ধর্মাধর্ম
স্থান : দিল্লি প্রেস ক্লাব। একতলায় বার তথা রেস্তরাঁ।
তারিখ : ১৩ নভেম্বর, মঙ্গলবার।
সময় : বেলা আড়াইটে।
দুজন মধ্যবয়সি সাংবাদিক মুখোমুখি বসে আছেন। এই দুই বাঙালি ভদ্রলোক দুজনে দুই বিপরীতমুখী সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা। কিন্তু দুজনের ভিতরে ব্যক্তিগত হৃদ্যতার অভাব নেই।
এর মধ্যে একজন হলেন কৌশিক দত্ত। অন্যজন সলিল দে।
সলিলবাবু এবং কৌশিকবাবু দুজনাই সমবয়েসি, পঞ্চাশের এদিকে ওদিকে বয়েস।
দুজনেই ভারি দুঃখী। তাঁদের স্ত্রীরা স্বামীদের মানুষের মধ্যে গণ্য করেন না।
কৌশিকবাবুর স্ত্রী ওখানে দিল্লিতে থাকেন না। কলকাতায় কলেজের অধ্যাপিকা তিনি, সুমলিনা দত্ত, পুজোর ছুটিতে কলকাতা থেকে স্বামীর কাছে দিল্লিতে ফিরেছিলেন। কালকেই কলকাতায় আবার চলে গেছেন। এঁদের একটি মেয়ে। তারও কলকাতায় বিয়ে হয়েছে।
সলিলবাবু লেবু দিয়ে ভদকা খাচ্ছিলেন।
লেবু ফুরিয়ে গেছে। বেয়ারাকে চেঁচিয়ে বললেন, লেবু।
লেবু এল। লেবু চিপে দুটো রস ভদকায় মেলালেন সলিলবাবু।
একবার সেদিকে তাকিয়ে কৌশিক বললেন, এত লেবু খেয়ো না, অম্বল হবে। চোয়া ঢেকুর উঠবে।
লেবু না খেলেও আমার অম্বল হয়, চোয়া ঢেকুর হয়। পরিতৃপ্তির সঙ্গে এক চুমুক ভদকা কণ্ঠস্থ করে সলিলবাবু বললেন, তবু লেবুর রস দিয়ে খেলে অম্বলটা একটু সুস্বাদু হয়, জিবটা তেতো হয় না।
এরকম সুযুক্তির পরে আর কথা চলে না। কৌশিকবাবু পুরো আধ গেলাস বিয়ার গলাধঃকরণ করে চোখ বুজে গুনগুন করে হাম তুম এক কামরেমে গাইতে লাগলেন। একই পংক্তি ঘুরে ফিরে বারম্বার।
বেলা বারোটা থেকে সলিল এবং কৌশিক বারের এই একপ্রান্তে বসে। দুজনেই সংসার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। ইতিমধ্যে অন্তত পাঁচটি ভদকা খেয়েছেন সলিলবাবু। কৌশিকবাবু একটু সাবধান। অল্প অল্প করে বিয়ার খাচ্ছিলেন। তা-ও দু বোতল হয়ে গেছে। একসঙ্গে দুজনের ভদকা ও বিয়ার ফুরোল। আর খাওয়া উচিত নয়। এবার উঠতে হয়। এমন সময় হই হই করে সোলেমান ঢুকল।
সোলেমান বাংলাভাষী, কলকাতার একটি উর্দু কাগজের দিল্লির রিপোর্টার। খুব আমুদে এবং গোলমেলে চরিত্রের।
সে দুবাহু প্রসারিত করে সলিল এবং কৌশিককে আটকিয়ে দিয়ে বলল, দাদারা যাচ্ছেন কোথায় এই ভরদুপুরে? কৌশিক গুম মেরে ছিলেন। কোনও কথা বললেন না। তবে সলিলবাবু বললেন, বাড়ি যাচ্ছি। দুপরে ভাত খেতে হবে না।
দুপুরে বারে মদ খাবেন। আবার বাড়িতে ভাতও খাবেন। এ তো সেই ধর্মে আছ, জিরাফেও আছ। সোলেমান বলল। সোলেমানের আন্তরিকতায় দুজনেই আবার বসলেন। সোলেমান তিনজনের জন্য তিন পেগ ভদকার অর্ডার দিল। কৌশিক আপত্তি করলেন না। যদিও আগে বিয়ার খাচ্ছিলেন। সে যা হোক, পান করতে করতে সলিলবাবু গসগস করতে লাগলেন, ধর্মে আছ। জিরাফেও আছ। জিরাফ কী জন্যে?
একসময় কৌশিক দত্ত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বললেন, এ তো শক্তিদার বিখ্যাত কবিতা। সলিলবাবু একটু রেগে গেলেন, বাংলা কবিতা নিয়ে আমাকে জ্ঞান দিও না। আমি একজন গুলি খাওয়া বাঘ। ফেল করা কবি।
কৌশিক বললেন, তাতে কী হয়েছে? সলিলবাবু বললেন, কিছু হয়নি। তবে তোমার চেয়ে এ ব্যাপারে আমি কিছু বেশি জানি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধর্মে আছ জিরাফেও আছ নামে কোনও কবিতা নেই। এটা একটা তাঁর বিখ্যাত কবিতার বইয়ের নাম। সলিলবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জিরাফ ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়। সবাই চুপ। জিরাফের ব্যাপারটা সলিলবাবুর একটা যন্ত্রণার দিক। এটা প্রায় সবাই জানে।
সলিলবাবুর স্ত্রী বন্দনা সাধারণ বাঙালি মেয়ের তুলনায় অত্যন্ত বেশি লম্বা। প্রায় পৌনে ছফুট। সেইসঙ্গে অস্বাভাবিক রোগা। সব মিলিয়ে হঠাৎ জিরাফের কথা মনে পড়া অস্বাভাবিক নয়। জানা-চেনারা অনেকে আড়ালে-আবডালে তাকে জিরাফ বলেই বলে।
বন্দনা তথা জিরাফ দেবী লোক খারাপ নন। পাড়াপ্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের কাছে তার সুনাম আছে। তিনি একটি হিন্দি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। এখন এই মাঝবয়সে কিছুটা শুচিবায়ুগ্রস্ত, কিছুটা ধর্মপ্রাণা হয়ে উঠেছেন।
নিঃসন্তান এই মহিলার সংসারের উপর টান ক্রমশ কমে আসছে। আর স্বামীকে তো দেখতে পারেন না, বিয়ের পর থেকেই।
দোষটা অবশ্য সলিলবাবুরই। কেউ মদ খেয়ে শ্বশুরবাড়ি যায় ফুলশয্যার দিন। সেদিন শুধু মদ খাওয়া নয় সলিলবাবু রীতিমতো মাতলামিও করেছিলেন। খুড়শ্বশুরের থুতনি ধরে বলেছিলেন, বাবা দীর্ঘজীবী হও। এরপর খেতে বসে সলিলবাবু লাঠি চেয়েছিলেন। সবাই অবাক। শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, বাবা খেতে বসে লাঠি দিয়ে কী হবে? সলিলবাবু জবাব দিয়েছিলেন, বাঁহাতে বেড়াল মারা লাঠি না থাকলে আমার ডানহাতে খাবার ওঠে না।
এই সময় কনিষ্ঠ শ্যালক, বন্দনার ছোট ভাই, সে বন্দনার চেয়েও লম্বা এবং খুবই স্বাস্থ্যবান। সে খাবার ঘরে ঢুকল। সে ধমকের সুরে সলিলবাবুকে বলল, এখানে বেড়াল দেখছেন কোথা! এ প্রশ্নে সলিলবাবু হেসে ফেলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, বেড়াল নেই? এখানে তো সবাই বেড়াল।
এরপরের ঘটনা সলিলবাবুর পক্ষে সম্মানজনক নয়। তবে বিপদের মুখে পড়ে সলিলবাবু নাকি সেদিন শ্যালকের হাত থেকে নিজের টুটি ছাড়াতে ছাড়াতে স্বীকার করেছিলেন যে না, সব বেড়াল নয়। এ ঘরে দুটো জিরাফ আছে।
তা, এসব অনেককাল আগেকার কথা। প্রায় পনেরো-বিশ বছর হয়ে গেল। এ বিয়ে কী করে যে টিকে আছে ভাবা যায় না। দুজনে একসঙ্গে একই ছাদের নীচে থাকেন। রান্নাঘর খাওয়া-দাওয়া বিছানা এক। শুধু একটি অলিখিত শর্ত আছে। শর্তটি হল কেউ কাউকে ঘটাবে না। এই শর্ত, বলা বাহুল্য সলিলবাবু যতটা মানেন জিরাফ দেবী ততটা মানেন না। এই এতকাল পরেও সলিলের মাতলামির ব্যাপার তাঁর ধাতস্থ হয়নি৷
সলিলবাবু দু-একবার অবরে অবসরে বন্দনাকে বুঝিয়েছেন, আমি হলাম সাংবাদিক। খবরের। কাগজের লোক। আমাকে মাতলামি করতেই হবে। মাতলামি না করলে আমার চাকরি থাকবে না। তুমি জান আমাদের অফিসে যে যত মাতাল তার তত প্রমোশন হয়। এই যে সেবার এক বোতল রাম খেয়ে মাও সে তুং-এর মৃত্যুর দিন নলিনীবাবু হেড লাইন করলেন, চিয়াং কাইশেক পরলোকে। সাতদিনের মধ্যে নলিনীদার এক হাজার টাকা ইনক্রিমেন্ট হল। সে বছর পদ্মশ্রীও পেলেন।
এইসব বাজে কথায় ভুলবার পাত্রী অবশ্য বন্দনা নন। তিনি বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস। তার ছাত্রীরা প্রায় সব কালোয়ার আর মারোয়াড়ি। মিথ্যে কথা শোনার এবং ধরার অভ্যাস যথেষ্ট আছে। স্বাভাবিক কারণে তিনি সম্প্রতি সংসারের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন।
আজ কিছুদিন হল বাড়ির কাছে গোলবাজারে এক গুরুদেব এসেছেন। বন্দনা তার কাছে নিয়মিত যাতায়াত করছেন। গুরুজির মুখে সবসময় হাসি লেগে আছে। গুরুজির কথাবার্তা সবই বন্দনাকে মুগ্ধ করেছে। গুরুজির বাছাই বাছাই শিষ্য-শিষ্যা, সংখ্যায় কম। বন্দনা গুরুজির কাছে প্রার্থনা করেছেন তাকে শিষ্যা করতে অর্থাৎ দীক্ষা দিতে ওই যাকে মন্ত্র নেওয়া বলে।
কিন্তু গুরুজি রাজি হননি।
গুরুজি পোড় খাওয়া লোক। তিনি এর আগে একবার এলাহাবাদে এক সুন্দরী বালবিধবাকে মন্ত্র দিয়ে হাজতবাস করে এসেছেন। থানা হাজতে পুলিশ বেশ শক্ত দুচার ঘা দিয়েছিল। সে বেদনা এখনও প্রশমিত হয়নি।
আর একবার কলকাতার কাছে চন্দননগরে এক ধনী গৃহিণীকে মন্ত্র দিতে গিয়ে যৎপরোনাস্তি বেকায়দায় পড়েছিলেন। কীসে কী হল কিছু বুঝতে পারেননি গুরুজি। হঠাৎ মন্ত্রদানের নিভৃতকক্ষে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন হই হই করে ঢুকে পড়ে। প্রথমে গৃহিণীকে ঘাড় ধরে বাথরুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে দেয়। তারপরে গুরুজিকে গলায় নামাবলির প্যাঁচ দিয়ে টানতে টানতে রাস্তায় বার করে আনে। ভাগ্য ভাল, নামাবলিটি পুরনো ও পচা ছিল। ফলে সেটা ফেঁসে যায়। নাহলে গুরুজি দমবন্ধ হয়ে মারা যেতেন।
এরপর পাড়ার কালীতলায় হাঁড়িকাঠের পাশে বসিয়ে তাঁর সালিশি হয়। বলি-টলি দেয়নি তাকে। কিন্তু পিঠে সিগারেটের হ্যাঁকা দিয়ে ওঁ লিখে তাকে একবস্ত্রে জি টি রোডে ছেড়ে দেয়।
বন্দনা গুরুজির কাছে দীক্ষা নিতে চাইলে গুরুজি প্রথমে শিউরে উঠলেন। তারপর তার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিলেন। সেই ফর্ম শুধু মহিলাদের জন্যে। পুরুষদের দীক্ষা নেওয়ার জন্যে কোনও ফর্ম পূরণের প্রয়োজন পড়ে না। (নারীবাদীরা ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। সেই ফর্মে নাম-ঠিকানা-বয়স ইত্যাদি ছাড়াও নীচের দিকে লিখতে হয়, আমি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ভীত বা প্রভাবিত হয়ে গুরুজির কাছে দীক্ষা নিচ্ছি।নীচে পিতা কিংবা স্বামীর অনুমোদন, আমার কোনও আপত্তি নাই।
বন্দনা আজ কিছুদিন হল গুরুজির কাছ থেকে একটা ফর্ম নিয়ে এসেছেন এবং সলিলকে জোর করছেন ফর্মটি সই করে দিতে, কিন্তু সলিল স্ত্রীকে অত সহজে ধর্মাচার করার সুযোগ দিতে রাজি নন। তিনি বারবারই এড়িয়ে গেছেন। কিছুতেই সই দেননি।
আজ প্রেস ক্লাবে ছয় পেগের মাথায় প্রায় অকারণেই জিরাফের প্রসঙ্গ আসায় সলিলবাবু তার স্ত্রী ও গুরুজির প্রসঙ্গ নিয়ে খুব রসিয়ে গল্প বললেন। সোলেমান বলল, দাদা আপনি সত্যিই বউদিকে পারমিশন দেবেন না? এটা কিন্তু মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করা হচ্ছে। সলিলবাবু বললেন, পারমিশন দেব না তা নয়। কিন্তু আমারও একটা ধর্ম করার আছে। জিরাফসুন্দরী কেবলই বাধা দিয়ে যাচ্ছে। সেটা এবার উশুল করব।
ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বললেন সলিলবাবু। তার ইচ্ছে, বহুদিনের ইচ্ছে বদ্রিনাথের মন্দিরে যাবেন। কিন্তু সলিলবাবুর শ্লেষ্মর ধাত। বন্দনা দেবী স্বামীর মাতলামি ইত্যাদি ব্যাপারে যতই রুক্ষ হোন, তাঁর সুখ-স্বাস্থ্য রক্ষার চেষ্টা করেন। বন্দনা দেবী প্রতিবারই বাধা দেন, তুমি বদ্রিনাথে গেলে ঠান্ডায় জমে যাবে। তোমার যাওয়া হবে না।
সলিলবাবু বলেন, বেশ তো তুমি আমার সঙ্গে চল।
বন্দনা বলেন, আমার গুরুজি আছেন। আমার বদ্রিনাথ লাগবে না।
সলিল বলেন, বদ্রিনাথ সাক্ষাৎ ভগবান। এসব কথা বোলো না। পাপ হবে।
বন্দনা বলেন, আমি গুরু-আশ্রিতা। পাপ হলে গুরুর হবে। আমার কী!
এইভাবেই চলছিল ব্যাপারটা। আজ হঠাৎ প্রেস ক্লাবে এই পড়ন্ত দুপুরে সলিলবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন বদ্রিনাথ যাব। অবশ্যই যাব। তার জন্যে বন্দনাকে ছাড়পত্র দিতে হয় তা হলেও রাজি। আমার ধর্ম আমি করব। বন্দনার ধর্ম বন্দনা করবে। এরকম ভাবতে ভাবতে সলিলবাবু বন্ধুদ্বয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরাও আমার সঙ্গে বদ্রিনাথ যাবে না কি?
সোলেমান রাজি হল না। কিন্তু কৌশিকবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি। স্ত্রী চলে গেছেন। খালি বাড়ি। দুদিনের জন্যে বদ্রিনাথ গেলে ভালই হয়। প্রতিবছর বদ্রিনাথের পথ শীতের আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারিখটা জানা দরকার।
সোলেমান উঠে গিয়ে এক ট্যুরিস্ট অফিসে ফোন করে জেনে এল এবার কেদারবদ্রি বন্ধ হচ্ছে ১৭ নভেম্বর। সুতরাং কালকেই রওনা হতে হয়। না হলে দুরাত্রিও থাকা হবে না। বাসে হরিদ্বারে গিয়ে সেখান থেকে অটোতে হৃষিকেশ, আবার সেখান থেকে বাসে বদ্রিনাথ। পুরো দেড় দিনের ধাক্কা। এত ঝামেলা অফ সিজন বলে। ঠিক হল পরদিন সকালে কৌশিকবাবু সলিলবাবুর ওখানে যাবেন। তারপর সেখান থেকে দুজনে স্ট্যান্ডে গিয়ে হরিদ্বারের বাস ধরবেন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা সলিলবাবু বাড়ি ফিরে দেখেন বন্দনা নেই। রাত সাড়ে নটা নাগাদ গুরুজির ওখান থেকে বন্দনা এলেন। মুখে গুনগুন করছে মীরার ভজন।
কোনওরকম রাখঢাক না করে সলিলবাবু সরাসরি বন্দনাকে বললেন, আমি কাল বদ্রিনাথ যাচ্ছি। মীরার ভজন থামিয়ে দিয়ে বন্দনা বললেন, তুমি নির্ঘাৎ মারা যাবে। ওখানে ঠান্ডায় জমে যাবে। তারপর বললেন, অবশ্য আমার সুবিধেই হবে গুরুজির ফর্মে তোমার সই দরকার পড়বে না। এতক্ষণ বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়েছিলেন সলিলবাবু। তিনি সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন, শোনো, একটা চুক্তি হয়ে যাক। আমি তোমার ফর্মে সই দিয়ে দিচ্ছি। তুমি আমার সুটকেসে গরম জামাকাপড় গুছিয়ে দাও। আমি তিন দিনের জন্যে বদ্রিনাথ থেকে ঘুরে আসি।
সঙ্গে সঙ্গে বন্দনা তার ফর্ম এনে সলিলের সই করিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার সুটকেস একটু পরে গুছিয়ে রাখছি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তুমি চায়ের টেবিলে পেয়ে যাবে।
পরদিন সকালবেলা কৌশিক এসে সলিলের ঘুম ভাঙাল। বন্দনা তখন স্কুলে চলে গেছে। সুটকেসটা টেবিলের উপরে রয়েছে। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে সুটকেসটা নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে সলিলবাবু বেরিয়ে পড়লেন অলকানন্দার তীরে বদ্রিনাথের মন্দিরের উদ্দেশে।
হু-হু করে বাস ছুটে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই হরিদ্বার। পথের পাশের একটা ছোট চটিতে বাস থামল। একটা ছোট চায়ের দোকান। তামার ঘটিতে ছাগলের দুধে প্রচুর গুড় মিশিয়ে ঘন চা তৈরি হচ্ছে। সলিলবাবু বাস থেকে নেমে এলেন।
এতক্ষণ বাসে কিছু বোঝা যায়নি। কিন্তু এখন বেশ ঠান্ডা। চারদিক হিম শীতল। এক গ্লাস চায়ের লোভে সলিলবাবু দাঁড়িয়ে কাঁপছেন।
বন্ধু কৌশিক চালাক লোক। বাস থেকে নামেননি। কাঁচের জানলা দিয়ে আকার-ইঙ্গিতে তার জন্যেও এক গ্লাস চা নিতে বলেছেন।
হঠাৎ উত্তর থেকে আরও ঠান্ডা হাওয়া আসছে। চা হতে দেরি হচ্ছে। বাসও সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। ড্রাইভার, কন্ডাকটর চটির মধ্যে ঢুকে বসে আছে।
অতিরিক্ত ঠান্ডা বোধ হওয়ায় সলিলবাবু বাসে উঠে গেলেন। পায়ের নীচে রাখা সুটকেসটা খুলে একটা মাফলার বা আলোয়ান যাই হোক বার করে কান-মাথা-গলা জড়িয়ে নিতে হবে। সামনের খালি সিটের ওপর সুটকেসটা তুলে ডালা খুলতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সলিলবাবু। কোথায় গরম জামাকাপড়! পুরো সুটকেস ভরতি গত কয়েক মাসের খবরের কাগজ। সলিলবাবু কোনওরকমে উলটোদিক থেকে আসা একটা ভাড়াটে টাটা সুমো গাড়িতে কষ্ট করে উঠে দিল্লি ফিরে এলেন, কৌশিককে ফেলে। ফেরার পথে সমস্তক্ষণ ভাবতে লাগলেন জিরাফসুন্দরীকে এবার কী শিক্ষা দেবেন।
কিন্তু জিরাফসুন্দরী তথা বন্দনাকে কোথায় পাবেন সলিলবাবু। বন্দনাদেবী এখন গুরুজির আশ্রয়ে। স্বামীর ছাড়পত্র নিয়ে তিনি আজকেই গুরুজির আশ্রয়ে চলে গেছেন। ইস্কুলের প্রভিডেন্ড ফান্ড, পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদির জন্যে নমিনি স্বামীর নাম কেটে গুরুদেবকে করে দিয়েছেন।
সলিলবাবু আর জীবনেও জিরাফের নাগাল পাবেন না।