1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ১৪

চোদ্দ

সায়েন্স মিনিস্ট্রি-বিল্ডিঙের সামনের সিঁড়ি ভেঙে চপলা হরিণীর মত তরতর করে উঠছে লামিয়া লিভানোভা। লাঞ্চ সেরে এসেছে মস্কোর অপূর্ব সুন্দর একটা পার্ক থেকে। জুন মাসের রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, তাপমাত্রা বিরাশি ডিগ্রি। চমৎকার একটা আবহাওয়া বিরাজ করছে রাশার ঐতিহ্যবাহী রাজধানীতে। বিশ্বাস করা কঠিন যে, আর তিনটে মাস পরেই তুষার শুরু হয়ে যাবে, পুরু সাদা চাদরে ঢেকে যাবে সব। তাপমাত্রা নেমে যাবে শূন্যের বিশ ডিগ্রি নিচে, বাইরে হাঁটাচলাই কঠিন হয়ে উঠবে।

যখন যতটা পারা যায় উপভোগ করে নাও, নিজেকে বলল সে।

ছিপছিপে গড়ন লামিয়ার, শরীর অ্যাথলিটের মত। খুব সুন্দরী বলা যাবে না, কিন্তু কী যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ রয়েছে ওর মাঝে। চোখ জুড়িয়ে যায় গায়ের রঙ দেখলে, মখমলের মত মসৃণ ত্বক। মাথায় মেহগনি রঙের চুল, আধুনিক ফ্যাশনে চোয়াল বরাবর কোনাকুনি করে কাটা। চুলের গোছা মাঝে মাঝেই ঢেকে দিচ্ছে মুখের একাংশ, ঢাকা পড়ছে একটা চোখ। কমনীয় চেহারা, কিন্তু কোমলতার চেয়ে কাঠিন্যই যেন বেশি। তার থুতনি সামান্য চৌকো, এবং একটু যেন শক্ত—সৌন্দর্য নিখুঁত হবার পথে ছোটখাট হলেও একটা বাধা বটে। প্রথম দেখায় তাকে বিজ্ঞানী বলে মনে হয় না, মনে হয় কোনও কলেজ-পড়ুয়া তরুণী।

বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, সম্প্রতি অ্যাডভান্সড এনার্জি সিস্টেমের ওপর ডক্টরেট করেছে লামিয়া। বর্তমানে বিজ্ঞান পরিদপ্তরের পুরোদস্তুর সদস্য। একটা টিমের সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি নিয়ে কাজ করছে—ওদের দায়িত্ব, কখনও তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস ফুরিয়ে গেলে রাশা কীভাবে চলবে, তার রূপরেখা তৈরি করা। অবশ্য আগামী পঞ্চাশ থেকে একশো বছরের ভেতরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই গবেষণাও চলছে ঢিমেতালে।

একদিক থেকে এটা ভাল। কেউ বিরক্ত করে না, নাক গলায় না ওদের কাজে। ওদের গ্রুপটা বিজ্ঞান পরিদপ্তরের সবচেয়ে ঢিলেঢালা গ্রুপগুলোর একটা, যারা স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে পারছে। বিজ্ঞানসাধনার জন্যেই করতে পারছে গবেষণা, সরকারের কোনও এজেণ্ডা বাস্তবায়নের জন্যে নয়।

ব্যাপারটা ভাল লাগে লামিয়ার। কোনও অস্ত্র তৈরি করতে হচ্ছে না ওকে। বানাতে হচ্ছে না বায়ু, পানি বা মাটি দূষণকারী কোনও যন্ত্র। কাজ করতে হচ্ছে না এমন কোনও কর্পোরেশনের জন্যে, যারা ওর কাজের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামাবে, কিন্তু বিনিময়ে সমাজকে কিছুই দেবে না। কাজের মধ্যে এক ধরনের স্বাধীনতা আছে ওর, রয়েছে নির্মলতা। কিন্তু তারপরেও, সত্যি বলতে কী, মাঝে মাঝে একঘেয়েমি পেয়ে বসে ওকে। নতুন কিছু করার জন্য উতলা হয় মন। সেই ইচ্ছে যে আজই পূর্ণ হতে চলেছে, তা কল্পনা করতে পারেনি।

অফিসে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল ও। কালো সুট পরা অচেনা দু’জন লোক অপেক্ষা করছে সেখানে। থ্যাবড়া চেহারার একজন দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের কাছে; মোটাসোটা, টাকমাথার আরেকজন বসে আছে ওরই ডেস্কে।

‘বসুন, ড. লিভানোভা,’ ওকে দেখতে পেয়ে বলল মোটা লোকটা।

‘আপনারা কারা?’ জিজ্ঞেস করল লামিয়া। ‘আমার অফিসে কী করছেন?’

‘আমরা সরকারি লোক,’ সংক্ষেপে জানানো হলো। অশুভ শোনাল মোটা লোকটার গলা।

লক্ষণ ভাল নয়।

অতিথির চেয়ারে বসল লামিয়া। অস্বস্তি বোধ করছে।

‘আপনি তো ড. লামিয়া লিভানোভা, তাই না?’ বলল মোটা লোকটা। ইশারা করল সঙ্গীর দিকে। ‘এ হচ্ছে মেজর ইভান রাবিনোভিচ।’

অপেক্ষা করছে লামিয়া, কিন্তু নিজের নাম বলল না মোটা লোকটা। বুক কাঁপছে ওর। আধুনিক রাশাতেও সরকারি এজেন্টরা ভয়ের প্রতীক, অনুন্নত দেশের পুলিশের মত। কেন এসেছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। আদর্শ নাগরিক ও, নিয়মিত ট্যাক্স দেয়। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব নেই, কখনও কোনও অপরাধ করেনি। বেশ কয়েক বছর আগে স্কেটার হিসেবে উইন্টার অলিম্পিকসে প্রতিনিধিত্বও করেছে দেশের। গোড়ালির সমস্যার কারণে পদক পায়নি, চতুর্থ হয়েছিল।

‘কী চান আপনারা?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল ও। ‘আমি তো কিছু করিনি।’

ওর কথা কানে তুলল না মোটা লোকটা। বলল, ‘আপনার ভাই তো প্যারাট্রুপার ছিল?’

‘হ্যাঁ। দু’বছর আগে মারা গেছে ও।’

‘দুঃখজনক। দেশভক্ত সৈনিক ছিল সে। দেশের সেবায় উৎসর্গ করেছিল নিজেকে।’

লামিয়া লক্ষ করল, কথাটা যথেষ্ট সম্মান দিয়ে বলা হলো।

সামনে ঝুঁকল লোকটা। ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমরা জানি, আপনিও দেশভক্ত। আর দেশ চায়, আপনি কিছু করুন মাতৃভূমির জন্যে।’

ধুকপুকানি একটু কমল লামিয়ার। ‘আমি সামান্য এক বিজ্ঞানী, খুবই জুনিয়র। যা করছি তার বাইরে কী-ই বা করতে পারি আমি?’

‘এমন কিছু, যেটা করার জন্যে আপনার ব্যাকগ্রাউণ্ড, ক্রীড়াদক্ষতা আর পুরনো খ্যাতি কাজে লাগবে।’

ডেস্কের ওপর দিয়ে একটা ফোল্ডার ঠেলে দিল মোটা লোকটা। নড়ল না লামিয়া।

‘স্কুবা ডাইভিং জানেন আপনি,’ বলল লোকটা। ‘প্রতি গ্রীষ্মে কৃষ্ণসাগরে যান, ডুব দেবার জন্যে।’

কথাটা সত্যি। ডাইভিঙের শখ আছে লামিয়ার। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল, ‘জী।’

‘গুড। তা হলে আপনাকে দিয়েই হবে। ফোল্ডারটা খুলুন।’

মলাট উল্টে ভেতরে উঁকি দিল লামিয়া। ছোট ছোট দ্বীপের অনেকগুলো ছবি দেখতে পেল। সেই সঙ্গে আছে বেশ কিছু খবরের কাগজের কাটিং। আচমকাই বুঝতে পারল, কীসের ফোল্ডার এটা। অ্যাযোর্সে ক’দিন আগে অদ্ভুত একটা মিনারেল আবিষ্কৃত হয়েছে… এ-নিয়ে ওদের গ্রুপেও প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ফোল্ডারে সেসব তথ্যই সাজিয়ে রাখা।

‘ওখানে আপনাকে পাঠাতে চাইছি আমরা,’ বলল মোটা লোকটা।

প্রস্তাবটা খারাপ লাগল না লামিয়ার। সুনীল সাগর, বালিময় সৈকত আর রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ—উপভোগ্যই হবার কথা। জানতে চাইল, ‘আবিষ্কারটা যাচাই করার জন্যে?’

‘হ্যাঁ। মানে… ওপর থেকে ব্যাপারটা সেরকমই যেন দেখায়।’

‘আর ভেতর থেকে? কী করতে হবে আমাকে?’

‘ফোল্ডারের শেষে যান।’

সাদাকালো কয়েকটা ছবি পাওয়া গেল ওখানে। প্রথমটা মাঝবয়েসী এক লোকের। গায়ে পুরনো ধাঁচের পোশাক, ছবিটাও বেশ পুরনো—কাগজ হলদে হয়ে গেছে, কিনারাগুলো হয়ে উঠেছে লালচে। দ্বিতীয় ছবিতে স্টেইনলেস স্টিলের দুটো ট্রাঙ্ক দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় ছবিটা প্রপেলার চালিত একটা রূপালি রঙের বিমানের—ট্রিপল টেইলটা ওর নজর কাড়ল।

‘ছবিতে যাকে দেখছেন, তার নাম স্তেফান কিরিলভ, ‘ বলল মোটা লোকটা। ‘রেড আর্মির প্রাক্তন সৈনিক, রাজতন্ত্র অবসানের লড়াইয়ের গর্বিত যোদ্ধা। দুর্ভাগ্যক্রমে, ১৯৫১ সালে আমাদের সঙ্গে বেঈমানি করে সে।’

‘কী করেছিল?’ ছবিতে আটকে আছে লামিয়ার চোখ। কিরিলভকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন ক্লান্ত মানুষের মত দেখাচ্ছে।

‘সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পদ চুরি করে আমেরিকায় চলে যেতে চেয়েছিল। সেই সম্পদের বৈধ উত্তরাধিকারী আসলে রাশা।’

‘কী ধরনের সম্পদ?’

মোটা লোকটার শীতল দৃষ্টি দেখে মনে হলো, প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। ক্ষমা চাইবে কি না ভাবল লামিয়া, কিন্তু তার আগেই লোকটা বলল, ‘রোমানভ পরিবারের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানা আছে আপনার?’

‘রোমানভ? মানে, জার দ্বিতীয় নিকোলাসের কথা বলছেন?’ মাথা ঝাঁকাল লোকটা।

‘জী, জানি,’ লামিয়া বলল। ‘সিংহাসনচ্যুত হবার পর ১৯১৮ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় তাঁকে। রানি আলেকজান্দ্রা, ছেলে আলেক্সি, চার মেয়ে ওলগা, তাতিয়ানা, মারিয়া এবং আনাস্তাসিয়া… সবাই নিহত হয়। অবশ্য গুজব আছে যে, গ্র্যাণ্ড ডাচেস আনাস্তাসিয়া অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। তার লাশ পাওয়া যায়নি রোমানভদের কবরে। পরে বেশ কিছু নারী নিজেকে আনাস্তাসিয়া বলে দাবি করেছিল।’

‘মিথ্যে দাবি,’ বলল মোটা লোকটা। ‘একটাও সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। আসল আনাস্তাসিয়া পরিবারের বাকিদের সঙ্গেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু আলেক্সি-সহ তার লাশটা কবর দেয়া হয়েছিল ভিন্ন জায়গায়। ইচ্ছে করেই ছড়ানো হয়েছিল বেঁচে থাকার গুজব, যাতে জারের সমর্থকেরা সামান্য আশার আলো পায়, সবাইকে খুন করা হয়েছে শুনে খেপে না ওঠে। সেই কবর কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে আলেক্সি আর আনাস্তাসিয়ার পরিচয়ও নিশ্চিত করেছি আমরা।’

‘এসবের সঙ্গে একটা আমেরিকান বিমানের কী সম্পর্ক?’

‘ধৈর্য ধরে শুনুন, তা হলেই জানতে পারবেন। মৃত্যুদণ্ডের আগ পর্যন্ত একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে ছিল রোমানভ পরিবার—ভেবেছিল ঘুষ-টুষ দিয়ে পার পেয়ে যাবে। আপনি কি জানেন, ফায়ারিং স্কোয়াড যখন তাদেরকে গুলি করে, প্রথম… এমনকী দ্বিতীয় দফাতেও অনেকে মারা যায়নি?’

গল্পটা শুনেছে লামিয়া। বলল, ‘হ্যাঁ। পোশাকের ভেতর দামি দামি পাথর আর স্বর্ণের পাত সেলাই করে রাখা ছিল তাদের, সেগুলোই ঠেকিয়েছিল বুলেট।’

হাসির শব্দ হলো। মেজর রাবিনোভিচ বলল, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে দামি বুলেটপ্রুফ পোশাক।’

‘ঠিক,’ একমত হলো মোটা লোকটা। ‘এনিওয়ে, পরে মাথায় গুলি করে এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় প্রত্যেককে। তবে স্বাভাবিকভাবেই ফায়ারিঙের সঙ্গে জড়িত সৈনিকেরা বোকা বনে গিয়েছিল। সবাই জানত, জারের সমস্ত ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; তা হলে পোশাকে লুকানো ওই সোনাদানা এল কোত্থেকে? শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। শেষ পর্যন্ত রোমানভদের এক ভৃত্যকে প্রাণভিক্ষার বিনিময়ে দলে টানা হলো। জারের লুকিয়ে রাখা দুটো ট্রাঙ্কের সন্ধান দিল সে—দামি রত্ন আর স্বর্ণমুদ্রায় ভরা দুটো ট্রাঙ্ক। কিন্তু বলশেভিকদের হাতে পৌছুবার আগেই উধাও হয়ে গেল ট্রাঙ্কদুটো। আসলে উদ্ধারের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন সৈনিকই চুরি করেছিল ওগুলো… লুকিয়ে ফেলেছিল। ত্রিশ বছর পর সেই সৈনিকদেরই একজন গোপন জায়গা থেকে বের করে আনে ট্রাঙ্কদুটো, সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে।

‘কিরিলভ?’ এবার বুঝতে পারছে লামিয়া।

ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মোটা লোকটা। ‘কিরিলভের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল আমেরিকা, কিন্তু যতক্ষণ না সে আমেরিকার মাটিতে পৌঁছচ্ছে, অফিশিয়ালি কিছু করার উপায় ছিল না তাদের। সমস্যাটা মেটানোর জন্যে টমাস মার্লো নামে এক ফ্রিল্যান্স এজেন্টকে পাঠায় তারা। ছবির বিমানটা ওরই। সারায়েভো থেকে কিরিলভকে তুলে নেয় সে, রাতের আঁধারে ইয়োরোপ ত্যাগ করে।’

‘এর সঙ্গে অ্যাযোর্সের কানেকশন কোথায়?’

নিঃশব্দে হাসল মোটা লোকটা, হিংস্র দেখাল তার চেহারা। ‘সারায়েভো থেকে সরাসরি আমেরিকায় যাবার উপায় ছিল না মার্লোর। বিমানের রেঞ্জ ছিল না।’

সেজন্যে অ্যাযোর্সে গিয়েছিল সে?’

‘ঠিক ধরেছেন। আমাদের বেশিরভাগ লোকজন যখন বোকার মত প্যারিস, মাদ্রিদ আর লণ্ডনের আকাশে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; বুদ্ধিমান কেউ একজন ধারণা করল যে, অপ্রত্যাশিত কোনও জায়গায় বিমানটা যেতে পারে—আমেরিকার কোনও মিত্রশক্তির এলাকা, যেটা বিমানের স্বাভাবিক গতিপথে পড়ে না। সান্তা মারিয়া দ্বীপে আমাদের এজেণ্ট ছিল, তাকে মেসেজ দেয়া হলো। কয়েক ঘণ্টা পরেই খবর এল, মার্লোর রূপালি বিমানটা ল্যাণ্ড করেছে ওখানে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় তিনদিন ওখানে বসে রইল ওটা, আমরাও সুযোগ পেলাম একটা টিম পাঠাবার। বিমানের ওপর হামলা করে ওরা, কিরিলভ মারা যায় গুলি খেয়ে। তবে দুর্ভাগ্য যে, বিমান নিয়ে তার পর পরই উড়াল দেয় মার্লো, ঢুকে পড়ে ঝড়ের ভেতর।’

‘দুর্ভাগ্যজনক,’ মন্তব্য করল রাবিনোভিচ।

‘খুবই,’ বলল মোটা লোকটা। ‘যা হোক, আমেরিকায় পৌঁছুতে পারেনি মার্লো। অ্যাযোর্স থেকেই যেতে পারেনি বেশিদূর। টেকঅফ করার পর মাত্র ন’মিনিট টিকেছিল সে, এরপরেই রেডিওতে মেডে সিগনাল পাঠায়, বিমান-সহ ক্র্যাশ করে আটলান্টিকে। তবে মারা যায়নি, অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। কয়েকদিন পর পর্তুগিজ একটা মাছধরা ট্রলার তাকে উদ্ধার করে সাগর থেকে। দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে ইলেকট্রো- ম্যাগনেটিক ইণ্টারফেয়ারেন্সের এক অদ্ভুত গল্প শোনায় সে। বিমানের সব ইনস্ট্রুমেন্ট নাকি অচল হয়ে পড়েছিল, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার। গল্পটা, স্বভাবতই, আমরা বিশ্বাস করিনি।’

‘আপনাদের ধারণা, সে ক্র্যাশ করেনি?’

মৃদু হাসল মোটা লোকটা। লামিয়ার আগ্রহ জাগাতে পেরে সন্তুষ্ট।

‘দীর্ঘদিন গল্পটা মিথ্যে ভেবেছি আমরা,’ বলল সে। ‘হয় মার্লো মিথ্যে বলছে, কিংবা সিআইএ। বিমানটা খুঁজে বের করার কোনও চেষ্টা করেনি আমেরিকা, আমাদের খোঁজা- খুঁজিতেও কিছু বেরিয়ে আসেনি। মনে হচ্ছিল, ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্যে দারুণ একটা কৌশল খাটিয়েছে আমেরিকানরা। তবে এখন আমরা অন্য কিছু ভাবছি।’

‘কেন?’

কোটের ভেতর থেকে নতুন একটা ছবি বের করল মোটা লোকটা। বাড়িয়ে ধরল লামিয়ার দিকে। ‘এটা দেখুন।’

ডেস্কের ওপর রেখে ছবির ওপর চোখ বোলাল লামিয়া অস্পষ্ট, ঘোলা একটা ছবি। প্রথম দেখায় বুঝল না কী দেখছে। ভাল করে তাকাতেই চমকে উঠল। সাগরতলের পলিমাটি থেকে বেরিয়ে আসা তিনটে ফিন দেখতে পাচ্ছে এবার। সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে বাঁয়ে তাকাল, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হলো একটা ফিউযেলাযের কাঠামো। সাগরের নিচে পড়ে আছে ওটা।

‘টমাস মার্লোর বিমান,’ বলল মোটা লোকটা। ‘ছবিতে মোটামুটি অক্ষতই দেখাচ্ছে।’

‘অবিশ্বাস্য!’ রূদ্ধশ্বাসে বলল লামিয়া।

‘কোনও সন্দেহ নেই। এটার কারণেই অ্যাযোর্সে আপনাকে পাঠাতে চাই আমরা। অদ্ভুত ওই ম্যাগনেটিজম স্টাডি করার অজুহাতে যাবেন ওখানে, সুযোগ বুঝে ডাইভ দেবেন বিমানটায়। ট্রাঙ্কদুটো যদি এখনও ভেতরে থাকে, কিংবা কাছাকাছি কোথাও খুঁজে পান, আপনার দায়িত্ব হবে ওগুলো নিরাপদে রাশায় ফিরিয়ে আনা।

বিশাল একটা দায়িত্ব, মনে মনে স্বীকার করল লামিয়া। তাকে যে এ-কাজের জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছে, ‘এটাও সম্মানের ব্যাপার। কথা হলো, ওকেই কেন নির্বাচন করা হলো?

‘যদি কিছু মনে না করেন, একটা প্রশ্ন করি? কাজটার জন্যে আপনারা কোনও প্রফেশনাল এজেন্টকে পাঠাচ্ছেন না কেন?’

‘সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে আপনি পরিচিত মুখ,’ বলল মোটা লোকটা। ‘ইতিপূর্বে বহুবার বিদেশে গেছেন… প্রতিবারই যথাযথ বৈজ্ঞানিক কাজে।’ ছদ্মবেশী কোনও এজেন্টের বদলে আপনাকে পাঠানোর সুবিধে হলো, কেউ সন্দেহ করবে না। কাজটা নিরাপদে সারা যাবে।’

‘কিন্তু আমি যদি যেতে না চাই?’ সাবধানে জানতে চাইল লামিয়া।

দৃষ্টি কঠিন হলো মোটা লোকটার। লামিয়া টের পেল, মেজর রাবিনোভিচ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হুমকিটা পরিষ্কার—ওর মতামতের কোনও গুরুত্ব নেই এদের কাছে।

‘মানুষের মত পাল্টানোর জন্যে আমরা যথেষ্ট নিষ্ঠুর হতে পারি, ড. লিভানোভা,’ বলল মোটা লোকটা। ‘তবে আপনার ক্ষেত্রে তার কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। চেহারাই বলে দিচ্ছে, আপনি যেতে চান… চ্যালেঞ্জটা নিতে চান।’

ছবিগুলোর দিকে আবার তাকাল লামিয়া। ভয় আর উত্তেজনার এক মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে শরীরে। প্রতিযোগিতায় নামার আগে অ্যাড্রেনালিনের যে-আলোড়ন অনুভব করত, এ যেন অনেকটা তা-ই। জানে, প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবার কোনও উপায় নেই… এ-ও জানে, তার কোনও প্রয়োজনও নেই।

সত্যিই যেতে চাইছে ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *