1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৭

সাঁইত্রিশ

বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে হাসপাতালের বিছানায় বসে আছে আসিফ, কেবিনে ঢুকেই ওর দিকে ছুটে গেল তানিয়া। ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকে, জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। দু’চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরছে। কেশে উঠল আসিফ, বলল, ‘আরে, ছাড়ো, ছাড়ো… মেরে ফেলবে নাকি?’

তাড়াতাড়ি ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হলো তানিয়া। ‘সরি, ব্যথা দিয়ে ফেলেছি?’

‘ব্যথা আর দেবে কী, এমনিতেই সারা শরীরে ব্যথা। তবে ডাক্তার বললেন, বিপদ কেটে গেছে।’

তানিয়ার পিছু পিছু রানা ও মুরল্যাণ্ডও ঢুকেছে ভেতরে। হাসিমুখে এগিয়ে এল বিছানার দিকে। রানা বলল, ‘বেঁচে আছিস তা হলে? ভালই ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি।’

‘আমাকে এসব না বলে নিজের দিকে তাকা,’ বলল আসিফ। ‘মনে তো হচ্ছে তুই-ই ফিরে এসেছিস মৃত্যুর মুখ থেকে।

‘কী তেজ রে, বাবা!’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘দেখেছ, তানিয়া, আমার কথা কীভাবে ফলে গেল? যমদূতও পালিয়ে গেছে ওর তেজ দেখে।’

হাসল সবাই।

‘কী হয়েছিল, বলো তো?’ বলল আসিফ। ‘আমার তো কিছুই মনে নেই।’

‘কিছুই না?’ জিজ্ঞেস করল তানিয়া।

‘ছাড়া ছাড়া সব

স্মৃতি। গ্রুপারে চেপে সাগরে নেমেছিলাম, এটুকু মনে আছে। কিন্তু এরপর সব ঝাপসা।’

অবাক হলো না তানিয়া, বড় ধরনের দুর্ঘটনায় এমনটা হয়। পীড়াদায়ক স্মৃতি মুছে ফেলে মস্তিষ্ক—এক রকম ডিফেন্স মেকানি সেটা। ব্যথা-বেদনা ভুলিয়ে শরীরকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে।

সংক্ষেপে আসিফকে গ্রুপারের ওপর হামলা, আর সাগরের তলা থেকে সংগ্রাম করে ওদের উঠে আসার ঘটনা শোনাল তানিয়া। শুনে চোখ বড় হয়ে গেল তার।

‘বলো কী! তোমাকে সঙ্গে নেয়া তো তা হলে একদম উচিত হয়নি,’ বলল সে। ‘এখন মনে পড়ছে, সাগরে ডুব দেবার আগে অ্যাডভেঞ্চারারের ডেকে দাঁড়িয়ে একা একাই নামব ভাবছিলাম।’

‘তা হলো বিরাট বোকামি করতে,’ বলল তানিয়া। ‘সবদিক সামলে একা একা ফিরতে পারতে না কিছুতেই। আমি না থাকলে জলকন্যা থাকত না; গ্রুপারের ড্যামেজ মেরামতেরও লোক থাকত না।’

‘তারপরেও… তোমাকে এমন একটা বিপদে ফেললাম…

‘কিচ্ছু হয়নি আমার,’ জোর গলায় বলল তানিয়া। ‘যা হবার তো হয়েছে তোমার। আমি বরং ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তোমার পাশে ছিলাম বলে।’

‘কী যে বলো না…’

তোমাদের প্রীতি-সম্ভাষণ বাড়িতে ফেরার পর করলে হয় না?’ বেরসিকের মত বলল মুরল্যাণ্ড। ‘আমাদের তাড়া আছে, আসিফ। কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারো।’

‘জানতে তো অবশ্যই চাই,’ বলে ওর দিকে তাকাল আসিফ। ‘কারা হামলা করেছিল আমাদের ওপর, কিছু জানতে পেরেছ?’

যা যা জানে, খুলে বলল রানা ও মুরল্যাণ্ড। শেষে যোগ করল, ‘লোকগুলোকে খুঁজে বের করতে চলেছি আমরা। নিশ্চিত থাক, এমনি এমনি পার পেতে দেব না কিছুতেই।’

‘তোরা ছুটে মরবি, আর আমরা দু’জন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে… হিসেব- নিকেশ মেটানোর ব্যাপার আছে।’

‘তার জন্যে আমি যাচ্ছি,’ বলল তানিয়া। ‘আটলান্টিকের একটা অ্যান্টি-সাবমেরিন ফ্রিগেটে আগামীকালই যোগ দেব আমি—টাস্ক ফোর্সের অ্যাকুস্টিক টিমের সঙ্গে কাজ করার জন্যে।’

বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকাল আসিফ। ‘তুমিও?’ বলল সে। ‘আমি কি তা হলে এখানে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজব?’

‘বিশ্রাম নিতে হবে তোমাকে, সেটাকে ভেরেণ্ডা ভাজা বলো, আর যা-ই বলো।’

‘অসম্ভব!’ ঝট করে গা থেকে চাদর সরিয়ে দিল আসিফ। বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।’

‘পাগলামি করিস না,’ রানা চোখ রাঙাল। ‘চারদিন বেহুঁশ ছিলি তুই, মরতে বসেছিলি।’

‘তোরাও তো মরতে বসেছিলি, সেজন্যে কি বিছানায় পড়ে থাকছিস? তা ছাড়া এখন আমি বিপদমুক্ত, সাগরের খোলা হাওয়ায় শরীর আরও দ্রুত সেরে উঠবে।’

‘তানিয়া,’ রানা ডাকল, ‘ওকে কিছু বলো!’

‘ও আবার কি বলবে?’ মুখ ঝামটে উঠল আসিফ। ‘টাস্ক ফোর্সে ওর চেয়ে আমাকে বেশি দরকার। আণ্ডারওয়াটার অ্যাকুস্টিকসে ওর চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশি।’

স্বামীর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তানিয়া। আসিফকে খুব ভাল করে চেনে ও, জানে কেন জেদ করছে। আসলে একা ওকে যেতে দিতে চাইছে না। অন্যদিক থেকে ভাবলে, ও নিজেও চাইছে না আসিফকে ফেলে যেতে। কিন্তু আবেগ দিয়ে তো বাস্তবতা বদলানো যায় না।

‘তুমি দুর্বল,’ নিচু গলায় বলল ও।

‘কীসের দুর্বল?’ বিছানা থেকে নেমে পড়ল আসিফ। একটু টলে উঠলেও দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। বলল, ‘দেখেছ, নিজেই দাঁড়াতে পারছি।’

চুপ করে রইল তানিয়া

‘আরে বাবা, এত ভয় পাবার কী আছে?’ বলল আসিফ। ‘যুদ্ধজাহাজে যাচ্ছি আমরা। আমাদেরকে ঘিরে রাখবে আর্মার প্লেটিং, মিসাইল, কামান আর টর্পেডো। এর চেয়ে নিরাপদ আর কিছু হয়?’

বড় করে শ্বাস ফেলল তানিয়া। ‘তোমার গোয়ার্তুমির সঙ্গে পেরে উঠব না আমি। ঠিক আছে, নেব তোমাকে। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’

‘কী শর্ত?’

‘পানিতে নামতে চাইতে পারবে না। সাবমারসিবলে চেপে, বা ডাইভ সুট পরে, কিংবা অন্য কোনও কায়দায়… কোনোভাবেই না। তার জন্যে তৈরি না আমি।’

‘আরে নাহ্, পানিতে নামতে হবে কেন? আমরা জাহাজেই থাকব, আমাদের এয়ার-কণ্ডিশনড় কোয়ার্টারে। যদি সম্ভব হয় তো জাহাজের মেসের কাছে, যাতে যখন যা খুশি খেতে পারি।’

হাসিমুখে কথাটা বললেও মনে মনে উদ্বিগ্ন হলো আসিফ তানিয়াকে কোনোদিন কোনও বিষয়ে ভয় পেতে দেখেনি ও। আর সে-ই কিনা এখন… ব্যাপারটা সত্যিই চিন্তা জাগাবার মত।

‘তোরা দু’জনেই পাগল,’ হতাশ গলায় বলল রানা।

.

সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনের রাস্তায়, পুরনো একটা রাশান ট্যাঙ্কের ওপর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট আকুম্বা। এ-ধরনের চল্লিশটা ট্যাঙ্ক আছে তাঁর, সবগুলোই এগোচ্ছে এক সারিতে। ট্যাঙ্কের সারির দু’পাশে রয়েছে মিসাইলবাহী ট্রান্সপোর্ট, জিপ আর আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার। অপারেশন পাইথনের নামে পুরো দেশে জাতীয়করণ কার্যক্রম শুরু করেছেন তিনি, সেজন্যে দুনিয়ার সামনে নিজের শক্তিমত্তা জাহির করছেন সামরিক শোভাযাত্রার মাধ্যমে। হেলিকপ্টার আর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে সেনাবাহিনীর পদাতিক সৈন্যরা ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা খনিগুলোর।

তুমুল হর্ষধ্বনির মাঝে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ধরে এগোচ্ছে প্রেসিডেন্টের শোভাযাত্রা। জাতীয়করণ শেষে বিশাল কর্মসংস্থান হবে সিয়েরা লিওনের নাগরিকদের; ভাল চাকরি দেয়া হবে সবাইকে, দেয়া হবে ভাল বেতন—এমন ঘোষণা শুনে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে এসেছে ঘরবাড়ি থেকে। রাস্তার দু’ধারে জড়ো হয়ে আকুম্বার নামে জয়ধ্বনি আর স্লোগান দিচ্ছে তারা।

আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন আকুম্বা। আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছেন, জনগণ মন থেকে জয়ধ্বনি দিচ্ছে তাঁকে। বন্দরের দিকে এগোচ্ছে তাঁর শোভাযাত্রা— ওটার নিয়ন্ত্রণ ইতিমধ্যে এসে গেছে তাঁর হাতে, ঠিক যেভাবে এসেছে কয়েক মাইল উত্তরের বিশাল অয়েল রিফাইনারি, এয়ারপোর্ট আর বিদেশি অনেকগুলো ফ্যাক্টরির নিয়ন্ত্রণ।

বাছাই করা একজন সাংবাদিক আর একজন ক্যামেরাম্যান রয়েছে প্রেসিডেন্টের পাশে—শোভাযাত্রার কাভারেজ দেবার জন্যে।

‘প্রেসিডেন্ট আকুম্বা,’ বলল সাংবাদিক, হৈ-হল্লা আর ট্যাঙ্কের গর্জনের মাঝে গলা চড়িয়ে কথা বলতে হচ্ছে তাকে, ‘এটা কি সত্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে আপনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, সিয়েরা লিওন আর ওদের ঋণ পরিশোধ করবে না?’

‘হ্যাঁ,’ বললেন আকুম্বা। ‘আর কত? সুদ দিতে দিতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।’

‘এর সঙ্গে কি আজকের এই পদক্ষেপের কোনও সম্পর্ক আছে?’

‘আজ স্বাধীনতার দিন,’ আকুম্বা বললেন। ‘একদিন আমরা যেমন ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে স্বাধীন হয়েছিলাম, ঠিক সেভাবে আজ আরেক নিপীড়ন থেকে স্বাধীন হচ্ছি—অর্থনৈতিক নিপীড়ন।’

সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল সাংবাদিক। ‘এর ফলাফল নিয়ে কি আপনি চিন্তিত নন?’ জানতে চাইল সে। ‘কয়েক ডজন বহুজাতিক কর্পোরেশনের অধিকার খর্ব করছেন আপনি। এ-অবস্থায় বিশ্ব আপনার পাশে থাকবে, এমনটা নিশ্চয়ই আশা করছেন না?’

‘চোখের বদলে চোখ—এই নীতিতে বিশ্বাস করি আমি,’ বললেন আকুম্বা। ‘শত শত বছর ধরে এসব কোম্পানি আমাদের অধিকার খর্ব করেছে… আমাদের জমি থেকে তুলে নিয়ে গেছে দামি দামি সব রত্ন আর খনিজ পদার্থ। বিনিময়ে দিয়েছে শুধু যন্ত্রণা। ওসব কোম্পানির রান্নাঘরের একজন বাবুর্চিও আমাদের একেকজন খনিশ্রমিকের বিশগুণ বেতন পায়, অথচ ‘ওসব শ্রমিকেরা রোদে পুড়ে, না খেয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। কোম্পানির কর্তাদের কথা আর না-ই বললাম।’

‘কিন্তু খনি বলুন, কিংবা রিফাইনারি… এসবের অবকাঠামো তৈরি করতে তো বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন,’ যুক্তি দেখাল সাংবাদিক। ‘সেটা বিদেশিরাই দিচ্ছে।’

‘হাহ্! সেই বিনিয়োগ আমরা বহু আগেই উশুল করে দিয়েছি—আমাদের রক্ত দিয়ে।’

বন্দরে ঢুকে পড়ল শোভাযাত্রা। দূরে কালো ধোঁয়ার মেঘ পাক খেয়ে উঠতে দেখলেন আকুম্বা। আগুন লেগেছে সম্ভবত, তবে তার সঙ্গে বন্দর দখলের কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হলো না। হয়তো কোনও দুর্ঘটনা। তারপরেও সামরিক অভিযানের পটভূমিতে কালো ধোঁয়া একটা দেখার মত জিনিস… ভয় জাগায়।

‘ছবি তোলো ধোঁয়াটার,’ ক্যামেরাম্যানকে বললেন তিনি। ‘দুনিয়া বুঝুক, আমরা কতখানি সিরিয়াস।’

তাড়াতাড়ি ওদিকে ক্যামেরা ঘোরাল লোকটা। যুম করে তুলতে শুরু করল ছবি। এই ধোঁয়ার মেঘ আর ট্যাঙ্কে আসীন আকুম্বার ভিডিও খুব শীঘ্রি সিএনএন আর বিবিসি-সহ পৃথিবীর তাবৎ মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হবে।

মুচকি হাসলেন আকুম্বা। সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলতে চলেছেন তিনি। তাঁর দেশকে করতে চলেছেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরে সিয়েরা লিওনে অবস্থানরত সমস্ত বিদেশি নাগরিককে আটক করবেন তিনি, বিমানে তুলে পাঠিয়ে দেবেন যার যার দেশে।

সন্দেহ নেই, খেপে যাবে পশ্চিমা বিশ্ব। হুমকি-ধমকি দেবে, অবরোধ আরোপ করবে, কৈফিয়ত চাইবে তাঁর কাছে। খুশিমনেই কথা বলবেন তিনি। যতবার প্রয়োজন ততবার। বিবেকের কাছে পরিষ্কার তিনি, কোনও অন্যায় করছেন না, কাজেই কথা বলতে দোষ কোথায়?

জানা কথা, এরপর তাঁর কাছে ছুটে আসবে বিদেশিরা—দর কষাকষির চেষ্টা করবে। ভয় দেখিয়ে, ধাপ্পা দিয়ে তাঁকে নতি স্বীকার করাতে চাইবে। কিন্তু মানবেন না তিনি। পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, তবে শেষমেশ হার মানতে হবে ওদেরকেই। তখন উল্টো আকুম্বাই দাবি-দাওয়া পেশ করবেন ওদের কাছে। উল্টে দেবেন ছক।

এসবে যে ঝুঁকি আছে, তা আকুম্বা জানেন। তবে সেই ঝুঁকি কাটাবার উপায়ও আছে তাঁরই হাতে। কারণ দু’হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবার

এই প্রথমবার একজন আফ্রিকান সমরনায়কের হাতে এমন এক অস্ত্র এসেছে, যা দিয়ে ধূলিসাৎ করে দেয়া যাবে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যলিপ্সা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *