৮
‘কৃষ্ণনগর’ নামটি কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নামানুসারে নয়।
নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার। তাঁর আদিনিবাস ছিল মাটিয়ারি গ্রাম। গ্রামটি অতি প্রাচীন। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে এই গ্রামটির উল্লেখ আছে—শ্রীমন্ত সওদাগরের সিংহল যাত্রার প্রসঙ্গে। বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই গ্রামে উৎকৃষ্ট কাঁসার বাসন তৈরী হত। এখন হয় কিনা জানি না, আমাদের বাল্যকালে সে গ্রামে—না, তখন আর সেটা গ্রাম ছিল না, গঞ্জই—সেখানে অসংখ্য কাঁসারিদের কাজ করতে দেখেছি। এই ভবানন্দ মজুমদারই কাশীর অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।
এই যে নদীয়া-রাজবংশ—যা কালে ফুলে-ফেঁপে বাঙলার ইতিহাসে চিহ্ন রেখে গেল, তার সূচনা কিন্তু একটি সামান্য ঘটনা থেকে। বালক ভবানন্দের সাহসিকতায়!
ভবানন্দ একদিন মাটিয়ারী গাঁয়ে গঙ্গাতীরে সমবয়সী কয়েকজন বালকের সঙ্গে খেলা করছে। হঠাৎ সবাই দেখতে পেল সৈন্য বোঝাই একটা নৌকা এসে ভিড়ল গঙ্গার ঘাটে। ওর বন্ধুবান্ধবেরা দুদ্দাড়িয়ে পালিয়ে গেল। চাণক্যবাক্য স্মরণ করে স্নানার্থীরাও তাড়াতাড়ি ঘাট ছেড়ে উঠে পালায়। দাঁড়িয়ে রইল একা ভবানন্দ। দ্বাদশবর্ষীয় বালক। বাহুবক্ষপাশ ভঙ্গিতে। যে ভঙ্গিতে তিনশ বছর পরে দেখা যাবে স্বামী বিবেকানন্দকে।
সৈন্যদলের সেনানায়ক ভাঙা ভাঙা বাঙলা বলতে পারে। সে বালকটিকে সকৌতুকে প্রশ্ন করে, কী হে? তুমি পালিয়ে গেলে না কেন?
—পালাব কেন? আপনারা বাঘ না রাক্ষস?
সেনাপতি জানতে চায়, বলতে পার খোকা, হুগলী বন্দর আর কত দূরে?
খোকা সেটুকু তো বলতে পারলও, ঐ সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় খবর সরবরাহ করল। ফৌজদার বালকের সাহস আর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তার অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। একটি পুরো দিন ওরা কাটিয়ে গেল মাটিয়ারিতে। তারপর অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে সেই বালকটিকে সঙ্গে করে নিয়ে চলল হুগলী। ভবানন্দ পিতার জ্যেষ্ঠপুত্র। পিতা রামচন্দ্র ভট্টাচার্যের বংশকৌলিন্য ছিল যথেষ্ট—আদিশূর তাঁর যজ্ঞসম্পাদন করতে কান্যকুব্জ থেকে যে ভট্টানারায়ণ মহোপাধ্যায়কে এনেছিলেন সেই বংশেরই সন্তান। কিন্তু তখন অর্থকৌলিন্য ছিল না। জ্যেষ্ঠপুত্রটিকে তার ভাগ্যান্বেষণে ঐ ফৌজদারের সঙ্গে যেতে দিলেন।
ফৌজদার তাকে নিয়ে এল সপ্তগ্রামে। অপুত্রক সেনানায়ক সযত্নে ভবানন্দের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করল—শাস্ত্রশিক্ষা, শস্ত্রশিক্ষা, রাজকার্য, ফারসীভাষা। অত্যন্ত মেধাবী ভবানন্দ। অচিরে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল সে।
কৈশোর-তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে ঐ ফৌজদারের প্রচেষ্টায় ভবানন্দ লাভ করলেন বাঙলার নবাব সরকারে কানুনগোর পদ এবং পরে মজুমদার উপাধি।
উদ্যোগী পুরুষের ভাগ্যে এমনটিই ঘটে। আকবর বাদশাহর মুগল-বাহিনী নিয়ে রাজপুত সেনাপতি মানসিংহ এসেছেন বঙ্গদেশে। বিরাট বাহিনী নিয়ে চলেছেন কপোতাক্ষ তীরে যশোর। বারো ভূঁইয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ নেতা যশোরাধিপতি প্রতাপাদিত্যের শাসন-মানসে। পথে নামল প্রচণ্ড বর্ষা। রাজপুতানার মানুষ। বঙ্গদেশের এ ভয়াবহ নিম্নচাপের, এই ঝড়-ঝঞ্জা আর অবিচ্ছিন্ন ধারাপাতের বিষয়ে কোনও ধারণা নাই।
বাল্যকালের সেই নাটকটিই পুনরভিনীত হল। মুগল সৈন্য আসছে শুনে গ্রাম-গঞ্জের মানুষ প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেছে। মানসিংহ ন্যায্য মূল্য দিতে প্রস্তুত—কিন্তু হাটে-বাজারে বিক্রেতার পাত্তা নেই। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য। প্রচণ্ড বিপদ! সেই সময়ে মুগল শিবিরে এসে সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করল এক অকুতোভয় স্থানীয় যুবক। সে জানালো—অর্থমূল্যে সে ঐ বিরাট বাহিনীর খাদ্যপানীয় সরবরাহ করতে পারবে। পুরো একটি সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হল মানসিংহকে। কিন্তু ভবানন্দ মজুমদারের ব্যবস্থাপনায় তাঁর সেনাবাহিনী অভুক্ত রইল না। এমনকি অশ্ব ও হস্তিযূথের খাদ্যও সরবরাহ করল সে। প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করে প্রত্যাবর্তনের পথে মানসিংহ ঐ যুবকটিকে সঙ্গে নিয়েই দিল্লীতে ফিরে গেলেন। তাঁরই সুপারিশে ভবানন্দ মজুমদার লাভ করলেন চতুর্দশ পরগণার শাসনাধিকার। সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফর্মান। কারণ সেটা শাহেনশাহ্ আকবরের দেহাবসানের পরের বৎসর—1606 খ্রীষ্টাব্দ।
ভবানন্দ ভট্টাচার্য হয়ে গেলেন, রাজা ভবানন্দ মজুমদার।
মাটিয়ারি গ্রামেই নির্মাণ করালেন রাজপ্রাসাদ।
তাঁর পৌত্র রাজা রাঘব মাটিয়ারি ছেড়ে গোয়াড়ি কৃষ্ণনগরে রাজধানী সরিয়ে আনেন। গ্রামটির পূর্বনাম: ‘রেউই’। রাজা রাঘবের পুত্র রুদ্র এই নতুন রাজধানীর নামকরণ করেন ‘কৃষ্ণনগর’। হেতুটি এই : রেউই-গ্রামে ছিল গোপদের বাস, তারা মহাসমারোহে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করত। রুদ্র রায়ের আমলে জমিদারী আরও বৃদ্ধি পায়; তিনি দিল্লীর বাদশাহকে সে আমলেই বিশ লক্ষ টাকা কর দিতেন। রুদ্রের পুত্র রঘুরাজ ছিলেন প্রখ্যাত ধনুর্ধর বীর। তখন মুর্শিদকুলি খায়ের আমল। বারাকোটির যুদ্ধে নবাবপক্ষ অবলম্বন করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দেন। রাজসাহীর বিদ্রোহী রাজা উদয়নারায়ণের সেনাপতি আলি মহম্মদকে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বহস্তে নিহত করেন—তীরবিদ্ধ করে। সাধারণের কাছে তিনি ‘রঘুবীর’ নামে পরিচিত। সেই রঘুবীরের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বে আমরা কাহিনীর নৌকা ভিড়িয়েছি। বস্তুত এ রাজবংশ-সূর্য ঐ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই মধ্যগগনে। তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রের আমল থেকে সে সূর্য পশ্চিমে চলেছে।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও স্বাভাবিকভাবে দোষে-গুণে মানুষ। মনে আছে, ছেলেবেলায় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে ক্লাইভের উপহার দেওয়া কামান দেখে আমরা নাক সিঁটকেছি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-বিপক্ষে যোগ দেওয়ায় তিনি ঐ কামানগুলি উপঢৌকন পেয়েছিলেন—লাভ করেছিলেন ‘মহারাজা’ খেতাব। সে-আমলে ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের প্রভাবে বাঙলার ঐ শেষ নবারটির প্রতি কিশোর মনে কিছু দুর্বলতা ছিল। তখনও বুঝবার বয়স হয়নি, কী মর্মান্তিক প্রয়োজনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বা রানী ভবানী সিরাজপক্ষে যোগ দিতে পারেননি।
কৃষ্ণচন্দ্র গোড়া ছিলেন, এ-কথা মানতেই হবে। আর সেই গোঁড়ামি যে অপকৌশলে জিইয়ে রাখতেন তা নিশ্চয়ই নিন্দনীয়। যেমন রাজা রাজবল্লভের বিধবা কন্যার পুনর্বিবাহের আয়োজন ব্যর্থ করে দেওয়া
রাজা রাজবল্লভ বৈদ্য—ব্রাহ্মণ নন। তাঁর অষ্টমবর্ষীয়া বিধবা কন্যাটির পুনর্বিবাহের জন্য তিনি প্রাণপাত করেছিলেন। সমাজপতি ব্রাহ্মণরাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মতিলাভের জন্য তিনি পত্র লেখেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে প্রত্যুত্তরে কিছু পণ্ডিতকে পাঠিয়ে দিতে বলেন কৃষ্ণনগরে বিচারের জন্য। রাজবল্লভ উৎসাহিত হয়ে কয়েকজন পণ্ডিতকে কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় পাঠিয়ে দিলেন। বিচার্য বিষয় : ‘অক্ষতযোনি বালবিধবার পুনর্বিবাহ শাস্ত্রসম্মত কিনা।
কৃষ্ণচন্দ্রের অন্যতম সভাপণ্ডিত রামগোপাল তর্কালঙ্কার রাজবল্লভ-প্রেরিত পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলেন। অনেক বিশিষ্ট পণ্ডিত সে-সভায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু অন্তিমে অপকৌশল প্রয়োগ করে ঐ সভাপণ্ডিত আরও কয়েকজন সহকারীর সাহায্যে প্রচার করলেন ‘বিধবাবিবাহ’ দেশাচারবিরুদ্ধ—শাস্ত্রে তার অনুমোদন নাই। মজার কথা, যে যুক্তিগুলি হেতু হিসাবে দেখানো হল, তা আদৌ ‘অক্ষতযোনি বালবিধবা সংক্রান্ত নয়, ‘যৌবনপ্রাপ্তা বিধবার পুনর্বিবাহ’। এ দুটি বিষয়ের পার্থক্য বুঝে নেবার মতো পাণ্ডিত্য নিঃসন্দেহে ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। কিন্তু তিনি জেনে-বুঝে সমাজপতি হিসাবে নিদান হাঁকলেন : বটেই তো! বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয়।
প্রশ্নটা ছিল : ‘অক্ষতযোনি বালবিধবার বিবাহ শাস্ত্রসম্মত কিনা’!
সমাজপতি জবাব দিলেন : যাবতীয় বিধবা বিবাহই অশাস্ত্রীয়!
যুক্তি হিসাবে দেখানো হল—পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃগণের ভিতর সম্পত্তি বণ্টন সম্ভবপর; ‘বৈপিত্রেয়’-ভ্রাতার উদ্ভাবনে সামাজিক জটিলতা অবশ্যম্ভাবী!
স্বতই প্রতিপ্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে; বিচারক মহাশয়! আপনি কি দুগ্ধপোষ্য শিশু?
সাত-আট বছরের একটি রাঙা-চেলির পুঁটুলিকে কনে-চন্দন পরিয়ে একরাত্রে তার কর্ণমূলে কিছু অংবং মন্ত্র শোনানো হল; তারপর একদিন তাকে বলা হল—তুই বিধবা হয়ে গেছিস!’—ব্যস! আজীবন বৈধব্যযন্ত্রণা! এই অনাচারকে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন রাজবল্লভ। কিন্তু তিনি বৈদ্য—ব্রাহ্মণ নন। তাই সমাজপতির অনুমতি চেয়েছিলেন। আর কৃষ্ণচন্দ্র সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন এই অজুহাতে—’বৈপিত্রেয় ভ্রাতার উদ্ভাবনে জটিলতা অবশ্যম্ভাবী!’
স্বীকার্য—রাজা রাজবল্লভ স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে এই সমাজ-সংস্কারের আয়োজন করে ছিলেন। পরবর্তী শতাব্দীর সেই বীরসিংহের পাগলের মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চাননি; কিন্তু তাঁর আচরণে নিন্দনীয় কিছু নেই।
কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের?
দোষ যেমন ছিল, গুণও ছিল। অসাধারণ গুণগ্রাহী, বিদ্যোৎসাহী।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গভূমে সংস্কৃত বিদ্যাচর্চা—বিশেষ করে গৌড়ীয় নব্যন্যায়ের বিকশন সবপর হয়েছিল একাধিক উদারমনা ভূস্বামীর অনুগ্রহে। ব্রাহ্মণকে সারস্বৎ আলোচনার সুযোগ দিয়েছেন তাঁরা অকুণ্ঠ বদান্যতায়—পুণ্যশ্লোক রানী ভবানী, উত্তরবঙ্গের একাধিক ভূস্বামী, বর্ধমান মহারাজ, রাজবল্লভ, শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব। তার ভিতর একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করেছিলেন—নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র।
সে আমলে একটি প্রবাদই চালু হয়ে গিয়েছিল : ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুগ্রহলাভ যে করেনি তার ব্রাহ্মণত্বে সন্দেহ জাগে!’
একটিমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম! তাঁর কথাই বলব এবার : রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত।
—‘বুনো’ রামনাথ!