দশ
মিতসুকি শিপিং কোম্পানির নিউ ইয়র্ক অফিসটা ম্যানহাটানের মিডটাউনে—কাঁচ আর ইস্পাতে তৈরি আধুনিক এক বিল্ডিঙের চারটে ফ্লোর নিয়ে। আন্তর্জাতিক মানের শিপিং কোম্পানি এই মিতসুকি, তাদের বহরে রয়েছে একশো সতেরোটা জাহাজ। এসব জাহাজ চব্বিশ ঘণ্টা ট্র্যাক করা হয় ছেচল্লিশ তলার একটা কন্ট্রোল রুম থেকে; সাতচল্লিশ তলায় রয়েছে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের জন্যে আপ্যায়নের ব্যবস্থা; আর অ্যাকাউন্টিং সংক্রান্ত সব কাজ সারা হয় আটচল্লিশ তলা থেকে। ফেং-শুই ডিজাইনে সজ্জিত ঊনপঞ্চাশ তলাটা ভিআইপি আর কর্পোরেট এগজিকিউটিভদের জন্যে বরাদ্দ। ক্লিনিং ক্রু-র আনাগোনা বাদে বছরের বেশিরভাগ সময় ফ্লোরটা খালিই থাকে।
এই সপ্তাহটা ব্যতিক্রম, কারণ মিতসুকির প্রেসিডেন্ট ও সিইও, শিনজিরো হায়াশি এসে উঠেছে ওখানে। তাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ফ্লোরটা, কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। প্রাথমিকভাবে নিউ ইয়র্কে এক মাস কাটাবার ইচ্ছে নিয়ে এসেছিল হায়াশি। উপভোগ করতে চেয়েছিল ব্রডওয়ে, নাইটলাইফ আর নগরের বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলো। কাজের তালিকায় ছিল স্টকব্রোকার আর সিকিউরিটিজ অ্যাণ্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিং। মাসশেষে নিউ ইয়র্কের স্টক একচেঞ্জে মিতসুকির তালিকাভুক্ত হবার ঘোষণা দেবার কথা তার। শেয়ার বিক্রি করে যে-পুঁজি পাওয়া যাবে, তা দিয়ে, কোম্পানির একটা আমেরিকান সাবসিডিয়ারি চালু করবে, আমেরিকা থেকে ইয়োরোপে পণ্য আনা-নেয়ার কাজ দেখাশোনা করবে ওটা।
হঠাৎ করেই বদলে গেছে পরিস্থিতি। সব কাজ শিকেয় উঠেছে হায়াশির, মিতসুকির মালিকানাধীন জাহাজ আরাতামা মারু ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে নানা ধরনের জটিলতা… গত এক সপ্তাহ ধরে সেগুলো মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাকে। এসব জটিলতা আরও বেড়ে গেছে দুটো কারণে। প্রথমত, সময়টা বড্ড বেকায়দা–বড় ধরনের একটা কর্পোরেট মুভের আগে ঘটল ঘটনাটা। পরের কারণটা ইনশিয়োরেন্স সংক্রান্ত। জাহাজটা সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাবার জন্যে নিবন্ধন করা হয়েছিল, ঘটনা ঘটেছে আফ্রিকা থেকে হংকঙে যাবার পথে। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি বেঁকে বসেছে, বলছে তাদের পলিসি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়… কোনও ক্ষতিপূরণ দেবে না।
হায়াশি জানে, এসব নিয়ে মাথা গরম করার কিছু নেই। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির সঙ্গে মিটমাট করে নেয়া সম্ভব-পাওনা টাকা থেকে খানিকটা ছাড় দিলেই মেনে নেবে ওরা। জাহাজডুবির কারণে শেয়ারের দামেও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। নিউ ইয়র্কের লোকজন কোথায় কোন্ জাহাজ ডুবল, তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এসব তো ঘটেই। কিন্তু আসল সমস্যা বেধেছে চিনা ক্লায়েন্টকে নিয়ে। হারানো কার্গোর পুরো দাম চাইছে সে। যথেষ্ট জটিলতা আছে এতে, মূল জটিলতা কার্গোর প্রকার নিয়ে।
জাপানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাপানি আইন মোতাবেক পরিচালিত হয় মিতসুকি। কিন্তু যেহেতু আমেরিকায় সাবসিডিয়ারি খুলতে চাইছে, আমেরিকান আইন মেনে চলতে হবে তাকে। সেই আইনে নির্দিষ্ট কিছু মালামাল এক দেশ থেকে আরেক দেশে পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, আরাতামা মারুর ম্যানিফেস্টে সে-ধরনের কার্গো ছিল।
এ-মুহূর্তে তথ্যটা কাউকে জানাতে চায় না হায়াশি। খবরটা আমেরিকান সরকারের কানে গেলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে। চিরতরে এ-দেশে মিতসুকির ব্যবসা গোটাতে হতে পারে।
ইন্টারকম বেজে উঠল। রিসিভার কানে ঠেকাতেই সেক্রেটারির কণ্ঠ শুনতে পেল সে।
‘মি. হায়াশি,’ বলল মেয়েটা, ‘দু’জন লোক এসেছে নিচতলার লবিতে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না জানতে চাইল না হায়াশি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে ওপরেই নিয়ে আসা হতো ওদের।
‘কারা এরা?’ জানতে চাইল সে।
‘আইডি কার্ড দেখিয়েছে-ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি নামে একটা আমেরিকান সংস্থা থেকে পাঠানো হয়েছে ওদেরকে। আপনার সঙ্গে আরাতামা মারুর বিষয়ে কথা বলতে চায়।’
নুমা! সংস্থাটা সম্পর্কে ভাল করেই জানা আছে হায়াশির। এদের একটা জাহাজ আরাতামার ওপর হামলাকারী জলদস্যুদের ঠেকাবার চেষ্টা করেছিল বলে জানানো হয়েছে তাকে। তবে নুমার সঙ্গে তার পরিচয় আরও পুরনো। প্রায় দশ বছর আগেকার একটা স্মৃতি খেলা করে গেল তার মনে। আর সেজন্যেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অপরাধবোধে আক্রান্ত হলো সে।
একটু নীরব থেকে হায়াশি বলল, ‘ওদেরকে বলো, এসব নিয়ে আমি কোনও কথা বলতে চাই না।’
সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে ডেস্কের ওপর রাখা সিকিউরিটি ক্যামেরার মনিটর অন করল সে। লবির ফিড চেক করল। সুট পরা দুই যুবক দাঁড়িয়ে আছে রিসেপশনে। নুমার রিসার্চার বা বিজ্ঞানীর সঙ্গে কোনও মিল নেই, এদেরকে দেখাচ্ছে প্রথম সারির কোনও ল-ফার্মের উকিলের মত।
কপালে ভাঁজ পড়ল হায়াশির। শুধু একটা কারণেই নুমা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইতে পারে।
ইন্টারকমে আবার ভেসে এল সেক্রেটারির গলা। ‘স্যর, ওরা বলছে প্রয়োজনে সারাদিন অপেক্ষা করবে। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা না করে যাবে না।’
‘সারাদিন কেন, সারাজীবন অপেক্ষা করুক,’ রাগী গলায় বলল হায়াশি। ‘আমি কথা বলব না ওদের সঙ্গে। সিকিউরিটিকে বলো, ওদেরকে যেন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।’
রিসিভার নামিয়ে মনিটর অফ করে দিল সে। চিন্তিত ভঙ্গিতে হেলান দিল চেয়ারে। নুমা একটা বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে-বিপদ কীভাবে সামাল দেবে, বুঝতে পারছেন না।