2 of 3

ধ্রুবতারা

ধ্রুবতারা

কিছু চাইব না। সামান্যতম সুখও আমি চাইব না। ঠাকুর আপনি আমাকে যা দেবেন তাই আমার প্রাপ্য; কারণ আমি জানি না, কি চাইতে হয়! কোন্‌টা আমার শ্রেয় কোন্‌টা আমার প্রেয়। আর চাইবই বা কেন? আপনাতে যখন সমর্পিত আমি, তখন আপনিই তো জানবেন আমার প্রয়োজন। আপনিই তো আমার ভবরোগের বৈদ্য। আমার ওষুধ, আমার পথ্য সবই তো হবে আপনার বিধানে। বিনা অভিযোগে যেন গ্রহণ করতে শিখি। দুঃখ–সেও আপনার দান, সুখ—সেও আপনার দান, এই বোধে আমি যেন অবিচল থাকতে পারি। আমি যেন আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমি যেন আপনার দর্শন পাই। আমি যেন আপনার স্পর্শ পাই। আমি যেন আপনার পদশব্দ পাই। আমি যেন আপনাকে অনুসরণ করতে পারি। আমার বিশ্বাস যেন টলে না যায়। একটা দানই আমি সকাতরে চাইব—কৃপা। নিরন্তর আমার এই প্রার্থনা—কৃপাকণিকা। কৃপা কি? আপনাকে বিশ্বাস। একটু অহঙ্কারও মিশুক না! কি সেই অহঙ্কার! আমি আপনার সন্তান! রামপ্রসাদের অহঙ্কার-

“এ সংসারে ডরি কারে, রাজা যার মা মহেশ্বরী।
আনন্দে আনন্দময়ীর খাস তালুকে বসত করি।।”

রাজা যার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, তার আবার কিসের ডর! ঠাকুর আপনিও বলতেন, রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না। বলতেন, মা যার আনন্দময়ী সেকি নিরানন্দে থাকে। রামকৃষ্ণের সন্তান আমি, আমার দিন ঠিকই চলে যাবে। প্রলোভন আমি জয় করতে পারব। আপনি বলেছিলেন, সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো। সেই পাঁকালের পিচ্ছিলতা আমি পাব আপনার কৃপায়। আপনি বলেছিলেন, হনুমান হতে। মহাবীর বুক ফেঁড়ে দেখালেন, রামসীতা। আমার নিষ্ঠায়, আমার বুকেও যেন ঠাকুর আর শ্রীমায়ের আসন পাকা হয়। নিষ্ঠা হলো, বালকের বিশ্বাস। বিশ্বাসে আমি যেন বালক হতে পারি। আপনি সেই জটিল বালকের গল্পটি বলেছিলেন—এক বিধবার একটি ছোট ছেলে ছিল। তার নাম জটিল। জটিল দূরে গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তে যেত। বিধবা বড় গরিব ছিল। তাঁদের আপন বলতে আর কেউ ছিল না। জটিলকে একটা বনের ভেতর দিয়ে পাঠশালে যেতে হতো। বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে রোজই তার ভয় করত। একদিন মায়ের কাছে কেঁদে সে বলল, ‘মা, একা একা পাঠশালে যেতে আমার বড্ড ভয় করে। আমার সঙ্গে একটি লোক দাও। নইলে আর পাঠশালে যাচ্ছিনে।

জটিলের কথায় মায়ের মনে দুঃখ হলো; বললেন, ‘লোক কোথা পাব, বাছা! বনে তোমার এক দাদা থাকে। তার নাম মধুসূদন। ভয় পেলে তাকে ডেকো। সেই তোমার সঙ্গে যাবে।’ বালক সরল বিশ্বাসে ডাকে—’মধুসূদন দাদা, তুমি কোথায়? এস।’ বালকের ডাকে তিনি এলেন। সত্যিই এলেন, নির্জন বনপথ পার করে দিতে। গুরুমশাইয়ের মায়ের শ্রাদ্ধ। সব ছেলেরাই সবকিছু দিচ্ছে। জটিল কি দেবে! মা বললেন, ‘তোমার মধুসূদন দাদাকে জিজ্ঞেস কর।’ তিনি বললেন, ‘গুরুমশাইকে বলো, তুমি দই দেবে।’ কাজের দিন জটিল ছোট এক ভাঁড় দই নিয়ে হাজির হলো। গুরুমশাই ক্ষিপ্ত—এত নিমন্ত্রিত আর এতটুকু দই। প্রহারে জটিল জ্ঞানহারা। ওদিকে অলৌকিক কাণ্ড, মধুসূদনের ভাণ্ড আর ফুরোয় না। যত ঢালে তত দই। গুরুমশাই বললেন, ‘জটিল, তোমার মধুসূদন দাদাকে একবার দেখাবে!’ বনের প্রান্তে সবাই হাজির। জটিল ডাকছে, ‘মধুসূদন দাদা এস। আমার গুরুমশাই দেখবেন।’

তিনি উত্তর দিলেন—’জটিল, আজ আমি আসতে পারব না। তুমি সরল বিশ্বাসে আমাকে পেয়েছ। তোমার গুরুমশাই ও অন্যান্য ছাত্রদের তোমার মতো বিশ্বাস নেই। তারা আমায় দেখতে পাবে না। তারা চলে গেলেই আমি তোমার কাছে আসব।’

এই সংসার অরণ্যে, ঠাকুর আমি একলা পথিক। কেউ নেই আমার, অর্থ, সামর্থ্য, লোকবল। আপনি আমার মধুসূদন দাদা। বালকের বিশ্বাসে ডাকি, ঠাকুর, ঠাকুর। বিশ্বাসের সুতোয় অবিশ্বাসের সামান্যতম ফেঁসোটি যখন ভক্তিলালায় মসৃণ হয়ে যাবে, তখনই তা রামকৃষ্ণ সূঁচের ছিদ্রে অনায়াসে প্রবিষ্ট হবে।

তবু যদি দুঃখ পাই জ্বালাযন্ত্রণা আসে আসুক। আপনি বলেছেন :

“কি জান, সুখ-দুঃখ দেহধারণের ধর্ম। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল; তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। দেহধারণ করলেই সুখ-দুঃখ ভোগ আছে। শ্ৰীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুলনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন। সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ। মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল। একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে; তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না। সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবান দেবকীর দর্শন হলো। কিন্তু কারাগার ঘুচল না।” প্রারব্ধ কর্মের ভোগ আমাকে করে যেতেই হবে। আমার মন তৈয়ার। যে কদিন ভোগ আছে, সেই কদিন দেহধারণ। কিন্তু আমার আনন্দ! আপনিই সেই আনন্দ।

“ওহে ধ্রুবতারাসম হৃদে জ্বলন্ত বিশ্বাস হে,
জ্বালি দিয়ে দীনবন্ধু পুরাও মনের আশ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *