1 of 2

দুপুর এখানে মৃত্যু – নির্মলকুমার

দুপুর এখানে মৃত্যু – নির্মলকুমার

সুচিত্রার সারা মনটা আনন্দে ভরপুর। সত্যি, তিমিরের পছন্দকে প্রশংসা করতে হয়।

মফস্বল শহরে বদলি হওয়ার সময় সুচিত্রা ভয়ে মুষড়ে পড়েছিল।

ওগো, বুঝলে, কলকাতার বাইরে আমি বেশিদিন থাকতে পারব না।

আচ্ছা, আচ্ছা, একবার দ্যাখোই না কলকাতা ছেড়ে। ভারি চমৎকার জায়গা।

তিমিরের কথায় সুচিত্রা ম্লান হেসেছিল। কিন্তু আজ সারা মনটা খুশিতে ছেয়ে গেছে। মফস্বল শহর। গভীর সান্ত্বনা। তার ওপর এই বাড়িটা। সামনে একটু ফুলের বাগান। দূরে লাল মাটির রাস্তাটা বাঁক নিয়ে তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে গেছে। জানলার পাশে বসে কতদূর দেখা যায়!

সত্যিই তোমার পছন্দ আছে। এত চমৎকার জায়গা, এত সুন্দর বাড়ি তুমি জোগাড় করবে আমি ভাবতেই পারিনি।

সুচিত্রার কণ্ঠস্বরে তিমির বলে, কেন, আমার বুঝি পছন্দ করার ক্ষমতা নেই?

তোমার পছন্দের যা নমুনা দেখেছি! মনে নেই, একটা চওড়া হলদে পাড়ের শাড়ি নিয়ে সেদিন বাড়িতে কী হাসাহাসিই না পড়েছিল!

তিমির হাসে, ওটা তো ছোট জিনিস। আমার পছন্দের তারিফ কিন্তু বন্ধুরা ভয়ানক করে। একজনের রূপের ছটায় তার প্রমাণ হয়ে গেছে।

যাও।—সুচিত্রা হাসে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সুচিত্রা।

সুচিত্রার হাতটা টেনে নেয় তিমির : পছন্দের বাজারে তোমার হার হয়েছে চিত্রা, আমার মতো একজন….।

বাধা দিয়ে বলে সুচিত্রা, বেশ বলো, যত পারো বলো, আমি চলে যাচ্ছি।

গভীরভাবে টেনে নেয় তিমির সুচিত্রাকে : রাগ হল বুঝি!

সুচিত্রা গভীর খুশিতে ডুব দিয়ে তিমিরের বুকে মুখ লুকোয়। জীবনে এত আনন্দ আছে! জীবনে এত সুখ!

সুচিত্রা হঠাৎ বলে, জানো, আজ দুপুরে বেশ মজা হয়েছে।

কী?

দুপুরে জানলার পাশে বসে সেই বইটা পড়ছি। হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তায়। মনে হল, দূরে তুমি আসছ। সেই ছাই রঙের ট্রাউজার, সাদা শার্ট। ভাবলাম, অফিস থেকে পালিয়েছ। তাকিয়ে রইলাম। তুমি এলে। বাগানের গেটটা খুলে দরজার কড়া নাড়লে। তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম, দুষ্টুমি করে খুলব না। কড়া নাড়লে। একবার…দুবার…তিনবার। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই! অবাক হয়ে গেলাম।

তিমির হাসে : ইস, ভয়ানক ভয়ের কথা। একেবারে হেডঅফিসে নজর!

সুচিত্রা হাসে : শুধু একবার নয়, তিনবার কড়া নাড়ে। যতবার খুলে দিই, দেখি কেউ নেই।

পাগলি! বাতাসে কড়া নড়ে ওরকম। এ তো আর কলকাতা নয়, বাতাসের নাম-গন্ধ পাবে না! একটু থেমে তিমির বলে, ভূতটুত বলে ভয় হচ্ছে নাকি?

ঘোড়ার ডিম, ওসব কুসংস্কার আমার নেই। ডিটেকটিভ নভেল পড়তে-পড়তে মাথাটা একটু খারাপ হয়েছিল আর কী।—একটু থেমে বলে সুচিত্রা, চলো, খাবে চলো।

আজ মনটা আমার বৈরাগ্যে ভরে উঠেছে। খাওয়ার আর ইচ্ছে নেই, দেবী।

বৈরাগ্যের কথা মনে রেখো গোঁসাই, শোধ নেব।—সুচিত্রা হেসে পালায়।

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় তিমিরের। একটা হাত তার কপালে, চুলে বয়ে যাচ্ছে। উঃ, কী ঠান্ডা হাত! যেন বরফ। সুচিত্রার হাত এত ঠান্ডা!

অসহ্য এই হাত। কপালের রক্তটা যেন জমে আসছে। হাতটা সরিয়ে দেবে মনে করে তিমির নিজের হাতটা তোলে। হাতটা সরে যায়। পাশ ফিরে মনে হয় সুচিত্রা ঘুমোচ্ছে। অঘোরে। সুচিত্রার হাতটা স্পর্শ করে। অনুভব করে, বেশ গরম। তিমির আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে।

একটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা নিশ্বাস তার মুখে চলাফেরা করছে। হিমশীতল নিশ্বাস, প্রাণের যেন ছোঁওয়া নেই। পাশ থেকে দেশলাইটা নিয়ে জ্বালায় তিমির। না, সুচিত্রা ঘুমোচ্ছে। তবে কে? ভুল? কিন্তু—।

সে সম্পূর্ণ অনুভব করছে। সম্পূর্ণ। মৃত্যুর মতো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ একটা।

হিমশীতল নিশ্বাস। ধীরে একটা হাত টেনে নেয় সুচিত্রার।

সকালে চায়ের টেবিলে চায়ের প্রস্তুতির ফাঁকে সুচিত্রার মুখে একটা দুষ্টুমি হাসি খেলে। তিমিরের এখনও ইয়ে গেল না। পরিপূর্ণ দৃষ্টি তুলে সুচিত্রা বলে, কী দুষ্টু বাবা!

কেন?

আর ন্যাকা সাজতে হবে না। কী দুষ্টুমিই করেছ কাল!

আমি?—বিস্মিত হয় তিমির। সে-ও এই প্রশ্ন করবে ভেবেছিল। দিনের আলোয় রাতের ঘটনাগুলো নিছক মনের ভুল বলেই ধরে তিমির। কিন্তু সুচিত্রাকে কাল…..।

কী, চুপ করে রইলে যে?—একটু হেসে বলে সুচিত্রা, রাগ করলে?

না, রাগ করব কেন, দুষ্টুমি করে রাগ করাটা একেবারে অন্যায়।—তিমির চেপে যায় রাতের নিজস্ব কথাগুলো।

উঃ, তোমার হাতটা কী অসম্ভব ঠান্ডা ছিল কাল! আমার সমস্ত রক্ত যেন জমে যাচ্ছিল।

ঠান্ডা! আমার হাত!—একটা প্রচণ্ড বিস্ময়ের ধাক্কায় কথাগুলো বেরিয়ে আসে তিমিরের মুখ থেকে।

হ্যাঁগো হ্যাঁ। বাবা, আমার যা ভয় লেগেছিল!—সুচিত্রা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলে, মনে হচ্ছিল, তোমার আঙুলগুলো যেন আমার গলা চেপে ধরছিল। ভয়ে তোমাকে ঠেলা দিলাম, তবে তো ছাড়লে!

তিমির বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়—সুচিত্রার সামনে শুধু হাসে : তোমাকে পরখ করছিলাম।

মরে যাই কি না তাই!—সুচিত্রা হেসে জবাব দেয়।

তিমির হাসে। একটা গভীর রহস্যের ধোঁওয়ায় সে যেন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।

একটা নিদারুণ বিস্ময়!

অফিসে কাজের মধ্যে ডুবে থাকার চেষ্টা করে তিমির। কিন্তু তলিয়ে যেতে পারে না।

কাল রাতের অনুভূতি। একটা বরফের মতো প্রাণহীন ঠান্ডা হাত…..হিমশীতল স্পর্শ। সুচিত্রাকে খুন করতে গিয়েছিল সে…..সেই ঠান্ডা হাত। সুচিত্রা পেয়েছে সেই মৃত্যুর স্পর্শ। তার হাত ঠান্ডা নয়।

অসীমবাবু, শুনুন!—তিমির হঠাৎ ডেকে ওঠে।

কী বলছেন, স্যার?

কাছে আসুন।—হঠাৎ অসীমের হাতটা চেপে ধরে তিমির, ফিসফিসিয়ে বলে, আমার হাতটা বরফের মতো প্রাণহীন ঠান্ডা?

কী বলছেন?

বলুন, আমার হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা?

না, স্যার।

যান।—তিমির উত্তেজিত হয়ে হাতটা টেনে নেয়।

অসীম দু-পা এগিয়ে গিয়ে বলে, স্যার, একটা কথা বলব?

কী কথা?

অসীম একবার ভালো করে তাকায় তিমিরের দিকে : স্যার, কাল রাত্রে আপনার বাড়িতে কিছু হয়েছিল?

তিমির বিস্ময়ে মুখ তোলে। এক চূড়ান্ত আগ্রহে সমস্ত মনটা মাতাল হয়ে যায়। যথাসম্ভব গাম্ভীর্য রেখে বলে, কেন?

স্যার, ওই বাড়িটার একটা বদনাম আছে। বছরদুই আগে ওই বাড়িটা তৈরি করেন কলকাতার কোনও এক ভদ্রলোক। কী করতেন সঠিক জানা যায় না। মাঝে-মাঝে স্ত্রীসহ এসে থাকতেন। দুজনের মধ্যে অত্যন্ত সদ্ভাব ছিল। কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না। অন্তত আমরা কোনওদিন দেখিনি। হঠাৎ একদিন বিকেলে পুলিশ বাড়ি ঘেরাও করেছে শুনলাম। ছুটে গিয়ে শুনলাম, স্বামী আত্মহত্যা করেছে। ভদ্রমহিলার গলা কে যেন টিপে ধরেছিল। পুলিশ রিপোর্টে পরে জানা যায়, খুনি স্বয়ং তাঁর স্বামী। তারপর থেকে কেউই ওই বাড়িতে বাস করতে পারেনি। নানারকম অদ্ভুত জিনিস দেখা যায় বলে গুজব। অবশ্য আমি নিজে কোনওদিন দেখিনি।—অসীম হাসে স্যার, আমি বলছিলাম—বাড়িটা আপনি ছেড়ে দিন।

আচ্ছা, সে পরে দেখা যাবে।—তিমিরের স্বরটা চুপসানো বেলুনের মতো শোনাল। সমস্ত মাথাটা যেন ঝনঝন করছে। কাল রাত্রের ঘটনা…তাহলে…।

তিমির হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। সুচিত্রা একা আছে বাড়িতে। কোনও দুর্ঘটনা যদি ঘটে!

দূর থেকে দেখতে পায় তিমির, কে যেন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ট্রাউজার-পরা ছিপছিপে চেহারা। কে? হঠাৎ এখন?

জোরে পা চালায় তিমির। কড়া নাড়ে। একবার…দুবার…তিনবার…কড়া নাড়ছেই।

উঁচু গলায় চিৎকার করে ওঠে তিমির, সুচিত্রা! সুচিত্রা!

দরজা খুলে বলে সুচিত্রা, এত তাড়াতাড়ি এলে যে!

কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কোনও উত্তর নেই কেন?—তিমিরের স্বরে বিরক্তি।

কতবার দেখব? এই নিয়ে আটবার দরজা খুললাম।—সুচিত্রা বলে।

আটবার!—তিমির মুখ তোলে : একটু আগে কে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন মনে হল।

বিস্ময়ে মুখ তোলে সুচিত্রা : কী পাগলের মতো বকছ!

আমি নিজের চোখে দেখেছি।—দিশেহারা চিন্তায়, কেমন একটা উত্তেজনায় তিমির কাঁপতে থাকে। এক অসহায় উত্তেজনা।

সুচিত্রা মুখ তোলে। তিমিরের চোখ দুটো কেমন যেন অস্বাভাবিক লাল মনে হচ্ছে। কেমন যেন অপরিচিত।

কী বলছ তুমি! কেউ আসেনি। আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলব!

তিমিরের উত্তেজনা থার্মোমিটারের পারার মতো এগিয়ে চলেছে। সুচিত্রাকে সে যেন আর সহ্য করতে পারছে না। একটা পাশব প্রবৃত্তি কাঁপছে যেন তার মনে, চিন্তায়, দেহে।

তুমি অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?—একটা প্রচণ্ড ভয় সুচিত্রার গলাকে কাঁপিয়ে দেয়।

নিশ্চুপ তিমির। সুচিত্রার গলাটা কী লম্বা! কী সরু! দু-পা এগোয় তিমির।

হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ হয়, জোরে—ঝড়ের মতো।

সুচিত্রা প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে।

স্যার, আমি।—অসীম ঢোকে। মনে হয় সে যেন দৌড়ে এসেছে।

মুখ ফেরায় তিমির। সমস্ত শরীর অসম্ভব ঘেমে উঠেছে।

কী ব্যাপার, অসীমবাবু?—তিমির কথা বলে।

বলছি।—অসীম উত্তর দেয়।

তিমির সুচিত্রার দিকে তাকায় : আমার অফিসে কাজ করে।

অসীম হাতজোড় করে নমস্কার করে : আপনি বেরিয়ে আসার পরই আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। আপনার মুখ দেখে, কথা শুনে মনে হল, কী যেন ঘটেছে অথচ আপনি আমায় লুকোচ্ছেন। তা ছাড়া এর আগে এই বাড়িতে দুপুরে দুটো দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সুচিত্রা বিস্ময়ে মুখ তোলে।

তিমির বলে, পরে বলছি, তুমি অসীমবাবুর জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করো।

সুচিত্রা চলে যায়।

অসীমবাবু, আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। জানি না কীসের তাড়নায় আমি যেন একটা কিছু করে ফেলতাম। আপনাকে সব বলছি।

অসীম হাসে : আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। দুপুর এখানে মৃত্যু। এক নির্মম ঘটনার হাতছানি এখানকার দুপুরে মিশে আছে।

সুচিত্রা চা নিয়ে ঢোকে।

ওর ভয়টা কেটে গেছে।*

* নির্মলকুমার চক্রবর্তী নামে প্রকাশিত

মাসিক রহস্য পত্রিকা

জুন-জুলাই, ১৯৫৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *