1 of 2

নতুন পাতা – প্রতিভা বসু

নতুন পাতা – প্রতিভা বসু

একটু বেশি তাড়াতাড়িই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন উত্তমাসুন্দরী। সুবিধেমতন পাওয়া গেল, নিজেরও সহায়সম্বলের তেমন জোর নেই যে, মেয়েকে বড় করবেন লেখাপড়া শিখিয়ে। বিধবা মানুষ, ভাশুরের আশ্রয়েই দিন কাটছে। তাই নানাদিক বিবেচনা ক’রে ঠিক করে ফেললেন সম্বন্ধ।

মেয়েটা একটু পাগলা-পাগলা। বয়সের তুলনায় ছেলেমানুষও খুব। একটামাত্র মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী আদর দিয়েছিলেন প্রচুর। যা যখন চাই―তাই সই। এই ক’রে ক’রেই বোধ হয় নষ্ট হয়েছে একটু। এ বাড়িতে এখন অন্তত তাই মত। ভাশুরের গাদাখানেক ছেলেপুলে, তারা কেমন সময়মত খায়-দায়, ইস্কুলে যায়, এর সেসব বালাই নেই। খাবে যখন খুশি তখন, অর্থাৎ সারাদিন পেলে তাই ভালো, আর ইস্কুলে তো যাবেই না। তেরো বছরের বলিষ্ঠ মেয়ে এই নিয়ে ক্লাস সেভেন দু’ দু’বার ফেল করলো। পড়ে না, শোনে না, ফেল না ক’রে করবে কী? আর তাতে তার লজ্জাও নেই, দুঃখও নেই। বরং সুখীই। কেননা, জ্যাঠামশায় বলেছেন, ‘আর তোমার ইস্কুলে গিয়ে কাজ নেই। কানকাটা সেপাই হ’য়ে বাড়ি ব’সে ঘাস খাও।’

বিয়ে ঠিক হবার পরে তার আরো আনন্দ। একেবারে নিঃসংশয় হ’লো যে, আর পড়তে হবে না। বইগুলোকে চুপে চুপে ছিঁড়ে ফেললো চিলকুঠির ছাতে ব’সে। মনে মনে অনেক সুখের কল্পনা করতে লাগলো চুরি ক’রে আচার খেতে খেতে। তারপর নিচে নেমে কি ভেবে ঘুমন্ত জ্যাঠতুতো বোনের চুলের বেণীটা কচ্‌কচ্‌ ক’রে কাঁচি দিয়ে কেটে মার পাশে এসে চুপটি ক’রে শুয়ে রইলো।

পাত্রপক্ষ নিতান্তই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ। ঢাকা শহর থেকে কয়েক স্টেশন দূরে কুর্মিটোলায় থাকে। শ্বশুর স্টেশন মাস্টার আর শ্বশুরের ছেলে ইস্কুল মাস্টার। বি-এ পাস ক’রেই সত্তর টাকা মাইনেতে কয়েক মাস মাত্র মাস্টার হয়েছে সেখানে। আরো দুটো ভাই আছে, মা আছে, বুড়ি ঠাকুমা আছে। কোয়ার্টারটি সুন্দর। বাগান-ঘেরা ছোট্ট একতলা। একটু দূরে ঝিরিঝিরি তেঁতুলতলায় মস্ত ইঁদারা। রেল-লাইনের বেড়ার ওপারে বুধি গাই। আবার কুকুরও আছে একটি। খাড়া-খাড়া কান, থুকথুকে পোকা, তিরতিরে ল্যাজ এইটুকু একটা বাংলা কুকুর। সুনীল (অর্থাৎ পাত্র) আর তার ভাইয়েরা তাকে খুব ভালবাসে। নাম বাঘা। ঢালাও করা লাল সুরকির চাতালে তার চেয়েও লাল কৃষ্ণচূড়ার গাছ। তার তলায় ছায়ায় বাঘা তার প্যাকাটির মত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে দিনের বেলা আর রাত্তিরে পাহারা দেয়। মোটমাট ছিমছাম ছোট্ট সচ্ছল শান্তির সংসার।

উত্তমাসুন্দরী একদিন নিজে এসে সব দেখেশুনে গেলেন, খুশিও হলেন। দোষের মধ্যে শুধু এইটুকু, ছেলেটি যেমন রোগা তেমনি কালো। কিন্তু চোখ দু’টি ভারি সুন্দর। আর বড় লাজুক, বড় বিনীত। কে বলবে এই ছেলে আবার ছেলে ঠেঙায় ইস্কুলে গিয়ে!

স্বামী যা রেখে গিয়েছিলেন, তার সবই তিনি খরচ করলেন এই বিয়েতে। ওদের বেশি দাবিদাওয়া ছিলো না, নগদ টাকায় ছেলের অমত, চাপাচাপি করায় বাপের অমত। মা সাতে নেই, পাঁচে নেই―তিনি কিছু বললেনই না। কেবল বুড়ি ঠাকুমা ক্যাটক্যাট করে অনেক কিছু আদায় করলেন। তা বুড়িকে চুপ করাবার মত সবই দিলেন উত্তমাসুন্দরী। জোড়া পালঙ্ক দিলেন, লিখবার টেবিল দিলেন, চেয়ার দিলেন, আলনা দিলেন, জামাইকে ঘড়ি আর সোনার বোতাম দিলেন। মেয়ের গায়ে তিরিশ ভরি সোনা দিলেন। এত দেয়ার ঘটা দেখে রাগ করলেন ভাশুর, উত্তমাসুন্দরী নিঃশব্দে সেই রাগটুকু হজম করলেন। এই তো তার সব। এ ছাড়া আর কী আছে তার?

জিনিসপত্র দেখে, গয়নাগাটি, নতুন নতুন শাড়ি-ব্লাউজের বহরে সাবির আর মজার সীমা নেই। রাত্রিবেলা মার গলা জড়িয়ে ধ’রে বলে, ‘আর মাত্র দু’দিন বাকি। তারপর এসব আমার না মা?’

মার চোখে জল আসে। ভাঙা-ভাঙা গলায় বলেন, ‘তোমার না তো কার? সব আমার সোনার।’

কিন্তু তেরো বছরের পাগলাটে সাবি এটা বোঝেনি যে, মাকে ছাড়বার দিন ঘনিয়ে এসেছে। যা খুশি তাই করার পালা এবার ফুরোলো।

গোলমালটা বিয়ের রাত্রিতেই হ’লো একটু। সন্ধ্যায় লগ্ন ছিলো, আর সব নিরাপদেই হ’লো, কিন্তু অচেনা-অজানা কালো রংয়ের রোগা ছেলেটার সঙ্গে একা ঘরে শুতে সে কোনোমতেই রাজি নয়। চুপেচুপে ডেকে নিয়ে উত্তমাসুন্দরী অনেক কিছু বুঝয়ে পটিয়ে তবে ঘরে পাঠালেন। হয়তো প্রচুর পরিমাণে আচার আমসত্ত্বের লোভেই এমন সাংঘাতিক কার্যটি সমাধা করতে অবশেষে রাজি হয়েছিলো সে।

মধ্যরাত্রে কিন্তু ঠিক পালিয়ে এলো মার কাছে।

বাড়ির লোকেরা পরের দিন সকালে ফিস্‌ফাস্‌ করলো ‘এ রকম একটা নির্বোধ মেয়েকে এতটুকু বয়সে বিয়ে দেওয়াই অন্যায় হয়েছে উত্তমার।’ উত্তমাসুন্দরী ম্লানমুখে চুপ। এমন কী-ই বা ছোট। তেরো বছর পূর্ণ হয়ে প্রায় চোদ্দ হ’তে চললো, দেখতে-শুনতে মনে হয়, ষোলো।

জামায়ের মুখ যেন থমথমে দেখালো। কে জানে, কী করেছে, কী বলেছে। শঙ্কিত প্রাণে সারাক্ষণ মেয়েকে একথা-ওকথা-সেকথা দিয়ে কেবলি উত্তমাসুন্দরী বোঝালেন যে, এই রোগা কালো রংয়ের ছেলেটিই এখন তার সব। বাসি-বিয়ের দিন অসুবিধে নেই, মার গলা জড়িয়েই রাত কাটলো আর মা সারারাত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, সিদ্ধিদাতা গণেশ, মা-লক্ষ্মী, মা-কালী, তেত্রিশ কোটি দেবতার পায়ে মেয়ের সুমতির জন্য প্রার্থনা জানালেন। কাকস্য পরিবেদনা। পরের দিন দুপুরের গাড়িতে যাবার সময় একেবারে হুলস্থূল। কী কান্নাই যে কাঁদলো তার ঠিক নেই, না যাবার জন্য কী কাণ্ডই যে করলো তারও ঠিকানা নেই। যতই ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ থাকুক, যতই পাগলাটে হোক, সত্যি সত্যি নির্বোধ তো আর নয়। তাই এ রকম একটা অনর্থ করতে পারে বিয়ের ব্যাপারে সেটা উত্তমাসুন্দরীর মাথায়ই আসেনি, অগত্যা তিনি সঙ্গে গেলেন, কিন্তু এই কড়ারে যে, কুর্মিটোলা স্টেশনে তিনি নামবেন না, তার আগের স্টেশন তেজপুরে নেমে থাকবেন। সেখানে তাঁর বোন আছেন, তাঁর বাড়িতে থাকবেন, পরের দিন সকালে দু’জনে মিলে গিয়ে তাকে দেখে আসবেন। সাবি রাজি হ’লো তাইতেই। একদম মা ছেড়ে যাবার চাইতে এটা ভালো।

তেজপুর স্টেশনে অবিশ্যি আর এক পশলা কান্নাকাটির ধুম হ’লো। শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মুখে বিরক্তির রেখা কুঞ্চিত হ’তে দেখলেন উত্তমাসুন্দরী, ভয়ে বুক কাঁপলো তাঁর।

সুনীলদের বাড়ি এসে এতগুলো অচেনা লোকের মধ্যে কয়েকদিন লজ্জায় ভয়ে চুপচাপ থাকলো, সাবি। মার শেখানো মতো গুরুজনদের প্রণাম করলো, শান্ত হ’য়ে ব’সে থাকলো, সমবয়সী ছোট দেওরটি যখন ভাব জমাতে চেষ্টা করলো তখন খুশিও হ’লো একটু। সেই রোগা টিংটিঙে বাঘ’ কুকুরের গল্প হ’লো খানিক। কৃষ্ণচূড়া ফুল বিষয়ে কিছু জ্ঞানমূলক আলোচনা, ট্রেনগুলো যতবার হুসহুস করে পাস করলো এই দেওরের সাহায্যেই জানালা দিয়ে দেখার সুযোগ ঘটলো। মোটমাট এই উৎকৃষ্ট ছেলেটির জন্যই বাড়িটা খুব অসহনীয় লাগলো না। কোনো এক রাত্রে সুনীল করুণ গলায় জিজ্ঞেস করলো―‘আমাকে কি তোমার একটুও ভালো লাগে না?’

অনেক দূরে, খাটের ঐ প্রান্তে রোজের মতই দেয়ালে মিশে গিয়ে সাবি জবাব দিল, ‘ন্‌না।’

‘কেন?’

‘তুমি দেখতে বিশ্রী।’

সুনীল ব্যথিত হ’য়ে চুপ করলো। একটু পরে আবার বললো, ‘আমাদের বাড়ির কাউকেই কি তোমার ভালো লাগে না?’

‘না।’

‘সবাই বিশ্রী?’

‘রঞ্জন ছাড়া।’ একটু চুপ ক’রে থেকে, ‘আর নেড়ি কুত্তাটার নাম বাঘা রেখেছ কেন? ওটার নাম ঘিয়েভাজা।’

সুনীল চুপ।

বাইশ বছরের অপাপবিদ্ধ মফস্বলের ছেলে, ভীরু-ভীরু মনে, থরো-থরো বুকে কত কিছুই ভেবেছিলো, সাবির সুন্দর মুখখানা দেখে কি মনে হয় সে এত নিষ্ঠুর? এত নির্বোধ? হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বয়স কত?’

‘বারো, তেরো, চোদ্দ, পনেরো, ষোলো, সতেরো।’

‘লেখাপড়া শিখছ?’

‘সেভেন উঠে পাঁচ, ছ’, সাত, আট, ন’, দশবার ফেল করেছি। তোমার কী!’

‘না আমার আর কী? রঞ্জনকে বুঝি এইজন্যেই খুব পছন্দ হয়েছে?’

‘কেন সে-ও কি ফেল মারে?’

‘সদা সর্বদাই।’

‘তাই ভালো।

একটু পরে সুনীল আবার বললো, ‘অত দূরে শুয়েছ কেন?’

‘আমার ইচ্ছে।’

‘তুমি ভূত দেখেছ?’

‘ভূত! কেরোসিনের লণ্ঠন কমানো ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় চোখে তাকালো সাবি, কেন, ভূত আছে নাকি এখানে?’

‘অনেক। শাঁকচুন্নি কন্দকাটা আর তিনঠেঙি তো সর্বদাই ঐ জানালাটার কাছে ঘোরাফেরা করে।’

‘অ্যা!’

‘হ্যাঁ।’

স্প্রিংয়ের মতো ছিট্‌কে এসে সাবি সুনীলের বুকের কাছে মুখ লুকোলো, সুনীল তার পিঠের উপর সন্তর্পণে হাত রেখে বললো, ‘এবার আর কিছু ভয় নেই, আমার কাছে এলেই ভূতেরা পালিয়ে যায়।’

সাবির আর সাড়াশব্দ নেই।

পরের দিন সন্ধে হ’তেই ঘুরঘুর করতে লাগলো শাশুড়ির পেছনে আর রাত্তিরে ঠিক গিয়ে তাঁর বিছানায় শুয়ে রইলো শ্বশুরের জোড়া বালিশে মাথা দিয়ে আরাম ক’রে। সবাই অবাক। রঞ্জন বললো, ‘হ্যাঁ মা, বউদি যে আজ আমাদের সঙ্গে শোবে।’

‘আমাদের সঙ্গে শোবে কী? যত সব অনাছিষ্টি কাণ্ড। ও বউ, বউ―’ সাবি ঘুমিয়ে কাদা। কখন যে সে এসে শুয়েছে কে জানে! শাশুড়ি বিরক্ত হ’য়ে জোরে জোরে ঠেলা দিতেই সে উঠে বসলো চোখ মুছতে মুছতে। তারপরেই ‘ওরে বাবারে ভূতরে’ ব’লে আঁকড়ে ধরলো শাশুড়িকে।

‘আমি ও ঘরে শোবো না, ও ঘরে ভূত আছে।’

‘তোমার মুণ্ড।’ গজগজ করলেন শাশুড়ি। শ্বশুর বললেন, ‘থাক না, শুয়েছে শুক না, ছেলেমানুষ, মা ছেড়ে এসেছে―’

‘ছেলেমানুষ না হাতি—’ লাগোয়া ঘর থেকে খেঁকিয়ে উঠলেন ঠাকুমা, ‘আঠারো বছরের ঝানু মেয়ে, ঢং দ্যাখো না। হ’তো আমাদের কাল, ঠোনা মেরে গালের চামড়া ছিঁড়ে দিত। দাও, উঠিয়ে দাও। অসভ্য বউ। বলা নেই, কওয়া নেই শ্বশুর-শাশুড়ি রইলো কোথায় প’ড়ে, সাততাড়াতাড়ি খেয়ে শুলো এসে। মা কি এইটুকু শিক্ষাও দিয়ে দেয়নি? ভদ্রলোকের মেয়ের এ কি ব্যাভার।’

‘থাক মা থাক’, শ্বশুর আবার একটা দুর্বল চেষ্টা করলেন প্রতিবাদ করতে, ‘রাত ক’রে আর ঝামেলা বাড়িয়ো না।’

শাশুড়িও যে একটু রাগ করেননি তাও নয়। এই কয়েকদিনের ব্যবহারে মোটেও সুখী হননি তিনি। বউ যেন বউ-ই নয় মোটে। যেন কেমনতরো। মাথার কাপড় তো আদ্ধেক সময় থাকেই না। শরম-ভরমের বালাই নেই। সারাদিন রোগা কুকুরটাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি, রঞ্জনের সঙ্গে হাতাহাতি, এর মধ্যেই ক’বার দরজা খুলে লাইনের ধারে চলে গিয়েছে ট্রেন দেখতে। কড়াগলায় ধমক দিলেন তিনি, ‘যাও, শোও গিয়ে। সারাদিন খেটেখুটে শুতে এলুম, আর যত আপদ এসে জুটলো। যাও।’ ধমক খেয়ে জলভরা চোখে আস্তে আস্তে উঠে গেল সাবি।

চুপচাপ নিজের ঘরে বসে সবই শুনছিলো সুনীল। তার ভূতের ভয়ের কৌশলটাই যে সাবিকে এই কষ্টটা দিল এটা ভেবে মনটা ভারি খারাপ হ’য়ে গেল। সাবি আসতেই তার ফুটফুটে ফরশা নরম হাতখানা নিজের কালো-রোগা হাতের মুঠোয় তুলে নিল, ‘আমার জন্যেই এই বকুনিটা খেলে তুমি। সত্যি বলছি ভূতটুত এ ঘরে কিছু নেই। আমি তোমাকে―’ য্‌যাও’ বলে এক ঝাপটা মেরে সুনীলকে চেয়ার থেকে উল্টে ফেলে গনগনিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লো মেঝেতে। কান্নার বেগে তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। সুনীল নিজেকে সামলে উঠে বসলো কোনরকমে। ভারি রাগ হ’লো তার। হ’লোই বা বাইশ বছর বয়স, একটা ইস্কুলের মাস্টার না সে? বি-এ পাস করেছে না? একটা পজিশন আছে না? ফট্‌ ক’রে আলো নিবিয়ে অন্ধকার করে দিল ঘর, তারপর জোড়া খাটে উঠে শুলো আরাম করে।

কিন্তু ঘুম এলো না। কেন এলো না কে জানে! অন্ধকারে তাকিয়ে তাকিয়ে কিসের অপেক্ষায় দুরু-দুরু করতে লাগলো বুক। মফস্বলের বাড়ি, অন্ধকারও সাঙ্ঘাতিক অন্ধকার, চোখ চলে না, মেঝেতে শুয়ে মেয়েটা করছে কী? এত অন্ধকারে সুনীলের নিজেরই তো ভয় করছে। ডাকবে নাকি উপরে উঠে শুতে? পরের মেয়ে, শেষে কি ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা লেগে মরবে? মরুক। আমার কী! ডাকতে গেলেই যেন সে আসবে! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো বোধ হয়, সহসা বুকের কাছে একটি উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের ওঠাপড়ায় চমকিত হ’লো সে। সব রাগ ভুলে গিয়ে সুনীলের একটা অদম্য ইচ্ছে হ’লো তার গায়ে একটু হাত ছোঁয়াতে, কিন্তু ভয়ে কাঁটা হ’য়ে রইলো পাছে আবার রাগ ক’রে সে সরে যায়।

পরের দিন সকাল থেকে আর সাবির পাত্তা নেই। সঙ্গে সঙ্গে নেড়ি কুকুরটাকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। চুপ। চুপ। চুপ। কী লজ্জা! কী লজ্জা! ঘরের বউ চন্দ্র সূর্যের মুখ দেখবে না সে নাকি বেরিয়ে গেল। ছি ছি ছি। লজ্জায়, ঘেন্নায় বাড়িসুদ্ধ লোকের প্রায় গলায় দড়ি দেবার দশা। সুনীল বালিশের তলায় ছোট্ট এক টুকরো চিঠি পেলো, ‘তোমরা বিশ্রি, তোমাদের বাড়ি বিশ্রি, আমি তাই চলে গেলাম। খবদ্দার আমাকে আনতে যেও না, তা হ’লে মা আবার জোর ক’রে পাঠিয়ে দেবেন। ইতি শ্ৰীমতী সাবিত্রী দত্ত।’ দত্তটা তার বাপের বাড়ির পদবী। সুনীলদের পদবী রায়। তলায় আবার পুনশ্চ দিয়ে লেখা―‘কিছু মনে কোরো না, বাঘাটাকেও নিয়ে গেলাম।’

একবাক্যে সক্কলের এই সিদ্ধান্ত হলো যে আর যদি ওরা মেয়ে নিয়ে এসে কখনো দাঁড়ায় এই স্টেশনে ধুলো পায়েই তৎক্ষণাৎ বিদায় দেবে তাদের। জোচ্চোরি ক’রে পাগল-ছাগল গছাবার আর জায়গা পায়নি ব্যাটারা। একটা বি এ পাস ছেলে, তার ঘাড়ে এই ভূত। এক মাসের মধ্যে ছেলের বিয়ে দেব আমরা।

মুখ চুন ক’রে ইস্কুলে গেল সুনীল। ইস্কুলে গিয়ে পড়াতে পারলো না। দিনকয়েকের দেখা দস্যি মেয়েটার জন্যই তার মন কেমন করতে লাগলো।

এদিকে এক যমের অরুচি বাংলা কুত্তা কোলে ক’রে সাবি যখন এসে তাদের বাড়িতে পৌঁছোলো মা তো অবাক। জ্যাঠা জ্যাঠাইমা জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা সব এসে ভিড় ক’রে দাঁড়ালো। কী ব্যাপার? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একা একা কার সঙ্গে এলি? কেন এলি?

সাবি চুপ।

‘পালিয়ে চ’লে এসেছিস নাকি?’

সাবি চুপ।

‘সব্বোনাশ করেছে তোর মেয়ে’ জ্যাঠাইমা আর্তনাদ ক’রে উঠলেন, ‘নে, সাধ ক’রে আরো হাবা মেয়ের বিয়ে দে!’ জ্যাঠামশাই হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘বেরো, বেরো শিগ্গির। নচ্ছার মেয়ে, পাজী মেয়ে, ভেবেছিস শ্বশুরবাড়ি থেকে চ’লে এলে এখানে সোনার থালায় ধানদূর্বা সাজিয়ে বরণ করবো। বেরো, এক্ষুনি বেরো।’ থাবড়া মেরে কোলের কুকুরটা ফেলে দিলেন, আর সেটা কেঁউ কেঁউ ক’রে উঠলো, ‘ইশ। কোথা থেকে আবার একটা নর্দমার কুকুর এনে হাজির করেছে।’ উত্তমাসুন্দরী পাথর।

কী দুঃখের দশা নিয়েই তিনি এই ভবসংসারে এসেছিলেন। এই সাবিত্রীর আগে আরো তাঁর চারটি পুত্রসন্তান জন্মেছিলো। অদ্ভুত এক রোগ ছিলো তাঁর। প্রত্যেকটি ছেলেই বিকৃত অঙ্গ নিয়ে জন্মাতো, এক বছর দেড় বছরের হ’য়ে মারা যেত শেষে। কত ডাক্তার, কত কবিরাজ, কত সাধু, কত সন্ন্যাসী―স্বামী চিকিৎসা করাতে আর বাকি রাখেননি। কিন্তু এর কোন সঠিক কারণ ডাক্তাররা নির্দেশও করতে পারেননি, সারাতেও পারেননি। আবার যখন এই মেয়ে পেটে এলো, চেষ্টা করেছিলেন নষ্ট ক’রে ফেলতে, শেষ পর্যন্ত পারেননি। তারপর যখন একমাথা কালো চুল আর এক মুঠো জুঁই ফুলের মত চেহারা নিয়ে জন্মালে কী আনন্দ। এই সন্তানেরই নাকি তিনি অনিষ্ট কামনা করেছিলেন। ছি ছি। ভাবতেও শিহরিত হ’য়ে উঠেছেন।

মেয়ে নিয়ে বুক জুড়োলো বটে, কিন্তু তার ছ’ বছর না পুরতেই বিধবা হলেন। সেই থেকে তো চলেছে এর দুয়ার আর তার দুয়ার। বড় ভাইঝির কাছে ছিলেন বছর খানেক, হাতে টাকা ছিলো তখন, অসুবিধে ছিলো না। তারপর নিয়ে এলেন বড়দা, রইলেন সেখানে পুরো তিন বছর। ছোট ভাই থাকে নাগপুরে, সেখানে বছর দেড়েক, তারপর একেবারে রিক্তহস্ত হ’য়ে ভাশুরের কাছে। কিছু গয়না আর লাইফ ইন্সিওরেন্সের হাজার টাকায় হাত দেননি এতকাল, তাও তো শেষ হয়েছে এই মেয়ের বিয়েতে।

উত্তমাসুন্দরী কতক্ষণ থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ ছুটে এসে পাগলের মতো এলোপাতাড়ি কিল চড় ঘুষি চালালেন মেয়ের পিঠে। জ্যাঠামশাই প্রজ্বলিত চোখে চ’লে গেলেন, ভাইবোনেরা হ্যা-হ্যা ক’রে হাসতে লাগলো, জ্যাঠাইমা রান্নাঘরে ঢুকলেন। কেবল কুকুরটাই এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানাতে লাগলো ক্রমাগত।

দুপুরে চোখের জলে ভেসে একখানা সুনীলকে আর একখানা সুনীলের মাকে চিঠি লিখলেন উত্তমাসুন্দরী। তাঁর মেয়েকে যেন তাঁরা ক্ষমা করেন, বোকা নির্বোধ ব’লে ঠেলে না দেন। তিনি নিতান্ত নিঃসহায় বিধবা, অন্তত তাঁর উপর দয়া ক’রেও যেন এবারের মতো মার্জনা করেন। তাঁদের চিঠি পেলেই মেয়েকে দিয়ে আসবেন তিনি নিজে গিয়ে। কয়েকদিন পরে জবাব এলো দুই ছত্র। সুনীলের মার কাছ থেকেও না, সুনীলের কাছ থেকেও না। লিখেছেন সুনীলের বাবা নিজে। দুঃখিত। এই বেরিয়ে যাওয়া বউ আর আমরা ঘরে তুলতে পারব না। কেননা ছেলে নিজেই বলেছে এই বউ যদি আবার এ-বাড়িতে ঢোকে কখনো, তা হ’লে সে-ই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তাছাড়া শিগ্গিরই আমরা মনোমত পছন্দমত আরেকটি পাত্রী স্থির করছি।

ব্যাস্। চুকলো। উত্তমাসুন্দরী ঘরে খিল দিয়ে দু’দিন কাঁদলেন, তিনদিন খেলেন না, ভাশুরের মুখ থমথমে হ’য়ে রইলো, জ্যাঠাইমা পাড়ায় ঘুরে জানিয়ে এলেন, এই ভবিষ্যদ্বাণী তিনি আগেই করেছিলেন। তারপর আবার কয়েকদিন পরে ঠিক হয়ে গেল সব। সবাই মেনে নিল সাবিকে। সে আগের মতোই স্বাধীন ইচ্ছেয় ঘুরতে ফিরতে লাগলো। এক মাস যেতে না-যেতে সকলেই ভুলে গেল যে সাবির আবার একটা বিয়ে হয়েছিলো মাঝখানে। বরং ভালোই হ’লো। আইবুড়ো নামও ঘুচলো আবার মার বুক খালি ক’রেও গেলো না। কোথায় যেন একটা নিশ্চিতাও অনুভব করলেন উত্তমাসুন্দরী।

কপালে সিঁদুর নাইবা থাকলো, ঘন ভ্রমরকৃষ্ণ আঙুরের মতো থোকা থোকা চুলের মাঝখানকার সরু সাদা সিঁথিতে লাল টুকটুকে রেখাটি কিন্তু জ্বলজ্বল করতে লাগলো সাবির। যত পাগলামিই করুক, স্নানটি ক’রে চুলটি আঁচড়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপে চুপে ঠিক চিরুনির ডগায় সিদুর নিয়ে রোজ ঐ রেখাটি আঁকে সে। আর আঁকতে আঁকতে একখানা কালো আর লাজুক মুখ হঠাৎ ক’রে ভেসে ওঠে চোখে। বুকের ভেতরটা একটা নাম-না-জানা অনুভূতিতে কাঁপতে থাকে অনেকক্ষণ ধ’রে।

এমনিতেই বাড়ন্ত, বিয়ের জল গায়ে লেগে বোধ হয় আরো বেড়ে উঠলো কচি লাউডাঁটার মত। শরীর পুরন্ত হ’লো, রং টুকটুকে হ’লো। আর যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো নিজে থেকেই কমে গেল তার, দলের সর্দারনী হ’য়ে ফোঁপরদালালি আর ভালো লাগলো না। দস্যিপনা শিথিল হ’লো। ভাইবোনেরা ইস্কুলে গেলে, জ্যাঠামশাই আপিসে গেলে মা জ্যাঠাইমা দুপুরে ঘুমুলে সে একা একা এঘর ওঘর করে, চিলকুঠির ছাতে গিয়ে চুপচাপ ব’সে থাকে। আবার কখনো কখনো ভীষণ লুকিয়ে, ভয়ঙ্কর চুপে চুপে, কোনো নিভৃত কোণে ব’সে দোয়াত কলম আর বিয়েতে পাওয়া নতুন চিঠির কাগজ নিয়ে কী যেন লেখে হিজিবিজি। টুক্ ক’রে একটা পাতা পড়ার শব্দ হ’লেও চমকে উঠে সেই লেখা পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে।

এর মধ্যেই একদিন তেজপুরের মেসোমশাই হন্তদন্ত হ’য়ে এসে খবর জানালেন, ‘আরে তোমরা করছো কী? মাস্টারবাবু যে তার ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন আবার। সব ঠিক। মেয়েও আমাদের চেনা।’ বাড়িতে তাই নিয়ে মহা হই-চই পড়ে গেল। জ্যাঠা বললেন, ‘নালিশ করবো। ইয়ে নাকি। চালাকি পেয়েছে? খোরপোশ দিতে হবে না?’জেঠি বললেন, ‘মেয়ে নিয়ে গিয়ে হাজির হও, দেখিনা কেমন না নিয়ে পারে।’ উত্তমাসুন্দরী কেবল চোখের জল মুছতে লাগলেন ঘন ঘন। শেষ পর্যন্ত কিছুই কার্যকরী হ’লো না, বাগাড়ম্বরই সার হ’লো।

স্নান ক’রে রোজের মতো সিঁথিতে সিঁদুররেখাটি আঁকতে গিয়ে আজ হাত কাঁপলো সাবির। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো তার চোখভরা জল। কেমন একটা কষ্টে গলা বুক ভারী হয়ে উঠেছে।

সেদিন দুপুর নির্জন হ’লে হাতবাক্স থেকে একটা টাকা নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো সে কোম্পানিবাগানের আঁকাবাঁকা পথ ধ’রে। আমবাগান ছাড়িয়ে, সরকার বাড়ির পেছন দিয়ে, মহিলা সমিতির কাঁচা ঘর ডিঙিয়ে সোজা বড় রাস্তায় এসে সে হাঁফ ছাড়লো। কতদিন বেরোয় না, আজ অনেকদিন পরে খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশ লাগলো তার। বাঘাটা পেছন পেছন এসেছিলো, দু’ চারবার ঢিল ছুঁড়তেই পালিয়ে গেল।

ভীষণ রোদ চড়েছে মাথার উপর। রাস্তাঘাটও নির্জন, নবাব-বাড়ির কাছাকাছি বড় গাব গাছটার তলায় এসে একটু গা ছম্‌ছম্‌ করলো। ভয়-ডর তার কুষ্টিতে নেই। আর এসব রাস্তা তো হাতের তেলো, কিন্তু ভূতের ভয়ে সে ভারি কাতর। ধীরে ধীরে রমনার রাস্তা বেয়ে পল্টন মাঠ ছাড়িয়ে লেবেল ক্রশের কাছে এসে রেল লাইন ধ’রে স্টেশনে এলো সে। রাতদিন গাড়ি যাচ্ছে তেজপুর, কুর্মিটোলা। পুরো এক ঘণ্টারও রাস্তা নয়, পঞ্চাশ মিনিট লাগে সবসুদ্ধ। ছ’ আনার টিকিট। একখানা টিকিট কেটে থার্ডক্লাস মেয়ে-কামরায় চুপচাপ উঠে বসলো। আর উঠে বসা মাত্রই হুইসিল বাজলো, নিশানা উড়লো আর ভালো ক’রে স্টার্ট দিতে না-দিতেই হুস ক’রে এসে গেল কুর্মিটোলা।

স্টেশনের উল্টোদিকের দরজা খুলে নেমে, মাথায় একগলা ঘোমটা টেনে দিয়ে আরো দু’টো লাইন পার হ’য়ে এপাশে এসে দাঁড়ালো সাবি। মাত্র পনেরো দিনের বসবাসের স্মৃতি। বেশ স্পষ্ট মনে আছে তার। ঐ তো দূরে স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টার, ঐ তো ইঁদারা, ঐ তো কাপড় শুকোচ্ছে তাদের। ধুতিটা কার? আবার বুকটা কেঁপে উঠলো একটু।

কিন্তু ইস্কুল কোনদিকে তা তো জানে না সাবি। গ্রাম দেশ, মাঠের আল বেয়ে বেয়ে এখন কোনদিকে যাবে সে? একটা গয়লানী থমকে দাঁড়ালো তার দিকে তাকিয়ে।

‘আমাকে বিদ্যাপতিহাই-ইস্কুলটা দেখিয়ে দিতে পার?’ সাবি আবেদনটা তাকেই জানালো। গয়লানী ঘাড় নাড়লো, তারপর বললো, তোমাকে যেন চেনা-চেনা লাগছে গো?’

‘আমাকে কোখেকে চিনবে? আমি হলাম গিয়ে বিদেশী।’

‘বিদেশী? কোথায় থাক?

‘তেজপুরে। তা-ও আমার বাড়ি নয়, দিদির বাড়ি।’

‘ও, তেজপুর। তো এখানে ইস্কুলে যাচ্ছ কেন মেয়েমানুষ?’

সাবি চিন্তা করলো একটু। তারপর বললো, বড় বিপদে পড়েছি কিনা। আমার দিদির খুব অসুখ বেড়েছে। জামাইবাবু এখানকার ইস্কুলমাস্টার, খবর দিতে এসেছি। বাড়িতে আর কোনো পুরুষ নেই।

‘ও। তবে তো ভারি মুশকিল। এসো, পা চালাও। আমি ওদিকেই যাচ্ছি।’

বেশি দূর না। একটা মাঠ পেরিয়েই মস্ত চালাবাড়ি। দূর থেকেই গোলমাল কোলাহলে বোঝা গেল, হ্যাঁ ইস্কুলই বটে। গয়লানী চৌকিদারকে ডেকে দিয়ে চলে গেল নিজের পথে। সাবি চৌকিদারের হাতে দু’ আনা পয়সা গুঁজে দিয়ে বললো,‘শিগ্গির সুনীল মাস্টারকে একটা খবর দিয়ে দাও তো দারোয়ানবাবু, বলো যে, বাড়িতে ভারি বিপদ।’

‘আর হাপুনে তাহুলে’―’

‘না না আমার কথা কিছু বলতে হবে না, শুধু তাকে একবার বার ক’রে নিয়ে এসো ক্লাস থেকে।’ আরো দু’ আনা গুঁজে দিল হাতে। দু’ আনাতেই যথেষ্ট গ’লে গিয়েছিলো চৌকিদার, তার উপরে দারোয়ানবাবু শুনে তো আত্মহারা, আবার তার উপর আরো দু’ আনা। এক দৌড়ে সে গিয়ে ডেকে নিয়ে এলো তাকে। আর হন্তদন্ত হ’য়ে ঘাম মুছতে মুছতে সুনীল এসে সাবিকে দেখে তো একেবারে থ। সাবি চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎ কেমন জানি লজ্জা করলো একটু।

‘তুমি! এখানে!’ সুনীলের মুখ থেকে খ’সে পড়লো শব্দ দুটি।

‘তা কী করবো?’ অভিমানে ভারি হ’লো সাবির গলা,‘তোমরা তো আমাকে বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না।’

‘না করেছি কখনো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কবে?’

‘তোমার বাবা তো লিখেছেন আমি এলেই তুমি বিবাগী হ’য়ে চলে যাবে। কেন, আমি কী করেছি?’ দুপুরের রৌদ্র-ঝলসিত সুন্দর একখানা মুখ, এই মুখখানা কতদিন কত সময়ে মনে পড়েছে সুনীলের। বুকের কাছে তার ভয় পাওয়া উষ্ণ নিঃশ্বাসটুকু অনুভব করতে করতে কত বুক কেঁপেছে। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সে। তারপর সহসা সচকিত হ’য়ে বললো, ‘একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।’

ক্লাস ছুটি নিয়ে আবার মুহূর্তে ফিরে এলো সে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পোড়ো মন্দিরের ভাঙা বটগাছের নিভৃত ছায়ায় এনে বসালো সাবিকে। একেবারে নিভৃত নির্জন জায়গা, চারদিক তাকালে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই, কেবল হলদে ফুল সরষে-খেতের ঢেউ। পকেট থেকে রুমাল বার ক’রে কোলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ‘মুখটা মোছ, কত ঘেমেছ। আবার ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছ বুঝি?’

‘কেন আসবো না?’

‘কেন আসবে?’

‘তুমি কেন বিয়ে করবে?’

‘বিয়ে।’ মুখটা শুকিয়ে গেল সুনীলের। একটুখন জবাব দিল না। তারপর বললো, ‘তুমি তো আর আমাকে চাও না। বিয়ে করি, বা না করি।’

‘ন্‌না।’

‘কী না?’

‘তুমি বিয়ে করবে না।’

‘করলে ক্ষতি কী?’

‘আমি ঢিল ছুঁড়বো’।

হেসে ফেললো সুনীল, কাকে?’

‘ঐ তাকে।’

‘তার কী দোষ?’

‘আমি জানিনে যাও।’ দু’ হাতে মুখ ঢাকলো সাবি।

একটু পরে হাত সরিয়ে দিয়ে সুনীল বললো, ‘একটা কথা শোন।’

‘না।’

‘এইসব অবাধ্যতা কর বলেই তো আমি বিয়ে করতে চাই।’

‘করবো, করবো তো, একশোবার করবো। আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না।’

‘শুনবে না’?

‘না।’

‘তা হলে বিয়ে করবো’?

‘না।’

‘বেশ কথা। নিজেও আসবে না অন্যকেও আসতে দেবে না!’

‘কেন দেব?’

‘কেনই বা দেবে না?’

‘তুমি—তুমি তো আমার’। ব’লেই ভয়ানক লজ্জা পেয়ে গাছের ও-পাশে গিয়ে মুখ লুকোলো। সুনীলের চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক মেরে উঠলো। বললো, ‘শিগ্গির এখানে এসো।’

‘না।’

‘এসো বলছি।

‘না।’

‘আসবে না?

‘না।’

‘ঠিক আছে। আমি চললাম। বটতলার খবর সবাই জানে, রাত্রি বা নীরব দুপুর তো দূরের কথা দিনের যে কোনো সময়ে একা দাঁড়িয়ে থাক না এর তলায়, সেই সিধু নাপিত ফাঁসি দিয়ে মরার পর থেকে—’

সড়াৎ ক’রে শুকনো পাতায় বুক মাড়িয়ে একটা গিরগিটি চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সাবি ‘ওরে মারে বাবারে’ বলে ছিটকে এসে জড়িয়ে ধরলো সুনীলকে। চারদিক তাকিয়ে সুনীল তৎক্ষণাৎ চট ক’রে সাবির বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরা কপালটিতে চুমু খেল একটি। লাল হয়ে সাবি বললো ‘ধ্যেৎ।’

সারা বেলা তারপর তারা কেমন ক’রে কাটালো, কোথায় কাটালো সেসব প্রশ্ন অবান্তর। সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন দু’জনে লম্বা ছায়া ফেলে ভেতরের উঠোনে এসে দাঁড়ালো কুণ্ঠিত পায়ে তখন মা তুলসী তলায় প্রদীপ দিতে দিতে ছেলের কথাই ভাবছিলেন। এখনো কেন স্কুল থেকে ফিরলো না সেটা ভেবেই উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন। কদিন থেকে তো বাড়িতে ছেলের সঙ্গে কম অশান্তি যাচ্ছে না বিয়ের ব্যাপার নিয়ে, নাকি তার জন্যেই রাগ ক’রে চ’লে গেল কোথায়! কতরকম ভাবতে ভাবতে যখন প্রণাম সেরে মুখ তুললেন, আস্তে এসে লক্ষ্মী মেয়ের মতো কাছে দাঁড়ালো সাবি।

‘কে?’ ঝাপসা আলোয় তিনি চমকে উঠলেন।

সুনীল এগিয়ে এসে বললো, ‘ওকে নিয়ে এলাম মা।’

‘নিয়ে এলি?’

‘তোমরা তো একজন বউ-ই চাইছিলে, তাই―’

‘তাই নিজে যেচে, সেধে গিয়ে ওকে নিয়ে এলি? একটা মান-সম্মানও কি নেই তোর? নিজের না থাক, মা-বাপের উপরও তো তোর একটা কর্তব্য―’

বড় বড় চোখ তুলে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো সাবি―‘না তো, ও তো আমাকে আনেনি। আমি তো নিজে এসেছি। পালিয়ে এসেছি দুপুর বেলা।’

সুনীল চকিত হ’লো। সুনীলের মা তাজ্জব। সাবি ছোট মেয়ের মত শাশুড়ির হাত ধ’রে ফিক ক’রে হাসলো, ‘ও ভীষণ মিথ্যুক মা। আরো কিন্তু অনেক মিথ্যে কথা বলবে ব’লে ঠিক ক’রে এসেছে।’

মা ছেলের দিকে তাকালেন, সুনীল নত দৃষ্টিতে চুপ।

হঠাৎ এতখানি জিব কাটলো সাবি, ‘এমা, তোমাকে তো নমস্কারই করিনি এতক্ষণ পর্যন্ত। খপ ক’রে শাশুড়ির পায়ে নরম হাতটা বুলিয়ে নিল একটু। শাশুড়ি কঠিন হ’য়ে পা সরিয়ে নিতে গিয়েও হঠাৎ হেসে ফেললেন, তারপর ওর না-আঁচড়ানো মাথার এলোমলো চুলের ঝুটি ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘যা ঘরে যা। আর কোনদিন যদি পালাস তখন দেখিস।’ নির্লজ্জের মতো অসংকোচে ঘরে যেতে যেতে সাবি বললো, “কেবল একদিন গিয়ে তোমাদের ঘিয়েভাজাটাকে নিয়ে আসতে হবে।

১৩৬১ (১৯৫৪)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *