চুয়াল্লিশ
ইউএসএস ফ্যারাগাটের অপারেশন্স সেন্টারে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়া। চারদিকে ব্যস্ততা। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহাজটা। শুধু ওরাই নয়, নৌবহরে যে-ক’টা জাহাজ আছে, সবগুলোই গত কয়েক ঘণ্টা ধরে নিচ্ছে একই ধরনের প্রস্তুতি। বহরের নেতৃত্ব দিচ্ছে একটা এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার—ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কন; সেটার ডেক থেকে নিয়মিত বিরতিতে টেকঅফ করছে একের পর এক ফাইটার জেট। পাঁচ মাইল দূর থেকেও ওগুলোর গর্জন শুনতে পাচ্ছে ওরা।
ক্যাপ্টেনের তলব পেয়ে অপারেশন্স সেন্টারে এসেছে আসিফ আর তানিয়া, ওরা ভেতরে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন তিনি। ক্যাপ্টেন রিচার্ড ফগেল, মাঝবয়েসী ছোটখাট গড়নের একজন মানুষ। এ-মুহূর্তে রাজ্যের গাম্ভীর্য ভর করেছে তাঁর চেহারায়।
‘কী ঘটেছে, তা আশা করি শুনেছেন,’ বললেন ফগেল। ‘যুদ্ধ শুরু করার আদেশ পেয়েছি আমরা। নতুন ধরনের একটা অস্ত্রের সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের দুটো স্যাটেলাইট ধ্বংস করে দিয়েছে—অস্ত্রটা নাকি পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরের শক্তিতে চলে।’
দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিল তানিয়ার চোখে। ‘এখানে কি আমরা নিরাপদ?’ কল্পনার
কল্পনার চোখে আরাতামা মারুর ধ্বংসাবশেষ, আর ভেতরের লাশগুলো দেখতে পাচ্ছে।
‘আশা তো করি,’ বললেন ফগেল। ‘পেন্টাগনের এক্সপার্টরা বলছেন, অস্ত্রটার রশ্মি সরলরেখায় চলে, অনেকটা লেজারের মত। তাই যতক্ষণ আমরা দিগন্তের নিচে থাকছি, বাঁক খেয়ে ওটা আমাদেরকে হিট করতে পারবে না। মাথা তুললে ভিন্ন কথা।’
সংক্ষেপে ওদেরকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন তিনি। সিয়েরা লিওন, প্রেসিডেন্ট জোসেফ আকুম্বা, ও তাঁর সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে জানালেন। এরপর দু’জনকে নিয়ে গেলেন একটা বড় স্ক্রিনের সামনে, সেটায় ফুটে উঠেছে সিয়েরা লিওনের উপকূলের মানচিত্র। অয়েল রিগগুলোর অবস্থানও মার্ক করা আছে ওতে। লাল রঙের একটা বক্ররেখা জ্বলজ্বল করছে একপাশে।
‘এটা ওদের হরাইজন, বা দিগন্ত,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘এই লাইনের ওপারে যা-ই যাক না কেন… হোক সেটা জাহাজ, বিমান, বা মিসাইল… ওরা চোখের পলকে ধ্বংস করে দিতে পারবে।’
শান্ত চোখে লাইনটা দেখল তানিয়া-অয়েল রিগ থেকে মোটামুটি চল্লিশ মাইল ওটার দূরত্ব।
‘আমি জানতাম, দিগন্ত সর্বোচ্চ ষোলো মাইলে থাকে, বলল ও। ‘এটা এত বেশি কেন?’
ওর দিকে ঘুরলেন ক্যাপ্টেন। ‘সেটা নির্ভর করছে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, তার ওপর। যুদ্ধের সময় এজন্যেই সৈনিকরা উঁচু জায়গা খোঁজে, কারণ তাতে আপনি আরও বেশি এলাকা দেখতে পাবেন। এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।’ স্ক্রিনে একটা অয়েল প্ল্যাটফর্মের ছবি আনলেন তিনি। ‘এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মূল কাঠামো সি-সারফেস থেকে সাড়ে তিনশো ফুট উঁচু। তাই যে-প্ল্যাটফর্মটা সবচেয়ে বাইরের দিকে রয়েছে, সেটা অনেক বেশি এলাকা কাভার করছে।’
‘দুর্গ-প্রাচীরের মাথায় দাঁড়ানো তীরন্দাজের মত, রাইট?’ বলল আসিফ।
‘ঠিক ধরেছেন,’ বললেন ফগেল। ‘যত উঁচুতে থাকবে, ততই দূরের টার্গেটে তীর চালাতে পারবে।’
‘আমরা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব?’
‘বেশি না। সারফেসের ওপরে ফ্যারাগাটের উচ্চতা ষাট ফুট। তারমানে ত্রিশ মাইল দূর থেকে আমাদের সুপারস্ট্রাকচারে আঘাত করতে পারবে ওরা। আর যদি মাস্তুলে আঘাত করতে চায়, সেটা পঁয়ত্রিশ মাইল থেকে করা সম্ভব।’
‘আর এয়ারক্র্যাফট? ওরা যদি সাগরের পানি ছুঁয়ে এগোয়?’
‘ওদেরও একই ঝুঁকি থাকছে। সাগরের পানি ছুঁয়ে এগোলেও প্রতিটা এয়ারক্র্যাফটের তো নিজস্ব একটা উচ্চতা আছেই। তা ছাড়া একটানা বেশিক্ষণ ওভাবে এগোনো সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা, খোলা সাগরে ওরা কোনও আড়াল পাচ্ছে না। দিগন্তের ওপারে যাওয়ামাত্র ডাইরেক্ট ফায়ারের মুখে পড়বে।’
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তানিয়া আর আসিফ।
‘আসলে,’ অস্বস্তি ফুটল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে, ‘এ-ধরনের পরিস্থিতি আগে কখনও মোকাবেলা করিনি আমরা।
‘কিছুই কি করার নেই?’ জানতে চাইল আসিফ।
‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে এয়ারস্ট্রাইকে যেতাম আমরা। আক্রমণ শুরু করতাম ক্রুজ মিসাইল দিয়ে। কিন্তু টমাহক আর হাপুন… দুটো মিসাইলই সাবসনিক স্পিডে চলে। এফ-এইটিন ফাইটারের সর্বোচ্চ গতি মাক টু… সাগরের পানি ছুঁয়ে এগোলে গতি আরও কমে যাবে।’ স্ক্রিনের দিকে ইশারা করলেন ফগেল। ‘অথচ এই অস্ত্রটা পার্টিকেল বিম ছোঁড়ে প্রায় আলোর গতিতে। তারমানে, আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী মিসাইলটাও দু’ফুটের বেশি এগোতে পারবে না, বিমের আঘাতে ধরাশায়ী হবে।’
সমস্যাটা বুঝতে পারছে তানিয়া। ব্যাপারটা অনেকটা ছুরি হাতে মেশিনগানধারী শত্রুর দিকে এগোবার মত… আঘাত হানার কোনও সম্ভাবনা নেই, দু’পা যেতে না যেতেই ব্রাশফায়ারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
‘সুপারসনিক এয়ারক্র্যাফট আর মিসাইলও যদি টার্গেট পর্যন্ত পৌছুতে না পারে,’ বলল ও, ‘আপনাদের প্ল্যান কী?’
স্ক্রিনে ফুটে ওঠা পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরের বৃত্তটার ওপর আঙুল বোলালেন ক্যাপ্টেন। বললেন, ‘একটা ব্যাপার পরিষ্কার, জিনিসটা সাগরের তলায় তৈরি করা হয়েছে, যাতে সহজে ডিটেক্ট করা না যায়। তবে এ-কাজ করতে গিয়ে মস্ত একটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে এর। পানি ভেদ করে পার্টিকেল বিম এগোতে পারে না। তাই পানির তলা দিয়ে আমরা আক্রমণ চালাতে পারব।’
‘সাবমেরিন?’ জিজ্ঞেস করল আসিফ।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। ‘প্রতিটা নৌবহরে …. বিশেষ করে ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপের সঙ্গে সাবমেরিন থাকে… আমাদেরও আছে। দুটো লস অ্যাঞ্জেলেস ক্লাস সাবমেরিন: মেম্ফিস আর প্রভিডেন্স। আপাতত ওগুলোর সাহায্যেই প্রাথমিক আক্রমণের প্ল্যান সাজিয়েছি আমরা। মেম্ফিস ইতিমধ্যে টার্গেট জোনের পনেরো মাইলের ভেতর পজিশন নিয়েছে। কিন্তু… ওদের সোনারে অনেকগুলো অ্যাকুস্টিক সিগনেচার ধরা পড়েছে… আপনাদের ওপর হামলার সময় যে- ধরনের সিগনেচার পাওয়া গিয়েছিল, ঠিক সেরকম।’
‘তার অর্থ?’
‘অন্তত এক ডজন ছোট ছোট সাবমেরিন আছে ওখানে—টার্গেট জোনের এন্ট্রি পয়েন্ট পাহারা দিচ্ছে। প্রত্যেকটায় যদি দুটো করেও টর্পেডো থাকে, আমাদের মাথাব্যথার জন্যে যথেষ্ট।’
‘আপনি বলতে চাইছেন, দুটো লস অ্যাঞ্জেলেস ক্লাসের সাবমেরিন এসব চুনোপুঁটিদের সামলাতে পারবে না?’
‘চুনোপুঁটি না, ড. রেজা। এরা হলো হুলঅলা মৌমাছি। লড়াই অবশ্য করা যাবে; কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের সাবমেরিন ডিজাইন করা হয়েছে রাশান আর চাইনিজ বড় বড় সাবমেরিনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে… তাও আবার গভীর সাগরে। কিন্তু এখানে, কোয়াডাঙ্গল সাইটে পানির গভীরতা গড়পড়তা ষাট ফুটের বেশি নয়। ওখান থেকে দু’মাইল দূরে এলে গভীরতা একটু বাড়ে, কারণ ওখানে একটা ডুবো- ক্যানিয়ন আছে…’ আঙুল দিয়ে ম্যাপে একটা আঁকাবাঁকা রেখা দেখালেন ক্যাপ্টেন, টার্গেট জোন থেকে সাগরের দিকে বিস্তৃত ওটা, ‘…কিন্তু এই ক্যানিয়নটাকে বাদ দিলে টার্গেটের দশ মাইলের মধ্যে কোথাও দু’শো ফুটের বেশি পানি নেই। তাই আমাদের সাবমেরিনগুলো ঠিকমত নড়াচড়া করতে পারবে না। আর নড়াচড়া যদি করতে না পারে, শত্রুদের সাবমেরিনগুলোর সহজ শিকারে পরিণত হবে।’
দম নেবার জন্যে একটু থামলেন ফগেল! টুপি খুলে আঙুল বোলালেন চুলে। তারপর আবার পরে নিলেন টুপিটা।
‘আমরা আসলে উভয়সঙ্কটে পড়ে গেছি, বুঝলেন? বললেন তিনি। ‘পানির ওপর-নিচ, কোনও দিক দিয়েই সুবিধে করতে পারছি না। অথচ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও সম্ভব নয় এই পরিস্থিতিতে।’
‘বিকল্প কিছু ভাবছেন নিশ্চয়ই?’ অনুমান করল তানিয়া। ‘নইলে আমাদেরকে এত কিছু শোনাতেন না। ‘
‘ইয়ে… আপনাদের একটু সাহায্য প্রয়োজন আমাদের।’
‘সাহায্য!’ বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল তানিয়ার।
আসিফ বলল, ‘ইউএস নেভি যদি কিছু করতে না পারে, আমরা কী করব?’
‘নুমা থেকে ছোট যে-সাবমারসিবলটা পাঠানো হয়েছে, ওটা নিয়ে ক্যানিয়নটায় ঢুকতে পারবেন আপনারা,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ‘ক্যানিয়নটা চার হাজার ফুট দীর্ঘ, ওটা ধরে টার্গেটের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারবেন।’
চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তানিয়ার।
ভুরু কুঁচকে আসিফ বলল, ‘আপনারা নিজেদের সাবমেরিন পাঠাচ্ছেন না কেন ওখানে?’
‘ক্যানিয়নটা খুবই সরু,’ ব্যাখ্যা করলেন ক্যাপ্টেন। ‘ওপরটা স্রেফ একটা ফাটলের মত—খুব বেশি হলে বিশ ফুট চওড়া। ভেতরের দিকে খানিকটা প্রশস্ত, তবে ওখানে বড় কোনও সাবমেরিন ঢুকবে না।’
তানিয়ার দিকে তাকাল আসিফ। কিছু বলছে না সে, কিন্তু চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধ চলছে ওর ভেতর।
‘দুঃখিত, ক্যাপ্টেন,’ বলল আসিফ। ‘আমরা এখানে অ্যাকুস্টিক টিমকে সাহায্য করতে এসেছি, কোনও মিলিটারি অপারেশনে অংশ নিতে নয়। আমাদেরকে কথা দেয়া হয়েছিল, এ-ধরনের কিছু করতে বলা হবে না।’
‘কেউ আপনাদের হুকুম দিচ্ছে না,’ বললেন ফগেল। ‘স্রেফ অনুরোধ করছি। আমার লোকেরা কেউ ওই সাবমারসিবল চালায়নি আগে।’
‘আপনি যদি চান, আমরা ছোটখাট একটা ট্রেইনিং দিয়ে দিতে পারি…’
‘তাতেও কাজ হবে না। কারণ শুধু সাবমারসিবল না, সঙ্গের রোবটটাকেও প্রয়োজন আমাদের। ওটার অপারেশন নিশ্চয়ই কয়েক ঘণ্টায় শিখিয়ে দিতে পারবেন না?’
তানিয়ার দিকে তাকিয়ে কঠোর হতে হলো আসিফকে। ‘ক্ষমা করবেন, আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কীসের মধ্য দিয়ে গেছি আমরা ক’দিন আগে, তা নিশ্চয়ই জানেন। এ-অবস্থায় আবারও সাবমারসিবল নিয়ে কোনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেতে পারব না আমরা।’
হতাশা ফুটল ক্যাপ্টেনের চেহারায়। তবে ওদের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন তিনি। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘বেশ, তা হলে কী আর করা। আমাদের সাবমেরিনই পাঠাতে হবে ঝুঁকির মুখে। আমি বলে দিচ্ছি ওদেরকে…’
‘দাঁড়ান!’ হঠাৎ বলে উঠল তানিয়া।
ওর দিকে তাকালেন ফগেল।
‘আপনাদের সাবমেরিনদুটোয় কত লোক আছে?’
‘আড়াইশোর কিছু বেশি।’
বড় করে শ্বাস নিল তানিয়া। আড়াইশো লোক… এদের সবার নিশ্চয়ই পরিবার-পরিজন আছে। আছে স্ত্রী-সন্তান। ওর আর আসিফের জীবন বাঁচাতে গিয়ে এতগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করার কী অধিকার আছে ওর? স্বামীর দিকে তাকাল, ওর দৃষ্টি দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল আসিফ।
‘কী করতে হবে আমাদেরকে?’ ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করল সে।
‘শত্রুদেরকে ব্যস্ত রাখব আমরা,’ বললেন ফগেল। ‘সেই সুযোগে ক্যানিয়ন ধরে কোয়াডাঙ্গলে ঢুকবেন আপনারা রোবটটাকে রিলিজ করবেন। ওটার গায়ে আড়াইশো পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ বেঁধে দেয়া হবে। অ্যাকসেলারেটর রিঙের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা খুঁজে নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে আপনাদেরকে।’
‘তারপর?’
‘বাকিটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন।’
স্ত্রীর দিকে তাকাল আসিফ। ‘কী বলো, পারবে?’
‘পারতেই হবে, দৃঢ় গলায় বলল তানিয়া। ‘আর তো কোনও উপায় নেই।’