দুর্গাপ্রতিমা ও কুমারটুলি
সেদিনের দুর্গাপূজা বলতে আমি আমার ছেলেবেলার, তার মানে বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকের দুর্গাপূজার কথা বলছি। আমার ছেলেবেলায় দুর্গাপূজার যে সৌরভ ও হিল্লোল দেখেছি, আজ আর তা নেই। আশমান-জমিন ফারাক হয়ে গিয়েছে। এক অবিকৃত আনন্দ ও উৎসবের মধ্যে ডুবে থাকত সেদিনের মানুষ, পূজার এ ক’টা দিন।
আমাদের ছেলেদের ভারি আনন্দ হত ঠাকুর গড়া দেখতে। আমাদের পাড়ায় বিশ্বাসদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হত। প্রতিমাটা তাঁদের বাড়ির ঠাকুর দালানেই গড়া হত। ওই প্রতিমা গড়া দেখবার জন্য আমরা ছেলের দল সারা বৎসরই উৎসুক হয়ে থাকতুম। জন্মাষ্টমীর পর প্রতিমা গড়বার জন্য ওঁদের বাড়িতে কুমোরের দল আসত। ওটাই ছিল প্রাচীন ঐতিহ্য। কলকাতা শহর গড়ে যখন ওঠে, তখন যে সব ঋদ্ধিবান হিন্দু কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন নিষ্ঠাবান সমাজের সমস্ত ধর্মকর্ম। দোল-দুর্গোৎসব তো তাঁরা করতেনই, তা ছাড়া করতেন আরও কত রকমের পূজা। তখন কুমারটুলির জন্ম হয়নি। প্রতিমা গড়বার জন্য কুমোররা আসতেন মৃৎশিল্পের দেশ নদীয়া থেকে। বর্ষার শেষে আসতন, আর সরস্বতী প্রতিমা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় থাকতেন। তারপর তাঁরা আবার ফিরে যেতেন নিজেদের দেশে। এ ক’মাস তাঁরা কুমারটুলিতে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তারপর কলকাতার জনসংখ্যা যখন বাড়তে লাগল, তখন আগন্তুক কুমোরের দলও বাড়তে লাগল। তখন তাঁরা কুমারটুলিতে স্থায়ী বসবাস শুরু করলেন। সে আজ থেকে অন্তত দুশো বছর আগেকার কথা। কেন না ১৭৮৪-৮৫ সনে মার্ক উড কলকাতার যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, তাতে কুমারটুলির ঘাটের কোনও উল্লেখ নেই
যাক, আমার ছেলেবেলার যে কথা বলছিলাম, সে প্রসঙ্গেই ফিরে আসা যাক। বিশ্বাসদের বাড়ি আমরা যখন ঠাকুর-গড়া দেখতে যেতুম, তখন কুমোররা আসত কুমারটুলি থেকে। তখন তাদের আমরা কুমোর বলেই জানতুম, আর পাঁচরকম কারিগরের মতো, কারিগর হিসাবে, মাত্র। তাঁরা যে আমাদের দেশের এক রকম শিল্পী, যাঁরা দেবতাকে দেন রূপ, তা জানতুম না। সে চেতনা আমাদের তখনও হয়নি।
প্রতিমাটা গড়া হত একটা কাঠের তৈরি কাঠামোর ওপর। ওই কাঠামোটা বিশ্বাসদের বহুকালের। অতীতে তাঁদের কোনও এক পূর্বপুরুষ, যিনি প্রথম দুর্গাপূজা প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনিই ওটা তৈরি করেছিলেন। তারপর থেকে ওই একই কাঠামোপূজা করে তার ওপর প্রতিমা গড়া হত।
বিশ্বাসবাড়ি কুমোররা এলেই আমরা ছেলের দল, ঠাকুরদালানে ওঠবার সিঁড়ির এক পাশে গিয়ে বসতুম এবং কুমোররা কী করে ঠাকুর গড়ে তা দেখতুম। ভারি আনন্দ হত দেখতে, কীভাবে তাঁরা বেলেমাটি, এটেল মাটি, তুষ, গোবর ইত্যাদি দিয়ে দেবতার মূর্তি গড়ে তুলতো। কখনও কখনও দেখতে দেখতে আমরা এমনই বিহ্বল হয়ে পড়তাম যে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যেতুম। বাড়ি থেকে ডাকের পর ডাক আসত, কিন্তু আমাদের ঠাকুর গড়া দেখতেই মন থাকত। আমাদের উত্তেজনা বিশেষ করে বাড়ত, যখন অসুরের মূর্তিটা তৈরি করা হত। অনেক সময় আমরা বলতাম, ‘কুমোরদাদা, অসুর ব্যাটার মুণ্ডুটা সিংগি মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিন।’ কুমোরদাদা বলতেন, ‘তা কি কখনও হয় দাদু, মা যে একে বধ করবেন। সিংগিব্যাটা যদি একে খেয়ে ফেলে, তা হলে মা কাকে বধ করবেন?” আমরা কুমোরদাদার যুক্তিটা বুঝতাম।
পূজার আর পনেরো কি কুড়ি দিন দেরি আছে। বাবা সেদিন রাত্রে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে, বিশ্বাসবাড়ির ঠাকুর-গড়া কি শেষ হল?” বললাম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এখন শুধু রঙ তেল করা ও ডাকের সাজ সাজানো বাকি আছে।
সেকালে ডাকের সাজ ছিল মায়ের ডাকসাইটে সাজ। এগুলো যাঁরা তৈরি করতেন, তাঁরাও বড় শিল্পী। তাঁরা মালাকার শ্রেণীরই এক শাখা। এঁদের উপাদান ছিল শোলা। শোলা নিচু জমিতে আপনি আপনি জন্মায়। নদীয়া জেলার বাতের বিলে যে শোলা জন্মায়, তাই হচ্ছে উৎকৃষ্ট। সেজন্য নদীয়া জেলার কালীগঞ্জ, মাতিয়ারী ও কৃষ্ণনগর সদরই ছিল শোলা-শিল্পীদের কেন্দ্র। তবে অন্য জেলাতেও অনেক শোলা-শিল্পী ছিলেন। যথা, হাওড়া জেলার বালি-ব্যারাকপুর ও আমতা; হুগলির ডানকুনি, উত্তরপাড়া ও শিয়াখালা; চব্বিশ পরগণার খড়দহ; মেদিনীপুরের তমলুক ও গড়বেতা; বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী; বর্ধমানের কাটোয়া, দোমহনী ও জামুরিয়া; মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ও বেলডাঙ্গা ও বীরভূমের খয়রাশোল, দুবরাজপুর ও ময়ূরেশ্বর।
কুমোরদের কাজটা যে একটা বিশিষ্ট শিল্প, তা বেশ বড় হয়ে বুঝলাম। কুমোরপাড়ার তখন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কারিগর ছিলেন গোপেশ্বর পাল। কুমোরপাড়ায় অত বড় শিল্পী আর জন্মায়নি। তাঁর হাত ও মনের মধ্যে ছিল ভগবানের অসীম করুণা। দু-চার মিনিটের মধ্যেই যে-কোনও লোকের আবক্ষমূর্তি তিনি তৈরি করে ফেলতে পারতেন। তাঁর শিল্পপ্রতিভার পরিচয় দেবার জন্য তিনি আহূত হলেন লণ্ডনের ব্রিটিশ এম্পায়ার একজিবিশনে। ডেক প্যাসেঞ্জার হয়ে যাচ্ছিলেন বিলাতে। একদিন হঠাৎ জাহাজের ক্যাপ্টেনের নজরে পড়ল, লোকটা সারাদিন ধরে মাটি নিয়ে কী গড়ে, আর ভাঙে। মুহূর্তের মধ্যে গোপেশ্বর তৈরি করে দিলেন ক্যাপ্টেনের মূর্তি। চমৎকৃত হলেন ক্যাপ্টেন। বুঝলেন লোকটি মস্ত বড় শিল্পী। নিজের দায়িত্বেই শিল্পীকে নিয়ে গিয়ে স্থান দিলেন সেকেণ্ড ক্লাস কেবিনে। এসব রূপকথার মতো শোনায়, কিন্তু সবই সত্য।
একজিবিশনে আসছেন ডিউক অভ কনট। বেঙ্গল প্যাভিলিয়নে থাকবেন পাঁচ মিনিট। কিন্তু ওই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গোপেশ্বর তৈরি করে দিলেন ডিউক অভ কনটের মূর্তি। অবাক হয়ে গেল দর্শকরা। গোপেশ্বর পালের সমকক্ষ না হোক, এরকম শিল্পী কুমারটুলিতে বহু কাল ধরেই আছেন। তবে তাঁরা অবহেলিত।
বিশ্বাসবাড়ির পূজা বন্ধ হয়ে গেল, বিশ্বাস-মশায়ের একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর থেকে। পাড়ায় দুর্গাপূজা শুরু হল আমাদের বাড়ি। আমার বাবাই এটা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আমাদের বাড়ি রাধাষ্টমীতে, কাঠামোপুজা হত, কিন্তু ঠাকুর তৈরি হত কুমারটুলিতে। আমাদের ঠাকুর তৈরি করতেন জিতেন পাল। তিনি এসে কাঠামোটা নিয়ে যেতেন। জিতেন পাল আরও তৈরি করতেন বাগবাজার সার্বজনীনের ঠাকুর। আমাদের বাড়ির পূজা বন্ধ হয়ে গেল আমার মার মৃত্যুর পর, ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে।
বাড়িতে যখন পূজা হত, তখন কী উন্মাদনা ছিল আমাদের। ঢাকের বাজনার তালে তালে নেচে উঠত আমাদের মন। আমাদের বাঁধা ঢুলির দল ছিল। তারা পূজার দু-চারদিন আগেই আমাদের বাড়ি এসে হাজির হতেন। আজ মাইকের প্রতিঘাতে এঁরা অনেক জায়গাতেই প্রত্যাখ্যাত অথচ এঁদের মধ্যেও থাকতো দক্ষ শিল্পী। অনেক সময় এদের সঙ্গে এমন সব সানাইবাদক থাকতো, যাঁরা আজ কালকার নামজাদা সানাইবাদকদের চেয়ে কম কৃতবিদ্য নন। পূজামণ্ডপে তাঁদের আলাপিত রাগরাগিনী আজ হারিয়ে গিয়েছে মাইক- পরিবেশিত সিনেমা তারকাদের গানের প্রতিঘাতে।
আমাদের সমাজজীবনে সেদিনের অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বেঁচে আছে শুধু তন্তুজ শিল্প; তা পূজোর সময় নতুন কাপড় না পরলেই নয়, সেজন্য।
‘আনন্দময়ীর আগমনে, আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে’–এ গান থেকেই বুঝতে পারা যায় যে পুজার সময় সে যুগের সমাজজীবনে বয়ে যেত এক অপূর্ব আনন্দের স্রোত। বিশেষ করে আজকের অবহেলিত শিল্পীদের আনন্দই ছিল সবচেয়ে বেশি। পূজার সময়টাই ছিল তাঁদের মরশুম। আজ পূজা-নির্ভর শিল্পগুলি অধিকাংশই অবহেলিত। সেইসব শিল্পীদের কোনও দিনই আমরা সংবর্ধনার আসরে ডাকিনি। তাঁদের জন্য কোনও সম্মান-পুরস্কার বা শিরোপাও রেখে দিইনি। অথচ একদিন তাঁরাই ছিলেন আমাদের পূজার আনন্দের উৎস। কালের চাকার বিবর্তনে, সমাজজীবনে সে পরিবেশ আজ বিধ্বস্ত।