নদীর মতো জীবন বইতেই থাকবে

নদীর মতো জীবন বইতেই থাকবে

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে শিল্পী যখন গানে বসেন, তখন তাঁর হাতে অথবা তাঁর শিষ্যের হাতে থাকে একটি তানপুরা, সুরে বাঁধা। মিনিট পাঁচেক যন্ত্রটি ম্যাও ম্যাও করে। গায়ক চোখ বুজিয়ে সুরের মেজাজ তৈরি করেন। তারপর গলা খোলেন। রাগ রাগিনীর প্রবাহ বেরিয়ে আসে।

সকালের সংবাদপত্র আমাদের তানপুরা। দিনের রাগিনীর মেজাজ তৈরি করে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযুদ্ধে নামিয়ে দেয়। রাগের নাম আতঙ্ক। গতকাল দুটো বাসে রেষারেষি চলছিল। দক্ষিণেশ্বরের ব্রিজের কাছে একটা শুয়ে পড়ল। কয়েকটি মানব-ছারপোকা চেপ্টে গেল। হাঁড়ি শিকেয় উঠল। ছেলের স্কুল বন্ধ হল। স্ত্রীর কপাল পুড়ল। বৃদ্ধ পিতার ওষুধ বন্ধ হল। বাড়িওয়ালার মেঘ-গর্জন শুরু হল। পার্কস্ট্রিটে সুন্দরী ষোড়শীদের নাচ বন্ধ হবে না। কলকাতার নামি ক্লাব থেকে যথারীতি তিন ঠেলা খালি বোতল বেরিয়ে আসবে। চকচকে মোটর গাড়ির পেছনের আসনে এলিয়ে থাকবে শেষ রাতের বিশাল স্বপ্ন। ধমনীতে হুইস্কির স্রোত। ওয়েটার তাঁর ইউনিফর্মের পকেট ঝেড়ে যে টিপস বের করবেন। সেই টাকায় ওই ছেলেটির এডুকেশান হয়ে যেত হয় তো। সমাজ খুব কঠিন নিয়মে চলে। যে যার, সে তার। যার দু:খ, তার দু:খ। যার বিপদ, তার বিপদ।

এত মৃত্যু, তবু বাসে-বাসে, মিনিতে-মিনিতে রেষারেষি হয় কেন? তার কারণ যাঁরা চালক তাঁরা বহু জনম আগে ‘রোমান’ ছিলেন। ‘চ্যারিয়ট রেস’ করতেন। সেই সংস্কার কাজ করছে। একটা বাস আর একটা বাসকে দেখলেই অতীতের স্মৃতি ফিরে আসে। রাজেন হয়ে গেল রোমের হিরো পেলিউস। ব্রজেন হয়ে গেল টাইডিউস। ঝঝঝড়ে বাস, ছত্রিশবার রিট্রেড করা টায়ার, খলখলে স্টিয়ারিং, হয়ে গেল রথ। কন্ডাকটারের চেল্লানি, যাত্রীদের উসকানি। লড়ে যাও মুন্সি, লড়ে যাও। যা: উলটে গেল। যা: মরে গেল। ধুর মশাই ঘটি-বাটি-গেলাস উলটে যায়, দেবতা হওয়া সত্বেও গণেশ উলটে যায়। বাস ওলটাবে না।

সুন্দরবনে মধু পাড়তে গিয়েছিল মউলিরা। একজনকে বাঘে ধরেছে এ তেমন কিছু নয়। প্রথমে ঘাড়ের কাছটা ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরবে, তারপর হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাবে তার মনোমতো জায়গায়। সেখানে শুদ্ধ বাংলায় পরিতোষ সহকারে আহার করবে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার। তারিয়ে তারিয়ে খাবে। খেপে খেপে খাবে। হাড় চিবোবে ডাঁটার মতো। অ্যাটেন্ডন্ট ফেউরা দূরে দূরে বসে থাকবে। অবশিষ্টের আশায়। মামার প্রসাদ।

পুলিশে ধরলে কী হয়? যাকে ধরে সেই জানে। খোল-নলচে আলাদা হয়ে যেতে পারে। চিরকালের মতো ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে যেতে পারে। পুলিশের রাগ সাংঘাতিক রাগ। আগে পুলিশ অ-পুলিশকে পেটাত। বৈজ্ঞানিক পিটুনি, অবৈজ্ঞানিক পিটুনি। পরিবেশ দূষণের ফলে কী যে হল। পুলিশ পুলিশের নাক চেপ্টে দিল, চোয়াল উপড়ে দিল। লণ্ডভণ্ড লঙ্কা কাণ্ড। পুলিশ সবাইকে ধরে, এইবার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া পুলিশকে ধরছে। মশাইকে হাজতে পাঠানো যায়, মশাকে কে হাজতে পাঠাবে।

 ট্রেন মাঝে মাঝেই উলটে যাচ্ছে। আহা বয়েস হয়েছে। ইংরেজরা সেই কবে লাইন পেতে ধোঁয়া ভসভস ট্রেন ছেড়েছিল। শ দুয়েক বছর বয়েস তো হল! বৃদ্ধ মানুষ উলটে যাবে, ডিগবাজি খাবে, এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। একজন বললেন, ট্রেন ওলটালে ওলটাক, আপনি শক্ত করে ধরে বসে থাকুন। জিগ্যেস করলুম, কাকে ধরব? তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, নিজের ভাগ্যকে। রাখে কেষ্ট মারে কে? মারে কেষ্ট রাখে কে? সবাই কি আর শেষ পর্যন্ত যেতে পারে!

ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়ি আসার কী হবে? আসবেন না। ওইখানেই বসে থাকবেন। আলু, পটল, পেঁয়াজ, কপি কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন। বউদি! দাদাকে অনেকদিন দেখতে পাচ্ছি না কেন? দাদা তো ব্যাংকে আছে, টাকা তোলা আর দাঁত তোলা প্রায় একই ব্যাপার। তোলার পরই যন্ত্রণা। না তুললেই হয়। সেই গানে আছে, ঘরে ঘরে যাব ভিক্ষা মেগে খাব।

প্রথমে হল ‘মিছিলের’ জাত, এইবার হবে ‘ভিখিরির’ জাত। মানুষের সংসার কীভাবে চলছে কে জানে? কিছুই তো নেই। দশটা-পাঁচটার চাকায় যাঁরা ফিট হয়ে আছেন, সেই চাকায় নতুন কেউ ফিট হবেন না। জোচ্চুরি ছাড়া কোনও ব্যাবসা নেই। বিড়িও জাল হচ্ছে। শ্বশুরমশাই বর পণ দিয়েছিলেন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা। আর একটু হলেই জামাই বাবাজীবনের হাজতের কম্বলে ফুলশয্যা হচ্ছিল। কারণ, পুরো বান্ডিলটাই জাল। এই মাল পেলেন কোথা থেকে? ধার। যান ধারের বান্ডিলে ধার শোধ করে আসুন। শ্বশুর মশাইয়ের হাজতবাস হল।

বললে, সে কীরকম, ধার দাতা নোটের কেতা দেখে চিনে ফেলেছেন তাঁর মাল তাঁর কাছেই ফিরে এসেছে। ভেবেছিলেন জালি নোট আসলি হয়ে ফিরে আসবে। ঘাতককে অম্লানবদনে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। মানুষ এতটা শয়তান হতে পারে? কেন পারে না? শয়তান আর ভগবান একই রকম দেখতে। বোঝো ঠ্যালা।

তা না হলে এমন ঘটনা ঘরে কী করে? পার্টির কাজকর্ম সেরে নেতা বাড়িতে এলেন। পোশাক পালটে ঘড়ি দেখে স্ত্রীকে বললেন—নটা যখন বেজেই গেছে রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাক। এমন সময় তিন চারটে মানুষ ঢুকল। একজন বললে, বা:। দাদা, বউদি একই সঙ্গে রয়েছেন, কী বরাত! বিজয়া আর দীপাবলী একই সঙ্গে হোক। জয় মা কালী পাঁঠাবলি!

বেশ তারিয়ে-তারিয়ে ভদ্রলোককে কোপানো হল। তারপর নিপুণ কায়দায় ধড় থেকে মুন্ডুটি আলাদা করে স্ত্রীর চরণে বিপ্লবী অঞ্জলি দেওয়া হল। মুন্ডে বিস্ফারিত দুটি চোখ—নীরব উক্তি, সংগ্রামী অভিনন্দন। এই ঠোঁট দুটি থেকে অগ্নিস্রাবী বক্তৃতা আর শোনা যাবে না। সমাজবদলের যাবতীয় মতলব ওই মস্তিষ্ক থেকে আর প্রসূত হবে না। ওই ঘরটিতে চিরকালের জন্যে আবদ্ধ হয়ে থাকবে এই মোগলাই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি। দিনের পর দিন মোছা হবে, তবু রক্তের দাগ উঠবে না।

আরে ভাই! রাজনীতিতে এমন হয়েই থাকে। সংবাদপত্র হয়তো এটিকে একটা ‘ইস্যু’ করবেন। কিন্তু আমার খিদে পাবে। ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে করবে। আমার অন্দরমহলে সুস্বাদু নানারকম রান্না হবে। গল্প করতে করতে, খেতে-খেতে, নানারকম পরিকল্পনা হবে। এই শীতে মনোরম কোনও ‘ফরেস্টে’ গেলে কেমন হয়! যেখানে নিরীহ বাঘ হিংস্রতার সুইচ অফ করে ঘুরে বেড়ায়। বিপুল হাতি তালে তালে শুঁড় দোলায়। মানুষকে আছাড় মারার পরিকল্পনা গজমুন্ডের লকারে গুটিয়ে রেখেছে। ময়ূর পেখম মেলে ছৌনাচ করছে। পাইথনের অগ্নিমান্দ্য, শীতের রোদে শরীর ফেলে রেখেছে। কোনও পাহাড়ে গেলে কেমন হয়! যার চূড়াটা টেবিলের মতো—’টেবিল টপ’। তুলো ঘাসের জাজিম পাতা। সুরার মতো বাতাস। হাত তুললেই মেঘ ছোঁয়া যায়। পাট পাট কাগজের তলায় সেই রক্তমাখা কাগজটি আরও অনেকদিন থাকবে। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করব। হয় তো এই বধ্যভূমিতে আর একটি বলি আসবে। নদীর মতো জীবন বইতেই থাকবে।

জিগ্যেস করলুম কর্তা এই নদীটার নাম কী গো?

চূর্ণী।

জল কীরকম?

দেখতেই তো পাচ্ছেন, যথেষ্ট জল। হাজা মজা নয়। বর্ষা শেষ হয়েছে। এখন অনেক জল। দুপাশে দুটি গ্রাম, মাঝখানে নদী। আলাপি নদী, মিশুকে নদী। বড় বড় গাছের কোল ছুঁয়ে বয়ে চলছে। ওপারে রাস্তার সরলরেখা। এ-পারে, ও-পারে বাড়িঘর। নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলে। এ-পারে বিরাট একটা ভিস্তি নৌকোর খাঁচা তেরছা হয়ে পড়ে আছে। যাত্রীবাহী নৌকো পাল তুলে চলেছে। পারের নৌকো এপার ওপার করছে।

এ-পাড়ে কলাইঘাটা। সাধারণ গ্রামটিকে ইতিহাসের মর্যাদা দান করে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এই গ্রামটি মথুরবাবুর জমিদারির অন্তর্গত ছিল। ১৮৬৯ কি ৭০ সালের প্রথম দিকে শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন এই কলাইঘাটে। মথুরবাবু নৌকো করে ঠাকুরকে নিয়ে ঘুরতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতি দেখতেন, মানুষও দেখতেন। কী দুর্দশা, কী দারিদ্র্য! মথুরবাবুকে বললেন, তুমি এই মহালের জমিদার। শুধু খাজানাটাই আদায় করো, এদের দুর্দশা চোখে পড়ে না!

বাবা! কী আদেশ বলো?

এদের চকচকে করতে হবে, ঝকঝকে করতে হবে, ধবধবে করতে হবে, পেটপুরে খাওয়াতে হবে। সে-ই হবে তোমার শিবপূজা। সব পূজার সেরা পূজা—শিবজ্ঞানে জীবসেবা। মথুরবাবু গাঁট গাঁট কাপড় আনলেন। তেল এল। এল চাল-ডাল তরিতরকারি। চূর্ণীর তীরে জীবসেবা তীর্থ তৈরি হল। পল্লিবাসীরা তেল মেখে স্নান করলেন। নতুন কাপড় পরলেন। ধবধবে চকচকে হয়ে বটতলায় আহারে বসলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দে ডগমগ। সাক্ষীবট আজও আছে। ওদিক থেকে এদিকে সরে এসেছে।

কর্তা! এ তো মহাতীর্থ! মানুষটি কাছে সরে এসে, অনুচ্চ গলায় বললে, না, তীর্থ হল না। কিছুদিন আগে গ্রামের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি খুন হয়েছে। ভয়, এখানে এখন ভয়। চূর্ণীর জল চোখের জল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *