আটাশ
সৈকতের ধারে প্রায়া ফরমোসার কটেজের সারি। রাস্তার ধারে গাড়ি থামলে নেমে পড়ল রানা আর লামিয়া। চারদিক সুনসান। সৈকতের দিক থেকে ঢেউ ভাঙার কলকল ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কোথাও। সব কটেজে মানুষ নেই মনে হচ্ছে; যেগুলোয় আছে, তারাও ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভাড়া মিটিয়ে ড্রাইভারকে রানা বলল, ‘আরেকটা ট্রিপ দেবেন? একশো ডলার পাবেন, তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।’
আপত্তি করল না ড্রাইভার। এত রাতে আরেক দফা যাত্রী পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া একশো ডলার তো যথেষ্টরও বেশি ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘কাজ সেরে আসুন আপনারা।’
‘রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমাদের কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
‘সমস্যা নেই। যান আপনারা।’ গিয়ার দিয়ে গাড়ি সরিয়ে নিল লোকটা।
‘বেচারাকে বিপদে ফেলছ না তো?’ জিজ্ঞেস করল লামিয়া। ‘আমাদের পেছনে তো লোক লেগেছে!’
‘ওরা সবাই পাহাড়ের ওপরে,’ বলল রানা। ‘আপাতত বিপদের আশঙ্কা করছি না। অবশ্য, ফ্রেঞ্চ টিম যদি কোর স্যাম্পলটা ফেরত না দিয়ে মারামারি বাধিয়ে দেয়, তা হলে ভিন্ন কথা।’
‘ফরাসিরা অত মারমুখো হয় না,’ হাসল লামিয়া। ‘আমরা নিরাপদ।’
কটেজের সারির দিকে তাকাল রানা। ‘কোন্ বাড়িটা?’
‘এসো আমার সঙ্গে।’
ঘুরে হাঁটতে শুরু করল লামিয়া। রানা লক্ষ করল, পেভমেন্ট ছেড়ে রাস্তার ধারের ঘাসে নেমে গেছে সে। খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বোধহয়।
‘এক জোড়া জুতো দরকার তোমার।’
‘উঁহু,’ দুষ্টুমিমাখা গলায় বলল মেয়েটা, ‘বরং তুমিও জুতো খুলে ফেলো। চলো, সৈকতে চলে যাই। খালি পায়ে বালিতে হাঁটতে দারুণ মজা।’
‘হাতের কাজ সেরে নাহয় সে-কথা ভাবা যাবে,’ বলল রানা।
একটু পরেই হলুদ রঙের একটা কটেজের সামনে পৌঁছুল দু’জনে। লামিয়া বলল, ‘এটাই।’
দরজায় টোকা দিল রানা। একবার… দু’বার। নীরবে কেটে গেল কিছুটা সময়। কেউ সাড়া দিল না।
কোন আলো নেই বাড়ির ভেতরে। বারান্দার বাতিটা পর্যন্ত জ্বলছে না।
‘এটাই তো?’ নিশ্চিত হবার জন্যে জিজ্ঞেস করল রানা। ‘এখানেই গত রাতে পার্টি করেছে ওরা,’ লামিয়া জানাল। ‘আমরা অনেকেই এসেছিলাম।’
আবার দরজায় টোকা দিল রানা, আগের চেয়ে জোরে। সাড়া না পেয়ে ধাম ধাম করে কয়েকটা কিল বসাল পাল্লায়। তাও জবাব দিল না কেউ। অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করল ও, প্রতিবার কিল মারার সময় মিটমিট করে উঠছে বারান্দার বাতিটা—জ্বলতে গিয়েও জ্বলছে না।
‘মানে কী!’ বিড়বিড় করল ও। সন্দেহ হচ্ছে। ঘুরে এগিয়ে গেল বাতিটার দিকে। নিচে দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্পর্শ করল বালবটা। লুজ হয়ে আছে। প্যাচ দিতেই জ্বলে উঠল। হোল্ডারে ওটা শক্ত করে আটকে দিল।
‘হঠাৎ ইলেকট্রিশিয়ান হয়ে উঠলে কেন?’ বাঁকা গলায় প্রশ্ন করল লামিয়া।
হাত তুলে ওকে চুপ থাকার ইশারা করল রানা। দরজার সামনে ফিরে হাঁটু গেড়ে বসল। খুঁটিয়ে দেখল ডোরনবটা। তালার চারপাশে আঁচড়ের দাগ দেখতে পেল। কুডাক শুনতে পেল মনের ভেতর।
‘কী দেখছ?’ অধৈর্য গলায় জানতে চাইল লামিয়া।
‘জোর খাটিয়ে ভাঙা হয়েছে তালাটা,’ বলল রানা। ‘তার আগে বারান্দার বাতিটা অচল করে নেয়া হয়েছিল, যাতে দূর থেকে কেউ দেখতে না পায়। সিঁধেল চোরদের পুরনো কৌশল।’
দরজার হাতল ঘোরাল ও। নাহ্, খোলা নেই। কাজশেষে আবার আটকে দেয়া হয়েছে তালা। বাড়ির একপাশ ঘুরে পেছনদিকে চলল ও, লামিয়া পিছু নিল ওর।
‘তোমার আসার দরকার নেই,’ বলল রানা। ‘এখানেই থাকো।’
‘মাথা খারাপ? তোমাকে একা ছাড়ছি না আমি।’
তর্ক করার সময় নেই। শ্রাগ করে হাঁটতে থাকল রানা।। বোগেনভিলিয়ার একটা ঝোপ পেরিয়ে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনে। চওড়া একটা সানডেক দেখা গেল ওখানে। চারপাশে নিচু রেলিং। এক লাফে ডেকে উঠে পড়ল ও, লামিয়াকেও উঠতে সাহায্য করল। দু’জনে এগিয়ে গেল স্লাইডিং গ্লাস ডোরের দিকে। স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না।
মাত্র তিন সেকেণ্ড লাগল রানার দরজাটার তালা খুলতে। লামিয়া বিস্মিত গলায় বলল, ‘সত্যি করে বলো, তুমি নিজেই কখনও সিঁধেল চোর ছিলে না তো?’
‘সব রহস্য এখুনি ফাঁস করা ঠিক হবে না,’ চোখ টিপে বলল রানা। ‘তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি ভেতরে যাচ্ছি।’
‘কেউ যদি আবার তোমার গলা টিপে ধরে? আমি না থাকলে কে বাঁচাবে তোমাকে?’
অস্ফুট একটা আওয়াজ করল রানা—এ-মেয়ে দেখি খোঁটা দেয়ার ওস্তাদ! হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে ইশারা করল পেছনে থাকতে। দরজা খুলে দু’জনে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর।
চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল, তারপরেই রানা টের পেল, ভেতরে গোলমাল আছে। পুরো বাড়িই লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
হঠাৎ কেঁপে উঠল লামিয়া, কাতরে উঠল নিচু স্বরে, বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। রানাও তাড়াতাড়ি বসল। ‘কী হয়েছে?’
‘কাঁচ,’ বলল লামিয়া।
মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাঁচ, তারই একটা টুকরো বিঁধে গেছে ওর পায়ে। উহ্-আহ্ করতে করতে সাবধানে ওটা দু’আঙুলে টেনে বের করল।
‘দু’মিনিট সময় দাও আমাকে। দেখি কী করা যায়।’ উঠে পড়ল রানা।
এবার আর আপত্তি করল না লামিয়া। বসে রইল। দ্রুত পা চালাল রানা। ঘুরে এল পুরো কটেজ। যখন ফিরল, ওর চেহারায় মেঘ জমেছে। লুকোচুরির প্রয়োজন দেখছে না আর, তাই জ্বেলে দিল লিভিং রুমের বাতি। এবার পরিষ্কার দেখা গেল ঘরটার অভ্যন্তর। যেন ঝড় বয়ে গেছে। উল্টে রয়েছে সোফা, সব কেবিনেট খোলা, ভেতরের সবকিছু বের করে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে মেঝেতে। আছাড় মেরে ভাঙা হয়েছে একটা কাঁচের ল্যাম্প, সেটার ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে।
এক জোড়া স্যাণ্ডেল নিয়ে এসেছে রানা, বাড়িয়ে ধরল লামিয়ার দিকে। বলল, ‘পরে ফেলো। আমি পুলিশে ফোন করছি।’
‘পুলিশ?’ ভুরু কোঁচকাল লামিয়া।
‘হ্যাঁ,’ সংক্ষেপে বলল রানা। ব্যাখ্যা করতে গেল না। ফোনটা খুঁজে বের করল রানা, রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। ডায়াল টোন নেই। কানেকশন চেক করল। তারটা টান দিয়ে খুলে আনা হয়েছে দেয়াল থেকে। ভেঙে গেছে জ্যাক। আরেকটা কানেকশন পয়েন্ট খুঁজে বের করা দরকার। টেলিফোন সেটটা হাতে নিয়ে কিচেনের দিকে রওনা হলো। পেছন পেছন এল লামিয়া।
‘কী ঘটেছে এখানে?’ জানতে চাইল সে।
‘বড় গলায় বড়াই করার কুফল।’
কিচেনের কাউন্টারের পাশে আরেকটা পয়েন্ট পাওয়া গেল, ওটায় কানেকশন দিল রানা। এবার কাজ করছে ফোন। পুলিশের নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশে রিং বাজতে শুরু করেছে, এমন সময় লামিয়ার ওপর নজর গেল ওর। কিচেনের লাগোয়া একটা কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাতির সুইচের দিকে।
‘থামো!’ চেঁচিয়ে উঠল রানা।
তার আগেই সুইচ টিপে দিয়েছে মেয়েটা। পরক্ষণে আঁতকে ওঠার মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে। ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল, চেহারা দেখে মনে হলো, জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে এক্ষুণি। টেলিফোন ফেলে ওর কাছে ছুটে গেল রানা। জড়িয়ে ধরল দু’হাতে।
‘ভয়ঙ্কর…’ ফুঁপিয়ে উঠে রানার বুকে মাথা গুঁজল লামিয়া। ‘কী ভয়ঙ্কর!’
‘সরি,’ নরম গলায় বলল রানা। ‘আমি চাইনি এ-দৃশ্য তুমি দেখো।’
সত্যিই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। পুরো ফরাসি টিমকে খুন করা হয়েছে, প্রাণহীন দেহগুলো নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে ফেলে দেয়া জঞ্জালের মত। একজনের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে গুলিতে, আরেকজনের গলায় দাগ দেখে মনে হলো গলা টিপে মারা হয়েছে। বাকি দুটো লাশের অবস্থা আরও খারাপ, রক্তের পুকুরের মাঝে পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন লাশগুলো। এদের মাঝে একজনকে চেনে রানা, তাকে গতকাল সাগরের তলা থেকে উঠিয়ে এনেছিল ও আর মুরল্যাণ্ড।
এখনও ফোঁপাচ্ছে লামিয়া। মৃত্যুর এমন বীভৎস রূপ আগে কখনও দেখেনি বেচারি। জড়ানো গলায় জানতে চাইল, ‘কীভাবে করল… কেউ কিছু টের পেল না কেন?’
‘প্রফেশনাল লোকের কাজ,’ অনুমান করল রানা। ‘একা না, দল বেঁধে এসেছিল। পিস্তলের সঙ্গে সাপ্রেসর ব্যবহার করেছে, কাজও করেছে খুব দ্রুত। নিঃশব্দে।’
‘কিন্তু কেন? কেন এভাবে খুন করল ওদেরকে?’
‘নিশ্চয়ই কোর স্যাম্পলটার জন্যে। জিনিসটা খুব দামি, পর্তুগাল আর স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ বাধতে চলেছে ওটার মালিকানা নিয়ে। আর এরা কিনা…’ মাথা নাড়ল রানা। ‘বোকা, একেবারেই বোকা। চুরি করেছে ভাল কথা, কিন্তু আগ বাড়িয়ে সেটা সবাইকে বলে বেড়ানো একদম উচিত হয়নি।’
লামিয়া একটু শান্ত হলে আবার পুলিশে ফোন করল রানা। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা হলো। খুব শীঘ্রি করোনার-সহ লোক পাঠাবে বলে জানাল সে। তাদের জন্যে অপেক্ষা করার ফাঁকে বাড়ির ভেতর তল্লাশি চালাল ও। জানে, পাবে না; তাও খুঁজল কোর স্যাম্পলটা। ওটা রাখার মত বাক্স পাওয়া গেল একটা কামরায়-খালি। রহস্যময় ঘাতকেরা জিনিসটা নিয়ে গেছে।
পনেরো মিনিটের ভেতর হাজির হলো পুলিশ। তাদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটাতে হলো লামিয়া আর রানাকে। জবানবন্দি দিতে হলো, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হলো… এরপর নিজেদের ঠিকানা লিখিয়ে ছাড়া পেল ওরা।
সৈকতের ধারে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে। লামিয়া জানতে চাইল, ‘এখন কী করবে?’
‘জাহাজে ফিরব,’ বলল রানা। ‘ওদেরকে একটা খবর পাঠালেই…’ বাক্যটা শেষ করল না। চোখ চলে গেছে বন্দরের দিকে।
‘আমার বোটে একটা রেডিও সেট আছে,’ বলল লামিয়া। ‘চাইলে ওটা ব্যবহার করতে পারো।’
‘তার বোধহয় প্রয়োজন হবে না। ওই দেখো।’
রানার ইশারায় এবার ও-ও বন্দরের দিকে তাকাল। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে একটা আকাশি নীল রঙের জাহাজ।
‘ওটাই আমার জাহাজ,’ বলল রানা। বুঝতে পারছে না, নেপচুন হঠাৎ বন্দরে ফিরে এসেছে কেন। বেশি ভাবতে পারল না, একটা মিনিভ্যান এসে থামল ওদের পেছনে।
‘যাবেন এখন?’
ঘুরে দাঁড়াতেই ড্রাইভারের হাসিমাখা মুখ দেখতে পেল রানা। অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি আছেন এখনও?’
‘আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছি, কী করে চলে যাই, বলুন? ভেবেছেন পুলিশ দেখে আমি ঘাবড়ানোর লোক?’
‘একশো ডলারের লোভ ছিল না?’
‘মানুষ হয়ে জন্মেছি, লোভ-টোভ তো একটু থাকবেই।’ হেসে ফেলল রানা। ‘এই সত্য কথাটা বলার জন্যে
আরও পঞ্চাশ ডলার বাড়তি পাওনা হলো আপনার। চলুন… বন্দরে নিয়ে চলুন আমাদের।’