দেবী নিধন পালা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

দেবী নিধন পালা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

ঋতুটির রঙ বড়ই অগ্নিবর্ণ হে। এস, দৌড়ে এস। পিছিয়ে পড়লে কেন!

মাথায় ভিজা গামছা, গায়ে নামাবলি, পায়ে খড়ম আমার ঠাকুরদা গৌরবর্ণ পুরুষ। তাঁর দ্রুত হাঁটার অভ্যাস। আমি পিছিয়ে পড়ছিলাম বারবার। তিনি কিছুটা গিয়েই পেছন ফিরে দেখছেন। দাঁড়াচ্ছেন। ডেকে বলছেন, এস, দেরি কোরোনা। ঋতুটির যশ নেই। ফাগুন মাস, আগুন হয়ে আছে ধরিত্রী। এটা আসলে মারীর ঋতু, বুঝলে।

চার ক্রোশ পথ হেঁটে যেতে হবে। ঠাকুরদা চার ক্রোশ পথ অনায়াসে যেতে পারবেন, আমার পক্ষে কতটা সম্ভব জানি না। তিনি তাঁর ছাতার নিচে আমাকে নিয়ে হাঁটছিলেন, বারবারই পিছিয়ে পড়ছিলাম। তাঁর গতি এই বয়সেও এত দ্রুত যে আমি কিছুতেই সঙ্গী হতে যেন পারছিলাম না। তাঁর এতে ক্ষোভ জন্মাতে পারে। ক্ষোভ জন্মালেই সেই অমোঘ কথা, ঋতুটির রঙ বড়ই অগ্নিবর্ণ হে। মানুষের জীবন বড়ই অগ্নিবর্ণ হে। হাঁটতে পারছ না!

ঠা-ঠা রোদুরে এই ক্রমান্বয় হেঁটে যাওয়া কেন আমি জানি না। ঠাকুরদা তাঁর অঞ্চলে কালপুরুষ হয়ে আছেন। তিনি মহামারীর প্রতিষেধক। কারণ তাঁর কোপে কোথাও আগুন জ্বলে উঠলে, গাছপালা, নদীনালা সব শুকিয়ে যেতে পারে। তাঁর আচরণ অত্যন্ত বায়ুগ্রস্ত। হাত তুলে একজন ঋষিপুরুষের মতো প্রকৃতির উপর বিজয় লাভ করাকে তিনি নিয়তি ভেবে থাকেন।

এখন সময় বড় কঠিন। ধুধু বালুরাশি উড়ছে। চষা জমির উপর দিয়ে হাঁটছি, কখনও আল ধরে। ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়ে যেতে পারি। সেই সময় নীল আকাশে গভীরে বালুরাশির সঙ্গে খড় এবং কীটপতঙ্গ পর্যন্ত ভেসে বেড়ায়। যে-কোনো কারণেই হোক ঠাকুরদা প্রকৃতির বিবর্ণ হেতুসমূহ সময়জ্ঞানে সঠিক ধরতে পারেন।

এ-অঞ্চলে বিশবাইশ ক্রোশের মধ্যে আমরাই একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার। ঠাকুরদার যজন-যাজনের সাম্রাজ্যে তিনি এতই প্রভাবশালী, যাঁর অনুমতি ভিন্ন কিছু করার উপায় নেই। বাড়িতেও। একমাত্র ঠাকুমার চোপার কাছে তাঁকে কখনও ফোঁস করতে দেখিনি। ঠাকুমার ইচ্ছে ছিল না, এই আশি বছরের প্রৌঢ় মানুষটির সঙ্গ নিই। কিন্তু হেতু এমন যে শুনে ঠাকুমাও নিষেধ করতে পারেনি।

আসলে এবয়সে ঠাকুরদার কথা যত ভাবি তত বিস্ময়ে আপ্লুত হই। তিনি বুড়ো হতে চান না, এবং প্রকৃতির উপর বিজয় লাভের হেতুতে কিছু নিমগাছ আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকটায় রোপণ করে রেখেছিলেন। নিমের হাওয়ায় বায়ু পিত্ত এবং কফ শরীরে ঠিক থাকে এমন তাঁর নিশ্চিত ধারণা। সে যাই হোক আমরা যাচ্ছি লাধুরচর নামক একটি নদীনালায় ঘেরা ব-দ্বীপের মতো জায়গায়। ব-দ্বীপ বোঝা যায় বর্ষায়। ফাঙ্গুন-চৈত্রে গ্রামটাকে অন্য অঞ্চল থেকে সামান্য উঁচু এই যা মনে হয়। লাধুরচর গ্রামে মা শীতলার আবির্ভাব ঘটেছে। ওলাওঠায় এবং গুটিবসন্তে বাড়ি সাফ হয়ে যাচ্ছে! সেই উপলক্ষে দেবী দিগম্বরীর পূজা। শিমুল গাছের নিচে মাঠের মধ্যে ওলাওঠা দেবী, ঢাক বাজবে, হ্যাজাক জ্বলবে এবং মানুষজনের ভিড়ে তিনি প্রার্থনা করবেন, দেবী আপনার কোপ প্রশমিত হোক।

আমাদের বোধ হয় আজ রাত্রিবাসও সেখানে।

এতে গাঁয়ের মানুষজনের উপর থেকে মা শেতলার কোপ দূর হবে, সঙ্গে পুণ্যসঞ্চয়। অর্ধমৃত মানুষ আবার প্রাণ ফিরে পাবে—ওলাওঠা দেবীর সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং ঠাকুরদার মন্ত্রপাঠ হবে দেবীর তুষ্টিবিধানে—ঠাকুরদা কোষকুষি নিয়ে সংকল্প পাঠ করবেন—সেই সংকল্পই মানুষজনকে মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করবে। এমত বিশ্বাস আছে বলেই উনি অমোঘ নিয়তি থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য ত্রাতার ভূমিকা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। এবং তিনি যে তাঁর কর্ম এবং উপচারে কখনও কাপালিক সদৃশ আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন, তা মানুষের বিশ্বাসই হেতু। এ বয়সে জানালায় চুপচাপ বসে থাকলে তা বিশেষ টের পাই।

এই অঞ্চলে হা-অন্ন মানুষেরই বাস বেশি। হা-অন্ন মানুষের ঘরেই দেবীর বেশি কোপ। জল নেই, বাতাস শুকনো, নদী-নালা-পুকুর মজে গেছে। তলানিতে ঘোলা জল—পায়ের পাতা ডোবে না। এবং এই ঋতুতেই আগুন সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। জতুগৃহ হয়ে যায় কুঁড়েঘরগুলি। মানুষের সর্বস্ব নাশের এমন নিষ্ঠুর ঋতুটিতে শিমুল ফুলের সমাবোহ। লাল ফুল, কোথাও ফুল থেকে ফল। ফল ফেটে রোদ্দুরে তুলো উড়তে দেখলে বোঝা যায় পৃথিবীকে যেন মারী এসে গ্রাস করছে। চাষ আবাদের জমিতে সবুজ চিহ্নটুকু পর্যন্ত থাকে না। এ-সময় নদীর চরে তরমুজের চাষ, দুই- দেয়া ঘরে কোনো বুড়ো মানুষের পাহারা—তরমুজ জলকষ্ট নিবারণ করে থাকে। প্রকৃতি কী রহস্যময়ী! ঠাকুরদা পথে যেতে যেতে জীবনের রহস্যময়তার কথাও বলছিলেন।

সুতরাং হা-অন্ন মানুষ, হাহাকার জলের এবং পানীয় জল বলতে মসজিদের ইঁদারা—যেমন আমাদের বাড়িতেও গভীর ইঁদারা আছে। প্রতাপ চন্দের বাড়িতে টিউকল। অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহের এই একমাত্র উৎস। সারি সারি নারী পুরুষ কোথাও পানীয় জলের জন্য দেখলাম দূরে মরীচিকার মতো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্রোশ দুই পথ হেঁটে জলতেষ্টা পেয়ে গেল। তেষ্টা নিবারণের উপায় তরমুজের রস।

ঠাকুরদা বললেন, তোমাকে নদী অতিক্রম করতে হবে। নদী অতিক্রম করে ছলিমুল্লার তরমুজের ক্ষেত। সেখানে পানীয় জল না হোক, তরমুজের রস খাওয়াতে পারব। গিরিশ মাঝিরও তরমুজের জমি আছে। হাঁটতে থাক। সব পাবে।

নদী পার হলাম। নদীতে জল নেই। চরায় তরমুজের জমি। ঝুপড়িমতো ঘর। চরার অদূরে গাঁ এবং আমজামগাছের নিবিড় ছায়া।

একজন বুড়োমতো মানুষ ঠাকুরদাকে দেখেই বের হয়ে এল। গড় হল। রাস্তায় মানুষজনেব এই স্বভাব। তাঁকে দেখলেই গড় হয়ে পায়ের ধুলো মুখে এবং কপালে স্পর্শ করানো—অমৃত-জীবন পান যেন যেন।দীর্ঘায়ু হওয়া, কল্যাণ কামনা এবং যাবতীয় দুঃখভোগ থেকে নিষ্কৃতি লাভ।

ঝুপড়িমতো ঘরে মানুষটির একটি ইস্পাতের ফলা আছে। ঠাকুরদার অনুমতি গ্রহণে মানুষটি এত বেশি উৎফুল্ল যে সে ছুটে গেল। ইস্পাতের ফুলাটি রোদে চকচক করছিল। সে তরমুজ কেটে দিল। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য ঠাকুরদা এবং আমি আশ্রয় নিলাম।

ঠাকুরদা বললেন, তোমাদের গাঁয়ে কী দেবী আবির্ভূত হয়েছেন!

গিরিশ লোকটি নতমস্তকে বলল, আজ্ঞে আপনার কৃপা। অর্থাৎ ঠাকুরদা গত অগ্নিবর্ণ ঋতুতে গিরিশ মাঝির গাঁয়ে মন্ত্রপাঠ করে গেছেন—দেবীর তুষ্টিবিধানে পূজা-আর্চা—কোনো অনিয়ম না হলে দেবীর কোপ হবার কথা না। তিনি এই ঋতুতে নিমপাতাভাজা এবং নিরামিষ ভোজনের পরামর্শ দেন। দক্ষিণমুখী শয়ন নিষেধ কিংবা মাছ গুটিবসন্তের জীবাণু বহন করে এমন বিধান দিয়ে থাকেন। বায়ুতে জীবাণু ভেসে বেড়ায় এবং নিমগাছ তার যে প্রতিষেধক তিনি বাড়ির দক্ষিণে তা লাগিয়ে সুফল পেয়েছেন বলে থাকেন।

গিরিশ জ্যাঠা বলল, এই লু-এর মধ্যে নাতিকে নিয়ে কোথায় রওনা হলেন কর্তাঠাকুর!

যাব লাধুরচর। মা শেতলার পুজো দিতে যাচ্ছি। দেবী কোন ফাঁকফোঁকরে ঢুকে গেছে। বিধান না-মানলে এই হয়! যেন কর্তাঠাকুরের কোনো দৈব বিধান লঙ্ঘন করার শাস্তির নিমিত্ত দেবীর নজর পড়েছে। ঠাকুরদার কথাবার্তায় ক্ষোভ।

তারপর তিনি বললেন, সুনুকে সঙ্গে নিচ্ছি নিরুপায় হয়ে। রাতে মা ওলাওঠার দেবী দর্শন দিলেন। বললেন, তুই একা যাস না অবনী, একা যাস না। সঙ্গে তোর প্রিয় কাউকে নিস!দেবীর নির্দেশে নিয়ে যাচ্ছি। তিনিই রক্ষা করবেন।

আমার ঠাকুরদার নাম অবনীন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, বলে রাখা ভাল। তিনি সম্পন্ন গেরস্থ। জমিজমা চাষ আবাদ সহ পুত্ররা তাঁর চাকরিসূত্রে প্রবাসী। বাড়িতে গৃহদেবতা, অষ্টপ্রহর দেবদ্বিজের গুণগান। মা-জেঠিমারা হেঁশেল সামলাতে প্রাণান্ত—অতিথি-অভ্যাগত, শিষ্য এবং বিধান যারা নিতে আসেন দক্ষিণের ঘরে তাঁদের রাত্রিবাস।

আমি ঠাকুরদার প্রিয় জানি। সবার চেয়েও প্রিয় হতে পারি। ওলাওঠা দেবী রাতে স্বপ্নে তাঁকে বোধ হয় দর্শন দিয়েছেন—যাতে তাঁর কৃপালাভ হয়, সেজন্য তিনি প্রিয় নাতিকে সঙ্গে নিয়েছেন দেবীর নির্দেশ লঙ্ঘন করার সাহস হয়নি। কারণ বড় অসময়। বসন্ত ঋতুটির সর্বত্র যেন আগুনে বাস। মড়ক, গৃহদাহ এ-সময়টায় মানুষের জীবনে বেশি গুরুত্ব পায়। অসময়ে দেবীর কোপ কার উপর এসে পড়বে কেউ জানে না। কোপ থেকে রক্ষা পাওয়া এমনিতেই কঠিন। মড়ক শুরু হবার এটা বড়ই প্রশস্ত কাল। মড়ক নিস্তেজ হয়ে এলে জীবিতরা ওলাওঠা দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য দল বেঁধে বাড়িতে হাজির হয়।

এ-হেন সময়ে ঠাকুরদা তাঁর দেবীর সাক্ষাৎকারটির নিপুণ বর্ণনা আমাকে দিতে থাকলেন।

—বুঝলে, ঋতুটি অগ্নিবর্ণ। দেবীর গায়ের রঙ অগ্নিবর্ণ। শ্বেতবর্ণ গর্দভের পিঠে তিনি গমনাগমন করেন। তাঁর দুই চোখ রক্তবর্ণ। মুখে প্রসন্ন হাসি। প্রকৃতির গভীর রহস্য তাঁর গোপন অঙ্গে। সৃষ্টি স্থিতি বিনাশ গোপন অঙ্গে বিদ্যমান।

গোপন অঙ্গ কী, প্রশ্ন করতেই ঠাকুরদা বিস্ময়ের গলায় বললেন, গোপন অঙ্গ বোঝ না! বোঝা উচিত।

ঠাকুরদার কণ্ঠে শ্লেষ। চতুদশবর্ষীয় হলে জীবনের অনেক গূঢ় রহস্য জানার কথা। আহাম্মক না হলে আমার এমন প্রশ্ন শোভা পায় না। আমি বুঝতে পারছি, গোপন অঙ্গ কী, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। কারণ আবু আমার সমবয়সী—কখন বর্ষায় কিংবা গ্রীষ্মে তার সেই গোপন অঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এটা সুবিধাজনক গ্রীষ্মের সময়। তখন পুকুরপাড়ে পাটের জমি, মাথাসমান উঁচু পাটগাছ, পাড়ে বড় বড় আমের বৃক্ষ। ডালপালা জমির উপরে ঢুকে গেছে। ঝড়ে কিংবা আম পেকে গেলে পাটের জমিতে আম পড়তেই পারে। জমিটা নরেন দাসের, এবং নরেন দাসের কনা আবুর যখন ক্ষোভ থাকত আমার উপর, ওদের জমিতে আম পড়লে কিছুতেই নিতে দিত না। গাছ আমাদের, জমি তাদের। সুতরাং আবুর সঙ্গে বচসা হত। আবু আম নিয়ে পাটের জমিতে সহজেই অদৃশ্য হয়ে যেত জমির ভিতর ঢুকে যেতাম। উপরে মাথা সমান পাটগাছ, তার ভিতর গাছ ফাঁক করে ছুটতে ছুটতে যখন আবিষ্কার করতাম—অবাক, সে তার হাত বাড়িয়ে বলত, নাও। যেন সে ইচ্ছে করেই বচসায় লিপ্ত হয়েছে, এবং আম নিয়ে গভীর কোন গোপন জায়গায় আমাকে নিয়ে যাবার বাসনাতে মনে মনে ষড়যন্ত্র এঁটেছে।

এটা ছিল আবুর নিজস্ব এক জগৎ—যেখানে এক বালক তাকে তাড়া করে। ইদানীং আবু খুবই নিষ্ঠাবতী এবং মা শেতলার ভরও ওঠে। শেতলাঠাকুর যে গায়ে হাজির থাকে. আবুকে সে গাঁয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঠাকুরদা আবুর উপর অপ্রসন্ন। দেবীকে ঠাট্টা-তামাসা তাঁর পছন্দ নয়। তিনি আবু এবং নরেন দাসের উপর খুবই ক্ষুব্ধ। সামান্য বালিকা, তার এত তেজ। সে দেবীর বার্তাবাহক।

আমরা এ-সময় বাজার পার হয়ে সাঁকোতে উঠে যাব। সামনে বল্লভদি গ্রাম। বাজারের মুখে বড় বড় পাটের আড়ত। দোচালা টিনের লম্বা ঘর, সেঁচা বাঁশের বেড়া। নিচে অনেকটা দূরে দামোদরজীর মঠের ত্রিশূল আকাশে ভেসে আছে। দু-পাশে মান্দার গাছ। তার ফুলও অগ্নিবর্ণ। বসন্ত ঋতুটির মহিমা যেন অগ্নিবর্ণ হয়ে থাকা। সব পুড়িয়ে ছারখার করে দাও। একটা কোকিল ডাকছিল।

ঠাকুরদাকে বললাম, দেবী কখন স্বপ্নে দেখা দিলেন?

—স্বপ্নে বলছ কেন?

—তবে।

—তিনি নিজেই এসেছিলেন। স্বপ্ন কি জীবন থেকে আলাদা। তাকে তুচ্ছ করার হেতু এত প্রবল কেন তোমার মধ্যে! তুমি জান তিনি আমাদের কী-ভাবে রক্ষা করছে। তাঁর কৃপায় আমার বাড়ি ওলাওঠা কী জানে না। গুটিবসন্ত কী জানে না।

এটা ঠিক, আমি মনে করতে পারছি না, আমাদের পরিবারে কেউ গুটিবসন্তে কিংবা ওলাওঠায় আক্রান্ত হয়েছে। শুনেছি, ঠাকুরদা কালপুরুষ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাড়িটার চারপাশে বন্ধন পড়ে গেছে। দেবীর বাহন কিছুতেই কাছে উঠে আসতে চায় না। কারণ নিমগাছে মরা কাক ঝোলে। কারণ ঠাকুরদা তাঁর কাঁসিঘণ্টা এত জোরে বাজান, কিংবা এত জোরে ঠাকুর বৈকালির সময় শঙ্খে ফুঁ দেন যে দূরবর্তী গায়ের লোকেরাও টের পায় আজকের দিনটির মতো কর্তাঠাকুরের কাজ শেষ। কখনও ঠাকুরদা বলতেন, এই বাদ্য শঙ্খ বল, কাঁসিঘণ্টা বল কিংবা ঢাকের বাদ্য যতদূর যায় ঠিক ততদূর আলাইবালাই থাকে না।

ঠাকুরদার চিন্তাভাবনা কিংবা বিশ্বাস আমাকেও তাড়িত করে। শনিঠাকুরের মতো মা শেতলাও কাঁচাখেকো দেবী। তিনি বিরূপ হবেন ভেবে সবাই তটস্থ থাকে।

—তিনি কখন এলেন?

ঠাকুরদা বললেন, ভোররাতে।

ভোর রাতের স্বপ্ন সত্য হয়—আমার নিজেরও এমন বিশ্বাস আছে। সুতরাং এই ঠা-ঠা রোদ্দুরে যতই কষ্ট হোক, তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। গাঁয়ের উপর দিয়ে তিনি যাচ্ছেন না। বরং জমির আলে আলে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়। গাঁয়ে ঢুকলে দেরি হয়ে যাবে তিনি জানেন। বাড়ি বাড়ি উপবেশনসহ জলযোগ এ-সব রকমারি ঝামেলা পরিহার করার জন্যই প্রায় গোপনে তিনি মাঠ পার হয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। মাথার ভিজা গামছাটি তৃতীয় বারের মতো শুকিয়ে উঠলে তা তিনি জলে ভিজিয়ে নিলেন। ব্রহ্মতালু ঠাণ্ডা থাকলে শরীর সতেজ থকে। বাড়িতেও ভিজা গামছা মাথায় দিয়ে বসে থাকার অভ্যাস আছে তাঁর।

ঠাকুরদা হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। সাঁঝবেলায় পূজাপাঠ শুরু হবে। লাধুরচরের শিবেশ্বর পালকি পাঠাবে বলেছিল, তিনি রাজি হননি। কারণ, দেবীর প্রতি অনুরাগ থাকলে পালকি চড়ে যাওয়া ঠিক না। দেবীকে তিনি অপমান করতে পারেন না—তা ছাড়া তিনি এই বয়সেও সতেজ কোনো মানুষের চেয়ে কম না—এই অহংকার কাজ করে। তিনি হেঁটে অতদূর গেছেন, তার অর্থ কোনো দৈবশক্তি তাঁর মধ্যে আছে, নতুবা যখন দাবদাহে কাকপক্ষী পর্যন্ত গাছের ডালে বসে থাকে, এবং গেরস্থ মানুষেরা ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে দাবদাহ থেকে আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে তখন একমাত্র অঞ্চলের কালপুরুষের পক্ষেই সম্ভব চার ক্রোশ পথ অক্লেশে হেঁটে যাওয়া। মনের মধ্যে তাঁর এক বালিকা এখন বুড়বুড়ি কাটছে সম্ভবত। কারণ তিনি বললেন, আবুর উপর মা শেতলার ভর হয়। তোমার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে কী এ-সম্পর্কে।

আমি শুনেছি। তবে গাঁয়ে মা শেতলার পূজা হলে আমার ছোটকাকা যান, সেজকাকাও পূজাপাঠ করেন। খুব নিদান কাল না এলে ঠাকুরদা যান না। লাধুবচরে এবার মড়ক লেগেছিল—এত বড় মহামারী থেকে গ্রামটিকে রক্ষা করা শুধু শেতলাপূজায় হবে না বলেই, ঠাকুরদা রাজি হয়েছেন। কর্তাঠাকুরকে যে করেই হোক রাজি করাতে হবে—এই ভেবে সব দলবল শিবেশ্বরের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ কর্তাঠাকুর এবং মা শেতলা দুই প্রায় বলতে গেলে প্রতিপক্ষ—তৃতীয় প্রতিপক্ষ বুঝি আবু। কোন দৈববলে আমার ঠাকুরদা তার বাড়িকে রক্ষা করে আসছেন কেউ জানে না। জানে শুধু মা শেতলা, যতই কাঁচাখেকো দেবতা হোক কর্তাঠাকুরকে সমীহ করেন। তিনি না করলেও তাঁর বাহনটি। কিছুতেই হেট হেট করে বাহনটিকে মা শেতলা ঠাকুর আমাদের পুকুরপাড়ে তুলে দিতে পারেন না।

তবে আবুর দেবী-ভক্তি প্রবল। আমাদের গাঁয়ে কার বাড়ি গুটিবসন্ত হয়েছে টের পেতাম, সেঁচা বাঁশের বেড়ায় নিমের ডাল দেখতে পেলে। সেদিকে যাওয়া বারণ—বাড়ির ভিতর ঢোকা বারণ। বড়রা ঢুকতে পারে, ছোটরা পারে না, আবু কিন্তু সহজেই সে-সব অগ্রাহ্য করতে পারত। তার ধারণা সে দেবীর পূজার ভোগ নৈবেদ্য থেকে ফুল বেলপাতা সব আহরণ করে থাকে—শুদ্ধ বস্ত্রে উপবাস থাকে, সবচেয়ে আগে সে পূজায় যোগ দেয়। সবার শেষে সে ফিরে আসে। দেবীর অনুগ্রহ আছে বলে, ওলাওঠা কিংবা গুটিবসন্ত তার হতে পারে না।

শুনতে পাচ্ছি দূরে কোথাও ঢাকের বাদ্য বাজছে। তারপর সেই ঢাকের বাদ্য ক্রমে নিকটবর্তী হতে থাকলে দেখলাম, প্রায় জনা পঞ্চাশ মানুষ, মাঠের উপর দিয়ে ছুটে আসছে। মাথায় কারো ওলাওঠার দেবী, কারো হাতে নিমের ডাল, কেউ ধুনুচিতে আগুন জ্বালিয়ে দেবীর পেছনে ছুটছে। পথিমধ্যে কর্তাঠাকুরকে পেয়ে তারা গোল হয়ে দাঁড়াল। আমি, কর্তাঠাকুর আর ওলাওঠার দেবী—তারা সব গোল হয়ে বাজনা বাজাচ্ছে নাচছে, এবং এক ধরনের কথাবার্তা—যা শুনে মনে হয়, আপৎকাল উপস্থিত তাদের। একমাত্র এই কালপুরুষ এবং দেবীই এখন অবলম্বন।

একজন আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে চাইল—কারণ এখন চাই দ্রুতগতি, যত সত্বর দেবী এবং কালপুরুষকে নিয়ে গাঁয়ে ওঠা যায়! আমি উঠতে চাইলাম না। কর্তাঠাকুর দ্রুত হাঁটতে পারেন, দেবীও দ্রুতগামী এখন, এবং সবাই। আমিও পারি। সবার সঙ্গে ছুটতে থাকলাম।

লাধুরচর গ্রামটি নদীর পাড়ে। আমাদের এই অঞ্চলে এক-আধ ক্রোশের মধ্যে নদী না হয় খাল পাওয়া যায়। ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার খাড়ি নদী অঞ্চলটিকে ফালা-ফালা করে দিয়েছে। নদী মজে যাওয়ায় চরায় বোরো ধানের চাষ, লংকার জমি এবং কোথাও তরমুজের খেত। এ-সময় সব গমের চাষ উঠে যায়। লংকা, তরমুজ আর বোরো ধানের চাষ থাকে। সেও নিচু জমি এবং নদীর চরা হলে ভাল হয়। আমরা এ-সব মাড়িয়ে গাঁয়ে উঠে যাবার মুখে দেখলাম, সব মানুষজন ঢাকের বাদ্য শুনে জড় হয়েছে। করজোড়ে আছে। কতাঠাকুরের পায়ে কেউ পড়ে গেছে সটান। গড়াগড়ি দিচ্ছে এবং বিলাপ—হায় কালপুরুষ, হায় আমার কপাল, আমি কী করব বলে দেন! আমার সব গেছে। পায়ে ঠাঁই দেন।

কর্তাঠাকুর শুধু বললেন, জীবন এ-রকমেরই। তাঁর ইচ্ছে সব। তিনি করাচ্ছেন সব—তুই আমি নিমিত্তমাত্র। যে কদিন আছিস ঠাকুরের নাম কর। ইহকালে শুধু বেঁচে থাকলেই হয় না। পরকালের কাজ করতে হয়। বিলাপ করলে আত্মার অমঙ্গল হয়। সে যেতে পারে না। মায়ায় আটকে থাকে। এ-সব যখন বলছিলেন, তখনই সহসা তাঁর কপালে কুঞ্চন দেখা গেল। চোখ-মুখ কঠিন পাথরের মতো।

আরে আবু দেখছি দাঁড়িয়ে আছে। সবার মধ্যে আবু যেন আর এক দেবী। তাকে রাঙা চেলি পরানো হয়েছে। গলায় জবাফুলের মালা। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। ভিড় তার চারপাশে। কর্তাঠাকুরের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বিন্দুমাত্র। কর্তাঠাকুরের চোখ-মুখ পাথরের মতো কঠিন কেন বুঝতে পারছি। এক সামান্য বালিকা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। সেও এসেছে, এই মড়ক থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। এসেছে না, বরং বলা যায় নিয়ে আসা হয়েছে।

সবাই কর্তাঠাকুরের পায়ে সটান গড় হচ্ছে, উঠে যাচ্ছে। এমনকি আমার পায়েও—একমাত্র আবু দাঁড়িয়ে আছে, সে কর্তাঠাকুরের পায়ে গড় হল না। গড় যে হয় না তা না, কিন্তু আজ সে আর এক দেবী, কারণ পূজা শেষ হলে প্রদীপ জ্বালিয়ে তার চারপাশে নৃত্য শুরু হলে আবু গুম মেরে থাকবে। তারপর ঘোরের মধ্যে পড়ে যাবে। ঠাকুরদার ইচ্ছে নয়, এ-সব সঙ কিংবা ছলনা। সামান্য এক নারী। এত জোর পায় কী করে!

আমি জানি আবুর স্বভাব অদ্ভুত। যেখানেই কাছেপিঠে ওলাওঠার দেবী, সেখানেই সে। তবে এতদূরে আসার কারণ আবুই বলে দিল, এটা তার মামার বাড়ির দেশ। মামারা নিয়ে এসেছে তাকে।

আমাদের গায়ে প্রতি বছরই দু-একজন যায়—হয় ওলাওঠায়, নয় গুটিবসন্তে। অগ্নিবর্ণ ঋতুটির সমাগম হলেই মানুষজন যেন প্রাণ হাতে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। আবুও তখন একরোখা হয়ে যায়। এবং রুগীর পরিচর্যা করে। তার যা বয়স তাতে বাড়ি ঢোকাই বারণ, যেমন আমরা ছেলেছোকরারা ঢুকতে পারি না। আবু রুগীর ঘর থেকে বের হয়ে সোজা শেতলাথানে যায়। সেখানে উবু হয়ে পড়ে থাকে। গত বছর সোমেশ্বরের নাতিকে সে ভাল করে তুলেছে এমন জনরব আছে। তবে সে সহজে যায় না। সে কী ভাবে কে জানে, বলেও দেয়, পারবে না। মা শেতলার ইচ্ছে নয় যাই। তাঁর ইচ্ছে না হলে জোর করে নিয়ে যায় কী করে? আবু না গেলে কর্তাঠাকুর। কর্তাঠাকুরের এক কথা, বালিকার মরণ ঝুলছে কানে। দেবীরে নিয়া তামাসা। দেবী তার সঙ্গে কথা বলে। শূদ্রকন্যার এত তেজ! হ্যাঁ, ভেবেছে কী!

আমার মনে হল, কর্তাঠাকুরের যা কঠিন পাথরের মতো মুখচোখ দেখছি, তিনি না দুর্বাসার মতো কূপিত হয়ে পড়েন।

ওলাওঠা না হবার কারণ আমাদের পানীয় জলের সরবরাহ সঠিক আছে অথবা এমনও হতে পারে, জলে প্রতিষেধক ব্যবহার হয়ে থাকে। গরমের দিনে জলে ফিটকিরি দেবার প্রথা থাকায় কিংবা সংক্রামক ব্যাধির সচেতনতা পরিবারে ওলাওঠা ঢুকতে দেয়নি। গরিব মানুষের ঘরে মড়ক এ-জন্যও বেশি হতে পারে—পরে আমার এমন মনে হয়েছে।

আমাদের বাড়ির দক্ষিণে সারি সারি নিমগাছ। ঠাকুরদা ঠাকুরঘর থেকে বের হয়ে ফাল্গুন-চৈত্রে নিমগাছের নিচে জল দেন। কখনও গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। এবং বর্ষায় যখন নিমের চারা বড় হয় তিনি সযত্নে তুলে রাখেন—কেউ এলে বলেন, নিয়ে যা। বাড়ির দক্ষিণে লাগিয়ে দিবি। গুটিবসন্তের ভয় থাকবে না।

সেই থেকে আমারও কেন যে বিশ্বাস জন্মে গেছিল, যতদিন বাড়িতে গৃহদেবতা আছে, নিমগাছ আছে, ইদারার জল আছে আর আছেন পিতামহ, ততদিন ওলাওঠা কিংবা গুটিবসন্ত বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। এছাড়া তিনি কালপুরুষ অঞ্চলের মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহের সাক্ষী। তিনি যজমানের বাড়ি পা দিলেই পাপ হালকা হয়ে যায় এবং এই যে আমরা চার ক্রোশ পথ হেঁটে এসেছি, এবং এখন চৈত্রে খর রোদ থেকে পরিত্রাণে এই গাছের নিচে বসে থাকা, কারণ, এ গাঁয়ে রাত্রিবাস করতে হবে। তবে আমি কিংবা পিতামহ কেউ ঘরে ঢুকব না। সাঁঝ লেগে আসছে। ধূসর মাঠ সামনে। ফসলহীন। এবং নিস্পাপ খয়েরি রঙের একটা নক্ষত্র উঠে আসছে পুব আকাশে। ওলাওঠার দেবী অশ্বত্থের নিচে। চারপাশের আগাছা চেঁছে জায়গাটা গোবরজলে নিকানো। সামিয়ানা টানানো হয়েছে—হ্যাজাক বাতি জ্বেলে দেওয়া হয়েছে দুটো। সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। পিতামহ জলচৌকিতে বসে আছেন, আমি তাঁর পাশেই।

বড় হয়ে ফাল্গুন এবং চৈত্রমাস অর্থাৎ বসন্ত ঋতুটি নিয়ে কাব্য গাঁথা পড়লে আমার হাসি পেত। বলতে ইচ্ছে হত মহামারীতে কোন ফুলের সুবাস আছে বল হে কবি! সেই গরিব-গুরবো মানুষের ঘরবাড়ি তখন জতুগৃহ হয়ে থাকত। খড় এবং পাটকাঠির বেড়া গোবর লেপা, কখনও দেখতাম নৈঋত কোণে দূর আকাশ অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠছে। দক্ষিণে উত্তরে, পুবে পশ্চিমে প্রায় রোজই আকাশ লাল অথবা গরলের মতো নীলাভ হয়ে যাচ্ছে ঋতুটি—যেদিকে চোখ যায়, ঝড় এবং পাতাঝরার খেলাশেষে এ কী ভয়ঙ্কর রূপ—তুমি কে হে জ্বলে উঠছ আপনমনে! কী যে ভয় লাগত। ঋতুটি চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে যেন নৃত্য করছে।

পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে অথবা উত্তরের মাঠে নেমে গেলে এ-হেন বর্ণের ত্রাস আমাদের কেমন নির্জীব করে রাখত। প্রকৃতি সব সময়ই কী দারুণ রুদ্ররোষে যুঁসছে—কী জানি, বর্ষায় নদীনালা ভেসে গেলে এতটা নিনাদ শোনা যেত না—কিংবা শীতে। শীতকালটা যব গমের মাটিতে, লুকোচুরি খেলা, আবু, শোভা, নলিনী আর সব সমবয়সীরা ঢুকে গেলে, আর এক ইচ্ছের বর্ণময় রূপ টের পেতাম ভিতরে। আবু ফ্রক পরে যব-গমের খেতে একবার লুকিয়ে থাকলে, পেছন থেকে সাপটে ধরেছিলাম। চোর-পুলিশ খেলা, এবং শীতের মধ্যে টের পেলাম, উষ্ণতায় ডুবে যাচ্ছে আবু। আমার গাল লেপটে গেছে তার গালে। নিঝুম হয়ে আসছে সব কিছু যেন। এ কীসের ঘ্রাণ পেলাম! অথবা আস্বাদন—যেন আবু আমাকে জড়িয়ে চুপচাপ সেই গোপন গভীর সবুজ অন্ধকারের ভিতর চঞ্চল অভিসারে চলে যাচ্ছে।

আবু হ্যাজাকের আলোতে পিছন দিয়ে বসে আছে। বিশাল সব গামলায় ফলমূল, একদিকে বিশাল সব উনুন, ধোঁয়া উঠছে, আগুন জ্বলছে—খিচুড়ি পায়েস রান্না হচ্ছে। দু’জন রাঁধুনী বামুন এসেছে—তারা রান্না করে দিয়ে চলে যাবে। কোথায় তাদের দেশ জানি না। মাথায় লম্বা টিকি, জবাফুল বাঁধা, মুখে খোঁচা দাড়ি। খারে কাচা কাপড় পরনে। গায়ে জামা থাকে না। হাতা খুন্তি বগলে নিয়ে এ-সময়ে তারা কোথা থেকে যে নেমে আসে! কর্তাঠাকুরের পায়ের কাছে বসে একজন এই কিছুক্ষণ হল তার দেশবাড়ির গল্প বলে গেছে। শীতের শেষে বের হয়ে পড়েছে। গাঁয়ে গাঁয়ে ওলাওঠা দেবীর অন্নভোগ রান্নার দায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর নেশা। পাপ খণ্ডন হয়। যেন বাঘের থাবা খাবলা খাবলা মাংস খসিয়ে নিয়েছে মুখ থেকে—এমত মুখ গুটিবসন্তে। একটি চোখ পায়রার পচা ডিমের মতো নষ্ট।

গুটিবসন্ত ভারি নচ্ছার অসুখ। সারা শরীরে লাল মুসুরির মতো গোটা, আর তাপ শরীরে, যেন পচে থাকে শরীর, পচে যায় শরীর। নিমের পাতা ছড়ানো থাকে বিছানায়। ঘরের বেড়ায় নিমের ডাল গুঁজে দেওয়া থাকে। নিমের ডাল গোঁজা থাকালেই আমরা টের পাই দূর থেকে, বাড়িতে মহাকাল ঢুকে গেছে। গোটা পরে ফোসকা হয়ে যায়, মাংস পচতে থাকে, খসে যায়—এমন শুনেছি যে দুজন লোক রান্না করছে, তারা এই ভেবে খুশি, ওলাওঠার দেবীকে খুশি রাখতে পারলে, বাড়ির মানুষজনের ভয় থাকবে না। পয়সাও হয়, তা ছাড়া চাল ডাল তেল নুন খোরাকি মিলে যায়—একই সঙ্গে উপার্জন এবং দেবীর আরাধনা হয়।

ঠাকুরদা বলছিল, কোথায় থাকা হয়, নিবাস কোথায়? যে লোকটার একটা চোখ নষ্ট, পায়রার পচা ডিমের মতো ঝুলে আছে, সে বলল, কর্তা নিবাস আমার ভাওয়াল পরগনার অন্তর্গত বনদুর্গাপুর গাঁয়ে।

বনদুর্গাপুর নামটা আমার এই প্রথম শোনা। এমন সুন্দর নাম হয় গাঁয়ের জানা ছিল না। ভাওয়াল দেশটা কোথায় জানি না কিন্তু ভাওয়াল রাজবাড়ির সেই সন্ন্যাসী রাজার মামলা চলছে, কত সব বিস্ময় রাজার নামে পদ্য পড়ে একটা লোককে হাটে চার পাতার বই বিক্রি করতে দেখেছি। লোকটা নিজেই পদ্য বানিয়েছে। পায়ে ঘুঙুর, নেচে নেচে বলত, শোনো শোনো দিয়া মন, ভাওয়াল রানীর কেচ্ছা করিব বর্ণন—এমন তাল ঠুকে লোকটা ছড়া আবৃত্তি করত, যে ভিড় জমে যেত। এক পয়সা দাম মাত্র। লোকটা বই বিক্রি করত এবং সেই লুঙ্গিপরা মাথায় ফেটি, গায়ে ফতুয়া, আর খাঁচায় তার টিয়াপাখি—এই লোকটাও ছিল এক বিস্ময়। তাকে হাটে একবার দেখেছি, সেই থেকে ভাওয়াল নাম কিংবা সেখানে পরগনা আছে জানি—কত দূরে জানি না।

আমি ঠাকুরদাকে বললাম, কতদূর দাদু ভাওয়াল? তিনি বললেন, বিশ ক্রোশ হবে। একদিন একরাত লেগে যায়। বড় হলে যাবে।

এত দূরদেশ থেকে তবে দুই পাকের ঠাকুর বগলে হাতা খুন্তি নিয়ে বের হয়ে পড়েছে। আমার বেশ মজাই লাগছিল। লোকজনের ভিড়। বেলপাতা, বেলফুল, কচি আম, হরতকি দুই ঝুড়ি ভর্তি। আকাশ নীল। কুরচি ফুলের মতো নক্ষত্ররা ভেসে বেড়াচ্ছে।

দূরদেশ থেকে আবু এসেছে। আমি ঠাকুরদার সঙ্গে এসেছি। আবুর দুই বিনুনি, মাথায় রাঙাজবা, সে শুদ্ধ বস্ত্রে ঠাকুরের ফল ফলাদি কাটছে। ওর মামি-মাসিরা এবং গাঁয়ের অন্য নারী সব এখন ভিড় করছে—কিন্তু আবুই যেন এই ওলাওঠা ঠাকুরের একমাত্র সেবার অধিকারী। সে একেবারে প্রবীণার মতো কথা বলছে। হাঁটাচলা এমন যে সে কাউকে গ্রাহ্য করছে না। আমার সঙ্গে এত ভাব, এখানে সে যেন চিনতেই পারছে না। অথবা কোনো মেলায় কিংবা বান্নিতে আলাপ এমন ভাব দেখাচ্ছে। আমরা দু’জনেই যেন দুই প্রান্তে লাল বাতাসা খাচ্ছি।

মুশকিল হল, ঘট গামছা শাড়ি ফলমূল এবং ধূপদীপের ঘ্রাণের মধ্যে হরিণের চামড়া পাতা হয়েছে। হরিণের লোমে চামড়ার আসন ঢাকা। তার উপর পিতামহের পাশে আমাকে বসে থাকতে হবে। যজমান-বাড়ি যাবার অভ্যাস সেই কবে থেকে। শ্রাদ্ধে অন্নপ্রাশনে কিংবা বিয়ে উপলক্ষে পিতামহ আমাদের সবাইকে যজমান-বাড়ি নিয়ে যাবেনই। সেই উপলক্ষে আমার চামড়ার আসনে বসার সৌভাগ্যই আছে। বড্ড কুটকুট করে—কম্বলের আসন কিংবা হরিণের চামড়ার আসন কষ্টদায়ক বিষয়—দেবীপূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পিতামহের পাশে চুপচাপ বসে থাকা বড় অস্বস্তিকর। সবচেয়ে অস্বস্তিকর, আবুর ভর উঠবে, পূজাশেষে। এ-অঞ্চলে আবুর উপর দেবীর ভর হওয়া এক দৈব ঘটনা। মানুষজন ঝেঁটিয়ে আসছে। একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে মিষ্টির দোকান, তারপর মুড়ি-মুড়কির দোকান পর্যন্ত লোকজনের হাঁটাহাঁটি। ঢাকের বাদ্য এমনই সাংকেতিক বোল তুলছে যে মানুষজন ঘরে থাকতে পারছে না। যেমন এই অগ্নিবর্ণ ঋতুতে জতুগৃহ হয়ে থাকে পাটকাঠির বেড়া, শনের চাল এবং আগুন ধরে গেলে, মানুষজন সর্বস্ব হারায়। তা ভর ওঠার মধ্যে আছে তার থেকে নিষ্কৃতি, রোগভোগ থেকে নিরুদ্দেশের খবর পর্যন্ত আবু গড়গড় করে বলে দিতে পারে। তাকে মনেই হয় না, সে আমাদের গাঁয়ের আবু, বালিকা কন্যা কিংবা মা জেঠিদের ভাষায় কুমারী কন্যা—কুমারী কন্যার যেন ঘুম ভেঙে যায়, তার মুখ হ্যাজাকের আলোতে চকচক করে। কেমন অন্যলোক থেকে সে বলে, দেবী প্রসন্ন হয়েছেন, তার ভোগ প্রসাদ গ্রহণ কর।

তখনই পাত পড়তে শুরু করবে। মচ্ছবের মতো লম্বা লাইন—যে যার কলাপাতা কেটে এনেছে, ইদারা থেকে ঠাণ্ডা জল—ভোগ খেয়ে সবার মধ্যে যে ত্রাস থাকে তা কাটিয়ে উঠতে পারলেই আবু আবার সেই নরেন দাসের কন্যা। তখন আর তাকে দেখলে কেউ গড় হয় না। সে আমাদের সঙ্গে যব-গমের চোরপুলিশ খেলায়ও যোগ দিতে পারে।

পূজার তন্ত্রমন্ত্র আমি কিছু কিছু জানি। পাদ্য অর্ঘ্য, সঙ্কল্প এবং গণেশের ধ্যান আমি জানি—যেমন মন্ত্রোচ্চারণ—ওম্ খর্ব স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদর সুন্দর প্রসন্ন গন্ধলুব্ধ—তারপর ভুলে যাচ্ছি। কর্তাঠাকুর আচমন করতেই ঢাক ঢোল কাঁসর বাজতে শুরু করেছে। দেবীর হাতে কলসি এবং ঝাঁটা—এ সব কিসের প্রতীক আমি জানি না। তবু আতঙ্ক—অদ্ভুত বিশ্বাস আমাকে তাড়া করে। আমি ঠাকুরদার পাশে বসে তার নির্দেশমতে, ঘণ্টা তিল তুলসী এগিয়ে দিচ্ছি, কখনও পুরোহিত দর্পণ থেকে মন্ত্রপাঠ করলে তিনি জোরে জোরে তা উচ্চারণ করছেন। চারপাশে মানুষজনের ভিড়। তারা ক্রমে ত্রাস থেকে মুক্ত হবে এবার। আসলে মানত থাকে, দেবীর পূজা সাঙ্গ হয়, সদ্য ভেড়াবলি, একটা ভেড়ার কাটা মুণ্ডু গামছায়। সকালে পিতামহ যখন রওনা হয় তখন গাঁয়ে কোনো মানুষ মাথায় বয়ে নিয়ে চলে, আতপ চাল, কাঁচা হরিদ্রা, পটল বেগুন—দেবীর ভোজা এবং দানের শাড়ি—বেশ বড় পুঁটুলি নিয়ে লোকটা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আবু দেখি পিছনে ছুটে আসছে।

তার চোখে রাত-উজাগরে চিহ্ন।

এই মেয়ে সারারাত জেগে ছিল। আমাদের সঙ্গে ফিরবে বলে, সে আর বোধ হয় ঘুমায়নি।

নদীর পাড়ে শ্মশান। সেখানে সাদা কাপড়ে মৃতদেহ ঢাকা। বেশ মোটা দড়ি এবং বাঁশ দিয়ে মোড়া ডুলির মতো বয়ে আনা হচ্ছে—কারণ, এ-সময় নদীর পাড়ের শ্মশান সব সময় অগ্নিবর্ণ থাকে, সার দিয়ে চিতা সাজানো হয়।

আমি ভয় পাব বলেই পিতামহ পাড় ধরে গেলেন না। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সাদা কাপড়ের নিচে কে শুয়ে আছে দেখি। কিন্তু ত্রাস আমারও কম না, সব সময়ে ঠাকুরদাকে অনুসরণ করছি। আবু আমাকে অনুসরণ করছে।

আবু বলল, কালাচাঁদের বেটাকে শেতলাঠাকুর খেয়েছে।

কালাচাঁদকে চিনি না। কিন্তু আবু চেনে।

আমাদের সমবয়সী, দেবী কাঁচাখেকো, আমাদের মতো বয়সীদের উপর তাঁর কোপ বেশি। যে দু’জন পাকের ঠাকুর বনদুর্গাপুর থেকে এসেছিল, তারাও ছুটে চলেছে। এবং তারা কিছুটা এসে আমাদের ধরে ফেলল। শ্মশানে যমদূতের মতো কিছু মানুষজন, কাঠ, শনের চালা—তার নিচে দাঁড়িয়ে ওরা দু’জন খবর নিয়েছে, কালাচাঁদের গাঁ কোথায়, খোটে বাঁধা জাবদা খাতা। মায়ের দয়ায় গেছে। বাড়িঘরের ঠিকানা নিয়ে ঠাকুরদার লগ ধরেছে। টুকে রাখল। ‘কালাচাঁদের বায়না’।

এ বড় দুঃসময়—ঠাঠা রদ্দুরে আমরা হাঁটছি। সেই পথ, পুকুর নদী নালা শুকিয়ে ফুটিফাটা। রোদের ঝিল্লিতে যেখানে যা কিছু সবুজ জ্বলছে। রোদে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। কাটা মুণ্ডুর একটা চোখ গামছার ফাঁকে আমাকে দেখছে।

আবু কী বুঝল কে জানে! সে দৌড়ে গেল মালবাহী লোকটির কাছে। ও মামা, দাঁড়াও।

মুণ্ডুটা এক হাতে ঝুলছিল।

আবু মুণ্ডটা গামছা টেনে ঢেকে দিল।

ঠাকুরদা উচ্চারণ করলেন, পরম ব্রহ্ম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মহা ঘোরে পড়ে গেছে প্রকৃতি। মারীভয় প্রকট। পাতক এবং পুণ্যবান কেউ রেহাই পায় না। সাবধানে হাঁটবে। ওই যে দেখছ প্রাচীন শিরীষ গাছ তার নিচে আশ্রয় নেব। জলতেষ্টা পেলেও কিছু করার নেই। এ-অঞ্চলে পানীয় জলের খুবই অনটন। মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খাচ্ছে। তরমুজের জমি নেই। বরং চল, আর একটু অগ্রসর হই। গোপের বাগে তপ্ত কাঞ্চন রঙের কোনো ফলবান বৃক্ষ পেতে পারি।

কাঞ্চন রঙের ফলবান বৃক্ষ কী হতে পারে বুঝতে পারছি না। কচি আম খুব উপাদেয় গরমে, সর্দিগর্মি থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত দাদু তাঁর পুঁটুলি থেকে প্রত্যেকের হাতে একটি করে কাঁচা আম দিলেন। জলতেষ্টা কিঞ্চিৎ প্রশমন হতে পারে বললেন।

ঠাকুরদার গম্ভীর গলা থেকে আরও যেন দৈববাণী হচ্ছে—তোমাকে দেবী তুষ্ট করতে কেন চান বুঝি না।

এ দেবী কে আমি ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। আবুর ভর হলে তার অন্য ঘোর। আমার পাশে আবু—সে লালপাড়ের শাড়ি পরেছে। ব্লাউজ গায়ে। বালিকা মনে হচ্ছে না। বরং দেবীর মতোই লাগছে। নরেন দাসের সুন্দরী কন্যা গাধার পিঠে বসে থাকলে, কাঁখে কলসি এবং হাতে ঝাঁটা দিলে ঠিক আর এক ওলাওঠার দেবী যেন।

এ সময় আমরা নদীর চরা ধরে হাঁটছি। দনদির হাট পার হয়ে শিমুলতলায় যাব। তারপর আবার শনের জমি ভাঙতে হবে। দখিনা হাওয়ায় শনের জমি ঠিক সেই তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ হয়ে আছে। ফলবান বৃক্ষ তপ্ত কাঞ্চনবর্ণের হয় কীভাবে আমি জানি না।

তাঁকে প্রশ্ন করলাম, কোথায় আপনার সেই তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ ফলবান বৃক্ষ?

তিনি পিছন দিকে তাকালেন। তাঁর গাত্রে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণের আভা, দীর্ঘকায় পুরুষ, এবং খড়ম পায়ে—এই খর-রোদে তিনি কাবু নন। তাঁর জলতেষ্টা পায় না। আল ধরে হাঁটার সময় তাঁর ঋজু চলাফেরা কোনো কালরুদ্রাদিদেবের মতো। আমার দিকে তাঁর চোখ এবং রক্তবর্ণ আভা। তিনি বললেন, রুদ্ররোষে প্রকৃতি জ্বলছে—তুমি কী বুঝছ! এস।

বলে তিনি দূর থেকে একটি ফলবান বৃক্ষের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখ!

আশ্চর্য, এ কোন ঘোর! সত্যি তপ্ত কাঞ্চবনর্ণের বৃক্ষ। ফল পাতা সব একরকমের। কাছে গেলে বুঝলাম ওটি মথুরাবাবুর আমের বাগিচা। নানা কিসিমের আম, এবং কাঁচামিষ্টি আমও সংগ্রহ করা গেল। খুব দূর থেকে কোনো বাগিচা, একটি মাত্র বৃক্ষ হয়ে যায় এই প্রথম টের পেলাম।

তাঁকে আবু বলল, ঠাকুরদা, আপনি কাঁচামিষ্টি আম খাবেন?

—আমার জলতেষ্টা নেই। আর ক্রোশখানেক পথ। বনদুর্গাপুর থেকে যে দু’জন আমাদের অনুসরণ করছে তাদের একজন হঠাৎ বসে পড়ল। হড়হড় করে বমি করছে। গরম এবং গুরুভোজন এই দুই কারণ হতে পারে। সে বলল, বড় তেষ্টা।

তিনি আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়ে কাছে গিয়ে ঝুঁকে কী দেখলেন। তারপর বললেন, ক্রোশখানের পথ। হাঁটতে পারবে।

মুখে মৃত মাছের চোখ দেখে আবু কেমন ভয় পেয়ে গেল। দেবী তবে সত্যি সঙ্গে অনুসরণ করছে। সে বলল, ঠাকুরদা, ওলাওঠার দেবী সঙ্গে রওনা হয়েছে।

তিনি কেমন ক্ষেপে গেলেন। বললেন, চুউপ। তারপর তিনি জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কিছু সবুজ লতাপাতা এনে হাতের তালুতে চিপে চিপে রস করলেন। লোকটিকে হাঁ করতে বললেন, নাম কি জানতে চাইলেন।

—পূর্ণচন্দ্র চাকি।

লোকটি রস খেয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ কবছে।

পূর্ণ চাকি কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কষে বমির বাসি দাগ ভেসে উঠছে। হাতের চেটোতে মুছে বলল, চার জায়গায় বায়না হয়ে আছে। আড়াই হাজার রায়বাবুর বাড়ি যেতে পারব তো। প্রাণবায়ু থাকবে তো কর্তাঠাকুর?

পূর্ণ কি তবে নিয়তি জেনে ফেলেছে? ত্রাসে পড়ে গেছে, আতঙ্ক! শেষ কারবার না মিটিয়ে গেলে আফসোস থাকবে। সঙ্গের লোকটি, যার চোখ পচা পায়রার ডিমের মতো ঝুলে পড়েছে এবং বীভৎস অবয়বে তাকালেই কণ্ঠা শুকিয়ে যায়, সে দৌড়ে এসে বলল, কী বুঝছেন! ঠাকুরদা রা করলেন না। তিনি আমাদের চলে যেতে বলছেন। আমি এবং আবু দু’জনই এবার ছুটতে থাকলাম। সনকান্দা পার হয়ে গেলেই সুমার বিলে পড়ব। বিল শুকিয়ে, ফুটিফাটা মাঠ। বর্ষায় কালাপানি এখানে কে বিশ্বাস করবে! সমুদ্র হয়ে যায়। কোথায় যে কে জল শুষে নেয়। অগস্ত্যমুনির কাণ্ড ভাবি। ও বেটা সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে সব জল শুষে নেয় আবার বর্ষায় ওগলে দেয়। আমার কেন যে অগস্ত্যমুনির ছবির সঙ্গে পিতামহের ছবি চোখে ভেসে ওঠে—যেন একই রৌদ্ররোষে দু’জনই প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ছে। দেবদেবীর পূজা দিয়ে, শান্তিস্বস্ত্যয়ন করে কিংবা বটুক ভৈরবস্তোত্রম্ পাঠ করে মারীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে চায়। আমি জানি, পূর্ণ চাকি যখন পিছু নিয়েছে, তাকে ঠাকুরদা আশ্রয় দেবেন। যতই সংক্রামক ব্যাধি হোক—ওলাওঠা কিংবা গুটিবসন্ত আমাদের চতুর্সীমানায় ঢুকতে গেলেই ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। কালপুরুষের ছায়া পড়ে বাড়িটায়। নিমগাছের ডালে মরা কাক হয়ে ঝুলে থাকে।

আমরা বারবার মরা কাক মড়কের সময় ঝুলতে দেখেছি গাছের ডালে। কে ঝুলিয়ে দেয় টের পাইনি। সেই অশ্বখুরের ধ্বনি কি ওলাওঠা দেবীর চেয়েও বিত্তবান। নিমগাছের ডালে মরা কাক ঝোলে। ঢাকের বাদ্যি বাজলে, অথবা ঋতুটি অগ্নিবর্ণ হয়ে উঠলেই, নিমগাছের ডালে মরা কাক ঝোলে। কালবৈশাখীর ঝড়ে পালক উড়ে যায়। ঠা-ঠা রোদ্দুরে মরা কাক শুকিয়ে কাঠ। তবু ঝোলে। বর্ষা নামলে ধপাস করে একবার মরা কাক গাছের ডাল থেকে নিচে পড়তে দেখেছিলাম। কোথা থেকে নেড়ি কুত্তা এসে গপ করে মুখে তুলেই ছুট লাগাল। কিন্তু কিছু দূরে গিয়ে হাঁটু মুড়ে পড়ে গেল। দাপাতে লাগল। এবং মরে গেল। বিষক্রিয়া হতে পারে। চটপটি বাজি পিঠের মধ্যে গুঁজে দিলে কাক ছোঁ মেরে নিয়ে গপ করে গিলে ফেললেই শেষ। সেই মরা কাক হয়তো কেউ ডালে ঝুলিয়ে দেয়। কে দেয় জানি না।

আবু আর আমি ছুটছি। বিলের চষা জমির উপর দিয়ে ছুটছি। কে বলবে, গেল রাতে মা শেতলার ভর উঠেছিল আবুর উপর। তাকে বলেও লাভ নেই। সে কিছু মনে রাখতে পাবে না। তার দেবীভক্তিই কারণ, যেমন পিতামহ দেবীর পূজা দিতে যান, তেমনি আবু গত দু-সাল ধরে যায়, ভর ওঠে, ফেরার সময় লোকজন সঙ্গে থাকে। কর্তাঠাকুর আছেন সঙ্গে, সেইহেতু আবুর সঙ্গে কেউ আসেনি। কেউ এলে পিতামহ অপমানবোধ করতেন। তাঁকে অনুসরণই শেষ কথা যেন।

পূর্ণ চাকির ভেদবমি শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি নিয়ে আসা গেছে। গোয়ালঘরের পাশে আলগা ঘর, সেখানে তাকে রাখা হয়েছে। ডাবের জল ছাড়া আর কোনো পথ নেই। প্রবল জ্বর এসে যাওয়ায় রক্ষে—কর্তাঠাকুর এমনই রায় দিলেন।

পায়রার পচা ডিম চোখে ঝুলে থাকলে কার না ডর লাগে। এদিকটায় কেউ এলেও দূর থেকে দরজায় দেখা যায় লোকটা একটা কলাপাতায় যোগবিয়োগ করছে। আমার কিংবা বাড়ির কেউ সেখানে যাবার নিয়ম নেই। ধনপিসি বিধবা মানুষ, তিনি সেবাযত্ন করছেন। এবং আরোগ্যলাভের পর ধনপিসির কিঞ্চিৎ দেবীসুলভ আচরণ অনুভব করে লোকটি দুটো টাকা প্রণামী দিয়ে বিদেয় হয়ে গেল।

আর সেদিনই ঠাকুরদা আমাকে কাছে ডেকে মুখে কী দেখলেন। মুখে ফুসকারি, ছোট দুটো-একটা দানা, হাতে পায়ে ব্যথা টের পাচ্ছি। মা কাছে টেনে নিতে সাহস পেল না। ঠাকুরদা বললেন, মশারি টানিয়ে দাও। পুবের ঘর থেকে সোনাজেঠি নেমে এল, এখন অনেক কাজ—ত্রাস গোটা পরিবারে।

ঠাকুমা ঠাকুরদাকে গাল দিয়ে ভূত ছাড়াচ্ছে। বয়সের সঙ্গে বুদ্ধিনাশ চলছে। মড়ক লাগলে সে গাঁয়ে কচিকাঁচা নিয়ে কে যায়! ঠাকুরদা ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছেন।

ঠাকুরঘরে বেশি সময় নিয়ে পূজা দিলেন ঠাকুরদা। ঘরের দাওয়া মেঝে গোবরজলে নিকানো। ধূপ জ্বলছে। পবিত্র কোনো মন্দিরের মতো এখন আমার ঘরটা। বাসি কাপড়ে ঢোকার নিয়ম নেই। মা পর্যন্ত আলগা হয়ে গেল। ঘরের তক্তপোশে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নিমের পাতা, নরম সবুজ, রোজ নিমের কচিপাতা বিছানায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘরের বেড়ায় নিমের ডাল গোঁজা।

বিছানায় শুয়ে টের পাচ্ছিলাম কী যন্ত্রণা শরীরে। সারা শরীর পচে গলে গেছে যেন। এ সময়টা তত ভয়ের নয়। ফুসকারি থেকে শুকিয়ে যাবার সময় ঘায়ের খোসা একটা একটা করে তুলতে হবে, একটা কাগজে প্রতিটি খোসা যত্ন করে রেখে দিতে হবে। খোসাগুলি তারপর আগুনে জ্বালিয়ে দেবেন তিনি এমন হবে জানি। কিন্তু আমার এখনও মুসুরির দানার মত সারা গায়ে ফোসকা ফুটে বেরই হচ্ছে। পচন শুরু হলে ভয়ের। ঘুম নেই, জলতেষ্টা পায়—নিরামিষ আহার। বেতের ডগা সেদ্ধ, ঘি-ভাত, মাঠা এবং তরমুজের রস পথ্য। সকালে নিমপাতা বাটা গেলাসে গুলে এক গেলাস। ঠাকুমার ত্রাহি চিৎকার, তুমি নিয়ে এলে দেবীরে। আবুর সঙ্গে আসা ঠিক হয়নি, কিংবা আবু জানে অনেক কিছু, তাকে আমাদের বাড়ি থেকে পাত্তা দেওয়া হয় না, সে রোজই সকাল বিকাল এসে বসে থাকে দাওয়ায়। ওঝা বদ্যি যারাই আসে, ছেমরিটা জ্বালাল—তুই ছেমরি দেবী সাজতে চাস—বকাঝকা, কোনোদিন নরেন দাসের বউ টেনে নিয়ে যায়, আবু শুধু বলে আমি একটিবার দেখব।

আমার উলঙ্গ শরীরে দুটো চারটে নিমপাতা ছাড়া কিছু লেগে নেই। চোখ ঘোলা হয়ে উঠছে। খেতে পারছি না। গলায় লাগছে। দুর্বল হয়ে পড়ছি। পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়। পচা গলা শরীর, আমার মা এখন ঘরে সারাদিন পড়ে থাকে। আর উঠোনে মানুষজনের চলাফেরার আওয়াজ পাই। দূরে কাক ডাকে। অন্ধকার রাতে সেই সাদা থানের মধ্যে আমি শুয়ে থাকি মাঝে মাঝে। বুঝি বাঘ থাবা চাটছে। চোখ কেমন ঝাপসা। নাক ফুলে গেছে। চটচটে শরীর। আঠা, পূজ এবং দুর্গন্ধ শরীরে।

দূরদেশ থেকে এল এক কবিরাজ—সে দিয়ে গেল হরীতকীবাটার প্রলেপ।

দূরদেশ থেকে এল এক ওঝা, সে দিয়ে গেল জলপড়া।

আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেউ সামনে আসছে না। সবাই দরজায় চুপি দিয়ে চলে যাচ্ছে, হা-হুতাশ—ঠাকুমা বারান্দায় বসে কপাল চাপড়াচ্ছে।

বাবা, জেঠারা খবর পেয়ে বাড়ি চলে এসেছেন—বাড়িটায় মানুষজন এত, অথচ আমার ঘরে আমি একা, অথবা মা আমার মশারির পাশে দাঁড়িয়ে। আর কারো ঢোকার অনুমতি নেই ঘরে। মা স্নান সেরে ধূপদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে যান। নিমগাছগুলি দাঁড়িয়ে থাকে। দক্ষিণের জানালা খোলা। মরা কাক বাতাসে দোলে।

আমার গলার স্বর বসে যাচ্ছে।

এখন এমন অসাড় শরীর যে কষ্ট নেই, যেন শুধু মগজে স্থির হয়ে থাকে কখনও বাঘের থাবা, অথবা মরা কাক, কখনও শ্মশানের চালাঘরে ঝড়বৃষ্টি, মৃতের শরীরে জল পড়ছে টুপটাপ। হাওয়ায় চাদর উড়ে গেলে দেখতে পাই আমার মুখ। ক্ষত বিক্ষত। পচা গলা চোখ সেই পায়রার পচা ডিমের মতো ঝুলছে। আমি প্রাণপণ চিৎকার করতে থাকি—না না।

মাঝে মাঝে মনে হয় উঠোনে বসে আছে এক বালিকা। যব-গমের খেতে সে আমার শরীরে জড়িয়ে গিয়েছিল, কুয়াশার মতো। তার শরীর ঘোরাফেরা করে, সে দাঁড়িয়ে থাকে শিয়রে। সত্যি কি দেবী আবির্ভূতা হন!

কী জানি!

আমি তাকালে টের পাই, আকাশ আর নীল নেই—নিমগাছগুলি ঝাপসা। বুকের ভেতর নড়বড়ে এক আমার অস্তিত্ব। যে-কোনো মুহূর্তে নিবে যেতে পারে। ঘরে প্রদীপ জ্বালা। মা শেতলা যেন প্রাণবায়ু কজা করার জন্য ফুঁ দিয়ে মাঝে মাঝে প্রদীপ নিবিয়ে দেয়। তেলপোড়া গন্ধ ঘরে। মনে হয় আমি ভেসে যাচ্ছি হাওয়ায়। চোখ বুজে আসে।

ঠাকুরদা তাঁর ঐশী শক্তি প্রবল ভেবে থাকেন। তাঁর বিশ্বাস, অমোঘ সব নিদান তাঁর আজ্ঞাবহ দাস। কখনও কাপালিকের মতো চোখ বড় তাঁর—আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে উপবীতে হাত রেখে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন সকাল-সন্ধ্যা।

একদিন সকালে তিনি বললেন, সুনু, জপ কর। আমি বলছি, তুমি জপ কর।

আমার গলার স্বর বুজে গেছে। শুধু মগজে জোনাকি বাতি ছাড়া আর কিছু জ্বলছে না। জোনাকি পোকা জ্বললে টের পাই পিতামহ কী বলছেন, নিবে গেলে কিছু শুনতে পাই না।

প্রায় জলদগম্ভীর স্বর তাঁর। নাভিমূল থেকে তিনি তার শব্দমালা তুলে আনছেন।

বল, ওম বন্দেহহং।

বল, শীতলা দেবীং রাসভস্থাং।

বল, দিগম্বরীম্।

বল, মার্জনীকলসো পেতাং।

কী শুনতে পাচ্ছ না। চুপ করে আছ কেন। বল, বল—সপালঙ্কৃত মস্তকা। বল বল।

তিনি বললেন, তুমি আরোগ্যলাভ কর। তুমি নিরাময় হও। তোমার ভেতরে প্রাণের ইচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য তদগদচিত্ত হোক। তুমি ধ্যান কর। মায়ের নাম জপ কর।

বাইরে কোনো গোলযোগ—ঠাকুরদা চেঁচাচ্ছে না। না হয় না। দেবী ভর! ছলনা নারীর। হয় না। ওকে ঢুকতে দেবে না। দেবে না বলছি।

—শেষ চেষ্টা।

—না। শেষ চেষ্টা বলে আর কিছু নেই। দেবী অপ্রসন্না। তার আয়ু শেষ। তাকে আর বিড়ম্বনা করবে না। শান্তিতে যেতে দাও। মুক্তি হোক আত্মার।

বাড়িতে কান্নাকাটির রোল, ঘরে কেউ ঢুকতে পারছে না। বুঝতে পারছি দরজার কাছে দুর্বাসার মতো উপবীত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কালের প্রহরী যেন। খড়ম পায়ে হেঁটে দূরাতীত কোনো রহস্যের সন্ধানে বের হয়ে পড়েছেন। তিনিই সত্য এবং তাঁর কাছে আবু সামান্য নারী ছাড়া আর কিছু না। আমার মগজ সেই জোনাকির মতো জ্বলছে নিবছে। অস্পষ্ট হয়ে আসছে সব কিছু।

আবু চিৎকার করে বলছে, আমলকীর রস মাখিয়ে দিতে বলেছে দেবী। আমায় একবার ওকে দেখতে দিন, একবার। বোধ হয় সে ঠাকুরদার পায়ে লুটিয়ে পড়ছে। বাড়িতে মানুষজনের ভিড়। বড় জ্যাঠামশাইর গলা পেলাম। তিনি বললেন, আবুকে যেতে দিন। দরজা থেকে সরে দাঁড়ান। অনেক করেছেন, পারলেন না। বয়স যত বাড়ছে, তত দেখছি ভীমরতি। সরুন। শেষ চেষ্টা।

ঠাকুরদার আর্তনাদ—প্রায় সেই বিশাল মহীরুহ ভেঙে পড়ার মতো আওয়াজ, এত বড় আস্পর্ধা তোমাদের। দেবীর ইচ্ছেকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে চাও। দেবী কাঁচাখেকো যখন স্থির করেছেন খাবেন, তখন তাকে খেতে দেওয়াই শ্রেয়। তোমরা কি বাড়িতে মড়ক ঢোকাতে চাও।

বড় জ্যাঠামশাই ফের বললেন, আপনি বাবা সরে দাঁড়ান। কী করছেন! যদি হয়। কিসে কোন বালাই দূর হয় কেউ বলতে পারে না। শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! মড়ক ঢুকবে কেন!

আমি কেমন ঘোরের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, দরজা খুলে দেবী ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে। নাকের নাসা ফুলছে। শাড়ি সায়া খুলে ফেলল। খোঁপা খুলে ফেলল। কোমরের কাছে তার কালো চুল। সে মশারির চারপাশে হেঁটে গেল ক’বার। প্রদীপের আলো উসকে উবু হয়ে দেখছে। শরীরে তার সেই তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ আর নাভিমূলে নরম কদমফুল। আমার শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ পাঠিয়ে দিচ্ছে আবু। দেবী আজ দিগম্বরীম্।

আবু কিছুটা আমলকীর রস আমার গায়ে পায়ে মাখিয়ে দিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ নারী এই প্রথম গোচরে এল এবং আমি যেন এক অতি প্রবহমান খড়কুটো তার হাতে, সে ইচ্ছে করলে ভাসিয়ে দিতে পারে আবার ইচ্ছে করলে আঁকড়ে ধরতে পারে। আমি কেমন টের পেলাম, নারীর ভেতরে আছে সেই অমোঘ শক্তি—যে দূর্ভোগে রক্ষা করে, যে ক্ষেপে গেলে ধ্বংস করে, যে কখনও চামুণ্ডা, অথবা ছিন্নমস্তা এবং কখনও দশভুজা। নারী তার বহুরূপিণী অঙ্গসজ্জায় আমার পাশে দাঁড়িয়ে। সে হাত নিয়ে কিছুক্ষণ তার স্তনে খেলা করে ছেড়ে দিল। আমার মধ্যে হাজার লক্ষ বিদ্যুতের কণিকা ঢুকে রক্তের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে। আমি তাকিয়ে আছি।

আবু বলছে, ভাল লাগছে!

আমি কিছু বলতে পারছি না। তাকিয়েই আছি।

আবু শাড়ি সায়া পরে বের হয়ে চলে যাবার সময় সবাইকে বলে গেল, দেবী কাল রাতে আবার পাঠাবেন আমাকে। ভাল হয়ে উঠবে। নিষেধ করলে সবার সর্বনাশ, গাঁয়ের সর্বনাশ।

ঠাকুরদা ঘরে ঢুকলেন না। জ্যাঠামশাই, মা এবং ঠাকুমা এসে প্রদীপের আলোয় আমার মুখ দেখে তাজ্জব। পরে জেনেছিলাম, আবু বের হয়ে যাবার পর গভীর নিদ্রা আমার।

আবু রোজ রাতে আমলকীর রস মাখিয়ে দিত। আমার পাশে বসত। এবং শরীরের সব ঘায়ে নিমপাতার বাটা লেপে দিত। এভাবে একদিন নিরাময় হয়ে উঠলে, আরোগ্যস্নান। ঠাকুরদার গলা পাওয়া যাচ্ছে না—ঠাকুরদা সারাদিন গৃহদেবতার ঘরেই থাকেন। বের হচ্ছেন না। উপবাসে আছেন। বাড়িতে নিমের গাছ মড়ক ঠেকাতে পারবে না, একজনের উপর দিয়ে যাবার কথা, এখন সবার উপর দেবীর দয়া হলে—এই এক ত্রাসে ঠাকুরদার কেমন মাথা গোলমাল হয়ে গেল।

আমার আরোগ্যস্নানের দিন মা দুটো খবর দিল—এক, আমার ঠাকুরদা গতকাল কোথায় শেতলা পূজা করতে গিয়ে ফিরে আসেননি। দুই, আবুর উপর মায়ের দয়া হয়েছে।

—আবুকে মা শেতলা দয়া করেছে? মার কাছে জানতে চাইলাম।

—হ্যাঁ।

—দাদু ফিরে আসেননি।

—না

ঠাকুরদা আমার কালপুরুষ, তিনি ফিরে আসবেনই। তিনি অজর অমর—কিন্তু ভয় আবুকে নিয়ে। যে নিজেই দেবী হয়ে যায় এবং যার ভর ওঠে, মা শেতলা যাকে দিয়ে সব বলিয়ে নেন তারই গুটিবসন্ত! হতেই পারে না।

ঠাকুমা বলল, আবু তোর রোগ নিজের শরীরে নিয়ে নিল।

আমি কিছু বলতে পারছি না। আমার এই নিরাময় কারণ রক্তের মধ্যে তুফান অথবা বিদ্যুতের বাহার খেলা করে গেছে—এবং রক্তই সব কিছুর মূলে কিংবা অকেজো হৃৎপিণ্ডকে সজোরে আঘাত করতে করতে কখন সে আবার শক্ত সমর্থ হয়ে গেছে, আর আমলকীর রসে আছে দিব্য সুধা, মনে হত মুহূর্তে জ্বলুনি নেই, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সব। শীতল আমেজ বোধ করতাম।

কিন্তু আবুর ক্ষেত্রেও এটা হতে পারত, তবে আমার যে দেবী নেই কিংবা ঠাকুরদার মতো আমি কালপুরুষ নই—কী যে হবে! আবুর উপর দেবী ভর করেন এই যা ভরসা।

অগ্নিবর্ণ ঋতুটির মাহাত্ম্য টের পেলাম, আবুকে পালিয়ে দেখতে গিয়ে। সে শুয়ে আছে মশারির নিচে। বিছানায় সেই নিমের পাতা ছড়ানো। বেড়ায় নিমের ডাল গোজা। আবুর সেই দিব্য অঙ্গ কেমন পুড়ে গেছে মনে হয়। জানালায় আমাকে দেখে বলল, তুই। কাছে আসিস না। পালা পালা। দেবী রাগ করছেন।

আমি দৌড়ে পালালাম। যেন দেবী আমাকে সত্যি তাড়া করেছে।

বাড়ি এসে শুনলাম, ঠাকুরদা ফেরেননি। হপ্তা পার হয়ে গেল। খোঁজ খোঁজ। কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না। শুধু সেই বনদুর্গাপুরের পূর্ণ দেশে ফেরার সময় ঠাকুরদার খবর দিয়ে গেল— তিনি গভীর রাতে কোনো জ্যোৎস্নায় এক বনভূমি আবিষ্কার করে ফেলেছেন—সেখান থেকে তিনি আর ফিরবেন না বলে গেছেন।

সত্যি আর ফিরলেন না।

প্রকতি এখন কিছুটা অহংকার ত্যাগ করেছে। ঝড় জল কালবৈশাখীতে প্রকৃতির রুদ্ররোষ আর নেই। প্রকৃতি নিস্তেজ। আকাশ ক’দিন থেকে মেঘলা। আবু কিন্তু নিষ্কৃতি পেল না।

ঠাকুরদার লাশ পাওয়া গেছিল বেশ কিছুদিন পর। তিনি নিজেকে হনন করার ইচ্ছেতে পাগল হয়ে গেছিলেন, না সামান্য এক বালিকার কাছে তাঁর এই পরাজয় শেষ বয়সে তাঁকে পাগল করে দিয়েছিল জানি না। এমনও হতে পারে বাড়িতে মারী এসে হাজির হবে এই আতঙ্কে গৃহত্যাগ করেছিলেন তিনি।

আবুর বিশ্বাস, মা শেতলা তাকে দয়া করলেও সে নিরাময় হয়ে যাবে। তার কিছু হবে না। সে জলপড়া কিংবা আমলকীর রস গায়ে মাখেনি। দেবীর নির্দেশ না পেলে সে বোধ হয় কিছু করতে পারে না।ওঝা বদ্যি সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ওরা ফিরেও গেছে—আতঙ্ক, সাক্ষাৎ দেবী যার ভরসা তাঁকে না ঘাঁটানোই ভাল। দেবীর নির্দেশ যে জানতে পারে কিংবা টের পায় তার বিরুদ্ধাচরণ করে কার এত সাহস! কার এত সাহস মারীকে তাড়া করার। আবু নিজেই যে দেবী কখনও।

এই দৈব বিশ্বাস যদি আবুকে আর ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারত। কিংবা আমার ঠাকুরদা মা শেতলার উপর মানুষের এই বিজয় যদি দেখে যেতে পারতেন। গুটিবসন্তে এখন আর কে মরে!

আবু দেখে যেতে পারল না। ঠাকুরদাও না।

চুপচাপ জানালায় বসে আধিভৌতিক মানুষগুলির কথা ভাবলে পৃথিবী বদলের খবর পাই। মারীর সেই অশ্বখুরের ধ্বনি আর শোনা যায় না। মানুষই পারে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে।

অথচ আবুর সেই সুন্দর মুখ, সরল বিশ্বাসের মধ্যে ছিল প্রকৃতির আসল রহস্য।

অগ্নিবর্ণ ঋতুর পালাটি এখানেই শেষ।

১৩৯৫ (১৯৮৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *