পঁচিশ
নুমা হেডকোয়ার্টারের সবচেয়ে ওপরের তলায় অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের অফিস। ওখানকার প্রশস্ত জানালা দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি-র একটা বড় অংশ দৃষ্টিগোচর হয়—দেখা যায় পটোম্যাক নদী, লিঙ্কন আর ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, এমনকী ক্যাপিটল হিলের বিশাল বিল্ডিংটাও। সময়টা সন্ধ্যা। কৃত্রিম আলোয় এখন ঝলমল করছে মনুমেন্ট ও দালান সব। দৃশ্যটা সুন্দর, তবে অ্যাডমিরাল এ-মুহূর্তে ওদিকে তাকাচ্ছেন না। তাঁর মনোযোগ কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটা ভিডিও কনফারেন্স চলছে ওতে। পর্দার একপাশে ফুটে উঠেছে তানিয়া রেজার চেহারা, আরেক পাশে দেখা যাচ্ছে নুমার কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ল্যারি কিংকে।
ক্লান্ত দেখাচ্ছে তানিয়াকে, তারপরেও নিজের দায়িত্ব পালন করছে নিষ্ঠার সঙ্গে। আরাতামা মারু থেকে পাওয়া স্যাম্পলগুলো বিশ্লেষণ করে যা যা পেয়েছে, তা ব্যাখ্যা করছে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আর ল্যারি কিঙের কাছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন অ্যাডমিরাল, তার উত্তর দিচ্ছে ধৈর্যের সঙ্গে। ল্যারি সব নোট করে নিচ্ছে, কদাচিৎ হুঁ-হাঁ ছাড়া কোনও আওয়াজ বেরুচ্ছে না তার মুখ দিয়ে।
তানিয়ার কথা শেষ হলে ল্যারির দিকে ফিরলেন অ্যাডমিরাল। ‘যা যা শুনলে, তার ওপর ভিত্তি করে একটা সিমুলেশন দাঁড় করাতে পারবে?’
‘আশা করি,’ বলল ল্যারি। ‘একেবারে নিখুঁত হয়তো হবে না, তবে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া যাবে।’
‘মোটামুটিতে চলবে না আমার, ল্যারি,’ বললেন অ্যাডমিরাল।
‘বুঝতে পারছি। কিন্তু খুব বেশি তথ্য নেই আমাদের হাতে। কী ধরনের শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, আর কাজটা কীভাবে করা হয়েছে… এতটুকু হয়তো জানাতে পারব। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইলে আরও ডেটা লাগবে।’
‘কাজ শুরু করো,’ নির্দেশ দিলেন অ্যাডমিরাল। ‘আমার ধারণা, খুব শীঘ্রি আরও ডেটা পাওয়া যাবে। এ-পর্যন্ত যা দেখেছি, তা কেবল শুরু। জল আরও অনেকদূর গড়াবে।’
‘জী, অ্যাডমিরাল।’
কানেকশন কেটে দিল ল্যারি। স্ক্রিনে শুধু তানিয়া রইল। তার দিকে তাকালেন হ্যামিলটন। ‘কেমন আছ জানতে চাইব না,’ বললেন তিনি। তবে এ-অবস্থাতেও যা করছ, তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
ধন্যবাদ আসলে আমারই জানানো উচিত, অ্যাডমিরাল,’ বলল তানিয়া। ‘আপনিই তো আদেশ দিয়েছেন স্যাম্পলগুলো স্টাডি করতে। তাতে বেশ উপকার হয়েছে আমার… নিজেকে ফিরে পেয়েছি।’
বিভ্রান্তি ফুটল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের চোখে। ‘কই, আমি তো অমন কিছু বলিনি!’
‘সে কী! তা হলে ডা. ডওসন যে বললেন…’
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবার হাসি ফুটল অ্যাডমিরালের ঠোঁটে। ‘ডওসন অনেক উঁচু দরের ডাক্তার। জানে, কী বললে তোমার মনোযোগ অন্য দিকে ফেরানো যাবে। ওটা ছিল তোমার ট্রিটমেন্টেরই একটা অংশ।’
তানিয়াও হেসে ফেলল। ‘রাগ করব, না খুশি হব, বুঝতে পারছি না।’
‘যা হোক,’ আবার সিরিয়াস হলেন অ্যাডমিরাল, ‘কেউ যদি সত্যিই অমন একটা অস্ত্র আবিষ্কার করে থাকে, তা হলে ওটা আবারও ব্যবহার করার আগে সেটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে। তোমাদেরকে ধন্যবাদ, সময় থাকতেই ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে পেরেছ বলে।’
‘কিন্তু কারা এই অস্ত্র তৈরি করেছে, তার কিছুই জানি না আমরা।’
‘এটা একটা সমস্যা, স্বীকার করলেন অ্যাডমিরাল। ‘ওদের পরিচয় জানা না গেলে কোনও অ্যাকশনে যাওয়া যাবে না। সে-ধরনের কোনও আদেশ দেবার আগে প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই বিস্তারিত জানতে চাইবেন।’ তানিয়ার দিকে সাগ্রহে তাকালেন তিনি। ‘কোনও আইডিয়া দিতে পারো? মানে… কীভাবে এদেরকে খুঁজে বের করা যায়?’
কপালের ওপর থেকে চুলের গোছা সরাল তানিয়া। বলল, ‘একটা ব্যাপার নিয়ে আমি ভাবছি। ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক বার্স্টের পর আরাতামা মারুর যেসব ক্রু বেঁচে গিয়েছিল, তাদের খুন করা হলো। কেন? ‘
‘সিম্পল, ওরা কোনও সাক্ষী রাখতে চায়নি, ‘অনুমান করলেন অ্যাডমিরাল। ‘সবাইকে মেরে জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে তাই।’
‘কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন, ওদের কাছে টর্পেডো আছে। গ্রুপারের দিকে ছুঁড়েছিল। তারমানে, চাইলে জাপানি জাহাজটাকেও টর্পেডো দিয়েই ডুবিয়ে দিতে পারত।’
চিন্তায় পড়ে গেলেন অ্যাডমিরাল। কথাটা ঠিক। নিচু গলায় বললেন, ‘হুম, মার্সেনারি পাঠানোর চেয়ে সহজ হতো সেটা।’
‘কাজটা সারাও যেত দ্রুত।’
‘রাইট। তা হলে সেটাই করল না কেন?’
‘আরেকটা প্রশ্ন আছে। ওই বিশেষ জাহাজটাতেই হামলা করা হলো কেন?’
এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। অ্যাডমিরাল বললেন, ‘জাহাজে কিছু ছিল। এমন কিছু, যেটা জাহাজ ডুবিয়ে দেবার আগে নামিয়ে নেয়া জরুরি ছিল। আর ওই জিনিস যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সেটা কাউকে জানতে দিতে চায়নি ওরা।’
পর্দায় মাথা ঝাঁকাল তানিয়া। ‘আমিও ঠিক এই কথাই ভাবছি।’
কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে এতে। মিতসুকি শিপিঙের সিইও শিনজিরো হায়াশি অ্যাডমিরালের বন্ধুস্থানীয় মানুষ, কয়েক বছর আগে একটা বড় ধরনের বিপদে তাকে সাহায্য করেছিলেন তিনি। এতটাই কৃতজ্ঞ হয়েছিল হায়াশি, কথা দিয়েছিল, যে-কোনও প্রয়োজনে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আর নুমাকে সব ধরনের সাহায্য করবে। সেই লোকই হঠাৎ করে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছে। আরাতামা মারু ডুবে যাবার পর পরই তাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন অ্যাডমিরাল, এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করেনি সে। নুমা থেকে দু’জন লোকও পাঠিয়েছিলেন তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। দেখা তো করেইনি, বরং ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ওদেরকে তাড়ানো হয়েছে মিতসুকির অফিস থেকে। কিছু একটা গোলমাল আছে, তা বুঝতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন নেই।
‘জাহাজটা কী কার্গো বহন করছিল, তা জানতে হবে আমাদেরকে,’ বলল তানিয়া। .
ওর কথায় সায় দিলেন অ্যাডমিরাল। জানেন, কী করতে হবে। তাঁকেই এবার নামতে হবে মাঠে।