1 of 2

দেহান্তর – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

দেহান্তর – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বরদা বলিল, ‘যারা প্রেতযোনিতে বিশ্বাস করে না তাদের জোর করে বিশ্বাস করাতে যাওয়া উচিত নয়, আমি কখনও সে চেষ্টা করি না। কেবল একবার—’

নিদাঘকাল সমুপস্থিত। মহাকবি কালিদাস বলিয়াছেন, এই সময় সূর্য প্রচণ্ড হয় এবং চন্দ্র হয় স্পৃহণীয়। সূর্যের প্রচণ্ডতা পরীক্ষা করিয়া দেখিবার প্রয়োজন হয় না ; পরন্তু চন্দ্রের স্পৃহণীয়তা যাচাই করিবার উদ্দেশ্যে আমরা ক্লাবের কয়েকজন সভ্য সন্ধ্যার পর ক্লাবের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিয়াছিলাম। পূর্বাকাশে বেশ একটি নধর চাঁদ গাছপালা ছাড়াইয়া উপরে উঠিয়াছে ; তাহার আলোয় পরস্পর মুখ দেখিতে কষ্ট হয় না। অধিকাংশ সভ্যই ঔর্ধ্বদেহিক আবরণ মোচন করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

ক্লাবের ভৃত্যকে ভাঙের শরবত তৈয়ার করিবার ফরমাস দেওয়া হইয়াছিল। চন্দ্র যতই স্পৃহণীয় হোক, সেই সঙ্গে বরফ-শীতল শরবত পেটে পড়িলে শরীর আরও সহজে স্নিগ্ধ হয়। আমরা সতৃষ্ণভাবে শরবতের প্রতীক্ষা করিতেছিলাম।

এইরূপ পরিবেশের মধ্যে বরদা যখন বলিল, ‘যারা প্রেতযোনিতে বিশ্বাস করে না—’ ইত্যাদি, তখন আমরা শঙ্কিত হইয়া উঠিলাম। ছুঁচের মতো সূক্ষ্মাগ্র এই প্রস্তাবনাটি যে অচিরাৎ ফাল হইয়া গল্পের আকারে দেখা দিবে, তাহাতে কাহারও সন্দেহ রহিল না। ভূতের গল্প শোনার পক্ষে গ্রীষ্মের চাঁদিনী রাত্রি অনুকূল নয়, এজন্য শীতের সন্ধ্যা কিংবা বর্ষার রাত্রি প্রশস্ত। কিন্তু বরদা যখন ভণিতা করিয়াছে, তখন আর নিস্তার নাই।

ভাগ্যক্রমে এই সময় শরবত আসিয়া পড়িল। আমরা প্রত্যেকে হৃষ্টচিত্তে একটি করিয়া ঠাণ্ডা গেলাস তুলিয়া লইলাম। পৃথ্বী গেলাসের কানায় একটি ক্ষুদ্ৰ চুমুক দিয়া বলিল—‘আঃ! দুনিয়াটা যদি মন্ত্রবলে এই শরবতের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেত—’

বরদা বলিল, ‘দুনিয়া বলতে তুমি কি বোঝো? এই ভারতবর্ষেই এমন জায়গা আছে, যেখানে এখন বরফ পড়ছে। গত বছর এই সময় আমি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলুম, দেখলুম দিব্যি শীত—’

প্রশ্ন করিলাম, ‘পাহাড়ে? কোন্ পাহাড়ে?’

বরদা বলিল, ‘মনে কর মসুরী কিংবা নৈনিতাল। নাম বলব না, তবে শৌখিন হাওয়া বদলানোর জায়গা নয়। আমার বড় কুটুম্ব সেখানে বদলি হয়েছেন, তাঁরি নিমন্ত্রণে মাসখানেক গিয়ে ছিলুম। সেখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল

অমূল্য সন্দিগ্ধভাবে বলিল, ‘ঘটনা না হয় ঘটেছিল, কিন্তু পাহাড়ের নাম বলতে লজ্জা কিসের?’ বরদা বলিল, —লজ্জা নেই। যে গল্প তোমাদের শোনাতে যাচ্ছি তার পাত্রপাত্রী সবাই জীবিত, তাই একটু ঢাকাটুকি দিয়ে বলতে হচ্চে। মাঝে মাঝে এমন উৎকট ব্যাপার ঘটে যায়। যা হোক, গল্পটা বলি শোন।

হিল স্টেশনে যাঁরা বাস করেন তাঁদের চালচলন একটু বিলিতি-ঘেঁষা হয়ে পড়ে। পুরুষেরা সচরাচর কোট-প্যান্ট পরেন। মেয়েরা অবশ্য শাড়ি ছাড়েন নি, কিন্তু হাবভাব ঠিক দিশি বলা চলে না। টেবিলে বসে স্ত্রী-পুরুষের এক সঙ্গে খাওয়া, ডিনারের পর দু’এক পেগ হুইস্কি বা পোর্ট—এসব সামাজিক ব্যবহারের অঙ্গ হয়ে গেছে। দোষ দেওয়া যায় না—শীতের রাজ্যে শীতের নিয়ম মেনে চলাই ভাল।

শ্যালকের চিঠি পেয়ে আমি তো গিয়ে পৌঁছুলুম। দু’চার দিন থাকতে না থাকতেই গায়ে বেশ গত্তি লাগল। আমার শ্যালকটি দারুণ মাংসাশী, বাড়িতে রোজ মুর্গি-মাটনের শ্রাদ্ধ চলেছে। তার ওপর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো। ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পায়। জায়গাটা সত্যি চমৎকার ; যেমন জল-হাওয়া, তেমনি তার প্রাকৃতিক দৃশ্য।

কয়েকটি নতুন বন্ধু জুটে গেল। এখানে দশ-বারো ঘর বাঙালী আছেন, সকলেই ভারি মিশুক, নতুন লোকে পেলে খুব খুশি হন। একটি ছোকরার সঙ্গে আলাপ হল, তার নাম প্রমথ রায়। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ, যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনি নরম স্বভাব। ভাল সরকারী চাকরি করে ; মনটা অতি আধুনিক হলেও উগ্র নয়। প্রায় রোজই বিকেলবেলা টেনিস খেলে ফেরবার পথে আমাদের বাসায় ঢুঁ মারত। ছোকরা অবিবাহিত ; একলা থাকে তাই আমাদের সঙ্গে খানিক গল্পগুজব করে দু’এক পেয়ালা চা কিংবা কক্‌টেল সেবন করে সন্ধের পর বাসায় ফিরত।

একদিন কথায় কথায় আমার শ্যালক প্রেতযোনির কথা তুললেন ; বললেন, ‘ওহে প্রমথ, তোমরা তো ভূতপ্রেত কিছুই মানে না। আমাদের বরদা একজন পাকা ভূতজ্ঞানী ব্যক্তি। ভূতের প্রমাণ যদি চাও, ওর কাছে পাবে’।

প্রমথ হেসে উঠল ; বলল, ‘আপনি একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হয়ে এইসব বিশ্বাস করেন?’

কথাটা সে হাল্কা ভাবে বললেও গায়ে লাগল ; বললুম, ‘শিক্ষিত লোকেরা এমন অনেক জিনিস বিশ্বাস করেন যা বিশ্বাস করতে অশিক্ষিত লোক লজ্জা পাবে’।

‘যথা?’

‘যথা ফ্রয়েডিয়ান্‌ সাইকো আনালিসিস্‌ কিংবা প্যাব্‌লভের বিহেভিয়ারিজম্‌’।

প্রমথ হাসতে লাগল। সে বুদ্ধিমান ছেলে তাই এঁড়ে তর্ক করল না। ভূতের কথা ঐখানেই চাপা পড়ল।

আমার পাহাড়ে আসার পর দু’হপ্তা কেটে গেল। দিব্যি আরামে আছি ; ওজন বেড়ে যাচ্ছে। মনে চিন্তা নেই, গায়ে ঘাম নেই, বিছানায় ছারপোকা নেই ; খাওয়া ঘুমানো আর ঘুরে বেড়ড়ান—এই তিন কাজে দিবারাত্রি কোথা দিয়ে কেটে যায় বুঝতে পারি না। জীবনে এরকম সুসময় ক্কচিৎ এসে পড়ে ; কিন্তু বেশী দিন থাকে না।

প্রমথ একদিন আমাদের চায়ের নিমন্ত্রণ করল। আমি আর শ্যালক যথাসময়ে তার বাসায় উপস্থিত হলুম। আর কেউ নিমন্ত্রিত হয়নি জানতুম ; কিন্তু গিয়ে দেখি একটি তরুণী রয়েছেন। এঁকে আগে কখনও দেখিনি। সুন্দরী তন্বী দীঘাঙ্গী, মুখে একটু বিষাদের ছায়া ; সাজসজ্জায় প্রসাধনে বর্ণবাহুল্য নেই, কিন্তু যত্ন আছে। চেহারা দেখে বয়স কুড়ি একুশ মনে হয়। হয়তো দু’এক বছর বেশী হতে পারে।

শ্যালক খুব আগ্রহের সঙ্গে তাঁকে সম্ভাষণ করলেন, ‘এই যে, মিসেস দাস, কি সৌভাগ্য! আপনার সঙ্গে দেখা হবে তা আশা করিনি—

তরুণী হাসিমুখে প্রতিনমস্কার করে বললেন, সাপ্তাহিক শপিং করতে শহরে এসেছিলুম। রাস্তায় প্রমথবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, উনি ধরে নিয়ে এলেন’।

প্রমথ তখন মহিলাটির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিল। ইশারায় বুঝলুম, মিসেস দাস বিধবা। শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে ‘হর-জটা’ নামে একটি উচু গিরিশিখর আছে ; খুব ছোট জায়গা, মাত্র দশ বারোটি বাংলো আছে। সেইখানে মিসেস দাস থাকেন। হর-জটা থেকে শহরের পথ সুগম নয়, মাঝে একটা উপত্যকা পড়ে ; তাই সেখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা মাঝে মাঝে শহরে এসে আবশ্যকমতো কেনাকাটা করে নিয়ে যান।

চা-কেক সহযোগে গল্প চলতে লাগল। লক্ষ করলুম, মিসেস দাস একদিকে যেমন সম্পূর্ণরূপে আধুনিকা অন্যদিকে তেমনি শান্ত আর সংযত। তাঁর সুন্দর চেহারার একটা প্রবল আকর্ষণ আছে, অথচ তাঁর সঙ্গে খুব বেশী ঘনিষ্ঠতা করাও চলে না। তিনি অত্যন্ত সহজভাবে সকলের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় যোগ দিতে পারেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রগল্‌ভতা করবার সাহস কারুর নেই। তাঁর সুকুমারত্বই যেন বর্ম।

প্রমথকেও সেই সঙ্গে লক্ষ করলুম। এতদিন বুঝতে পারিনি যে, তার জীবনে প্রেমঘটিত কোনও জটিলতা আছে ; এখন দেখলুম বেচারা একেবারে হাবুডুবু খাচ্চে। কম্পাসের কাঁটা অন্য সময় ঠিক থাকে ; কিন্তু চুম্বকের কাছে এলে একেবারে অধীর অসংবৃত হয়ে পড়ে ; প্রমথর অবস্থাও সেই রকম। তার প্রতিটি কথা প্রতিটি অঙ্গভঙ্গী প্রকাশ করে দিচ্ছে যে ঐ মেয়েটিকে সে ভালবাসে ; লোকলজ্জার খাতিরেও মনের অবস্থা লুকোবার ক্ষমতা তার নেই।

অথচ মিসেস দাস বিধবা, হোন প্রগতিশীলা আধুনিকা—তবু হিন্দু বিধবা।

মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলুম। পাহাড়ের হিমেল হাওয়ায় এই যে বিচিত্র রোমান্স অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে, এর পরিণতি কোথায়?

চায়ের পর্ব শেষ হতেই মিসেস দাস উঠে পড়লেন, দিনের আলো থাকতে থাকতে তাঁকে হর-জটায় ফিরতে হবে। তিনি আমাদের তিনজনকে দৃষ্টির আমন্ত্রণে টেনে নিয়ে বললেন, ‘একদিন হর-জটায় আসুন না। একটু নিরিবিলি এই যা, নইলে খুব সুন্দর জায়গা। এমন সূর্যোদয় পৃথিবীতে আর কোথাও দেখা যায় না। আসবেন’।

আমরা গলার মধ্যে ধন্যবাদসূচক আওয়াজ করলুম। তিনি চলে গেলেন। তারপর আরও কিছুক্ষণ বসে আমরাও উঠলুম। অতিথিসৎকারের যথোচিত চেষ্টা সত্ত্বেও প্রমথ ক্রমাগত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে দেখে তাকে আর কষ্ট দিতে ইচ্ছে হল না।

বাড়ি ফেরার পথে শ্যালককে জিগ্যেস করলুম, ‘কি হে, ব্যাপার কি? ভেতরে কিছু কথা আছে নাকি?

শ্যালক আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন, ‘তুমিও লক্ষ করেছ দেখছি। আমি গুজব শুনেছিলুম, আজ চোখে দেখলুম। প্রমথ সাবিত্রীকে বিয়ে করার জন্যে ক্ষেপে উঠেছে’।

‘ওর নাম বুঝি সাবিত্রী? তা উনি কি বলেন?’

‘যতদূর শুনেছি, সাবিত্রীর মত নেই’।

‘মত নেই কেন? হিন্দু সংস্কার? না অন্য কিছু?’

‘তা ভাই ঠিক বলতে পারি না। কতকটা সংস্কার হতে পারে, আবার কতকটা মৃত স্বামীর প্রতি ভালবাসাও হতে পারে’।

জিগ্যেস করলুম, ‘স্বামী কতদিন মারা গেছেন?’

শ্যালক বললেন, ‘তা প্রায় বছর দুই হতে চলল। ভদ্রলোক রেলের বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ; হঠাৎ রেলে কাটা পড়লেন’।

‘তোমার সঙ্গে পরিচয় ছিল?’

‘সামান্য। খুব রাশভারী জব্বরদস্ত লোক, বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ বছর হয়েছিল। মাত্র বছরখানেক সাবিত্রীকে বিয়ে করেছিলেন’।

‘মিসেস দাস হর-জটায় থাকেন কেন?’

‘বাড়িটা দাসের ছিল, সাবিত্রী উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তা ছাড়া দাস ‘অন্ ডিউটি’ মারা গিয়েছিলেন তাই রেলওয়ে থেকে তাঁর বিধবা একটা মাসহারা পায়। তাইতেই চলে।’

‘সাবিত্রী কেমন মেয়ে তোমার মনে হয়?’

‘খুব ভাল ; অমন মেয়ে দেখা যায় না। এই বয়সে একলা থাকে, কিন্তু কেউ কখনও ওর নামে একটা কথা বলতে পারেনি।

‘বিধবা-বিবাহ সম্বন্ধে তোমার মতামত কি?’

এ রকম ক্ষেত্রে হওয়াই ভাল। সারা জীবন অতীতের পানে চেয়ে কাটিয়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। ছেলেপুলে থাকলেও বা কথা ছিল। কিন্তু সাবিত্রী বোধ হয় বিয়ে করবে না।’

এই ঘটনার পর আরও দিন দশেক কেটে গেল। প্রমথ আর আসেনি। আমরা তার মনের কথা আঁচ করেছি বলেই বোধ হয় সে আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে।

আমারও স্বর্গ হতে বিদায় নেবার সময় হল। আমি পাততাড়ি গুটোচ্ছি এমন সময় একদিন প্রমথ এল। একটু লজ্জা লজ্জা ভাব। দু’চার কথার পর বলল, “মিসেস দাস চিঠি লিখে আমাদের তিনজনকে হর-জটায় নেমন্তন্ন করেছেন, সূর্যোদয় দেখবার জন্যে। যাবেন?’

আমার কোনই আপত্তি ছিল না। কিন্তু শ্যালক আপত্তি তুললেন—সূযোদয় দেখতে হলে তার আগের রাত্রে গিয়ে হর-জটায় থাকতে হয়, কিংবা রাত্রি দুটোর সময় এখান থেকে বেরুতে হয়। সে কি সুবিধে হবে?

প্রমথ পকেট থেকে চিঠি বার করে বলল, ‘তাঁর চিঠি পড়ে দেখুন, অসুবিধে বোধ হয় হবে না’।

চিঠিতে লেখা ছিল

প্রীতি নমস্কারান্তে নিবেদন, প্রমথবাবু দেখছি আমার সেদিনের নিমন্ত্রণ আপনারা মুখের কথা মনে করেছেন। আমি কিন্তু সত্যিই আপনাদের তিনজনকে নিমন্ত্রণ করেছিলুম। আসুন না। রাত্রে আমার বাড়িতে থেকে সকালে সূর্যোদয় দেখবেন। কষ্ট হবে না। আমার বাড়িতে তিনজন অতিথিকে স্থান দেবার মতো জায়গা আছে।

কবে আসবেন জানাবেন। কিংবা না জানিয়ে যদি এসে উপস্থিত হন তাহলেও খুশি হব। আশা করি ভাল আছেন।

নিবেদিকা সাবিত্রী দাস

এর পর আর শ্যালকের আপত্তি রইল না। প্রমথ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আজ শনিবার আছে, চলুন না আজই যাওয়া যাক। পাঁচটার সময় বেরুলে সন্ধের আগেই পৌঁছুনো যাবে’।

তাই ঠিক করে বেরিয়ে পড়া গেল।

হর-জটা শিখরটি উপত্যকা থেকে দেখা যায় ; সত্যি হর-জটা নাম সার্থক। যেন ধ্যানমগ্ন মহাদেবের জটা পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠেছে ; তার খাঁজে খাঁজে সাদা বাংলোগুলি ধুতুরা ফুলের মতো ফুটে আছে। অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু সেখানে পৌছুবার রাস্তাটি অপূর্ব নয় ; তিন মাইল পথ হাঁটতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা লাগল।

আমরা যখন মিসেস দাসের বাংলোর সামনে গিয়ে হাজির হলুম তখন দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে ; তবু হর-জটার কুটিল কুণ্ডলীতে সূর্যাস্তের আবির লেগে আছে। মিসেস দাস বাড়ির সামনের বারান্দায় ইজি-চেয়ারে বসে ছিলেন, উৎফুল্ল কলকাকলি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আমাদের দেখে তাঁর এই অকৃত্রিম আনন্দ বড় ভাল লাগল।

শোনা যায়, আসন্ন দুর্ঘটনা সামনে কালো ছায়া ফেলে তার আগমনবার্তা জানিয়ে দেয়। কিন্তু আশ্চর্য, সেদিন দুর্ঘটনার বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস পাইনি। সেই পার্বত্য সন্ধ্যার গৈরিক আলো—মনে হয়েছিল, এ আলো নয়, অপরূপ এক দৈবী প্রসন্নতা। তার আড়ালে যে লেশমাত্র অশুভ লুকিয়ে থাকতে পারে তা কল্পনা করাও যায় না। আমার বোধ হয় প্রমথও কিছু আভাস পায়নি।

মিসেস দাস আমাদের বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। গরম জলে মুখহাত ধুয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখি চা তৈরি। বাড়িতে পুরুষ চাকর নেই ; দুটি পাহাড়ী মেয়েমানুষ কাজকর্ম রান্নাবান্না করে এবং রাত্রে থাকে।

হর-জটায় এখনও বিদ্যুৎবাতি এসে পৌছয় নি। কেরোসিন ল্যাম্পের মোলায়েম আলোয় চা খেতে বসলুম। মিসেস দাস চাকরানিদের সাহায্যে আমাদের পরিচর্যা করতে লাগলেন।

ড্রয়িংরুমের দেয়ালে একটা এনলার্জ করা ফটোগ্রাফ টাঙানো ছিল। দূর থেকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলুম না ; চা খাওয়া শেষ হলে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। ইনিই অকালমৃত মিস্টার দাস সন্দেহ নেই। ভাল করে দেখলুম। চেহারা সুন্দর বলা চলে না, কিন্তু একটা দৃঢ়তা আছে ; চওড়া চিবুকের মাঝখানে খাঁজ, চোখের দৃষ্টি একটু কড়া। ফটো তোলবার সময় ঠোঁটের কোণে যে হাসি আনার নিয়ম আছে সেটি অবশ্য রয়েছে, কিন্তু হাসি দিয়ে চরিত্রের দৃঢ় বলিষ্ঠতা ঢাকা পড়েনি।

মনে মনে এই মুখখানার সঙ্গে প্রমথর নরম মিষ্টি মুখের তুলনা করছি এমন সময় পাশে মৃদুকণ্ঠের আওয়াজ হল, —আমার স্বামী।

দেখলুম, মিসেস দাস আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারপর প্রমথও এসে দাঁড়াল। মিসেস দাস কিছুক্ষণ ফটোর দিকে তাকিয়ে থেকে চকিতে প্রমথর পানে চাইলেন। তাঁর মুখখানি শান্ত, মুখ দেখে মনের কথা ধরা যায় না; তবু সন্দেহ হল তিনিও আমারই মতো ফটোর সঙ্গে প্রমথর মুখ তুলনা করলেন।

আমরা আবার ফিরে এসে বসলুম।

মেয়েমানুষের মন বোঝা সহজ নয় ; বিশেষত মিসেস দাসের মতো মেয়ের মন। কবি বলেছেন, রমণীর মন সহস্র বর্ষের সখা সাধনার ধন। আমি ভাবতে লাগলুম, ইনি প্রমথকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেছেন একথা নিশ্চয় সত্যি, কিন্তু প্রমথ সম্বন্ধে তাঁর মনে কি কোনও দুর্বলতা নেই? এই যে আজ তিনি আমার মতন একজন অপরিচিত লোককে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন, এটা কি শুধুই লৌকিক সহৃদয়তা? না এর অন্তরালে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে কাছে পাবার অভিপ্রায় লুকিয়ে ছিল?

প্রমথর অবস্থা বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন। সেদিন যেমন দেখেছিলুম আজও ঠিক তাই। চুম্বকাবিষ্ট কম্পাসের কাঁটা, অন্য কোনও দিকেই তার লক্ষ নেই।

ক্রমে রাত্রি হল। উত্তর দিক থেকে একটা খর ঠাণ্ডা হাওয়া উঠে মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে বইতে লাগল।

রান্নাবান্না হতে স্বভাবতই একটু দেরি হল। আমরা রাত্রির খাওয়া শেষ করে যখন উঠলুম তখন প্রায় এগারোটা বাজে। মিসেস দাস বললেন, ‘আপনারা শুয়ে পড়ুন গিয়ে। সকাল সাড়ে তিনটের আগে কিন্তু উঠতে হবে, নইলে সূর্যোদয়ের সব সৌন্দর্য দেখতে পাবেন না’।

ভাবনা হল, এখন শুতে গেলে সাড়ে তিনটের সময় বুম ভাঙবে কি? যদি না ভাঙে আজকের অভিযানটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। জিগ্যেস করলুম, অ্যালার্ম ঘড়ি আছে কি?

মিসেস দাস বললেন, ‘না। কিন্তু সেজন্য ভাববেন না ; আমি ঠিক সময়ে আপনাদের তুলে দেব’।

শ্যালক বললেন, ‘কিন্তু আপনার ঘুম যে ভাঙবে তার ঠিক কি?

মিসেস দাস একটু হেসে বললেন, ‘আমি ঘুমোব না, এই ক’ঘণ্টা বই পড়ে কাটিয়ে দেব। আমার অভ্যেস আছে।’

অবাক হয়ে চেয়ে রইলুম। আমরা ঘুমোব আর ভদ্রমহিলা সারারাত জেগে থাকবেন?

হঠাৎ প্রমথ তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, তাহলে আমিও জেগে থাকি’। আমাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনারা শুয়ে পড়ুন’।

আমার মন কিন্তু এ প্রস্তাবে সায় দিল না। আমরা দু’জন বয়স্থ ব্যক্তি ঘুমোব আর এই দুটি যুবক-যুবতী সারারাত্রি একত্র থাকবে—

শ্যালক সমস্যা ভঞ্জন করে দিয়ে বললেন, ‘তবে আমরা সকলেই জেগে থাকি না কেন? আমার আবার নতুন জায়গায় সহজে ঘুম আসে না ; এমনিতেই হয়তো চোখ চেয়ে রাত কেটে যাবে’।

আমি বললাম, ‘আমারও ঠিক তাই’।

মিসেস দাস আপত্তি করলেন, কিন্তু আমরা শুনলুম না। ড্রয়িংরুমে বেশ জুত করে বসা গেল। চার ঘণ্টা দেখতে দেখতে কেটে যাবে। শ্যালক প্রস্তাব করলেন, তাস খেলা যাক ; কিন্তু বাড়িতে তাস ছিল না বলে তা আর হল না।

প্রথমে খুব উৎসাহের সঙ্গে আরম্ভ হয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গল্প চলেছে। মিসেস দাস একটি হেলান দেওয়া চেয়ারে শুয়েছেন ; শ্যালক সোফায় লম্বা হয়ে সিগার টানছেন ; আমিও একটা গদিমোড়া চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে বেশ আরাম অনুভব করছি ; কেবল প্রমথ অস্থিরভাবে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা ওটা নাড়ছে, আলোটা কখনও কমিয়ে দিচ্ছে কখনও বাড়িয়ে দিচ্ছে—

মিসেস দাসের শান্ত চোখ তাকে অনুসরণ করছে।

এ বারোটা বাজল।

শ্যালক উঠে বসলেন ; সিগারের দগ্ধ প্রান্তটুকু অ্যাস-ট্রের ওপর রেখে বললেন, ‘আচ্ছা মিসেস দাস, আপনি এই বাড়িতে একলা থাকেন, আপনার ভয় করে না?’

মিসেস দাস একটু ভুরু তুলে তাকালেন, ‘ভয়? কিসের ভয়?’

বাড়ির মাথার ওপর ঠাণ্ডা বাতাসটা সাঁই সাঁই শব্দ করে চলেছে ; আমি একটা হাই চাপা দিয়ে বললুম, ‘মনে করুন ভূতের ভয়’।

প্রমথ মিস্টার দাসের ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়িয়ে বিরাগ-ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমার কথা শুনে চকিতে ফিরে চাইল ; তারপর আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। বিদ্রুপ করে বলল, ‘ভূতের ভয়! সে আবার কি? ভূত বলে কিছু আছে নাকি? বরদাবাবুর যত কুসংস্কার’।

মিসেস দাসকে জিগ্যেস করলুম, ‘আপনারও কি তাই মত?’

তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘পরজন্ম আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ভূত—কি জানি—’

প্রমথ জোর গলায় বলে উঠল, ‘ভূত নেই। ভুত শব্দের যে অর্থই ধর, ভূত থাকতে পারে না। আছে শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এই কি যথেষ্ট নয়?’

তার মুখের পানে তাকালুম ; মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে। প্রমথ নরম স্বভাবের মানুষ, তাকে এত বিচলিত কখনও দেখিনি। যেন সাবিত্রীকে একটা কথা বলবার জন্যে তার প্রাণে প্রবল আবেগ উপস্থিত হয়েছে, অথচ আমাদের সামনে বলতে পারছে না।

শ্যালকও ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। তিনি বললেন, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যদি থাকে তবে ভূতও থাকতে বাধ্য। আমাদের সকলেরই অতীত জীবন আছে—সেইটেই ভূত। তোমারও ভূত আছে প্রমথ, তাকে এড়ানো সহজ নয়। তবে মরা মানুষের সঙ্গে আমাদের তফাত এই যে, মরা মানুষের সবটাই ভূত ; আমাদের কিছুটা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আছে।’

শ্যালক যে ভূত কথাটার দু’রকম অর্থ নিয়ে লোফালুফি করছেন, প্রমথ তা বুঝল না ; তার তখন রোখ চেপে গেছে। সে হাত নেড়ে বলল, ‘ওসব হেঁয়ালি আমি বুঝি না। মৃত্যুর পর আত্মা যে বেঁচে থাকে তা প্রমাণ করতে পারেন?’

শ্যালক হেসে বললেন, ‘আমি কিছুই প্রমাণ করতে পারি না। প্রেতযোনি সম্বন্ধে বরদা খবর রাখে, ওকে জিগ্যেস কর’।

আমি বললুম, “দেখুন প্রমথবাবু, যে লোক জেগে ঘুমোয় তাকে জাগানো যায় না ; আপনিও যদি বিশ্বাস করবেন না বলে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করানো কারুর সাধ্য নয়। তবে এইটুকু বলতে পারি, অনেক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিভাবান লোক প্রেতযযানিতে বিশ্বাস করেছেন। যথা—উইলিয়াম ক্রুকস, অলিভার লজ, কোনন ডয়েল—

প্রমথ মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না। যদি প্রমাণ করতে পারেন প্রমাণ করুন, নইলে কেবল কতকগুলো বিলিতি নাম আউড়ে আমাকে কাবু করতে পারবেন না’।

একটু রাগ হল। বললুম, ‘বেশ। বিশ্বাস করা না-করা আপনার ইচ্ছে। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? মিসেস দাস, আসুন, প্ল্যাঞ্চেট করা যাক’।

তিনি একটু শঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘প্ল্যাঞ্চেট! ভূত নামাবেন!’

বললুম, ‘প্রমথবাবুর অবিশ্বাস ভাঙবার আর তো কোনও উপায় দেখি না। তবে আপনার যদি ভয় করে তাহলে কাজ নেই’।

তিনি বললেন, ‘না, ভয় করবে না’। চকিতে একবার প্রমথর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেশ তো, করুন না। আর কিছু না হোক সময় তো কাটবে। কি চাই বলুন?’

বললুম, ‘বেশী কিছু নয়, শুধু একটা তেপায়া টেবিল হলেই চলবে’।

ছোট একটা তেপায়া টেবিল ঘরেই ছিল। আমি তখন দু’চার কথায় প্ল্যাঞ্চেটের প্রক্রিয়া বুঝিয়ে দিলুম। তারপর আলোটা কমিয়ে দিয়ে চারজনে টেবিল ঘিরে বসা গেল।

শ্যালক প্রশ্ন করলেন, কাকে ডাকা হবে?

আমি বললুম, ‘যাকে ইচ্ছে ডাকা যেতে পারে। তবে এমন লোক হওয়া চাই যাকে আমরা সবাই চিনি। অন্তত যার চেহারা আমাদের সকলের জানা আছে’।

আমরা যেখানে বসেছিলুম তার অল্প দূরেই মিস্টার দাসের ছবি দেয়ালে টাঙানো ছিল। প্রমথ বসেছিল ছবির দিকে পিঠ করে, আর মিসেস দাস ছিলেন তার সুমুখে। মিসেস দাস ছবির পানে চোখ তুললেন ; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখও সেই দিকে ফিরল। অল্প আলোতে ছবিটা সমস্ত দেখা যাচ্ছে না, কেবল মুখখানা স্পষ্ট হয়ে আছে।

মিসেস দাস ছবি থেকে চোখ নামিয়ে আমার পানে চাইলেন। তাঁর চোখের প্রশ্ন বুঝে আমি বললুম, হ্যাঁ, ওঁকেই ডাকা যাক । আমি যদিও ওঁকে দেখিনি তবু ছবিতেই কাজ চলবে। সকলে চোখ বুজে মনে মনে ওঁর কথা ভাবুন’।

আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে টেবিলের ওপর হাত রাখা হল। তারপর আমরা চোখ বুজে মিস্টার দাসের ধ্যান শুরু করে দিলুম।

প্ল্যাঞ্চেটের টেবিলে যখন প্রেতযোনি আবির্ভাব হয় তখন টেবিলটা নড়তে থাকে ; মনে হয় টেবিলের মরা কাঠে প্রাণসঞ্চার হয়েছে, তার ভেতর দিয়ে একটা স্পন্দন বইতে থাকে। আমরা প্রায় দশ মিনিট বসে রইলুম, কিন্তু টেবিল নড়ল না, তার মধ্যে জীবনসঞ্চার হল না। তখন চোখ খুলে আর সকলের পানে তাকালুম।

প্রমথকে দেখেই বুঝলুম প্রেতের আবির্ভাব হয়েছে ; টেবিলের ওপর নয়, মানুষের ওপর। এমন মাঝে মাঝে হয়। তার মুখটা বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে, ঠোঁট দুটো নড়ছে ; মুখের চেহারা কেমন যেন বদলে গেছে।

প্রেতের উদ্দেশে প্রশ্ন করলুম, ‘কেউ এসেছেন কি?

প্রমথ আস্তে আস্তে মুখ তুলল ; তারপর টকটকে রাঙা চোখ খুলে মিসেস দাসের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল।

আমি হাত বাড়িয়ে আলোটা উজ্জ্বল করে দিলুম। এতক্ষণে প্রমথর মুখ ভাল করে দেখা গেল। তার মুখ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলুম। কঠিন হিংস্র মুখ—ক্রুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। চোখের দৃষ্টি প্রমথর দৃষ্টি নয়, যেন তার চোখের ভিতর দিয়ে অন্য একজন উঁকি মারছে।

মিসেস দাস সম্মোহিতের মতো তার পানে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ প্রমথ উগ্র কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সাবিত্রী!’

তার গলার আওয়াজ পর্যন্ত বদলে গেছে। মিসেস দাসের চোখ বিস্ফারিত হতে লাগল ; তাঁর ঠোঁট দুটি খুলে গেল। তারপর তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘অ্যাাঁ! তুমি, তুমি!’ এই বলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

তারপর যা কাণ্ড বাধল তা বর্ণনা করা যায় না। প্রমথ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো ; তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। আমি তাকে ধরতে গেলুম, কিন্তু আমার সাধ্য কি তাকে ধরে রাখি। তার গায়ে অসুরের শক্তি। আমাকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে সে সাবিত্রীর অজ্ঞান দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাকে দু’ হাতে ঝাঁকুনি দিতে দিতে গরজাতে লাগল, ‘তুমি আবার বিয়ে করতে চাও? দেব না—দেব না—তুমি আমার—’

ভেবে দ্যাখো, প্রমথর মুখ দিয়ে এই কথাগুলো বেরুচ্ছে! কিন্তু আমাদের তখন ভাবার সময় নেই ; আমি আর শ্যালক দু’জনে মিলে টেনে প্রমথকে আলাদা করলুম। ইতিমধ্যে পাহাড়ী চাকরানি দুটো চেঁচামেচি শুনে এসে পড়েছিল ; তারা সাবিত্রীকে তুলে নিয়ে কৌচের ওপর শুইয়ে দিল। আমরা প্রমথকে টেনে নিয়ে চললুম স্নানঘরের দিকে ; সেখানে তাকে মেঝেয় ফেলে মাথায় বালতি বালতি জল ঢালতে লাগলুম আর চিৎকার করে বলতে লাগলুম, ‘আপনি চলে যান—চলে যান—’

‘না যাব না—সাবিত্রীকে বিয়ে করতে দেব না—’ দাঁত ঘষে ঘষে প্রমথ বলতে লাগল। আমরা জল ঢালতে লাগলুম। ক্রমে তার গলার আওয়াজ জড়িয়ে এল ; হাত-পা ছোঁড়াও বন্ধ হল।

আধঘণ্টা পরে দুজনে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে একটা বিছানায় শুইয়ে দিলুম। তখন তার গায়ে আর শক্তি নেই, তবু বিজবিজ করে বকছে, ‘দেব না—দেব না—’

শ্যালককে তার কাছে বসিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলুম। দেখি মিসেস দাসের জ্ঞান হয়েছে। আমাকে দেখে তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে কেঁদে উঠলেন, ‘এ কী হল? বরদাবাবু, এ কী হল?’

মেয়েদের মনের অন্তরতম কথা যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন তাদের লজ্জা আর ভয়ের অন্ত থাকে না, কান্নাই তখন তাদের একমাত্র আবরণ। আমি মিসেস দাসের পাশে বসে তাঁকে যথাসাধ্য ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা করলুম। তারপর চাকরানিদের বললুম, ‘এক পেয়ালা কড়া চা শিগ্‌গির তৈরি করে নিয়ে, এস।’

সেদিন সূর্যোদয় দেখা মাথায় উঠল। দুই ঘরে দুটি রুগীর পরিচর্যা করতেই বেলা সাতটা বেজে গেল।

যা হোক, মিসেস দাস তো সামলে উঠলেন, কিন্তু প্রমথ সেই যে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কিছুতেই তার ঘুম ভাঙে না। জোর করে ঘুম ভাঙাতেও সাহস হল না, আবার হয়তো বিদ্‌ঘুটে কাণ্ড আরম্ভ করে দেবে। এদিকে বেলা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের আজ ফিরে যেতেই হবে, নইলে অনেক হাঙ্গামা।

বেলা একটা পর্যন্ত যখন প্রমথর ঘুম ভাঙল না, তখন আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলুম। ভাগ্যক্রমে একজন বৃদ্ধ ডাক্তার হর-জটায় বাস করেন, তাঁকে ডাকা হল। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, ‘বুকে একটু ঠাণ্ডা বসেছে, বিশেষ কিছু নয় ; কিন্তু আজ এর বিছানা থেকে ওঠা চলবে না’।

আমরা কাতর চক্ষে মিসেস দাসের পানে চাইলাম। তিনি এতক্ষণে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেন, বললেন, ‘প্রমথবাবু আজ এখানেই থাকুন। আপনারা যদি নিতান্তই না থাকতে পারেন—’

শ্যালক অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “দেখুন, যাওয়া খুবই দরকার। কিন্তু আমরা না থাকলে আপনার যদি কোনও লজ্জার কারণ হয়—’

মিসেস দাস বললেন, ‘সেজন্যে ভাববেন না।’

বৃদ্ধ ডাক্তার আমাদের কথা শুনছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, ‘ভাবনার কি আছে? আমি তো কাছেই থাকি, আমি না হয় রাত্রে এসে সাবিত্রী মা’র বাড়িতে থাকব ; দরকার হলে আমার স্ত্রী এসে থাকতে পারেন। আপনারা ফিরে যান’।

বৃদ্ধ ডাক্তারটি মরমী লোক ; অযথা প্রশ্ন করেন না। আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। প্রমথ সম্বন্ধে চিন্তার কারণ নেই ; ঘুম ভাঙলেই সে সহজ মানুষ হয়ে পড়বে।

বেরুবার সময় মিসেস দাস আমাদের একটু আড়ালে বললেন, ‘কাল রাত্রির ঘটনা নিয়ে কোনও আলোচনা না হলেই ভাল হয়’।

আমরা আশ্বাস দিলুম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন’।

তারপর হর-জটা থেকে নেমে এলুম।

পরদিন সন্ধের সময় খবর পেলুম প্রমথ ফিরে এসেছে। কিন্তু সে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল না

এদিকে আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, দু’এক দিনের মধ্যে বেরুতে হবে। ভাবলুম, যাই, আমিই প্রমথর সঙ্গে দেখা করে আসি। এইসব ব্যাপারের পর তার হয়তো আসতে সঙ্কোচ হচ্ছে।

পরদিন সকালবেলা বেড়িয়ে ফেরার পথে তার বাসায় গেলুম। সদর দরজা বন্ধ। কড়া নাড়তেই প্রমথ এসে দোর খুলে দাঁড়ালো। তার চেহারায় কী একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে। সে কট্‌মট্‌ করে কিছুক্ষণ আমার পানে চেয়ে রইল, তারপর দড়াম্‌ করে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলে।

প্রমথর সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। তার পরদিনই পাহাড় থেকে নেমে এলুম।

এই পর্যন্ত বলিয়া বরদা থামিল। ইতিমধ্যে চাঁদ অনেকখানি উপরে উঠিয়াছে। ভাঙের নেশার জন্যই হোক বা বরদার গল্প শুনিয়াই হোক, বাতাস বেশ ঠাণ্ডা লাগিতেছে।

পৃথ্বী প্রশ্ন করিল, তোমার গল্প এইখানেই শেষ? না আর কিছু আছে?

বরদা একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল, আর একটু আছে। মাসখানেক পরে শ্যালকের কাছ থেকে এক চিঠি পেলুম। তিনি এক আশ্চর্য খবর দিয়েছেন ; সাবিত্রীর সঙ্গে প্রমথর সিভিল ম্যারেজ হয়ে গেছে। আমার ধারণা হয়েছিল,যে ব্যাপার ঘটেছে, তারপর তাদের বিয়ে অসম্ভব! প্রমথ যে শেষকালে আমার সঙ্গে এমন রূঢ় ব্যবহার করেছিল সেটাও আমি তার ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া মনে করেছিলুম। কিন্তু দেখলুম, আমার হিসেব আগাগোড়াই ভুল।

‘শ্যালক আর একটি খবর দিয়েছেন, সেটি আরও অদ্ভুত। এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রমথর চেহারা

নাকি অনেকখানি বদলে গেছে ; সকলেই বলছে, তার চেহারা ক্রমশ গতাসু মিস্টার দাসের মতন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি তার চিবুকের মাঝখানে একটা খাঁজ দেখা দিয়েছে—

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়া বরদা বলিল, ‘এতক্ষণ আমি সরলভাবে ঘটনাটা বলে গেছি, নিজের টীকা-টিপ্পনী কিছু দিই নি। এখন তোমরাই এর টীকা-টিপ্পনী কর—এটা কি ব্যাপার! মিস্টার দাসের প্রেতাত্মা কি প্রমথকে তার দেহ থেকে উৎখাত করে নিজে কায়েমী হয়ে বসেছেন এবং নিজের বিধবাকে আবার বিয়ে করেছেন? কিংবা—আর কি হতে পারে?

আমরা কেহই উত্তর দিলাম না। বরদা তখন কতকটা নিজ মনেই বলিল, “যদি তাই হয় তাহলে প্রমথর আত্মাটার কী হল? কোথায় গেল সে?’

অকস্মাৎ আকাশে একটা দীর্ঘ আর্ত কর্কশ চিৎকারধ্বনি হইল। আমরা চমকিয়া উর্ধ্বে চাহিলাম ; দেখিলাম, বাদুড়ের মতো একটা পাখি চাঁদের উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছে—কালো ত্রিকোণ পাখা মেলিয়া পাখিটা ক্রমে দূরে চলিয়া গেল।

কণ্টকিত দেহে আমরা চাহিয়া রহিলাম।

১৩৫৫ (১৯৪৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *