1 of 3

নদীর দু-ধারে

নদীর দু-ধারে

কীসের আওয়াজ? বোমা, না গুলি?

কত রাত কে জানে। সূর্য টুপ করে ডুবে যাওয়ার পরই আলোর সঙ্গে আর সম্পর্ক থাকে না। আকাশ দেখেও তো প্রহর বোঝার উপায় নেই, পূর্ণিমা আর অমাবস্যার সীমারেখা ঘুচে গেছে যে! আকাশেস্তরে-স্তরে কাজল মেঘ।

মানুষ কত দিন, কত মাস মেঘের জন্য হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকে। মেঘের জন্য কত প্রেম। কত গান। আল্লা মাঘ দে, পানি দে…। সাধের বুইন গো মেঘা রানি, কোথায় তোমার ঝরঝরানি…। প্রথম ধারাবর্ষণে ঠিক যেন সারা গায়ে হোলির রং মাখার আনন্দ।

আবার কখনও মেঘ দেখলেই ভয়। গুরু-গুরু ডাক শুনলেই বুক কাঁপে, ছিরছিরে বৃষ্টি শুরু হলে চোখে কান্না আসে। লেবুর পাতা, করমচা, দূরের বৃষ্টি দূরে যা!…

অলুক্ষুণে বৃষ্টি, ভেসে যায় যে সৃষ্টি!

আকাশের দয়া, বৃষ্টি। আকাশের অভিশাপ, বৃষ্টি!

মেঘ আছে, কিন্তু ওটা মেঘের গর্জন নয়। তবে কীসের শব্দ? বোমা না গুলি?

যারা ঘুমিয়ে ছিল, জেগে উঠেছে। যারা ঘুমোয়নি, এপাশ-ওপাশ করছিল, উঠে বসেছে। তারা শুনছে।

প্রথমে দুবার, তারপর একটু থেমে আবার তিনবার। বোমার শব্দ গোল মতন, আর গুলির শব্দ চেরা-চেরা। তবু সন্দেহ যায় না।

কিছু নীল রঙের পলিথিনের ঠেকনো দেওয়া তাঁবু, আর হোগলা আর শন-ছাওয়া অস্থায়ী আশ্রয়।

তার মধ্যে, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে শুয়ে আছে হাজারদেড়েক মানুষ, বুড়ো-বুড়ি, কুচো-কাচার সংখ্যাই বেশি, জোয়ানের সংখ্যা কম, সেইসব পুরুষদেরও আর জোয়ান বলা চলে না, দু-তিন সপ্তাহেই বুক-পেট চুপসে গেছে।

তাদেরই মধ্যে একজনের নাম চানু। সে-ই প্রথম গিরগিটির মতন একটু-একটু করে বুকে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে।

মনুষ্যজীবনের এই একটা মজার ব্যাপার, কৌতূহল। কৌতূহলের জন্য কত প্রাণও চলে যায়, তবু কৌতূহল অদম্য। কীসের আওয়াজ, তা জানতে হবে না?

সাঁইথিয়া আর আমোদপুরের বাইরের জগৎ দেখেনি চানু, তবু সে অনেক কিছু জেনে গেছে। যেমন, সে হেলিকপ্টারের আওয়াজ চেনে, সে জানে, এ শব্দ হেলিকপ্টারের হতে পারে না, তবু বড় আশা করে সে আকাশের দিকে তাকাল চোখ সরু করে। কালো আকাশ, একেবারে বোবা। বিদ্যুৎ চমকও নেই।

আরও একবার সেই পিলে চমকানো শব্দ হতেই, চানুর বুকের কাঁপুনি পৌঁছে গেল মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে সে নিশ্চিত হয়ে গেল, বোমা নয়, গুলিরই আওয়াজ। খুব দূর থেকেও নয়। কাছেই পুলিশ পোস্ট।

বোধের উদয় হওয়ার পরেও চানুর খটকা লাগে। আর কোনও হুড়োহুড়ি, গোলমাল শোনা যাচ্ছে না তাহলে পুলিশ শুধু-শুধু গুলি চালাবে কেন? বোমা হলে মানে বোঝা যেত, বোমাবাজরা অতর্কিতেই আসে। অনেক লোকজন জড়ো না হলে তো পুলিশ গুলি খরচ করে না। চারদিক শুনশান, মানুষের কণ্ঠস্বর তো দূরে থাক, এখন কোনও রাতচরা পাখিও ডাকেনি। সেপাইগুলো কি এমনি-এমনি নিশানা প্রাকটিশ করছে?

চানু একাই সাহসিকোত্তম নয়, আরও কিছু কিছু লোক, এমনকী নারী ও গুঁড়োগাড়াও বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কৌতূহল প্রবৃত্তিই তাদের টেনে এনেছে।

মুখ দেখা যায় না, এমনই একজন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, পুলিশ গুলি চালাইচ্ছে  গো!

সে চিৎকারে মিশে আছে আনন্দের ঝিলিক।

সবচেয়ে আনন্দ হয়, হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে। পুরোটা উচ্চারণ করতে পারে না, এরা বলে হেলি। কেউ একটু বেশি চালাকি করে বলে, কোপার! হয়তো কারুর মুখে শুনেছে, চপার। সে যাই হোক, হেলিকপ্টার এলে সমবেত উল্লাসের ধ্বনি শোনা যায়, কারণ ওই উড়ন্ত বৃহদাকার ফড়িংটি খাদ্য আনে, বস্ত্র আনে, ওষুধ আনে। যখন শহর থেকে কোনও গাড়ি আসতে পারে না, প্রবল স্রোতে নৌকাও ভেসে যায়, তখন ওই হেলিই তো আকাশ থেকে খুব নীচুতে নেমে বস্তা। বেঁধে সব ছুড়ে-ছুড়ে দেয়! বেশি ব্যস্ত হয়ে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে কেউ-কেউ মরে, ওপর থেকে বস্তা এসে পড়ে মাথায়, যেমন এবারে মরেছে নিরাপদ (আহা, বাপ-মা কী নামই রেখেছিল!) আর বিপলাই। ওদের মৃত্যুর জন্য কেউ শোক কিংবা আফসোস করেনি। কেন ওরা ধৈর্য ধরতে পারেনি, ছুটে গেল সাত তাড়াতাড়ি, অন্যদের ঠকাবার মতলবে? ভলান্টিয়ার বাবুরা কত নিষেধ করেছিলেন। তা ছাড়া, বন্যা হবে, কিছু লোক মরবে না, এ কী মামাবাড়ির আবদার নাকি! মা ধরিত্রী মাঝে-মাঝে এত মানুষের ভার সহ্য করতে পারেন না। তাই এক একবার খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, ঝড়-বাদলে কিছু মানুষ কমিয়ে দেন। কথা হচ্ছে, কে কে মরবে, আর চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!

দ্বিতীয় উৎসাহজনক ঘটনা, পুলিশের গুলি।

বোমাবাজদের বিশ্বাস নেই। তারা পুলিশের সঙ্গে ঠক্কর লড়ে। কিন্তু তারা গরিব-গুর্বোদের দিকেও তাকায় না। তারা কেন আসে, কেন যায় কে জানে। তাদের বোমায় পুলিশ কেতরে পড়ল, না। গরিব ছত্রখান হয়ে গেল, সে দিকে তারা ভ্রূক্ষেপও করে না।

বোমাবাজরা আসেনি, গোলমাল নেই, তবু পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই এর বিশেষ একটা তাৎপর্য আছে। অর্থাৎ বড় সড়কের পানি কমেছে, এসে গেছে গরমেন্টের রিলিফের ট্রাক, ছাতু এনেছে, চিড়ে-মুড়ি-গুড় এনেছে, এমনকী দুধও আনতে পারে।

চলো, চলো, রিলিফের ট্রাকের দিকে চলে!

এর আগে রিলিফের ট্রাকের সামনে গুলি চলেছে দুবার। সাঁইথিয়ায় আর মহম্মদবাজারে।

যখন খাওয়ার-দাওয়ার কিছুই থাকে না, তখন মানুষ পেটে কিল মেরে বসে থাকতে পারে। কয়েকটা দিন না খেয়ে থাকলেও তো মানুষ মরে না, বেঁচে থাকতে হয়তো আশায়-আশায়। বাচ্চাগুলো চেঁচায় বটে, মায়েরা তাদের মারে, মারতে-মারতে নিজেরাও কাঁদে, আর পুরুষরা নিঃশব্দে চেয়ে থাকে মাটির দিকে। নিজেদের হাত দেখে, পা দেখে। মনে-মনে প্রশ্ন করে, এটা কি পুরুষের শরীর? বউ-ছেলে-মেয়েদের খাওয়ানো পরানোর দায়িত্ব পুরুষ মানুষের, যখন তা পারে। তখন কী করে আর সে পুরুষ থাকে? সে তখন ওলটানো বজ্রকীটের মতন অসহায়।

মানুষ আগুনকে ভয় পায়, জলকে ভালোবাসে। জল থেকেই তো জন্ম আর আগুনে শেষ সৎকার। কিন্তু বেঁচে থাকার সময়টায় আগুনের থেকেও জল কখনও-কখনও ভয়ঙ্কর সর্বনেশে হতে পারে। জল দিয়ে আগুন নেভানো যায়, কিন্তু জলকে আটকাবার উপায় নেই। আগুন বড়জোর একখানা দু-খানা কিংবা দশখানা বাড়ি খেয়ে শান্ত হয়, আর জল যে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে দিতে পারে! জল শুধু বাড়ি-ছাড়া করে না, ডুবিয়ে দেয় ফসলের খেত, গ্রাস করে ভবিষ্যৎ।

হ্যাঁ, কয়েকটা দিন জলের তোড় থেকে কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে উপোস করেও থাকা যায়, কিন্তু চোখের সামনে খাবার দেখলে আর তর সয় না। তাই যখন রিলিফের ট্রাক আসে, তখন কর্তাব্যক্তিদের শত ধমকানি সত্বেও মানুষ লাইন বেঁধে দাঁড়াতে চায় না, সবাই একসঙ্গে ট্রাকগুলো ঘিরে চিলুবিলু করে, ধাক্কাধাক্কিতে আপন-পর ভেদ থাকে না। তবু প্রথমবার তেমন। কিছু বিশৃঙ্খলা হয়নি, কিন্তু চিড়ে-গুড় বিলি করতে-করতে অর্ধেক লোকের পর ফুরিয়ে গেল। এবার? বাকি অর্ধেক মাটিতে মুখ ঘষবে?

তাই, দ্বিতীয় দফায় রিলিফের ট্রাক আসতে-না-আসতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল একসঙ্গে। জোর যার, চিড়ে-গুড় তার। দশ মিনিটের মধ্যে লুট হয়ে গেল সব কিছু। এবারে অর্ধেকেরও অনেক বেশি লোক পেল না কিছুই।

লুটপাটের সময় পুলিশ তো গুলি চালাতেই পারে। নইলে আর তারা কাঁধে বন্দুক রাখে কীসের জন্য? তবু লুটপাট থামে না। এ যেন জুয়া খেলার মতন। কার গায়ে গুলি লাগবে আর কে চিড়ে গুড় নিয়ে দৌড়বে, তার তো কোনও ঠিক নেই। জুয়া খেলতে কে না ভালোবাসে। জীবনটাও বাজি ধরা যায়।

নিঝুম রাতে পুলিশের গুলির শব্দ শুনে সেই জন্যই মনে হয়, হঠাৎ বুঝি আবার এসে পড়েছে। রিলিফের ট্রাক। শুরু হয়ে গেছে লুট। এ তো বড় আনন্দের সংবাদ। তাহলে চলল, আমরাও যাই জুয়া খেলতে। লুটের মাল সব শেষ হওয়ার আগেই ভাগ বসাতে হবে, তাতে কারুর গায়ে যদি দু একটা গুলি লাগে তো লাগুক। গুলি খেয়ে যদি কেউ মরে, পুরুষ হয়েই মরবে।

চানু, বিমল, খাদু, জিনজিরা, সুলেমান, মকাই, অনন্ত, কালু, নিতাই, পিতু, জলিল, ছকু এইসব নামের পুরুষরা ছুটতে লাগল আগে, তাদের পেছনে স্ত্রীলোক ও বাচ্চারা, এমনকী হাড় জিরজিরে বুড়োরাও সবাই জুয়া খেলতে চায়।

ছুটতে ছুটতে ওদের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।

রিলিফের ট্রাকগুলো আসে সিউড়ির দিক থেকে, তা ছাড়া তো আর পথ নেই। ময়ূরাক্ষীর ওপারে বিহার। ট্রাকগুলো যাবে এদিক থেকেই, কই কেউ তো আওয়াজ শোনেনি। সেই গাঁকগাঁক শব্দে মরা মানুষেরও জেগে ওঠার কথা।

তা ছাড়া, ক্যাম্পগুলো সব এদিকের বাঁধের ওপর, ওদিক থেকে লুট করতে আসছে কারা? ওদিকের গ্রামগুলো থেকে মানুষ পালিয়ে এসেছে অনেক আগেই, এখনও জল নামেনি। তবে?

একটু পরেই ওরা দাঁড়াল পুলিশ পোস্টের কাছে এসে।

একটাও ট্রাক নেই, লুটেরার দল নেই। শুধু তিনজন পুলিশ রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে।

পুলিশদের বড় মজবুত তাঁবুটির মধ্যে জ্বলছে একটা জোরাল হ্যাজাক বাতি। আর সবদিকে মিশমিশে অন্ধকার। একটা জোনাকিও আলো ধার দিতে আসেনি।

তাঁবুতে একটা যন্ত্রের সামনে বসে আছে আর-একজন পুলিশ। ঘর-র ঘর-র আওয়াজের মধ্যে মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে যেন প্রেত কণ্ঠের কয়েকটি শব্দ।

বাচ্চাগুলো সেখানে উঁকিঝুঁকি মারতেই সেই পুলিশটি বেরিয়ে এল। সমবেত জনতার উদ্দেশে, পুলিশ-সুলভ উগ্রকণ্ঠে নয়, বরং আবেদনের ভঙ্গিতে বিনীতভাবে বলল, আপনারা গোলমাল করবেন না প্লিজ, প্লিজ, তাতে আরও বিপদ হতে পারে। যে-যার জায়গায় ফিরে যান। আমাদের কাজ করতে দিন।

বিপদ মানে? কথায় বলে, মড়ার বাড়া গাল নেই। আর কী বিপদ হতে পারে? নদী কি আবার ফুঁসে উঠল? কইনা, অন্ধকারে অদৃশ্য নদী চুপ করে আছে।

আর ঠিক তখনই দূরের জমাটবাঁধা অন্ধকার থেকে ভেসে এল ভয়ংকর শব্দ। শুধু অন্ধকার নয়, যেন আকাশও চিরে গেল সেই আওয়াজে। এ শব্দ কিছু মানুষের একেবারে অচেনা নয়, তবু যেন মনে হল, পাতাল থেকে উঠে এসেছে একদঙ্গল দৈত্য-দানব।

দুই

ভোরের আলো ফুটেছে একটু আগে।

পুলিশ ক্যাম্পের মধ্যে নেয়ারের খাঁটিয়ায় ঘুমোচ্ছে দুজন, আর-একজন দাঁতন করছে বাইরে, আর ওদের যিনি অফিসার, সেই তাপস বড়াল জেগে আছেন সারারাত, খাঁকি প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা ডান বাহুতে বড় রূপোর তাবিজ, মাথার চুল নস্যি রংয়ের, সিগারেট টানছেন অনরবত।

রেডিও টেলিফোনটি থেমে আছে আপাতত, যে-কোনও মুহূর্তে আবার ঘড়ঘড়িয়ে উঠতে পারে। তাঁবুর ধারেকাছে কিছু লোক এমনিই উবু হয়ে বসে আছে। কেউ ঘাস ছিড়ছে, কেউ চুলকোচ্ছে উরু।

এর মধ্যেই খবর রটে গেছে অনেকখানি। বানভাসি মানুষেরা নদীর ধারে উঁচু বাঁধে আশ্রয় নিলেও তাদের কৌতূহলবোধটি তো নিবৃত্ত হয় না। কয়েকজনের ট্রানজিস্টার রেডিও আছে, কেউ-কেউ জালি নৌকো বা তালের ডোঙায় চেপে এদিক ওদিক ঘুরতেও যায়। দেখে আসে আঘোডুবন্ত বাড়ি আর জমিতে ধানগাছের ডগাটুকু অন্তত জলের ওপর জেগে আছে কি না। ডগা পর্যন্ত ডুবলেই একেবারে সর্বনাশ।

আকাশে মেঘ থাকলেও কাল রাত থেকে আর বৃষ্টি হয়নি। জল কমছে একটু-একটু। এইরকমভাবে চললে কাল পরশুই বাড়ি ফেরা যাবে।

সিউড়ির দিক থেকে রাস্তা সারাই চলছে পুরোদমে। সরকারের টনক পড়ে দেরিতে। বন্যা যখন আসে, বাড়ি ঘর, খেত-খামার ভেসে যায়, ব্যাকুল-উদভ্রান্ত মানুষেরা উঠে বসে গাছের ওপরে, তলিয়ে যায় দু-চারটি শিশু, তখন সরকারের কোনও চিহ্নও পাওয়া যায় না, বরং বাঁধ থেকে আরও জল ছাড়া হয়। বাঁধ বাঁচাতে হবে তো!

এখন শুধু সরকার নয়, আসছে আরও কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আজ থেকে খোলা হবে খিচুড়ির লঙ্গরখানা।

বিপদ আসছে অন্য দিক থেকে।

ওদিকে বিহার, এদিকে বাংলা। ওদিকে দুমকা জেলা, এদিকে বীরভূম। দুমকা জেলায় তাণ্ডব শুরু করেছে হাতির পাল। তিনটি বাচ্চা সমেত মোট তেরোটি, তাদের নায়ক ঐরাবতের মতন এক প্রকাণ্ড দাঁতাল।

ওদিকে রানিপুর থানায় কয়েকখানা গ্রাম তছনছ করে দিয়েছে সেই হাতির পাল, বাড়িঘর ভেঙেছে, মানুষ মেরেছে। কতজন? মৃত্যু নিয়েই গুজব ছড়ায় বেশি। যত না ঘটে, তার চেয়ে অনেক বেশি রটে। কুড়ি জন? পঁচিশ জন? মহিষবাথান গ্রামে শেষ রাতে হাতির দঙ্গল এসে হুড়মুড়িয়ে সব ঘুমন্ত মানুষদের চেপটে দেয়নি? পালের গোদাটি এক বুড়িকে গুঁড়ে তুলে আছাড় মারেনি? যারা শোনে, তারাও যেন চাক্ষুষ করেছে দৃশ্যটি।

রানিপুর থেকে এদিকের মহম্মদবাজার আর কতটাই বা দূর!

চানু, বিমল, সুলেমান, কালু, মকাই, জলিল, পিতুরা তো মহম্মদবাজারেরই মানুষ। জল কমতে শুরু করায় তারা ঘরে ফেরার সুখস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। পুলিশ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এখন তাদের ফেরা হবে না।

কাল রাতে একবার শুধু হাতির পালের ক্রুদ্ধ ডাক শোনা গিয়েছিল, চোখে দেখা যায়নি। এখন দিনের আলোতেও নদীর ওপারে কিছু দেখা যায় না। যদিও ওদিকে জঙ্গল নেই, ঘাপটি মেরে থাকবেই বা কোথায়? ওদিকেও বন্যা হয়েছে অনেকখানি, ডুবেছে অনেক ধানি জমি।

রেডিও-টেলিফোন যন্ত্রটি আবার চিড়বিড় করে উঠল। তাপস বড়াল সেটার সামনে গিয়ে বসে মন দিয়ে শুনলেন খানিকক্ষণ। তারপর এক সময় দাঁতমুখ খিচিয়ে বলে উঠলেন, মামদোবাজি! অ্যাঁ? তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁতন-করা কনস্টেবলটিকে ধমক লাগিয়ে বললেন, আর কতক্ষণ দাঁত খোঁচাবে? এক ঘণ্টা তো হয়ে গেল?

রঘুনন্দন নামে কনস্টেবলটির দাঁতন করতে সত্যিই এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। যেন সে ওই কর্মটিতে যৌন আনন্দ পায়। নিমড়ালের গোছাটি সে মাথার কাছে রেখে রাত্রে শোয়।

পিচ করে থুতু ফেলে সে জিগ্যেস করল, স্যার, কী খবর পেলেন?

তাপস বড়াল বললেন, বিহার পুলিশ কী করছে জানো? হাতির পালটাকে খেদিয়ে দিচ্ছে বেঙ্গলের দিকে। পরশু রাতে নাকি তাড়াতে-তাড়াতে বক্রেশ্বরের কাছ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাতিগুলো নদীতে নামেনি। আবার উলটোদিকে ফিরেছে।

রঘুনন্দন বলল, কাল রাতে এদিক পানে এসেছিল এখন তারা কোথায়, কিছু শুনলেন?

তাপস বড়াল বললেন, সিউড়ি থেকে তা কিছু বলতে পারছে না। বারবার শুধু বলছে, মহম্মদবাজারে ঢুকে পড়ার চান্স খুব বেশি। মাঝে-মাঝে আমাদের ফায়ারিং চালিয়ে যেতে হবে।

রঘুনন্দন বলল, স্যার, হাতি তাড়ানো কি পুলিশের কাজ?

তাপস বড়াল যেন সামনের কোনও প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বললেন, সেই কথাই তো বলছি বারবার। এটা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব? তামিঃ রায় কী বললেন, শুনবে? উনি। বললেন, বীরভূমে আগে কখনও হাতি ঢুকেছে? মেদিনীপুর-বাঁকুড়ায় মাঝে-মাঝে হাতির পাল আসে, ওদের হাতি খেদাবার অভিজ্ঞতা আছে। আমরা তো ওসব জানিই না।

রঘুনন্দন বলল, বাবা বাবা বাঃ! আমরা এখানে শিখণ্ডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব? পাবলিক যদি খেপে যায়? যদি ধরুন সত্যিই হারামজাদা হাতিগুলো এই পর্যন্ত এসে পড়ে, আমরা কি সত্যিই গুলি চালাব?

তাপস বড়াল বললেন, সে চেষ্টাও কোরো না। তার আগেই প্যান্টলুন নষ্ট হয়ে যাবে। তা ছাড়া, হাতি বধ করা নিষেধ। গণেশ ঠাকুরের বংশধর না ওরা?

একটু বেলা হতেই চলে এল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা জিপ। দুজন অফিসার, দুজন আর্মড গার্ড। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর সেই জিপটা আবার চলেও গেল বক্রেশ্বরের দিকে।

এরপর আরও জিপের পর জিপ, দুখানা ট্রাক। দুধ দেওয়া হবে আজ বাচ্চাদের। আজ হুড়োহুড়ি নেই, লুটপাটের প্রশ্নই নেই, আবহাওয়াতেই বোঝা যায়, আজ সবাই কিছু-না-কিছু পাবে। এমনকী জামা-গেঞ্জিও বিলি হতে পারে।

হিন্দু ও মুসলমানদের ছাউনিগুলি আলাদাভাবে ভাগ করা, মাঝখানে কিছুটা ফাঁক। দু-দিকের পুরুষদেরই পরনে লুঙি, চেহারা দেখে ধর্ম চেনার উপায় নেই। তবে মুসলমানদের দিকে। কয়েকজন নামাজ আদায় করতে বসে গেছে ফাঁকা জায়গায়, হিন্দুদের প্রতিদিনের ধর্মচর্যার দায় নেই, তারা গুলতানি করছে এদিকে।

সকলেরই মাঝে-মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে নদীর ওপারে। হাতিরা কি এল? হাতির পাল এসে। পড়লে কী যে বিপদ হবে, তা এখন সকলেই বুঝেছে, তবু অনেকেই ভাবছে, কেন আসছেনা এখনও? মানুষ তো বিপদ নিয়েও জুয়া খেলে। বিপদ থেকে যেমন বাঁচতে চায়, তেমন বিপদকে ডেকে আনে।

গুজব এখন পাখনা মেলছে নানারকম। দুপুরের মধ্যে দুবার মিথ্যে রব উঠে গেল, হাতিদের দেখা গেছে, হাতিরা ধেয়ে আসছে। ভয়ার্ত হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচি, কান্নাকাটির পর সত্যিই হাতিরা আসেনি বলে হাসির ধুমও পড়ে গেল। এই প্রথম সর্বস্ব হারানো, পলাতক, দয়াজীবী, ক্যাংলা মানুষগুলো হাসছে। যে উপলক্ষ নিয়ে তারা হাসাহাসি করছে, সেই উপলক্ষটি তাদের পরবর্তী চরম বিপদ এনে দিতে পারে।

সত্যিই যদি তেরোখানা হাতি নদী পেরিয়ে এদিকে তেড়ে আসে, তা হলে যে কী উপায় হবে, তা পুলিশরাও জানে না। একটা-আধটা নয়, তেরোটা, বন্যারই মতন এ এক অদ্ভুত প্রতিপক্ষ, যাকে রোধ করা সম্ভব নয়। এও কি প্রকৃতির তাণ্ডব?

বিহার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কয়েকবার। তারা ইচ্ছে করে হাতিগুলোকে খেদিয়ে দিচ্ছে বাংলার দিকে, এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে তীব্রভাবে। ইচ্ছে করলেই বুনো হাতির পালের গতিপথ বদলানো যায়? একবার এদিকে এসে দেখে যাক না বঙ্গাল পুলিশ!

এই হস্তিযূথটি পথভ্রষ্ট। এদিকে আসবার কথাই নয়, তবু এসে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেছে। ওদের খাবার নেই। ধানখেত, গমখেত বন্যায় ডুবে গেছে। বর্ষায় বড়-বড় ঘাস হয়, সেসবও নেই, ওরা। খাবে কী? হাতিদের জন্য রিলিফের ট্রাক পাঠাবার কি ব্যবস্থা আছে কোনও?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধে, তারপর আবার নিশ্চিন্দ্র অন্ধকারের রাত। এর মধ্যে মাঝে-মাঝে অতিরঞ্জিত দুঃসংবাদ পিলে চমকে দিয়েছে অনেকের। হাতিরা পাহাড়ে ফিরতেও পারছে না, কোনও জঙ্গলও খুঁজে পাচ্ছে না। যে-কোনও গ্রামের কাছাকাছি এলেই গ্রামের মানুষ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মশাল আর বর্শা আর ইট-পাথর ছুড়ে তাড়াতে চাইছে তাদের। তাতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে তারা সামনে যা-কিছু দেখছে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে, তা বাড়িই হোক, মানুষের মাথাই হোক।

অন্ধকারেই বহু যুগ প্রবাহিত ভয়। আজ রাতে আর কে ঘুমোবে? যদি গভীর রাতে আসে? অত বড় একটা প্রাণী, তবু নাকি চলাফেরা করতে পারে নিঃশব্দে। ওদের সাঁতার শিখতে হয় না, যখন-তখন পার হয়ে যেতে পারে নদী। পুলিশের এইসব বন্দুকের গুলিতে মানুষ মারা যায়, মানুষ মারা অতি সহজ, কিন্তু এই গুলিতে হাতির গায়ে ফোস্কাও পড়বে না।

সরকার কী করছে, কলকাতার সরকার? খবর পায়নি তারা? এদিকে বনদপ্তর অনবরত কথা চালাচালি করছে ওদিকের বনদপ্তরের সঙ্গে। কথার পিঠে কথা, তর্কাতর্কি। সরকার এখানে আসবে ঠিকই। একটা কিছু ঘটে যাওয়ার পর। খুব বড়রকম কিছু ঘটে গেলে দিল্লির সরকারও আসবে। আগে কেউ আসে না।

এই রাতে নদীর ওপর থেকেও মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ। তাতে আরও বুক কাঁপে। ওদিক থেকে তাড়ালে তো এদিকে আসবেই। যে-কোনও সময়ে। এদিক থেকে অকারণে ফায়ারিং করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে, দরকার হলে মিলিটারি আসবে, পুলিশের আপাতত কিছু করার দারকার নেই।

এক-একটা রাত কত লম্বা হয়! কেউ-কেউ হঠাৎ-হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বিপদের সম্ভাবনায় নতুন করে জেগে ওঠে শোক। খালি পেটে অনুভূতিগুলি ভোঁতা হয়ে যায়, আজ দুপুরে খিচুড়ি পেটে পড়েছে। সন্ধের সময় পাওয়া গেছে চিঁড়ে-মুড়ি, পেটের আগুন নিভে এখন জ্বলছে মাথার আগুনে। যার সন্তান মারা গেছে, যার হালের গরু বাঁচানো যায়নি তাদের এখন উথলে উঠছে সেই দুঃখ।

মুসলমানদের ছাউনির দিক থেকে হঠাৎ একটা শোরগোল শোনা গেল। কেউ ফোঁসফোঁসানি শুনেছে, কেউ দেখেছে একটা লম্বা দাঁড়াশ সাপ। এখন আর দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের মানুষ অনেকেই টর্চ রাখে, খুব দরকার না হলে জ্বালে না। অনেকের ব্যাটারি ভিজে গেছে, তবু দু-তিনটি ছোট টর্চ পাওয়া গেল, সাপটাকে নিকশে করতে না পারলে এক মুহূর্ত নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না। চানু, হাবু, কানুরাও ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে সাপটাকে খুঁজতে থাকে। দাঁড়াশ সাপ ঢেউয়ের গতিতে চলে, ওদিক থেকে এদিক আসতে আর কতক্ষণ। গত পরশুই সাপের কামড়ে মরেছে। একজন, জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার শব।

তাপস বড়াল এখানে এসে বললেন, কী হয়েছে? সাপ? কত বড় বললেন?

জালাল বলল, আমি নিজের চোখে দেখিচি, অ্যাই অ্যাও বড়, চার-পাঁচ হাত তো হবেই।

তাপস বড়াল বললেন, এত বড় সাপ বিষাক্ত হয় না। তা খুঁজতে হয় খুঁজুন। মারতে হয় মারুন। হইহল্লা করছেন কেন? গোলমাল করাটা আপনাদের স্বভাব! যদিবা হাতিরা এসে পড়ে

আজকাল গ্রামের মানুষদের সঙ্গেও তুই-তুকারি চলে না। আপনি আজ্ঞে করতে হয়, কিন্তু মুখে অবজ্ঞার ভাবটা লুকোতে পারেন না তাপস বড়াল। অনবরত সিগারেট টেনে-টেনে তাঁর ঠোঁট এমনিতেই তেতো হয়ে আছে।

যেদিকে গোলমাল হয়। সেদিকেই হাতিরা আসে? হবেও বা। সবাই চুপ মেরে যায়।

তাপস বড়াল একটা বড় টর্চ হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন নদীর ধারে। তাঁর চোখ থেকে ঘুম উবে গেছে একেবারে। সারাদিন অসম্ভব গুমোট, একটুও বাতাস ছিল না, এখন তবু নদীর ধারে ঘামে ভেজা শরীরে একটু-একটু বাতাস লেগে নিস্তব্ধতার স্বাদ পাওয়া গেল। তাঁর এখন একটা গান। গাইতে ইচ্ছে হল। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন কীর্তনিয়া, তিনি শুনেছিলেন সেই ঠাকুরদা মৃত্যুর ঠিক। আগে আপন মনে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে গান গাইতে-গাইতে তারপর ঢলে পড়েছিলেন। সে দৃশ্যটি ভাবলেই বড় ভালো লাগে।

শেষ রাত থেকে শুরু হল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, সেইসঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। কিছুক্ষণ পরে তা থামল বটে, কিন্তু সকাল হলেও সূর্য দেখা গেল না। ছাইছাই রঙের দিন। অন্য জেলা থেকে যেন উড়ে এসে আকাশ জুড়ে বসছে কালো রঙের মেঘ।

দশ-বারো বছর বয়েসি কয়েকটি ছেলেমেয়েই প্রথম চিৎকার করে ছুটে এল আকাশ কাঁপিয়ে। তারা দেখেছে। সত্যিই দেখেছে। নদীর ওপারে মূর্তিমান যম।

হাজার মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেনদীর উঁচু বাঁধে। অপরিচ্ছন্ন আলোর জন্য খুব স্পষ্ট বোঝা যায় না, তবু সন্দেহ নেই, হাতির পালই দাঁড়িয়ে আছে ওপারে সার বেঁধে।

মিলিটারি আসেনি, বন বিভাগের লোক ফিরে গেছে, এখন কী করা হবে; হাতির পাল যে-কোনও সময় নদী পেরুতে পারে। তাপস বড়াল আর. টি. চালু করে চিৎকার করতে লাগলেন, বলুন, বলুন, এখন কী করব? বলুন, লোকগুলোকে বলব, যে যেদিকে পারে পালাক। তার আগে ক্যাম্প ফেলে রেখে আমরা পালাব? বলুন, বলুন!

ওদিক থেকে উত্তর এল, মিলিটারিকে খবর দেওয়া হয়েছে, পৌঁছে যাবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। আর এক গাড়ি পুলিশ যাচ্ছে। ক্যাম্প ছেড়ে যাবেন না, প্লিজ। একজন ডেপুটি মিনিস্টার বিকেলের দিকে,…জনসাধারণকে ধৈর্য ধরে থাকতে বলুন, সবাই যেন এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে, কেউ এদিক ওদিক ছিটকে গেলেই বিপদ হতে পারে। গভর্নমেন্ট থেকে। সবকিছু ব্যবস্থা করা হচ্ছে! ওভার!

তাপস বড়ালের ইচ্ছে হল আর. টি. যন্ত্রটায় একটা লাথি কষাতে।

দৃশ্যটি ক্রমশ আর একটু স্পষ্ট হল। চেনা যাচ্ছে দাঁতালটিকে। কয়েকটি হাতি শুড় দোলাচ্ছে। এক, দুই, তিনটি বাচ্চা হাতি, ঠিক গণেশ ঠাকুরের মতনই মনে হয়। ওরা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে কেন?

ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, দিশেহারা, এক পাল হাতি। ময়ূরাক্ষীতে এখন প্রবল স্রোতের টান, ওরা জলে নামছে চাইছে না। তবু বাচ্চাগুলো, দুরন্ত মানব শিশুরই মতন, জলে নেমে খলবলাচ্ছে, আর

অভিভাবকরা তাদের টেনে তুলে আনছে ওপরে।

একটা বিদ্যুতের ঝলক চিরে গেল আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। সেই ধবল আলোয় ওপারে দৃশ্যটিকে মনে হল একটা বাঁধানো ছবি। ভারি অপরূপ।

তারপরই প্রচণ্ড বজ্রগর্জন। দশ-কুড়িটা কামানের হুঙ্কারের পরেও গুরু-গুরু রব গড়াতে লাগল আকাশে। যেন পাথরে কেউ পাথর ঘষছে। মেঘ কি পাথরের মতন হয়? আবার গলে গলেও তো পড়ে।

আবার বৃষ্টি? আবার জল বাড়বে, আবার বন্যা? আর কত কষ্ট দেবে, হে ভগবান, হে আল্লা? আবার ডুবে যাবে সিউড়ির সড়ক। খাদ্য আসবে না, ওষুধ আসবে না, সাপে কামড়াবে, ভেদবমি হবে। এর মধ্যে যদি হাতিগুলো তেড়ে আসে, কোন দিকে পালাবে মানুষ। মাঠে-মাঠে এখনও বুক জল।

মানুষ ভাবছে, হাতিরা তাদের মারতে আসবে। হাতিরাও কি কিছু ভাবে না? এক সঙ্গে অত মানুষ দেখে তাদেরও কি মনে হতে পারে না যে মানুষরাই তেড়ে আসবে তাদের দিকে? ওরাই বা পালাবে কোন দিকে? জলে ডোবা মাঠ দিয়ে ছুটতে পারে না জোরে, সব দিকেই তো মানুষ, তারা আগুন ছোঁড়ে, কাঁটা বিঁধিয়ে দেয়।

হাতিগুলো মাঝে-মাঝে শুড় তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কেন? ওপরেও কি ভগবান কিংবা আল্লার মতন কিছু আছে? ওরাও কি বাঁচার জন্য প্রার্থনা জানায়? ওপারের মানুষ দেখল, কয়েকটা হাতি একসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়েছে জলে। তা হলে ওরা এবার নদী পার হবারই সিদ্ধান্ত নিল?

সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ভয় পাওয়া চিৎকার, ঠেলাঠেলি, দৌড়। বাচ্চারা জড়িয়ে ধরল মায়েদের, দু-তিনটে ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে কোলে কাঁখে নিয়ে পালাচ্ছে এক-একজন মা, বুড়ির হাত ধরে ছুটছে বুড়ো, সমর্থ পুরুষরা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে সেই বুড়ো বুড়িদের। শুধু কিশোর-কিশোরীরা মৃত্যুর সঙ্গে জুয়া খেলা বেশি ভালোবাসে বলে খানিকটা দৌড়ে পালিয়েও ফিরে আসছে আবার।

অন্য পুলিশদেরও পাত্তা নেই, শুধু একা পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছেন তাপস বড়াল, হাতে সিগারেট। তিনি কিছুতেই পালাবেন না ঠিক করেছেন। মৃত্যুভয়ে পালাতে তাঁর ঘেন্না হয়। তাঁর বুকের ভেতর থেকে ঠেলে উঠে আসছে একটা কীর্তন গান।

শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি।

একটা হাতির বাচ্চা খেলাচ্ছলে পা পিছলে চলে গেছে গভীর জলে, ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে। মা-বাবা স্থানীয় কয়েকটি বয়স্ক হাতি সাঁতরে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে এপারের মানুষদের দিকে তাদের মন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *