প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

ধর তক্তা মার পেরেক

ধর তক্তা মার পেরেক

আবহাওয়ার পূর্বাভাস : একটি মাত্র ময়লা-ময়লা কুড়ি টাকার নোট পড়ে আছে। চলতেও পারে নাও চলতে পারে। মাসের এখনও দশদিন বাকি। এর ওপর একটি প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে উড়ছে। দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কন্যার বিবাহ। শ’খানেক টাকার একটি শাড়ি নিয়ে তবেই তিনি ফুল দিয়ে সাজানো চেয়ার থেকে নামবেন। প্রতিদিন পনেরো টাকা না ফেললে দানাপানি জুটবে না। তার মানে মিনিমাম দেড়শো চাই। এমতাবস্থায়!

হারমোনিয়াম নামা।

হারমোনিয়াম কী হবে?

নামা না।

নে কোরাসে ধর, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা। আমাদের এই বসুন্ধরা। লাগা কোরাসে লাগা। নে এবার দেখে আয় সংখ্যায় বেড়েছে কি না!

পাগলের পাগলামি। গান গাইলে নোট বাড়বে।

দ্যাখোই না।

এই যে সেই সবেধন নীলমণি, কেলে কুচ্ছিত একটি কুড়ি টাকা।

বেশ। সবাই মিলে ধরো, সুজলাং সুফলাং শস্যশ্যামলাং। তেড়ে ধরো। তিন-চার ফেরতা মারো। নাও দ্যাখো। বেড়েছে?

ঘোড়ার ডিম হয়েছে।

বুঝেছি। যে যুগের যা। উদ্দীপক সংগীতের তেজ মরে গেছে। ছিপি খোলা স্পিরিটে যেমন স্পিরিট থাকে না। নাও নোটটা রাখো। চেয়ারে উঠে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে দেখি।

কে তুমি?

আমি বক্তা। আমি একদা মনুমেন্টের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার করাল বন্যায় দেশের সব সমস্যা ভাসিয়ে দিয়েছি। আমার দাবড়ানিতে আলো জ্বলে, আমার তবড়ানিতে কল চলে, খেতে ফসল ফলে, মানুষ টগবগিয়ে ওঠে। কুড়ি টাকা এই মুহূর্তে কুড়ি হাজার হয়ে যাও।

ওহে মিঞা, নেমে পড়ো। মাত্র কুড়ি টাকা আছে। পড়ে পা ভাঙলে এখুনি প্লাস্টারে আর একস-রেতে, শ’তিনেক গলে যাবে।

তাহলে কী হবে?

চিরকাল যা হয়! ধার কার্য। বেরিয়ে পড়ো। খতিয়ে দ্যাখো এখনও কোন মাথায় টুপি চাপাওনি। শ’খানেক মুচড়ে আনো।

আবার ধার?

রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, আর তুমি পরেশ সরকার, সকলেরই ওই এক পথ, ধার। কারুর কোটি, আর কারুর কুটি। যাও বৎস, নেমে পড়ো ফিল্ডে। ক্ষুরস্যধারা। উপনিষদেই আছে। মানে ধারের ধারালো পথে এগিয়ে চলো। ধারে সংসার। ধারে ছেলেমেয়ের এডুকেশান, ধারে চিকিৎসা, ধারে মেয়ের বিয়ে। ধারে শ্রাদ্ধ-তিলকাঞ্চন।

তানসেন গান গেয়ে আলো জ্বালাতেন।

এখন বক্তৃতায় আলো নেবে।

গান গেয়ে কাজের গোলক ফাটাতেন।

এখন বক্তৃতায় মাইক ফাটে।

গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতেন।

বক্তৃতায় ড্যাম ফেটে বন্যা হয়।

কিন্তু বিবিজান তারপর যে হয়। ‘বন্যায় দেশ গিয়েছে ভাসিয়া’ বলে সুর ধরলেই মাল-কড়ি কেমন আসতে থাকে বলো! ভাঙা সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম, হেঁড়ে গলা। তাইতেই ছপপর ফুঁড়ে নেমে আসে অকৃপন দান। সামান্য বক্তৃতা, ত্রাণ তহবিল উপচে পড়ে। কোন অবিশ্বাসী বলেছে, গণসঙ্গীতে দেশ এগোয় না, বক্তৃতায় সমস্যা দূর হয় না! এই দ্যাখো, আমার বক্তৃতায় কতক্ষণ চলে গেল, একবারও চাল, ডাল, গম, চিনি, তেল, নুন, ঝাল, টকের কথা মনে পড়েছে? পড়েনি। এসো আমরা একটা সেমিনার করি। বিশ্বের অগ্রগতিতে পরেশ সরকার ও রেবা সরকারের ভূমিকা। অথবা পাঞ্জাব সমস্যা ও জাল নোট এবং দেবানন্দ। কিম্বা অলিম্পিক এবং লোডশেডিং। অথবা বাবা তারকেশ্বর বনাম পাড়ায় হিন্দিগান। কিম্বা শিক্ষা ও রাজ্যপাল। তা না হলে চক্ররেল ও লেভেল ক্রসিং। অথবা ট্রেনের কামরায় কাটামুণ্ড। তা না হলে বাতাস ও পুষ্টি।

আরও একটা কাজ করা যায়, একটা বন্ধ ডাকো। মনে করো আমি এই সংসারের কেন্দ্র আর তুমি রাজ্য। আমার অসীম অপদার্থতার প্রতিবাদে চব্বিশ ঘণ্টা হাঁড়ি বন্ধ। আগামীকাল বন্ধের প্রতিবাদে আমি বন্ধ ডাকি। পরের দিন, তোমার আমার যৌথ গণ অবস্থান। একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা বের করে নাও, যাতে তুমি আমি দুজনেই জড়িত, যেমন দেশলাই কেন জ্বলে না, সিমেন্ট কেন জমে না, টুথপেস্টের টিউবে সিকিভাগ কেন বাতাস!

একটা শ্রেণিসংগ্রামও বাধিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ধর আমি শাসক, তুমি শাসিত। আবার কখনও তুমি শাসক আমি শাসিত। মাসের প্রথম দিকে আমি পুঁজিবাদী, তুমি সর্বহারা। প্রায়ই তো বলো, আমার আর কে আছে! তোমার হাতে পড়ে ভাজাভাজা। দুটি শ্রেণি তো হয়েই আছে, স্বামী শ্রেণি আর স্ত্রী শ্রেণি। অত্যাচারী আর অত্যাচারিতা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাজিয়া লেগেই আছে। সেইটাকেই এইবার জাতে তোলো। তোমার রান্নাঘরে মজুত অস্ত্রের অভাব নেই। খুন্তি মেরে আমার লাশ ফেলে দাও। দিয়ে বিধবা হয়ে যাও। পুলিশ অবশ্য ধরতে আসবে। তখন চেষ্টা করবে, বেরিয়ে আসতে। সাফ বলে দেবে, এটা পারিবারিক খুন নয়, রাজনৈতিক খুন। আমি জোতদার মেরেছি। মারার আগে প্রথামতো গান গেয়েছি, ‘নতুন দিন আমরা আনবই, আনব। বিদ্যুৎ ধুত, বড় জ্বালা, আঁধারেই কল চলবে। সেচের জল ছাড়া কৃষকের গোলা ধানে ভরবে। অন্ধকারের শত্রু, নিপাত যাক। আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে।’ যদি না শোনে, তবুও যদি হাজতে ভরে দেয় মন্দ কী! দু’বেলা হাঁড়ি ঠেলতে হবে না। রোজ আর সেই স্লোগান দিতে হবে না—ঠেলছি না ঠেলব না। এও খাঁচা সেও খাঁচা। খাবে দাবে আর বসে বসে বই পড়বে। বেরিয়ে এসেই নেতা। মুর্দাবাদ, জিন্দাবাদ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *