2 of 3

দুজনেই মার সখী

দুজনেই মার সখী

প্রশ্ন করেছিলেন গিরিশ। ঠাকুর সেদিন বলরাম মন্দিরে ভক্তসঙ্গে ভাবাবেশে রয়েছেন। তারিখটা হলো ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দের ১২ এপ্রিল। গিরিশ, শ্রীম ও অন্যান্য ভক্তরা রয়েছেন। কথা বলতে বলতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হচ্ছেন। দেশ কাল বোধ চলে যাচ্ছে। অতি কষ্টে ভাবসম্বরণ করার চেষ্টা করছেন। ভাবে বলছেন : “এখনো তোমাদের দেখছি, কিন্তু বোধ হচ্ছে, যেন চিরকাল তোমরা বসে আছ—কখন এসেছ, কোথায় এসেছ এসব কিছুই মনে নেই।”

কোনরকমে নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে বলছেন : “জল খাব।” সমাধিভঙ্গের পর মন নামাবার জন্য ঠাকুর এইকথা প্রায়ই বলে থাকেন। গিরিশ নতুন আসছেন। এইসব দেখেননি, জানেন না, তাই জলের সন্ধানে ব্যস্ত হলেন। ঠাকুর বারণ করছেন, আর বলছেন : “না বাপু, এখন খেতে পারব না।”

প্রকৃতিস্থ ঠাকুর তখন নিজের মহাভাবের অলৌকিক অবস্থার কথা বর্ণনা করছেন। শেষে বলছেন : “আমার অবস্থা নজিরের জন্যে। তোমরা সংসার কর অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে, পাঁকাল মাছের মতো। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে, তবু গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।”

গিরিশ তখন হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলেন : “আপনারও তো বিয়ে আছে।” সঙ্গত প্রশ্ন। ঠাকুরের বিবাহের কি প্রয়োজন ছিল! কামিনী আর কাঞ্চন দুটির প্রতিই ঠাকুরের অসীম বিতৃষ্ণা। হাতে টাকা পড়লে আঙুল বেঁকে যায়। ঠাকুরের বর্ণনা—”সিঁথির মহিন্দর পাল পাঁচটি টাকা দিয়ে গিছল রামলালের কাছে। সে চলে গেলে পর রামলাল আমায় বললে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন দিয়েছে?’ রামলাল বললে, ‘এখানের জন্যে দিয়েছে।’ তখন মনে উঠতে লাগল যে, দুধের দেনা রয়েছে, নাহয় কতক শোধ দেওয়া যাবে। ওমা, রাত্রে শুয়ে আছি, হঠাৎ উঠে পড়লাম। একবার বুকের ভিতর বিল্লি আঁচড়াতে লাগল। তখন রামলালকে গিয়ে বললাম, ‘কাকে দিয়েছে? তোর খুড়িকে কি দিয়েছে?’ রামলাল বললে, ‘না, আপনার জন্য দিয়েছে।’ তখন বললাম, ‘না, এক্ষুণি টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আয়, তা নাহলে আমার শান্তি হবে না।”

কাঞ্চনে যাঁর আসক্তি নেই শুধু নয়, মুদ্রা স্পর্শ মাত্রে যাঁর হাত বেঁকে যায়, অন্যের কাছে তাঁর সেবায় দেওয়া অর্থ মাঝরাতে বেড়ালের মতো আঁচড়ায়, সেই ঠাকুর আমার সংসারী! সংসারীর জন্য তাঁর করুণা ঝরে পড়ত। তিনি আক্ষেপ করতেন : “বদ্ধজীবেরা সংসারে কামিনী কাঞ্চনে বদ্ধ হয়েছে, হাত-পা বাঁধা। আবার মনে করে যে, সংসারের ঐ কামিনী ও কাঞ্চনেতেই সুখ হবে, আর নির্ভয়ে থাকবে। জানে না যে ওতেই মৃত্যু হবে।” ঠাকুর বলতেন : “আমার সন্তানভাব।” নারী তাঁর চোখে জননী। তাহলে কেন বিবাহ করলেন? গিরিশের অতি সঙ্গত সাহসী প্রশ্ন।

সেই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর হাসতে হাসতে বলছেন : “সংস্কারের জন্য বিয়ে করতে হয়, কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে! গলায় পৈতে পরিয়ে দেয় আবার খুলে খুলে পড়ে যায়, সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে, শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল সংস্কারের জন্য। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল।”

ঠাকুরের কথায় সকলেই হাসলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন : “কামিনী কাঞ্চনই সংসার—ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

বিবাহ করবে সংসারীও হবে; কিন্তু থাকবে কিভাবে? সেই শিক্ষাটুকুও তো দিতে হবে গুরুর গুরু জগদ্‌গুরু অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে। শুধু মুখের উপদেশ নয়—আপনি আচরি ধর্ম। শ্রীশ্রীমা একদিন মৃদু প্রশ্ন করেছিলেন। বিবাহের অনেক বছর পরে। মা তখন যুবতী, প্রশ্নটা সরাসরি—”আমি তোমার কে?” ঠাকুর তখন মহাভাবে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন— “আনন্দময়ী।”

মা আনন্দময়ী। শ্রীশ্রীমা ঠাকুরের পায়ে হাত বুলিয়ে দেন। ঠাকুর বলছেন : “পায়ে হাত বুলায়ে দেয়, তারপর আমি আবার নমস্কার করি।”

এইভাবে সাধারণ সংসারীরও হতে পারে, যদি তাঁরা ঠাকুরের ভাবটি ধারণ করেন। সহধর্মিণী সেবাদাসী নয়, ভোগ্যা নয়, তিনি আনন্দময়ী। মাতৃস্বরূপা। শক্তিরূপিণী। বিদ্যার সংসারে এই ভাবই খেলে। বিদ্যার সংসার হয় কিভাবে? ঠাকুর বলছেন : “ঈশ্বরলাভের পর যে সংসার, সে বিদ্যার সংসার। কামিনী- কাঞ্চন তাতে নাই। কেবল ভক্তি ভক্ত আর ভগবান। আমারও মাগ আছে, ঘরে ঘটিবাটিও আছে, হরে প্যালাদের খাইয়ে দিই, আবার যখন হাবীর মা এরা আসে, এদের জন্যেও ভাবি।”

অবতারপুরুষের সংসারচিত্রটি বড় মধুর। ঠাকুরের বয়স তখন বাইশ কি তেইশ, শ্রীশ্রীমা তখন ছ-বছরের বালিকা। বিবাহ হলো। কেন বিবাহ! ঠাকুর বলছেন : “সকলে বললে, পাগল হলো, তাই তো এরা বিবাহ দিলে। উন্মাদ অবস্থা, প্রথম চিন্তা হলো, পরিবারও এইরূপ থাকবে, খাবে-দাবে।”

তিনি জগজ্জননী হবেন। ঠাকুর তাঁকে সেবা শেখাবেন, জ্ঞান দেবেন, তাঁর ভাবাদর্শ ধারণের শক্তি দেবেন। সন্তান নয়, ঠাকুরকে ধারণের জন্যে তিনি জননী হবেন। রামকৃষ্ণ-দীপাধারে তিনি হবেন তৈল, শিখা নরেন্দ্রনাথ

মায়ের স্থান হলো নহবতে। একটি, দুটি সন্তান তো নয়, আবিশ্ব ভক্তমণ্ডলীর জননী তিনি। মা নহবতে থাকতেন, অনেক সময় জানাই যেত না, তিনি আছেন। নীরব সেবিকা। বোঝা যেত তখনই যখন নহবত থেকে ভক্তদের জন্যে আসত রুটি, ছোলার ডাল। নহবত থেকে মাঝে মাঝে আসতেন ঠাকুরের কাছে, তাঁর সেবায়। ঠাকুর বলেইছেন, আমার সন্তান ভাব। আবার সর্বদাই ভাবে বিভোর। কে দেখবে তাঁকে! তিনি মায়ের ওপর কতটা নির্ভর করতেন, বোঝা যায় তাঁর এই উক্তিতে—”উঃ, আমার কি অবস্থা গেছে! মন অখণ্ডে লয় হয়ে যেত! এমন কত দিন! সব ভক্তি-ভক্ত ত্যাগ করলুম! জড় হলুম দেখলুম মাথাটা নিরাকার, প্রাণ যায় যায়। রামলালের খুড়িকে ডাকব মনে করলুম!” আশ্চর্য নয়! অমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় ঠাকুর কাকে ডাকতে চাইছেন। শ্ৰীশ্ৰীমাকে!

আমার আত্মভোলা, জগৎভোলা ঠাকুরের সুমিষ্ট একটা দাম্পত্যজীবনও ছিল। তার চিত্র ধরা আছে এই কথায়—”আমি একজায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়িকে জিজ্ঞাসা করাতে বারণ করলে। আর যাওয়া হলো না।” পরেই ঠাকুর মন্তব্য জুড়েছেন—”উঃ, আমি সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগী, তাতেই এই! সংসারীরা না জানি পরিবারদের কাছে কিরকম বশ!”

রামকৃষ্ণ-সেবিকা মা সারদা। একটি কথায় ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পরিষ্কার। কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর বলেছেন—প্রসঙ্গটা ছিল ইন্দ্রিয় ও জিতেন্দ্রিয়—”তা নাহলে পরিবারকে আট মাস কাছে এনে রেখেছিলাম কেমন করে? দুজনেই মার সখী।” আর তো কিছু ভাবা যায় না! এ-লীলা কেমন লীলা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *