দুর্গোৎসব
অনেক কাল আগেই দুর্গাপুজো থেকে পুজো হাওয়া হয়ে গেছে। দুর্গাপুজোকে বলা হয় কলির অশ্বমেধ। বোধন থেকে নিরঞ্জন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর কাণ্ড। উপবাস, শুদ্ধাচার, দ্রব্যাদি সংগ্রহ, প্রকৃত সংস্কৃতজ্ঞ, শাস্ত্রবিদ পুরোহিতের সন্ধান, যিনি দুর্গাতত্বটি বোঝেন, কার পূজা, কীসের পূজা। প্রতিটি মন্ত্রের অর্থ যাঁর জানা। ঋগবেদের দেবীসুক্ত, ‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাম’, আমি রাষ্ট্রের অধীশ্বরী সেই দেবী। মহাভারতের বিরাটপর্বে ভ্রষ্টরাজ্য যুধিষ্ঠির ত্রাণমন্ত্র পাঠ করছেন—’দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈ:। এই স্ত্রোত্রে দেবী চতুর্ভুজা। যুদ্ধযাত্রার অব্যবহিত আগে অর্জুনকেও দেবী দুর্গার স্তব করতে দেখা গেছে। দেবী সেখানে বিন্ধ্যবাসিনী। মহিষমর্দিনীও মা দুর্গার আর একটি বিশেষ রূপ। দ্বিভুজ থেকে অষ্টদশভুজ দেবীর বিভিন্ন মূর্তি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজিতা ‘ওড্রদেশে কলিঙ্গে তু মধ্যদেশে তথৈবচ, দেবী চাষ্টভুজা পূজ্যা অযোধ্যায়াং সুরাষ্ট্রকে।’ এই শ্লোকে দেখা যাচ্ছে, কন্যাকুমারী থেকে উত্তরপশ্চিম সীমান্তর রামঠ পর্যন্ত দেবী বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠিতা। দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন তাই তিনি দুর্গা। পার্শ্ব স্বগতোক্তি, হায়, আমাদের পোড়া কপাল, এখন ত্রাতার সেবকদের হাত থেকে ত্রাণের জন্যে লালবাজারের স্পেশাল সেলে শরণ নিতে হয়। স্বয়ং মহিষাসুর মায়ের পদতল থেকে উঠে, যাত্রার হাসি হেসে, গুলি ফুলিয়ে, বুক চিতিয়ে বলতে থাকে, পাঁচশো এক, পাঁচ হাজার এক, ভোগ লাগা, নয় তো মায়ের ভোগে চলে যা। মা আমার কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। বল্লম, তরোয়াল, খড়গ, খেটকের কাল শেষ। এ কে ৪৭ হাতে, হাতে। বেতারে চণ্ডীপাঠের লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরোনো স্পুলই বাজে বারেবারে।
পূজা শব্দটির উৎসসন্ধানে পাওয়া যাচ্ছে, শব্দটি বা কথাটি দ্রাবিড়দের, অর্থ পুষ্পকর্ম। বৈদিক ফলযজ্ঞকে যেমন বলা হত পশুকর্ম। আর্য ঋষিরা পূজা শব্দটিকে সংস্কৃতে স্থান দিলেন। অর্থ সম্প্রসারিত হল। দাঁড়াল, ফুল বেলপাতা প্রভৃতি উপকরণ আর উপাচার দ্বারা ভগবানের আরাধনা।
পূজা আমরা আজ করছি না। মানুষের মনীষার উন্মেষকাল থেকেই পূজা আমাদের মনে, আমাদের সংস্কারে সংশ্লিষ্ট হয়ে হাঁটছে। বিভিন্ন, বিচিত্র তার প্রকাশ। নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্ম থেকে সাকার, সগুণ মূর্তি। ঋষিরা ছিলেন দ্রষ্টা। তাঁদের মনন ছিল। সত্যং শিবং সুন্দরম বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্মাকে চিন্তা করার মতো ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন তাঁরা। কিন্তু আমজনতা যে রূপ চায়, আকার চায়। ভক্তের ভক্তিতে নিরাকার সাকার হলেন।
চিন্ময়স্যাদ্বিতীয়স্য নিস্কলস্যাশরীরিণ:।
উপাসকানাং কার্যার্থং ব্রহ্মণো রূপকল্পনা।।
অদ্বিতীয় নিরাকার ঈশ্বর ভক্তের মনোবাসানা পূর্ণ করে রূপ গ্রহণ করলেন। বেদে ঈশ্বর বলছেন, একোহহং বহু স্যাম। আমি এক, আমি আবার বহু। দুর্গাপূজাও মূর্তিপূজা। নিরাকার ঈশ্বরের সাকার উপাসনা। ঋগ্বেদে আছে। বেদ থেকে পুরাণে। পুরাণ থেকে দেবীর বারোয়ারিতে পতন। সর্বজনীন। চাঁদার খাতা। হুতোমের ভাষায়, চাঁদা সাধা। সাধনের দল। হুতোম বলছেন, ”বারোজনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মরক হতেই সৃষ্টি হয়—ক্রমে সেই অবধি ‘মা’ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন। মহাজন, গোলদার, দোকানদার হেটোরাই বারোইয়ারি পূজোর প্রধান উদ্যোগী।”
দুর্গাপুজো থেকে উৎসবটাকে বাদ দিলে, এর এই ভয়ঙ্কর, বিশাল গুরুত্বটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সবটাই বুঝতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সারাটা বছর আমরা সবাই আধমরা। সমস্যা যেন মশা, মাছি। অনবরত ভনভন, আর দংশন। মাঝ বছরে এই যে একটা আয়োজন, এ এক মস্ত বড় রিলিফ। ধ্যাত, ঘোড়ার ডিম, যা হয় হোক, চারটে দিন একটু হইচই করে কাটানো যাক। অধর্ম যদি কিছু করেও ফেলি ধর্মের নামেই করি। মা দুর্গাকে চণ্ডীর খটমটো থেকে বের করার উপায় তো আছে! তিনি তো আমাদের ঘরের মেয়ে উমা। তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা, ইয়ার্কি, তামাশা, মশকরা সবই চলতে পারে। শিবঠাকুরটিকে এনে ফেলতে পারলেই সব সহজ। মা চলে এলেন বেদ থেকে বাউলে, তখন সাহস করে বলতে পারি, ‘ওই দ্যাখো মা দুর্গাদেবী সিংহবাহিনী গণেশেরে কোলোৎ কইর্যা আইসে জননী।’ দশপ্রহরণধারিণী অসুরঘাতিনী ভয়ঙ্করীতে আমাদের প্রয়োজন নেই। দুর্গাতত্ব অতি কঠিন। তিনি শাক্তের শক্তি। তিনি মহাকালী। যোগনিদ্রাগত বিষ্ণুর কর্ণমল হতে জাত মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের বিনাসের জন্যে স্বয়ং ব্রহ্মা যাঁকে আবাহন করেছিলেন। ওই খড়গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভূশুণ্ডীং সন্ত্রাসবাদীদের জন্যে থাকুন, বঙ্গজননী মা মেনকা যাঁকে চান, তিনি আমাদের ঘরের কন্যা ঃ ‘দ্বিভূজা বালিকা আমার উমা ইন্দুবদনী/কক্ষে লয়ে গজানন, গমন গজগামিনী/মা বলে মা ডাকে মুখে আধ আধ বাণী।।” মা যেই দশভুজা মূর্তিতে এলেন, মেনকা অমনি প্রশ্ন করলেন, গিরিরাজ আমার সেই উমা কোথায়!’ ‘এ তুমি কাকে নিয়ে এলে, কে রণরঙ্গিনী / কে নারী অঙ্গনে এল, চিনিতে না পারি / অঙ্গনে দাঁড়াইয়ে এ নয় আমার প্রাণকুমারী।।’
মা যশোদাকে বালক কৃষ্ণ একবার খুব কায়দা করে বিশ্বরূপ দেখাতে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মা ভয় পেয়ে তাঁর মৃত্তিকা ভক্ষণের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। বালক গোপাল কোথায় বসে মাটি খাচ্ছিলেন, ব্রজ মৃত্তিকা, সব শিশুই যে অপরাধে অপরাধী। মা যশোদার কাছে নালিশ চলে গেল—কৃষ্ণং মৃদং ভক্ষিতাবানিতি। মা যশোদা তাঁর পৃথুলা শরীর নিয়ে দৌড়ে এলেন। কান ধরেছেন, বল, কেন মাটি মুখে দিয়েছিস। দুষ্ট গোপালের সেই একই অস্বীকার, ম্যায় নেহি মাখখন খায়ার মতো, ‘কে বলেছে তোমাকে মা, আমি মাটি খেয়েছি, নাহং ভক্ষিতবানস্ব! সর্বে মিথ্যাভিশংসিন:।’ ওরা তোমাকে মিছে কথা বলেছে, এই আমি হাঁ করছি, ‘পশ্য মে মুখম।’ বালক হাঁ করেছে। মা যশোদা প্রথমটায় ভয় পেয়েছিলেন, এ কী দেখছি! জগৎ স্থাস্নু চ খং দিশ:। শ্রীকৃষ্ণের মুখবিবরে ‘স্থাবর, জঙ্গম, অন্তরীক্ষ, দিকসকল, পর্বত, দ্বীপ, সমুদ্র, ভূর্লোক, প্রবহবায়ু, অগ্নি, চন্দ্র, তারাসমম্বিত জ্যোতিশ্চক্র, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব গোপালের মুখবিবরে জ্বলজ্বল করছে, এমনকী সেখানে মা যশোদা ও ব্রজধামও রয়েছে। মা যশোদা নিজেকে সামলে নিলেন, বিভূতি দেখাচ্ছিস! রাখ তোর বিভূতি, তুই আমার মাটিখেকো গোপাল, তুই আমার নন্দলাল, তুই আমার ননীচোরা, দামাল দুষ্টবালক।
চিরন্তন বাৎলস্য রসে কী বৈষ্ণব, কী শাক্ত উভয়েই ভেসে গেছেন। ধনুর্ধারী রাবণ নিধনকারী রামচন্দ্রকে নিয়ে আমাদের লীলা যত না জমেছে, তার অধিক আমরা পেয়েছি বালক শ্রীরামে, ‘ঠুমকি চলত রামচন্দ্র বাজ পায়জনিয়া’। মা মেনকা সেই একই আবেশে ভয়ঙ্করীকে চান না, ঐশ্বর্যময়ীকেও চান না, তিনি চান মাধুর্যময়ীকে। সশস্ত্রা, সালঙ্কারা দেবীর রূপ বদলে গেল। হয়ে গেলেন ঘরের মেয়ে। শ্বশুরালয়ে থেকে চারদিনের জন্যে আসছেন পিত্রালয়ে। এই আগমনই তো ‘আগমনী’। এসেছে শরৎ, হিমের পরশ। ভোরের মরকত নীল আকাশ, ভিজে বাতাস উৎসবের মতো রোদ, বিন্দু বিন্দু শিশির। গ্রীষ্মের দাবদাহ প্রশমিত। তরল বর্ষায় সনাতন প্রকৃতি স্নাত। নদী, জলাশয়, পূর্ণগর্ভিণীর মতো জলভারে টলটলে। সব সবুজে সবুজ। প্রকৃতির এই সাজ বদলেই আছে তাঁর আগমনবার্তা। এই শিশির ভেজা শরৎ-ই আমাদের উমা। ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা /নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই’। ভেলা নয়, টুকরো টুকরো, হালকা হালকা মেঘ আমাদের উমা মায়ের বেয়ারিং চিঠি। কৈলাস থেকে নিয়ে আসছে বাতাস ডাকহরকরা। প্রকৃতি জুড়ে পূজার প্রস্তুতি। সুবিপুল আয়োজন। মানুষ অধিক আর কী করবে! প্রকৃতির পূজার কথা এই আগমনীতে অতুলনীয়,—’তব চরণ ধোয়াবে শারদ-শিশির, শেফালী অর্ঘ্য দেবে।/ধরণী শ্যামল আসন বিছাবে, তুমি মা আসিবে যবে।।/রক্ত ঊষাতে সিন্দুরের টিপ পরাবে মা তোর ভালে।/চাঁদিমা আরতি দিয়ে যাবে মাগো সুনীল গগন-তলে।।/কত শতশত কমল কুমারী তোমারে পূজিতে চাহে।/দিকে দিকে তব আগমন-গীতি দোয়েল শ্যামা গাহে।।”
প্রকৃতির আয়োজনের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা অসম প্রতিযোগিতা। প্রতিমা তো সেই একই ছাঁদে গড়া। যতই ভাঙাচোরা হোক, সেখানে শাস্ত্রের শাসন একেবারে উপেক্ষার তো নয়। একচালা ঠাকুর পারিবারিক পুজোয় বজায় আছে। বহনযোগ্য। বারোয়ারির বড় পুজোয় মায়ের হাতে ধরাধরি, কাঁধে কাঁধ, নিবিড় পরিবারটিকে আমরা ছত্রভঙ্গ করেছি। শুধু পুজো হলেই হবে না। কথায় বলে আর্টের ঠাকুর। এক এক বছর এক এক প্যান্ডেলে এমন এমন পোজ দেখেছি, আমি তো আমি, স্বয়ং মহিষাসুরও হকচকিয়ে আছে। মা যুদ্ধ করবেন কী, এখুনি না অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দড়াম করে পড়ে যান। স্রেফ দৈবশক্তির জোরে দন্ডায়মান। পুজোয় পর্যাপ্ত পরিমাণে কালচার ঢোকাতে হলে ট্রাডিশনাল পটুয়া পাড়া ছাড়তে হবে। শিল্পী ধরতে হবে। ইতিহাস ঘেঁটে মূর্তির ঢং বের করবেন। সে মূর্তি যথেষ্ট বড় হবে না তবে আর্টে মেরে দেবেন। ব্লো ল্যাম্প মেরে মাকে অক্সিডাইজ করা হবে। লালচে, কালচে সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মহাকালী, মহিষাসুরমর্দিনী পাঞ্চ। অথবা হ্যামার ফিনিশ। রঙের কায়দা। যত শুকোচ্ছে, তত ফাটছে। চুল ফাট। দশমীর সকালে একেবারে লোলচর্মা ধুমাবতী। আর্টের ঠাকুরে অসুর এক ডিস্টার্বেন্স। গোটা অ্যারেঞ্জমেন্টে তাকে খুঁজে নিতে হয়। আট পয়েন্ট টাইপে ফুটনোটের মতো তিনি যে কোথায় আছেন সময় সময় উদ্যোক্তরাও ভড়কে যান। একবার এক পুজোর অসুর কারখানাতেই পড়ে ছিল। সাধারণত মায়ের একটা পা থাকে সিংহ আর একটা অসুরের জানুতে। অসুর আসেনি, মিসিং, মায়ের বাঁ পা হ্যাঙ্গিং। শিশুটি মাকে উত্যক্ত করছে, মা অসুর কোথায়? শৈশবে আমরাও অসুরের জন্যে কাতর হতুম। একটি শিশুর আই লেভেলে যা থাকে সেটার প্রতি তার সমধিক আকর্ষণ। আই লেভেলে অসুর, সিংহ, প্যাঁচা, হাঁস, ইঁদুর। স্বয়ং মা দুর্গা সেই কোন ওপরে বড় বড় অপ্রাকৃত চোখ নিয়ে কী করছেন দেখতে হলে অনেকটা পেছিয়ে যেতে হবে। মহিষাসুর একেবারে টকিং ডিসটেনসে। দুটো সুখদু:খের কথা বলা যায়। বছর বছর মা দুর্গাকে দু:খের কথা জানিয়ে বোঝা গেছে ডেফ ইয়ারস। অঙ্কের প্রশ্নপত্র যে শক্ত, সেই শক্ত, ইংরিজি যতটা ভোগাতে পারে ততটাই ভোগাচ্ছে, পিতার মনে প্রেম আসার সম্ভাবনা আদৌ নেই, আর মা কখনও পিঠটাকে ঢাক ভাবছেন, গাল দুটোকে ভাবছেন চাপাটি। কান দুটো তো জন্মাবধি, ছাত্রাবস্থায় গুরুজন ও শিক্ষকদের জন্যে বলিপ্রদত্ত। মধ্যযৌবন থেকে মৃত্যুতক স্ত্রী নামক স্ত্রীজাতির সেবায় নিয়োজিত। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই, অসুরই ভালো। ভারতে দেবীর চেয়ে অসুরের প্রতিষ্ঠাই বেশি। অসুরের ধর্ম নেই। ফিগার আছে। টেরিফিক ডাঁট। ছেলেটাকে সেই ছেলেবেলা থেকে ভালোবেসে আসছি। বাস্তবজীবনে দেখেছি একটা অসুরকে ভালো করে পোষ মানাতে পারলে কিছুটা নিশ্চিন্ত আরামে থাকা যায়। মা দুর্গার উদাসীনতা সম্পর্কে জেনেছি, ওটা কৃপার এলাকা। যাকে কৃপা করবেন তাকে কৃপা করবেন। জোর জবরদস্তি চলবে না। অর্থাৎ দুর্গতিনাশিনী তাঁর নাম হতে পারে, উপোষ করে আগাপাশতলা চণ্ডীপাঠ করা যেতে পারে, তাতে আমার দুর্গতি যা ছিল তাই থাকবে, বরং উপবাসে ঠায় চারঘণ্টা চিৎকার, চেঁচামেচির ফলে শারীরিক দুর্গতি আরও বেড়ে যাবে। ভারতবর্ষের অর্থনীতির মতো। পঞ্চাশ বছর ধরে ডেভালাপিং, ডেভালাপড আর হল না। টাকার সঙ্গে ডলারের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। আর আমরা লেংচে মরি। এরই মধ্যে বছর বছর দুর্গাপুজো দুশ্চিন্তার কারণ হলেও শেষ পর্যন্ত বেশ একটা অনুভূতি রেখে যায়। অবশ্যই একটা ইভেন্ট। অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। যেমন গত বছর জেনেছি, বিশ্বকর্মাকে শুইয়ে দিলেই মহিষাসুর। কিছু উদ্বৃত্ত বিশ্বকর্মা থাকেই। একে বর্ষা, তায় বায়োয়ারির চাপ, দাও শুইয়ে। আরও জেনেছি মায়ের গঠনে সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল জিওমেট্রি হল, মায়ের ডান হাত আর অসুরের বুকের মধ্যস্থলের অ্যালাইমেন্ট। মায়ের হাতের বর্শা যেখানে এসে মিট করবে। শিল্পী তো লাল রং মেরে ছেড়ে দিলেন। এদিকে পুরোহিতমশাই অস্ত্র পরাতে হিমসিম। সোজাসুজি এসে গেলে দেখায় ভালো নয় তো বেঁকেচুরে ধনুক। একজন বলেছিলেন, আজকাল স্লিম দুর্গা দেখা যায় না, পানপাতার মতো প্রাোভার্বিয়াল মুখ। সঙ্গে সঙ্গে পালটা প্রশ্ন, স্লিম রমণীও কি দেখা যায়, সবই থায়রয়েড কেস।
তবে আজকাল কেউ সেইভাবে খুঁটিয়ে মাকে দ্যাখেন না, সবাই প্যান্ডেল দেখেন। প্যান্ডেলটাই সব। পাড়ার পুজো টিংটিং করছে, পুজো এখন কলকাতায়। বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা ঘুরে ঘুরে দেখেন। অস্কারের মতো পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা। বেস্ট প্যান্ডেল, বেস্ট প্রতিমা, বেস্ট লাইটিং ইত্যাদি, ইত্যাদি।
যা ছিল শৈশবে, আজও তাই আছে, নতুন জামা, কাপড়, জুতো। তফাত একটাই, তখন হত পাওনা, এখন শুধুই দেনা। আর একটা তফাত, তখন পায়ের জুতো কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে উঠত, কারণ ফোস্কা। এখন পায়ের জুতো পায়েই থাকে, কারণ সফটওয়্যার। কম্পিউটারেও সফটওয়্যার, পায়েও সফটওয়্যার, কিন্তু দামে ভেরি হার্ড। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ মশাই! ভুলে হাতের জুতো তৈরি করলেন না কী! হাজার টাকা হাঁটবে, রাস্তা কোথায়! টায়ার যেখানে ভয় পায় সেখানে টেংরি!
সত্যি কথা বলতে কী, পুজোর কিছুই জানি না। এইটুকু জানি, এমন মিলনমেলা, কাতারে কাতারে এমন উচ্ছ্বাস আর দ্বিতীয় নেই। পুজোটা হিন্দুর; কিন্তু সর্বধর্মের মানুষ মেতে ওঠেন। শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলে এমনটি হত না। এইটিই মা দুর্গার অলৌকিকত্ব। একটা অসুর সত্যিই তিনি বধ করেছেন, সেটি হল গোঁড়ামি। আর একটা কাণ্ড অলক্ষ্যে ঘটেছে, তা হল সংস্কৃতির মিলন। কোন ধর্মের কোন উৎসবে শারদ সাহিত্যের, সঙ্গীতের ডালি সাজানো হয়!
নব পত্রিকার রহস্য হয়তো জানি না। গণেশের কলাবউটি হয়েই তিনি থাকুন, কেন প্রয়োজন হয় বেশ্যার ভিটের মাটি জানতে চাই না। সপরিবারে কেনাকাটা করব, দুশ্চিন্তায় মরব, সপ্তমীর ভোরে কলাবউয়ের স্নানমিছিল দেখব, মাছ খাব, অষ্টমীর দিন লুচি, ছোলার ডাল, নবমীর দিন মাংস। দশমীর রাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরব, আর রকম রকম ঘুগনি। গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকাব। দশমীর চাঁদ পশ্চিমে ঝুলছে। সেইখানে ঠিক সেই তারাটা, বিসর্জনের বুকখালি করা সেই দীর্ঘশ্বাস—যা:, তুমি চলে গেলে! আবার একটা বছর! তখন কে থাকে কে যায়!
।। দুই ।।
আরও একটু না বললে বাঙালি জীবনে দুর্গাপূজার তাৎপর্য যথেষ্ট পরিষ্কার হবে না। বারো মাসে আমাদের তেরো পার্বণ। পার্বণ মানে পূজা, উৎসব, দেদার মজা। তেরো পার্বণের পাঁচালিটা বলেনি:
চৈত্রমাসে চড়ক পূজা গাজনে বাঁধ ভারা
বৈশাখ মাস দেয় সকলে তুলসীগাছে ঝারা
জৈষ্ঠ্যমাসে ষষ্ঠীবাটা জামাই আনাআনি
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দড়া টানাটানি
শ্রাবণ মাসে ঢেলাফেলা হয় চড়চড়ি
ভাদ্রমাসে টকপান্তা খান মনসা বুড়ি
আশ্বিনে অম্বিকা পূজা কাটে মোষ পাঁঠা
কার্ত্তিকে কালিকা পূজা ভাইদ্বিতীয়ার ফোঁটা
অঘ্রানে নবান্ন নূতন ধান কেটে
পৌষ মাসে বাউনি বাঁধা ঘরে ঘরে পিঠে
মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতেখড়ি
ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা ফাগু ছড়াছড়ি।
আশ্বিনে অম্বিকা আর কার্ত্তিকে কালিকা, এই দুই পূজাই মহাপূজা। এই চণ্ডীপূজা বহু প্রচীন। ইতিহাস আছে। হঠাৎ শুরু হল। রাজা, মহারাজা, ইতর প্রজা সহসা মেতে উঠলেন, এমন নয়। বাঙালি বণিকেরা অষ্টাদশভূজা উগ্রচণ্ডী দুর্গার পূজা শ্যাম, কম্বোজ, চিন, কোরিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপসমূহ, সুমাত্রা, জাভা, বালি, বোর্নিও, সেলিবেস, এবং ফিলিপাইন দ্বীপসমূহে নিয়ে যান। এই সকল স্থানে আদিম বঙ্গীয় বর্ণমালার আঠারোটি অক্ষর (ব্যঞ্জনবর্ণ) মাত্র প্রচলিত। ১৮ মহাপুরাণ, ১৮ উপপুরাণ ও মহাভারতের ১৮ পর্ব, বাংলার ১৮টি বীজ অক্ষরের মহিমা-জ্ঞাপক। এই রহস্যময়তা মানুষকে জীবন থেকে অতিজীবনের দিকে নিয়ে যায়। এ হল মানুষের ভাব ও ভাবনার ইতিহাস। বাণিজ্য আর বাণিজ্য-তরণী, সাহস আর সওদার পাশাপাশি মিকস্টারি মানুষের মলাট উলটে দেখার চির প্রচেষ্টা। তা না হলে ক্রিট দ্বীপে ডা: ইভানস কেমন করে ৩০০৫ খ্রি: পূ: অব্দের সিংহবাহিনী মূর্তি আবিষ্কার করেন! এই একটি নয়, আরও নজির আছে। এশিয়া মাইনরের ভোগাজ কিউ-এর গিরি মন্দিরে খ্রি: পূ: ২৮০০ অব্দে যা নির্মিত, সেখানে মায়ের মূর্তি। ৬০০ খ্রি: পূ: অব্দের কার্থেজের দুর্গাও এই একই গোত্রের। এইসব টানাটানির অর্থ, বুঝে নেওয়া, এই মাতৃপূজা বহু প্রাচীন। জাভার পমবনমে কম সে কম এক হাজার চণ্ডীমন্দির আছে। এই সমস্ত মন্দির ৫২৫ খ্রি: থেকে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রাচীন বাংলা দেশের আর্যরা প্রথমে এই মাতৃপূজা স্বীকার করেননি। প্রচলিত ছিল বণিকদের মধ্যে। প্রচলন করেছিলেন রমণীরা। ঘটের পূজা। গোপনে। স্বামীরা জানতে পারলে দেবীকে ডাইনি বলে ঘটে লাথি মারতেন। অবশেষে যেভাবেই হোক গ্রহণ করেছিলেন। পরে আবার বর্জনও করলেন। করার কারণ সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ শক্তি আরাধনার নামে পশুবলি এমনকী নরবলিও শুরু করলেন। বৌদ্ধযুগে এবম্বিধ উগ্র পূজা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হল, শেষে পৌরোহিত্যের ভার পড়ল চর্মকার সম্প্রদায়ের হাতে। শূন্যপুরাণে দুর্গাকে কখনও কখনও বলা হয়েছে হাড়ির মেয়ে। হাড়ির বাড়িতে বাদ্য না বাজলে কোনও কোনও অঞ্চলে পুজোই শুরু হত না, এমন জনশ্রুতিও আছে। হাড়িকাঠ শব্দটি এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই কারণেই জড়িত যে, পশুবলি এঁরাই দিতেন।
দূর অতীত থেকে কাছের অতীতে সরে এসে কী দেখছি। দুশো কী দেড়শো বছর আগের কলকাতা। বলির রক্তে নদীর ধারা বইছে। জয় মিত্রের বাড়িতে নবমীর দিন অসংখ্য মহিষ, মেষ, ছাগল বলি দেওয়া হত, এই বড় মানুষের বাড়িতে সপ্তমী থেকে নবমী যত ছাগল বলি হত, তার যতটা লাগল লাগল, বাকি সব রাখা হত গুদামে। একদশীর দিন নায়েবমশাই খাতা খুলে বসতেন। বাবুর পৈতৃক আমল থেকে যে যে ব্রাহ্মণের বার্ষিক ছিল তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। একালের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ শিউরে উঠবেন। আশ্বিনের ভ্যাপসা গরম, গুদামে পড়ে আছে কাটা ছাগল। মাংস রসস্থ হচ্ছে। স্বাদ বাড়ছে। বলির মাংস মহাপ্রসাদ। পেঁয়াজ, রসুন বর্জিত, হিং দিয়ে কবিরাজি রান্না। কী ছিল সে যুগের ভোজনবিলাসী বাঙালির রুচি!
প্রাণকৃষ্ণ দত্ত মশাই লিখছেন, ‘নবমীর বলিদানের আমোদ কর্তাদিগের নিকট যাহা শুনিয়াছি, তাহা আরও অদ্ভুত। তাঁহারা বলিতেন, কেবল মহিষ মেষ ছাগ কুষ্মাণ্ড, আখ নহে, অনেক গৃহে আমোদ করিয়া গোধিকা, কপোত, মাগুর মাছ, নানাবিধ লেবু সুপারি এবং গোলমরিচ পর্যন্ত বলিদান হইত।’ বলিদানের পর আরতি। আরতির পর ভীমবপু কিছু মানুষের নৃত্য। রক্তপ্লাবিত এই প্রান্তরে শুধু নৃত্য নয়, শুরু হত মল্লযুদ্ধ ও ব্যায়াম প্রদর্শন। মোষের মুণ্ড, আখ, কুমড়ো, লেবু, নারকেল নিয়ে কাড়াকাড়ি, রক্তে গড়াগড়ি। এক একজন উবু হয়ে বসেছে, পেট আর দুই উরুর মাঝখানে চেপে ধরে আছে একটা নারকেল, এইবার আট-দশজন বীর সেই নারকোলটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য টানাটানি, কাড়াকাড়ি আছাড় পিছাড়। এইবার রক্তমাখা বীরের দল পথে। বাদ্যবাজনার সঙ্গে মিছিলের তাণ্ডব নৃত্য। যেন যক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করে শিবসৈন্যের দল বিজয়-মিছিল বের করেছে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩, এই তেরোটি অধ্যায় হল দেবীমাহাত্ম্য, চণ্ডী বা দুর্গাসপ্তশতী। সেখানে কোথাও এমন ভয়ঙ্কর, রক্তাক্ত দেবী আরাধনার দর্শন নেই। শ্রীমদ্ভগবদগীতার মতো শ্রীশ্রীচণ্ডীও উচ্চ আধ্যাত্মিকতার পরিবেশক। গীতার শ্রীকৃষ্ণ ভগবান বলছেন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি র্ভবতি ভারত / অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।’ চণ্ডীর দেবীরও সেই একই আশ্বাসবাণী, ‘ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থাভবিষ্যতি তদাতদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম।’
সমস্ত পুরাণেরই একটি উদ্ভব কাহিনি থাকে, চণ্ডীরও আছে। দেবীমাহাত্ম্যের উপাখ্যানটি সর্বপ্রথম মেধস মুনি রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধিকে বলেন। তারপর ঋষি মার্কণ্ডেয় ভাগুরিকে বললেন। সব শেষে পেলেন জৈমিন। চণ্ডীর সুউচ্চ আত্মবোধিনী ভাবের কারণে বৌদ্ধরাও এই গ্রন্থের সমাদর করতেন। নেপালের রাজ গ্রন্থাগারে ৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের এক বৌদ্ধচার্যের লেখা একখানি সপ্তশতী চণ্ডীর সন্ধান মিলেছে। প্রাচীন নেওয়ারী অক্ষরে লেখা।
রাজা সুরথ রাজ্যপাট হারিয়ে বনে চলে এসেছেন। এদিকে সমাধি নামে এক বণিক বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে একই জায়গায় এসেছেন। স্ত্রী-পুত্ররা সব কেড়ে নিয়ে দূর করে দিয়েছে সওদাগরকে। রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত তবু রাজ্যের কথা, প্রজাদের কথা, শাসনের কথা ভুলতে পারছেন না। আর সমাধি! বিতাড়িত! তবু স্ত্রী-পুত্রদের চিন্তায় কাতর। দুই হতভাগ্যের মিলন। দুজনেরই জিজ্ঞাসা, কেন এই বৈকল্য! কেন ভুলতে পারছি না যা ছেড়ে এসেছি! গেলেন মেধস মুনির কাছে। মেধস বললেন, রাজা, এইটি হল মহামায়ার খেলা। রাজা প্রশ্ন করলেন, আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন তিনি কে? তিনিই দুর্গা, দুর্গতিহারিণী। তাঁর জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, তিনি বিশ্বচরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। মধুকৈটভ, মহিষাসুর আর শুম্ভনিশুম্ভ বধের জন্যে দেবীর বিভিন্ন মূর্তিতে আবির্ভাব। তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং। তিনিই তোমাদের মোহিত করেছেন, তামুপৈ হি, মহারাজ শরণম।
রাজ সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদীর ধারে দেবীর মৃন্ময়মূর্তি গঠন করে, কখনও নিরাহার, কখনও যথাহারে, তন্মনস্ক ও সমাহিত হয়ে দেবীসুক্ত পাঠ করে ‘পুষ্প’, ধূপ অগ্নি ও ‘তর্পণ’ সহায়ে দেবীর আরাধনা করলেন। তিনটি বছর এইভাবে গেল, অবশেষে মহামায়ার আবির্ভাব। পরিতুষ্টা জগদ্বাথী প্রত্যক্ষ্যাং প্রাহ চণ্ডিকা—বর প্রার্থনা করো। রাজা ইহজন্মে নিজের রাজ্য আর পরজন্মে অবিভ্রংশী রাজ্য প্রার্থনা করলেন। বৈশ্য সমাধি চাইলেন আত্মজ্ঞান, যা লাভ করলে ‘আমার’ বা ‘আমি’ বোধ চলে যায়। দেবী দুজনকেই বললেন, ‘তথাস্তু’।
ভোগ আর যোগ দুয়েরই দেবী দুর্গা। ঐশ্বর্য ও বৈরাগ্য দুটোই তাঁর কৃপা। রাজার তিনি রিপাবলিক, লক্ষ্মী ধনের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক বীরত্বের, গণেশ সাফল্যের প্রতীক। কলাবউ এগ্রিকালচার। অতি সাধারণ, মাটির মানুষের প্রয়োজনে যা লাগে, তাই দিয়ে বাঁধা এক শষ্প নারী। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান, ধান এই ন’টি দিয়ে রচিত নবপত্রিকা অর্থাৎ গ্রাম বাংলা। ‘প্রিয়জনে যাহা দিতে পারি তাহা দেই দেবতারে’। প্রতিমাতেই তো সার্বজনীনতা। মন্ত্র ও সার্বজনীন, ‘তিষ্ঠ দেবীগণৈ: সহ’। রাজদ্বারের মৃত্তিকা আর বেশ্যাবাড়ির মৃত্তিকা ছাড়া পুজো হবে না। কেন? উত্তম এবং অধম উভয়েই একই কৃপার এলাকায়। সমদরশি হই। পেঁচা, ইঁদুর, ময়ূর, সিংহ প্রকৃতিতে সবাই পূজিত, ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স, বায়োকন্ট্রোল। মহিষাসুরেরও পূজা আছে। অসংখ্যের প্রতীক হল দশ সংখ্যা। অসংখ্য অর্থাৎ ‘মাস’-এর প্রতিপালিনী তিনি। দশপ্রহরণের দশটি আধ্যাত্মিক প্রয়োগ। অসুর বধ তো আছেই। সেটি স্থূল প্রয়োগ। আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি হল, ত্রিশূল–স্থূল সূক্ষ্ম কারণ, জীবের এই দেহের লয় ঘটিয়ে সিদ্ধ দেহ জাগাবে। খড়গ শুধু অস্ত্র নয়, এটি জ্ঞানখড়গ, তত্বজ্ঞানের অসি ইত্যাদি।
রাজনারায়ণ সেকালের কথা বলতে গিয়ে লিখলেন, ‘সেকালের লোকদিগের ধর্মের প্রতি বিশেষ আস্থা দৃষ্ট হইত। তাঁহারা যেরূপ বিশ্বাস করিতেন তদনুরূপ কার্য করিতেন। তাঁহারা হিন্দুধর্মের নিয়ম সকলে যত্নপূর্বক পালন করিতেন…রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর পূজার সময় সাহেবদিগকে আহারের নিমন্ত্রণ করিতেন বলিয়া অন্যান্য হিন্দুগণ তাঁহার ওপর বড় বিরক্ত হইয়াছিলেন। সেকালে ধর্ম বিষয়ে, ভিতরে একখান বাহিরে একখান, এরূপ ছিল না। এক্ষণে যেমন দালানে পূজা হইতেছে, বৈঠকখানায় মদ্যপান ও উইলসনের দোকানের খানা চলিতেছে, অন্তরে দেবদেবীতে বিশ্বাস নাই, কিন্তু সম্ভ্রম রক্ষার জন্য বাহ্য ঠাঁট বজায় রাখিতে হইবে, সেকালে এবম্ভূত ব্যাপার দৃষ্ট হইত না।’
সেই সময়কার কাগজে অদ্ভুত এক বিজ্ঞাপন। পুজোর আকর্ষণ ‘Prime York hams in canvas just in time for the Poojah’. ১৮৬৭ সালের দুর্গাপুজোয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে পিটার সাহেব জিমন্যাস্টিক দেখিয়েছিলেন। বাঙালি যুবকরা উৎসাহিত হলেন। তারই পরিণতি পরবর্তীকালের বাঙালি সার্কাস। এ তো রাজবাড়ির পূজা। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখছেন, ”যিনি দুইটাকা আড়ই টাকা বেতনের চাকুরি করিতেন, তাঁহার গৃহে দোল দুর্গোৎসব হইবে…চারি পাঁচখানি দুগোৎসব হইত না এমন গলি ভদ্রপল্লীতে দেখা যাইত না। পূর্বে যে যে গৃহে পূজার মহাড়ম্বরে পল্লী আমোদিত হইত, এখন তাঁহাদের অনেক পরিবার হীনাবস্থা হওয়ায়, পূজা বন্ধ হইয়াছে’ প্রাণকৃষ্ণ বড়লোকদের রেষারেষির বর্ণনা দিয়েছেন, ‘বড়বাবু চারিটা ঢোল দুইটা ঢাক রাখিয়াছে, আমায় আটটা ঢোল চারিটা ঢাক রাখিতে হইবে। ওখানে দুইটা পাঁঠা বলি হইবে, আমি আটটা বলি দিব।’
রাজা সুরথ দেবীর কৃপায় হৃতরাজ্য পেলেন। বৈশ্য সমাধি পেলেন আত্মজ্ঞান। চৈতন্য পেলেন। আমাদের রাজারা বাই নাচিয়ে, সায়েব খিলিয়ে সব হারালেন। আর বৈশ্যকুল টাকায় কালো হয়ে গেলেন। ব্যাপার-স্যাপার বোঝা দায়। তার চেয়ে ওই প্যান্ডেল ভালো, চন্দননগরের আলোয় জুরাসিক পার্ক ভালো। এবারে লেডি ডায়না, কী মাদারও আসতে পারেন। আর ভালো ওই দৃশ্যটি, নতুন শাড়িতে মা, পাশে প্রজাপতির মতো নেচে নেচে চলেছে নতুন ফ্রক পরা মেয়েটি। হ্যালোজেনের আলোয় ফটফট করছে, ক্ষতবিক্ষত, দাগরাজি, দগদগে রাস্তা, আর তারই একপাশে আরও অলৌকিক দৃশ্য, আমাদের পাড়ার মণি পাগলি নতুন শাড়ি পরেছে আর ঝাড়ুদারনি বীণাদি সুসজ্জিতা হয়ে মণির চুলে লাল ফিতের ফুল বাঁধছে। আজ আর তার হাতে পেল্লায় সেই ভোরের ঝাঁটাটা নেই।