1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৪০

চল্লিশ

মার্কিন রণতরী ইউএসএস ফ্যারাগাট-এর প্রায়ান্ধকার কন্ট্রোল রুমে, সোনার অপারেটরের চেয়ারে বসে আছে আসিফ। চারদিকে শোভা পাচ্ছে অনেকগুলো ফ্ল্যাট-স্ক্রিন মনিটর আর কন্ট্রোল প্যানেল। হঠাৎ দেখায় জায়গাটা একটা রেকর্ডিং স্টুডিওর মিক্সিং রুম বলে মনে হতে পারে। অবশ্য বাস্তবেও যন্ত্রগুলোর কাজ মোটামুটি একই ধরনের—শব্দ নিয়ে কাটা- ছেঁড়া করা।

এ-মুহূর্তে নুমার জাহাজ অ্যাডভেঞ্চারার থেকে পাওয়া টেপ নিয়ে কাজ করছে ও, তানিয়া আর নেভির এক পেটি অফিসার, তার নাম জন পেরি। বেশ খাটতে হচ্ছে ওদেরকে, কারণ টেপে স্পষ্ট কিছু নেই। অ্যাডভেঞ্চারারের সোনারটা বিশ বছরের পুরনো, তার ওপর ওটা সাগরতলের গবেষণার জন্যে ডিজাইন করা। সি-ফ্লোর থেকে ভেসে আসা শব্দতরঙ্গই শুধু রিসিভ করে ওটা, যার ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়। চারদিকের খুব সামান্যই কাভার করে। এ-কারণে গ্রুপারের ওপর হামলার সময় হামলাকারীদের তথ্য বলতে গেলে কিছুই সংগ্রহ করতে পারেনি। আবছাভাবে যা ধরা পড়েছে টেপে, সেটাই বার বার বাজিয়ে, ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে-কমিয়ে শত্রুদের সাবমেরিনের অ্যাকুস্টিক সিগনেচার পাবার চেষ্টা করছে ওরা।

ক্লান্ত বোধ করছে আসিফ, টানা কয়েক ঘণ্টা ধরে কাজ করছে ওরা। তানিয়ার চেহারাতেও ভর করেছে অবসাদ। পেটি অফিসার পেরিই শুধু উৎফুল্ল। মনের মত কাজ পেয়েছে, উৎসাহের কমতি নেই তার। ছোটখাট প্রতিটা ব্যাপারে লেগে আছে নাছোড়বান্দার মত।

‘হয়েছে,’ পঞ্চাশতম বারের মত বলল সে। ‘আবার শুরু করা যাক।’

হেডসেট তুলে কানে লাগাল আসিফ। লক্ষ করল, কাগজ- কলম নিয়ে তানিয়াও তৈরি। প্লে বাটনে চাপ দিল পেরি, আবারও প্রথম থেকে বাজতে শুরু করল টেপ। প্রতিবারই ওটা থেকে নতুন কিছু না কিছু বের করে আনছে সে।

‘কী করেছি এবার, জানিয়ে রাখি,’ বলল পেরি। ‘আপনাদের ভয়েস কমিউনিকেশন যোগ করে দিয়েছি টেপে, যাতে টাইমিংটা বুঝতে অসুবিধে না হয়। ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজও কমিয়ে দিয়েছি অনেকটা।’

হেডসেটে নিজের আর তানিয়ার কণ্ঠ শুনতে পেল আসিফ-প্রথমে অ্যাডভেঞ্চারারের সঙ্গে, তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অদ্ভুত লাগল, এসব আলাপচারিতার বলতে গেলে কিছুই মনে নেই ওর।

‘কিছু পেলে?’ পাশ থেকে জানতে চাইল তানিয়া।

‘মাত্রই তো শুরু হলো, একটু অপেক্ষা করো।’

মাথা ঝাঁকিয়ে নোটবুকে মনোযোগ দিল তানিয়া। টেপ পৌছে গেল হামলা শুরু হবার মুহূর্তটায়। হেডসেটটা ভাল করে কানের ওপর চেপে ধরল আসিফ। চোখ স্ত্রীর ওপর। এখানটায় পৌছুলেই অস্বস্তিতে পড়ে তানিয়া, সেদিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায় ওর। এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। নার্ভাস ভঙ্গিতে নোটবুকের ওপর কলমের টোকা দিচ্ছে ও।

‘…হয়ে গেছে,’ জলকন্যাকে অপারেট করতে থাকা তানিয়ার রেকর্ড করা কণ্ঠ শোনা গেল টেপে। ‘এবার জাহাজের আরও ভেতরে যাচ্ছি।’

এরপরেই শোনা গেল সোনার অপারেটরের কণ্ঠ, ‘ড. রেজা, আমরা একটা সোনার কন্ট্যাক্ট পাচ্ছি… সিগনালটা খুব দুর্বল, আপনাদের পশ্চিম থেকে আসছে। তবে আসছে খুব দ্রুত।’

একটু বিরতি, তারপরেই কন্ট্রোলারের চিৎকার। ‘মাই গড! ওটা টর্পেডো! একটা না, দুটো! আপনাদের দিকে আসছে…’

‘স্টপ,’ পেরির দিকে তাকিয়ে বলল আসিফ। ‘শেষের বিশ সেকেণ্ড আবার বাজান।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল তানিয়া।

‘কিছু একটা শুনলাম মনে হলো। আগেরবার শুনিনি ওটা।’

মুখ ঘুরিয়ে নিল তানিয়া, চেহারার বিষাদ লুকাতে চাইছে। এমনভাবে ঘড়ি দেখল, যেন স্কুলে শেষ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় রয়েছে ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। আসিফ বুঝল, টেপটা যতবার শুনছে, ততবারই সেদিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি ফিরে আসছে বেচারির মনে। ব্যাপারটা টের পেয়ে চলে যেতে বলেছিল অনেকক্ষণ আগে, কিন্তু কথা শোনেনি ও।

রিওয়াইণ্ড করে আবার টেপটা বাজাল পেরি। শোনার পর- একটু ভাবল আসিফ। তারপর আরেকবার প্লে করতে বলল ওই অংশটা।

…আমরা একটা সোনার কন্ট্যাক্ট পাচ্ছি।’

‘কী ধরনের কন্ট্যাক্ট?’

‘বোঝা যাচ্ছে না। সিগনালটা খুব দুর্বল, আপনাদের পশ্চিম থেকে আসছে। তবে আসছে খুব দ্রুত …

‘থামুন!’ উত্তেজিত গলায় বলে উঠল আসিফ। ‘ওই তো, শুনতে পেয়েছেন?’

পেরি জবাব দেবার আগেই নিজের হেডসেট খুলে ফেলল তানিয়া, বলল, ‘কিছুই শুনিনি। আমার আর ভাল লাগছে না, আসিফ। একটু হাওয়া খেয়ে আসি।’

‘ঠিক আছে, যাও।’

তানিয়ার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আসিফ। বুঝতে পারছে ওর মনের অবস্থা। একদিক থেকে সে-তুলনায় ভাল আছে সে। স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ায় ঘটনাটার প্রতি আলাদা কোনও অনুভূতি খেলা করছে না। আর দশটা দুর্ঘটনার মতই গবেষণা করতে পারছে টেপটা নিয়ে।

পেরির দিকে ফিরল ও। ‘ভাইব্রেশনটা আলাদা করতে পারবেন? ভয়েস ট্র্যাকটাও বাদ দিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই,’ বলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পেটি অফিসার।

মাত্র এক মিনিট নিল সে। এরপর আবার বাজিয়ে শোনাল টেপের ওই অংশটা। কিছু একটা ব্লক করছে আসল শব্দকে। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকাল আসিফ। ফ্রিকোয়েন্সি চার্টে বেশ কিছু ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ, আর দুটো বড় ভাইব্রেশন দেখাচ্ছে। ভাইব্রেশনদুটোর ভেতরে একটা অন্যটার চেয়ে সামান্য বড়।

‘কী এটা?’ ওদিকে আঙুল তাক করে জানতে চাইল ও। ‘গ্রুপারের মোটর সিগনেচার,’ বলল পেরি। ‘এটাকে বাদ দিতে পারবেন?’

মাথা ঝাঁকিয়ে কি-বোর্ডের ওপর আঙুল নাচাল পেরি। ‘রেডি।’

‘প্লে করুন।’

এবার শব্দটা ঠিকমত শুনতে পেল আসিফ। কীসের শব্দ, বলতে পারবে না; তবে এতক্ষণ যে কল্পনা করেনি ওটা, তা প্রমাণ হয়ে গেল।

স্ক্রিনে থেকে যাওয়া বড় ভাইব্রেশনটার ওপর আঙুল রাখল ও। ‘বাকি সব ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ বাদ দিয়ে শুধু এটা প্লে করতে পারবেন? এনহ্যান্স করে নিলে ভাল হয়।’

হাসল পেরি। ‘ড. রেজা, বার বার এই পারব কি না-পারব কি না জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত সাউণ্ড ইকুইপমেন্ট নিয়ে বসেছি আমরা। কী চান, সেটা শুধু হুকুম করবেন।’

আসিফও হাসল। ‘বেশ, তা হলে এই সাউণ্ড ওয়েভটা বড় করে শোনান আমাকে। বাকি সবকিছু বাদ দিয়ে।’

কয়েক মুহূর্ত পরেই শব্দটা উঁচু ভলিউমে শুনতে পেল আসিফ। গুঞ্জনের মত আওয়াজ… মনে হলো বুঝি খালি রাস্তা দিয়ে তুমুল বেগে চলে গেল একটা কম হর্সপাওয়ারের মোটরসাইকেল।

পেরির দিকে ফিরল ও। ‘যা ভাবছি, এটা কি তা-ই?’

শব্দটা আরেক দফা শুনে মাথা ঝাঁকাল পেরি। ‘কম্প্রেশন,’ বলল সে। ‘শুরুর দিকে শব্দটা হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্প্রেসড্ হয়ে গেছে, কারণ উৎসটা গ্রুপারের দিকে আসছিল; আর শেষের তিন সেকেণ্ডে চলে গেছে লো-ফ্রিকোয়েন্সিতে, কারণ তখন ওটা দূরে সরে যাচ্ছিল।’

‘ট্রেনের হুইসেলের মত, রাইট?’ বলল আসিফ। ‘প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো একজন মানুষের সামনে দিয়ে হুইসেল বাজাতে বাজাতে ট্রেন চলে গেলে যা ঘটে। পুরোটা সময় একই শব্দ শুনছি, কিন্তু গতি আর দূরত্বের কারণে সেটা বাড়ছে-কমছে।’

‘এগজ্যাক্টলি,’ সায় জানাল পেরি।

‘তা হলে ওটা টর্পেডোর আওয়াজ হতে পারে না, কারণ ওগুলো আমাদের দিকে ছুটে আসছিল, দূরে সরে যায়নি।’

‘উঁহুঁ। কোনও ধরনের জলযান। শব্দ শুনে যা বুঝলাম, একটা না, দুটো।’

আসিফেরও তা-ই মনে হচ্ছে। ‘এটা আমরা আগেই শুনলাম না কেন?’

‘চারদিকের আওয়াজ, বিশেষ করে টর্পেডোর আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল,’ বলল পেরি। ‘ইন ফ্যাক্ট, টর্পেডোর ফ্রিকোয়েন্সিতেই ছিল ওটা।

‘তা হলে এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?’

‘অর্থ হলো, আপনাদেরকে ছোট আকারের… দ্রুতগামী দুটো সাবমেরিন আক্রমণ করেছিল। টর্পেডো ছুঁড়েই সরে গেছে ওখান থেকে, যাতে কেউ পিছু নিতে না পারে।’

‘ছোট দুটো সাবমেরিন…’ বিড়বিড় করল আসিফ। তারমানে আশপাশে নিশ্চয়ই কোনও মাদার শিপ ছিল। বড় সাবমেরিন হলে মাদার শিপের প্রয়োজন হয় না।

কান থেকে হেডসেট নামিয়ে রাখল পেরি। ‘খবরটা ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে আসি। এরপর আবার কাজে বসা যাবে।’

‘আমিও আসব?’

‘দরকার নেই। আপনি বরং আপনার স্ত্রীর কাছে যান। উনি আপসেট হয়ে পড়েছেন মনে হলো।’

কয়েক মিনিট পর জাহাজের আফট ডেকে বেরিয়ে এল আসিফ। কড়া রোদ, তাজা বাতাস আর হেলিকপ্টারের রোটরের গুরুগম্ভীর ধ্বনি স্বাগত জানাল ওকে। ধূসর রঙের একটা সি-হক হেলিকপ্টার হোভার করছে হেলিপ্যাডের ওপর। কপ্টারের তলায় ঝুলছে নেট দিয়ে বাঁধা কী যেন। ওটা নামানো হচ্ছে নিচে।

রেইলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তানিয়া, তাকিয়ে আছে ওদিকে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল আসিফ।

‘নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি,’ গলা চড়িয়ে বলল ও।

‘কী?’

‘অ্যাকুস্টিক সিগনেচার বের করতে পেরেছি হামলাকারী সাবমেরিনের। একটা না, দুটো সাবমেরিন ছিল ওখানে।’

‘হুম,’ নির্বিকার রইল তানিয়া।

‘খুশি হওনি?’ বিস্মিত গলায় বলল আসিফ। একানে হেডসেট লাগিয়ে আর বসে থাকতে হবে না আমাদের। এবার আরাম করা যাবে।’

‘ভাল।’

‘কী হয়েছে, বলো তো? এমন লাগছে কেন তোমাকে?’ স্বামীর দিকে মুখ ফেরাল তানিয়া। একটা হাত তুলে ইশারা করল হেলিপ্যাডের দিকে। ‘ওটা এখানে কেন?’

তাকাল আসিফ। নেটের ভেতরে কী আনা হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে এখন। ছোট একটা সাবমারসিবল; সেটার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্টের প্যাকেজ, আর একটা মানুষ আকৃতির ধাতব আরওভি। জলকন্যা।

‘অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন পাঠিয়েছেন,’ বলল ও।

‘তুমি জানতে?’

‘আজ সকালে কথা হয়েছে অ্যাডমিরালের সঙ্গে,’ বলল আসিফ। ‘চিন্তা কোরো না, ওটাকে স্রেফ ইমার্জেন্সির জন্যে আনা হয়েছে। প্রয়োজনে যেন হাতের কাছে পাওয়া যায়, এ-ই আর কী। তোমাকে কিছু করতে বলছে না কেউ।’

চুপ করে রইল তানিয়া। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। তারপর ওকে ওখানে রেখেই চলে গেল জাহাজের ভেতর।

.

প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসের অফিসে নাথানিয়েল ম্যালোনকে নিয়ে আলোচনায় বসেছেন প্রেসিডেন্ট আকুম্বা। চোখ লাল হয়ে আছে ম্যালোনের, ঘুমাতে পারেনি। বন্দি বিজ্ঞানীরা ডেডলাইনের ভেতরেই পেশ করেছেন তাদের প্রাথমিক সমাধান, সারা রাত জেগে সেগুলো যাচাই করতে হয়েছে তাকে। সকালে ছুটে আসতে হয়েছে প্রেসিডেন্টের কাছে।

‘সহজ করে বলতে গেলে,’ বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবগুলো ব্যাখ্যা করার পর বলল ম্যালোন, ‘ওরা সবাই একই সমাধান দিয়েছে। ছোটখাট কিছু পার্থক্য আছে, তবে মোদ্দা কথা একই।’

‘তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’

‘সবগুলো গ্রুপ যেহেতু একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, সমাধানটা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে আমার। ওদের ক্যালকুলেশনে আমি অন্তত কোনও গলদ খুঁজে পাইনি।’

‘ওরা যেভাবে বলছে, সেভাবে কাজ করতে পারবে?’ ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ম্যালোন। ‘পার্টিকেল অ্যাকসেলারেটরে কোনও পরিবর্তন আনতে হবে না। স্রেফ আরও বেশি মাত্রায় চার্জ করা পার্টিকেল ব্যবহার করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা পিস্তলে পয়েন্ট টু-টু ক্যালিবারের বুলেটের বদলে ফোরটি-ফাইভ ক্যালিবারের বুলেট ব্যবহারের মত। বাকি সবকিছু ঠিক থাকছে। পার্টিকেলগুলোর গতি সামান্য কমে যাবে, তবে সেটা ধর্তব্য নয়। তিন গুণ বেশি শক্তিতে আঘাত হানতে পারবে ওগুলো। কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘ব্যাপারটা আসলে জটিল কিছু নয়।’

‘এই সহজ ব্যাপারটা যদি তুমি কয়েক মাস আগে ধরতে পারতে,’ বিতৃষ্ণা ফুটল প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে, ‘অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতাম আমরা।’

‘এসব থিয়োরেটিক্যাল কাজ,’ নির্বিকার রইল ম্যালোন। ‘আমার ফিল্ড নয়।’

‘তা তো বটেই,’ বিদ্রূপ করলেন আকুম্বা। ‘তুমি যে সামান্য এক মেকানিক, তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।’

ডেস্কের ওপর রাখা ইন্টারকম বেজে উঠল। বোতাম চাপতেই শোনা গেল তাঁর সেক্রেটারির গলা।

‘মি. প্রেসিডেন্ট, একজন অতিথি এসেছেন। আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর… আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

‘খুব ভাল,’ বললেন আকুম্বা। ‘ভেতরে পাঠাও।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ম্যালোন। ‘সবকিছু ঠিকঠাক করে নিতে আমার চব্বিশ ঘণ্টামত লাগবে।’

‘বসে না থেকে কাজ শুরু করে দাও তা হলে,’ বললেন আকুম্বা। পাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিলেন। ‘ওখান দিয়ে বেরোও।’

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল ম্যালোন। কয়েক মিনিট পরেই খুলে গেল সামনের দরজা। অফিসে ঢুকলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বিশালদেহী মানুষ, টেক্সাসের লোক। সবসময় উঠে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান আকুম্বা, কিন্তু আজ তা করলেন না। হাতের ইশারায় সামনের চেহারায় বসতে বললেন তাঁকে।

দায়সারা ভঙ্গিতে কুশল বিনিময় করে অ্যাম্বাসেডর বললেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আশা করি বুঝতে পারছেন, অপ্রীতিকর একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি আমি।’

‘অপ্রীতিকর?’ ভুরু কোঁচকালেন আকুম্বা। ‘তা হবে কেন? শৃঙ্খলমুক্ত হওয়া কি অপ্রীতিকর?’

‘যেটাকে আপনি শৃঙ্খলমুক্তি বলছেন, সেটা বাস্তবে নগ্ন আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। সোজা কথায় ডাকাতি করছেন আপনারা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ অমান্য করছেন। এ-ধরনের ধৃষ্টতা কেউ কোনোদিন করেছে বলে জানা নেই আমার।’

‘তা হলে বলতেই হচ্ছে, ইতিহাসে আপনি বড্ড কাঁচা, ‘ মৃদু হাসলেন আকুম্বা। ‘১৯৫০ সালে, স্ট্যাণ্ডার্ড অয়েলের সমস্ত সম্পদ জাতীয়করণের ঝুঁকি দেখা দিলে, সৌদি রাজপরিবার আরবের অর্ধেক তেল নিজেদের দখলে নিয়েছিল। গত সত্তর বছরে সে-তেলের দাম দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলার। ২০০১ সালে একই কাজ করেছে ভেনিজুয়েলার হিউগো শ্যাভেজ। ১৯৭২ সালে সালভাদর অ্যালেন্দের অধীনে চিলি তার সমস্ত তামার খনি জাতীয়করণ করেছিল। ১৯৫৯ সালে হাভানা দখল করে ফিদেল ক্যাস্ত্রো, ধৈর্য ধরে বসে থাকে হাভানা হিলটন হোটেলের নির্মাণকাজ শেষ হবার জন্যে, যাতে ওটাকে সে কমিউনিস্ট পার্টির হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বিদেশিদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল সে, কোনোদিন ফিরিয়ে দেয়নি। এ-ঘটনাগুলোর একটাও কি জানা নেই আপনার?’

বড় করে শ্বাস টানলেন অ্যাম্বাসেডর। ‘অবশ্যই আছে। কিন্তু আপনি যা করছেন, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

‘হ্যাঁ, ভিন্ন,’ গলার স্বর কঠিন হলো আকুম্বার। ‘আর কতখানি ভিন্ন, তা এখনও টের পাননি। আপাতত এটুকু জেনে সন্তুষ্ট থাকুন, এতক্ষণ যেসব উদাহরণ দিলাম, টাকার হিসেবে আমাদেরটা সেগুলোর চেয়ে অনেক… অনেক কম। সত্যি বলতে কী, আপনাকে দেখে আমি একটু অবাকই হয়েছি। আমি ভেবেছিলাম সবার আগে চাইনিজ অ্যাম্বাসেডর ছুটে আসবেন—সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ওঁদেরই হচ্ছে কিনা!’

থতমত খেয়ে গেলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমরা ওঁদেরও প্রতিনিধিত্ব করছি। ইন ফ্যাক্ট, এদেশে অবস্থানরত সমস্ত বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি আমি-আমাদের প্রতিবাদ এবং অভিযোগ জানাতে।’

‘বাহ্, ভাল লোকই বেছেছে ওরা। নিশ্চয়ই ভেবেছে, আমেরিকার নাম শুনলে ভয়ে কেঁচো হয়ে যাব আমি, তাই না?’

‘ব্যাপারটা ওরকম নয় মোটেই,’ বিব্রত কণ্ঠে বললেন অ্যাম্বাসেডর। খাদে নামালেন গলা। ‘আনঅফিশিয়ালি একটা কথা বলি… আপনারা কেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তা বুঝতে পারছি আমরা। সিয়েরা লিওনের অর্থনীতির অবস্থা তো আমরা জানি। সেজন্যে একটা প্রস্তাব আছে। ঋণ পরিশোধের শর্তগুলো শিথিল করতে রাজি আছি আমরা, যদি চান তো সুদও কিছুটা মওকুফ করে দেব। তবে প্রিন্সিপাল পুরোটাই ফেরত দিতে হবে, ওটা মাফ করা সম্ভব নয়।’

ঠোঁটের কোনা বেঁকে গেল প্রেসিডেন্টের। ‘অশেষ দয়া আপনাদের,’ বললেন তিনি। ‘আমি একটা পাল্টা-প্রস্তাব দিই? এখন পর্যন্ত যা নিয়েছি, সব আমাদেরই থাকবে; আর আপনার দেশ সিয়েরা লিওনকে বছরে বিশ বিলিয়ন ডলার অনুদান দিতে থাকবে।

‘কী!’ চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে অ্যাম্বাসেডরের।

‘আমি আসলে নতুন করে ঋণই চাইব ভাবছিলাম,’ নীরস গলায় বললেন আকুম্বা। ‘কিন্তু ভেবে দেখলাম, আগের টাকাই এখনও পরিশোধ করিনি; আবার নিলেও শোধ করতে পারব, এমন সম্ভাবনা কম। তাই অনুদান নেয়াই ভাল। আরে, ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? ইয়োরোপ আর চীনের কাছ থেকেও আমরা একই পরিমাণ অনুদান চাইব।’

‘আপনি কি মস্করা করছেন?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন অ্যাম্বাসেডর। ‘আমাদের সবার সম্পত্তি জবরদখল করবেন, আর… আর আমরা আপনাকে বছরে ষাট বিলিয়ন ডলার চাঁদা দেব?’

‘খুব সামান্যই চাইছি,’ তাঁকে আশ্বস্ত করলেন আকুম্বা। ‘কয়েক বছর আগে আপনারা আপনাদের ব্যাঙ্কগুলোকে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সাতশো বিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন। ইরাকে এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন আপনারা… মাসে বিশ বিলিয়ন হারে। আমি তার একটা ভগ্নাংশ চাইছি মাত্র, এতে কোনও চাপ পড়বে না আপনাদের ওপর। বিনিময়ে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ দেব আমরা। এক ধরনের প্রণোদনা আর কী।’

কথা বলতে বলতে হাসছেন প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা আর ইয়োরোপের মাতব্বরি দেখে দেখে তিনি ক্লান্ত, কথায় কথায় টাকা-পয়সার খোঁটা মারে। এবার তার সমুচিত জবাব দেয়া যাচ্ছে।

অ্যাম্বাসেডরের মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। ‘বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেবার চেষ্টা করছেন আপনি, মি. প্রেসিডেন্ট,’ বললেন তিনি। ‘এসব টিকবে না।’

‘সৌদিরা টিকে আছে,’ আকুম্বা বললেন। ‘শ্যাভেজ আর ক্যাস্ত্রোও টিকে ছিল। গোয়ার্তুমি না করে মীমাংসায় আসুন, তাতে সবার মঙ্গল। নইলে তার ফলাফল শুভ হবে না।’

প্রচ্ছন্ন হুমকির সুর তাঁর কণ্ঠে। যা বলার আভাসে-ইঙ্গিতে বলছেন, তারপরেও অ্যাম্বাসেডরের মুখের ভাব বদলে যেতে দেখে বুঝলেন, অর্থটা অনুধাবন করতে পেরেছেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক, তারপর হাসতে শুরু করলেন।

‘এতে হাসির কী আছে?’ থমথমে গলায় জানতে চাইলেন আকুম্বা।

‘ইঁদুরের গর্জন শুনে হাসছি,’ বললেন অ্যাম্বাসেডর। ‘তুড়ি মেরে এই দেশ দখল করে নিতে পারি আমরা, আর আপনি কিনা আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছেন?’

বেয়াদবি সহ্য হলো না আকুম্বার, নিজের চাবুকটা তুলে ঠকাস করে বাড়ি মারলেন ডেস্কে। চমকে উঠলেন অ্যাম্বাসেডর, আরেকটু হলে পড়ে যেতেন চেয়ার থেকে।

‘ঔদ্ধত্যই আপনাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে, মি. অ্যাম্বাসেডর,’ বললেন প্রেসিডেন্ট। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। ডেস্কের ওপর দু’হাতে ভর রেখে ঝুঁকলেন রাষ্ট্রদূতের দিকে। ‘দিনের পর দিন আমাদেরকে শোষণ করে চলেছেন আপনারা, কিন্তু আর না। এখন থেকে আমরাই’ বরং শোষণ করব আপনাদের। চুষে ছিবড়ে বানাব। কথা না শুনলে দেব ভয়ঙ্কর শাস্তি। কারণ সিয়েরা লিওন ইঁদুর নয়, সিংহের দেশ। বাড়াবাড়ি করলে এই সিংহের থাবায় প্রাণ দেবেন আপনারা।

অ্যাম্বাসেডরের জবাবের অপেক্ষা করলেন না তিনি, হাত বাড়িয়ে বাযার টিপলেন। সশস্ত্র কয়েকজন গার্ড ঢুকল কামরায়।

‘এই বেয়াদব লোকটাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাও,’ হুকুম দিলেন আকুম্বা। ‘একে বহিষ্কার করা হচ্ছে এই দেশ থেকে। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিমানে তুলে দেবে।’

‘এ অন্যায়!’ চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাম্বাসেডর। ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করছেন আপনি!’

‘আপনার সঙ্গে শিষ্টতা দেখানোর কোনও প্রয়োজন দেখছি না,’ বললেন আকুম্বা। ‘নিয়ে যাও একে।’

অ্যাম্বাসেডরকে খেদিয়ে বের করে নিয়ে গেল গার্ডরা। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট। বুঝতে পারছেন, ঝোঁকের বশে খানিকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। মাথা ঠাণ্ডা রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঔদ্ধত্য দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ফলাফলটা পরিষ্কার—মীমাংসার সব পথ এখন রুদ্ধ হয়ে গেল। কাঁধ ঝাঁকালেন, কী আর করা… এমনিতেও মীমাংসার কোনও ইচ্ছে ছিল না তাঁর।

পরের চালটা খুব দ্রুত দিতে হবে। সন্দেহ নেই, আমেরিকানরা তাঁর হুমকিকে খুব একটা গুরুত্ব দেবে না। তাই ওদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে তাঁর শক্তি। নইলে আর দশজন খ্যাপা স্বৈরশাসকের কাতারে ফেলা হবে তাঁকে, সারা দুনিয়া হাসবে তাঁকে নিয়ে।

না, ক্রুদ্ধভাবে ভাবলেন আকুম্বা, মানুষের উপহাস সহ্য করতে পারবেন না তিনি। তাই ঘটাবেন ধ্বংসযজ্ঞ। এনার্জি ওয়েপনের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব যখন দেখতে পাবে বিশ্ব, জোসেফ আকুম্বাকে শ্রদ্ধা না করে উপায় থাকবে না কারও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *