তিন
দেড় বছর পর।
পূর্ব আটলান্টিকের মৃদুমন্দ ঢেউ চিরে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে চলেছে জাপানি জাহাজ আরাতামা মারু। গন্তব্য, উত্তরের জিব্রাল্টার-ভূমধ্যসাগরের প্রবেশপথ। আট নট গতিতে চলেছে জাহাজটা, সর্বোচ্চ গতিবেগের অর্ধেকে, কম তেল পুড়িয়ে এই গতিতেই সবচেয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারে ওটা।
জাহাজের শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন র্যাগনার লারসেন। চোখ রেডার স্ক্রিনে। আবহাওয়া পরিষ্কার, সামনে কোনও জাহাজ নেই। দশ মাইল পেছনে রয়েছে একটা ভিএলসিসি বা ভেরি লার্জ ক্রুড ক্যারিয়ার, সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় সুপারট্যাঙ্কার। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জাহাজ ওগুলো, এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারের চেয়েও বড়। পানামা বা সুয়েজ খালে জায়গা হয় না ওগুলোর। পুরোপুরি লোডেড অবস্থায় পাঁচ লাখ টন পর্যন্ত ওজন হয় একেকটার। অবশ্য পেছনে যেটা রয়েছে, সেটা সম্ভবত খালি—যে-গতিতে এগোচ্ছে, তাতে তা-ই মনে হয়।
কিছুক্ষণ আগে ট্যাঙ্কারটাকে ডাকাডাকি করেছিলেন লারসেন। আশপাশে কোনও জাহাজ থাকলে তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করেন তিনি, বিশেষ করে বিপজ্জনক এলাকায়। এখন অবশ্য বিপজ্জনক এলাকা পাড়ি দিচ্ছেন না তাঁরা; পূর্ব আফ্রিকা, বিশেষ করে সোমালিয়ার উপকূলের তুলনায় পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল অনেক বেশি নিরাপদ; তারপরেও অন্য কোনও জাহাজ পেলে তাদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চান তিনি, ভালমন্দ জেনে নেবার চেষ্টা করেন। কেন জানি ট্যাঙ্কারটা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। তাতে অবশ্য কিছু মনে করেননি ক্যাপ্টেন; কেউ কেউ যেচে আলাপ জমায়, আবার কেউ চুপ করে থাকতে পছন্দ করে—এটাই দুনিয়ার রীতি।
স্ক্রিন থেকে মুখ তুললেন লারসেন। ব্রিজের উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে তাকালেন সামনে। খোলা সাগর আর শান্ত রাত তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
‘স্পিড বারো নটে তোলো,’ হুকুম দিলেন তিনি।
‘আই, আই, স্যর,’ জবাব দিল হেলমসম্যান-মার্টিন গুইরাদো নামের এক ফিলিপিনো সে।
পুরোপুরি বহুজাতিক জাহাজ বলা চলে আরাতামা মারুকে। ক্যাপ্টেন নরওয়েজিয়ান, রেজিস্ট্রি করা হয়েছে বাহামায়, বানানো হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়, মালিকানা জাপানি, আর ক্রু-রা বেশিরভাগই ফিলিপিনো। কাজের দিক দিয়েও একই দশা—এবারের ট্রিপে আফ্রিকান খনিজ পদার্থের একটা লোড বহন করছে জাহাজটা, চীনের একটা ফ্যাক্টরিতে ডেলিভারি দেবার জন্যে।
এই বহুজাতিক সমাবেশ দেখে বাইরের যে-কারও কপালে ভ্রূকুটি দেখা দিতে পারে, তবে বাস্তবতা হলো, জাতীয়তার পার্থক্য থাকলেও জাহাজের সবার মাঝে বোঝাপড়া চমৎকার, যে-যার কাজে দক্ষ। আজ দু’বছর হলো গুইরাদোকে নিয়ে সেইল করছেন লারসেন, তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে তাঁর।
গতি বাড়াতেই ইঞ্জিনের শব্দ বদলে গেল। সুইচ টিপে চার্ট টেবিলের ওপরের একটা মনিটরে রেডারের ডিসপ্লেটা নিয়ে এলেন লারসেন। জিনিসটা আসলে অত্যাধুনিক একটা হাই ডেফিনিশন টাচস্ক্রিন। পর্দায় ফুটে উঠল জাহাজের চারপাশের পানি। এক কোণে দেখা যাচ্ছে পজিশন, কোর্স আর স্পিড।
প্রথম দেখায় সব স্বাভাবিক মনে হলো। কিন্তু স্ক্রিনে যুম করে লারসেন বুঝতে পারলেন, দক্ষিণমুখী একটা স্রোতের ধাক্কায় নির্ধারিত কোর্স থেকে পাঁচশো গজ দূরে সরে এসেছেন তাঁরা।
‘টু ডিগ্রিজ টু পোর্ট,’ নির্দেশ দিলেন তিনি।
‘আই, আই, স্যর,’ আবারও বলল গুইরাদো।
জাহাজের কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে একটা সুইভেল চেয়ারে বসে আছে সে। দেখে মনে হতে পারে কোনও মহাকাশযান চালাচ্ছে। পুরনো আমলের হুইল আর লিভারের দিন শেষ, আরাতামা মারু চালানো হয় একটা অত্যাধুনিক কন্ট্রোল প্যানেলের মাধ্যমে। গুইরাদোর সামনে একটা কম্পিউটার স্ক্রিনে ফুটে উঠছে কম্পাস বেয়ারিং থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ডেটা। হুইলের বদলে ছোট্ট একটা লিভার ব্যবহার করছে সে, ইঞ্জিনের আরপিএম বাড়াচ্ছে- কমাচ্ছে গাড়ির গিয়ারের মত ছোট্ট একটা গিয়ার দিয়ে।
প্যানেলে প্রয়োজনীয় অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই রাডার কন্ট্রোল ইউনিট আর ইঞ্জিনে চলে গেল ইলেকট্রনিক সিগনাল। দু’ডিগ্রি নাক ঘোরাল আরাতামা মারু। খালি চোখে বোঝা মুশকিল, তবে রেডারের স্ক্রিনে পরিষ্কার দেখা গেল পরিবর্তনটা।
সন্তুষ্ট হয়ে গুইরাদোর দিকে তাকালেন লারসেন। ‘এই কোর্সেই রাখো,’ বললেন তিনি। ‘এত চমৎকার সব ইকুইপমেণ্ট যখন পেয়েছি, ওগুলো কাজে লাগানো যাক।’
‘ইয়েস, স্যর,’ হাসিমুখে বলল গুইরাদো।
ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। স্থানীয় সময় রাত দশটা। তৃতীয় ওয়াচের ক্রুরা ডিউটি করছে সবখানে। ওদের ওপর আস্থা আছে তাঁর, ডিউটি অফিসারের দিকে ফিরে বললেন, ‘জাহাজের দায়িত্ব এখন তোমার। আমি নিচে গেলাম।’
‘জী, স্যর,’ মাথা ঝাঁকাল ডিউটি অফিসার।
যাবার আগে রেডারে শেষবারের মত সুপারট্যাঙ্কারের পজিশন দেখে নিলেন তিনি। একটু বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলেন, ওটাও দু’ডিগ্রি নাক ঘুরিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্পিড তুলেছে বারো নট।
‘নকলবাজ!’ বিড়বিড় করলেন লারসেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। ব্রিজের দরজা খুলে রওনা হলেন জাহাজের পেছনদিকে। পোর্টহোলে নজর গেল তাঁর, পিছু নেয়া জাহাজটার আলো দেখতে
দেখতে পাচ্ছেন। অদ্ভুত একটা রঙ-নীলচে সাদা, আধুনিক গাড়ির হাই ইনটেনসিটি হেডলাইটগুলোর আলো যেমন হয়। এই প্রথম কোনও জাহাজে অমন আলোর বাতি দেখছেন ক্যাপ্টেন। তিনি পুরনো আমলের মানুষ, জাহাজে হলদে কিংবা ধবধবে সাদা রঙের বালব দেখে অভ্যস্ত। নতুন আলোটা কেমন যেন অপার্থিব লাগল। তাই বলে অবাক হলেন না, কয়েক বছর আগেও কি ভেবেছিলেন, একদিন কম্পিউটার দিয়ে জাহাজ চালাবেন?
স্টেয়ারওয়েলে ঢুকলেন লারসেন, বন্ধ করে দিলেন হ্যাচ। নামতে শুরু করলেন সিঁড়ি ধরে। উন্মুখ হয়ে আছেন নিজের কেবিনে পৌছুবার জন্যে। আজকাল জাহাজে পরিবার নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে, তাই তরুণী স্ত্রীকে প্রথমবারের মত সমুদ্রযাত্রায় নিয়ে এসেছেন তিনি। দু’বছর হলো বিয়ে হয়েছে তাঁদের, স্ত্রীর সঙ্গে বয়সের বিস্তর ফারাক থাকলেও সেটা তাঁদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কায়রো পর্যন্ত যাবে তাঁর স্ত্রী, সেখানে তাকে নামিয়ে দেয়া হবে বিমানে চেপে বাড়ি ফেরার জন্যে। এরপর আরাতামা মারুকে নিয়ে সুয়েজ খাল পেরোবেন লারসেন।
সময়টা ভালই কাটছে তাঁদের। ছুটি ছাড়াই ছুটির মত একটা আমেজে রয়েছেন। একসঙ্গে ডিনার করার জন্যে অপেক্ষা করছে তাঁর স্ত্রী, সেজন্যেই কেবিনে ফেরার তাড়া।
লোয়ার ডেকে পৌছুতেই ম্লান হয়ে এল স্টেয়ারওয়েলের বাতি। ছাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন লারসেন, জ্বলন্ত অঙ্গারের মত লাল হয়ে গেছে বালবগুলোর ফিলামেন্ট, যেন পুড়ে ছাই হতে চলেছে। ওপরদিকে কিছু টিউবলাইট আছে, সেগুলোও জ্বলছে-নিভছে অস্বাভাবিক ছন্দে।
এক মুহূর্তের জন্যে ঠিক হলো আলো; লারসেন ভাবলেন, নিশ্চয়ই জেনারেটরে কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে। উল্টো ঘুরে ব্রিজের দিকে ফিরে চললেন তিনি, খোঁজ নেবেন কী হয়েছে। অর্ধেকটা উঠতেই আবার ম্লান হলো আলো, তারপর চোখের পলকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তাঁর। আচমকা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো সবক’টা বালব আর টিউবলাইট, দেখা গেল বিদ্যুতের নীলচে শিখা-ভাঙা কাঁচের টুকরো বৃষ্টির মত নেমে এল ক্যাপ্টেনের ওপরে।
খপ্ করে রেইল আঁকড়ে ধরলেন লারসেন—একই সঙ্গে বিস্মিত ও শঙ্কিত। এমন ঘটনা আগে কখনও দেখেননি তিনি। টের পেলেন, একদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে জাহাজ, যেন তীক্ষ্ণ বাঁক নিচ্ছে। অন্ধকার স্টেয়ারওয়েল ধরে ত্রস্ত পায়ে ছুটলেন তিনি, জানা দরকার সমস্যাটা কোথায়।
ঘাড় আর চোয়ালে হঠাৎ তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করলেন ক্যাপ্টেন। মানসিক চাপের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, ভাবলেন তিনি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছেন, বড় কোনও গোলমাল দেখা দিয়েছে তাঁর জাহাজে।
ঝড়ের মত ব্রিজে ঢুকলেন লারসেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হচ্ছেটা কী এখানে?
প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেল না গুইরাদো বা ডিউটি অফিসার। হেলমসম্যান ইন্টারকমে চেঁচামেচিতে ব্যস্ত, আর ডিউটি অফিসার যুদ্ধ করছে কম্পিউটার নিয়ে—পাগলের মত একের পর এক বোতাম চাপছে অটোমেটিক কন্ট্রোল ওভাররাইড করার জন্যে। কাজ হচ্ছে না, ক্রমাগত নাক ঘোরাচ্ছে জাহাজ।
রাডার ইণ্ডিকেটরের দিকে তাকালেন লারসেন—বাম দিকের শেষ প্রান্তে ঠেকে গেছে কাঁটা। এক মুহূর্ত পরেই ঝিরঝির করে অন্ধকার হয়ে গেল স্ক্রিন। পাশের একটা যন্ত্রের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি। মাথার ব্যথাটা বেড়ে গেল তাঁর।
চোখের সামনে ডিউটি অফিসারকে লুটিয়ে পড়তে দেখলেন লারসেন। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গোঙাতে শুরু করেছে সে।
‘গুইরাদো!’ হুকুম দিলেন তিনি। ‘নিচে যাও। আমার স্ত্রীর কী অবস্থা দেখো।
ইতস্তত করল হেলমম্যান।
‘যাও বলছি!’
মাথা ঝাঁকিয়ে ছুটল গুইরাদো।
কমিউনিকেশন সেটের মাইক্রোফোন তুলে নিলেন ক্যাপ্টেন, রেডিওতে সাহায্য চাইবেন। টক বাটন চাপতেই তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল স্পিকার থেকে। আরেকটা যন্ত্রের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি, কিন্তু সেটা ধরার আগেই তীব্র জ্বলুনি অনুভব করলেন বুকে। মাথা নামাতেই দেখলেন, কোটের ধাতব বোতামগুলো লাল হয়ে গেছে। খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন, বোতাম ধরতেই ছ্যাঁকা লাগল হাতে।
মাথার ভেতরে যেন আক্ষরিক অর্থেই ঝড় শুরু হয়েছে লারসেনের, পড়ে গেলেন মেঝেতে। চোখের পাতা মুদেও রেহাই পাওয়া গেল না—লাল, নীল হাজারো ফুল দেখতে পেলেন। টনটন করছে দুটো চোখই, মনে হচ্ছে কেউ আঙুল দিয়ে টিপে ধরেছে তাঁর মণিদুটো। খুলির ভেতর বিস্ফোরণের মত একটা আওয়াজ পেলেন তিনি, নাক দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। বুঝলেন, কোথাও একটা রক্তবাহী ধমনী ফেটে গেছে।
চোখ খুললেন লারসেন। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে পুরো ব্রিজ। হামাগুড়ি দিয়ে ব্রিজ উইঙের দিকে এগোলেন তিনি। নাক দিয়ে অঝোরে ঝরছে রক্ত, পরোয়া করছেন না। খোলা বাতাসে বেরুতে হবে তাঁকে। দরজা পর্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে পৌঁছুলেন, কোনোমতে পাল্লা খুললেন, কোনোমতে শরীরের অর্ধেকটা বেরও করলেন, কিন্তু এরপরেই শক্তি হারালেন। বেকায়দাভাবে দরজা আর উইঙের মাঝখানটায় পড়ে রইল তাঁর দেহ। মাথার ভেতরের ঝড়টা বেড়ে গেছে বহুগুণ, তীব্র যন্ত্রণায় ভুলে গেছেন সবকিছু। আবছাভাবে দেখলেন, জাহাজের রেলিং আর সুপারস্ট্রাকচারে বিদ্যুতের শিখা নাচানাচি করছে। পেছনের সুপারট্যাঙ্কারটাও দেখলেন—এখনও দশ মাইল দূরত্ব বজায় রেখেছে ওটা, কিন্তু বিয়েবাড়ির মত আলোয় ঝলমল করছে।
চিন্তাশক্তি লোপ পেল লারসেনের, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে শুরু করল তাঁর দেহ। নিজের অজান্তে একটা আর্তচিৎকার দিলেন তিনি, তারপরেই দপ্ করে আগুন ধরে গেল তাঁর পুরো শরীরে।