দোলনচাঁপা
রিনাবউদি ঘরে ঢুকে বললন, জর্দা আছে কারো কাছে?
মিনা ঝংকার দিয়ে বলল, পারোও বাবা তুমি। একদুপুরের জন্যে পিকনিকে এসে গোটা সংসার না নিয়ে এলে নয়। দেখো গিয়ে, থাকলে তোমার বরের কাছেই আছে।
রিনাবউদি লাল টুকটুক জিভ বের করে হাতে-ধরা পানের বোঁটা থেকে একটু চুন কামড়ে জানলা দিয়ে পিক ফেললেন। ঢোঁক গিললেন। তার পর জানলার তাকে বসে বললেন, তোর জামাইবাবু কি এখনও জেগে আছে? দেখ গিয়ে ঘুমোচ্ছে পাশের ঘরে।
শান্তু পাজামা গুটিয়ে একটা তাকিয়ার ওপর ঘোড়ার মতো করে বসে থ্রিলার পড়ছিল। মুখ তুলে বলল, দিদি, জামাইবাবুকে তুলে দাও ঘুম থেকে। উনি জমিয়ে নাক ডাকলে কিন্তু এই পুরোনো কাঠের বাংলো যেকোনো মুহূর্তে ধসে যাবে। শান্তুর কথায় সকলে হেসে উঠল।
মিনা বলল, সত্যি দিদি, জামাইবাবুকে একটু রোগা হতে বলো। তুমি একটা যা-তা। নিজের ফিগারটি তো বেশ চাম্পু করে রেখেছ বাবা।
রিনাবউদি বললেন, তোরা বেশি ফাজিল হয়েছিস। তোরা সকলে মিলে আমার বরের পেছনে লেগেছিস কেন? তার তো পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েস হয়েছে। আর এই যে ইয়াংম্যান বালিশ বগলে ভরদুপুরে ঘুমোচ্ছে? এর বেলা কী হয়?
সকলে অমনি বিজুর দিকে তাকাল। পাজামার ওপর একটি হাতওয়ালা গেঞ্জি, ছিপছিপে বিজু একটা বালিশের নীচে মুখ গুঁজে শুয়েছিল। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে ও জেগেছিল এবং মনে মনে ঘরসুদ্ধু লোককে, এক মিনা ছাড়া, গালাগালি করছিল। ও প্রার্থনা করছিল যে, সকলে ঘর ছেড়ে চলে যাক, পাশের ঘরে গিয়ে তাস নিয়ে ব্রে খেলতে বসুক, নয়তো কচুগাঁওয়ের রাস্তায় পায়চারি করুক অথবা রান্নাঘরের পাশের বাতাবিলেবু গাছ থেকে লেবু পেড়ে খাক। মানে যার যা-ইচ্ছে হয় তাই করুক। শুধু ওকে আর মিনাকে ওরা একটু একা থাকার সুযোগ দিক। একা থাকলে কী করবে তা বিজু জানে না। হয়তো মিনার চোখের দিকে চেয়ে ওর চোখের ভেতরে কিছু খুঁজবে। মিনা বলবে, কী দেখছেন আমার চোখের মধ্যে? আমার চোখে কিছু ডুবে গেছে আপনার? বিজু কথা বলবে না। শুধু তাকিয়ে থাকবে। এমনি করে ওর হাতের পাতাটি হাতে নিয়ে, ওর চোখের দিকে চেয়ে সমস্ত দুপুর কাটিয়ে দেবে। তার পর বিকেল হলেই তো কচুগাঁও থেকে নীল বাসটি ধুলো উড়িয়ে আসবে, তার পর দাদা, বউদি, শান্তু, মিনা ওরা সকলেই চলে যাবে ধুবড়িতে। তার পর বর্ষার ঝিঁঝি-ডাকা সন্ধেবেলায় বরবাধার এই নির্জন ফরেস্ট বাংলোতে রেঞ্জার বিজনবিহারী রায় একা একা বারান্দায় বসে ব্যাঙের ডাক শুনবে আর শালের বনে বৃষ্টির শব্দ শুনবে। বিজুর কাছে এই একটি দুপুরের যে কত দাম, এই একটি সামান্য দুপুর অন্যদের সহৃদয়তায় যে কত বড়ো প্রাপ্তি হয়ে উঠতে পারে ওর কাছে তা এক বিজুই জানে।
মিনা বলল, এই যে রেঞ্জার মশাই শুনছেন। আমাদের নেমন্তন্ন করে নিজেও দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘুমোচ্ছেন যে অসভ্যের মতো। উঠুন, নয়তো একটি চিমটি কাটলাম। বলেই, মিনা বিজুর পায়ের পাতায় টুকুস করে একটি চিমটি কাটল।
বিজু ছিটকে উঠল, বলল: ‘আউ’। তার পর উঠে বসে বলল, আমি ঘুমোইনি। ভাই-বোনে মিলে আমার মোটা দাদার কীরকম নিন্দে হচ্ছে, তাই শুনছিলাম। দাদার নিন্দে শোনো উচিত নয় বলেই কানে বালিশ চাপা দিয়েছিলাম।
রিনাবউদি বললেন, ফাজিল। তার পর বলল, আচ্ছা রেঞ্জার সাহেব, তোমার জানালার পাশে এই যে গাছটা, এটা কী গাছ?
মিনা কথা কেড়ে বলল, কাঁঠাল।
শান্তু বলল, তুই আর হাসাস না মিনা। কলকাতার মেয়ে বলে কি কাঁঠাল গাছও চিনবি না? মিনা বলল, ইয়ার্কি মারিস না। পনেরো দিন হল আমি ধুবড়ির মেয়ে। আরও পনেরো দিন ধুবড়িতেই থাকব। তার পর কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে ফিরে ছাদের কাকগুলোকে পর্যন্ত শিখিয়ে দেব কোনটা কী গাছ।
বিজু আসন করে বসে কোলে বালিশটা টেনে নিয়ে বলল, এটা দোলনচাঁপা গাছ।
শান্তু হঠাৎ চঞ্চল হয়ে বলল, ধ্যাৎ। এখানে এসে ঘরে বসে কী হবে? কেমন মেঘলা দিনটা। চল দিদি, ঝরনাটার পাশে ঘুরে আসি। কীরকম ঘন বেতের জঙ্গল দেখেছিস? ওখানে নিশ্চয়ই চিতাবাঘ থাকে।
রিনাবউদি হঠাৎ অল্পবয়েসি হয়ে বললেন, চল একটু অ্যাডভেঞ্চার করেই আসি। তোমার ফরেস্ট গার্ডকে পাব তো গেটে?
বিজু বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি যাও না। ও তো বসেই আছে তোমাদের বিশ্বদর্শন করাবে বলে।
একে একে রিনাবউদি এবং শান্তু ঘরের বাইরে বেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল।
মিনা খাটের কোনায় এক-পা ঝুলিয়ে বসেছিল। ও বিজুর মুখের দিকে তাকাল, তারপর ওঠার ভঙ্গি করে শুধোল, আমিও যাই?
বিজুর মুখ-চোখ হতাশায়, দুঃখে ভরে গেল। বিজু বলল, না মিনা। তুমি যাবে না। প্লিজ তুমি থাকো।
এমন সময় সিঁড়ি থেকে রিনাবউদি ডাকল, মিনা আয়। তোর জন্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। মিনা ধড়মড়িয়ে উঠে একবার বিজুর মুখের দিকে তাকাল, তার পর বোধ হয় বিজুর মুখ দেখে মায়া হল। দৌড়ে সিঁড়ির মুখ অবধি গিয়ে রেলিং ধরে ঝুঁকে বলল, দিদি, তোমরা যাও। দিদি, আমার খাওয়ার পর রোদে ঘুরতে ভালো লাগে না। আমি জামাইবাবুকে চা করে দেব।
দিদিরা চলে গেলে, মিনা একবার পাশের ঘরটা ঘুরে এল। দেখল একটা বালিশ মাথায় এবং অন্য একটা কোলবালিশ কোলে করে জামাইবাবু প্রচন্ড নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।
বিজুকে ঘরে দেখতে পেল না মিনা। কিন্তু ঘরে পা দিতেই দরজার পাশ থেকে বিজু ওকে হাত ধরে কাছে টেনে আনল। ভীষণ জোরে জোরে নি:শ্বাস পড়ছিল বিজুর। মিনার বুক উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠল। মিনা জোর করে বিজুর হাত ছাড়িয়ে বাইরে গিয়ে যেন কিছুই হয়নি, এমনি লঘুপায়ে হেঁটে বারান্দায় রাখা কুঁজো থেকে গড়িয়ে একটু জল খেল। তার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল দিদিরা আলো-ছায়ার চিরুনি বুলোনো পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পর মিনা মুখ ফেরাল। মুখ ফেরাতেই বিজু চোখে-মুখে অনুনয় জানিয়ে ওকে ঘরে আসতে বলল। মিনা ওখানে দাঁড়িয়েই একবার হাতজোড় করল। মুখে কিছু বলল না। বিজু মাথার নীচে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর খুব খারাপ লাগছিল। মিনাকে অমন জোর করে আদর করতে গেছিল বলে এবং দ্বিতীয়ত মিনাও জোর করে পালিয়ে গেল বলে। আসলে এই দুইয়ের মধ্যে কোন কারণের জন্যে ওর বেশি খারাপ লাগছিল, বিজু বুঝতে পারল না।
দুটো দাঁড়কাক এসে বারান্দার রেলিঙে বসেছিল। মিনা বলল, এই হুস হুস। তার পর একটু পরে কী ভেবে মিনা নিজেই এসে বিজুর ঘরে ঢুকল।
বিজু কথা বলল না। ওর মুখ বিস্বাদ লাগছিল। এই সামান্য চাওয়াটুকু মিনা সফল করল না। মিনা হয়তো ভাবে, কী বাহাদুরিই না সে করল, কিন্তু তাতে বিজুর যে কী মর্মান্তিক কষ্ট হল বুকের মধ্যের সমস্ত যন্ত্রপাতি যে ধকধক শব্দ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল, একথা মিনা কোনো দিন বুঝবে না। বোঝেনি। তার নিজের মহত্ত্ব, তার নিজের পবিত্রতার বড়ো বড়ো বুলিতে সে নিজেকে বরাবর justify করে এসেছে। বিজুর যন্ত্রণা, বিজুর কষ্ট, সে কোনোদিনও বোঝেনি; বুঝতে চায়ওনি। মিনা এসে বিজুর পাশে বসল। বলল, অসভ্য।
বিজু অন্য দিকেই মুখ ফিরিয়ে ছিল। বলল, কী হত? তোমার কী ক্ষতি হত?
কিছুই হত না হয়তো। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছে।
কেন?
আমার মনে হয়েছে, এইজন্যেই আপনি আমাকে এখানে আসতে লিখেছিলেন প্ল্যান করে।
এর আগে মিনা বিজুর মনে অনেক বার অনেকরকম কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এই কথাটি শুনে বিজুর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন করতে লাগল। যাকে সে রোজ ঘুমোতে যাওয়ার সময় মনে করে, ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে, ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই পাখির ডাকের মতো, ফুলের গন্ধের মতো, যার ভাবনা প্রথমে ওর অবচেতন থেকে চেতনে ওকে হাত ধরে নিয়ে আসে, তাকে বঞ্চনা করার জন্যে, ঠকাবার জন্যে, কয়েক মুহূর্তের জন্যে আদর করার জন্যে সুদূর কলকাতা থেকে অসমের জঙ্গলে প্ল্যান করে একদুপুরের জন্যে নিয়ে এসেছে শুধু এই জন্যেই, একথা মিনা কী করে বলতে পারল বিজু ভাবতে পারল না। কিছু একটা করতে ইচ্ছে করল বিজুর। চেঁচিয়ে। কেঁদে উঠে বলতে ইচ্ছে করল, তোমাকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি। তুমি আর কোনো প্রমাণ চাও আমার কাছ থেকে?
যা বলতে ইচ্ছে করে তা সব বলা যায় না। বললে, যাত্রা-যাত্রা শোনায়। তাই বিজু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার পর ধীরে ধীরে, কেটে কেটে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি এ বিষয়ে তোমার কোনো সন্দেহ আছে?
বিজুর মনে হল, মিনার দুটি সুন্দর নরম কবুতরি বুকের আড়ালে ওর বোধ হয় হৃদয় বলে কিছু নেই। ও বোধ হয় সমস্তটুকুই কঠিন হিসেব দিয়ে তৈরি। নইলে কোনো মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে না।
মিনা এক অদ্ভুত চোখে বিজুর চোখে তাকাল। তার পর বলল, না। কোনো সন্দেহ নেই।
বিজু বলল, তবে?
আমার এসব ভালো লাগে না। আপনি জানেন, আমার অনেক ছেলের সঙ্গে আলাপ আছে। কিন্তু অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে এই জন্যেই।
বিজু পাশ ফিরে হাতের ওপর মাথা রেখে শুল। বলল, তাহলে বলতে চাইছ আমার সঙ্গেও তাদের অনেকেরই মতো একদিন সম্পর্ক থাকবে না তোমার?
আবার অদ্ভুত চোখে চাইল মিনা, বলল, না। আপনার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে। বিজু উত্তর দিল না। ভাবল, মিনা ওর গভীরতার কতটুকু খোঁজ রাখে। মিনা ওকেও বোধ হয় ওর অনেক বন্ধুদের মতোই মনে করে। বিজু জানে মিনা ইচ্ছে করলেও কোনোদিন বিজুর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। সত্যিকারের ভালোবাসা যদি সে পেয়ে থাকে, তবে তা মিনা কিছুতেই অবহেলায় ফেলে দিতে পারবে না। এজন্মে, পরজন্মে, কোনো জন্মেই পারবে না। সেই বিশ্বাস বিজুর আছে।
বিজু বলল, কেন থাকবে তাহলে সম্পর্ক?
মিনা বলল, থাকবে, কারণ আপনার সঙ্গে আমার একটা সামাজিক সম্পর্ক আছে। যে সম্পর্কটা বরাবরই থেকে যাবে।
আমি সে-সম্পর্কটাকে কোনো মূল্য দিই না। কোনো মূল্যই না। বিজু বলল।
মিনা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। বিজুর হাতটি নিজের হাতে নিয়ে খেলা করতে লাগল। বিজু বার বার মিনার ডান হাতটি মুঠিভরে ধরতে লাগল। হঠাৎ বিজু বলল, জানো, আমার মনে হয় আমি একটা নেগেটিভ আর তুমি পজেটিভ। তোমার হাতে আমার হাত ঠেকলেই আমার ভেতরে অনেক রঙিন আলো জ্বলে ওঠে, আনন্দে আমি ভরে উঠি। আমি বুঝতে পারি, তোমার হাতের মধ্যে আমার ভবিষ্যৎ লুকোনো আছে। তুমি কখনো বুঝতে পারো?
মিনা বলল, বিজুদা আমি জানি আপনার দুঃখ আছে, দুঃখ হয়। মানে, আমি হয়তো আপনাকে অনেক দুঃখ দিয়েছি। কিন্তু প্রত্যেকেরই উচিত, যতটুকু পাওয়া যায়, আপনা থেকে পাওয়া যায়, তাই নিয়েই সুখী হওয়া। আপনি আমার কথাটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? আমার কি দুঃখ নেই? আমি যদি হাসিমুখে থাকতে পারি, আপনি পারেন না কেন? আপনাকে এতদিন যা দিয়েছি তার চেয়েও আজ যা কেড়ে নিতে চাইছিলেন সেটাই কি বড়ো? আপনি একজনের কাছ থেকে সবই চান। হয়তো আমিও চাই সবটুকু। অথচ তা কখনো পাওয়া যায় না। অনেকের কাছ থেকে অল্প অল্প এবং বিচিত্র নিয়েই ঝুলি ভরতে হয়। যে যতটুকু খুশি হয়ে ভিক্ষা দেয়। কখনো জোর করতে নেই বিজুদা। আমি একজনের কাছে জোর করে কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করছি দেখছেন না?
বিজু কথা বলল না। হাতের মধ্যে মিনার হাতটি নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। দোলনচাঁপা গাছটির বড়ো বড়ো পাতার হাওয়ায় দোলনাটা দুলছে। অনেক পাখি ডাকছে বাইরে। গোরু দুটির গলায় ঘণ্টার টুঙটুঙানি ভেসে আসছে হাওয়ায়। বিজুর হঠাৎ নিজেকে ভারি ছোটো লাগতে লাগল। মনে হল, উঠে মিনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। বিজু চুপ করে মিনার চোখে চেয়ে রইল।
এমন সময় নীচে ওদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সিঁড়িতেও দুড়দাড় আওয়াজ হল। মিনা তাড়াতাড়ি বিজুর হাত ছেড়ে সরে বসল।
শান্তু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মিনা কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার।
কী?
সাপ।
কী সাপ?
গুঁই সাপ।
মারলি না কেন? দারুণ হ্যাণ্ডব্যাগ হত আমার একটা—।
মিনা এমনভাবে কথাটা বলল যে, হ্যাণ্ডব্যাগ, বেলুন, খেলনা, ললিপপ এইসব নিয়েই ও সারাদিন ভেবে মরে। এতক্ষণ যে গভীর খোলসে ছিল, সে খোলস ছেড়ে একটা চিকন সাপের মতো এখন সম্পূর্ণ অন্য খোলসে প্রবেশ করল মিনা। মিনা হো: হো: করে হাসতে লাগল। শান্তুকে ভীরু বলে খেপাল। তার পর রিনাবউদির সঙ্গে চায়ের বন্দোবস্ত করতে চলল।
একটু আগে যে-মিনা বিজুর হাতে হাত রেখে বসেছিল, সে-মিনাকে আজ আর ফিরে পাবে না বুঝল বিজু। কিছুতেই পাবে না।
বেলা পড়ে এসেছে। ওরা সকলে গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিল। বাসটা আসছে দেখা যাচ্ছে। বিজু ওদের তামাহাট অবধি এগিয়ে দিয়ে আসবে তার পর উলটোদিকের বাস ধরে ফিরে আসবে বরবাধায়।
বাসটা এসে গেল। এক এক করে সকলে উঠে পড়ল। মিনা বাঁ-দিকের জানলার পাশে একটি সিট নিল। বিজু ওর পেছনে বসল। বাসটা জঙ্গলের পথ বেয়ে তামাহাটের দিকে ছুটল।
মিনা একটি লো-কাট ব্লাউজ পরেছে। চাঁপা-রং শাড়ি, পোলকাডটের ভয়েল। পিঠের দু-পাশের পাখনার হাড় দেখা যাচ্ছে। বাসের দোলানিতে মিনার শরীর দুলছে, বেণী দুলছে। বেণীতে একটি দোলনচাঁপা গুঁজেছে মিনা। হাওয়ার ঝলকে ঝলকে বিজু গন্ধ পাচ্ছে নাকে।
এক সময় মিনা ওর সুন্দর গ্রীবা বেঁকিয়ে পেছনে ফিরে বিজুকে বলল, বেশ সুন্দর কাটল দিনটা। অনেক দিন মনে থাকবে।
বিজু উত্তর দিল না। চোখ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাল।
ওপাশের সিট থেকে শান্তু বলল, মিনা একটা গান গা-না। ফাইন লাগছে বিকেলটা।
মিনা বলল, ধ্যাৎ। এই বাসের ঝাঁকুনিতে গান হয়? আমার গাইতে ইচ্ছে করছে না।
বিজু, মিনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, গাও-না মিনা। কতদিন তোমার গান শুনিনি।
সত্যি শুনবেন? মুখ ঘুরিয়ে মিনা বলল।
বিজু বলল, গাও।
মিনা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে নীচু গলায় আস্তে আস্তে গাইতে লাগল।
‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে…
তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে…’
দেখতে দেখতে তামাহাট এসে গেল। শান্তু বলল, জামাইবাবু, এখানে ঘোষের দোকানে ভালো রসগোল্লা পাওয়া যায়।
রিনাবউদি বললেন, জামাইবাবুর যোগ্য চেলাই হয়েছিস।
শান্তু এবং দাদা নেমে গেলেন মিষ্টির দোকানে।
বিজু বাস থেকে নেমে জানলার পাশে দাঁড়াল।
মিনা বলল, কখন ফিরবেন?
বিজু চোখ দিয়ে পথের উলটো দিকে দাঁড়ানো বাসটি দেখিয়ে বলল, ওই বাসে, তোমরা চলে গেলেই।
হঠাৎ বিজুর মনে পড়ল, পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে বলল, তুমি চেয়েছিলে। বলে, পকেট থেকে একমুঠো দোলনচাঁপা বের করল। জানলার ফাঁক দিয়ে দু-হাতের পাতা মেলে ধরল মিনা।
বিজু ফুলগুলো সব ওর হাতে ঢেলে দিল। দেওয়ার সময় মিনার হাতে হাত ঠেকল। ভালো লাগায় বিজু আবার নতুন করে ভরে গেল।
বিজু বলল, ভালো করে ধরো, পড়ে যাবে।
মিনা হাসল, বলল, পড়বে না, এ তো অন্য কিছু নয়, এ যে ফুল।
শান্তুরা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বাসে এসে উঠল। বাস স্টার্ট দিল। মিনা ফিস ফিস করে বলল, যাওয়ার আগে আর একবার আসার চেষ্টা করব। শরীরের যত্ন নেবেন। আপনি ভীষণ রোগা হয়ে গেছেন। তার পর একটু থেমে বলল, দিনটা বড়ো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। ভালো লাগছে না যাওয়ার সময়।
বিজু কথা বলল না, হাসি হাসি মুখে মিনার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আসলে বিজুর তখন কান্নায় গলা বুজে আসছিল।
দাদা চেঁচিয়ে বললেন, চলি রে, বিজু।
ড্রাইভার বাসটাকে গিয়ারে দিল। মিনা বলল, যাচ্ছি বিজুদা।
তার পর বাসটা চলে গেল।
ফিরতি বাস ধরে বিজু বরবাধার বাংলোয় ফিরে আসছিল। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। পশ্চিমের আকাশটা বেশ পরিষ্কার—। মাঝে মাঝে হিমালয়ের চূড়ার ঝিলিক দু-এক খন্ড মেঘের মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। বেতবনে, ল্যানটানায়, সেগুন আর শালেদের বড়ো বড়ো ডাল-পালায় সোনা আর হলুদে মেশা গোধূলিবেলার আঁচ লেগেছে। পথের পাশের পাহাড়ি নালায় একটা মাছরাঙা সোজা ওপর থেকে নেমে এসে জলে ছোঁ মেরে পাহাড়ি পুঁটি ধরছে—আবার সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছে। তার ডানায় পৃথিবীর সব রং ঝিকমিকিয়ে উঠছে।
বাসটা চলেছে। অদূরে গুমা রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। পথের দু-ধারের বনে দোলনচাঁপা ফুটেছে। এই শান্ত স্নিগ্ধ রঙিন বিকেলে গন্ধে ম ম করছে সমস্ত বন। বনের হাওয়া।
মিনার হাতের পরশ, মিনার চোখের চাওয়া, মিনার গলার স্বর এসবের স্মৃতিবাহী এ-দিনটি বিজুর সমস্ত সত্তা ভরে এক বিধুর বাঁশির মতো বাজছে। চাঁপার গন্ধে বুঁদ হয়ে চলেছে বিজু।
সেই গন্ধের বন্যায় ভাসতে ভাসতে বাসের দোলায় দুলতে দুলতে হঠাৎ বিজুর মনে হল, পৃথিবীর বনে বনে এমন অনেক দোলনচাঁপা ফোটে যা ছিঁড়ে এনে নিজের ঘরের ফুলদানিতে সাজানো যায় না।—কিন্তু সে-ফুলের সুগন্ধে সারাঘর, সারামন; সারাজীবন নিশ্চয়ই ভরে রাখা যায়।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ভরে রাখা যায়।