ছয়
রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আরাতামা মারুর ডেক। বুলেটের বন্যা বইছে সবদিক থেকে। খোলা জায়গা থেকে দ্রুত সরে যাবার চেষ্টা করছে কর্টেজ, কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে লোরিকে, মাঝে মাঝে উল্টো ঘুরে এক পশলা গুলি ছুঁড়ছে রণক্ষেত্রের দিকে। তবে এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই তার, বিকল্প একটা প্ল্যান খেলা করছে তার মাথায়।
আড়ালে পৌছে একটু থামল সে। যাচাই করল পরিস্থিতি। অতর্কিত হামলা চালিয়ে তার দলে ছ’জনকে ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষ, তবে এখন আর অগ্রসর হচ্ছে না। নিরাপদ আশ্রয় থেকে গোলাগুলি করছে। নিশ্চয়ই ব্যাকআপের অপেক্ষায় রয়েছে।
ধারণাটা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো কয়েক মিনিট পরেই। কাছে চলে এসেছে প্রতিপক্ষের জাহাজ, সেখান থেকে গমগম করে উঠল লাউডস্পিকার।
‘অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করো।’
বিপদটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে কর্টেজ, তবে হাল ছাড়ল না। পাশার দান উল্টে দিতে জানে সে। লোরিকে নিয়ে একটা লোডিং ক্রেনের কাছে গেল, টেনে নামাল হুক, ওতে আটকে দিল তামার তার দিয়ে বাঁধা বন্দিনীর হাতদুটো। পাওয়ার সুইচ অন করতেই গুঞ্জন তুলল ক্রেনের হাইড্রলিক পাম্প।
লোরির মুখে গোঁজা কাপড়টা সরিয়ে নিল কর্টেজ। নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলল, ‘চেঁচাতে হবে তোমাকে, ডিয়ার। যত জোরে পারো!’
লিভার টেনে দিল সে, সচল হলো ক্রেন। টান দিয়ে লোরিকে তুলে ফেলল শূন্যে। তামার তার কেটে বসল হাতের চামড়ায়, নিজের অজান্তেই আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে।
.
স্টিলের একটা হ্যাচ কাভারের পেছনে উবু হয়ে আছে রানা। বোট নিয়ে সরাসরি জাহাজের ডেকে উঠে আসার প্ল্যানটা দারুণ কাজে দিয়েছে। নেপচুন পেছন থেকে আসছে বলে ওদিকে নজর ছিল দস্যুদের, ধোঁয়ার আড়ালে বোটটাকে দেখতে পায়নি। ফলে বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাবার আগেই ঘায়েল করা গেছে ওদের বেশ কয়েকজনকে। প্ল্যানের একমাত্র খুঁত হলো, বিপক্ষের সংখ্যা ঠিকমত আন্দাজ করতে পারেনি ও। যা ভেবেছিল, তার চেয়ে ডজনখানেক, কিংবা তারও বেশি জলদস্যু হানা দিয়েছে আরাতামা মারুতে।
বেঁচে যাওয়া দস্যুরা এখন কাভার নিয়ে গুলি ছুঁড়ছে ওদের দিকে, এগোতে দিচ্ছে না। নেপচুন থেকে বাকি দুটো বোট আসার অপেক্ষায় আছে রানা, ওগুলো চলে এলে সংখ্যার দিক থেকে দু’পক্ষের একটা ভারসাম্য তৈরি হবে। তারপরেও কতখানি রক্তপাত ঘটাতে হবে, সেটা নিয়েই ও চিন্তিত।
কোমরে ঝোলানো রেডিও’ জ্যান্ত হয়ে উঠল। বোর্ডিং পার্টিবাহী বাকি দুটো বোটের গতি কম, পেছনে পড়ে গেছে। ওগুলোর একটা থেকে ডাকা হচ্ছে ওকে। ‘মি. রানা, আমরা স্টার্নের দিকে এগোচ্ছি। এখনও বাধা পাইনি
ওদেরকে কিছু বলার সুযোগ পেল না রানা, একের পর গুলি এসে বিঁধছে হ্যাচের গায়ে। আরেকটু নিচু হলো ও, বোঝার চেষ্টা করল, কোত্থেকে গুলি করা হচ্ছে। আর তখুনি ভেসে এল নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সেদিকে তাকাতেই একটা মেয়েকে দেখতে পেল, ত্রিশের কোঠায় বয়স, অসহায়ভাবে ঝুলছে ক্রেনের হুক থেকে।
এবার একটা ভরাট গলা ভেসে এল ওপর থেকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘পাগলামিটা কি থামানো যায় এবার?’
মাথা বের করে বক্তার দিকে তাকাবার চেষ্টা করল না রানা, তাতে গুলি খাবার সম্ভাবনা আছে। ওর ইশারা পেয়ে গুলিবর্ষণ বন্ধ করল সবাই। মেয়েটার দিকে আবার তাকাল ও—হাত বেয়ে রক্তের ধারা নামছে তার, ভিজে যাচ্ছে পোশাক।
‘বেশ, আমার কথা তা হলে শুনতে পাচ্ছ তোমরা,’ ওপর থেকে বলল কণ্ঠটা। ‘কী চাই সেটা জানিয়ে দেয়া যাক। এক্ষুনি আমাকে আমার লোকজন-সহ জাহাজ থেকে নেমে যেতে দেবে তোমরা, নইলে গুলি করে মেয়েটাকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে।’
আশপাশে তাকাল রানা, ধোঁয়া আর ঘামে চোখ জ্বলছে। লক্ষ করল, গোড়ালি পর্যন্ত উঠে এসেছে পানি। বো ডুবে গেছে পুরোপুরি। খোলা হ্যাচ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঢুকতে দেখল খোলের ভেতরে। বুঝল, অন্তিম দশা ঘনিয়ে এসেছে জাহাজের। সামনের কার্গো হোল্ডগুলো পানিতে ভরে যেতে যা দেরি, এরপর ওজনের টানে পুরো জাহাজ তলিয়ে যাবে সাগরে।
‘আমি অপেক্ষা করছি!’ ওপর থেকে গর্জে উঠল কণ্ঠটা। ‘মি. রানা?’ রেডিওতে ডাকা হলো। ‘কী করতে চান?’ বাটন চাপল রানা। বলল, ‘যে যেখানে আছ, সেখানেই থাকো।’
‘কথা বলছ না কেন?’ চেঁচাল কর্টেজ।
ঝুলে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। কোনও পথ দেখছে না দাবি মেনে নেয়া ছাড়া। বাকি দুটো বোট এখনও পৌঁছায়নি। পৌঁছলেও দস্যুদের পরাস্ত করার আগেই খুন হয়ে যাবে মেয়েটা। সেটা হতে দেয়া যায় না। তা ছাড়া জাহাজ থেকে নামলেই নাগালের বাইরে যেতে পারছে না দস্যুরা। ধাওয়া করে ওদেরকে পরেও ধরা যাবে।
গলা চড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। চলে যাও তোমরা।’ সঙ্গীদের নির্দেশ দিল, ‘কেউ বাধা দিয়ো না।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডেকে পায়ের · আওয়াজ পাওয়া গেল—দস্যুরা পালাচ্ছে।
রেডিওতে ফিসফিসাল রানা, ‘লিডারকে দেখতে পাচ্ছ কেউ? ওপরেই কোথাও আছে সে।’
গুলির আওয়াজ হলো, কেউ মাথা তুলেছিল। শোনা গেল গোঙানি।
‘উঁকি দেয়া চলবে না,’ আড়াল থেকে বলল কণ্ঠটা।
হতাশায় মাথা নাড়ল রানা। রেডিওতে জানতে চাইল, ‘কে গুলি খেয়েছে?’
কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর জানানো হলো, ‘ফস্টার।’
দাঁতে দাঁত পিষল রানা। গলা উঁচু করে বলল, ‘আর যদি একজনও গুলি খায়, এখান থেকে তুমি প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।’
হাসির আওয়াজ ভেসে এল। ‘হ্যাঁ, সেটা ভেবেই বসে থাকো।’
ঊরুতে চুমু খাচ্ছে পানি, মনে হলো জোয়ার এসেছে, তবে খুব দ্রুত। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে জাহাজের। নাক নিচু হয়ে যাওয়ায় আলগা জিনিসপত্র গড়াতে শুরু করল ডেকের ওপর দিয়ে।
মেয়েটাকে দেখল রানা—তীব্র ব্যথায় চেহারা সাদা হয়ে গেছে। যে-লোক ওর এই দশা করেছে, তাকে নিজ হাতে শাস্তি দেবে, ঠিক করল ও।
কয়েক মিনিট কাটল। এরপর স্টারবোর্ড সাইড থেকে ভেসে এল শক্তিশালী আউটবোর্ড মোটরের গর্জন। উঁকি দিয়ে মাঝারি আকারের একটা পাওয়ারবোটকে পানি চিরে দুরন্ত বেগে ছুটতে দেখল রানা। লাফ দিয়ে এবার উঠে দাঁড়াল ও।
‘মুভ!’
আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সবাই।
‘কী অবস্থা আমাদের?’ জানতে চাইল রানা।
‘ফস্টার আহত,’ এগিয়ে এল নেপচুনের এক অফিসার, তার নাম ডিকসন। ‘লেসলিও গুলি খেয়েছে।’
‘দু’জনকেই বোটে তুলুন।’
‘এখানে তল্লাশি করব না?’
‘মনে হয় না কাউকে বাঁচিয়ে রেখেছে,’ বলল রানা। ‘সময়ও নেই।’
কর্কশ একটা আওয়াজ ভেসে এল জাহাজের পেছন থেকে। দশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ডুবে গেছে বো, ঢালু ডেকের ওপর দিয়ে তুমুল বেগে ছুটে আসছে একটা ভারী চেইন। ডাইভ দিয়ে সরে গেল রানা। চেইনটা পড়ে গেল একটা খোলা হ্যাচের ভেতরে। ধাতব ঝঙ্কার ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। মরণ-আর্তনাদ ছাড়ছে আরাতামা মারু।
‘জাহাজ থেকে নেমে যান এখুনি, ডিকসনের দিকে তাকিয়ে বলল রানা। ‘কুইক!’
‘আপনি কোথায় চললেন?’
ক্রেনের দিকে ইশারা করল রানা। ‘মেয়েটাকে নামিয়ে আনতে।’
ঢালু ডেক ধরে ক্রেন ডেকের দিকে এগোল ও। জাহাজের সারফেস তেল আর পানিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে, পা হড়কে যেতে চায়। আশপাশে যা পেল, তা-ই ধরে ধরে এগোতে হলো ওকে—পর্বতারোহীর মত। বহু কষ্টে পৌঁছুল একটা মইয়ের কাছে, ওটা ধরে উঠে এল ওপরে। চকিতে দেখতে পেল দস্যুদের বোট-দক্ষিণ দিকে ছুটছে। ওদিকে আর তাকাল না, হাঁচড়ে-পাঁচড়ে এগোল ক্রেনের কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে
ওখানে পৌঁছে ক্ষণিকের জন্যে থমকাল রানা। অপারেটরের সিটের গদিতে বিদ্ধ হয়ে আছে একটা অদ্ভুতদর্শন ছুরি। ফলাটা পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, টাইটেনিয়ামের তৈরি, ভাঁজ করা যায়। সন্দেহ নেই, ওর জন্যেই ছুরিটা রেখে গেছে অচেনা শত্রু- ওকে ব্যঙ্গ করার জন্যে। ফলা ভাঁজ করে ছুরিটা পকেটে রাখল ও।
কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর মনোযোগ দিল রানা। স্বস্তি অনুভব করল বাতি জ্বলতে দেখে। তার মানে সচল আছে যন্ত্রটা।
‘একটু ধৈর্য ধরুন,’ মেয়েটাকে বলল ও। ‘এখুনি আপনাকে নামিয়ে আনছি।’
জবাব দিল না লোরি, দেবার মত অবস্থায় নেই।
লিভার টানল রানা, ক্রেনের বাহুটাকে সাবধানে নিয়ে আসছে ডেকের ওপরে। কিন্তু কিছুটা এসেই ঝাঁকি খেল ওটা, থেমে গেল। পেণ্ডুলামের মত দুলে উঠল লোরির দেহ, ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সে।
নিচে তাকাল রানা… এতক্ষণে লক্ষ করল, ক্রেনের পাশ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরছে হাইড্রলিক লিকুইড। যাবার আগে পাইপটা কেটে দিয়ে গেছে দস্যুদলের নেতা। ছুরি রেখে যাবার অর্থটা বোঝা যাচ্ছে এবার। কানে যেন ভেসে এল লোকটার হাসির আওয়াজ।
রেডিওতে ডাক শোনা গেল ডিকসনের। ‘মি. রানা, আমরা নেমে গেছি। আপনারও নামা দরকার। জাহাজের পেছনদিক উঁচু হয়ে গেছে, ফ্যানটেইল দেখতে পাচ্ছি আমরা।’
সামনে তাকাল রানা। বো-র কোনও অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই চলে গেছে পানির তলায়। বিপজ্জনকভাবে সামনে ঝুঁকে পড়েছে জাহাজের পুরো কাঠামো। হাতে একেবারেই সময় নেই।
ক্রেন অচল, এখন একটাই রাস্তা। কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে রাখল ও, উঠে পড়ল ক্রেনের বাহুতে। জাহাজের মত ওটাও ঝুঁকে গেছে সামনে, গায়ে পড়েছে তেল-পানির আস্তর। সাবধানে সাপের মত পিছলে আগে বাড়ল রানা। নিচে ধাম ধাম করে কতগুলো গ্যাস সিলিণ্ডার আছড়ে পড়ল ডেকে, গড়াতে শুরু করল। ধারালো কিছুর সঙ্গে খোঁচা খেল একটা সিলিণ্ডার, স্ফুলিঙ্গ উঠল, পরক্ষণে বিস্ফোরিত হলো ওটা।
শকওয়েভের ধাক্কায় ছিটকে গেল রানা। পড়েই যেত, শেষ মুহূর্তে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ক্রেনের বাহু, পাদুটো ঝুলে পড়ল শূন্যে। সামনে থেকে ভেসে এল লোরির চিৎকার।
‘ওহ্ গড! প্লিজ, তাড়াতাড়ি আসুন!’
এগোবে কী, ক্রেন ধরে কোনোমতে ঝুলে আছে রানা। নিচে আরও বিস্ফোরণ ঘটছে। নাকে ভেসে আসছে তেলপোড়া গন্ধ। পানির ওপর ভাসছে জ্বলন্ত ফিউয়েল, আক্ষরিক অর্থেই নরকে পরিণত হয়েছে পুরো জাহাজ।
দাঁতে দাঁত পিষল রানা, একটু দোল খেয়ে একটা পা তুলে দিল ক্রেনে, এরপর তুলে আনল পুরো দেহ। নিচে তাকিয়ে আঁতকে উঠল, ডেক আর দেখা যাচ্ছে না, উন্মত্ত পানি খেলা করছে সবখানে। তাড়াতাড়ি সামনে এগোল।
দশ ফুট যেতেই হুকের ঠিক ওপরে পৌঁছে গেল ও। দেখল, লোরির কবজি কেটে মাংসে ঢুকে গেছে তারের বাঁধন। ক্রেনের গায়ে শরীর মিশিয়ে দিয়ে দু’হাত নিচে বাড়িয়ে দিয়ে ধরল ও মেয়েটার বাহুদুটো। টেনে ওপরে তোলার চেষ্টা করতেই বুঝল, লাভ নেই। রক্তে ভেজা চামড়ায় পিছলে যাচ্ছে মুঠো, লেভারেজ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘মি. রানা!’ রেডিওতে চিৎকার ভেসে এল। ‘জাহাজটা ডুবছে… ডুবছে!’
জানে রানা, কিন্তু করার কিছু নেই। লোরিকে বলল, ‘আমি ধরছি আপনাকে। উঁচু হতে পারেন কি না দেখুন।’
‘পারব না,’ দুর্বল গলায় বলল লোরি। ‘আমার কাঁধের হাড় নড়ে গেছে।’
নিচে থই থই করতে থাকা পানির দিকে তাকাল রানা—একটাই রাস্তা দেখছে। পকেট থেকে দস্যুনেতার ছুরিটা বের করল ও, ভাঁজ খুলল। তারপর নিচু হয়ে পৌঁচ দিতে শুরু করল লোরির বাঁধনে। ছুরিটা খুবই ধারালো, কয়েক পোচ দিতেই ছিঁড়ে গেল তামার তার। নিচে পড়ে গেল লোরি। রানাও ঝাঁপ দিল ওর পিছু পিছু।
ঝপাস করে পানিতে পড়ল দু’জনে, পড়েই তলিয়ে গেল। পায়ের তলায় শক্ত কিছু ঠেকতেই আবার লাথি দিল রানা, ভেসে উঠল ভুস করে। চোখ থেকে পানি সরে গেলে লোরিকে দেখতে পেল, এক হাত নেড়ে ভেসে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে মেয়েটা। পেছন থেকে ওকে জাপটে ধরল রানা, সাঁতার কাটতে শুরু করল। যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে হবে, নইলে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। ওদের চারদিকে পানি পাক খেতে শুরু করেছে, টানছে নিচের দিকে।
ডুবে যাচ্ছে আরাতামা মারু। লেজটা উঠে গেছে শূন্যে, প্রপেলার ব্লেড আর ফ্যানটেইল এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। তীরের মত পুরো কাঠামোটাই এবার তির্যকভাবে ঢুকে যাবে পানিতে, সারফেসে ভয়াবহ এক সাকশন তৈরি করে। বিপদসীমার বাইরে যেতে না পারলে টেনে নেবে রানা আর লোরিকেও।
পাগলের মত সাঁতার কাটছে রানা, লোরিও হাত-পা নেড়ে সাহায্য করছে যতটা সম্ভব; কিন্তু পরিষ্কার বুঝল ও হেরে যাচ্ছে ওরা। এভাবে বেশিদূর যেতে পারবে না।
কয়েক মিনিট পর তা-ই ঘটল, জাহাজটা তলিয়ে গেল পানিতে… ঢেউ, ফেনা আর বুদের আলোড়ন তুলে। সৃষ্টি হলো ভাটার মত তীব্র এক টান। এগোতে আর পারল না রানা, পানির টানে ভেসে গেল পেছনে। মনে মনে মৃত্যুকে মেনেই নিতে চলেছিল, কিন্তু আচমকা প্রচণ্ড বেগে নেপচুনের দ্রুতগামী বোটটা ছুটে এল, থামল ওদের পাশে। কয়েক জোড়া হাত নেমে এল, রানা আর লোরিকে টেনে তুলল বোটে। এরপর আবার নাক ঘোরাল বোট, গতি বাড়িয়ে সরে এল আলোড়িত পানির সীমানা থেকে।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা। আরাতামা মারুর আর চিহ্ন নেই সাগরের বুকে।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মি. ডিকসন,’ বলল ও। ‘আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন।’
‘শখ করে বাঁচাইনি,’ হালকা গলায় বলল ডিকসন। ‘আপনাকে ফেলে গেলে ক্যাপ্টেন মিচাম আমাদেরকে আস্ত রাখতেন ভেবেছেন?’ হাসল সে।
লোরির দিকে তাকাল রানা। মূর্তির মত বসে আছে সে। সারা গায়ে তেল-কালি, কেটে গেছে দু’কবজি। গায়ের পোশাক শতচ্ছিন্ন। লাল হয়ে আছে দুই চোখ। ডান কাঁধের ফোলা দেখে বোঝা যাচ্ছে, জয়েন্ট নড়ে গেছে। কিন্তু কোনও আওয়াজ নেই তার মুখে।
‘আমাদের জাহাজে ডাক্তার আছে, তাকে বলল ও। ‘আঘাত কোনোটাই খুব গুরুতর বলে মনে হচ্ছে না। আশা করি ঠিক হয়ে যাবেন।
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল লোরি। শোকে মুহ্যমান।
নেপচুনের দিকে ছুটে চলল বোট।
.
দশ মিনিট পর লোরিকে ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে নেপচুনের ব্রিজে উঠে এল রানা। বোটগুলো ইতিমধ্যে তুলে নেয়া হয়েছে, দিক পাল্টে দস্যুদের পিছু নিয়েছে জাহাজ।
‘আপনার অবস্থা তো সুবিধের নয়,’ রানার কালিঝুলি মাখা চেহারা দেখে বললেন ক্যাপ্টেন মিচাম। ‘সিক বে-তে যাননি কেন?’
‘কারণ আমি অসুস্থ নই,’ বলল রানা।
একদৃষ্টে ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন মিচাম। এরপর গলা চড়িয়ে বললেন, ‘কেউ মি. রানাকে একটা তোয়ালে এনে দাও। উনি আমার ব্রিজ ভিজিয়ে দিচ্ছেন।’
তোয়ালে নিয়ে এল এক নাবিক। মাথা আর মুখ মুছে ক্যাপ্টেনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘ধরা যাবে ওদের?’
রেডার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন মিচাম। ‘আমাদের চেয়ে স্পিড বেশি। চল্লিশ নটে ছুটছে। তবে ওই ছোট্ট বোট নিয়ে ওরা আফ্রিকা থেকে এসেছে বলে মনে হয় না। বাজি ধরে বলতে পারি, সামনে একটা মাদার শিপ আছে।’
মাথা ঝাঁকাল রানা। জলদস্যুরাও আজকাল আধুনিক হয়ে উঠেছে। আগে শুধু উপকূলের কাছাকাছি থাকত, কিন্তু এখন রীতিমত মাদার শিপ নিয়ে মাঝসাগরে হামলা চালানোর মত সামর্থ্য রাখে। মালবাহী জাহাজের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় মাদার শিপগুলো। সময়-সুযোগমত ছোট পাওয়ারবোটে- দস্যুদের নামিয়ে দেয় পানিতে, কাজ শেষে আবার তুলে নেয় সংগোপনে।
‘রেডারে কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘এখনও না।
ক্যাপ্টেনের বিনোকিউলার তুলে নিল রানা, চোখে ধরে তাকাল সামনে। পলায়নরত বোটটাকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকমত, তবে ওদের রেখে যাওয়া ফেনার ট্রেইল পরিষ্কার ফুটে উঠেছে সাগরের বুকে। পাঁচ মাইল সামনে রয়েছে বোটটা, প্রতি মুহূর্তে দূরত্ব বাড়াচ্ছে নেপচুনের সঙ্গে। তবে চিন্তার কিছু নেই, রেডার রেঞ্জের বাইরে যেতে অনেক সময় নেবে। আর যদি মাদার শিপটা লোকেট করা যায়…
ভাবনাটা শেষ হলো না রানার, চোখ ধাঁধিয়ে গেল উজ্জ্বল আলোয়। পরক্ষণে সামনে একটা আগুনের গোলা লাফিয়ে উঠতে দেখল ও, ফুলঝুরির মত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ভাঙা লোহালক্কড় আর জ্বলন্ত কাঠের টুকরো।
‘হোয়াট দ্য…’ বিস্মিত গলায় বলে উঠলেন মিচাম।
আলোর চেয়ে শব্দের গতি কম, তাই কয়েক সেকেণ্ড পরে শোনা গেল বিস্ফোরণের আওয়াজ। সামনে আলোর ঝলকানি কেটে গেল। তাড়াতাড়ি বিনোকিউলারের লেন্স অ্যাডজাস্ট করল রানা, বিস্ফারিত চোখে দেখল—উধাও হয়ে গেছে জলদস্যুদের পাওয়ারবোট। ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ওটা