1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

হাতে পিস্তল নিয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে চলেছে রানা। চল্লিশ ফুট যেতেই একটা স্টেয়ারওয়েল পাওয়া গেল। একটা সিঁড়ি ওপরে উঠেছে, আরেকটা নেমেছে নিচে। রেলিঙের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কতদূর গেছে সিঁড়িদুটো। ওপরদিকে গেলে দশতলা উঁচু অ্যাকোমোডেশন ব্লকের মাথা, কিংবা ছাত পর্যন্ত হয়তো পৌঁছনো যাবে, যেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টেনা আর রেডার এমিটার। নিচেরটা ধরলে পৌঁছুনো যাবে জাহাজের একদম তলার বিজ্ পর্যন্ত

কর্টেজ আর লামিয়া ওপরে গেছে বলে অনুমান করল রানা। ইচ্ছে হলো এখুনি গিয়ে মুখোমুখি হয় মার্সেনারি লিডারের, কিন্তু দমন করল নিজেকে। বুঝতে পারছে, জাহাজের ভেতর যে-রহস্যই থাকুক না কেন, তা ওপরতলার লিভিং কোয়ার্টার, অফিস বা ব্রিজে পাওয়া যাবে না; পাওয়া যাবে নিচে… পেটের ভেতরে, যেখানে থাকে ইঞ্জিন, জেনারেটর, পাম্প-সহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি। তাই নিচের সিঁড়ি ধরল ও।

দুটো লেভেল নেমে একটা খালি পাম্প রুম পেল রানা। ঢুকে পড়ল ওখানে।

নর্দার্ন স্টারের মত অতিকায় ট্যাঙ্কারগুলোয় বিশাল বিশাল সব পাম্প রুম থাকে। জাহাজের ট্যাঙ্কগুলোয় লক্ষ লক্ষ গ্যালন তেল খুব দ্রুত লোড এবং আনলোড করা হয় এসব পাম্প রুম থেকে। কোনও কোনও পাম্প রুম ইঞ্জিন রুমের চেয়েও বড় হয়। রানা যেটায় ঢুকেছে, সেটাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে…

মেইন পাইপের দিকে এগিয়ে গেল ও। বরফের পাতলা স্তর জমে আছে পাইপের গায়ে, ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের বাল্কহেডেও। একটা পাইপ আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল—ভীষণ ঠাণ্ডা। বুঝতে অসুবিধে হলো না, এখান থেকে তেল পাম্প করা হচ্ছে না মোটেও।

দেয়াল ঘেঁষে একটা কন্ট্রোল প্যানেল আর কম্পিউটার স্ক্রিন বসানো আছে। রিডআউট বলছে, পুরো সিস্টেম অপারেট করা হচ্ছে ব্রিজ থেকে। এটাও অস্বাভাবিক। ব্রিজ থেকে কখনোই অয়েল পাম্প অপারেট করা হয় না।

দরজার কাছে ফিরে গেল রানা, বাইরে বেরুনোর আগে কান পেতে অপেক্ষা করল একটু। ইঞ্জিন আর জেনারেটরের গুঞ্জন ছাড়া কিছুই শুনতে পেল না। নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলল, সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করল আরও নিচে।

আবারও দুটো লেভেল পার হলো ও, তারপর হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দুই লেভেল নিচের রেলিঙে একটা হাত দেখতে পেল। কারা যেন উঠে আসছে ওপরে। গলার আওয়াজ শোনা গেল, কথা বলছে দু’জন মানুষ।

‘….এতকিছু জানি না, আমাকে শুধু বলা হয়েছে ফুল পাওয়ার দিতে,’ বলল একজন।

‘কিন্তু আশপাশে তো আর কোনও জাহাজ নেই,’ বলল অপরজন।

‘আমি তার কী জানি? তবে কিছু একটা ঘটছে নিশ্চয়ই। এর আগে কখনও একশো পার্সেন্ট পাওয়ারে যাইনি আমরা।’

আরও কিছু শোনার ইচ্ছে ছিল রানার, কিন্তু সে-সুযোগ নেই। চট করে ল্যাণ্ডিঙের পাশের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ও। এই ডেকে যন্ত্রপাতির আওয়াজ আরও জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। ইঞ্জিন রুমের ঠিক ওপরে আছে ও, আন্দাজ করল রানা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল, একটা চোখ দরজার ওপরে, আরেকটা চোখ বাঁয়ের করিডোরে।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে। কাছাকাছি চলে আসছে লোকদুটো। এখনও কথা বলছে তারা, তবে যান্ত্রিক গুঞ্জনের কারণে পরিষ্কার নয় তাদের কণ্ঠ। দরজার সামনে চলে এল পদশব্দ, এরপর আবার কমতে শুরু করল। নিশ্চয়ই ওপরে উঠে যাচ্ছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল রানা, ঠিক তখুনি হাট করে খুলে গেল দরজাটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা একটা লোক তার শরীরের অর্ধেকটা ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। দোরগোড়া থেকে উল্টো ঘুরল, কথা বলল সঙ্গীর উদ্দেশে।

‘তোমাকে একটা গোপন কথা জানাই,’ বলল সে। ‘আগামীবার যখনই জাহাজ বন্দরে যাবে, কেটে পড়ব আমি। এখানকার ভাবসাব আর ভাল লাগছে না আমার।’

‘ও-কথা আগেও বলেছ,’ হেসে বলল সঙ্গীটি। ‘কিন্তু যাবে কোথায়, বলো তো? এদের মত ভাল বেতন আর কে দেবে তোমাকে?’

‘টাকাই কি সব? জীবনে আরও…’

দরজায় দাঁড়িয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছে লোকটা। রানার দিকে পিঠ ফিরিয়ে। দম আটকে অপেক্ষা করছে রানা, ধরা পড়ে গেল বোধহয়। ব্যাটা কথা থামিয়ে দরজা বন্ধ করে না কেন!

বন্ধুর সঙ্গে আরও কয়েক সেকেণ্ড বাক্য-বিনিময় করল লোকটা, এরপর হাসতে হাসতে পিছিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়াল। মুখোমুখি হলো রানার পিস্তলের। জমে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

ঠোঁটের কাছে একটা আঙুল তুলে ইশারা করল রানা। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কোনও আওয়াজ কোরো না। দরজা বন্ধ করো।’

ঢোক গিলে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হাত বাড়িয়ে ঠেলে দিল দরজার পাল্লা। চেহারাসুরতে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার মানুষ বলে মনে হচ্ছে তাকে, বয়স পঁয়ত্রিশের আশপাশে। রোদে-পোড়া চামড়া, মাথায় কোঁকড়ানো চুল। মুখে ছোট করে ছাঁটা দাড়ি।

সিঁড়িতে পদশব্দ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপর হাসল। ‘থ্যাঙ্কস।’

‘কে তুমি?’

‘ভূত,’ সকৌতুকে বলল রানা। ‘রাত হলে বেরিয়ে আসি, মানুষকে ভয় দেখাই।’

আবারও ঢোক গিলল লোকটা। ‘তুমি কি খুন করবে আমাকে?’

‘বাধ্য না হলে তেমন কোনও ইচ্ছে নেই।’ পিস্তল নাচাল রানা। ‘চলো, কোথাও বসে শান্তিতে গল্প করা যাক।’

করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করল দু’জনে। সামনে দাড়িঅলা, পেছনে অস্ত্র হাতে রানা। চালাকির কোনও চেষ্টা করছে না সে, তবে সুযোগ পেলেই করবে, জানে রানা।

করিডোরের শেষ প্রান্তে আরেকটা দরজা। ওটার সামনে পৌঁছল ওরা।

‘খোলো,’ নির্দেশ দিল রানা।

কথামত দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লোকটা। তাকে অনুসরণ করল রানা। ওপাশে পা রেখেই থেমে দাঁড়াল। বিশাল একটা রুমে ঢুকেছে ওরা, ছাতটা অন্তত চল্লিশ ফুট উঁচুতে। বাষ্পবাহী পাইপের উত্তাপে তেতে আছে পুরো জায়গাটা, মুহূর্তেই ঘেমে গেল ও। একদিকে রয়েছে সারিবদ্ধ কয়েকটা জেনারেটর, ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ করছে ওগুলো। রুমের মাঝখানে তিনতলা উঁচু একটা সবুজ রঙের সিলিণ্ডার- সদৃশ বস্তু শোভা পাচ্ছে, সাদা আর নীল রঙ করা অনেকগুলো পাইপ বেরিয়ে এসেছে ওটা থেকে, চলে গেছে বিভিন্ন দিকে।

সামনে এগোল রানা। সবুজ জিনিসটার গায়ে রাশান হরফে কী যেন লেখা। পাশে রয়েছে রেডিও-অ্যাক্টিভিটির আন্তর্জাতিক প্রতীক। ভুরু কুঁচকে দাড়িঅলাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল লোকটা।

উঁকি দিয়ে পেছনে একই রকম আরেকটা রিঅ্যাক্টর দেখতে পেল রানা। বিস্ময় বোধ করল। এরা রিঅ্যাক্টর কোথায় পেয়েছে, সেটা প্রশ্ন নয়… ব্ল্যাক মার্কেটে পুরনো আমলের সোভিয়েত রিঅ্যাক্টর পাওয়া যায়… প্রশ্ন হলো, এগুলো জাহাজে কী করছে? ডিজেলে চলছে ট্যাঙ্কারটা, প্যারাশুটে নামার সময় নাকে ডিজেল-পোড়া গন্ধ পেয়েছে ও; তারমানে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর জাহাজ চালানোর জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে না। তা হলে?

‘এগুলো কীসের জন্যে?’ জানতে চাইল ও।

‘জানি না,’ বলল দাড়িঅলা। তবে তার চেহারাই বলে দিল, মিথ্যে কথা বলছে।

ঝট্ করে পিস্তল তুলল রানা, ঠেকাল লোকটার দুই ভুরুর মাঝখানে। কঠিন গলায় বলল, ‘আগেই বলেছি, তোমাকে খুন করার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু আমাকে তুমি বাধ্য করছ। জলদি বলো, রিঅ্যাক্টরগুলো কী কাজে ব্যবহার হয়?’

কাঁপতে শুরু করেছে দাড়িঅলা। ভয়ার্ত গলায় জানাল, ‘অ্যাকসেলারেটরের জন্যে।

পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটর? এই জাহাজে?’

চুপ করে রইল লোকটা।

‘কথা বলো!’ ধমকে উঠল রানা। বেরেটার হ্যামার টানল। ‘বন্ধুকে কী বলছিলে, তা আমি শুনেছি। কিছু একটা ফুল পাওয়ারে দেয়ার হুকুম পেয়েছ তুমি। সেজন্যেই আসছিলে এখানে। আর চেহারাসুরতে যা বুঝছি, তুমি সাধারণ নাবিক নও, ইঞ্জিনিয়ারিঙের লোক। তারমানে তুমি জানো এখানে কী ঘটছে। সব খোলাসা করে বলো, নইলে ট্রিগার চাপব আমি।’

নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে রানার চেহারা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল দাড়িঅলা। বলল, ‘রিঅ্যাক্টরের সাহায্যে অ্যাকসেলারেটরে শক্তি জোগানো হয়। এক ধরনের বিম তৈরি করে ওটা… বিমটা ট্যাঙ্কারের সামনে দিয়ে বেরোয়। যে- কোনও জাহাজ অচল করে দেয়া যায় ওই বিম দিয়ে।’

‘শুধু অচল?’ বলল রানা। ‘কমিয়ে বলছ, হে। ওই বিম কী করতে পারে, তার নমুনা আমি দেখেছি। জাহাজের ভেতরের মানুষকে পর্যন্ত জ্যান্ত কাবাব বানিয়ে ফেলে।’

‘আ…আমি এত কিছু জানি না। আমার কাজ শুধু রিঅ্যাক্টর চালানো।’

‘অজুহাত ভালই দিচ্ছ। কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?’

‘কন্ট্রোল রুমে।’

‘চলো, আমিও যাব।’

রুমের একপ্রান্তে একটা সিঁড়ি আছে, সেটা ধরে একটা ক্যাটওয়াকে উঠে এল দু’জনে। ক্যাটওয়াকটা চলে গেছে রুমের আরেক প্রান্তে, ব্যালকনির মত ঝুলে থাকা একটা কামরা পর্যন্ত। সেখানে গিয়ে দরজা খুলল দাড়িঅলা, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকাল রানা, নিজেও ঢুকে পড়ল।

নানা ধরনের প্যানেল আর কম্পিউটারে ভরা কামরাটা, সেখানে কাজ করছে দু’জন লোক: একজন ইঞ্জিনিয়ার– মাথাভরা টাক তার, অন্যজন টেকনিশিয়ান। চমকে উঠে পেছনে তাকাল তারা।

‘সাবধান, কোনও চালাকি নয়,’ হুমকি দিল রানা। ‘দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়াও।’

তিন বন্দিকে দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে দাঁড় করাল ও। তারপর এগিয়ে গেল কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে। জাহাজের নকশা দেখা যাচ্ছে ওতে। নানা ধরনের আইকন ফুটে আছে বিভিন্ন জায়গায়। বিদ্যুতের লাইন মার্কিং করা হয়েছে হলুদ রেখা দিয়ে; আর নীল রঙের একটা রেখা জাহাজের পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে পাক খেয়ে খেয়ে একেবারে নিচ থেকে উঠে এসেছে ওপর পর্যন্ত। জাহাজের আকৃতির অসামঞ্জস্যতা নিয়ে মুরল্যাণ্ড কী বলেছিল, মনে পড়ল ওর। বোঝা গেল, নীল রেখাটাকে জায়গা করে দেবার জন্যেই ওভাবে বানাতে হয়েছে খোলটা।

‘এটাই কি পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরের রিং?’ জানতে চাইল ও।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ইঞ্জিনিয়ার। ‘বলল, ‘হ্যাঁ। পুরো জাহাজ ঘুরে এসে বো-র কাছ দিয়ে বেরিয়েছে।’

‘হুম,’ গম্ভীর হয়ে গেল রানা। কানেকশনটা আগেই ধরতে পারল না কেন, ভাবছে।

রানা জানে, আরাতামা মারুতে যখন ওয়াইবিসিও লোড করা হয়, তখন ফ্রিটাউনের বন্দরের বাইরে নোঙর করে ছিল নর্দার্ন স্টার। ওটাই যে পরে জাপানি জাহাজটাকে অনুসরণ করে হামলা চালিয়েছিল, সেটা ভাবতে পারেনি। কিন্তু এরপরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। জাপানি জাহাজটা যখন ডুবে যায়, তখন নর্দার্ন স্টার ছিল কোথায়? কুচিয়োর বোট ধ্বংস হয়ে যাবার পর ভাল করে তল্লাশি চালিয়েছে নেপচুন, ত্রিসীমানায় কোনও জাহাজ পায়নি। আরাতামা মারু থেকে ওয়াইবিসিও আনলোড করতে নিশ্চয়ই সময় লেগেছে, তারপর তো রেডারের সীমানা থেকে সরে যাবার মত যথেষ্ট সময় ছিল না এত বড় একটা সুপারট্যাঙ্কারের হাতে।

আরেকটু ভাবল রানা। একটাই ব্যাখ্যা এর। ট্যাঙ্কারটা হামলা চালাবার পর আর অপেক্ষা করেনি, রাতেই সরে গেছে অকুস্থল থেকে। দিগন্তের ওপারে, রেডার রেঞ্জের বাইরে কোথাও গিয়ে থেমেছিল। বিকল্প কোনও কায়দায় সমস্ত ওয়াইবিসিও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওখানে। কিন্তু কী সেই কায়দা? বোট-টোট জাতীয় কিছু হতে পারে না; হলে সেটা ধরা পড়ত নেপচুনের সেন্সরে। তা হলে?

‘সাবমেরিন আছে তোমাদের সঙ্গে?’ জানতে চাইল ও।

‘তিনটা,’ মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল টেকনিশিয়ান।

‘তার ভেতরে কোনোটা কি কার্গো নেবার মত?’

আবারও সায় জানাল লোকটা। ‘ওটাকে ট্রাক বলি আমরা। একশো দশ ফুট লম্বা, ভেতরে বলতে গেলে কিছুই নেই।‘

হ্যাঁ, এবার মিলছে ধাঁধাটা। বোটে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কর্টেজ ও তার সঙ্গীরা পালাল কীভাবে, তারও ব্যাখ্যা মিলছে। সাবমেরিন ব্যবহার করা হয়েছে আরাতামা মারু থেকে ওয়াইবিসিও আনলোড করে নর্দার্ন স্টারে নেবার জন্যে। ওটাতে চড়েই পালিয়েছিল কর্টেজ।

সবকিছুর পরেও আরেকটা প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। নর্দার্ন স্টারকে যদি জাহাজ-ধ্বংসের কাজেই ব্যবহার করা হয়, হঠাৎ করে ফুল পাওয়ার চাইছে কেন কর্টেজ? ধারেকাছে তো আর কোনও জাহাজ নেই।

কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নকশাটা যুম করে দেখল রানা। জাহাজের ঠিক মাঝখানে, যেখানে ক্রুড অয়েলের ট্যাঙ্ক থাকার কথা, সেখানে একটা বৈসাদৃশ্য চোখে পড়ল। একগাদা হাই ভোল্টেজ লাইন গিয়ে মিশেছে ওখানে।

‘উল্টো ঘোরো, নির্দেশ দিল ও। আঙুল ঠেকাল স্ক্রিনে। ‘এটা কী?’

ইতস্তত করল তিন বন্দি।

‘জলদি!’ তাড়া দিল রানা। ‘রাতভর অপেক্ষা করতে পারব না আমি।’

‘ইয়ে… ওটা ফালক্রাম,’ মিনমিন করে নিচু গলায় বলল ইঞ্জিনিয়ার।

‘ফালক্রাম? মানে কী? কী কাজে লাগে?’

‘কাছে এসে দেখাই? নইলে বুঝতে পারবেন না।’

লোকটাকে কম্পিউটারের কাছে আসার অনুমতি দিল রানা। এগিয়ে এসে কিবোর্ডের কয়েকটা বোতাম চাপল সে। স্ক্রিনে বড় হলো ছবিটা। ক্ষণিকের জন্যে ওদিকে মনোযোগ চলে গেল রানার, আর সেটাই হলো ভুল।

আচমকা নড়ে উঠল ইঞ্জিনিয়ার, খপ্ করে দু’হাতে চেপে ধরল রানার পিস্তল ধরা হাতটা, ঠেলে দিল ওপরে। চোখের কোণ দিয়ে বাকি দু’জনকেও সচল হয়ে উঠতে দেখল ও। ওরাও জাপটে ধরতে চাইছে ওকে। দেরি না করে শরীর হেলিয়ে দিল পেছনে। সামনে ঝুঁকে গেল ইঞ্জিনিয়ার, তাল হারাল’। তাকে বুকের ওপর নিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ল রানা। ঝাঁকিতে আলগা হয়ে গেল লোকটার হাতের মুঠো। ঝটকা মেরে তাকে গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিন ও। তারপর কনুইয়ের একটা গুঁতো মারল সোলার প্লেক্সাসে। দম আটকে হাঁসফাঁস অবস্থা হলো ইঞ্জিনিয়ারের।

এক জোড়া পা এগিয়ে আসতে দেখল এবার রানা। দাড়িঅলা লোকটা এগিয়ে এসেছে। ওঠার চেষ্টা করল না ও, শোয়া অবস্থাতেই লাথি চালাল প্রাণপণে। দাড়িঅলার হাঁটুর নিচে লাগল লাথি। গুঙিয়ে উঠল সে। পড়ে গেল হুড়মুড় করে।

হাঁটু গেড়ে উঠে বসতেই টেকনিশিয়ানকে একটা রেঞ্চ নিয়ে ছুটে আসতে দেখল রানা। বেরেটা তুলে নিয়ে নির্দ্বিধায় লোকটার কাঁধে গুলি করল ও। তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল সে। হাত থেকে খসে পড়ল রেঞ্চ। আহত কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়ল মেঝেতে। উঠে দাঁড়াল রানা। কষে দুটো লাথি বসাল দাড়িঅলা আর টেকনিশিয়ানের চোয়ালে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল তারা।

পরক্ষণে তারস্বরে বেজে উঠল অ্যালার্ম।

ঝট্ করে ঘুরল রানা। ইঞ্জিনিয়ার এখনও মেঝেতে, কিন্তু খানিকটা উঁচু হয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে কন্ট্রোল প্যানেলের তলায়। টিপে দিয়েছে অ্যালার্মের বাটন।

ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে লোকটার দিকে পিস্তল তাক করল রানা। ইচ্ছে হলো ট্রিগার টিপে খুন করে তাকে, কিন্তু তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে নিরস্ত করল নিজেকে। সাধারণ এক ইঞ্জিনিয়ার, নিরস্ত্র… বিপথগামী হতে পারে, কিন্তু সেজন্যে তার প্রাণ নেয়া যায় না। লোকটার প্রশস্ত টাকের ওপর পিস্তলের এক ঘা বসিয়ে দিল রানা, জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।

দরজা খুলে কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এল রানা, ছুটতে শুরু করল ক্যাটওয়াক ধরে। খটাখট শব্দ হচ্ছে পায়ের, পরোয়া করল না। পালাতে হবে এখান থেকে।

সিঁড়ি ভেঙে অর্ধেকটা নামতেই শোনা গেল গুলির শব্দ। ক্যাটওয়াকের গায়ে বুলেটের আঘাতে ফুলকি উঠতে দেখল রানা, তারপর দেখতে পেল কয়েকজন অস্ত্রধারী লোককে—ও যে-দরজা দিয়ে ঢুকেছে, সেখান দিয়েই ভেতরে ঢুকছে তারা। পিস্তল তুলে পাল্টা গুলি ছুঁড়ল রানা। একজনের কাঁধে লাগল… বুলেটের ধাক্কায় আধপাক ঘুরে গেল সে; তাকে ধরে ফেলল বাকিরা, কাভার নেবার জন্যে পিছু হটল, চলে গেল দরজার বাইরে।

রেলিং টপকে লাফ দিল রানা, নেমে এল নিচে রিঅ্যাক্টরগুলোকে পাশ কাটিয়ে ছুটতে শুরু করল। বিশাল রুমটা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে জাহাজের আরও ভেতরদিকে।

ছুটতে ছুটতে একটা দরজার সামনে পৌঁছল ও। হাতল ঘুরিয়ে ঢুকে পড়ল ওপাশে। হিমশীতল বাতাসের একটা ঝাপটা বয়ে গেল ওর ওপর দিয়ে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, অদ্ভুত একটা কম্পার্টমেন্টে পৌঁছে গেছে। আকারে মোটামুটি একটা স্টেডিয়ামের সমান—প্রায় দশতলা উঁচু, জাহাজের পুরো প্রস্থ জুড়ে বিস্তৃত। মাথার ওপরে ভাঁজ হয়ে আছে অনেকগুলো ধাতব বাহু, দেখতে অনেকটা ভাঁজ করে রাখা চেয়ারের মত। বাহুগুলোর গায়ে লাগানো হয়েছে শত শত ধূসর রঙের ব্লক। হাই ভোল্টেজ পাওয়ার লাইন, আর বরফের আস্তর পড়া পাইপের সংযোগ রয়েছে ব্লকগুলোর সঙ্গে।

জাহাজের নকশা স্মরণ করল রানা। বুঝল, এ-ই সেই ফালক্রাম। কিন্তু কী এর উদ্দেশ্য?

লঘু পায়ে সামনে এগোল ও, তীক্ষ্ণ নজর বোলাচ্ছে চারদিকে। লক্ষ করল, সবগুলো বাহুর গোড়ায় রয়েছে হাইড্রলিক পিস্টন। এর অর্থ, পিস্টনের সাহায্যে বাহুগুলো প্রসারিত করা যায়। দেয়ালে কিছু ওয়ার্নিং সাইন আছে—পিস্টনের সংযোগ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরের সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে?

ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবার বেশি সময় পাওয়া গেল না। দূরে কোথাও খুলে গেল আরেকটা দরজা, শোনা গেল পদশব্দ। যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে তাকাল রানা। ওখান দিয়েও পেছনের দলটা হাজির হয়ে যাবে যে-কোনও মুহূর্তে। ফাঁদে পড়ে গেছে।

ওপরে তাকিয়ে ত্রিশ ফুট উচ্চতায় একটা ক্যাটওয়াক দেখতে পেল ও। ছুটে গেল দেয়ালের কাছে। দেয়ালের গায়ে লাগানো পাইপ আর তারের খাঁজে হাত-পা বাধিয়ে উঠতে শুরু করল ওপরে।

অসতর্কতায় হঠাৎ একটা কুল্যান্ট পাইপের সঙ্গে হাত লাগল ওর, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে আনল হাতটা। আরেকটু হলে নিচে পড়ে যেত, কোনোমতে সামলাল নিজেকে। দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করল ব্যথাটা। তারপর হাতের তালুটা চোখের সামনে মেলে ধরল। অনেকখানি চামড়া উঠে এসেছে তালু থেকে—তাপের কারণে নয়, ঠাণ্ডায়। চরম শীতল তাপমাত্রা চোখের পলকে জমিয়ে- পুড়িয়ে দিয়েছে চামড়াটা।

পাইপটা ভাল করে দেখল রানা। দেখা যায় কি যায় না… ছোট ছোট হরফে লেখা আছে—এলএনটু। তরল নাইট্রোজেনের সঙ্কেত। অ্যাডমিরাল ফনসেকার মুখে কী শুনেছিল, মনে পড়ল ওর—চরম শীতল তাপমাত্রা ছাড়া কাজ করে না সুপারকণ্ডাক্টর… সুপারকণ্ডাক্টিং এফেক্ট সৃষ্টির জন্যে তরল নাইট্রোজেনে ভিজিয়ে ঠাণ্ডা করে নিতে হয়। আর তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা যে শূন্যের সত্তর ডিগ্রি নিচে, তা-ও জানা আছে ওর। কপাল ভাল যে, হালকাভাবে ছুঁয়েছে, নইলে পুরো হাতই জমে বরফ হয়ে যেতে পারত।

সাবধানে আবারও দেয়াল বাইতে শুরু করল রানা। খেয়াল রাখছে, কুল্যান্ট পাইপে যেন আর হাত না লাগে। ক্যাটওয়াকে যখন পৌঁছুল, ধাওয়াকারীরা নিচে হাজির হয়ে গেছে। একপাশ থেকে এসেছে পাঁচজন, আরেক পাশ থেকে দু’জন। রানার খোঁজে ছড়িয়ে পড়ল তারা।

হামাগুড়ি দিয়ে ক্যাটওয়াক ধরে এগোতে শুরু করল রানা। নিঃশব্দে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ঝাঁকুনিতে ক্যাটওয়াকের তলা থেকে খসে পড়ল এক টুকরো বরফ, আর পড়বি তো পড় একেবারে একটা পাওয়ার লাইনের ওপরে। জোরালো শব্দ হলো।

‘ওই যে!’ চেঁচিয়ে উঠল কেউ।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। দৌড় লাগাল প্রাণপণে। একটা মাত্র গুলি ছোঁড়া হলো ওর উদ্দেশে, তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেটা। দ্বিতীয়বার কেন গুলি করা হলো না, তা আর জানার চেষ্টা করল না ও। তবে পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেত, যে-লোক গুলি ছুঁড়েছে, তার গলা টিপে ধরেছে ওদের লিডার—স্পর্শকাতর ইকুইপমেন্টে ভরা এমন একটা জায়গায় ফায়ার ওপেন করেছে বলে।

ছুটতে ছুটতে ক্যাটওয়াকের শেষ প্রান্তে পৌঁছুল রানা। নতুন একটা দরজা দেখতে পেয়ে বেরিয়ে গেল ওখান দিয়ে পৌঁছুল একটা করিডোরে। থামল না, ছুটে চলল। লুকানোর মত জায়গা খুঁজছে… বাইরে কীভাবে খবর পাঠানো যায়, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে।

কোনও সন্দেহ নেই, কিছু একটা ঘটতে চলেছে… বড় কিছু, খুব খারাপ কিছু। আর ট্যাঙ্কারের ছদ্মবেশধারী জাহাজটার ভূমিকা থাকবে তাতে। যে-করেই হোক, সেটা ঠেকাতে হবে ওকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *