত্ত আস্তে আস্তে টিপে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে বললেন, না, এখনও নরম আছে, অসুবিধে হবে না। একেকজনের এমন শক্ত হয়ে যায়, অথচ তেল চকচকে পিছলে চামড়া, কিছুতেই ধরা যায় না–তখন অবশ্য আমরা ভুড়ির উপরে আঠালো মাটি মাখিয়ে নিই।
সুখের বিষয় নবারুণবাবুর ভুঁড়ির জন্যে আঠালো মাটি লাগল না। অল্প একটু আস্তে আস্তে টেপার পর ঘনশ্যামবাবু নবারুণের ভুড়ির নীচের দিকে বুড়ো আঙুল চেপে ধরে সামনের চার আঙুল দিয়ে ভুড়ির যতটা পারলেন গোল করে প্যাঁচ দিয়েছিলেন, তারপর শুরু করলেন আঁকি ও টান– আর সে কী কঁকি, সে কী টান! ভুঁড়ির থেকে ধোঁয়া উঠল কিনা, কে জানে, কিন্তু চোখে ধোঁয়া দেখতে লাগলেন নবারুণবাবু এবং কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান হারালেন।
ঘণ্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরে আসতে ঘনশ্যাম একগাল হেসে নবারুণকে বললেন, প্রথমবার ওরকম হয়, তাও তো আপনার তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরল। শ্যামচাঁদ আগরওয়ালা তো দুদিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
সমস্ত ঘটনা তখন নবারুণের সহ্য ও বুদ্ধির বাইরে। কোনও রকমে মিনমিন করে বললেন, দয়া করে আমাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিন।
ট্যাক্সি করে নবারুণ যখন বাড়িতে পৌঁছালেন তখন তার মুখ চোখের এবং শরীরের অবস্থা দেখে বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল। মালতী কপাল চাপড়াতে লাগলেন, মেয়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল। পাড়ার দুজন শক্তসমর্থ লোক এসে নবারুণকে কোলে করে দোতলার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এল। সবার প্রশ্ন, কী করে কী হল? নবারুণবাবু পেটে হাত দিয়ে দেখালেন, পেটব্যথা। সকলেই খুব অবাক হয়ে গেল, বাবা, কী সাংঘাতিক পেটব্যথা, হাত-পা পর্যন্ত নাড়তে পারছে না!
অবশেষে ডাক্তারও এল। এইরকম ভীষণ পেটব্যথা দেখে ডাক্তার যখন অতীব চমকিত হলেন, নবারুণকে বহু কষ্ট করে ডাক্তারকে বোঝাতে হল, পেটব্যথা ঠিকই, তবে পেটের ভেতর নয়, পেটের বাইরে ব্যথা।
এ কাহিনি আর বিস্তারিত করে লাভ নেই। দু-চারদিনের মধ্যে নবারুণবাবুর পেটব্যথার উপশম হবে। আবার রাস্তাঘাটে, অফিসে তিনি বেরোবেন। তার সঙ্গে আপনাদের দেখা হবে। দয়া করে তাকে আর রোগা হওয়ার পরামর্শ, উপদেশ দেবেন না। আহা মোটা মানুষ, মনের সুখে আছেন। ওঁর বাপ-ঠাকুর্দাও মোটা ছিলেন, সুখী ছিলেন। ওঁকে ছেড়ে দিন, আসুন আমরা কামনা করি, নবারুণকে রোগা হতে হবে না-নবারুণবাবু মোটা থাকুন, সুখে থাকুন।