১
নবদ্বীপ।
জননী জাহ্নবীর দুই আত্মজা—ভাগীরথী আর জলাঙ্গীর বিয়ে হল ভিন্ন ভিন্ন-গাঁয়ে। রাঙা চেলিতে কিশোরীতনু ঢেকে দুই চন্দন-চর্চিতা বালিকাবধূ গেল দু-মুখো, ঘর-সংসার করতে। তারপর যে-যার শ্বশুরঘরে গিন্নিপনা সেরে এ-গ্রাম সে-গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে একেবারে দুজনের মুখোমুখি!
‘ওমা! মুখপুড়ি! তুই হেথায় এলি কোত্থেকে?’ বলে এ-ওর গলা জড়িয়ে ধরল। সেই যে কথায় বলে না—’গাঙে গাঙে দেখা হয়, তবু বোনে বোনে হয় না!’—এ যেন সেই বিত্তান্ত। দেখা হতেই দুই বোন দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। হাপুস-নয়নে কান্না। কত সুখ-দুঃখের গপ্পো। তারপর পানের বাটা খুলে বললে, নে, পান খা!
দুই বোনের সেই মিলনস্থলটির নামই হল গিয়ে—নবদ্বীপ!
কোন্ বিস্মৃত অতীতে এই জনপদটি গড়ে উঠেছিল তা বাপু ভুলে বসে আছে বুড়ো ইতিহাস। শুধালে বলে, কী জানি বাপু, জান্নে!
কেউ বলে, দুই নদীর মিলনস্থলে রাখা সেই সোনার পানের বাটার উপরে জেগে উঠেছিল একটা চরা বা দ্বীপ। নতুন গজানো দ্বীপ বলে তার নাম ‘নবদ্বীপ’। আবার কেউ বলে, ছাই জান তোমরা—’নব’ মানে ‘নতুন’ নয়; এ হল গিয়ে ‘আটের-পরে-দশের-আগের’ নয়। ঐ নতুন-জাগা চরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক মহান তন্ত্রসাধক। লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি ওখানে বসে গুপ্ত সাধন-ভজন করতেন। সাঁজের বেলায় জ্বেলে দিতেন নয়টি প্রদীপ—নবগ্রহের উদ্দেশ্যে। সারারাত নদীকিনারে জ্বলত সেই নয়টি প্রদীপ। নদীপথে নৌকার যাত্রীরা ঘন আঁধারে তান্ত্রিককে তো দেখতে পেত না—দেখত শুধু অনির্বাণ শিখায় জ্বলছে নয়টি ঘৃতপ্রদীপ। তা থেকেই ঐ দ্বীপের নাম হয়ে গেল নব-দীপ, বা নবদ্বীপ।
সেন বংশীয় নৃপতি বল্লাল সেন এখানে বানিয়ে ছিলেন একটা জবর প্রাসাদ—একেবারে গাঙের কিনার সই-সই: ‘গঙ্গাবাস’। সেটা দ্বাদশ শতাব্দীর ঘটনা। ঐ প্রাসাদ থেকেই পরে মহম্মদ বতিয়ারের আক্রমণে বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন গঙ্গাযোগে পলায়ন করেন। তোমাদের যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে এখনো গিয়ে দেখে আসতে পার—সেই গঙ্গাবাসের দু-দশখানা ছোট মাপের পাতলা বাঙলা ইট—গাঙের পুবপারে। ঐ যে এখন জমজমাট মায়াপুর আশ্রম হয়েছে তার মাইল -খানেক উত্তরে—বামুনপুকুর গাঁয়ে। তবে আমার কথা শুনে অতদূরে গিয়ে যদি দেখ সবই ভোঁ—ভাঁ, তাহলে আমাকে দোষ দিও না বাপু! বিশ্বাস কর, আমাদের হাফ-প্যান্ট-পরা যুগে—বিশ-ত্রিশের দশকে তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি!
এখন হয়তো কিছুই নেই, পরে একথা লোকে বিশ্বাস করবে না। তাই আমাদের শিশুকালে কী ছিল তাই বরং লিপিবদ্ধ করে যাই—
প্রাচীন মায়াপুর থেকে আধমাইলটাক উত্তরে বামুনপুকুর গাঁ। সেখানে কোন পুকুর দেখেছি কিনা মনে নেই, তবে চাঁদকাজীর সমাধি ছিল। আর সেই সমাধির ঠিক পাশে ছিল প্রকাণ্ড—অতি প্রকাণ্ড একটা গোলক-চাঁপার গাছ। আজও যদি সেটা বেঁচে থাকে, তবে চাঁদকাজীর সমাধিটা খুঁজে নিতে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। এত বড় গোলকচাঁপার গাছ তোমার কখনো দেখনি। ভাল কথা, চাঁদকাজীকে চিনতে পারলে তো? তাঁর আসল নাম মৌলানা সিরাজউদ্দীন। তাও চিনতে পারলে না? বলি শোন, গৌড়েশ্বর হুসেন শাহ্র নামটা শুনেছ তো? সেই যিনি ফতোয়া জারী করেছিলেন—শ্রীচৈতন্যদেব নগর সংকীর্তন করতে পারবেন না। এই চাঁদকাজী ছিলেন সেই হুসেন শাহ্র শিক্ষক। তাঁরই মোক্তবে পড়তে যেতেন হুসেন শাহ্। কী পড়তেন? শোন বলি : মোক্তবে তখন তিনজাতের শিক্ষা দেওয়া হত। প্রথমত ‘তাবি’, অর্থাৎ ভৌত-বিজ্ঞান, দ্বিতীয়ত ‘রিয়াজি’—তার মানে হল গিয়ে অঙ্ক আর অলঙ্কার শাস্ত্র। শেষ ‘ইলাহি’–ধর্মতত্ত্ব, অল্লাহ্র উপাসনা। এ তিন বিদ্যা আয়ত্ত না করলে মুসলমান সমাজে ‘আলিম’ হওয়া যেত না।
চাঁদকাজী ‘মোছলমান’, কিন্তু ভক্ত বৈষ্ণবেরা সে আমলে ঐ সমাধি প্রদক্ষিণ করে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করতেন, চিরাগ জ্বেলে দিয়ে যেতেন। ঐ চাঁদকাজীর শিক্ষার বনিয়াদ ছিল বলেই না হুসেন শাহ্ শেষ-মেশ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের মহিমা।
সমাধি মন্দিরের কিনার-ঘেঁষে মৌলানা সিরাজউদ্দীনের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।
অদূরেই ‘বল্লাল ঢিবি’।
প্রায় সওয়া শ মিটার দীর্ঘ আর তিনতলা সমান উঁচু। দূর থেকে মনে হয় একটা প্রাকৃতিক টিলা। আসলে তা গঙ্গাবাসের ধ্বংসস্তূপ। এখন এলাকাটা পুরাতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বে সংরক্ষিত। আমরা ওখানেই দুদশখানা পাতলা বাঙলা-ইট দেখেছি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। তোমরা পথ চিনে চিনে অকুস্থলে পৌঁছে হয়তো এখন দেখতে পাবে শুধু সেই নীলরঙা বোর্ডে পরিচিত সাদা হরফের একটা বাঁধা বয়ান। ইংরাজী ভাষার ‘লুটিশ’—যার বয়ান লর্ড কার্জনের :
এই স্থান সংরক্ষিত!
শ্রীচৈতন্যদেবের প্রায় সমকাল থেকে বাঙালী মনীষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে নবদ্বীপ। তার দুটি ধারা—যেন ভাগীরথী আর জলাঙ্গীর মিলন। জলাঙ্গী—নব্যন্যায়; আর ভাগীরথী
জলাঙ্গী—নব্যন্যায়; চৈতন্যভাবধারা। দ্বিতীয় ভাবধারার সঙ্গে আমরা সুপরিচিত—তাই নব্যন্যায় চর্চার কথাই বলি—
প্রাক-চৈতন্যযুগ থেকেই বেদান্তের অনুশীলন হত—শঙ্করাচার্যের মায়াবাদকে খণ্ডনের একটা প্রবণতা দেখা যেত। এ অঞ্চলে ন্যায়-বৈশেষিকের প্রাধান্যের ফলে। আদি শঙ্করাচার্যের গুরু গোবিন্দপাদের গুরুদেবের নামই ছিল ‘গৌড়পাদ’। নামেই হয়তো পরিচয়, তিনি ছিলেন—গৌড়জন। গৌড়ীয় নব্যন্যায়ের চর্চা যদিচ প্রাগ্বর্তীকাল থেকেই অন্তঃসলিল ধারায় প্রবাহিত ছিল, তবু তা ভীমনাদিনী হয়ে উঠল বাসুদেব সার্বভৌমের (জন্ম আনুমানিক : 1420) সময় থেকে। বাসুদেব এবং তাঁর সুযোগ্য শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণি (জ-আ : 1455) এ ধারার যুগ্ম-ভগীরথ। এবং স্মার্ত রঘুনন্দন।
ন্যায়শাস্ত্রের প্রধান গ্রন্থ মহর্ষি গৌতম বিরচিত ন্যায়সূত্র। পরে ঋষি বাৎস্যায়ন রচনা করেন তার ভাষ্য, আর তারও পরে উদ্দোতকর প্রণয়ন করেন ন্যায়ের টীকা-টিপ্পনী। নব্যন্যায়ের চর্চা প্রধানত সীমিত ছিল মিথিলায়। গৌড়ীয় বিদ্যার্থীকে ঐ জ্ঞান আহরণের জন্য মিথিলায় যেতে হত। কী-ভাবে সেই নব্যন্যায় মিথিলা থেকে নবদ্বীপে আসে তা নিয়ে কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। কাহিনীর নায়ক কোথাও বাসুদেব সার্বভৌম, কোথাও বা তাঁর শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণি। নায়ককে সনাক্ত নাই বা করলাম, গল্পটা শোন—
গৌড়ীয় পণ্ডিত নব্যন্যায় অধ্যয়ন করতে মিথিলায় এসেছেন। মিথিলার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্রের চতুষ্পাঠীতে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করে স্বহস্তে রচনা করলেন নানান টীকা-টিপ্পনী। শিক্ষা সমাপনান্তে যখন তিনি গুরুর কাছে বিদায় চাইলেন তখন পক্ষধর মিশ্র বললেন, ও কী বাবা! তোমার ঐ পুঁথিগুলি তো তুমি গৌড়ে নিয়ে যেতে পার না। গৌড়ীয় পণ্ডিত সবিস্ময়ে বলেন, কেন গুরুদেব? এগুলি তো আমার স্বহস্ত-লিখিত পুঁথি! এ তো আমার নিজস্ব সম্পদ?
গুরু বললেন, সে-কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এগুলি যদি তুমি গৌড়মণ্ডলে নিয়ে যাও তাহলে ভবিষ্যতে তো সেখান থেকে আর কোন শিক্ষার্থী মিথিলায় আসবে না। আমি কী ভাবে সজ্ঞানে আমার মাতৃভূমি মিথিলার সর্বনাশ করি?
শিষ্য বলেন, যুক্তিপূর্ণ কথা। সে-ক্ষেত্রে আমাকে এ গুরু-গৃহে আরও এক সপ্তাহকাল বসবাসের অনুমতি দিন।
গুরু সহাস্যে বলেন, এক সপ্তাহ কেন, বাবা? তুমি স্বীকৃত হলে মিথিলারাজের কাছ থেকে উপযুক্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি আজীবন মিথিলাবাসী হয়ে থাকতে পার।
তরুণ পণ্ডিত স্মিত হেসে বলেন, তা কেমন করে হবে, গুরুদেব? আমিও তো সজ্ঞানে আমার মাতৃভূমি নবদ্বীপের সর্বনাশ করতে পারি না।
সপ্তদিবস-রজনী শিষ্য ঐ চতুষ্পাঠীর এক রুদ্ধদ্বার গৃহে তাঁর রচিত টীকা-টিপ্পনী আদ্যন্ত কণ্ঠস্থ করে ফেললেন। বিদায়কালে যখন রিক্তহস্তে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন নব্যন্যায়ের বিভিন্ন সূত্র ও ব্যাখা তাঁর মস্তিষ্ক-মঞ্জুষায় থরে থরে সাজানো।
গৌড়ীয় বিদ্যার্থীকে অতঃপর নব্যন্যায় চর্চার জন্য মিথিলায় যেতে হত না।
এই প্রচলিত কাহিনীর অনুপ্রেরণাতেই সতেন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাঙালী’ কবিতায় লিখেছিলেন, …পক্ষধরের পক্ষশাতন করি/বাঙালীর ছেলে ফিরে এল ঘরে যশের মুকুট পরি।’
কারও মতে ঐ নবীন গৌড়ীয় পণ্ডিত স্বয়ং বাসুদেব সার্বভৌম। সেটি ভ্রান্ত হতে বাধ্য। কারণ তিনি পক্ষধর মিশ্রের সমসাময়িক পণ্ডিত এবং পিতা নরহরি বিশারদের নিকটেই নব্যন্যায় শিক্ষা করেন—জীবনে কখনো মিথিলা যাননি। পুরী গেছেন, বারাণসী গেছেন, মথুরা-বৃন্দাবন পরিক্রমা করেছেন; কিন্তু মিথিলা নয়।
কারও মতে এ কাহিনীর নায়ক রঘুনাথ শিরোমণি, যাঁর আর এক নাম ‘কাণভট্ট’ শিরোমণি। তিনি বাসুদেব সার্বভৌমের শিষ্য; তাঁর একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি ছিল না বলেই ঐ নাম। তিনিও কিন্তু পক্ষধর মিশ্রের কাছে নব্যন্যায় শিখতে যাননি।
তার মানে কি সত্যেন দত্ত ওটা ভুল লিখেছেন? পক্ষধরের পক্ষশাতন কোন বাঙালী পণ্ডিত করেননি? না, সেটাও ঠিক নয়। করেছিলেন। অযোধ্যা নয়, বাল্মীকির মনোভূমিই যেমন শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান, ঠিক তেমনি ঐ খণ্ডকাহিনীটি প্রচলিত প্রবাদ হওয়া সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবেশিত কাব্যসত্য ঋত! সেই সত্যকাহিনীটি এবার বলি—
নব্যন্যায়ের এক জটিল তত্ত্বের সমাধান হচ্ছিল না। মৈথিলী পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে দ্বিমত তখন মিথিলারাজ এক মহতী বিচার- সভার আয়োজন করলেন। একপক্ষে মৈথিলী বিদ্বৎসমাজের শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক পক্ষধর মিশ্র, অপরপক্ষে নবদ্বীপপন্থী গৌড়ীয় পণ্ডিতেরা। মিথিলারাজের নিমন্ত্রণ এসে পৌঁছাল নবদ্বীপের পণ্ডিতসমাজের মধ্যমণি বাসুদেব সার্বভৌমের নিকট। বাসুদেব স্বয়ং সে বিচার-সভায় গমন করলেন না। পাঠিয়ে দিলেন নিজের প্রিয় শিষ্য রঘুনাথ শিরোমণিকে। তাঁর সঙ্গে আর দুই পণ্ডিত—কুশদহ বিদ্বৎসমাজের জনৈক তর্কসিদ্ধান্ত—যার পূর্ণ পরিচয় সংগ্রহ করতে পারিনি, আর নলদ্বীপ ভট্টাচার্য বংশীয় বিষ্ণুদাস সিদ্ধান্ত।
বিচার্য বিষয়টা যে কী, তা বুঝবার মতো বিদ্যে আমার নেই। একটি উদ্ধৃতি শুধু পরিবেশন করতে পারি, মহাপণ্ডিত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের “বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান (১ম)” গ্রন্থ থেকে। দেখুন, আপনারা ধরতাইটা ধরতে পারেন কি না—“বিচার্যের বিষয় ছিল সামান্য লক্ষণা-নামক ন্যায়শাস্ত্রসম্মত অলৌকিক সন্নিকর্ষ।”
ঘটনাটা 1480-85-এর ভিতর।
স্বয়ং বাসুদেব সার্বভৌমের পরিবর্তে গৌড়মণ্ডল থেকে তিন-তিনজন নব্যপণ্ডিত উপস্থিত হয়েছেন দেখে ক্ষুব্ধ হলেন মহাপণ্ডিত পক্ষধর মিশ্র। যদিচ তিনি পূর্বপক্ষের দলপতি, তবু তাঁর শিষ্যত্রয়ীকে ঐ গৌড়াগত উত্তরপক্ষের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বললেন। স্বয়ং নীরব শ্রোতার ভূমিকা অবলম্বন করলেন।
কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, মিথিলাপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে এর পর পক্ষধর মিশ্র স্বয়ং বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। কিন্তু রঘুনাথ শিরোমণির ক্ষুরধার যুক্তিতে তাঁর সমস্ত যুক্তিই ভেসে গেল। পক্ষধর সংযম হারালেন! তিনি ছিলেন স্বভাব কবি—শেষ পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি রঘুনাথের উদ্দেশ্যে একটি শ্লেষাত্মক শ্লোক রচনা করে তাঁকে আক্রমণ করলেন-
“বক্ষোজপানকৃৎ[১] কাণ[২]! সংশয়ে জাগ্রতি স্ফুটং।
সামান্যলক্ষণা কস্মাদকস্মাদবলুপ্যতে।।”
[১. বক্ষোজপানকৃৎ= যে বুকের দুধ খায়, অর্থাৎ দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র
২. কাণ = কানা।]
তৎক্ষণাৎ ন্যায়াধিশ বিচারক তর্কযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে বলে ঘোষণা করলেন। বললেন, মৈথিলী বৃদ্ধ পণ্ডিত নিজ স্বীকৃতিমতে পরাজিত! কারণ তাঁর যুক্তিতর্ক আর নৈর্ব্যক্তিক নয়। তা তরুণ উত্তরপক্ষ অবলম্বনকারীদের প্রতি প্রযুক্ত অহৈতুক কটুভাষা মাত্র। ব্যক্তিগত আক্রমণ!
এটিই হল কবি সত্যেন্দ্রনাথের ঐ অনবদ্য পংক্তিটির যাথার্থ্য!
বাসুদেব সার্বভৌম পরে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্মের দ্বৈতবাদ স্বীকার করে নেন তিনি তত্ত্বচিন্তামণির এক অনবদ্য টীকা রচনা করেন। রঘুনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘অনুমানদীধিতি। পরবর্তীকালে জগদীশ তর্কালঙ্কার (জ:আ:1540) নব্যন্যায়ের আর এক স্তম্ভ। এঁর আর একটি কীর্তি: চৈতন্যদেবের প্রভাবে তিনি আচণ্ডালকে শিষ্যত্বদানে পরান্মুখ হননি। বাস্তবে তাঁর কয়েকজন প্রখ্যাত শূদ্র শিষ্য ছিলেন। আরও অর্ধশতাব্দী পরে গদাধর ভট্টাচার্য, হরিদাস ন্যায়ালঙ্কার, মথুরানাথ তর্কবাগীশ প্রভৃতি নবদ্বীপের উজ্জ্বল রত্ন। মধুসূদন সরস্বতী বোধ করি অদ্বৈতবাদের তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ প্রচারক। তাঁর নামে একটি বহুল প্রচারিত শ্লোক আজও শোনা যায়—
“সরস্বত্যাঃ পারং বেত্তি মধুসূদন সরস্বতীঃ
মধুসূদন সরস্বত্যাঃ পারং বেত্তি সরস্বতীঃ।।”[১]
[১. বাগদেবীর জ্ঞানের সীমান্তে যেমন উপনীত হতে পেরেছিলেন মধুসূদন সরস্বতী, তেমনি মধুসূদনের জ্ঞান-সীমার পরিমাপ একমাত্র বাগদেবীরই পক্ষে করা সম্ভব।]
নবদ্বীপ-গৌরবের দ্বিতীয় ধারাটি চৈতন্য-আশ্রয়ী। সে তথ্য সর্বজনবিদিত। শ্রীচৈতন্যের স্মৃতি-বিজড়িত কত-কী আছে নবদ্বীপে, মায়াপুরে, শান্তিপুরে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান যে নবদ্বীপধাম, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। প্রশ্ন : সেটি কি গঙ্গার পশ্চিমপারে? অথবা পূর্বে, জলাঙ্গী নদীর উত্তরে? যুক্তিগ্রাহ্য মত—চৈতন্যদেবের জন্মস্থান ঐ মায়াপুর। এ মতের পিছনে বহু পণ্ডিত, ভক্ত এবং পুরাতত্ত্ববিদদের সমর্থন। প্রাচীন ইতিহাস আর বৈষ্ণব গ্রন্থমতে নবদ্বীপ গঙ্গার পূর্বতটে অবস্থিত। গঙ্গার পশ্চিম তীরস্থ জনপদকে মনে হয় প্রাচীন নবদ্বীপ মণ্ডলের অন্তর্গত কোলদ্বীপ বা ‘কুলিয়া-পাহাড়পুর’। ভুললে চলবে না ভাগীরথীর মূল জলধারা তখন ভিন্ন খাতে বইত—জলাঙ্গী, মাথাভাঙা, গড়াই, ইছামতি তখন ছিল দুর্বার। ক্রমে তা পদ্মার পথ খুঁজে নেয়। পরম বৈষ্ণব নরহরি চক্রবর্তী বা ঘনশ্যাম দাস—যিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে, আর শ্রীরূপ গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত গোবিন্দজীর ভোগ নিজে হাতে রান্না করতেন—তিনি তাঁর সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘ভক্তি-রত্নাকরে’ লিখে গেছেন—
“নবদ্বীপ মধ্যে মায়াপুর নামে স্থান।
যথা জন্মিলেন গৌরচন্দ্র ভগবান।।
যৈছে বৃন্দাবনে যোগপীঠ সুমধুর।
তৈছে নবদ্বীপে যোগপীঠ মায়াপুর।।”
চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কাশীর দণ্ডী সমাজের নেতা প্রকাশানন্দ সরস্বতী—যাঁকে মহাপ্রভু নতুন নাম দিয়েছিলেন ‘প্রবোধানন্দ সরস্বতী—তিনি তাঁর ‘নবদ্বীপ শতক’ গ্রন্থেও এই মায়াপুরের নাম উল্লেখ করেছেন।
এই সব বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞাত ছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। এই সব তীর্থ স্বচক্ষে দেখবেন, তাদের যাথার্থ্য বিচার করবেন—এমন মনোবাসনা নিয়ে তিনি চলেছেন নবদ্বীপে।
.
আমাদের কাহিনীর কালে নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স বত্রিশ বৎসর। তখনো তিনি ‘মহারাজ’ হননি। সে খেতাব পেয়েছিলেন পরবর্তী দশকে, সিরাজ-বিতাড়ন নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করায়। প্রজানুরঞ্জন, গুণগ্রাহী, নিজে সংস্কৃত ও ফারসী ভাষায় সুপণ্ডিত, শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী এবং বিদগ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ। কিন্তু কূটকৌশলী, প্রাচীনপন্থী, আর আদিরসের দিকে তাঁর ঝোঁক। নবদ্বীপ থেকে তাঁর রাজধানী প্রায় সাত ক্রোশ দূরে—’গোয়াড়ি-কৃষ্ণনগর’। গোয়াড়ি গ্রামের নামটা যুক্ত করতে হয় ‘খানাকুল-কৃষ্ণনগর থেকে পৃথক করতে।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গুণগ্রাহী অতি ব্যাপক অর্থে। ন্যায় ও বেদান্তের পণ্ডিত, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কুস্তিগীর, লাঠিয়াল, মৃৎশিল্পী, হাস্যরসিক—প্রভৃতি সকলেই তাঁর অনুগৃহীত। আকবর বাদশাহের মতো তাঁর সভাতেও নবরত্নের প্রভা! স্মার্ত রঘুনন্দনের বংশধর হরিরাম তর্কালঙ্কার, অদ্বৈতাচার্যের অধস্তন পুরুষ শান্তিপুর বিদ্বৎসমাজের তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত গোস্বামীপাদ রাধামোহন বিদ্যাবাচস্পতি, নবদ্বীপের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক শঙ্কর তর্কবাগীশ তাঁর রাজসভার তিন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। কালীভক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন এর পদ্মরাজ-মণি। আর পেঁড়ো-ভুরশুটের সেই বাণীর বরপুত্র—রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র সে সভার কমলহীরে! আকবর-দরবারে বীরবলের প্রতিচ্ছায়া ঘূর্ণী গ্রাম নিবাসী হাস্যার্ণব গোপালচন্দ্র ভণ্ড!
এসব তথ্যই মোটামুটি জানা ছিল রূপেন্দ্রনাথের। এঁদের সকলের খ্যাতি-তখন গোটা রাঢ়খণ্ডে বিস্তৃত। তিনি এসব কথা আরও বিস্তারিতভাবে শুনেছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু মহাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছে। তিনিও ঐ কৃষ্ণচন্দ্রের বৃত্তিভোগী—যদিও তিনি কৃষ্ণনগর রাজসভায় কদাচিৎ পদধূলি দিতেন। বস্তুত তিনি ছাড়াও রাঢ়খণ্ডের অনেকানেক পণ্ডিত ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বৃত্তিভোগী। যেমন হুগলি গুপ্তিপাড়ার রামদেব তর্কবাগীশের সুযোগ্য পুত্র বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। তিনি প্রায়ই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আহ্বানে কৃষ্ণনগরে তাঁর সভা অলঙ্কৃত করতে আবির্ভূত হতেন। তিনি মুখে মুখে কবিত্বপূর্ণ সংস্কৃত শ্লোকে ‘পাদপূরণ’ করতে পারতেন। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর উদ্যোগে বাঙলাদেশের তদানীন্তন প্রধান কয়েকজন স্মার্ত পণ্ডিতের প্রচেষ্টায় যখন ‘বিবাদার্ণবসেতু’ সংকলন-গ্রন্থ রচিত হয়, তখন বাণেশ্বর তার প্রধান রূপকারের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।