দূরের গাড়ি – অগ্নি বসু
১.
জ্যোছনের ঘুম আসছিল না। নক্ষত্ৰভরা আকাশের নীচে নির্বাক পৃথিবীকে চমকে দিয়ে ঝঝন্ বাজনা বাজিয়ে গাড়ীটা ছুটে চলেছে। বর্ধমান স্টেশন ছাড়িয়ে যাবার পর সামান্য যেন শীত শীত করতে লাগল। জ্যোছ খদ্দরের পাতলা চাদরখানি গায়ে দিয়ে, জানালার শার্সিতে মাথা ছুঁয়ে আধশোরা হয়ে বসেছিল। হু হু করে দূরের গাছপালা, আবছা আঁধারে-মোড়া বাড়ীঘর, আলোকিত জনহীন প্ল্যাটফর্ম ছুটে এসে দৃষ্টি ছুঁয়ে পলকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। দুলতে দুলতে গাড়ীটা চলেছে। জ্যোছনের মুখোমুখি লোয়ার বার্থে বাবলি শুয়ে আছে। পাতলা সাদা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা, মাথার নীচে একটা কীটব্যাগ রাখা।
হাতের কাছে ঘড়ি না থাকায় রাত কতো, জ্যোছ বুঝতে পারলো না। মাথার ওপর মৃদুনীল আলো সার বেঁধে জ্বলছে। পথ চলতে চলতে ঘুমিয়ে রয়েছে কত লোক। বিরাট এক মুসাফিরখানা দুলতে দুলতে দূর থেকে সুদূরে চলেছে। শেষ রাতের ক্ষয়া চাঁদের আবছা আলোয় চোখের ওপর একে একে ভেসে উঠলো মধুপুর স্টেশন, ঝঝা, কিউল জংশন। দুলতে দুলতে টেপাকলের জলে মুখ ধুয়ে নিতে ভারী অসুবিধে হচ্ছিল বাবলির। ভীষণ ঝাঁকুনি দিচ্ছে গাড়ীটা। ভোর এখনও হয়নি। আকাশে এখনও শেষরাতের ছোঁয়া লেগে আছে। রেললাইনের দুপাশে ঘুমিয়ে আছে ধু ধু রুক্ষ মাঠ, দুরের গাছপালা ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। এতে ভোরে কোনও দিন ঘুম ভাঙেনি বাবলির।
গাড়ীটা একটা বড় স্টেশনে এসে দাঁড়াল।
আলতো করে গায়ে ধাক্কা দিয়ে বাবলি জ্যোছনকে বল্লওঠো। তন্দ্রা ভেঙে বাবলির দিকে তাকিয়ে জ্যোছন শুধলো ‘এটা কোন স্টেশন?’—’পাটনা’ বাবলি উত্তর দিলো। উঠে বসল জ্যোছন। ট্রেনের জানালা দিয়ে হু হু করে ভোরের হাওয়া ভেসে আসছিল। মোগলসরাই স্টেশন পার হয়ে যাবার পর এতক্ষণে বাবলির মনে হল সে সত্যিই বাড়ী থেকে বহুদূরে, বিদেশে চলেছে। মার কথা মনে পড়ল। বাবার কথা, বাপ্পার কথা।
.
২.
ভিড় ঠেলে ঘন্টি বাজিয়ে রিকশাটা ছুটছিল। চওড়া রাস্তায় দুপাশে সাজানো গোছানো। দোকান। পথের পাশে বসে ফুল, বেলপাতা আর ফুলের মালা বিক্রী করছে কেউ কেউ। যতদূর চোখ যায় রাস্তায় মানুষ গাড়ী আর কখনো কখনো বড় সড় গরুদের জমজমাট ভীড়। অবাক হয়ে জ্যোছ চেয়ে দেখল বেশীর ভাগ দোকানের সাইনবোর্ডে হিন্দীর পাশাপাশি বাঙলা ভাষাও লেখা আছে। এতদূরে এসে বাঙলা বর্ণমালা দেখতে পেয়ে, অবাঙালী রিশওয়ালার মুখে ভাঙাচোরা বাঙলা ভাষা শুনতে পেয়ে জ্যোছনের ভারী ভালো লাগছিল। জ্যোছনের হাত আলতো করে ছুঁয়ে বাবলি ব—এখানে কতো রিক্শ দেখেছ? সামান্য থেমে বাবলি, আবার বল্ল-বেনারসে অনেক বাঙালী থাকে জানো তো। মনেই হয় না বাঙলার বাইরে এসেছি।
নিরুত্তর জ্যোছন অপলকে অচেনা পথের দৃশ্য দেখছিল। বাবলি শুধোলো, কী ভাবছ, বল তো?
—কিছু না।
—তুমি জানো না, ছোড়দিরা ভীষণ ভালো লোক। ওদের বাড়ী গিয়ে উঠলে ওরা কিছু মনে করবে না, দেখো। জ্যোছন প্রশ্ন করল, ছোড়দি তোমার কেমন দিদি? বাবলি বল্ল-তোমায় তো বলেছি আগে। ভুলে গেছো? ছোড়দি আমার বড় মাসীর মেয়ে। আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড়ো, অথচ দেখো আমরা বন্ধুর মতো।
বাঙালীটোলার এই গলিটার ভেতরে রিকশ ঢোকে না। হেঁটে হেঁটে গলির ভেতরে ঢুকে বাড়ীটা খুঁজে খুঁজে বার করল বাবলি। দেয়ালের চুনবালি পলেস্তারা খসে পড়া সেকেলে বাড়ী। ভারী কাঠের সবুজ রঙের দরজা বন্ধ করা ছিল। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে মেয়েলী গলায় কেউ প্রশ্ন করল—কে? কওন?
দরজা খুলে অবাক চোখে চেয়ে রইল বীনা। দেখল, সিঁড়ির ওপর বাবলি দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর মুখখানিতে ক্লান্তির ছাপ, অগোছালো বাসি চুল। পরনে খুব সাধারণ একটি শাড়ী। বাবলির পেছনে বাবলির চেয়ে বয়সে সামান্য বড়, রোগা পাতলা একটি ছেলে অচেনা মানুষের মতো সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে।
—আরে বাবলি তুই! হঠাৎ এলি যে? এসো ভাই ভেতরে এসো।
বাবলিকে একান্তে ডেকে নিয়ে বীনা শুধালো, ও কে রে বাবলি?
—একটু জিরিয়ে নিই ছোড়দি, সব বলছি।
.
৩.
তিন ছাদের ওপর মাদুর পেতে বসেছিল জ্যোছন আর শঙ্কর–ছোড়দির স্বামী, বাবলির জামাইবাবু। অন্যদিকে ছোড়দি আর বাবলি।
এখনো সন্ধ্যে হয়নি। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় এখানে বসেই নদীর এপারে দশাশ্বমেধ আর মনিকর্ণিকার ঘাট চোখে পড়ে। নদীর অন্যপারে বেশ দূরে অস্পষ্ট ছবির মতো রামনগর শহর।
একথা সেকথার পর শঙ্করের দিকে চেয়ে জ্যোছন প্রশ্ন করল—এখানে চাকরি পাওয়া কি সহজ হবে জামাইবাবু?
শঙ্কর তার ঠোঁট থেকে ফুরিয়ে আসা সিগারেট নামিয়ে বল্ল-সহজ নয়। তবে লাকিলি ঠিক এই সময়েই আমার অফিসে একটি পোষ্ট ভ্যাকান্ট রয়েছে। অ্যাপয়েন্টমেন্টও খুব জলদি হবে। আমি চেষ্টা করব।…
.
বিকেলবেলা ঘরে ফেরার পর জ্যোছনকে বাবলি জিজ্ঞেস করল—ইন্টারভিউ হয়েছিল? বিরস গলায় জ্যোছন উত্তর দিল, হয়েছিল, আমার চাকরী এখানে হলো না।
সামান্য উঁচুগলায় বাবলি শুধালো হলো না! কেন? ম্লান হেসে জ্যোছন উত্তর দিল—চাকরী কি অত সহজে হয়? আর তাছাড়া, আমি কোথাকার ছেলে, এদেশে কি লোক নেই? আমাকে দেবে কেন বলো?
ঘর ছেড়ে আসার সময় সঙ্গে করে সার্টিফিকেট মার্কশীটগুলো আনার কথা বুদ্ধিমতী বাবলি জ্যোছকে বলেছিল। জ্যোছনের হাত থেকে নিয়ে এখন সেগুলো গুছিয়ে তুলে রাখতে রাখতে বাবলি বল্ল-জামাইবাবু ছিলেন না ওখানে? কী বল্লেন?
–ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর জামাইবাবু ঘরের বাইরে এসে আমাকে বল্লেন, আমার অন্য যোগ্যতা থাকলেও একটা জরুরী যোগ্যতা আমার নেই। সেটা হলো ক্যান্ডিডেটকে স্থানীয় হতে হবে। আমি গত পাঁচ বছর ধরে বেনারসে আছি। এমন মিথ্যে সার্টিফিকেট আমাকে কি কেউ দেবে?
বাবলি নীরবে জ্যোছনের কথা শুনছিল। জ্যোছ বপ্প-জামাইবাবু আমার জন্যে কিন্তু অনেক চেষ্টা করেছেন। অন্য কেউ হলে আমায় তাড়িয়ে দিত।
জ্যোছনের দিকে চেয়ে বাবলি স্মিত মুখে বল্ল, অমন কথা বলো না।
.
পথের পাশের এই ছোট ঘরখানিতে গভীর রাতে অনেক রকমের শব্দ ভেসে আসে। পথ চলা মানুষের পায়ের ধুপ ধুপ শব্দ। ঘর হারানো ছোট্ট গাধার কর্কশ শব্দ। মশারীর চারপাশে বিন বিন শব্দ করে মশা উড়ছিল। খাটের ওপর জ্যোছনের দিকে পাশ ফিরে বাবলি শুয়েছিল। তার বাঁ হাতখানি জ্যোছনের হাতে ধরা। ঘরের আবছা সবুজ আলোয় স্বপ্নের ছবির মত বাবলির মুখখানি জ্যোছনের দৃষ্টিতে লগ্ন হয়েছিল। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে জ্যোছনের দিকে চেয়ে বাবলি বল্ল এখন কী করবে বলো? পরের বাড়ীতে আর কতোদিন এভাবে–
অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো বাবলি।
—আমার ঘুম আসছে না, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
আমরা কোথায় যাব, কী করবো বলো?
শান্ত গলায় জ্যোছ বল্ল আমি তো চেষ্টা করছি। সারাদিন ছুটোছুটি করছি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবলি বকবে যে তোমার একটা চাকরী হবে। অকারণেই কেন কে জানে, বাবার মুখখানি জ্যোছনের চোখের সামনে ভেসে উঠলো, বোন। পূর্ণিরও।
পাশ ফিরে শুয়েছিল বাবলি। নীচুগলায় জ্যোছ বল্প—আমরা কিন্তু এতো তাড়াহুড় না করলেও পারতাম। বাবলি উত্তর দিল না। চুড়ির রিনরিন শব্দ শোনা গেল। দীর্ঘশ্বাস। নিরুত্তর অভিমান। অব্যক্ত এক কষ্টের ব্যথা বাবলির গলার কাছে। ঠেলে ঠেলে উঠছিল। আলতো করে দুহাতে বাবলির মুখখানি কাছে টেনে নিয়ে জ্যোছন শুধোলো–তুমি কাঁদছ বাবলি?
জ্যোছনের হাত দুখানি দূরে সরিয়ে দিল বাবলি, মুখ নীচু করে বল্ল তুমি আমাকে এমন দুঃখ দিলে কেন বলো? কেন আমার এমন সর্বনাশ করলে।
তড়িৎ স্পৃষ্টের মতো ভাষাহীন চোখে বাবলির দিকে চাইল জ্যোছন। আনত মুখে বাবলি ধীরে ধীরে বল্ল—আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। কোথাও না। আমার শরীরের ভেতরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে সে ছোট মানুষটা, সে আর কিছুদিন পরে পৃথিবীতে আসবে। তাকে নিয়ে আমি কী করে বাঁচব বলো? তুমি আমার কথা একটুও ভাবো না?
–অবুঝ হয়ো না বাবলি।
.
৪.
দু-তিনদিন বেশ ঘোরাঘুরি করার পর ছোটখাটো একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল জ্যোছনের। চাকুরী ঠিক নয়, তবে চাকরীর মতো। গোধূলিয়ার মোড়ের ক্যালকাটা সিল্ক হাউস, বেনারসী শাড়ীর দোকান। বড় বড় হোটেলের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বিদেশী খদ্দের ধরে আনতে পারলে কমিশন পাওয়া যাবে। প্রথমদিন ক্লার্কস হোটেলের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক কষ্টে দু’জন হিপির সঙ্গে আলাপ জমালো জ্যোছন। জ্যোছনের সঙ্গে তারা শাড়ীর দোকানে এলো। পাতলা পাঞ্জাবী আর পাজামা পরা সঙ্গীনির গায়ের রঙের সঙ্গে মানানসই অসংখ্য শাড়ী দেখল রাজপুতদের মতো সাজপোষাক পরা হিপি ছেলেটি। দু’জনে অকারণেই হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ল। শেষে কোনও শাড়ী পছন্দ না হওয়ায় তারা চলে গেল। শুকনো মুখে জ্যোছ সেদিন বাড়ী ফিরে এল। দ্বিতীয়দিন জ্যোছন যে দু’জন খদ্দেরকে ধরেছিল তাদের একজন শাড়ী কিনল। কয়েকদিন যাবার পর জ্যোছন আবিষ্কার করলো, তার মতো আরও অনেক মানুষ এই কাজ করছে। তবে তারা জ্যোছনের চেয়ে চালাক, এছাড়াও তারা অন্য কাজও করে।
.
সারাদিন রোদ্দুর আর পথের ধুলো মেখে নিয়ে দিনের শেষে ঘরে ফিরে বাবলিকে ডেকে জ্যোছন বল্ল-আজ হাম কামাল কিয়া।
—ইস্ ঘামে একেবারে ভিজে গেছে। জামাটা খুলে ফেল। জামাটা একটানে খুলে খাটের একপাশে রেখে আদ্দিকালের ঘড়ঘড়ে সিলিং ফ্যানের বাতাস খেতে খেতে জ্যোছন বল্ল-আজ আমি কতো রোজগার করেছি জানো? উজ্জ্বল চোখে জ্যোছনের দিকে চেয়ে বাবলি বল্ল-কতো? বল না গো কতো?
—দু’শ’ তেত্রিশ টাকা।
-সত্যি? একদিনে?
অনেক সন্তর্পণে পকেট থেকে ধীরে ধীরে জ্যোছন নোটগুলো বার করল। ঘনিষ্ঠ হয়ে জ্যোছনের পাশে দাঁড়িয়ে বাবলি বল্পকাল রোববার। আমরা কাল বাজার করে আনব, কেমন? দাঁড়াও ছোড়দিকে বলি।
.
রোববার দুপুরে খেতে বসতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। আনাড়ী হাতে অনেক বাজার করেছে জ্যোছন। বারান্দায় পাতা আসনে জ্যোছনের পাশে বসে জ্যোছনের মাছের ঝোলের বাটিতে নিজের বাটিখানি ছুঁয়ে ঠুং শব্দ করে শঙ্কর বলে উঠল—চিয়ার্স। জ্যোছনবাবু যুগ যুগ জিও।
.
৫.
সেদিন দুপুরবেলা জ্যোছনের বিছানার শিয়রে বাবলি বসেছিল। বীনা এসে তার হাতে একখানি ইনল্যান্ড লেটার দিয়ে বল্ল-এই নে বাবলি তোর চিঠি।
–কার চিঠি ছোড়দি?
–রাঙামাসীর, পড়ে দেখ।
—মার চিঠি? মা জানে আমি এখানে?
বীণার দু চোখে স্নেহের হাসি মাখানো। বাবলির দিকে চেয়ে বীণা বল্ল-আমি রাঙামাসীকে চিঠিতে জানিয়েছিলাম।
—তুমি আমার সমস্ত কথা মাকে জানিয়েছ ছোড়দি? সব কথা?
–জানিয়েছি। শুধু জ্যোছনের অসুখের কথা চিঠিতে জানানো হয়নি। চিঠির ভঁজে, আঙুল রেখে চিঠিখানি খুলে পড়তে শুরু করল বাবলি। জানালার শার্সি ছুঁয়ে ফুরিয়ে আসা দুপুর বেলার ম্লান আলো জ্যোছনের মুখে এসে পড়েছিল। বিছানায় জ্যোছন শুয়েছিল। মোটা একখানি কম্বল বুকের ওপর টানা, গলায় মাফলার জড়ানো। মাথার নীচে অয়েল ক্লথ পাতা, শিয়রে জল ভরা বালতি রাখা। প্রায়ই মাথা ধুয়ে দিতে হয়। হাতের কাছে রাখা ছোট টিপয়ে সাজানো ছোটবড় ওষুধের বোতল, কাগজের লেবেল-আঁটা মিক্সচারের শিশি। সেদিন সারনাথ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ জ্বর এলো জ্যোছনের।
সন্ধ্যেবেলায় ঘরে বাতি জ্বেলে দিতে এসে জ্যোছনের নিরক্ত ঠোঁট দু-খানিতে দীর্ঘ উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বাবলি বল্ল তুমি ভীষণ রোগা হয়ে গিয়েছ। কতোদিন দাড়ি কাটা হয়নি। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে শেভ করে নিও কেমন?
.
শেষরাতে হঠাৎ অস্পষ্ট গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বাবলির। ভয় পেয়ে বীনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। শঙ্করকেও। জ্যোছনের হাত দুখানি বুকের কাছে রাখা। বুকের ভেতর অস্পষ্ট ঘড় ঘড় শব্দ। চোখ খোলা ছিল জ্যোছনের। তবুও এই ঘরের কোন দৃশ্যই যেন জ্যোছনের চেতনায় ধরা দিল না। কোন শব্দই তার শ্রুতিকে ছুঁতে পারলো না। তন্দ্রাতুর মানুষের মতো জ্যোছনের দৃষ্টি অপলকে বার বার কিছু যেন খুঁজছিল। সমস্ত লজ্জা ভুলে গিয়ে জ্যোছনের মুখখানি দু’হাতে ধরে নিজের মুখের কাছে এনে বাবলি বল্ল কষ্ট হচ্ছে? বলো, কোথায় কষ্ট?
অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বল্ল জ্যোছন। বোঝা গেল না। কান পেতে ছিল বাবলি। মৃদু আড়ষ্ট গলায় ধীরে ধীরে জ্যোছন উচ্চারণ করল—সব পাখী ঘরে আসে, সব নদী।
দিশেহারা চোখে শঙ্করের দিকে চেয়ে বাবলি শুধালো—ও কী বলছে জামাইবাবু?
—ভুল বকছে, বাবলি। ভালো করে ওর মাথা ধুয়ে দাও বীণা, আমি আসছি।
.
রাত অনেক। নির্জন রাস্তার ঘুম ভাঙিয়ে শঙ্করের বাইসাইকেলখানি ছুটছিল। দীর্ঘ পথটুকু নিমেষে পার হয়ে ডিসপেন্সরীর লাগোয়া তেওয়ারীজীর বাড়ীর দরজার কড়া নেড়ে বিহ্বল গলায় শঙ্কর ডাক দিল—ডাকদার সাহাব! ডাকদার সাহাব!
ঠিক তখনই বিছানায় শুয়ে থাকা জ্যোছন অলস মায়াবী চোখে বাবলির দিকে একবার চাইল। জ্যোছনের ঠোঁট দু’খানি কিছু বলতে চেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। আবার। বাবলি উৎকর্ণ ছিল। কিছু শোনা গেল না।
.
৬.
মনিকর্ণিকার ঘাটে ভিজে এলোচুলে বসেছিল বাবলি। স্নান সারার পর ছোড়দি তাকে কালোপেড়ে কোরা থানখানি পরিয়ে দিয়ে বলেছে—এ শুধু নিয়ম মানার জন্য। তুই। আবার রঙীন শাড়ি পরিস বাবলি।
বিশ্বনাথের মন্দিরের দোরে দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তিকে সাক্ষী রেখে বাবলির সিঁথিতে যে সিদুর এই সেদিন জ্যোছন পরিয়ে দিয়েছিল, মনিকর্ণিকা ছুঁয়ে বয়ে খাওয়া নদীর জলে আজ তা হারিয়ে গেল। পথের ধুলোয় অনাদরে পড়ে রইল নতুন শাখার ভাঙা টুকরো।
বাবলির হাতখানি ধরে বীণা বল্ল–আয় বাবলি।
.
নৌকোটা ঘাটেই বাঁধা ছিল। রাজা মানসিংহের ঘাট, চৌষট্টি ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট ছুঁয়ে এই তত সামান্য আগে জ্যোছনকে নিয়ে তারা এই নৌকোয় এসেছিল। সিঁড়িতে ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে এগিয়ে চলল বাবলি, বীনা, সবশেষে শঙ্কর। বীনার হাতে রাখা বাবলির ভিজে কাপড় থেকে জলের ফোঁটা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছিল। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে, শঙ্করের কাছে এসে বাবলি বল্লো,জামাইবাবু?
–কী রে বাবলি?
–ও চলে যাবার আগে কী কথা বলছিল যেন?
—কোন কথা?
—ঠোঁট কেঁপে উঠল বাবলির। নতমুখে ধীরে ধীরে বল্ল-ঐ যে, সব পাখী ঘরে আসে।
সামান্য নীরব থেকে শঙ্কর বন্ধু—ও একটা কবিতার লাইন। সব পাখী ঘরে আসেসব নদী—ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।
.
নৌকোয় পা রাখতেই ঘুমভাঙা মানুষের মতো চমক লেগে যেন দুলে উঠল নৌকোটা। সন্ধ্যে হয়ে এল। নদীর এপারে একে একে দীপ জ্বলে উঠছিলো। ওপার আবছা হয়ে ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। বাবলির হাতটা ধরে শঙ্কর বল্প—পিছনে তাকাস না বাবলি। পিছু ফিরতে নেই।