দৈবাৎ

দৈবাৎ

পরিচয়

পরিতোষবাবু—ভদ্রলোক, অবস্থাপন্ন, বিপত্নীক, নিঃসন্তান।

শৈলেন—যুবক, উচ্চশিক্ষিত, মাতৃপিতৃহীন, মাতুল পরিতোষবাবু কর্তৃক পুত্রবৎ পালিত।

ঊষা—শৈলেনের কনিষ্ঠা ভগিনী।

ফটিক—বালক ভৃত্য।

ভাগিনেয়—আগন্তুক।

সকলেই বায়ু পরিবর্তনের জন্য দেওঘরে আসিয়াছেন।

প্রথম দৃশ্য

জসিডি জংশন। দিঘড়িয়া পাহাড়ের প্রায় পাদমূলে। সন্ধ্যা হইয়াছে; বৃষ্টি হইতেছে, জোরে ঝড় বহিতেছে। কিছুই স্পষ্ট দেখা যাইতেছে না। কেবল স্থানে স্থানে বৃষ্টির জল জমিয়া একটি মলিন শ্বেতাভার সৃষ্টি করিয়াছে।

ঊষা অতি সাবধানে পা ফেলিয়া পাহাড়ের দিক হইতে প্রবেশ করিল। তাহার গা ওয়াটার-প্রুফে ঢাকা, পায়ের সাদা চামড়ার জুতা জল ও কাদায় অত্যন্ত ভারী হইয়া উঠিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া মোটেই ভীত বা উৎকণ্ঠিত বোধ হইতেছে না। বরং সে যেন এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পথ হারাইয়া যাওয়ার ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করিতেছে।

বিদ্যুৎ চমকিল এবং পরক্ষণেই বজ্রের একটা বিকট আর্তনাদ উঠিল।

ঊষা হঠাৎ ভয় পাইয়া চেঁচাইয়া উঠিল, ‘মামা-মামা—’

পাহাড়ের দিক হইতে সাহেব বেশধারী এক ব্যক্তি প্রবেশ করিল। পিচ্ছিল জমির উপর পা হড়্‌কাইয়া পড়িতে পড়িতে দু’বার সামলাইয়া লইল। কিন্তু তৃতীয়বার আর পারিল না—হঠাৎ চার হাত দূর পর্যন্ত পিছলাইয়া গিয়া কাদার মধ্যে উপুড় হইয়া পড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে তাহার মাথার টুপিটা দম্‌কা হাওয়ায় উড়িয়া ব্যোমপথে অদৃশ্য হইল।

ঊষা অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করিতে না পারিয়া ছুটিয়া কাছে আসিয়া ডাকিল, ‘মামা—’

সে ব্যক্তি উঠিয়া বসিল। নাসিকার অগ্রভাগ হইতে কর্দম মুছিয়া ঝাড়িয়া ফেলিল। তারপর বলিল, ‘আমি মামা নই—আমি ভাগ্নে।’

ঊষা অবাক হইয়া গেল।

ঊষা। ভাগ্নে?

ব্যক্তি। হ্যাঁ-ভাগ্নে। কিন্তু মামা আমার সঙ্গে সদ্‌ব্যবহার করেননি। আমাকে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ফেলে তাঁর অস্ত যাওয়া মোটেই উচিত হয়নি।

ঊষা। আপনার মামা কে?

সে ব্যক্তি উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যক্তি। আমার মামা—সূয্যি মামা।

কিছুক্ষণ অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকিয়া ঊষা খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

ঊষা। সূয্যি মামা—(হাসি)

সূয্যি মামার ভাগ্নে ঘাড় বাঁকাইয়া বীরদর্পে দাঁড়াইল; চক্ষু পাকাইয়া বলিল, ‘হাসি! এই ঝড় বৃষ্টির সময় হাসি! আমি পা পিছলে কাদার মধ্যে হেঁডেডুডু খেল্‌ছি। আর হাসি!’ (পদদাপ)

পদদাপ করিতে গিয়া আবার পদস্খলন ও চিৎ হইয়া পতন। ঊষার উচ্চ হাস্য। সে ব্যক্তি শয়ান অবস্থাতেই হস্তভঙ্গি করিয়া ক্রুদ্ধভাবে কহিল, ‘ফের হাসি! আমি পড়ে গেছি তাই—তুম্‌ কোন্‌ হ্যায়? কে তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি বাঙালী কি বেহারী কি মারাঠী কি গুজরাটী কি ওড়িয়া—’

ঊষা। আমি বাঙালী।

সে ব্যক্তি অর্ধোপবিষ্ট হইয়া চিন্তা করিল।

ব্যক্তি। বাঙালী? ঠিক! বেহারী কিংবা ওড়িয়া হলে ‘মামা’ না বলে ‘মামু’ বলত। —কিন্তু তোমার অত হাসি কিসের? তুমি কি জাতি?

ঊষা। আমি স্ত্রী জাতি।

সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যক্তি। স্ত্রীজাতি? আপনি বাঙালী স্ত্রীজাতি! (টুপি তুলিবার জন্য মাথায় হাত দিয়া) আমার টুপি। কোথায়?

ঊষা। আমি তাকে উড়ে যেতে দেখেছি।

সহসা সে ব্যক্তি ভীষণ চটিয়া উঠিল।

ব্যক্তি। কি! আমার টুপি উড়ে যেতে দেখেছ? (আত্মসম্বরণ করিয়া) ওঃ, আপনি বাঙালী স্ত্রীজাতি। তা—ইয়ে হয়েছে—আপনি এখানে কি মনে করে?

ঊষা। আমি আর আমার মামা পাহাড়ে বেড়াতে এসেছিলুম। তারপর এই দুর্যোগে মামাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।

ব্যক্তি। আপনার মামা—ইয়ে—তাঁকে আর খুঁজে পাবেন না।

ঊষা। আঁ! সে কি!

ব্যক্তি। দিঘড়িয়া পাহাড়ে ভয়ানক বাঘ—আপনার মামা বোধ হয় তাদের সঙ্গেই রাত্রি যাপন করবেন।

ঊষা। [ব্যাকুলভাবে চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া] অ্যাঁ—না না—মামা মামা—

ব্যক্তি। [নিজ মনে] হাসি! হাসি! আমি কাদায় আছ্‌ড়া পিছ্‌ড়ি খাচ্ছি আর হাসি! (ঊষার নিরুপায় ভাব লক্ষ্য করিয়া] না—এটা উচিত হচ্ছে না—নেহাৎ বর্বরতা হচ্ছে। —[প্রকাশ্যে] ইয়ে—তা কোনও ভয় নেই। বাঘেরা আপনার মামার সন্ধান নাও পেতে পারে।

ঊষা নীরব মিনতির চক্ষে তাহার পানে তাকাইয়া রহিল।

ব্যক্তি। দেখছেন না এই পেছলে বাঘ কখনো বেরুতে পারে? আর যদি বা বেরোয় আর কোথাও যেতে পারবে না, সড়াৎ করে এইখানে এসে হাজির হবে।

ঊষা। কিন্তু কৈ, এসে হাজির হচ্ছে না তো।

ব্যক্তি। তার মানে তারা বেরোয়নি। আমাদের চেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বেশী।

ঊষা। কিন্তু মামা—

ব্যক্তি। তিনিও নিশ্চয় বেরোননি, নিরাপদেই আছেন। অথবা হয়তো আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেছেন।

ঊষা। স্টেশন কোন্‌ দিকে?

ব্যক্তি। হ্যাঁ—দিঘড়িয়া পাহাড়কে পেছনে রেখে যেদিকে হোক এগোনই ভাল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলে নিউমোনিয়া হতে পারে, হাঁটলে সে ভয় কম।

সে ব্যক্তি অগ্রসর হইল। একাকিনী দাঁড়াইয়া থাকা অপেক্ষা ইহার সঙ্গে যাওয়া শ্রেয় বিবেচনা করিয়া ঊষা তাহার অনুসরণ করিল।

ব্যক্তি। [যাইতে যাইতে সহসা থামিয়া] মাফ কর্‌বেন—[ইতস্তত] ওর নাম কি—

ঊষা! আমার নাম ঊষারানী দত্ত।

ব্যক্তি। না না, সে কথা নয়। আপনি কি জংশনেই থাকেন?

ঊষা! না। দেওঘরে বম্পাস টাউনে। আপনি?

ব্যক্তি। আমিও।

ঊষা। [সাগ্রহে] বম্পাস টাউনে!

ব্যক্তি। হুঁ।

ঊষা। আপনার নাম—?

ব্যক্তি। আমার নাম [মাথা চুলকাইয়া] শ্রীভাগিনেয় বসু।

এই বলিয়া বড় বড় পা ফেলিয়া প্রস্থান। ঊষার অনুগমন—উভয়ে অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।

পাহাড়ের দিক হইতে সাহেব বেশধারী আর একজনের প্রবেশ। প্যান্টালুন কর্দমাক্ত, মাথার টাকের উপর হইতে বৃষ্টির জল চারিদিকে গড়াইয়া পড়িতেছে। ইনি ঊষার মামা পরিতোষবাবু।

পরি। ঘোড়ার ডিম! ভারী পেছল। [পা পিছলাইয়া] উঃ, ঘোড়ার ডিম—গিয়েছিলুম আর একটু হলে। ঊষা—ঊষা! [হতাশভাবে ঘোড়ার ডিম! [দাঁড়াইয়া টাক হইতে জল মুছিলেন] কোথায় গেল মেয়েটা! কেন তাকে একলা ছেড়ে দিলুম! ঘোড়ার—[উৎকর্ণ হইয়া শুনিলেন] ঐ যে কে ‘মামা’ ‘মামা’ করে ডাকছে! কিন্তু ওতো ঊষার গলা নয়। ঘোড়ার ডিম—আরও মামা এখানে আছে নাকি!

দূর হইতে শব্দ হইল—‘মামা’—‘মামা’—।

পরি। ঐ যে ঊষার গলা! ঊষা—ঊষা! কিছু দেখবার যো নেই। ঘোড়ার ডি—[বিদ্যুৎ চমকিল]

পরি। ঐ যে সামনে কিছু দূরে দু’জন লোক দেখলুম না! একজন ওয়াটার-প্রুফ পরা, ঊষা বলেই বোধ হল। ঘোড়ার ডিম—বিদ্যুৎ আর একবার চাম্‌কালে হত যে। একে পেছল তায় অন্ধকার, ঘোড়ার ডিম—(নিষ্ক্রান্ত হইলেন)

দ্বিতীয় দৃশ্য

দেওঘর। বম্পাস টাউনে একটি সুদৃশ্য কুটির। নাম—প্রেম কুটির। তাহার পাঁচিল-ঘেরা বাগানের মধ্যে বাঁধানো চাতালের উপর টেবিল চেয়ার প্রভৃতি সজ্জিত। সূর্য এইমাত্র অস্ত গিয়াছে—আকাশে বৃষ্টির কোনও লক্ষণ নাই। হাওয়া ঝরঝরে।

পরিতোষবাবু একটি বেতের মোড়ায় বসিয়া একটি চুরোটের অতি ক্ষুদ্র শেষাংশ চুষিতেছিলেন। পরিধানে কোঁচাননা ধুতি ও পিরান কিন্তু গলায় উলের গলাবন্ধ, পায়ে মোজা এবং চটিজুতা।

পরিতোষবাবুর মোড়ার পিছনে দাঁড়াইয়া তাঁহার বালক ভৃত্য ফটিক নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছে।

সে কিছু হৃষ্টপুষ্ট—গাল দুটি উঁচু হইয়া নাসিকার বিশেষ খবৰ্ত সাধন করিয়াছে। কপাল নাই বলিলেই হয়। বর্ণ নিকষকৃষ্ণ।

অন্য কেদারায় বসিয়া একটি যুবক,—সান্ধ্য ভ্রমণের উপযুক্ত সাজ—চেহারা সুশ্রী ও গম্ভীর কিন্তু অধরোষ্ঠ ঈষৎ চপলতার পরিচায়ক। সে নিবিষ্টমনে সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিল। সে ঊষার দাদা শৈলেন।

বাড়ির ভিতর হইতে বাদ্য সংযোগে সঙ্গীতের আওয়াজ আসিতেছিল। ঊষা গাহিতেছিল—

‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’

পরিতোষবাবু চুরেটের দগ্ধাবশেষ হইতে আর কিছুমাত্র ধূম বাহির করিতে না পারিয়া বিরক্ত হইয়া সেটা ফেলিয়া দিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে বলিলেন, ‘আজকের খবর পড়লে!’

শৈলেন। (কাগজখানা মুড়িয়া রাখিয়া) হ্যাঁ।

পরি। জাপানের ব্যাপারখানা দেখেছ?

শৈলেন। (একটু হাসিয়া) হ্যাঁ।

পরি। এমন ফন্দিবাজ জাত আর পৃথিবীতে নেই—ঘোড়ার ডিম—ওরা ভয়ানক ধূর্ত। এই যে জাহাজের পর জাহাজ তৈরি করছে সে কি মিছিমিছি? ঘোড়ার ডিম—মোটেই নয়। ভারতবর্ষ যদি না জাপানীরা আক্রমণ করে তো বোলো তখন। ওই যে সব জাপানী ফিরিওয়ালা বস্তা ঘাড়ে করে দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা কি সাধারণ লোক মনে করেছ? ওরা সব ঘোড়ার ডিম—স্পাই স্পাই—দেশের প্ল্যান করে বেড়াচ্ছে, সুবিধে পেলেই আক্রমণ করবে।

শৈলেন। তা যদি করে আমাদের বেশ সুবিধে আছে—ওদের বস্তাগুলো কেড়ে নিলেই হবে।

পরি। তারা কি ঘোড়ার ডিম—বস্তা নিয়ে লড়াই করতে আসবে? সঙ্গীন উঁচিয়ে কামান দাগতে দাগতে এসে হাজির হবে।

‘ওঃ’ বলিয়া শৈলেন এমনভাবে স্তব্ধ হইয়া রহিল যেন এ সম্ভাবনা সে কল্পনাই করে নাই।

(ঊষার প্রবেশ)

ঊষা। কৈ, মিঃ বোস এখনো এলেন না?

পরি। ফটিক! ফটিক! ঘোড়ার ডিম ঘুমিয়ে পড়েছে। (উচ্চকণ্ঠে) ফটিক!

জাগরণের চিহ্ন স্বরূপ ফটিক প্রথমে বাম চক্ষু পরে দক্ষিণ চক্ষু সাবধানে উন্মীলন করিল এবং পরক্ষণেই কাঁদিয়া ফেলিল।

পরি। গেটের কাছে গিয়া দাঁড়াগে যা। একটি বাবু আসবেন, এইখানে নিয়ে আস্‌বি।

(চক্ষু মুছিতে মুছিতে ফটিকের প্রস্থান)

ঊষা অন্যমনস্কভাবে আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল; একটা স্ফুটনোন্মুখ গোলাপের কুঁড়ি ছিঁড়িয়া একবার তাহাকে আঘ্রাণ করিয়া চুলের মধ্যে গুঁজিয়া রাখিল। শৈলেন আড়চোখে তাহাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া খুব গাম্ভীর্যের ভান করিয়া বলিল, ‘ঊষা, কালকের ঘটনাটা কবিতায় লিখে ফেল—তারপর সেটা ‘মন্দাকিনী’তে পাঠিয়ে দিলেই হবে। একে তোমার লেখা, তার ওপর নায়কের নামটি যে রকম চিত্তাকর্ষক—’

ঊষা দাদাকে লক্ষ্য করিয়া ভ্রূকুটি করিল। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইল।

পরি। কেন শৈলেন, তুমি ওকে ক্ষেপাও? ওর বাস্তবিক লেখবার ক্ষমতা আছে—তুমি ঘোড়ার ডিম—তার বুঝবে কি? তুমি ওর ‘অস্ফুট’ পড়ে যতই হাসো না কেন, তার মধ্যে বাস্তবিক ভাল কবিতা আছে। এই ধর না কেন, ‘প্রার্থনা’, ‘আশ্রয় যাঞ্চা’—এগুলো ঘোড়ার ডিম উৎকৃষ্ট রচনা। ওইটুকু মেয়ের হাত থেকে অমন লেখা বেরোন কি যে-সে কথা। তুমি হাজার চেষ্টা করলেও অমন একটা পদ্য লিখতে পারবে না।

শৈলেন। ‘মন্দাকিনী’তে তার যে রকম প্রশংসা বেরিয়েছিল তাতে সে রকম লেখিকার উচ্চাশা আমার বড় একটা—

ঊষা আসিয়া তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। ছেলেবেলার প্রথম লেখা ছাপানোর লজ্জাকর অধ্যায়টা এমনই ঊষাকে ত্রস্ত-সঙ্কুচিত করিয়া রাখিত,—তার উপর শৈলেন যখন সেই কথা লইয়া তাহাকে বিঁধিতেও ছাড়িত না তখন তাহার দাদার প্রতি রাগ ও নিজের বিগত নির্বুদ্ধিতার জন্য লজ্জার সীমা-পরিসীমা থাকিত না। এক এক সময় শৈলেনের জ্বালায় সত্য সত্যই তাহার লোক-সমাজে মুখ দেখানো ভার হইয়া উঠিত।

ঊষার বয়স এখন উনিশ; তাই সে পনেরো বছর বয়সে লেখা নিজের কবিতার মধ্যে অক্ষমতা ও ছেলেমানুষি ভিন্ন আর কিছুই খুঁজিয়া পায় না, এবং লজ্জায় মরিয়া গিয়া ভাবে—কেন মরিতে এগুলাকে ছাপিতে গিয়াছিলাম।

ভাগিনেয় বোসের প্রবেশ ও সকলের অভিবাদন।

পরিতোষবাবু মোড়া ছাড়িবার উদ্যোগ করিয়া আবার বসিয়া পড়িলেন। শৈলেন আগন্তুককে কিছুক্ষণ বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে নিরীক্ষণ করিয়া কি একটা বলিতে গিয়া থামিয়া গেল। ঊষা পূর্বদিনের সেই কাদা মাখা অদ্ভুত জীবটির পরিবর্তে এই সুবেশ সুশ্রী অতিথিটিকে দেখিয়া সহসা সম্ভাষণ করিবার মতো উপযুক্ত কথা খুঁজিয়া পাইল না এবং মনে মনে চঞ্চল হইয়া উঠিল। সকলে উপবিষ্ট হইলেন।

ভাগিনেয়। আপনাদের গেটের কাছে একটি বালক দেখলাম যার প্রকৃতি কিছু অস্বাভাবিক বলে বোধ হল। আমাকে দেখেই সে কেঁদে ফেল্‌লে; তাই দেখে আমার মনে দয়া হল, আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। পরক্ষণেই দেখি সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

পরি। ওটি আমার বেয়ারা ফটিক!

ভাগি। ভারী আশ্চর্য! বাস্তব জগতে ফ্যাট বয় এবং যব ট্রাটারের এমন অপূর্ব সংমিশ্রণ বোধ হয় আর কোথাও নেই। ওকে যাদুঘরে পাঠিয়ে দিন।—(ঊষার দিকে ফিরিয়া) কাল আপনার সঙ্গে আমি সদ্‌ব্যবহার করিনি। সে জন্যে মাফ চাইছি। মনুষ্য সমাজে যে ব্যবহার একেবারে অমার্জনীয়, দিঘড়িয়া পাহাড়ের ধারে হয়তো ততদূর নাও হতে পারে এই মনে করে এই দুষ্প্রাপ্য জিনিস চাইতে সাহস করছি।

ঊষা। (সুস্মিত মৃদুস্বরে) সাহসের বলে মানুষ অনেক জিনিস লাভ করে—আপনিও করলেন।

ভাগি। আমাকে বেশী সাহসী মনে করবেন না। প্রথমত আমি বাঙালী, সুতরাং বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মতে আমার ভীরু হওয়া একটা জাতীয় কর্তব্য, দ্বিতীয়ত—

শৈলেন। কিন্তু আপনার নামটি অসমসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে।

ভাগি। কি ভাবে?

শৈলেন। নামকরণ সম্বন্ধে সামাজিক বিধিবিধানগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে।

ভাগি। (কিয়ৎকাল ভাবিয়া) দেখুন—আমার নামটা একটা মহামুহূর্তের প্রেরণার ফল। ওটির জন্য আমাকে ঈর্ষা করবেন না।

ঊষা। আচ্ছা ভাগিনেয়বাবু, এ নামটি আপনার কে রেখেছিল?

ভাগি। আমি স্বয়ং। ছেলেবেলা থেকেই মামাদের প্রতি আমার একটু পক্ষপাত আছে।

শৈলেন। তাই নিঃসংশয়ে পৃথিবীসুদ্ধ লোকের ভাগ্নে হয়ে বসে আছেন। কিন্তু এতে কোনও লোকের কিছু অসুবিধা হওয়া সম্ভব।

ভাগি। কি করে?

শৈলেন। (ইতস্তত করিয়া) আপনার মহিলা বন্ধুরা সকলে এ সম্বন্ধ স্বীকার করতে রাজী না হতে পারেন।

ভাগি। আমার জানিত একটি লোক আছেন—তাঁর নাম প্রাণেশ্বর! তাঁর বান্ধবীরা তাঁকে প্রাণেশ্বর বলে ডাকতে দ্বিধা করেন না।

সকলে স্তব্ধ। পরিতোষবাবু অভিভূত। শৈলেন পরাজিত, ঊষা লজ্জাহত।

সন্ধ্যা হইয়াছিল। পরিতোষবাবু দু’একবার কাশি চাপিবার চেষ্টা করিয়া শেষে বলিলেন, ‘ঘোড়ার ডিম—কাল জলে ভিজে ঠাণ্ডা লেগে গেছে। আর বাইরে থাকা ঠিক নয়। ঊষা, তোমারও তো—’

ঊষা। না মামা, আমার কিছু হয়নি। তুমি বরং ভেতরে যাও, আমরা আর একটু পরে—

পরি। আচ্ছা। ভাগিনেয়বাবুকে ছেড়ে দিও না। আমি তোমাদের জন্যে ড্রইং-রুমে অপেক্ষা করব। ঊষা, একবারটি শুনে যাও।

(উভয়ে নিষ্ক্রান্ত)

শৈলেন। (উত্তেজিতভাবে) বিজন, তুমি—?

ভাগি। চুপ—ব্যস। আমি ভাগিনেয়। সব মাটি করে দিও না। পরিতোষবাবু তোমার—?

শৈলেন। মামা।

ভাগি। মেয়েটি?

শৈলেন। বোন।

ভাগি। (উৎকণ্ঠিত) ‘অস্ফুট’এর—?

শৈলেন। লেখিকা।

ভাগি। (মাথায় হাত দিয়া) উঃ—চুপ!

(ঊষার প্রবেশ)

ঊষা। মামা বললেন আজ আমাদের সঙ্গে ডিনার খেয়ে তবে বাড়ি যেতে পাবেন। কিন্তু ডিনারের এখনো ঢের দেরি আছে। ততক্ষণ না হয় এখানে বসে—

শৈলেন। কাব্য আলোচনা করা যাক। কি বলেন ভাগিনেয়বাবু? আপনি বাবো হয় জানেন না, আমার ভগিনী খুব একজন উঁচুদরের—

ঊষা। আঃ দাদা—চুপ কর।

শৈলেন। কবি। বাঙলা ভাষার সঙ্গে যদি আপনার পরিচয় থাকে, এমন কি মুখ দেখাদেখিও থাকে তাহলে নিশ্চয় আপনি ‘অস্ফুট’ নামক অপূর্ব কাব্যগ্রন্থের নাম শুনেছেন। তার মধ্যে ‘প্রার্থনা’, ‘আশ্রয় যাঞ্চা’ প্রভৃতি যে সব উচ্চ অঙ্গের কবিতা আছে তা পড়লে চোখের জল সজোরে বেরিয়ে পড়ে। আপনি বল্‌বেন ভগিনীর কাব্য সম্বন্ধে ভ্রাতার মনে একটু দুর্বলতা থাকা সম্ভব। প্রত্যুত্তরে আমিও বলতে পারি যে ফটিক ঊষার ভাই নয়, তথাপি সেও কেঁদে ফেলেছিল।

ঊষা। দাদা, তুমি—

শৈলেন। আমি কিছুমাত্র অত্যুক্তি করছি না। দরকার হয় আমি এখনি ফটিকের ঘুম ভাঙিয়ে তার সামনে তোমার একটা কবিতা আবৃত্তি করে একথা প্রমাণ করে দিতে পারি। তাছাড়া ‘মন্দাকিনী’র সম্পাদক বিজন বোস এই কাব্যখানির যে মর্মস্পর্শী সমালোচনা করেছিলেন—

ঊষা। তবে যাও—(প্রস্থানোদ্যতা)

ভাগি। ওর নাম কি—যাবেন না। দশানন সীতাহরণ করেছিলেন সেই অপরাধে সাগরের বন্ধন হল। আপনার দাদার ধৃষ্টতার জন্যে আপনি আমাকে শাস্তি দিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন?

ঊষা। (ফিরিয়া আসিয়া চেয়ারে বসিয়া) বেশ, যত ইচ্ছে বলে যাও। আমি ওসব গ্রাহ্য করি না।

ভাগি। এই তো চাই। সমালোচনা গায়ে মাখতে নেই; সমালোচককে জব্দ করবার ঐ একমাত্র উপায়।—আমার যখন বয়স অত্যন্ত কম তখন একবার নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে একটা আস্ত ডিম খোলাসুদ্ধ কচমচিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলাম। তারপর থেকে আমার সামনে ডিমের নাম উচ্চারণ করলেই আমার মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করত এবং নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করত। কিন্তু এখন দেখুন, আমার চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ মুর্গী এবং হাঁস অনবরত ডিম পাড়তে থাকলেও আমি অবিচলিত হয়ে তা দেখতে পারি। আমার মনে কোনও বিকার উপস্থিত হয় না।

শৈলেন। আচ্ছা ঊষা, বিজন বোসের সঙ্গে যদি তোমার দেখা হয় তাহলে তুমি কি কর?

ঊষা কুঞ্চিতভ্রূ, নীরব।

ভাগি। একথা আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি যে সে ব্যক্তি যতবড় দুর্বৃত্তই হোক না কেন উনি তাকে ক্ষমা করবেন।

ঊষা। কখ্‌খনো না—কখ্‌খনো না। আমি আপনাকে বলছি ভাগিনেয়বাবু, দাদা যদি রাতদিন এই কথা নিয়ে আমাকে জ্বালাতন না করতেন তাহলে হয়তো আমি এই বিজনবাবুকে ক্ষমা করতে পারতুম। কিন্তু—শুনেছি বিজনবাবু দাদার বন্ধু—এঁরা দু’জনে মিলে আমাকে পাগল করে দেবেন।

(ঊষা রোদনোন্মুখী)

ভাগি। (ঊষার পাশে চেয়ার টানিয়া লইয়া) আপনার দাদা যখন সেই নরাধমের বন্ধু তখন আপনার দাদার সম্বন্ধেও আমার ধারণা বদলে গেল। বুঝলাম, উনিও একজন পাষণ্ড। কিন্তু পাপী এবং পাষণ্ডদের ক্ষমা করাই হচ্ছে ধর্ম। ভেবে দেখুন, ইংরেজদের যীশুখ্রীস্ট পর্যন্ত ঐ কথা বলে গেছেন।

ঊষা। যীশুর উপদেশ ইংরেজরা যেমন মানে আমিও তেমনি মানব।

ভাগি। সেটা কি ভাল দেখাবে? আপনি একজন খাঁটি আর্যনারী, নিমাই নিতাই শুক সনকের দেশে আপনার জন্ম। আপনিও যদি কতকগুলো অস্পৃশ্য কদাকার ইংরেজের দেখাদেখি যীশুকে অবহেলা করেন—তাহলে প্রভু নিত্যানন্দ কি মনে করবেন এবং আমাদের এই সনাতন উদার হিন্দুধর্মেরই বা কি গতি হবে?

ঊষা। হয়তো সদ্‌গতি হবে না; কিন্তু সেজন্য আমি চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত হচ্ছি আপনি এঁদের জন্য এত ওকালতি কচ্ছেন কেন?

ভাগি। নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করার যে মহৎ আনন্দ আমি তাই উপভোগ করছি। যে হতভাগা নরপিশাচ আপনার কবিতার নিন্দা করে তার লেখনীর মুখ কালিমালিপ্ত করেছে তার ইহকাল এবং পরকালে অসীম দুর্গতির কথা ভেবে আমি আপনাকে সদয় হতে অনুরোধ করছি।

ঊষা। ভাগিনেয়বাবু, আপনার অনুরোধ এক্ষেত্রে নিস্ফল। এতখানি বাগ্মিতা অনর্থক অপব্যয় করলেন।

ভাগি। আচ্ছা, সে ব্যক্তি অর্থাৎ সেই বিজনবাবু যদি স্বয়ং এসে আপনার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে—তাহলে কি—?

ঊষা। তাহলেও না। বিজনবাবুকে আমি কখনো দেখিনি আর দেখতেও চাইনে। —আসুন, ভেতরে যাই। ফটিক বোধ হয় আমাদের ডাকতে আস্‌ছিল, রাস্তার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঊষা নিষ্ক্রান্ত।

শৈলেন। কি ভাবছ?

ভাগি। (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) ভাবছি যীশুর কথা—Repent! For the kingdom of Heaven is at hand.

(উভয়ে নিষ্ক্রান্ত)

তৃতীয় দৃশ্য

প্রেম কুটিরের সম্মুখ। কাল—অপরাহু। ফটকের একপাশে টুলের উপর বসিয়া ফটিক নিদ্রামগ্ন। আর কেহ কোথাও নাই।

পথ দিয়া একটি চীনা ফেরিওয়ালার প্রবেশ। তাহার পিঠে বস্তা; ফটিককে নিদ্রিত অবস্থায় দেখিয়া সে তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল—ফটিকের মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া নিরীক্ষণ করিল। তারপর বলিল,—গুট মলনিং স্যাল্‌, লিট্‌ল বয়।

ফটিক তথাপি নিদ্রিত। চীনাম্যান তখন নিজের ভাষায় কি বলিয়া হি হি করিয়া হাসিল। তারপর পকেট হইতে একটি কাঠি বাহির করিয়া ফটিকের নাকে দিল। ফটিক হাঁচিয়া ফেলিল এবং পরক্ষণেই জাগিয়া উঠিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

চীনা। নো ক্লাই—গুটম্যান চায়নাম্যান।

ফটিক। হু—হু—হু—(ক্রন্দন)

চীনা। (বিস্মিত ও বিপন্ন) নো ক্লাই লিত্‌ল্‌ বয়—নো ক্লাই—লাফ্‌। আই ফানি চায়নাম্যান—হি হি হি হি—লাফ্‌।

ফটিক। (পূর্ববৎ) হু—হু—হু—

(ক্রন্দন)

চীনা। (ঝুলি হইতে চুষিকাঠি বাহির করিয়া) তেক—গুট বয়—নো ফিয়াল, আই ফানি চায়নাম্যান—

ফটিক। (চুষিকাঠি গ্রহণ ও ক্রন্দন) হু—হু—হু—

পরিতোষবাবু। (নেপথ্যে) ফটিক! ফটিক!

পরিতোষবাবু প্রবেশ করিলেন। সম্মুখে চীনাম্যান দেখিয়া স্তম্ভিত।

চীনা। গুট মলনিং স্যাল—আই চিনী হকার গুট ম্যান—

ফটিক। হু—হু—

পরি। ঘোড়ার ডিম—এ যে ভীষণ ব্যাপার। ফটিক, তোকে মারপিট করছে নাকি?

চীনা। নো স্যাল, আই নো বিট লিতল বয়। আই কম—হি শ্লীপ, আই ওয়েক হিম—হি ক্লাই হু হু হু;—আই গিফ হিম নাইছ তয়, হি ক্লাই হু হু হু; আই পুয়োল চায়নাম্যান—হেলপ-লেছ! (হতাশ মুখভঙ্গি করিল)

পরি। হুঁ। ঘোড়ার ডিম ব্যাপার বড় সুবিধের বোধ হচ্ছে না। একেবারে খাঁটি জাপানী স্পাই। ঘোড়ার ডিম—কি করা যায়! ফটিক, তুই যা, চট করে আমার লাঠিটা নিয়ে আয়।

(ফটিকের প্রস্থান)

চীনা। বয় ভেলি সরি স্যাল—ক্লাই, আই গিব হিম তয়—নাউ হি প্লে, হ্যাপি—লাফ্‌ হি হি হি—

পরি। হুঁ—লাফ হি হি হি ঘোড়ার ডিম। তোমার মতলব কি আর আমি বুঝিনি? চুষিকাঠি ঘুষ দিয়ে ঘোড়ার ডিম বাড়ির মধ্যে ঢোকবার ফিকির করেছিলে!

চীনা। ইয়েস স্যাল—আই ব্লিং ভেলি নাইছ টিংস—সিল্ক, তয়, লিবন—ভেলি চীপ—

পরি। (দৃঢ়ভাবে) জাপানী সায়েব, তুমি ঘোড়ার ডিম সটান হিঁয়াসে চলা যাও। হিঁয়া ওসব চালাকি নেই চলেগা—

চীনা। ভেলি গুট স্যাল, আই গট জাপানী সিল্ক—

(বস্তা নামাইল)

পরি। নো নো সায়েব, তুম ন্যাকা সাজতা হায় কাহে? ঘোড়ার ডিম, তুম শিগ্‌গির চলা যাও—নেই তো ঘোড়ার ডিম—

চীনা। ভেলি গুট স্যাল—(বস্তা তুলিয়া) আই গো ইন স্যাল—শো বিউটিফুল টিংস—সিল্ক, তয়, লুকিং গ্লাস—(ফটকের ভিতর প্রবেশের উদ্যোগ)।

পরি। (চিৎকার করিয়া) ওরে ফটিক। শিগ্‌গির লাঠি নিয়ে আয়—ঘোড়ার ডিম—জাপানীটা ঘরে ঢুকতে চায়, এখনি বাড়ির প্ল্যান তৈরি করে ফেলবে ঘোড়ার ডিম—

(ঊষা ও লাঠি হস্তে ফটিকের প্রবেশ)

ঊষা। কি হয়েছে মামা—

পরি। (লাঠি হাতে লইয়া) ঘোড়ার ডিম একটা জাপানী স্পাই জোর করে বাড়ি ঢুকতে চায়। শৈলেনটাও যে ছাই এই সময় বেড়াতে গেল। নাউ—ঘোড়ার ডিম—গো—

চীনা। (টুপিতে হাত দিয়া সহাস্যে) গুট মলনিং ম্যাদাম্‌। আই নো জ্যাপ, আই চায়নাম্যান—ভেলি গুট চায়নাম্যান—হংকং চায়নাম্যান—(খানিকটা চীনাভাষায় কথা কহিল) আই নো দালতি (dirty) জ্যাপ, ব্যাড ম্যান জ্যাপ (নাক সিঁটকাইল)

ঊষা। মামা, ও জাপানী হতে যাবে কেন? ও তো চীনে ফেরিওয়ালা।

পরি। না না, তুমি বোঝ না ঊষা। ঘোড়ার ডিম একেবারে খাঁটি জাপানী গুপ্তচর। গোঁফ দেখছ না, একদম পুরোদস্তুর সমুরাই প্যাটার্নের—জেনারেল নোগুচির মতো।

ঊষা। সব চীনেম্যানেরই তো ঐ রকম গোঁফ হয়।

পরি। ঘোড়ার ডিম তুমি কিছু জানো না। সব চীনাম্যানের গোঁফ তুমি দেখেছ?

চীনা। লিবন ম্যাদাম, ভেলি গুট্‌ লিবন—লেদ্‌ ব্লু গ্লীন—সিল্ক লিবন ভেলি চীপ্‌।

ঊষা। আসুক না মামা, ভেতরে, রিবন আছে বলছে—আমার কিছু রিবনের দরকার, আর যদি পছন্দসই ব্লাউজের সিল্ক থাকে—

পরি। ঘোড়ার ডিম, মেয়েমানুষের কাছে সিল্ক আর গয়নার নাম করলে আর তাদের জ্ঞান থাকে না। তুমি কি ভেবেছ ওর ওই বস্তায় সিল্ক আর রিবন আছে। মোটেই নয় ঘোড়ার ডিম।

ঊষা। তবে কি আছে?

পরি। গোলা বারুদ বোমা, ঘোড়ার ডিম আরো কত কি।

ঊষা। (হাসিয়া ফেলিয়া) তা ও গোলা বারুদ ঘাড়ে করে বেড়াচ্ছে কেন?

পরি। তা কি ঘোড়ার ডিম বলা যায়? ওর মতলব হচ্ছে বাড়িতে ঢুকে বাড়ির প্ল্যান তৈরি করা।

ঊষা। সে কি! কেন?

পরি। তাই যদি বুঝতে পারবে ঘোড়ার ডিম তবে আর ভাবনা কি! জাপানী গভর্নমেন্ট কি ঘোড়ার ডিম ঘাস খায়! তারা ভীষণ ষড়যন্ত্র আঁটছে। আজ নয় কাল তারা ভারতবর্ষ আক্রমণ করবেই।

ঊষা। তা করুক, কিন্তু তাই বলে মামা, চীনে ফেরিওয়ালা বাড়ি ঢুকতে পাবে না?

পরি। না না, ঘোড়ার ডিম ঊষা, তুমি বাড়ির ভেতরে যাও, আমি ব্যাটাকে বিদেয় করছি। (লাঠি নাড়িয়া) জাপানী সাহেব, আমি তোমার ফন্দি বুঝে নিয়েছি, তুমি ঘোড়ার ডিম চট্‌পট্‌ সরে পড়।

চীনা। (লাঠি নিরীক্ষণ করিয়া) স্তিক্‌? আই গট্‌ নো স্তিক্‌। বট গুট দ্যাগাল্‌, সোল্‌দ্‌ দ্যাগাল্‌,—নাইছ—সি?

পরি। শুনলে তো? ঘোড়ার ডিম তলোয়ার ছোরা ছুরি নিয়ে বেড়াচ্ছে, সাংঘাতিক ব্যাপার ঘোড়ার ডিম; তাড়ালেও যায় না যে!

চীনা। কম্ সি, ভেলি নাইছ দ্যাগাল্‌—বিউটিফুল।

(ভিতরে প্রবেশের উদ্যোগ)

পরি। ওরে ঘোড়ার ডিম। এ যে নাছোড়বান্দা স্পাই; ভেতরে ঢুকবেই। সায়েব, হাম বুড়া আদমি হ্যায়, তার ওপর কোমরে ব্যথা কিন্তু যদি জবরদস্তি কর তাহলে এই লাঠি ঘোড়ার ডিম মাথায় বসিয়ে দেব। (লাঠি ঘুরাইতে লাগিলেন)

চীনা। হোয়াৎ! বিৎ মি? (বস্তা ফেলিয়া) কামান (মুষ্টি ঘুরাইতে লাগিল)

পরি। ঘোড়ার ডিম!

ফটিক উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিল, পরিতোষবাবু লাঠি ঘুরাইতে লাগিলেন, চীনাম্যান মুষ্টি ঘুরাইয়া নাচিতে লাগিল। ঊষা স্তম্ভিতবৎ দাঁড়াইয়া রহিল। ভাগিনেয় প্রবেশ করিল।

ভাগি। এ কি! ব্যাপার কি! Open air vaudeville হচ্ছে নাকি?—ফটিক, স্তব্ধ হও। (ফটিক নীরব হইল) এটা কি হচ্ছে বলুন দেখি!

ঊষা। মামা চীনাম্যানকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন।

ভাগি। আরে তাইতো। এ যে ফিচিং সায়েব দেখছি।—ওহে ফিচিং, নিরস্ত হও। পরিতোষবাবু, লাঠি নামান।

পরি। ঘোড়ার ডিম ভাগিনেয়, লোকটা দুর্দান্ত গুপ্তচর। জোর করে বাড়ি ঢুকতে চায়।

ভাগিনেয়কে দেখিয়া চীনাম্যানের মুখ প্রশান্ত হাসিতে আরো থ্যাবড়া হইয়া গেল।

চীনা। গুট মলনিং পীজনবাবু, আই লিংচু, নো ফিচিং—

ভাগি। হ্যাঁ হ্যাঁ লিংচু। তুমি ক্রোধ সম্বরণ কর। (হস্ত উত্তোলন, লিংচু মুষ্টি নামাইল, পরিতোষবাবু লাঠি নামাইলেন) এইবার ঘটনাটা বলুন তো, আপনাদের মনোমালিন্য কিসের জন্য? ফিচিং সাহেব কি আরসোলা দাবি করেছে? তা যদি করে থাকে—

পরি। ঘোড়ার ডিম আরসোলা নয়, ও আমার বাড়ির প্ল্যান তৈরি করতে চায়।

ভাগি। প্ল্যান! কি উদ্দেশ্যে? ফিচিং, তুমি কি সরকারী সারভেয়র হয়েছ? প্ল্যান তৈরি করতে চাও কেন?

চীনা। পীজনবাবু, হি ত্রাই বিৎ মি, স্তিক; আই সে—কামান! (হস্ত ঘূর্ণন)

ভাগি। বেশ বেশ, তুমি বীরপুরুষ। এখন ঠাণ্ডা হও।

ঊষা। ও আপনাকে পীজনবাবু বলে ডাকছে কেন?

ভাগি। (ঘাড় চুলকাইয়া) মানে ফিচিং সায়েব আমাকে বড় ভালবাসে। ওর কাছ থেকে একটা সিগারেট কেস কিনেছিলুম, সেই থেকে প্রণয়।

ঊষা। কিন্তু তাই বলে পীজনবাবু বলবে?

ভাগি। তা জানেন না? চীনেরা যাকে ভালবাসে তাকে পীজন বলে ডাকে। প্রেমের পায়রা আর কি।

চীনা। ইয়েছ, পীজনবাবু ভেলি গুটম্যান—

ভাগি। (অস্ফুট স্বরে) নাঃ তোমাকে বিদেয় করতে হচ্ছে, তুমি এখনি সব মাটি করবে। চল ফিচিং, আমার বাড়ি; অনেক জিনিস কেনবার আছে—

পরি। হ্যাঁ হ্যাঁ ভাগিনেয়, তুমি ওকে তাড়াও নইলে ঘোড়ার ডিম ভীষণ গোলমাল বাধাবে।

ঊষা। কিন্তু আমি যে রিবন কিন্‌ব মামা—আর, কিছু সিল্ক—

চীনা। ইয়েছ, লিবন ভেলি ফাইন্‌ লিবন, লেদ্‌ ব্লু গ্লীন্‌—

ভাগি। তাইতো। এখন কি করা যায়? তাড়াবো কি তাড়াবো না? (চিন্তা) আচ্ছা, ঠিক হয়েছে—চল চিংফু তুমি আমার বাসায়; তারপর তোমার ঝোলায় কত রিবন আর সিল্ক আছে দেখা যাবে।

পরি। সাবধান! ও ঝোলায় ঘোড়ার ডিম স্রেফ গোলা বারুদ আছে।

ভাগি। কুছ পরোয়া নেই। গোলা বারুদ সব আমি বাজেয়াপ্ত করে কেল্লায় পাঠিয়ে দেব।

ঊষা। কিন্তু—

ভাগি। আপনি ভাববেন না। চিংফুর ঝোলায় যতক্ষণ এক টুকরো রিবন আছে ততক্ষণ আমার হাতে ওর নিস্তার নেই—ঝোলা উজোড় করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। (লিংচুর গলদেশে হস্তাৰ্পণ করিয়া) চিংফু, চল তো যাদু—

চীনা। (প্রসন্ন হাস্যে) পীজনবাবু গুটম্যান—বাই সিগালেট্‌ কেস—পীজনবাবু—

ভাগি। চোপ রও। ফের পীজনবাবু বলেছ তো ঘাড় মটকে দেব।

পরি। কিন্তু ভাগিনেয়, সাবধানে থেকো ঘোড়ার ডিম—

ভাগি। আজ্ঞে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—গোলা বারুদ আমার কিছু করতে পারবে না। চিংফুর পায়রা-প্রণয়কেই ভয় বেশী। চল চিংফু—আর নয় (লিংচুকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া প্রস্থান)

পরি। নাঃ ঘোড়ার ডিম, ভাগিনেয় কাজের লোক আছে। ঊষা, তোমাকে ঘোড়ার ডিম সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাবার অনুমতি চাইছিল, না? তা তুমি যেতে পার। ছোকরা তালেবর আছে—ও না এসে পড়লে ঘোড়ার ডিম জাপানীটা প্ল্যান তৈরি করে তবে ছাড়ত।

ঊষা। হ্যাঁ মামা।

(সকলের প্রস্থান)

চতুর্থ দৃশ্য

পরিতোষবাবু ও শৈলেন ড্রয়িং-রুমে আসীন। দু’জনের হাতে চায়ের বাটি। কাল প্রভাত। ঊষা একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমায় তাই এখনো যোগ দিতে পারে নাই।

পরি। এ ক’দিন ঘোড়ার ডিম তোমার ভাব দেখে তো এমন কিছু বোধ হল না যে তুমি ওকে আগে থাকতেই চেন। —তা কথাবার্তা যদিও একটু অদ্ভুত রকমের তবু ছোকরাটি মন্দ বোধ হল না। বিশেষত জাপানীটাকে সেদিন যেভাবে তাড়ালে। বড়ঘরের ছেলে, পয়সা আছে বলছ। বদ্‌খেয়ালের মধ্যে বাঙলা কাগজ চালায়। তা—সে ঘোড়ার ডিম বড়মানুষের ছেলেদের একটা বাতিক না থাকলে সময় কাটবে কি করে? আমি ‘জাপানী গুপ্তচর’ বলে যে প্রবন্ধটা লিখছি সেটা না হয় ওর কাগজেই দেব। কি নাম বললে কাগজখানার?

শৈলেন। ঊষার কাছে এখন ফাঁস করে দিও না—‘মন্দাকিনী’।

পরি। তা দেব না। কিন্তু তোমরা দুই বন্ধুতে মিলে ঘোড়ার ডিম—মেয়েটার বিরুদ্ধে কোন রকম ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছ না তো?

শৈলেন। তুমি কি পাগল হয়েছে মামা! আসল কথা, বিজন ভয় কচ্ছে যে, ঊষা যদি আগে জানতে পারে যে ও-ই বিজন বোস তাহলে হয়তো—যাক, তোমার অমত নেই তো?

পরি। ছোকরা দেখতে শুনতে তো মন্দ নয়—তা ঊষার যদি ওকে পছন্দ হয় তাহলে—

শৈলেন। থামো—ঊষা আসছে।

দু’জনে চায়ের বাটিতে মনোনিবেশ করিলেন।

(ঊষার প্রবেশ)

ঊষা। বড্ড দেরি হয়ে গেছে, না? কি যে আমার ঘুম, সাতটার আগে কিছুতেই ভাঙে না। ফটিক কৈ?

শৈলেন। তাকে পাঠিয়েছি ভাগিনেয়বাবুকে ডেকে আনতে। ওর পাগলাটে ধরনের কথাবার্তা আমার বেশ লাগে।

ঊষা। (ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া) পাগলাটে ধরনের!

শৈলেন। তা নয় তো কি! আমার বোধ হয় লোকটির মাথায় একটু ছিট্‌ আছে।

ঊষা। (মনে মনে ক্রুদ্ধ হইয়া) ভারি তো জানো তুমি! তোমার—তোমার বন্ধু ঐ অজিত গুহর চেয়ে ঢের ভাল।

শৈলেন। (চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া) অজিতের চেয়ে ভাল। কিসে শুনি? রূপে, না গুণে, না বিদ্যায়!

ঊষা। সব তাতেই। তোমার বন্ধুদের মধ্যে এমন একটাও নেই—(বলিতে বলিতে হঠাৎ মহা লজ্জায় থামিয়া গেল)

পরি। কি বলে ভাল, যদি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তুলনায় সমালোচনাই করতে হয় শৈলেন, তাহলে ঘোড়ার ডিম একথা না মেনে উপায় নেই যে ঐ অজিত গুহটা আস্ত জিরাফ, অশোক সান্ডেলটা নিরেট গুণ্ডা, অসিত সামন্তটার যেমন ভালুকের মতো চেহারা তেমনি উল্লুকের মতো বুদ্ধি—আর ঐ কিংশুক গুপ্তটা—ওটাকে দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।

ঊষা। (সোৎসাহে) আমারও—

শৈলেন। আসল কথা, তোমরা আমার বন্ধুদের দেখতে পারো না।

ঊষা। আর মামা—সেই মীনধ্বজ হালদার—!

পরি। সেটাকে ঘোড়ার ডিম শিম্পাজি বললে শিম্পাজির মানহানি করা হয়।

ঊষা। আর জানো মামা, এঁরা সব কেউ এক বর্ণ বাঙলা লিখতে জানেন না।

পরি। সব ঘোড়ার ডিম আন্‌কোরা গোরার বাচ্চা কিনা!

শৈলেন। ওরা সব ইংরিজী শিক্ষা পেয়েছে—তাই—

পরি। আমরাও তো ইংরিজী শিক্ষাটা—আসটা পেয়েছি রে বাপু; ঊষাও তো ঘোড়ার ডিম জুতোটা মোজাটা পরে, চা বিস্কুটও খায় আর ইংরিজীতে তোমার ঐ সবকটা বন্ধুর ঘোড়ার ডিম কান কেটে নিতে পারে। কিন্তু কৈ, অমন ট্যাশফিরিঙ্গ তো হয়ে যায়নি। তুমিও তো ঘোড়ার ডিম টেবিলে বসে খানা ডিনার খেয়ে থাকো, কিন্তু তাই বলে কি বাঙলা কথা ভুলে গেছ?

ঊষা দাদার বন্ধুদের এই লাঞ্ছনা খুব উপভোগ করিতেছিল। দাদার উপর প্রতিশোধ তুলিবার এত বড় সুযোগ সে বড় পায় না। তাই তার এত আমোদ।

সে গম্ভীর মুখে বলিল, ‘এক কথায় দাদার বন্ধুগুলো সব একদম রদ্দি।’

শৈলেন। সব বন্ধু—একটাও বাদ নয়?

ঊষা। একটাও বাদ নয়।

শৈলেন। (দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া) আচ্ছা বেশ, এর বিচার পরে হবে।

(ভাগিনেয় বোসের প্রবেশ)

ভাগি। মাফ করবেন, আপনারা বোধ হয় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?

শৈলেন। বোধ হয় কি রকম—নিশ্চয়ই ডেকে পাঠিয়েছিলুম।

ভাগি। ঠিক ধরেছি তাহলে। চা খাবার আগে একটু বেড়িয়ে আসব বলে বেরুচ্ছি দেখি আপনার ফটিক আমার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। আন্দাজে ব্যাপারটা বুঝে নিলুম। পাশ কাটিয়ে সটান এখানে চলে এসেছি। তার কাঁচা ঘুম ভেঙে দেবার আর প্রবৃত্তি হল না। সে বোধ হয় নিদ্রিত অবস্থায় এখনো আমার সিংহদ্বারে পাহারা দিচ্ছে।

পরি। বোসো বোসো ভাগিনেয়; ঊষা, চা দাও।

ভাগিনেয় উপবিষ্ট হইল।

শৈলেন। (সহসা) আপনি বাঙলা জানেন?

ভাগি। (অবাক হইয়া কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া) ওর নাম কি, এতক্ষণ কি আমি না জেনে চীনে ভাষায় কথা কইলাম!

ঊষা। দাদার যত সব অদ্ভুত কথা।

শৈলেন। অর্থাৎ আমি জানতে চাই আপনি বাঙলায় পদ্য লিখতে পারেন কিনা?

ভাগি। একবার এক বন্ধুর বিয়েতে লিখেছিলাম কিন্তু ছাপা হয়নি।

ঊষা। (সাগ্রহে) কি পদ্য বলুন না!

ভাগি। তার প্রথম দু’ছত্র কেবল মনে আছে—

‘গজুর অদ্য বিবাহ।

পদ্মবনে ঢুকিবে একটি বরাহ—’

(পদ্য শুনিয়া ঊষা মুষড়িয়া গেল)

শৈলেন। (খুশি হইয়া) খাসা পদ্য তো! আপনিও দেখছি তাহলে একজন কবি। অবশ্য ঠিক ঊষার সঙ্গে এক শ্রেণীর না হলেও—

ঊষা। দাদা—ফের—

শৈলেন। না না, তোমার সঙ্গে যে ভাগিনেয়বাবুর তুলনাই হয় না সে আমি জানি—

ঊষা। দাদার কথা শুনবেন না, খালি আমাকে জ্বালাতন করবার চেষ্টা। আপনি নিশ্চয় ভাল কবিতা লিখতে পারেন। দাদার বন্ধুরা কেউ এক অক্ষর বাঙলা লিখতে জানে না। আচ্ছা, আপনার লেখা একটা ভাল পদ্য বলুন না।

ভাগি। দেখুন, আমি যে ভাল পদ্য লিখতে পারি এটা আপনার মুখ থেকে শুনলাম বলেই সত্য বলে বিশ্বাস হচ্ছে। এবং আপনার দাদার বন্ধুরা যা পারে না আমি তাই পারি, একথা প্রমাণ করবার জন্যে যদি আমাকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে হয় তাতেও আমি প্রস্তুত আছি—পদ্য লেখা তো দূরের কথা।

ঊষা। (সোল্লাসে) আচ্ছা, বেশ। তাহলে একটা বেশ ভাল—এই ভালবাসার পদ্য বলুন।

শৈলেন। ভাগিনেয়বাবু, কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আপনি যদি আর কোনও কবির কাব্য নিজের বলে এখানে চালিয়ে দেন, তাহলে তস্কর বলে আপনাকে সনাক্ত করবার ক্ষমতা আমাদের কারুর নেই—এক ঊষা ছাড়া, কিন্তু ঊষার ভাবগতিক দেখে বোধ হচ্ছে সে আপনাকে ধরিয়ে দেবে না।

ভাগি। কি করতে হবে বলুন? সকল রকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্যে আজ আমি বদ্ধপরিকর।

শৈলেন। আপনাকে একটি ইংরিজী কবিতা তর্জমা করতে হবে।

ভাগি। বেশ কথা। কবিতা বলুন।

শৈলেন। ঊষা, বিষয় নির্বাচনের ভার তোমার ওপর। তুমি একটা কবিতা বল।

ঊষা। (কিছুক্ষণ ভাবিয়া তারপর লজ্জিত নতমুখে)

When we two parted

In silence and tears

Half broken-hearted

To sever for years—

তারপর আর—তারপর আর মনে পড়ছে না—

শৈলেন। Pale grew the cheek and cold

Colder thy kiss

Truly that hour foretold

Sorrow to this!

ভাগি। কঠিন পরীক্ষা। আচ্ছা, কাগজ-কলম দিন।

পরি। ঘোড়ার ডিম। এইখানে বসে বসেই পদ্য লিখবে নাকি?

ভাগি। আজ্ঞে হ্যাঁ। ফটিক যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমুতে পারে তখন আমি বসে বসে পদ্য লিখব এ আর বিচিত্র কি?

ঊষা কাগজ পেনসিল আনিয়া দিল ও উৎসুক হইয়া লিখনরত ভাগিনেয়ের প্রতি চাহিয়া রহিল…ভাগি। হয়েছে। ঠিক যে বায়রণের যোগ্য হয়েছে তা বলতে পারি না—তবু, আচ্ছা শুনুন—

যখন মোরা দোঁহে বিদায় নিয়েছিনু

নীরব নীর-নত চোখে,

আধেক ভাঙা বুকে সুখের স্মৃতি লয়ে

সাঁঝের ম্লান দিবালোকে;

কপোল হল তব পাংশু হিমবৎ

অধর হল হিমতর,

তখনি জানিলাম সুখের বিভাবরী

পোহাবে ব্যথা জরজর।

ঊষা। (মুগ্ধভাবে ক্ষণকাল নীরব) চমৎকার হয়েছে। এমন কি ছন্দটি পর্যন্ত!

শৈলেন। ও কিছুই হল না,

Truly that hour foretold

Sorrow to this—ওর কি এই তর্জমা!

ঊষা। আপনি দাদার কথা শুনবেন না, সত্যিই ভারী সুন্দর হয়েছে।

ভাগি। (পরিতোষবাবুর দিকে ফিরিয়া) আপনি কি বলেন?

পরি। ও ইংরিজী বাঙলা কোনটারই ঘোড়ার ডিম কিছু মানে হয় না।

ভাগি। যাক, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সমালোচনা দুই ভাগে বিভক্ত, একজন বলছেন চমৎকার হয়েছে আর একজন বলছেন কিছুই হয়নি। এক্ষেত্রে যিনি কবি আমি তাঁর মন্তব্যটি গ্রহণ করলাম। কারণ শাস্ত্রে বলেছে ‘কবিতারসমাধুৰ্য্যং কবিৰ্বেত্তি’—

শৈলেন। ঊষার মন্তব্য কিন্তু অন্য রকম হত যদি আপনি না লিখে আমার কোনো বন্ধু ঐ কবিতাটি লিখতেন।

ঊষা। (আরক্তিম হইয়া) তার মানে?

ভাগি। মানে অতি সহজ—কবিকে না জানলে তাঁর কাব্য বোঝবার সুবিধা হয় না। আপনি আমাকে জানেন বলেই এত সহজে আমার কবিতাটি উপভোগ করতে পারলেন। ধরুন, আপনাকে জানবার আগে যদি আমি আপনার ‘অস্ফুট’ নামক ঐ অপূর্ব কাব্যগ্রন্থটি পড়তাম; হয়তো ভাল না বুঝতে পেরে, সম্যক রসগ্রহণ না করে আমি ওটির নিন্দা করতাম। কিন্তু সে সমালোচনা কি যথার্থ হত? কখনই না!

শৈলেন। আপনার যুক্তির মধ্যে একটুখানি গলদ রয়ে গেল। তা থাক, আমাকে এবার একবার উঠতে হবে, গোটা কয়েক চিঠি লেখা দরকার। মামা, তুমিও উঠছ নাকি?

পরি। ঘোড়ার ডিম হ্যাঁ। কোমরটাতে মালিশ করাতে হবে, সেই ব্যথাটা এখনো গেল না। দেখি ফটিক এলো কিনা।

(প্রস্থান করিলেন)

শৈলেন। ঊযা, ভাগিনেয়বাবু তাহলে তোমার জিম্মায় রইলেন। দুই কবিতে যত ইচ্ছা কাব্য-চর্চা হোক কিন্তু আমার বন্ধু বাঙলা লিখতে পারে না একথাটা ভবিষ্যতে আর বোলো না।

(নিষ্ক্রান্ত)

ঊষা ও ভাগিনেয় কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিল। ঊষার বুকের ভিতরটা দুরদুর করিতে লাগিল। এই লোকটির সহিত একলা থাকিলেই ঊষার ঐ রকম হয়।

ভাগি। কাল-পরশুর মতো চলুন আজ বিকেলেও কোনও দিকে বেড়িয়ে আসা যাক।

ঊষা। (নিম্নস্বরে) আজ কোনদিকে যাবেন?

ভাগি। যেদিকে হয়। সোজা একটা রাস্তা ধরে শহর-বাজার পার হয়ে এমন কোথাও গিয়ে পৌঁছনো যাক যেখানে মানুষ নেই, গরু-ভেড়া নেই, শুধু আমি আর—শুধু দু’জন পথিক—

ঊষা। আর যদি বাঘ থাকে?

ভাগি। থাকুক বাঘ। বাঘ না থাকলে পথিক দু’জনের আনন্দ-যাত্রাপথে বৈচিত্র্য আসবে কোথা থেকে? বাঘ থাকাই চাই।

ঊষা। সেদিন দিঘড়িয়া পাহাড়ে বাঘের নামে কিন্তু বৈচিত্র্যের বদলে আতঙ্কই এসেছিল।

ভাগি। (কিছুক্ষণ সুখ-চিন্তায় নিমগ্ন থাকিয়া) ওঃ—দিঘড়িয়া পাহাড়! চলুন, আজ সেইখানেই যাওয়া যাক। —আচ্ছা ঊষা—(বলিয়াই সহসা থামিয়া গিয়া) রাগ করলে নাকি? (ঊষা মাথা নাড়িল) আমি তোমার চেয়ে বয়সে অন্তত সাত আট বছরের বড়, তার ওপর তোমার দাদার—ইয়ে—সমবয়সী। আর আমাদের আলাপও হল প্রায়—ক’দিন হল ঊষা?

ঊষা। (মৃদুস্বরে) আজ নিয়ে ন’দিন।

ভাগি। ন’দিন! দু’দিন নয়, চারদিন নয়; এক হপ্তা নয়—পুরো ন’দিন! সুতরাং তোমাকে আমি ঊষা বলেই ডাকব, আর ‘আপনি’ বলতে পারব না। —হ্যাঁ, কি কথা হচ্ছিল?

ঊষা। দিঘডিয়া পাহাড়।

ভাগি। হ্যাঁ, দিঘড়িয়া পাহাড়। চল, আজ সেখানেই যাওয়া যাক।

ঊষা। এত জায়গা থাকতে আজ সেখানে কেন?

ভাগি। সেখানে—আমার টুপি হারিয়ে গেছে খুঁজে দেখতে হবে।

ঊষা। (হাসিয়া) আপনার টুপি আর খুঁজে পাবেন পাবেন না।

ভাগি। পাব না? বেশ, কিন্তু আর কিছু যদি হারিয়ে থাকে সেটা তো খোঁজা দরকার।

ঊষা! (আরক্তিম নতমুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া) না, আমি ওখানে যাব না। আমার বড্ড ভয় করবে। কি জানি যদি ফের কোনও রকম দুর্ঘটনা হয়?

ভাগি। (অনেকক্ষণ ঊষার মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া) সম্প্রতি তোমার ভাগ্যে একটা গুরুতর দুর্ঘটনা ছাড়া আর কোনও আশু বিপদ তো আমি দেখছি না?

ঊষা। (সকৌতুকে) আপনি হাত গুনতেও জানেন নাকি?

ভাগি। জানি বৈকি।

ঊষা। (করতল প্রসারিত করিয়া) কৈ, গুনুন দেখি আমার হাত। কি দুর্ঘটনা হবে শুনি।

ভাগি। (ঊষার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া পরীক্ষা করিয়া গম্ভীর ভাবে) শিগ্‌গির তোমার বিয়ে হবে—

ঊষা। (হাত টানিয়া লইবার চেষ্টা করিয়া) যান!

ভাগি। তোমার দাদার এক বন্ধুর সঙ্গে—

ঊষা। (রাগ করিয়া) ছেড়ে দিন—আমার হাত দেখতে হবে না।

ভাগি। বেশ, ছেড়ে দিচ্ছি—(ঊষার করতলে একটি চুম্বন করিয়া হাত ছাড়িয়া দিল)

ঊষা। (ক্রন্দনোন্মুখী হইয়া) আর আমি আপনার সঙ্গে কখ্‌খনো—

ভাগি। কখ্‌খনো ছেলেমানুষি কোরো না। যেটা নিলাম ওটা গণৎকারের দক্ষিণা।—ঊষা, একটা ভারী গোপনীয় কথা তোমায় বলব?

ঊষা। আমি শুনতে চাই না—

ভাগি। তুমি না চাইলেও আমি বলবই। —ঊষা, আমাকে বিয়ে করবে?

ঊষা। যাও!

(ঊষা দু’হাতে মুখ ঢাকিল)

ভাগি। ঊষা—

ঊষা। যাও।

ভাগি। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) বারবার যাও বলছ? বেশ, চললাম। (দ্বার পর্যন্ত গিয়া) একটা গুরুতর অপরাধ স্বীকার করবার ছিল—তা আর হল না।

ঊষা। কি অপরাধ শুনি!

ভাগি। (ফিরিয়া আসিয়া) আগে বল আমায় বিয়ে করবে?

ঊষা। না।

ভাগি। করবে না?

ঊষা। না।

ভাগি। দু’বার না বললে। বারবার তিন বার বললেই বুঝব মনের কথা বলছ। বিয়ে করবে না?

(ঊষা নীরব। ভাগিনেয় দু’হাত ধরিয়া ঊষাকে জোর করিয়া তুলিল)

ভাগি। ঊষা—

ঊষা। আগে শুনি কি অপরাধ।

ভাগি। আগে বল রাগ করবে না।

ঊষা। আগে শুনি।

ভাগি। আচ্ছা বলছি। রাগ করলেও এখন তো আর কথা ফিরিয়ে নিতে পারবে না—বিয়ে করতেই হবে। ঊষা, আমার নাম ভাগিনেয় নয়, আমার নাম—বিজন বোস।

ঊষা। (বিস্ফারিত নেত্রে) তুমি—আপনি—তুমি আপনি—

ভাগি। তুমি—তুমি। ‘আপনি’ নয়।

ঊষা। তুমি—দাদার বন্ধু—

বিজন। হ্যাঁ। বলেছিলাম কিনা গণনা করে যে তোমার দাদার বন্ধুর সঙ্গে শিগ্‌গির তোমার বিয়ে হবে?

ঊষা। তুমি ‘মন্দাকিনী’র—

বিজন। হতভাগ্য সম্পাদক।

ঊষা। যাও, তোমার সঙ্গে আর একটি কথাও কইব না।

বিজন। কথা কইবে না? তুমি জানো এই ক’দিনে আমি ‘অস্ফুট’ থেকে সমস্ত কবিতা আগাগোড়া মুখস্থ করে ফেলেছি। সত্যি বলছি ঊষা, তোমাকে যতদিন না চিনতাম ততদিন তোমার কাব্যের সৌরভ আমার প্রাণে গিয়ে পৌঁছোয়নি। এখন বুঝতে পেরেছি, আধফুটন্ত অপরিণত প্রাণের কী তরল মধুর সীধু ঐ বইখানির মধ্যে ভরা আছে। শুনবে? আচ্ছা—‘আশ্রয় যাঞ্চা’ কবিতাটি আবৃত্তি করছি—

ঊষা। (বিজনের মুখ চাপিয়া ব্যাকুলভাবে) না—না তুমি থামো—

(সহসা শৈলেনর প্রবেশ। ঊষা লজ্জায় জড়সড়)

শৈলেন। এ কি! কবি আর সমালোচকে দিব্যি ভাব হয়ে গেছে দেখছি যে!

বিজন। কবি আর সমালোচকে যেখানে মিলন হয়, সে স্থান মহাপুণ্যতীর্থে পরিণত হয়—মানো কি না?

শৈলেন। নিশ্চয় মানি।

বিজন। ব্যস। আজ থেকে দেওঘরও এক মহাতীর্থ হল।

ঊষা। দাদা, কি দুষ্টু তুমি! আগে যদি জানতে পারতুম—তাহলে কিন্তু—

শৈলেন। (ঊষার গালে আঙ্গুলের টোকা মারিয়া) আগে জানলে সমস্ত ভেস্তে যেত—না? —ঊষা, আমার সব বন্ধুরাই একদম রদ্দি—কি বলিস্‌?

ঊষা। (বিনতভুবনবিজয়ীনয়না) একদম রদ্দি!

শৈলেন। আমাকে একবার পোস্ট-অফিসে যেতে হবে। বিজন, আসছ নাকি?

বিজন। তুমি এগোও। সামান্য একটু কাজ সেরে আমি এই এলাম বলে।

(শৈলেন প্রস্থান করিল)

বিজন। (ঊষার খুব কাছে গিয়া) সামান্য কাজটুকু সেরে নিতে পারি।

ঊষা। (বুকে মুখ গুঁজিয়া) না—

বিজন দুই আঙ্গুল দিয়া ঊষার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া গভীর স্নেহদৃষ্টিতে ক্ষণকাল তাকাইয়া রহিল।

বিজন। পারি?

ঊষা চোখ খুলিল না, অনুমতিও দিল না। সহসা পরিতোষবাবু ঘরে প্রবেশ করিয়া এই দৃশ্য দেখিয়া আবার দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। অস্ফুটস্বরে কহিলেন—ঘোড়ার ডিম!

১৩৩৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *